সাত
‘চিৎ ইয়া পৎ…….হু র্ র্ র্ ইয়াঃ। খোদা যিসকো দেগা উসকো ছপ্পর ভরকে দেগা, যিসকো নেহি দেগা উসকো রোনা মাৎ। লা ইলাহা ইল্লিল্লা ইল্লা রসুল্লাহা।’ বলেই আর্চ করার ভঙ্গিতে একটা ডিগবাজি খেয়ে শিরদাঁড়া টন করে বল্লমটা ওপরে তুলে আবার চিৎকার করে উঠল, আল্লা হো আকবর্ র্ র্। খোদা বঢ়ি মেহেরবান।
দিঘা সৈকতে ভ্রাম্যমাণ জনতার উৎসুক চোখের দিকে তাকিয়ে একটু হেসে সে আবার বলল, যো চলা যায়েগা, ও কভি নেহি আপস আয়েগা। যো আয়েগা ও জিয়েগা নেহি। জিয়েগা তো জিন্দগিভর জিয়েগা, নেহি জিয়েগা তো ক্যা কিয়েগা? দুর্গামায়ী বাচাকা রাখা, দুর্গামায়ী বাচাকা রাখা। সীতারাম ঝটপট। যার কাছে যা কিছু আছে চটপট দিয়ে দিন। সীতারাম ঝটপট কব্ তক্ খাড়া রহেগা? বলেই হাত পেতে ভিড়ের ভেতর দিয়ে এগোতে লাগল।
লোকটার যে কী জাত, তা কেউ জানে না। হিন্দু না মুসলিম না খ্রিস্টান, তাও জানে না কেউ। কী যে ওর ভাষা তাও তো রহস্যময়। মুখে বলবে সীতারাম ঝটপট। নাম জিজ্ঞেস করলে বলবে, আমার নাম অ্যান্টনি। শ্রীমান অ্যান্টনি ধিড়িঙ্গি। বোঝ। একটা আধবুড়ো লোক নামের আগে শ্রীমান বলবে, সারনেম বলবে ধিড়িঙ্গি। ধিড়িঙ্গি কি কারও পদবি হয়? কে জানে? কেউ বলে ছিটিয়াল, কেউ বলে পাগল, কেউ বলে বহুরূপী, কেউ বলে গুপ্তচর। আবার কেউ বা বলে বদের ধাড়ি। বেশটি করে ধরে চাক্কালে তবে গায়ের রাগ যায়। কিন্তু যে যাই বলুক ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের কাছে এই লোকটি অত্যন্ত আদরের। ওকে আসতে দেখলে ছোটদের আনন্দের আর অবধি থাকে না। লোকটি হাত পেতে পয়সা নিতে নিতে ভিড় ঠেলে বাজারের দিকে এগিয়ে চলল।
এমন সময় কে যেন একজন ভিড়ের ভেতর থেকে চেঁচিয়ে বলল, হেই ব্রেনলেশ সীতারাম অ্যান্টনি! এই পাগলা! হোয়ার আর ইউ গোয়িং? লোকটি ঘুরে তাকিয়েই রাগে থর থর করে কাঁপতে লাগল। ক্রুদ্ধ স্বরে বলল, আমার নাম অ্যাস্টনি ধিড়িঙ্গি নইকো ট্যাস্ নই ফিরিঙ্গি,
যে আমায় পাগল বলবে—
তার কথায় কি দুনিয়া চলবে? কিসিসে দোস্তি কভি তো নয় ইউ আর অল শূকর-তনয়।
যে লোকটি ভিড়ের ভেতর থেকে অ্যান্টনিকে পাগলা বলে ডেকেছিল, এখন গালাগালি খেয়ে লোকটি ছুটে এসে আক্রমণ করল ওকে। অ্যান্টনির গালে একটা চড় মেরে বলল, তুই আমায় গালাগালি দিলি কেন?
অ্যান্টনিও আক্রমণের জবাবে লোকটিকে পালটা আক্রমণ করে একেবারে ধরাশায়ী করে ফেলল। এবার চলল দু’জনের ধুলোয় লুটোপুটি। লোকটির চোয়াল এক হাতে শক্ত করে টিপে অ্যান্টনি বলল, তোদের যার যা ইচ্ছে সে তাই বলে যাবি আর আমি মুখবুজে সহ্য করে যাব দিনের পর দিন তাই না?
