দিঘা সৈকতে আতঙ্ক – ৬

ছয়

এদিকে স্থানীয় পুলিশ তো বিভিন্ন সূত্র ধরে চারদিকে পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে তদন্ত শুরু করল। জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষে চলল জোর তল্লাশি। অসমঞ্জবাবু নিজে একজন গোয়েন্দা হয়েও ঘটনাটা কীভাবে কী ঘটে গেল তার বিন্দুমাত্র আঁচ করতে পারলেন না। অবশ্য দোষও নেই। একদিকে স্ত্রীর ওই অবস্থা, অন্যদিকে নিজেও পুত্রশোকাতুর। যত বেশি ভাবেন, যত বেশি চিন্তা করেন, ততই হতাশ হন। সাধারণ বুদ্ধিমত্তাও যেন হারিয়ে ফেলেন মাঝে মাঝে।

বাপ্পার অন্তর্ধান রহস্য তাঁকে একদিকে যেমন ভাবিয়ে তুলল, অপরদিকে তেমনি বিস্মিতও করল। কেন না এইসব ক্ষেত্রে সাধারণত যা হয়, বাপ্পার বেলায় তা হল না। ছেলেটাকে নিয়ে যাবার পর এতখানি সময় পার হয়ে গেল, অথচ ছেলেটার মুক্তিপণ দাবি করে কেউ কোনও চাপ সৃষ্টি করল না। বিশেষ করে ছেলেটা যখন টাকা-পয়সা বা সোনার গয়না নয় যে, একবার হারিয়ে গেলে আর ফেরত আসবে না। আসলে ছেলেটা তো ছেলেই। কাজেই ছেলেটাকে যদি কেউ অপহরণ করে থাকে, তা হলে তাকে আটকে রেখে অসম্ভব রকমের কোনও একটা প্রস্তাব নিয়ে কেউ-না-কেউ চিঠিপত্তর দেবেই। কিন্তু না। এক্ষেত্রে তা হল না। কোনও দাবিদারই এগিয়ে এল না তার সীমাহীন কোনও চাহিদা নিয়ে।

অসমঞ্জবাবুকে এই ব্যাপারটাই সবচেয়ে বেশি পীড়া দিল। বাপ্পাকে কিডন্যাপ করে কেউ যদি তার কোনও দাবি পেশ না করে, তা হলে কী উদ্দেশ্যে এবং কী কারণে নিয়ে গেল ছেলেটাকে? ওকে হত্যা করাও যদি উদ্দেশ্য হয়, তা হলেও তো এতক্ষণে ওর লাশ কোথাও-না-কোথাও পাওয়া যেত। এইসব নানারকম চিন্তা-ভাবনার ঢেউ মাথার মধ্যে খেলতে লাগল অসমঞ্জবাবুর। কিন্তু তবুও তিনি নিজে কোনও স্থির সিদ্ধান্তে আসতে পারলেন না।

অসমঞ্জবাবু পুলিশের লোক হয়েও মনে মনে ঠিক করেছিলেন বাপ্পার মুক্তিপণ চেয়ে কেউ যদি কোনও অসম্ভব রকমের কিছু চেয়েও বসে, তবে তা দিতেও তিনি পিছপা হবেন না। বেশি ঘাঁটাঘাঁটি না করে দুর্বৃত্তদের হাতে যথাসর্বস্ব তুলে দিতেও তিনি সাধ্যমতো চেষ্টা করবেন। কিন্তু কই? সেরকম সম্ভাবনা নিয়েও কেউ তো এল না? তবে কি ছেলেটা আদৌ অপহৃত হয়নি? তবে কি থানা-পুলিশ নিয়ে বড্ড বেশি ঘাঁটাঘাঁটি হয়ে গেছে বলে কেউ আসতে চাইছে না? কিন্তু আসবে তো উড়োচিঠি। তাই বা আসছে না কেন?

