দশ
খুশির আরও একটা কারণ আছে।
কাল সন্ধ্যার অন্ধকারে অসমঞ্জবাবুর মৃত্যুসংবাদটা চারদিকে ছড়িয়ে পড়লেও, আজ সকালে জানা গেছে তিনি বেঁচেই আছেন। এবং সুস্থ শরীরে এখানকার হাসপাতালে বিশ্রাম করছেন। জ্যাঙ্গোর দলের আততায়ীরা তাঁকে গুলি করলেও সেটি তাঁর বাঁ কাঁধের ওপর দিকে লাগে। সাময়িকভাবে তিনি সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েন যদিও, এখন তিনি অপারেশনের পর সম্পূর্ণ সুস্থ। শুধু ক্ষতস্থানটা শুকিয়ে যেতে যেটুকু সময় লাগে।
কিন্তু তবুও এই খুশির শেষেও একটু অখুশির রেশ আছে। দিঘা সৈকতে আতঙ্ক না থাকলেও এখন যা আছে তা শুধুই রহস্য। অর্থাৎ যাকে নিয়ে এত কাণ্ড সেই বাপ্পাই তো নেই।
সুজাতাদেবী পাষাণপ্রতিমার মতো বসে আছেন।
অসমঞ্জবাবু উদাস চোখে বসে আছেন জানালার বাইরে দৃষ্টি মেলে দিয়ে। এছাড়া উপায়ই বা কী? আর কিছুই তো ভাবতে পারছেন না তিনি। অ্যাটম আর পেটোর কথা সুজাতাদেবীর মুখ থেকে শুনেছেন। এই দুই অসম সাহসী ভূঁইফোঁড় হঠাৎ না গজালে বাপ্পা বা সুজাতাদেবী কারও হদিসই পাওয়া যেত না। সুজাতাদেবী ফিরে এসেছেন। কিন্তু বাপ্পা? বাপ্পা কই? কোথায় গেল ছেলেটা? অ্যাটম আর পেটোও নেই। তাদের নামই শুনেছেন শুধু, কিন্তু তাদের চেহারা দেখেননি। কাল রাত থেকে এরাও নিখোঁজ। যেমন ধূমকেতুর মতো উদয় হয়েছিল তেমনই কর্পূরের মতো উবে গেছে।
অসমঞ্জবাবু এবং সুজাতাদেবী যখন চুপচাপ বসে বসে বাপ্পার কথা ভাবছিলেন সেই সময় হঠাৎ বাইরে প্রচণ্ড কোলাহল।
একজন লোককে ধরে টানতে টানতে ঘরের ভেতর নিয়ে এসে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল পুলিশের লোকেরা। এটা হাসপাতাল হলেও আলাদা একটা কেবিন, তাই রক্ষে। অসমঞ্জবাবু লোকটির দিকে তাকিয়ে চমকে উঠলেন। এ তো সেই লোক যাকে তিনি মনে মনে সন্দেহ করেছিলেন। লোকটি মুখ থুবড়ে পড়ে গেল ঘরের মেঝেয়। ওর হাতের বল্লমটি ছিটকে পড়ল এক কোণে! লোকটি মেঝে ধরে কোনওরকমে উঠে বসল। তারপর বল্লমটি টেনে নিল ধীরে ধীরে। বল্লমের ডগায় জমাট লাল রক্ত।
এ কী! রক্ত! রক্ত কেন?
ওকেই জিজ্ঞেস করুন স্যার। এই বল্লমটা দিয়ে একজন লোককে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মেরে তাকে টানতে টানতে রাস্তা দিয়ে নিয়ে আসছিল। লোকটা যে এরকম শয়তান তা আমরা এর আগে বুঝতে পারিনি। উঃ কী সংঘাতিক! অসমঞ্জবাবু বললেন, তাই যদি হয় তা হলে ওকে আমার কাছে নিয়ে এলে কেন? থানায় নিয়ে যাও।
থানাতেই নিয়ে যাচ্ছিলাম। কিন্তু তার আগে ও একবার আপনার সঙ্গে দেখা করতে চাইল।
আমার সঙ্গে? কেন, কী ব্যাপার !
লোকটি আস্তে করে বলল, বাবু! বাবুমশায় গো! আমার অপরাধ লিবেন না, আমার নাম অ্যান্টনি ধিডিঙ্গি নইকো ট্যাস নই ফিরিঙ্গি নই হিন্দু নই মুসলমান নই পার্শি নই কেরেস্তান।
কিন্তু বাবু আমি এক মনিষ্যি বটে। এই যে বল্লমের ডগায় লাল অক্তটা দেখতেছেন এই অক্ত আমার শরীলেও বইছে। সবাই বলে আমি নাকি ‘ব্রেনলেস’। বাট আয়্যাম নাউ সিক্সটি ফাইভ ইয়ার্স ওল্ড। আই নোজ, টু প্লাস টু ইজিকল্টু ফোর। থ্রি ইনটু থ্রি ইজিকল্টু নাইন, অ্যান্ড ওয়ান মাইনাস ওয়ান ইজিকল্টু জিরো। আমি দীর্ঘদিন ধরে একটা লোককে খুন করব ভাবছিলাম। আজ করেছি। সে আমার একমাত্র সন্তানকে বিপথগামী করেছে। অনেক সময় হাতের মুঠোয় লোকটাকে পেয়েও কিছু করতে পারিনি। কারণ ওকে খুন করে আমি জেলে গেলে আমার ছেলেকে রক্ষা করত কে? এখন আমার ছেলে নেই। কিন্তু আমি আছি। আমার জেল হলে আমি সুখে থাকব। ফাঁসি হলেও দুঃখ নাই।
অসমঞ্জবাবু বললেন, বেশ তো। কিন্তু এই ব্যাপারে তুমি আমার কাছে এসেছ কেন? আমি তোমার জন্য কী করতে পারি?