গোলমাল আরও গড়াত। স্থানীয় কিছু লোকজন এসে ছাড়িয়ে দিল তাই রক্ষে। যে লোকটিকে অ্যান্টনি ধরাশায়ী করেছিল সে লোকটি উঠে দাঁড়িয়ে গায়ের ধুলো ঝেড়ে অ্যান্টনিকে গালাগালি দিতে দিতে চলে গেল।
অ্যান্টনিও হাতের বল্লমটা একবার শূন্যে নিক্ষেপ করে পরক্ষণেই সেটাকে
লুফে নিয়ে সুর করে বলল, ল্যাংড়া-খোঁড়া নাচার বাবা মুঝে এক পয়সা দো…। অসমঞ্জবাবুর এমন দুঃখের দিনেও হাসি পেল। এতক্ষণ স্ত্রীর খোঁজে পথে বেরিয়ে লোকটির কাণ্ডকারখানা দেখছিলেন। এবার সঙ্গের সাদা পোশাকের পুলিশ অফিসারকে বললেন, এ লোকটি কে বলুন তো?
তা জানি না। তবে লোকটি অনেকদিন ধরেই এখানে আছে। কতদিন?
এই ধরুন বছর পনেরো।
থাকে কোথায়।
এর কোনও নির্দিষ্ট ঠিকানা নেই। আজ এখানে, কাল ওখানে, পরশু সেখানে। ভিক্ষে করে যা পয়সা পায় তাতেই কোনওরকমে দিন কাটায়।
লোকটাকে একটু নজরে রাখবেন।
কেন স্যার, ও আমাদের পরিচিত। কোনও সন্দেহভাজন কেউ নয়। দিঘা ছেড়ে বড় একটা যায়ও না কোথাও।
ওই লোকটাকে চিৎ করে ফেলে ওর বুকে ওঠার টেকনিক দেখলেন? অসীম শক্তি ওর দেহে। লক্ষণ ভাল বুঝছি না। এইসব পাগল-ছাগল মার্কা লোকেরাই অনেক সময় বিভিন্ন দলের হয়ে কাজ করে। তাই বলছি ওর গতিবিধির ওপর একটু নজর রাখবেন।
অসমঞ্জবাবু কথা বলতে বলতেই একটা সিগারেট ধরালেন। এমন সময় দু’জন সার্জেন্ট এসে নমস্কার জানিয়ে বলল, না স্যার। কোনও হদিসই পাওয়া গেল না। তবে আপনার হোটেলের বেয়ারা যে রকম গাড়ির কথা বলছে, ওই রকম একটি গাড়িকে অবশ্য কিয়াগেড়িয়া চেকপোস্টে দেখা গেছে। সেটি এখন সীমান্তের ওপারে। ওড়িশার পুলিশকে আমরা নজর রাখতে বলেছি। তবে ওরা যদি একটু তৎপর হয় তো একটা বিহিত হতে পারে।
অসমঞ্জবাবু বললেন, হুম। ওদের আর কখনও ফিরে পাব এমন আশা আমি মনের মধ্যে রাখি না, তবুও বলি এখানকার সমস্ত নামকরা ক্রিমিন্যালগুলোকে এক এক করে অ্যারেস্ট করুন এবং তাদের মুখ থেকে কথা বার করার চেষ্টা করুন।
সে কাজ অনেক আগেই শুরু করে দিয়েছি আমরা। এবং কয়েকজনকে পাকড়াও করে জিজ্ঞাসাবাদও চলছে।
অসমঞ্জবাবুর বুক থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল। একসঙ্গে স্ত্রী-পুত্র দু’জনকেই হারালেন তিনি। সুজাতাদেবী যে কার সঙ্গে কোথায় গেলেন, বা যেতে পারেন, তা কিছুতেই অনুমান করতে পারলেন না। এবং এখনও পর্যন্ত যখন তাঁর ফিরে আসার কোনও খবর নেই, তখন ধরেই নেওয়া যেতে পারে যে, তাঁকেও অপহরণ করা হয়েছে।
এ খবরও চাপা রইল না। বাতাসের আগে দিঘার সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ল। আবার হই হই পড়ে গেল চারদিকে।