ভাবতে ভাবতে পাগল হয়ে যাবার উপক্রম হল।

অসমঞ্জবাবুর চোখদুটি ভরে উঠল জলে। কতরকম ভাবতে লাগলেন তিনি। মনে মনে ঠিক করলেন, একবার—শুধু একবার যদি বাপ্পাকে ফিরে পান, তা হলে পুলিশের চাকরিতে আর নয়। তাঁর তো টাকা-পয়সার অভাব নেই। পৈত্রিক সম্পত্তি এবং ব্যাঙ্কের টাকা যা আছে, তাতে চাকরি না করলেও চলে যাবে তাঁর। দেওঘর, গিরিডি কিংবা ঘাটশিলার কোনও নির্জন পরিবেশে গিয়ে শান্তিতে বসবাস করবেন। কলকাতার ওই বিষাক্ত পরিবেশে আর নয়। তবে কিনা এ সবই অবাস্তব চিন্তা। আসলে যার জন্য এত চিন্তা-ভাবনা সে কই? কোথায় বাপ্পা? বাপ্পাকে কি আর কখনও ফিরে পাবেন? সে কি সত্যি বেঁচে আছে?

দূরাগত মোটর বাইকের শব্দে চিন্তার জাল ছিঁড়ে গেল অসমঞ্জবাবুর। এখানকার একজন ছুঁদে পুলিশ অফিসার মি. কাঞ্জিলাল এসে হাজির হলেন। তাঁকে বেশ উদ্বিগ্ন ও উত্তেজিত মনে হল।

অসমঞ্জবাবু আশান্বিত হয়ে বললেন, কোনও খবর আছে?

কেন? কোনও হদিস-টদিস পাওয়া গেল?

আপনাকে এখনই একবার থানায় যেতে হবে স্যার।

একবার থানায় আসুন।

অসমঞ্জবাবু অশুভ চিন্তায় থর থর করে কাঁপতে লাগলেন। ভয়ে ভয়ে বললেন, কেন? ছেলেটার ডেড বডি দেখতে?

না না। সেসব কিছু নয়। তবে সন্দেহভাজন একজনকে আমরা গ্রেপ্তার করেছি। এবং এ লোকটা এক দাগি আসামি।

অসমঞ্জবাবু হতাশ হয়ে বললেন, তাতে আর লাভ কী? ওকে মোচড় দিলে কি আমার ছেলের খোঁজ পাওয়া যাবে?

লাভ আছে বইকী। আমার মনে হয় একে মোচড় দিলেও কিছু বেরোবে। কেন না এ সেই রুমালের মালিক। ইতিপূর্বে দু’-একটা ছেলেচুরির কেসেও জড়িত ছিল। এবং ও একজন জেল পলাতক কয়েদি।

অসমঞ্জবাবু সোজা হয়ে উঠে দাঁড়ালেন, কী বললেন? এ সেই রুমালের মালিক? মানে, যে রুমালটা আমি সকালে কুড়িয়ে পেয়েছিলাম? হ্যাঁ।

কী করে ধরলেন ওকে?

ধরেছি। ওর এক সঙ্গীও আছে। তাকেও ধরবার চেষ্টা করছি। কিন্তু পারছি না। অসমঞ্জবাবুর একটু আগের স্নায়বিক দুর্বলতা কেটে গেল। এখন আবার উনি সেই পুলিশ। তাঁর পুলিশিরক্ত টগবগিয়ে উঠল। শিরদাঁড়া টান-টান করে বললেন, কান যখন হাতের মুঠোয়, মাথাও তখন নাগালের মধ্যে। মেরে হাড় গুঁড়িয়ে দেব ওর। চলুন তো। কিন্তু আমার ছেলের ব্যাপারে কিছু বলেছে কি?

ওই জন্যেই তো ছুটে এলাম আপনার কাছে। ও বলছে, যা বলবার তা নাকি আপনাকেই বলবে।

তার মানে ও কিছু জানে।

সুজাতাদেবী তখনও শয্যাশায়ী ছিলেন। বললেন, দ্যাখো ওকে যেন আগেই তোমরা মারধর করে বসো না। ও যদি আমার বাপ্পার কোনও খোঁজখবর দিতে পারে, তা হলে ওকে কিচ্ছু বলো না তুমি। লক্ষ্মীটি এবারের মতো ওকে ক্ষমা করো।

