দিঘা সৈকতে আতঙ্ক – ৩

তিন

সেই অন্ধকারে বাপ্পা একাই সাহসে ভর করে এগিয়ে চলল। না-যাওয়া ছাড়া উপায়ই বা কী? যেভাবেই হোক পৌঁছতে তো হবে? উঁচুনিচু বালিয়াড়িতে অনভ্যস্ত হাঁটাচলার পথ চলতে লাগল বাপ্পা।

একটা টর্চ নেই, কিছু নেই। আপন খেয়ালে চলে এসে এখন বুঝতে পারছে কী ভুলই না করেছে ও।

কনকনে ঠান্ডায় ওর হাত-পা জমে যাচ্ছে যেন।

হঠাৎ ও কী! কী ওটা !

বাপ্পা থমকে দাঁড়াল। দেখল আগুনের গোলার মতো দুটো চোখ ওর দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে। সে কী ভীষণ চাহনি। ভয়ে বুক শুকিয়ে গেল ওর।

বাপ্পা তবু সাহসে ভর করে হাতে তালি দিল একবার। মুখে শব্দ করল ‘হ্যাট হ্যাট’। কিন্তু ফল হল উলটো। ততক্ষণে আরও কয়েকটি ওইরকম জ্বলন্ত চোখ ওর দিকে তাকাল ওই একই ভাবে।

বাপ্পা আর থাকতে পারল না। জোরে চেঁচিয়ে উঠল, কে আছও বাঁচাও। সঙ্গে সঙ্গে একটা টর্চের আলো সেখানে এসে পড়ল। এবং সেই আলোর সঙ্গে সঙ্গেই নিভে গেল সেই জ্বলন্ত চোখগুলো।

টর্চের আলো ধীরে ধীরে চারদিকে ঘুরপাক খেয়ে বাপ্পার মুখের ওপর এসে পড়ল। দু’জন লোক টর্চ হাতে কাছে এসে ওর সামনে দাঁড়িয়ে বলল, কে! কে তুমি?

আমি বাপ্পা।

বাপ্পা অন্ধকারে লোকদুটোকে ভাল করে দেখতে পেল না। শুধু বুঝল ওরা ফুলপ্যান্ট আর ফুল হাতা জামার উপর সোয়েটার পরে আছে। ওরা বলল, তোমার বাড়ি কোথায় ?

কলকাতায়।

কলকাতায়? এখানে এই অন্ধকারে একা তুমি কী করছ?

কিছু করিনি। আমি মোহনা দেখতে গিয়েছিলাম। ফিরতে খুব দেরি হয়ে গেল। এই অন্ধকারে আমি কিছু দেখতে পাচ্ছি না। এমন সময় দেখলুম, আগুনের গোলার মতো কতকগুলো চোখ আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমার খুব ভয় পাচ্ছে এখন। আপনারা আমাকে একটু দিঘার দিকে এগিয়ে দেবেন?

লোকদুটো পরস্পর পরস্পরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে লাগল।

হয়েছে একজন বলল, ও। তুমিই তা হলে সেই ছেলে! মা-বাবা যেই একটু অন্যমনস্ক অমনি সেই ফাঁকে ডানা মেলে উড়ে পড়েছ। ওদিকে তোমার মা-বাবার কী অবস্থা তা জান?

কী হয়েছে তাদের?

কী হয়নি সেটাই বলো? অনুমান করো দিকিনি কারও ছেলে হারালে তার মা-বাবার অবস্থা কী হতে পারে? শোনো, তোমার মা ফিট হয়ে পড়ে আছেন। আর বাবা থানা-পুলিশ করে তোলপাড় করছেন চারিদিক। ছিঃ ছিঃ ছিঃ। এই ভাবে কেউ আসে?

বাপ্পা করুণ স্বরে বলল, আর কখনও আমি মা-বাবাকে না বলে কোথাও যাব না। আমাকে আপনারা একটু এগিয়ে দিয়ে আসবেন চলুন।

লোক দু’জন কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, আচ্ছা এসো।

বাপ্পা ওদের সঙ্গে কিছুটা পথ এগোবার পর এক সময় ওরা দু’জনেই থামল। বাপ্পা বলল, কী হল থামলেন যে?