এরই মধ্যে সমুদ্রের বুকে সূর্যাস্ত হল। অসমঞ্জবাবু সাদা পোশাকের পুলিশ অফিসারকে সঙ্গে নিয়েই আবার হোটেলে ফিরে এলেন। এখন বার বারই তাঁর মনে হতে লাগল সেই কুখ্যাত গুন্ডা রূপেনকে ছেড়ে দিয়ে সত্যিই তিনি কোনও ভুল করলেন কি না? এটা কি ওদের কোনও নাটকীয় চাল? দেখাই যাক। লোকটার তো সন্ধের পর আসবার কথা আছে। যদি না আসে তা হলে ধরে নিতে হবে এ ওদেরই কাজ। এবং তখন তাঁর নিজের ভুলের মাশুল নিজেকেই দিতে হবে।
রূপেন যেরকম কথা দিয়েছিল, ঠিক সেইরকম সময়েই সন্ধ্যার অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়ে লুকিয়ে এল। অবশ্য ও একা নয়। সঙ্গে সুখেনও।
অসমঞ্জবাবুর তখন উদ্ভ্রান্তের মতো অবস্থা। ওদের দু’জনকে দেখেই জলমগ্ন ব্যক্তি যেমন হাতের কাছে কোনও কিছু পেলে তাই ধরে ওঠবার চেষ্টা করে, ঠিক সেইভাবেই ওদের দু’জনকে চেপে ধরলেন। দু’জনের দুটি হাত ধরে বললেন, আমি তোমাদের জন্যেই অপেক্ষা করছিলাম। একমাত্র তোমরাই পারবে আমার স্ত্রী-পুত্রকে উদ্ধার করতে। কেন না তোমরা চিরকাল অসৎ পথে ছিলে। তাই খারাপ লোকেদের গোপন ঘাঁটিগুলো তোমাদের অজানা নয়। তোমরা চারদিক ছুঁড়ে ফেলো। আমি আমার পুলিশবাহিনী দিয়ে যতদূর পারব সাহায্য করব। তা ছাড়া আমি নিজে তো চেষ্টা করবই। যেভাবেই হোক জীবিত অথবা মৃত ওদের উদ্ধার করতেই হবে।
রূপেন বলল, ব্যাপারটা খুবই রহস্যময় স্যার। কেন না আমাদের ধারণা আপনার ছেলেকে অপহরণ করার উদ্দেশ্য ওদের ছিল না। যে পরিবেশে ছেলেটিকে আমরা দেখেছি বা তার সঙ্গে কথা বলেছি, সেই পরিবেশে কুকুরের তাড়া খেয়ে পালাবার সময় হঠাৎ চোখের পলকে ছেলেটিকে গুম করাটা নেহাতই অঘটন ছাড়া কিছু নয়।
সুখেন বলল, বিশেষ করে ছেলেটি যে বালিয়াড়ির ওইখানেই আসবে, সেটা তো অপহরণকারীদের আগে থেকে জানবার কথা নয়।
তা ঠিক। কিন্তু টারগেট যদি না-থাকবে তা হলে ওরা কীসের স্বার্থে আমার স্ত্রী-পুত্রকে অপহরণ করল? সবচেয়ে আশ্চর্য এই, অপহরণের আগে বা পরে কোনও ভীতি প্রদর্শনের ব্যাপার ঘটেনি। কোনও ব্ল্যাকমেলের হুমকি আসেনি। কেউ কোনও টাকাকড়ি বা সোনাদানাও চায়নি। তবে কেন? কেন ওরা এইভাবে লুকিয়ে রাখল ওদের?
রূপেন ও সুখেন বলল, আপনি অত বেশি ভাববেন না। যা হবার তা তো হয়ে গেছে। এখন আমরা দু’জনে যখন ফিল্ডে নেমেছি তখন আমাদের কিছু করতে দিন। রীতিমতো শেরিফ বদমাস ছাড়া আমাদের মুখের গ্রাস কেড়ে নিতে আসবার মতো দুঃসাহস কারও হবে না। আমরা বুঝতে পারছি, এ আমাদেরই প্রধান শত্রু মি. জ্যাঙ্গোর কাজ।
কী বললে? কী নাম? জ্যাঙ্গো!
হ্যাঁ। জগজিৎ সিং জ্যাঙ্গো। একজন ইন্টারন্যাশনাল স্মাগলার। এবং এদেশের বহু নারী-শিশুর হত্যাকারী ও একাধিক ব্যাঙ্ক ডাকাতির নায়ক। আমরা জ্যাঙ্গোরই দলের লোক। আজ রাতেই আমরা ওর ঘাঁটি আক্রমণ করব। অবশ্য এর জন্য যা দরকার তা আপনাকে দিতে হবে। কী চাও তোমরা?