অসমঞ্জবাবু সঙ্গে সঙ্গে তৈরি হয়ে মি. কাঞ্জিলালের বাইকেই থানায় এসে হাজির হলেন।

ধৃত বন্দি যুবকের দিকে তাকিয়েই চমকে উঠলেন অসমঞ্জবাবু। সর্বনাশ! ছেলেটা এদের খপ্পরে পড়েছে নাকি? বহুদিনের পুরনো এবং কুখ্যাত এক দাগি আসামি। কোনও এক কিশোরী হত্যা মামলায় অ্যারেস্ট হয়েছিল লোকটা। বিচারে দশ বছরের জেল হয়। জেলে গিয়েও মাস ছয়েকের মধ্যে সেখানকার রক্ষীকে মেরে পলাতক হয় ও। ওর এক বন্ধুও আছে। তাকেও ধরেছিলেন। উপযুক্ত সবরকম প্রমাণ লোপ পাওয়ায় সে-যাত্রায় বেঁচে গিয়েছিল লোকটা, কিন্তু পরবর্তী সময়ে একটা রাহাজানি কেসে ধরা পড়ে ওই একই জেলে দু’জনে মিলিত হয়। এরপরই জেল পালানোর ওই ঘটনা ঘটে।

অসমঞ্জবাবু ধৃতের মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, কীরে! চিনতে পারছিস? ধৃত লোকটি কোনওরকমে মাথা ঝুঁকিয়ে নমস্কারের ভঙ্গি করল। তারপর বলল, পারছি বইকী।

শেষকালে আমার ঘরে হাত দিতে এসেছিস তোরা? সাহস তো কম নয়। লোকটি নীরব।

তোর নামটা কিন্তু ভুলে গেছি।

আমার নাম রূপেন।

তোর সেই বন্ধুটা।

ওর নাম সুখেন।

হুঁ। তা ছেলেটাকে কোথায় রেখেছিস?

ভগবান যেখানে রেখেছেন। আমরা কোথাও রাখিনি তাকে।

অসমঞ্জবাবু জুতোসুদ্ধু পায়ে ওর পেটে সজোরে একটা লাথি মারলেন। লোকটার হাতদুটো পিছমোড়া করে বাঁধা ছিল। তাই মুখ থুবড়ে পড়ে গেল। অসমঞ্জবাবু ওর চুলের মুঠি ধরে টেনে দাঁড় করালেন ওকে, বল শিগগির। না হলে মেরে হাড় গুঁড়িয়ে দেব একেবারে।

আপনি বিশ্বাস করুন স্যার। সত্যি বলছি। বাবা চন্দনেশ্বরের দিব্যি আমি কিছুই জানি না।

কিছুই জানিস না যদি তো আমার সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিস কেন?

জানতিস না বুঝি আমরা দু’জনে মুখোমুখি হলে এইরকম ভয়ংকর একটা ব্যাপার ঘটবে? বলেই শক্ত রুলের বাড়ি এক ঘা।

রূপেন যন্ত্রণায় ককিয়ে উঠে বলল, আপনি বিশ্বাস করবেন না জানি, তবুও বলি আপনার ছেলেকে আমরা ধরিনি। কেনই বা ধরব? তার ওপরে তো আমাদের কোনও রাগ নেই।

নাই বা রইল। আমার ওপরে তো আছে?

তা আছে। তবে এই মুহূর্তে আর নেই।

এমন ঝাড় খাওয়ার পরেও না?

না। আসলে আপনার সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছি অন্য কারণে। আপনার ছেলের ব্যাপারে একটু কথা বলতে এসেছিলাম।

আমার ছেলের ব্যাপারে! কী কথা?

আপনার ছেলেটাকে আমরা দেখেছিলাম।

কখন?

কাল সন্ধ্যায়। সন্ধে উত্তীর্ণ হয়ে গেছে তখন। সেই অন্ধকারে। ও মোহনার দিক থেকে আসছিল। এমন সময় আমাদের সঙ্গে দ্যাখা। আমরা দু’জনেই ছিলাম তখন। মানে আমার বন্ধু সুখেনও ছিল। ও-ই প্রস্তাব দিয়েছিল ছেলেটাকে গুম করবার। ও চেয়েছিল ওকে হত্যা করতে। এবং ওকে হত্যা করে আপনার ওপর প্রতিশোধ নিতে। যদিও আমি তাতে রাজি হইনি এবং সে কাজ ওকে করতেও দিতাম না। তবুও আমরা যখন এইসব আলোচনা করছি তেমন সময় হঠাৎ দেখি ছেলেটা নেই।

সে কী!

