দিঘা সৈকতে আতঙ্ক – ২

দুই

সামনে সমুদ্র দেখে আনন্দের আতিশয্যে অধীর হয়ে উঠল বাপ্পা। বাস থেকে যেখানে ওরা নেমেছিল, তার পাশেই দিঘার প্রধান স্নানের ঘাট। আবেগের উচ্ছ্বাসে ‘হুররে’ বলে লাফিয়ে উঠেই বাপ্পা ছুটে গেল ঘাটের কিনারে। ঘাটের কিনারে বড় বড় বোল্ডারের ওপর সুনীল সাগর শ্বেত-শুভ্র ফেনার রাশি নিয়ে আছড়ে পড়ছে।

কত লোক তখন স্নান করছে সমুদ্রে। কেউ বা নুলিয়া নিয়ে, কেউ বা একা একাই। কেউ সাঁতার কাটছে। কেউ বা ঢেউ খাচ্ছে। সাঁতার কাটতে কাটতে কেউ অনেক দূরে চলে যাচ্ছে। যদিও সমুদ্রের বেশি দূরে কখনও যাওয়া উচিত নয়, তবুও সতর্কীকরণ না মেনেই বেপরোয়া মানুষেরা দলে দলে চলে যাচ্ছে গলাজল পেরিয়ে। বাপ্পার মনে হল, সেও ওদেরই মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে সমুদ্রের বুকে। ভেসে বেড়ায় ঢেউয়ের দোলায় দোলায়।

অসমঞ্জবাবু ডাকলেন, বাপ্পা চলে এসো, সমুদ্রের কাছে যেয়ো না।

না না, কিছু হবে না। এই তো আমি। জলে তো নামিনি। তা ছাড়া ভয় কী

বাপি, আমি তো পুরীর সমুদ্রেও ঢেউ খেয়েছি।

তা হোক। একেও বড় হেলাফেলা মনে

বাঃ রে। এত লোক যে ঢেউ খাচ্ছে?

তুমিও ঢেউ খাবে। তবে এখন নয়। এখন চলে এসো। আগে আমরা একটা হোটেল বা লজে গিয়ে উঠি, তারপর তো।

আমি আজই সমুদ্রে স্নান করব বাপি।

কোরো না।

আজ নয়। আজ এই অবেলায় এত ঠান্ডায় কেউ স্নান করে? কাল করবে। এখন চলে এসো।

বাপ্পা চলে এল। না এসে উপায়ই বা কী? সত্যি, বেলা তো হয়েছে। তার ওপর মা-বাবা ডাকলে, তাঁরা গুরুজন, সর্বাগ্রে তাঁদের কথা শুনতে হয়। অসমঞ্জবাবু খোঁজখবর নিয়ে কাছেই প্রধান সড়কের ওপর নবনির্মিত একটি চমৎকার হোটেলে গিয়ে উঠলেন। নাম ‘হোটেল সুন্দরম।’

কী সুন্দর হোটেল। মেন রোডের ওপর। ঠিক যেন একটা স্টুডিয়ো। বড় একটা ঘর। লাগোয়া আরও একটা ছোট ঘর। একটিতে খাট-বিছানা, ড্রেসিং টেবিল। অপরটিতে বিশ্রামের জন্য চেয়ার ও ইজিচেয়ার পাতা। অ্যাটাচড বাথ। গ্রাউন্ড ফ্লোরের ঘর। ভাড়া দৈনিক পঁয়ত্রিশ টাকা। অসমঞ্জবাবু তাঁদের থাকার জন্য নীচের তলায় এই ঘরটিই বেছে নিলেন।

হোটেলের ঘরে ঢুকে জামা-কাপড় ছেড়ে মুখহাত ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে বিশ্রাম নেওয়া হল কিছুক্ষণ। তারপর ঘরে চাবি দিয়ে অন্য একটা হোটেলে গিয়ে পেট ভরে মাছ-ভাত খেয়ে তিনজনে আবার সমুদ্রতীরে এলেন। কিন্তু এ কী! কী আশ্চর্য! কোথায় গেল সমুদ্র।

ওরা সবিস্ময়ে দেখল তীরভূমি থেকে বহুদূরে সমুদ্র সরে গেছে।

গঙ্গার ঢেউয়ের মতো ছোট ছোট ঢেউ কাদার ওপর ছলাৎ ছলাৎ করছে!