দল থেকে বেরিয়ে আসার সময় যা আমরা খুইয়েছি। অর্থাৎ দুটো প্ৰচণ্ড শক্তিশালী রিভলভার।
বেশ, পাবে। তোমরা বোসো! আমি ব্যবস্থা করছি।
অসমঞ্জবাবু ওদের বসিয়ে বাথরুমসংলগ্ন পাশের ঘরে এলেন। সেখানে দু’জন সাদা পোশাকের পুলিশ ওদের জন্য অপেক্ষা করছিল। তারা আদেশের অপেক্ষায় অসমঞ্জবাবুর চোখের দিকে তাকাতেই উনি বললেন, লোকদুটোকে দেখে তো মনে হচ্ছে, ওরা সত্যি সত্যিই আমাদের সঙ্গে সহযোগিতা করতে চায়। কিন্তু তবুও এটা ওদের একটা হল হতে পারে। এই টোপ ফেলেই ওরা হয়তো আমাকে ওদের ঘাঁটিতে নিয়ে যেতে চায়। কাজেই আমি ওদের সঙ্গে এগোতে থাকলে তোমরা দূর থেকে নিঃশব্দে আমাকে অনুসরণ করবে। আপাতত দুটো রিভলভার চাই।
ওরা বলল, পাবেন। আমরা জানতাম এগুলো লাগবে। শুধু রিভলভার কেন, অন্যান্য আগ্নেয়াস্ত্রও আমাদের হাতের কাছেই মজুত রেখেছি। মি. কাঞ্জিলালও দশ-বারো জন সাদা পোশাকের পুলিশ নিয়ে বাইরে লুকিয়ে আছেন। আপনারা বাইরে বেরোলেই ওঁরা আপনাদের ফলো করবেন।
থ্যাঙ্কস। বলে দুটো রিভলভার নিয়ে পাশের ঘরে গিয়ে, রূপেন-সুখেনের হাতে তুলে দিলেন।
রূপেন ও সুখেন সে দুটি হাতে নিয়ে বলল, ভগবানের কসম। ওই শয়তান জ্যাঙ্গোকে আমরা এইবার দেখে নেব। আশা করি আপনার স্ত্রী-পুত্রকে ওদের ঘাঁটি থেকে উদ্ধার করে আনতে পারব আমরা।
বেশ, যদি পারো তা হলে আমিও কথা দিলাম, তোমাদের পূর্বকৃত অপরাধের বোঝা আইনের চোখে যতটা হালকা করানো যায় তার চেষ্টা করব।
রূপেন ও সুখেন রিভলভারদুটোকে একবার চুমু খেয়ে বলল, ঠিক আছে। তা হলে আমরা চলি স্যার।
অসমঞ্জবাবু বললেন, আমিও তোমাদের সঙ্গে যাব।
শুধু শুধু কেন বিপদ বাড়াতে যাচ্ছেন? আগে আমাদের যেতে দিন। আমরা গোপন পথ ধরে অতি সন্তর্পণে যাব। সহসা কোনও বিপদে পড়লে পালাবার রাস্তা জানি। কিন্তু আপনি থাকলে আমাদেরও অসুবিধে হতে পারে। আমি যাব।
রূপেন ও সুখেন পরস্পরের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখল একবার! তারপর বলল, আপনি কি আমাদের বিশ্বাস করতে পারছেন না?
পারছি বইকী। না-পারলে কী ও-দুটো তোমাদের হাতে তুলে দিতাম?