সম্ভবত আমাদের কথাবার্তা ও শুনতে পায় এবং তাতেই ভয় পেয়ে পালায়। ওকে পালাতে দেখে আমরাও ধরবার জন্য ছুটলাম। এমন সময় হঠাৎ কয়েকটা কুকুর ওকে তাড়া করে।

অসমঞ্জবাবু সশঙ্কিত হয়ে বললেন, সে কী! কুকুরগুলো ওকে আঁচড়ে কামড়ে দেয়নি তো?

মনে হয় না। তা হলে ছেলেটা চেঁচাত। যাই হোক, আমরা যখন ছেলেটাকে কুকুরের হাত থেকে বাঁচাব বলে ছুটে গেলাম তখন দেখি, ছেলেটা ম্যাজিকের মতো হাওয়া হয়ে গেল। পরক্ষণেই একটা মোটর বাইকের শব্দ। আমরা বুঝলাম কেউ ওকে নিয়ে গেল।

অসমঞ্জবাবু বললেন, তা হলে কাল রাতেই তোরা এসে খবর দিসনি কেন আমাকে?

কেন দেব? আমরা যখন অপহরণ করিনি তখন কেন আমরা নিজেদের জড়াতে যাব? আমরা জেল পলাতক কয়েদি। দাগি আসামি। আমরা কিছু বললেও কি আপনারা বিশ্বাস করতেন? পরে অবশ্য ভেবে দেখলাম কাজটা আমরা ঠিক করিনি।

অসমঞ্জবাবু দু’হাতে নিজের মাথার চুলগুলো মুঠো করে বললেন, ওফ্। আজ যদি তুই ধরা না-পড়তিস, তা হলে এসব কথা তো জানতেই পারতাম না আমি। ধরা আমি পড়িনি স্যার। কাল সারা রাত ধরে দু’বন্ধুতে যুক্তি করে আজ আমি নিজেই এসে ধরা দিয়েছি। না হলে আমাদের ধরবে কে? এইসব পুলিশ? তুই নিজে এসে ধরা দিয়েছিস?

হ্যা। আপনাদের কাছে ভাল প্রস্তাব নিয়ে আসারও পুরস্কার তো হাতেনাতে পেয়ে গেলাম। থানার কাছাকাছি যেই না এসেছি, অমনি আপনাদের লোকেরা আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে হাতে হাতকড়া লাগিয়ে দিল। সবাই ধরে নিল, আমি বোধহয় ছেলেটাকে আটকে রেখে তার মুক্তিপণ চাইতে এসেছি। কিন্তু এটুকু বুদ্ধি কারও ঘটে নেই যে, মুক্তিপণ চাইতে আমি থানায় আসব কেন?

অসমঞ্জবাবু বললেন, তুই তা হলে কী জন্যে এসেছিস?

যদি আপনি আমাকে বিশ্বাস করেন তা হলে বলি। আপনার ছেলের চুরির ব্যাপারে আমি আপনাকে একটু সাহায্য করতে চাই। এবং সেই জন্যেই এখানে এসেছি। তবে একটু ভুল হল, এখানে না এসে যদি আপনার হোটেলটা খোঁজ করে সেখানে দেখা করতাম তা হলে এইসব পুলিশের চোখে সন্দেহভাজন হতাম না। যাক, যেজন্যে আসা সেই কথাই বলি। আমরা দু’বন্ধুই এখন খুব একটা বিপজ্জনক পরিস্থিতির মধ্যে আছি।

কেন, কী হল?

আমরা যে কোনওকারণেই হোক আমাদের মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছি এবং দল থেকে বেরিয়ে এসেছি। আমাদের মতো ক্রিমিন্যাল দল থেকে বেরিয়ে এলে আমাদের পরিণাম কী হতে পারে, তা অনুমান করতে পারছেন নিশ্চয়ই? ওরা তোদের মারবার জন্যে উঠে পড়ে লেগেছে। এই তো?