দুর্গা মায়ি বাচাকা রাখা। শুধু আমার একটা প্রশ্নের জবাব আপনাকে দিতে হবে। খুনিরা তো খুন করে পালায়। ধরা পড়লে তাদের ফাঁসি হয়। কিন্তু আমি যে খুন করে খুনের লাশ নিয়ে শহরময় ঘোরালাম আমার কী শাস্তি হবে? আমি নিজে ধরা না-দিলে আপনাদের পুলিশ আমাকে ধরতে পারত না। তা যদি পারত তা হলে বাবু, যে ছেলেটা আপনাদের চোখের সামনেই ‘গুম’ হয়ে ছিল তাকে আপনারা ঠিকই খুঁজে বার করতে পারতেন।
কার কথা বলছ তুমি?
আপনি একজন ঝানু গোয়েন্দা। বুঝতে এত দেরি করলেন বাবু? আমি আপনার ছেলের কথাই বলছি। আপনার ছেলেকে ফিরিয়ে আনতে গিয়ে আমার ছেলেটাই তো ফিরল না। তা বাবু আমার ছেলের রক্তের দামটা আপনারা কীভাবে দেবেন? খারাপ কাজ করলে তো আপনাদের আইনে শাস্তি মেলে। কিন্তু ভাল কাজ করলে তার জন্যে কিছু ইনাম তো মেলা উচিত?
আমার ছেলে ডাকু ছিল, লুটেরা ছিল, আইনের চোখে দাগি ছিল। কিন্তু বাবু আপনার বউ-বাচ্ছার জান বাঁচাতে সে তার জীবন দিয়েছে। আমার ছেলের নামে হুলিয়া ছিল বাবু। তাই আপনার কাছে আমার একটাই আর্জি স্রেফ ইনাম হিসেবে ওর নামের পাশে একটু কিছু ভাল কথা লিখে দেবেন।
অসমঞ্জবাবু অবাক হয়ে বললেন, তুমি কার কথা বলছ বলো তো? আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।
লোকটি হাউ হাউ করে কেঁদে উঠে বলল, আমি ওই হতভাগা সুখেনটার বাবা বটে।
অসমঞ্জবাবু এবার উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, আপনি সুখেনের বাবা?
হ্যাঁ। আমি ওর বাবা। তবে বাবু, আমি তো শ্রীমান অ্যান্টনি ধিড়িঙ্গি। আমি একটা খুনী। আমি নেউল দাসকে মার্ডার করে রাস্তায় ঘোরাচ্ছিলাম। আপনি আমাকে ‘আপনি’ বলবেন না। ওই ব্যাটা নেউল দাস আপনার ছেলেটাকে নিয়ে ভাগছিল। ভাগ্যিস চোখে পড়ল আমার। রাগের মাথায় দিলাম বল্লমটা ওর পেটের ভেতর ঢুকিয়ে।
আমার ছেলেটা? তার কোন ক্ষতি হয়নি তো?
না! বহুকষ্টে ছেলেটাকে উদ্ধার করে এক জায়গায় লুকিয়ে রাখা হয়েছিল। তা ব্যাটা ঠিক টের পেয়ে সেখান থেকে নিয়ে পালাবার তাল করছিল। এখন বাবু আপনি আমাকে ডবল ফাঁসির আসামি সাজিয়ে ছেলেটাকে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করুন। তবে কিছু মনে করবেন না বাবু, আপনারা পুলিশরা কোনও কাজের নন। সেই জন্যেই ছেলেটা ক’দিন এত কষ্ট পেল। আপনারা শুধু পেটাতেই জানেন। কাজ জানেন না।
অসমঞ্জবাবু আর সুজাতাদেবী হাঁ হাঁ করে উঠলেন, কোথায়? কোথায় আমার ছেলে? কোনখানে কীভাবে আছে সে?