আসতে চাইলে আমদের আ ত্তির কিছু নেই। তবে এখনও বলছি, যে শত্রুর মোকাবিলা আমরা করতে চলেছি, তাতে আপনার অন্তত না-আসাই উচিত।
বুঝলাম, কিন্তু তোমরা যদি ওই শত্রুর মোকাবিলা করতে গিয়ে কোনও বিপদে পড়, তখন তোমাদের রক্ষা করার জন্যও আমার থাকার দরকার নয় কি? অসমঞ্জবাবু তৈরি হয়েই ছিলেন। তবুও যাবার আগে একবার বাথরুম যাবার অছিলায় পাশের ঘরে গিয়ে সেই দুই পুলিশকে চোখ টিপে ইশারা করলেন। তারপর ঘর থেকে বেরিয়ে এসে যেইনা রাস্তায় পা দিতে যাবেন, অমনি এক ধাক্কায় ছিটকে পড়লেন একদিকে। আর সঙ্গে সঙ্গে শুনতে পেলেন প্রচণ্ড একটা বিস্ফোরণের শব্দ। চারদিক ধোঁয়ায় ধোঁয়াচ্ছন্ন। বিস্ময়ের ঘোর কাটতেই এবং ধোঁয়াটা হালকা হতেই দেখতে পেলেন রূপেন পনেরো-ষোলো বছরের একটি ছেলের জামার কলার টিপে ধরেছে। ছেলেটির নিতান্তই দৈন্য দশা।
রূপেন ঠাস করে ওর গালে একটা চড় মারল।
ছেলেটি মার খাওয়া রুগ্ন কুকুরের মতো তাকিয়ে রইল ওর দিকে। মুখে একটু গোঁ গোঁ শব্দ করল শুধু। বোঝাই গেল ছেলেটি বোবা।
রূপেন বলল, কাকে মারবার জন্যে ওটা ছুড়েছিলি? আমাকে, না ওই বাবুকে? ছেলেটি কথা বলল না। ভয়ে কাঁপতে লাগল। বল শিগগির?
আবার সেই গোঁ গোঁ শব্দ।
রূপেন অসমঞ্জবাবুকে বলল, আমরা যে এখানে আছি ওরা তা হলে টের পেয়েছে। বেশ রীতিমতো নজরদারি করছে আমাদের ওপর। এবং সেই জন্যেই নিজেরা না–এসে এই নির্বোধ বোবাটাকে পাঠিয়েছে আমাদের ওপর বোম চার্জ করবার জন্য। ভাগ্যে ওটা ফসকে অন্যদিকের দেওয়ালে লেগেছে। না হলে সর্বনাশ হয়ে যেত।
অসমঞ্জবাবুর কপালের একটা পাশ কেটে গল গল করে রক্ত ঝরছে। অসমঞ্জবাবু রুমাল দিয়ে সেটাকে চেপে ধরলেন।
সুখেন বললেন, আপনার এই অবস্থার জন্য আমি দুঃখিত। কিন্তু আমি ওকে দেখতে পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আপনাকে ঠেলে না-দিলে আপনার জীবন বিপন্ন হতে পারত।
অসমঞ্জবাবু হেসে বললেন, তোমার উপস্থিত বুদ্ধির জন্য ধন্যবাদ। রূপেন বলল, এখনও ভেবে দেখুন কী করবেন?
আমি যাব। কারণ ওরা শুধু তোমাদের শত্রু নয়। আমারও। আমার স্ত্রী-পুত্রকে
ওরা চুরি করে থাকুক, বা না-থাকুক, ওরা আমার প্রাণনাশের চেষ্টা তো কণোছেল। তা হলেই বুঝছেন, ওদের ঘাঁটিতে পৌঁছতে হলে আমাদের একটু অন্যভাবে যেতে হবে।
হ্যাঁ। তোমরা যে আমাদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছ এবং আমরা যে, ওদের আক্রমণ করব এটা ওরা জেনেই গেছে। তাই আমরা দলবল নিয়ে হই হই করে ওখানে যাব না। কারণ যদি ওরা সত্য সত্যই আমার স্ত্রী-পুত্রকে লুকিয়ে রেখে থাকে তা হলে ওরা ওদের ক্ষতি করে ফেলবে।
অসমঞ্জবাবু হঠাৎ রূপেনের পেটের কাছে রিভলভার ঠেকিয়ে বললেন, তা হলে ইউ আর আন্ডার অ্যারেস্ট।
রূপেন এবং সুখেন দু’জনেই ঘাবড়ে গেল।
অসমঞ্জবাবু চাপা গলায় বললেন, সুখেন, এই সুযোগ। তুমি দৌড়ে পালাও এখান থেকে। যেভাবেই হোক আবার ওদের ঘাঁটিতে ফিরে গিয়ে দোস্তি করার চেষ্টা করো ওদের সঙ্গে। যাতে ওরা ধারণা করে আমরা তোমাদের অবিশ্বাস করে গ্রেপ্তার করেছি এবং তুমি পালিয়ে বেঁচেছ। ওরা অবশ্য এত সহজে তোমাকে বিশ্বাস করছে চাইবে না বা দলে নেবে না। তবুও তুমি ফিরে গিয়ে এমন নাটক করো, যাতে ওরা আপাতত আমাদের এখান থেকে নজর উঠিয়ে নেয়।
কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গেই সুখেন ছুটে গিয়ে রাস্তার এক পাশে রাখা নিজের মোটর বাইকটায় চেপে বসল এবং পরক্ষণেই ঝড়ের বেগে উধাও হয়ে গেল সেখান থেকে।
অসমঞ্জবাবু তখনও সেই একই ভাবে রিভলভারের নলটা রূপেনের পেটের কাছে ধরে রইলেন। তারপর এক চোখ টিপে তাকে আরও একবার বুঝিয়ে দিলেন এ সবই নক্সা। যদি নজর দেবার আরও কোনও লোক নিযুক্ত থাকে তো সে দেখুক রূপেন অ্যারেস্ট হয়েছে।
অসমঞ্জবাবু বললেন, এই কে আছ হাতকড়া লাগাও।
সঙ্গে সঙ্গে দু’জন সাদা পোশাকের পুলিশ এসে শক্ত করে ধরে ফেলল রূপেনকে এবং একজন সেই হাবাটাকে।
একটু পরেই ফোনে খবর পেয়ে পুলিশের গাড়ি এল।
ওঁরা সকলেই সেই গাড়িতে চেপে থানাতে চললেন।
রূপেনকে এবং সেই হাবা ছেলেটিকে লকআপেই রাখা
হল।
অসমঞ্জবাবু রূপেনকে বললেন, এই রকম একটু অভিনয় করা ছাড়া আপাতত আর কোনও উপায় দেখলাম না।
ভাল করেছেন। কিন্তু বেচারা সুখেন, ও যদি কোনও বিপদে পড়ে? একা গেল বেচারা।
মনে হয় বিপদে পড়বে না। কেন না আমি যা বুঝেছি তা হল, ও অত্যন্ত চতুর এবং সতর্ক। ও জানত আমরা যে কোনও সময় আক্রান্ত হতে পারি। এবং জানত বলেই একটা অঘটন ঘটে যাবার আগেই আমাকে ঠেলে সরিয়ে দেয়। যাক, এবার দেখি এই ছেলেটার কাছ থেকে কোনও কিছু জানতে পারি কি না।
সুখেন বলল, বৃথা চেষ্টা করবেন না স্যার। আমি ওকে জানি। মেরে ফেললেও ও একটি কথাও বলবে না আপনাকে।
ওদের কোনও গোপন তথ্য আমি তো জানতে চাই না। সেজন্য তোমরা আছ। আমি শুধু জানতে চাইব আমার স্ত্রী-পুত্র ওদের হেফাজতে আছে কি না। দেখুন চেষ্টা করে।
প্রয়োজন হলে ইলেকট্রিকের শক খাওয়াব ব্যাটাকে।
অসমঞ্জবাবু ধীর ধীরে ছেলেটির দিকে এগিয়ে গেলেন। তারপর বেশ তৈরি তবু বললেন, কতদিন আছিস এ-লাইনে?
হয়ে একটি আলাদা ঘরে নিয়ে গেলেন তাকে। ছেলেটিকে বললেন, তুই বোবা? ছেলেটি হ্যাঁ বা না কিছুই বলল না। ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে রইল শুধু। অসমঞ্জবাবু জানেন হাবা-বোবারা কানেও শুনতে পায় না।
এবারও কিছু বলল না ছেলেটি। মানে বলবার চেষ্টা করল না। অর্থাৎ কথা তো বলতে পারে না, একটু ঘাড়ও নাড়ল না।
অসমঞ্জবাবু এবার আদর করার ছলে ছেলেটিকে কাছে টেনে নিয়ে বললেন, তুই যদি আমায় সাহায্য করিস তা হলে আমি তোকে কিচ্ছুটি বলব না। আমি পুলিশের লোক। আমাকে সাহায্য করলে তোর ভাল হবে। করবি তো? ছেলেটি নীরব।
আমার মনে হচ্ছে তুই অসহায় একটি ছেলে। জন্মবোবা নোস। তোর মা-বাবা কে তাও বোধহয় তুই জানিস না। ওরা তোকে নিশ্চয়ই খুব ছোটবেলায় কোথাও থেকে চুরি করে এনেছিল। এবং নিশ্চয়ই কোনও ওষুধের দ্বারা অথবা ইঞ্জেকশান দিয়ে তোকে বোবা করে রেখেছে। তুই যদি আমার কথার উত্তর দিস তা হলে, আমি বড় ডাক্তার দেখিয়ে তোকে ভাল করে তুলব। আমার কথার উত্তর দিবি তো?