হ্যাঁ! এবং আমরাও ওদের মারবার জন্যে উঠে পড়ে লেগেছি। কাল রাতে ওই নির্জনে সেই ব্যাপারেই আলোচনা করছিলাম আমরা। এমন সময় আপনার ছেলের সঙ্গে আমাদের দ্যাখা হয়। স্যার, আমাদের চোখের সামনে থেকে আমাদের মুখের গ্রাস কেড়ে নেবে এমন ক্রিমিন্যাল এ অঞ্চলে নেই। তাই আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস আমাদের গতিবিধির ওপর কেউ নজর রাখছিল এবং আমাদের জালে জড়াবে বলে বা অন্য কোনও মতলবে ছেলেটাকে ওই নজরদাররাই চুরি করে। এটা আমাদের মূল কেন্দ্রের কাজ।

অসমঞ্জবাবু বললেন, যদি তাই হয়, তা হলে তোরা কি পারবি আমার ছেলেকে ওদের খপ্পর থেকে বার করে আনতে?

আপনার সাহায্য পেলে পারব। বিশ্বাস করুন, এই প্রাণ বাঁচানোর জন্যে ছুটোছুটি দৌড়াদৌড়ির খেলা আর ভাল লাগছে না। আমাদের হয়েছে জলে কুমির, ডাঙায় বাঘ। একদিকে পুলিশের তাড়া, অন্যদিকে আততায়ীর বুলেট। এইভাবে বেঁচে থেকে কী লাভ আছে কিছু? আমার বন্ধু সুখেন, সে তার একমাত্র পুত্রকে হারানোর জন্য আপনাকেই নিমিত্ত বলে মনে করে। কিন্তু পুত্রশোক যে কী জিনিস তা তো সে জানে। তাই অনেক বুঝিয়ে তারও মনের পরিবর্তন ঘটিয়েছি। সেও আপনার ওপর প্রতিশোধ নিতে চায় না। মোট কথা এখন আমরা দু’জনেই আইনের আওতায় আসতে চাই। আপনি আমাদের জেলে ঢোকান, প্রাণে মারুন, যা ইচ্ছে করুন, শুধু যারা আমাদের এই পথে নিয়ে এসেছে, দুনিয়া থেকে বরাবরের জন্যে চলে যাবার আগে তাদের সঙ্গে লড়বার একটা সুযোগ করে দিন। আশা করি আপনার ছেলে আমরাই উদ্ধার করতে পারব।

তোমাদের কি দৃঢ় বিশ্বাস ওরাই এ কাজ করেছে?

হ্যাঁ।

বেশ। আমি তোমাদের বিশ্বাস করলাম। বলে একজন সার্জেন্টকে বললেন,

লোকটার হাতকড়া খুলে দিতে বলুন তো।

একজন এসে বন্ধনমুক্ত করল রূপেনকে।

রূপেন অসমঞ্জবাবুর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে বলল, একদিন আমরাও ভদ্রঘরের ছেলে ছিলাম স্যার। কর্মদোষে এবং ভাগ্যদোষে আজ ক্রিমিন্যাল হয়েছি। যাই হোক, আমরা কসম খেয়েছি আর কখনও খারাপ কাজ করব না। এতে অবশ্য আইনের হাত থেকে আমরা রক্ষা পাব না। তবুও ভাল হবার চেষ্টা করে আগেকার পাপের কিছুটা প্রায়শ্চিত্ত করব। তবে আমাদের শত্রুদের বিনাশ ঘটাবই। ওদের মর্জিমাফিক আর কোনও খারাপ কাজ করতে আমরা চাইনি বলেই ওদের দলচ্যুত হয়েছি। খারাপ কাজ আর করব না বলেই দল ছেড়ে বেরিয়ে এসেও পালটা দল আর গড়িনি। শুধু ওদের শেষ করে নিজেরাই গিয়ে জেলে ঢুকব এই প্রতিজ্ঞা করেছি।