অর্থাৎ এখন ভাটার সময়। বিস্তীর্ণ চরার ওপর বড় বড় ট্রাক, মোটর ছুটছে।

বাপ্পার সব আনন্দ জল হয়ে গেল। অসমঞ্জবাবু, সুজাতাদেবী এবং বাপ্পা তিনজনেই তখন চরায় নেমে সমুদ্রের কাছে এগিয়ে যেতে লাগল। তখনও সেই দারুণ অবেলায় কত লোক সমুদ্রে স্নান করছে।

বাপ্পা চরায় নেমে বলল, দেখ বাপি, চরাটা কী বিচ্ছিরি। এই চরা পুরীর মতো বালির নয়। কাদা মাটির। তবে বেশ শক্ত। অর্থাৎ পা গেঁথে যায় না। আর সেইজন্যেই এই চরার ওপর দিয়ে মোটর, লরিগুলো অনায়াসে যাতায়াত করতে পারছে। তাই না? এটাও কিন্তু দিঘার একটা আকর্ষণ। এরকম বোধহয় কোথাও নেই। যাক, আমার আশা তো মিটল।

অসমঞ্জবাবু অনেকটা নিজের মনেই বললেন, এই সেই দিঘা।

সুজাতাদেবী বললেন, কী সুন্দর না?

হ্যাঁ। সুন্দর তো বটেই। দিঘা আজ ছোটখাটো সুন্দর একটি শহর। অথচ একদিন এই দিঘা ছিল ছোট্ট একটি গ্রাম। ১৭০৩ খ্রিস্টাব্দে রেনেলের মানচিত্রে বীরকূল পরগণার উল্লেখ আছে। আটটি গ্রাম নিয়ে তিনশো পঞ্চাশ বর্গ মাইল বিস্তৃত ছিল এই পরগণা। দিঘাও সেই পরগণার অন্তর্গত একটি গ্রাম ছিল। এখন অবশ্য যাকে আমরা দিঘা বলে জানি, এ কিন্তু সেই আসল দিঘা নয়। প্রাচীন দিঘা ছিল সমুদ্রের আড়াই মাইল দক্ষিণে।

বাপ্পা বলল, তা হলে সেই দিঘা এখন কোথায়?

অসমঞ্জবাবু হেসে বললেন, সেই দিঘাসহ সাতটি গ্রাম এখন তলিয়ে আছে সমুদ্রের জলের তলায়।

বলো কী!

বাংলার গভর্নর ওয়ারেন হেস্টিংস খুব সমুদ্রবিহার করতে এবং শিকার করতে ভালবাসতেন। সেজন্যে মাঝেমধ্যে তিনি সস্ত্রীক বেড়াতে আসতেন বীরকূলে। এখানে তাঁর একটি সুন্দর বাংলোও ছিল। সেটিও এখন সমুদ্রগর্ভে।

কবেকার কথা বাপি?

সে প্রায় ১৭৯৬ খ্রিস্টাব্দের কথা। তারও অন্তত পঞ্চাশ বছর পরে বেইলি সাহেব দিঘা বেড়াতে এসে মুগ্ধ হন। দিঘার অপার সৌন্দর্য দেখে মোহিত হন তিনি। দিঘার কথা তিনি কাগজে লিখতে থাকেন। এবং তাঁর সেই লেখা পড়ে দিঘার ব্যাপারে মানুষের উৎসাহ বাড়তে থাকে। যাই হোক, এর পরেও বহুকাল কেটে যায়। ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দের ১৫ অক্টোবর চারজন ইংরেজ অনেক কষ্টস্বীকার করে দিঘায় বেড়াতে আসেন। এসে এঁরাও অত্যন্ত মুগ্ধ হন। এঁদের মধ্যে একজন হলেন মি. জ়ে এফ স্নেইথ। তিনি প্রায় এক বছর পরে মেদিনীপুরের কালেক্টরের কাছ থেকে এক খণ্ড জমি কিনে বিরাট একটি বাংলো বানালেন। তারপর সকলকে উৎসাহ দিয়ে আরও অনেক বাংলো তিনি তৈরি করালেন এখানে। ধীরে ধীরে নতুন দিঘা গড়ে উঠতে লাগল। এরপর পশ্চিমবঙ্গের রূপকার ডা. বিধানচন্দ্র রায় ১৯৫৬ সালে দিঘা উন্নয়ন পরিকল্পনা করলেন।

অসমঞ্জবাবু কথা বলতে বলতে একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলেন। একটি মোটর আচমকা সজোরে এসে সামনে ব্রেক কষতেই সচকিত হলেন তিনি।

অসমঞ্জবাবু ‘স্যরি’ বলে পিছিয়ে এলেন একটু। মোটরটা আবার হু হু শব্দে উধাও হয়ে গেল। বাপ্পা অবাক চোখে সেদিকে তাকিয়ে থেকে বলল, এগুলো কোথায় যাচ্ছে বাবা এদিকে?