একজন বলল, তোমার বাবা তো পুলিশে কাজ করেন, তাই না? হ্যাঁ। আমার বাবা গোয়েন্দা পুলিশের একজন বড় অফিসার।

আমরা চিনি তোমার বাবাকে। তোমার বাবার সঙ্গে আমাদের বিশেষ সদ্ভাব নেই। শুধু তোমার বাবার সঙ্গে কেন, কোনও পুলিশের সঙ্গেই সদ্ভাব নেই আমাদের।

বাপ্পা অবাক হয়ে বলল, কেন নেই?

সে তুমি বুঝবে না!

কেন বুঝব না? আমি কি বাচ্চা ছেলে? আমার বারো বছর বয়েস। আমি ক্লাস সেভেনে পড়ি।

আমরা সমাজবিরোধী। তোমার বাবা আমাদের একবার জেলে পাঠিয়েছিলেন, আমরা বহু কষ্টে সেই জেল ভেঙে পালিয়ে এসেছি।

বেশ করেছেন। আমার বাবার হাতে আইন ছিল, তাই জেলে পুরেছিলেন। আপনাদের হাতে ক্ষমতা ছিল, তাই জেল ভেঙে পালিয়ে এসেছেন। কিন্তু আমি তো কোনও দোষ করিনি। কাজেই আপনাদের সঙ্গে আমার কোনও শত্রুতা নেই। দয়া করে আপনারা আমাকে একটু এগিয়ে দিন।

লোকদুটো তখনও এক পাও না—এগিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে বাপ্পা বলল, কী হল? যাবেন না? আমার বাপি পুলিশ হতে পারেন। তবুও তিনি মানুষ। তাঁর পথহারানো ছেলেকে আপনারা যদি উদ্ধার করে তাঁর হাতে পৌঁছে দেন, তা হলে নিশ্চয়ই তিনি সেই উপকারের বিনিময়ে আপনাদের হাতে হাতকড়া পরাবেন না। যদি পরান, তা হলে জেনে রাখবেন বাপির সঙ্গে আর কখনও কথা বলব না আমি। একদিন স্কুল যাবার নাম করে পালিয়ে গিয়ে এমন হারিয়ে যাব যে, আর কখনও বাড়ি ফিরব না।

তুমি নিতান্তই ছেলেমানুষ তাই এই সব কথা বলছ। তোমাকে তোমার বাবার কাছে পৌঁছে দিলে হয়তো তিনি খুশিই হবেন খুব। কিন্তু তবুও উনি পুলিশ। আমাদের দেখলেই তাঁর মাথার ব্রহ্মতালুতে কর্তব্যবোধটা কড়াং করে উঠবে। পরক্ষণেই হাতে হাতকড়া পরিয়ে আবার শ্রীঘরে পাঠিয়ে দেবেন আমাদের।

আমি আপনাদের কথা দিলাম যদি আপনারা আমাকে আমার বাপির কাছে পৌঁছে দেন, তবে. আমি তাঁর পায়ে ধরে অনুরোধ করব তিনি যেন আপনাদের কিছু না বলেন।

তা না হয় করলে। কিন্তু তোমার ব্যাপার নিয়ে দিঘা এখন পুলিশেপুলিশে ছয়লাপ। এখানকার পুলিশ আমাদের দেখতে পেলে ছাড়বে কেন? আমরা খুব কুখ্যাত লোক। তা কি জান? তবে একটু অপেক্ষা করো, আমরা তোমার ব্যাপারটা নিজেদের ভেতরে একটু আলোচনা করে দেখি কী করা যায়, তোমাকে নিয়ে।

বাপ্পা বলল, যা করবেন তাড়াতাড়ি করুন। আমার আর তর সইছে না।

লোক দু’জন টর্চ নিভিয়ে সেই অন্ধকারে সিগারেট ধরাল। তারপর বাপ্পার কাছ থেকে একটু সরে গিয়ে ফিস ফিস করে কী সব যেন বলতে লাগল। এত চাপা কথাবার্তা যে বাপ্পা কিছুই বুঝতে পারল না।