ছেলেটি এবার হাসিমুখে ঘাড় নাড়ল।
আমার ছেলে, আমার বউ কোথায় আছে তুই জানিস?
ছেলেটি ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ বলল।
তুই তাদের দেখেছিস?
ছেলেটি আবার ঘাড় নাড়ল।
অসমঞ্জবাবু বললেন, আমি যদি চাই তুই আমাকে সাবধানে নিয়ে যেতে পারবি সেখানে?
ছেলেটি ঘাড় নেড়ে সম্মতি জান ।
আমি এখনই যাব।
অসমঞ্জবাবু আসবার আগে আর একবার রূপেনের সঙ্গে দেখা করলেন।
বললেন, আমি ছেলেটির সঙ্গে যাচ্ছি। তুমিও মেকআপ নিয়ে ছদ্মবেশে সুখেনের খোঁজে যাও। চুপচাপ বসে থাকার একদম সময় নেই।
রূপেন বলল, সে আমি তৈরি হয়ে নিচ্ছি। তবে আপনি কিন্তু ওই বিচ্ছুটার সঙ্গে খুব সাবধানে যাবেন। ওকে একদম বিশ্বাস করবেন না। বলো কী?
হ্যাঁ। হয়তো আগাগোড়া ঘাড় নেড়ে সবই আপনাকে মিথ্যে বলেছে।
অসমঞ্জবাবু ছেলেটিকে সঙ্গে নিয়ে অন্ধকারে ওরই নির্দেশিত পথে বালিয়াড়িতে এসে নামলেন। তারপর সমুদ্রসৈকত ধরে এগিয়ে চললেন চন্দনেশ্বরের দিকে। বেশ খানিকটা যাবার পর একসময় অনুভব করলেন কে বা কারা যেন অনুসরণ করছে তাঁকে! হয়তো দিঘা-পুলিশ নিরাপত্তার জন্য পিছু নিয়েছে তাঁর। কিন্তু না। সে ভুল ভাঙল যখন জোড়া জোড়া টর্চের আলো তাঁর সর্বাঙ্গে এসে পড়ল। অসমঞ্জবাবু থমকে দাঁড়ালেন! আর সঙ্গে সঙ্গে ওদিক থেকে আগ্নেয়াস্ত্র গর্জে উঠল গুড়ুম।
বোবা ছেলেটি রক্তাক্ত কলেবরে লুটিয়ে পড়ল বালুচরে।
অমনি অন্ধকার বিদীর্ণ করে ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি গিয়ে বিদ্ধ করল আততায়ীদের। সম্ভবত এগুলো পুলিশের গুলি। অসমঞ্জবাবু নিজেও গুলি চালাতে গেলেন। কিন্তু পারলেন না। ততক্ষণে আততায়ীদের একটি বুলেট এসে বিদ্ধ করেছে তাঁকে। তাঁর হাতের রিভলভার ছিটকে পড়ল সমুদ্রের জলে। তিনিও বালুচরে লুটিয়ে পড়লেন। সাদা পোশাকের পুলিশরা হই হই করে ছুটে এল তাঁর দিকে।
বাপ্পার যখন জ্ঞান ফিরল তখন দেখল একটি অন্ধকার স্যাঁৎসেঁতে ঘরে শুয়ে আছে সে। ঘরের ওপর দিক থেকে ভেন্টিলেটারের ফাঁক দিয়ে সামান্য একটু রোদের ছটা দেখা যাচ্ছে। এই দেখে মনে হয় ও কোনও আন্ডারগ্রাউন্ডে আছে। ওর মাথার কাছে বসে বসে বিড়ি টানছে ওরই মতো দুটো ছেলে। বাপ্পা ক্ষীণস্বরে বলল, আমি কোথায়?
ছেলে দুটি খিল খিল করে হেসে উঠল একবার। তারপর ওর দিকে মিটিমিটি চোখে তাকিয়ে একজন অপরজনকে বলল, চালু পুরিয়া রে। এতক্ষণ কেমন চুপচাপ শুয়ে ঘুমোচ্ছিল। এখন ন্যাকার মতো জিজ্ঞেস করছে, আমি কোথায়? কী বলি বল তো?