দিঘা সৈকতে আতঙ্ক – ৪

চার

একটা দোকানে শাঁখা, পুঁতি ইত্যাদির মালা এবং অন্যান্য কিছু জিনিসের দরদাম করছিলেন সুজাতাদেবী। অসমঞ্জবাবুও হাতির দাঁতের কাজ করা একটা ছুরি নিয়ে নাড়াচাড়া করছিলেন। এমন সময় হঠাৎ খেয়াল হল বাপ্পার কথা। তাই তো! ছেলেটা অনেকক্ষণ নেই। কোথায় গেল ছেলেটা? সুজাতাদেবী ডাকলেন, বাপ্পা! কোথায় বাপ্পা!

অসমঞ্জবাবু বললেন, এদিক ওদিক কোথাও গেছে হয়তো।

সে কী! এমন তো কখনও করে না ও। যাও এগিয়ে গিয়ে

একটু দ্যাখো।

অসমঞ্জবাবু সব দিকে নজর দিতে দিতে এগিয়ে গেলেন ঘাটের দিকে! সিঁড়িতে দাড়িয়ে যতদূর চোখ যায় তাকিয়ে দেখলেন বাপ্পা নেই। ডানদিকেবাঁদিকে সামনে-পিছনে, বাপ্পার চিহ্নমাত্র নেই কোথাও।

ঘাটে অন্যান্য আরও অনেক লোক ছিল। সবাই সচকিত হয়ে উঠল এবার। যারা আগে বাপ্পাকে দেখেছিল তারা বলল, হ্যাঁ হ্যাঁ। এই তো একটু আগেই এখানে দাঁড়িয়েছিল ছেলেটা।

কেউ বলল, আমি একবার নীচে নামতে দেখলুম বটে। কিন্তু কোনদিকে গেল, তা বলতে পারছি না।

কেউ বলল, বাজারের দিকটা একবার দেখুন তো। ছেলেমানুষ, যদি কিছু মজার জিনিস দেখে কোথাও দাঁড়িয়ে থাকে।

শুরু হল তোলপাড়–তোলপাড়—তোলপাড়। সুজাতাদেবীকে ঘাটে বসিয়ে রেখে অসমঞ্জবাবু ছুটোছুটি করতে লাগলেন। যেদিকে বাপ্পা গিয়েছিল সেদিকেও খানিকটা পথ গিয়ে কোনও হদিস না-পেয়ে ফিরে এলেন। তারপর ডানদিকের পথ ধরে যেখানে ঝাউবন আরও গভীর — আলো ঘন, সেদিকেও কিছুটা এগিয়ে গেলেন। কিন্তু না। ডানদিক বাঁদিক চারদিকেই শূন্যতা। কোথাও নেই বাপ্পা।

অন্যান্য ট্যুরিস্টরা যারা বেড়াতে এসেছিল এখানে, তারাও তখন উৎকণ্ঠিত হল। তাদের মধ্য থেকেও কিছু উৎসাহী যুবক দিকে দিকে খোঁজাখুঁজি শুরু করল।

কিন্তু যে যেদিকে গেল, সে সেদিক থেকেই ব্যর্থ হয়ে ফিরে এল। না। কোনওদিকেই বাপ্পা নেই। চোখের সামনে থেকে, এত মানুষের ভিড়ের মধ্যে থেকে, ছেলেটা একেবারেই উবে গেল যেন।

ক্রমে দিনের আলো নিভে এল। সন্ধ্যার অন্ধকারে সুজাতাদেবী ঘাটের সিঁড়িতেই ‘উঃ মাগো’ বলে সংজ্ঞাহীন অবস্থায় লুটিয়ে পড়লেন।

অসমঞ্জবাবু একা অসহায়ভাবে কী যে করবেন কিছু ঠিক করতে পারলেন না।

স্ত্রীকে দেখবেন? ডাক্তার ডাকবেন? ছেলেকে খুঁজবেন? না, পুলিশে খবর দেবেন, কিছুই ঠিক করতে পারলেন না তিনি। চারদিকে ভিড়ে ভিড়।

এ রকম তো কখনও হয়নি। হাজার হাজার ট্যুরিস্ট সারা বছরের বিভিন্ন সময়ে এখানে যাতায়াত করেন, কিন্তু এমন তো কখনও ঘটেনি। দিঘা অতি নিরুপদ্রব ভদ্র এবং শান্ত জায়গা। বরং এখানকার শান্ত সমুদ্রে স্নান করতে গিয়ে আচমকা ভাটার টানে অথবা হাঙরের আক্রমণে নিখোঁজ হয়েছে অনেকে। যারা শুধুই সমুদ্রের শিকার হয়েছে, পরে অবশ্য তাদের মৃতদেহ ভেসে উঠতে দেখা গেছে। সমুদ্র শুধু প্রাণটুকু কেড়ে নিয়েই দেহটিকে পরিত্যক্ত আবর্জনার মতো কিনারে ফেলে দিয়েছে। আসলে দিঘা সৈকতের সৌন্দর্য এবং আতঙ্ক যা কিছুই বলো, তা এই সমুদ্র। কিন্তু তাই বলে সকলের জোড়া জোড়া চোখের সামনে এমন রহস্যময় ছেলে হারানো, সত্যি বলতে কী এই প্রথম।

যাই হোক, অসমঞ্জবাবুর এই অসহায় অবস্থায় কিছুই করতে হল না তাঁকে। দলে দলে কত যে মানুষ এসে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিল তাঁর দিকে তার ঠিক নেই।