এই কনকনে ঠান্ডায় বাপ্পা তখন জমে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে ব্যাকুল সামুদ্রিক বাতাস জোরে বইতে থাকলে ঝাউবনে ঝাউয়ের ঝালরগুলি সর সর শব্দ করে মাথা দোলাচ্ছে। সমুদ্রের জলোচ্ছ্বাসের শব্দ খুবই দ্রুতগতি। তার মানে জোয়ার আসছে—জোয়ার আসছে—জোয়ার আসছে। বাপ্পা এখন অবশ্য খুব উঁচু একটা বালিয়াড়ির ওপর আছে। কাজেই সমুদ্রের জল সেখান পর্যন্ত যে এসে পৌঁছবে না, এ ব্যাপারে সে পুরোপুরি নিশ্চিন্ত। কিন্তু ওই লোক দু’জনের মতলব তো ভাল বলে মনে হচ্ছে না। ওরা কেন ওকে নিয়ে অত আলোচনা করছে? ওরা না যাবে, সেকথা তো বলে দিতেই পারে। বাপ্পা কি একা যেতে পারবে না? এত কী ফিসফিস করার আছে?

বাপ্পা অনেকক্ষণ ধরে কান পাতার পর এবার একটু স্পষ্ট কথাবার্তা শুনতে পেল ওদের।

একজন বলল, কী দরকার আবার ওই সব ঝামেলায় জড়াতে যাবার? অপরজন বলল, এমন মওকা। হাতছাড়া করা উচিত হবে না। প্রতিশোধ নেবার এই হচ্ছে উপযুক্ত সময়।

কিন্তু ছেলেটা তো কোনও দোষ করেনি।

আমার ছেলেটা কী দোষ করেছিল? সেদিন যদি ওই শয়তান আমাকে জেলে না ঢোকাত, তা হলে কি ভেবেছিস ওই ভাবে বেঘোরে মরত আমার ছেলেটা? আমার একমাত্র ছেলেকে আমি যার জন্যে হারিয়েছি, আমি চাই সেও তার ছেলেকে আমার জন্য হারাক। সেদিন যদি আমি জেলে না-যেতাম, তা হলে আমার বউ ছেলে আমার ঘরেই থাকত। না আমার বউ পেটের জ্বালায় ওর বাপের বাড়ি যেতে যাবে, না বাস চাপা পড়ে মরবে। আমি বলে তাই এখনও স্থির আছি। অন্য কেউ হলে হয়তো পাগল হয়ে যেত। পুত্রশোক কী তাই তুই কী বুঝবি? তুই তো বিয়েথা করিসনি, বেশ আছিস।

তাই বলে তুইও কি ওই ছেলেটাকে বিনা দোষে মেরে ফেলবি? ভেবে দেখ, আমাদের এখন সামনে কাঁটা, পিছনেও কাঁটা। একবার যখন দল ছেড়ে এসেছিস তখন আর সেখানে ফেরবার মুখ নেই। বরং ওরাই আমাদের মারবার জন্যে হন্যে হয়ে ঘুরছে। আর এদিকে রয়েছে পুলিশের তাড়া। এর ওপর একটা পুলিশের ছেলেকে মার্ডার করলে ব্যাপারটা কোন দিকে গড়াবে তা বুঝতে পারছিস? তার চেয়ে বরং এইসব ছেড়ে দে। আমরা আসলে যে কাজের জন্যে এখানে ঘুর ঘুর করছি সেই কাজ আগে হাসিল করি। যে ভাবেই হোক আগে সর্দারকে দুনিয়া থেকে সরাই। তারপর অন্য কাজে হাত দেব। এখন এইসব বাজে ঝামেলায় জড়িয়ে কোনওরকমে যদি আবার অ্যারেস্ট হয়ে যাই তো আমাদের শত্রুরই সুবিধে হবে। মাথায় উঠবে তখন হিস্যা নেওয়া।

বুঝলাম। কিন্তু এই ছেলেটাকে কোনওরকমেই ফিরতে দেওয়া হবে না।

বাপ্পার পিঠের শিরদাঁড়া বেয়ে একটা হিম স্রোত নেমে এল। সে বুঝতে পারল এমন পাল্লায় এসে পড়েছে যে, এই মুহূর্তে তার জীবনই বিপন্ন। সে তখন উপস্থিত বুদ্ধি খাটিয়ে একটু একটু করে অনেকটা দূরে সরে গেল। তারপর ঝাউবনের বাইরে এসেই ছুটতে লাগল ঊর্ধ্বশ্বাসে। কিন্তু সেই অন্ধকারে কি ছোটা যায়? পা চলছে না। তবু সে ছুটতে লাগল।