ওখানকার স্থানীয় অধিবাসী একজন কাছেপিঠেই ছিলেন। বললেন, মোহনার দিকে।

মোহনা! কোথায় ?

ওই যে ওইদিকে। ওই দেখা যায় লাইকানির চর। ওখানে মৎস্যজীবীদের বাস তো। জেলেরা গভীর সমুদ্র থেকে মাছ ধরে এনে জড়ো করে। ওই মাছ ট্রাকবোঝাই চালান যায় নানা স্থানে।

বাপ্পা বলল, বাপি যাবে?

কোথায়?

মোহনার দিকে।

যাব। তবে আজ নয়। আজ ঘাটের ধারে বসি সবাই। কাল যাব। বেড়াতে যখন এসেছি, তখন নিশ্চয়ই যাব। একদিনে সব কিছু দেখে ফেললে দেখা শেষ হয়ে যাবে। এই ছোট্ট জায়গাটা তখন আর ভাল লাগবে না।

অসমঞ্জবাবু আবার ঘাটের দিকে ফিরে এলেন। ঘাটের ধারে তখন কত কী বিক্রি হচ্ছে। কত রঙিন মাদুর। সামুদ্রিক দ্রব্যাদির খেলা। শাঁখের মালা। আরও কত কী। সুজাতাদেবী ঘুরেফিরে সেইসব দেখতে লাগলেন। অসমঞ্জবাবু একটা বোল্ডারের ওপর রুমাল পেতে বসলেন। আর বাপ্পা? সে চুপচাপ বসে থাকবার ছেলেই নয়। চারদিকের সুন্দর সুন্দর বাংলোবাড়ি, কোয়ার্টার, লজ দেখতে লাগল ঘুরেফিরে। দেখতে দেখতে সি বিচ ধরে এক পা, এক পা করে এগিয়েই চলল সে। চলতে চলতে ওকে যেন ক্রমশ চলার নেশাতেই পেয়ে বসল। খানিক যাবার পর বাপ্পা দেখল দিঘা সৈকতের সৌন্দর্য যেন আরও প্রকটিত হচ্ছে। চারদিকে শুধু ঝাউবন আর ঝাউবন। উঁচু উঁচু বালিয়াড়ি। ঠিক যেন ছোটখাটো বালির পাহাড় সব। ও যেই বাঁধা রাস্তার শেষে বালিয়াড়িতে নামতে যাবে, অমনি একটা ঝুপড়ির আড়াল থেকে সরেঙ্গা লম্বা রোগামতো পাগল-পাগল চেহারার একটি লোক লাফিয়ে পড়ল ওর সামনে। লোকটির মাথায় একটি লাল ফিতের ফেত্তি বাঁধা। হাতে বল্লম। মাথার চুল রুক্ষ এবং ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া। পাকানো গোঁফ। পরনে একটি জাঙ্গিয়া ও গেঞ্জিবিহীন হাতকাটা সোয়েটার। সেটি যেমনই ময়লা, তেমনি ছেঁড়া। লোকটি ওর পথ রোধ করে বুক ফুলিয়ে দাঁড়াল। তারপর কর্কশ গলায় বলল, এই তুম কৌন হ্যায় রে?

বাপ্পা তো আচমকা ওই মূর্তিমানকে দেখে ভয়ে চেঁচিয়ে উঠতে যাচ্ছিল। তবু নিজেকে সামলে অতি কষ্টে কাঁপতে কাঁপতে বলল, আমি বাপ্পা।

তোর বাড়ি কোথায়?

আমার বাড়ি কলকাতায়। সল্টলেকে।

লোকটি হঠাৎ বল্লমটি বালিতে গিথে অনেকটা আর্চ করার ভঙ্গিতে একটা ডিগবাজি খেয়েই বলে উঠল –

আমার নাম অ্যান্টনি ধিড়িঙ্গি

নইকো ট্যাস, নই ফিরিঙ্গি

হ্যান করেঙ্গে ত্যান করেঙ্গে

পকেটকা পয়সা লুঠকে লেঙ্গে।

বাপ্পা সভয়ে একটু পিছিয়ে এল। লোকটি বলল, কী আছে তোর কাছে বার কর।

ভয়ে বুক শুকিয়ে গেল বাপ্পার। বলল, আমার কাছে অন্য কিছু তো নেই, সামান্য কিছু খুচরো পয়সা আছে।

