পাঁচ
দিঘার পুলিশ চেষ্টার কোনও কসুর করল না। চারদিক তন্নতন্ন করে খুঁজেও আবিষ্কার করতে পারল না বাপ্পাকে। যেখানে যত পোড়ো বাড়ি ছিল, অস্থান কুস্থান ছিল, সর্বত্র ঢুঁ মেরে দেখল। লঞ্চে করে সমুদ্র তোলপাড় করল। কিন্তু না। কোথাও নেই বাপ্পা।
অবশেষে সকলেই এই সিদ্ধান্তে এলেন যে, ছেলেটাকে নিশ্চয়ই কেউ চুরি করে ভিন্ন রাজ্যে নিয়ে গেছে। তবুও বাপ্পার বাবা অসমঞ্জবাবু একজন ঝানু গোয়েন্দা। স্থির সিদ্ধান্তে এসেও তিনি হাল ছাড়লেন না। সূত্রসন্ধানের আশায় এখানকার পুলিশকে সঙ্গে নিয়ে নিজেই তদন্ত শুরু করলেন।
প্রথমেই বাঁদিকের সি বিচ ধরে এগিয়ে চললেন মোহনার দিকে। ছেলেটা মোহনা দেখতে চেয়েছিল। একা একা সেখানে যেতে গিয়ে কোনও বিপদে পড়েনি তো? কে জানে? চারদিকে সতর্ক দৃষ্টি রেখে তিনি এগিয়ে চললেন।
সোজা রাস্তা ধরে বালিয়াড়ির কোল ঘেঁষে এগোতে গিয়ে হঠাৎ এক জায়গায় এসে থমকে দাঁড়ালেন তিনি। এই তো! এই তো পাওয়া গেছে বাপ্পার রিস্টওয়াচটা। তা হলে তো বাপ্পা সমুদ্রের শিকার হয়নি। বাপ্পা তা হলে এদিকে এসেছিল। এবং এদিকে এসেই সে বিপদে পড়েছে। অর্থাৎ সে যে কোনও দুষ্ট লোকের চক্রান্তের বলি হয়েছে, তা বুঝতে একটুও দেরি হল না তাঁর।
তিনি বার বার সন্ধানীদৃষ্টিতে চারদিকের পায়ের ছাপ লক্ষ করতে লাগলেন। আরও কিছু সূত্র পাবার আশায় উৎসুক হয়ে উঠলেন তিনি। কিন্তু না। এখানে পায়ের ছাপ এত বেশি যে, সব গোলমাল হয়ে গেল।
এখানেই বালিয়াড়ির মধ্যে একটা ধসের চিহ্নও দেখলেন অসমঞ্জবাবু। আর ঠিক তার নীচেই ওই রিস্টওয়াচ। অর্থাৎ বোঝা গেল ওই বালিয়াড়ির ওপর থেকে যেভাবেই হোক হড়কে পড়ে গেছে ও।
অসমঞ্জবাবু ভাবলেন, আচ্ছা এমনও তো হতে পারে বাপ্পা কোনও কারণে ওখান থেকে পড়ে গিয়ে অজ্ঞান অবস্থায় কারও আশ্রয়ে আছে? অবশ্য একথা মনে এলেও এর স্বপক্ষে কোনও যুক্তি খুঁজে পেলেন না। কেন না তাই যদি হবে, তা হলে এতক্ষণে তারা তো নিশ্চয়ই জানাবে পুলিশকে। অথবা হাসপাতালে ভরতি করবে।
অসমঞ্জবাবুর মাথার ভেতর ঝিমঝিম করতে লাগল।
তা হলে সত্যিই কি তাঁর ওপর প্রতিহিংসা চরিতার্থ করবার জন্য কেউ নিয়ে গেছে ছেলেটাকে? তাঁর ওই একমাত্র সন্তান। কত আদরযত্নে তাকে তিনি বড় করে তুলছেন। কত স্বপ্ন ছিল ওই ছেলেটিকে ঘিরে। সব জাল যেন ছিঁড়ে গেল। এতটুকু আঘাত যে সহ্য করতে পারে না, দুর্বৃত্তরা হয়তো তার ওপর আঘাতের পর আঘাত হেনে চলেছে। আহা রে। বাপ্পা কি পারবে অত নির্যাতন সহ্য করতে?
হয়তো মরেই যাবে ছেলেটা। অসমঞ্জবাবুর চোখদুটি জলে ভরে উঠল। রুমালের খুঁট দিয়ে সে জল মুছে নিলেন তিনি।
তবুও তিনি বালিয়াড়ি বেয়ে ওপরে উঠে দেখলেন, এক জায়গায় কয়েকটি আধপোড়া সিগারেট পড়ে আছে। তার পাশেই অপ্রত্যাশিত ভাবে আর একটি সূত্র। অর্থাৎ একটি রুমাল। মানে এটা পেতে কেউ এখানে বসেছিল। কিন্তু উঠে যাবার সময় নিয়ে যেতে ভুলে গেছে। এ নিশ্চয়ই কোনও ভদ্রলোকের রুমাল নয়। না হলে এত জায়গা থাকতে এইখানে এসে কোন ভালমানুষ বসতে যাবে? যাই হোক, রুমালটা কাজে লাগবে।
তারপর আরও একটু এগোতেই দেখতে পেলেন একটি গাছের গায়ে আঁচড় কাটা বাপ্পার নাম।
অসমঞ্জবাবুর বুকের ভেতরটা হু হু করে উঠল।
বাপ্পার এখানে আসার সবরকম অস্তিত্বই তো আছে। শুধু বাপ্পাই নেই। এখানকার আকাশ-বাতাস, ঝাউবন, সমুদ্র সবাই সব কিছুই দেখেছে, কিন্তু এরা তো মূক। তাই কিছু বলতে পারছে না। শুধু অসহায়ভাবে তার সেই পদচিহ্নের স্মৃতিটুকু বুকে করে ধরে রেখেছে! আর এঁকে রাখা স্বাক্ষরকে চোখের সামনে মেলে ধরেছে।
অসমঞ্জবাবু আরও এগিয়ে চললেন। ওই দেখা যায় মোহনা। বাপ্পা ওখানেও গিয়েছিল নিশ্চয়ই। লাইকানি নদী যেখানে সাগরের সঙ্গে মিশেছে, সেইখানে এসে থামলেন। মোহনায় তখন নুলিয়া ও জেলেদের ভিড়। তারা বলল, আমরা তো কিছুই বলতে পারব না বাবু। কাল সন্ধ্যায় যারা এখানে ছিল তারা এখন সাগরে। আর আমরা যারা সাগরে ছিলাম, আজ এই সকালে আমরা লাইকানির চরে।
অবশেষে অনেক জিজ্ঞাসাবাদের পর একজন বুড়ো মাঝি বলল, হ্যাঁ হ্যাঁ, কাল ঠিক ভর সন্ধেবেলায় একটি ছেলে এখানে এসেছিল। তবে কিনা তাকে তো এখানে বেশিক্ষণ থাকতে দেওয়া হয়নি। বুঝিয়েবাঝিয়ে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
অসমঞ্জবাবু একটি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। নাঃ। আর কোনও সূত্র নেই। এখান থেকে ফিরে যাবার সময়ই বাপ্পা দুর্বৃত্তদের নজরে পড়ে। তারপর ওর নিয়তি ওকে যেখানে নিয়ে গেছে সেখানেই গেছে ও।