অসমঞ্জবাবু একটা চেয়ারে বসে বারবার দু’হাতে মাথার চুলগুলো অকারণেই মুঠো করে ধরতে লাগলেন।

রূপেন বলল, অত ভেঙে পড়বেন না স্যার। আমরা আছি আপনার পিছনে। আমাদের আগেকার অপরাধের জন্য যা শাস্তি হয় দেবেন। মাথা পেতে নেব। এখন শুধু আপনার ছেলেকে উদ্ধার করে আনার মতো একটা ভাল কাজের সুযোগ করে দিন।

তোমার ওই একই কথা বারবার বলার আর দরকার নেই। এখন কীভাবে কী করতে চাও তাই বলো। কেন না আমার মানসিক অবস্থা অত্যন্ত খারাপ। তবে না-বুঝে তোমাকে মারধর করেছি বলে দুঃখিত।

হ্যাঁ। আমরা কী ভাবে কী করতে চাই তা সবই আপনাকে বলব। আমার বন্ধু রূপেন একটি গোপন স্থানে অপেক্ষা করছে আমার জন্য। আমি আগে একবার তার কাছে যাব। তারপর সন্ধের সময় চলে যাব আপনার হোটেলে। আপনি কোন হোটেলে আছেন স্যার?

হোটেল সুন্দরম।

ঠিক আছে। আপনার সঙ্গে যোগাযোগগুলো আমরা খুবই গোপনে করতে চাই। যাতে ওরা বুঝতে না-পারে যে, আমরা আপনার সঙ্গে সহযোগিতা করছি। অসমঞ্জবাবু বললেন, যারা তোমাদের এত বেশি নজরে রাখছে তারা কি মনে করো এত কাঁচা লোক যে তুমি থানায় এসে নিজেই ধরা দিয়েছ, অথবা ধরা পড়েছ এ খবর তারা পায়নি? বিশেষ করে জেনে রেখো তুমি ধরা পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই ওরা সতর্ক হয়ে গেছে। কেন না ওরা জানে তোমরা দু’বন্ধুই এখন ওদের শত্রু। অর্থাৎ তোমরা ধরা পড়লে স্বেচ্ছাতেই ওদের সব কথা পুলিশকে বলে দেবে। তবু বলছ যখন তখন যতটা সাবধান হওয়া দরকার ততটা সাবধান হয়েই কাজ করে যাবে।

আমি এখন একবার সুখেনের কাছে যেতে চাই। ঠিক সন্ধের সময় দেখা করব আপনার সঙ্গে।

কোরো। ছেলে উদ্ধার হোক না-হোক ওদের গ্যাংটাকে তো ধরতে পারব। এটাও আমার কর্তব্য।

রূপেন চলে গেলে অন্যান্য পুলিশের লোকেরা বলল, এ কী করলেন স্যার! একটা বর্ন ক্রিমিন্যালকে আপনি এইভাবে ছেড়ে দিলেন? ও তো রীতিমতো নকশা মেরে বেরিয়ে গেল। ও কি সন্ধের পর আপনার সঙ্গে সত্যি সত্যিই দেখা করবে ভেবেছেন?

করতেও তো পারে। দেখাই যাক না একবার একটু সুযোগ দিয়ে। বিশেষ করে ও যখন এসেছিল দেখা করতে।

অসমঞ্জবাবু আর বসলেন না। থানা থেকে বেরিয়ে আবার হোটেলে ফিরে এলেন। কিন্তু এ কী! দরজায় তালা দেওয়া কেন?

বেয়ারা বলল, মা তো একটু আগেই এক ভদ্রলোকের সঙ্গে মোটরে চেপে চলে গেলেন।

কোথায়?

খোকাবাবুকে আনতে।

তার মানে?

কেন বাবু, শুনলাম যে খোকাবাবুকে পাওয়া গেছে। আপনিই তো থানা থেকে লোক দিয়ে গাড়ি পাঠিয়েছিলেন!

সে কী !

হ্যা। উনি তো তাই বললেন।

অসমঞ্জবাবু মাথায় হাত দিয়ে বসলেন। এই মুহূর্তে নিজেকে তাঁর অত্যন্ত বোকা এবং অসহায় বলে মনে হল।