অন্য কিছু চাইছে কে তোর কাছে? খুচরো পয়সাগুলোই দে। ডোন্ট ডিলে, একদম দেরি নয়——কুইক। বার কর শিগগির। জলদি কর।

বাপ্পা পকেট হাতড়ে ভয়ে ভয়ে যা ছিল, সব বার করে দিল।

লোকটি সেগুলো হাত পেতে নিয়ে আনন্দে চোখদুটো বড় বড় করে বলল, বাঃ! বাঃ! বেড়ে বেড়ে। এতে আমার এক কাপ চা হবে। একটা পাউরুটি হবে। উপরন্তু বিড়িও হয়ে যাবে গোটাকতক। ওঃ হো। কী মজা! বাপ্পা পয়সাগুলো দিয়ে চলে আসছিল।

লোকটি বলল, হোয়াই আর ইউ রিটার্ন ব্যাক? আমি একটা ব্রেনলেস। আমাকে দেখে এত ভয় পাবার কী আছে? আমি যখন পয়সা পেয়ে গেছি, তখন আর কোনও ভয় নেই তোর।

বাপ্পা এবার একটু সাহস পেয়ে বলল, আমার কাছে যদি পয়সা না-থাকত?

তা হলেও ভয়ের কিছু ছিল না। কেন না আমি ছোট ছেলেদের কিছু বলি না। তবে তোকে দেখেই বুঝেছি তুই বেশ বড়লোকের ছেলে। তোর কাছে হাতপাতলে টু-পাইস পাওয়া যেতে পারে।

বাপ্পা এবার হেসে বলল, তা এই কি তোমার হাতপাতার নমুনা? তুমি বেশ মজার লোক তো?

লোকটি হোঃ হোঃ হোঃ হোঃ করে হাসতে হাসতে ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে চলতে লাগল দিঘাবাজারের দিকে মুখ করে। আর বলতে লাগল, দুর্গা মায়ি বচাকে রাখখা—দুর্গা মায়ি বচাকে রাখখা। যো দেগা উসকা ভি ভালা হোগা, যো নেহি দেগা উসকা ভি ভালা হোগা। সীতারাম ঝটপট…।

বাপ্পা কিছুক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে থেকে আস্তে আস্তে বালিয়াড়ির ওপর দিয়ে এগিয়ে চলল সামনের দিকে। একটা বালির ঢিপির ওপর উঠতেই দূরের অনেক কিছু দেখতে পেল। কত ঝাউবন এখানে। ও সাহস করে সেই ঝাউবনের দৃশ্য দেখতে দেখতে এক জায়গায় এসে থমকে দাঁড়াল। কী সুন্দর একটা জিনিস চক চক করছে সেখানে। সূর্যের আলো পড়ে চোখ যেন ঠিকরে পড়ছে। বাপ্পা কাছে গিয়ে সেটা হাতে নিয়েই অবাক হয়ে গেল। দেখল একটা রুপোর পদক। তাইতে ইংরেজিতে নাম লেখা আছে ‘নীতা সিং’, জিনিসটার মূল্য কতখানি, বাপ্পা তা জানে না। শুধু অনুমান করল, নিশ্চয়ই কোনও নীতা সিং তার মা-বাবার সঙ্গে দিঘা বেড়াতে এসে এই পদকটা এখানে হারিয়েছে এবং পরে মা-বাবার কাছে খুব বকুনিও খেয়েছে। যাক, এটা বাপির হাতে দিয়ে দিলে বাপি নিশ্চয়ই এটা ঠিক লোকের হাতে পৌঁছে দিতে পারবেন। কেন না বাপি তো পুলিশের লোক। এই ভেবে বাপ্পা পদকটা পকেটে নিয়ে এগিয়ে চলল। যেতে যেতে হঠাৎ কী মনে হতেই ফিরে এল বাপ্পা। একটা পাথরের টুকরো কুড়িয়ে নিয়ে যেখানে পদকটা পেয়েছিল সেইখানে একটি গাছের গায়ে নিজের নামটা লিখে রাখল। তারপর আবার এগিয়ে চলল সামনের দিকে। এক জায়গায় দেখল ছোট ছোট হোগলার ঘরে সমুদ্রের মৎস্যসন্ধানীরা তাদের ছোটখাটো সংসার পেতে বসে আছে। এদের সংখ্যা প্রায় দশ হাজার। কত মাছ কেনাবেচা হচ্ছে সেখানে। জেলেরা গভীর সমুদ্র থেকে মাছ ধরে এনে ডাঁই করে রেখেছে। বাপ্পা জানে মরশুমে এখানে মাছের উৎপাদন হয় ষাট হাজার টন। কী দারুণ আঁশটে গন্ধ। গা যেন ঘুলিয়ে ওঠে। মাছের নামে যেন ঘেন্না ধরে যায়। বাপ্পা আরও এগিয়ে চলে। ওই তো মোহনা। সারি সারি নৌকা বাঁধা আছে সেখানে। লাইকানি নদী এসে মিলিত হয়েছে সমুদ্রে। মাঝিরা অনেকেই স্নান সেরে খেতে বসেছে। কেউ কেউ গভীর সমুদ্রে মাছ ধরতে যাবার জন্য তৈরিও হচ্ছে। আর সুবিস্তীর্ণ বালুচরে শয়ে শয়ে লোক বসে জাল বুনে চলেছে আপন মনে। বাপ্পা অনেকক্ষণ ধরে সেই জালবোনা দেখতে লাগল। অদূরে দ্বীপের মতো একটা স্থানে ঘন ঝাউবনের শোভা দেখল। একজনকে জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা ওই যে জায়গাটা, ওটার নাম কী গো? ওর নাম শংকরপুর।