সুজাতাদেবীর ওই রকম অবস্থা দেখে তারাই গিয়ে ডাক্তার ডেকে আনল। কয়েকজন মহিলা সুজাতাদেবীর সেবাশুশ্রূষার কাজে লেগে গেলেন। এই ফাঁকা জায়গায় প্রচণ্ড শীত বলে কাছাকাছি একটি বাড়িতে নিয়ে আসা হল সুজাতাদেবীকে। কয়েকজন বিশিষ্ট ভদ্রলোক অসমঞ্জবাবুকে নিয়ে থানায় গিয়ে রিপোর্টও করালেন।

এখানকার থানার ভারপ্রাপ্ত অফিসার অসমঞ্জবাবুর পরিচয় পেয়ে সসম্মানে তাঁকে বসতে বললেন। এবং সব কিছু ডায়েরিতে লিখে নিয়ে বললেন, আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন স্যার। আপনার ছেলেকে আমরা খুঁজে বার করবই। অবশ্য সমুদ্রে যদি তলিয়ে গিয়ে না-থাকে এবং অন্য ক্ষতি না হয়ে থাকে, তা হলে ছেলে আপনি পাবেনই। তবে জেনে রাখুন, দিঘায় কোনও ক্রিমিন্যাল নেই। থাকলেও তারা সক্রিয় নয়। কারণ, সমুদ্রের ধারে এখন ট্যুরিস্টের মেলা। সেখানে অত লোকের চোখের সামনে একটা ছেলে সমুদ্রে নামবে, অথচ কেউ দেখবে না, বা একটা ছেলেকে চুরি করে নিয়ে পালাবে কেউ দেখতে পাবে না, তা হয় না। যাই হোক, আপনি হোটেলে যান। আমরা ব্যবস্থা করছি আপনার ছেলেকে উদ্ধার করবার।

অসমঞ্জবাবু বললেন, আমি কি আপনাদের সঙ্গে থাকব?

কোনও প্রয়োজন নেই। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। আপনার ছেলে নিশ্চয়ই দূরে কোথাও গিয়ে পথ হারিয়ে ফেলেছে। এদিকে লাইকানির চর, ওদিকে চন্দনেশ্বর সব তোলপাড় করছি আমরা। এবং ঘণ্টায় ঘণ্টায় আপনি আমাদের অনুসন্ধানের খবর পাবেন।

অসমঞ্জবাবু তখন আর যেন নিজের মধ্যে নিজেই নেই। কেন কে জানে, বার বারই তাঁর মনের মধ্যে কু গাইতে লাগল। আসলে তিনি পুলিশের লোক তো। অভিজ্ঞতাও অনেক। কাজেই বিপদের সম্ভাবনাকে কোনও মতেই অন্যদের মতো উড়িয়ে দিতে পারলেন না।

অসমঞ্জবাবু সকলের সঙ্গে আবার ঘাটের কাছে ফিরে এলেন। তারপর যে বাড়িতে তাঁর অসুস্থ স্ত্রীকে নিয়ে গিয়ে রাখা হয়েছিল সেখানে এসে স্ত্রীকে সঙ্গে করে ফিরে এলেন হোটেলে। আপাতত সুজাতাদেবী একটু সুস্থ হোন। তারপর তিনি নিজেই অনুসন্ধান চালাবেন। তিনি বেশ বুঝতে পারছেন একটা অশুভ মেঘের কালো ছায়া হঠাৎ আবির্ভাব হয়েছে তাঁর ভাগ্যাকাশে।

পরদিন খুব ভোরে দিঘা আবার প্রাণচঞ্চল হয়ে উঠল। রাতের অন্ধকার থেকেই দলে দলে লোক এল সি বিচে সূর্যোদয় দেখবে বলে। চারদিকে শাল, কোট ও সোয়েটারের মেলা। সর্বত্রই চা ও কফির লোভনীয় আয়োজন। সাগরসৈকতে নুলিয়াদের মাছধরা। সে দেখবার মতো দৃশ্য। কিন্তু তবুও গত সন্ধ্যায় এই মনোরম পর্যটনকেন্দ্রে বাপ্পার অন্তর্ধান রহস্য দিঘা সৈকতে একটা আতঙ্কের সৃষ্টি করল। তাই তো! কী হল! কোথায় গেল ছেলেটা? দুর্ঘটনা যে কোনও সময়ে ঘটতে পারে। তাই কিছু ঘটে গেলে মানুষ সন্ত্রস্ত হয় বইকী। সেই নিয়েই আলোচনা সবার মুখে।

নানা লোক নানা কথা বলাবলি করতে লাগল। কেউ বলল, ছেলেটাকে নিশ্চয়ই কেউ গুম করেছে। কেউ বা অন্যরকম আশঙ্কা করল। বলল, পুলিশের ছেলে তো। হয়তো কারও না কারও রাগ আছে ওর বাবার ওপর। তাই দিয়েছে ছেলেটাকে শেষ করে। কিন্তু তাই যদি হবে, অর্থাৎ গুমই যদি করে থাকে, ছেলেটা আস্ত আছে তো? আর মেরে যদি ফেলে তা হলে ডেড বডি কই? কেউ কোনও উদ্দেশ্য নিয়ে লুকিয়ে রাখলে এক্ষেত্রে যা হয় অর্থাৎ অসম্ভব একটা মুক্তিপণ চেয়ে নিশ্চয়ই কোনও চিঠি দিত। কিন্তু তাও কেউ করেনি। তবে কি একা একা সমুদ্রে নামতে গিয়ে হাঙড়ের পেটে গেছে? না হলে গেল কোথায়? কোথায় গেল ছেলেটা?

যাই হোক, অনেকে অনেক মন্তব্যই করল। কিন্তু আসল ঘটনা যে কী, তা কেউ কল্পনাও করতে পারল না।