হঠাৎ কোথা থেকে ঘেউ ঘেউ করে কয়েকটা কুকুর তেড়ে এল ওর দিকে। বাপ্পা ভয়ে চিৎকার করে আরও জোরে ছুটতে গিয়েই পা হড়কে সেই বালিয়াড়ির ওপর থেকে গড়িয়ে পড়ল একদম নীচে। কুকুরগুলো সমানে ঘেউ ঘেউ করে চেঁচাতে লাগল। বালির ওপর থেকে সমস্বরে চিৎকার করতে করতে শয়তান কুকুরগুলোও নেমে আসতে লাগল। কী ভয়ংকর মূর্তিতে তাড়া করে আসছে ওরা। যেন ধরতে পারলে দলবদ্ধভাবে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে খেয়ে ফেলবে।

বালিয়াড়ির ওপর থেকে পড়ে গিয়েই বাপ্পা দেখতে পেল দুটো জোরালো টর্চের আলো চারদিকে প্রতিফলিত হচ্ছে। অর্থাৎ লোকদুটো খুঁজছে ওকে।

বাপ্পা এখন নিজেকে লুকিয়ে ফেলবার অনেক চেষ্টা করল। কিন্তু কুকুরগুলোর জন্যে পারল না। কুকুরগুলো ওকে ভয়ংকর রকমের তাড়া করছে। ওকে দেখেই চিৎকার আর লাফালাফি করছে। কামড়াচ্ছেও না। অথচ ভাবটা এমন যে, পেলে আস্ত গিলে খায়।

বাপ্পা এখান থেকেই আলোকমালায় সজ্জিত দিঘাকে দেখতে পেল। আর একটু ছুটে এগোতে পারলেই দিঘা সৈকতের বোল্ডার ধরে বাঁধানো রাস্তাটায় গিয়ে পৌঁছবে ও। কিন্তু ছুটতে গেলেই যদি কামড়ে দেয় কুকুরগুলো?

এদিকে ওই কুকুরগুলোকে ওইভাবে চেঁচাতে দেখে এদিকের আরও কিছু কুকুর তাদের ক্রুদ্ধ প্রত্যুত্তর দিল। তারপর যেই না ওই কুকুরগুলো ওর দিকে এগোতে যাবে, অমনি শুরু হল কুকুরে কুকুরে প্রচণ্ড খেয়োখেয়ি।

সেই টর্চের আলো তখনও চারদিকে প্রতিফলিত হচ্ছে! ঝাউবন, বালিয়াড়ি, সৈকত ও সমুদ্রের কিনারা পর্যন্ত ঘুরপাক খাচ্ছে আলো। তারপর একসময় ওর ওপরও এসে পড়ল। বাপ্পা বুঝল আর সে নিজেকে রক্ষা করতে পারবে না। তাই দু’হাতে মুখঢেকে মৃগশিশুর মতো কাঁপতে লাগল সে।

বাপ্পা বুঝতে পারল ওর ওপর টর্চের আলো ফেলে বালিয়াড়ির ওপর থেকে দ্রুত নেমে আসছে ওরা। এবং যেভাবে নেমে আসছে তাতে বেশ বোঝা যাচ্ছে, এক সাংঘাতিক রকমের প্রতিশোধ স্পৃহা এবং হত্যালীলা মাথায় খেলছে ওদের। একথা মনে হতেই বাপ্পা সোজা হয়ে উঠে দাঁড়াল। তারপর মরিয়া হয়ে দৌড় লাগাল সে। দৌড় দৌড় দৌড়, জোরে ছুটতে গিয়ে হঠাৎ এক জায়গায় পাথরে হোঁচট খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়ল বাপ্পা! অমনি সেই অন্ধকারে কে যেন ঝাঁপিয়ে পড়ল ওর ওপর। তারপর রোমশ কঠিন একটি বাহু ওকে তুলে নিল অনায়াসে। সে তার হাতদুটো বাপ্পার মুখ এমন ভাবে টিপে রইল যে, ওর আর এতটুকু চিৎকার করবারও ক্ষমতা রইল না।