ওখানে লোক বাস করে?

নিশ্চয়ই। এখানে সর্বত্রই মানুষ বাস করে। বাঘভালুক এখানে নেই। কী নাম তোমার?

আমার নাম বাপ্পা রায়।

দিঘা বেড়াতে এসেছ বুঝি?

হা

সঙ্গে কে আছেন?

মামণি, বাপি দু’জনেই আছেন।

না না, এখানে?

এখানে আমি একা।

ও সর্বনাশ। শিগগির পালাও এখান থেকে। সন্ধে হয়ে আসছে। এতখানি পথ চলে এসেছ, ফিরতে যে রাত্রি হয়ে যাবে। তাড়াতাড়ি যাও। আর একটু পরেই ফাঁকা হয়ে যাবে সব।

বাপ্পা গর্বের সঙ্গে বলল, হোক না ফাঁকা। আমি ফাঁকা জায়গাতেও ভয় পাই না।

ওঃ হোঃ। তুমি বুঝছ না কেন খোকা, ভয় না-পেলেও এসব জায়গা ভাল নয়। অনেক রকমের বদ লোক ঘোরাফেরা করে এখানে, তা ছাড়া এই দারুণ শীতে উঁচুনিচু রাস্তায় অন্ধকার হয়ে গেলে তুমি ফিরবে কী করে?

বাপ্পা বলল, বদ লোকই হোক, আর যেই হোক, কেউ আমার কিছু করতে পারবে না। আমার বাবা কলকাতার গোয়েন্দা পুলিশের একজন নামকরা অফিসার। সবাই ভয় করে আমার বাবাকে।

তা হোক। তবু তুমি যাও। তবে সাবধানে! উঁচু বালিয়াড়ির ওপর দিয়ে যাবে কিন্তু। কেন না এখন জোয়ার আসার সময় হয়ে গেছে। এ তো তোমাদের গঙ্গার জোয়ার নয়, সমুদ্রের। খুব তাড়াতাড়ি জল চলে আসে।

বাপ্পাও অবশ্য দেরি করল না আর। বিশেষত এই সব শোনার পর কে আর দেরি করে? মোহনা দেখবার শখ ছিল মিটে গেছে। তবে একটা ভুল সে করেছে। এখানে আসবার আগে বাপিকে বা মামণিকে একবার জানিয়ে আসাটা উচিত ছিল তার। এতক্ষণে তাঁরা নিশ্চয়ই খোঁজাখুঁজি শুরু করে দিয়েছেন। অবশ্য সত্যিকথা বলতে কী, ও যে এখানে আসবে তার তো কোনও ঠিক ছিল না। সে নিজের মনে ঘুরতে ঘুরতেই চলে এসেছে এখানে। বেশ খানিকটা চলে আসার পর সমুদ্রের খুব সাংঘাতিক রকমের গর্জন শুনতে পেল বাপ্পা। সেই সঙ্গে দেখতে পেল বড় বড় ঢেউয়ের জলোচ্ছ্বাস। এক এক লহমায় সমুদ্র যেন দিঘা সৈকতকে গ্রাস করবার জন্য এগিয়ে আসছে, এক সময় দিগন্তের বুক থেকে দিনান্তের শেষ রংটুকুও মুছে গেল। ধীরে ধীরে ঘন অন্ধকার গ্রাস করল সৈকত, বালিয়াড়ি ও ঝাউবনকে।