ছেলেটা আমার কাছেই আছে বাবু। কাল সারারাত সে একটা গাছের ডালে ছিল। এখন বোধহয় ঘুমুচ্ছে। বাবু, আপনারা যখন শহর তোলপাড় করতেন, বন-জঙ্গল ঢুড়ে ফেলতেন, আমি তখন সি আই ডি বনে গিয়েছিলাম। ছেলে হারানোর ব্যথা আমার চেয়ে বেশি আর কে বোঝে বাবু? তবে এই কাজের জন্যে সবচেয়ে বেশি কৃতিত্ব যারা দাবি করতে পারে তারা হল অ্যাটম আর পেটো নামে দুটি ছেলে। ওই দুই খুদে বিচ্ছু যেমনই বদ, তেমনই বিশ্বাসী। একটি পোড়ো বাড়ির আন্ডারগ্রাউন্ডে আপনার ছেলেকে আবিষ্কার করার পর যখন তাকে উদ্ধার করার চেষ্টা করে ওরা, তখন থেকেই আমি ওদের নজরে রাখছিলাম। ওরা আপনার ছেলেকে উদ্ধার করে চন্দনেশ্বরের বাদামবনে একটি গাছের মগডালে মাচায় শুইয়ে রেখে শয়তানের ঘাঁটি আবিষ্কারে যাচ্ছিল যখন, আমি তখন সেই নির্জনে বল্লম হাতে একাই ওকে পাহারা দিচ্ছিলাম। ভেবেছিলাম ওরা ফিরে এলে সবাই একসঙ্গে ছেলেটাকে আপনার হাতে তুলে দেব। কিন্তু তার আগেই দেখি নেউল দাস ছেলেটাকে গাছ থেকে নামিয়ে মিথ্যে পরিচয় দিয়ে ভাগবার তাল করছে। গেল মাথাটা গরম হয়ে…। বাবু, জগজিৎ সিং জ্যাঙ্গোর সব লোকই মরেছে। শুধু বাকি ছিল ওই নেউল দাসটা। ওটাকে আমিই শেষ করে দিলাম।
আপনার কাছে আমি কৃতজ্ঞ ধিড়িঙ্গিবাবু। আপনি আমার ছেলেকে ফিরিয়ে দিন। আই মাস্ট ডু ফর ইউ।
লোকটি বলল, আসুন তা হলে আমার সঙ্গে।
সুজাতাদেবী অসমঞ্জবাবুকে বললেন, তুমি না। এখন তোমার কোথাও না-যাওয়া উচিত। আমি যাই। আমি বাপ্পাকে নিয়ে এসে তোমার কোলে তুলে দেব।
অসমঞ্জবাবু বললেন, না না। আমিও যাব। তা ছাড়া ও একটু আধটু ব্যাথায় আমার কিচ্ছু হবে না। আমার বাপ্পাকে ফিরে পাব শুনে আমি আমার পূর্ব শক্তি আবার ফিরে পেয়েছি তা কী জানো?
অসমঞ্জবাবু ও সুজাতাদেবী দু’জনেই চললেন লোকটির সঙ্গে বাপ্পাকে ফিরিয়ে আনতে। সঙ্গে চলল দু’তিন গাড়ি পুলিশ।
চন্দনেশ্বরের মন্দিরের সামনে গাড়ি থামতেই দলেদলে লোক এসে ভিড় করল সেখানে। দু’জন পাণ্ডা গলায় ফুলের মালা পরানো বাপ্পাকে নিয়ে এসে সমর্পণ করল অসমঞ্জবাবু ও সুজাতাদেবীর হাতে।
বাপ্পা তো মা-বাবাকে পেয়ে খুশির জোয়ারে উপচে উঠে জড়িয়ে ধরল দু’জনকে।
সুজাতাদেবী ও অসমঞ্জবাবুও বাপ্পাকে বুকে জড়িয়ে স্থির হয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। তাঁদের দু’জনেরই চোখে তখন আনন্দের অশ্রু।
এরই মধ্যে এক ফাঁকে বাপ্পা ‘নীতা সিং’-এর নাম লেখা সেই রুপোর পদকটিকে বার করে অসমঞ্জবাবুর হাতে দিয়ে বলল, বাপি এটা তোমার কাছে রেখে দাও। সেদিন বালিয়াড়িতে এই পদকটা আমি কুড়িয়ে পেয়েছিলাম। আমার কী মনে হচ্ছে জান বাপি, এই ‘নীতা সিং’কেও বোধহয় আমার মতো জোর করে কোথাও লুকিয়ে রেখেছিল কেউ। তুমি তো অনেক কিছুই জান, একটু খোঁজ নিয়ে দেখবে এই ‘নীতা সিং’ কখনও তার মা-বাবার কাছে ফিরে যেতে পেরেছিল কি না?
অসমঞ্জবাবু পদকটা পকেটে ঢুকিয়ে রেখে বললেন, নিশ্চয়ই দেখব বাবা। এখন থেকে এই কাজের দিকেই আমি বেশি করে জোর দেব।
সুজাতাদেবী বললেন, আর দেরি নয়। এখন চলো যাঁর কৃপায় আমরা আমাদের হারানিধিকে ফিরে পেয়েছি সর্বাগ্রে তাঁর পুজোর কাজটা সেরে আসি।
পাগলা অ্যান্টনি মন্দিরের চাতালে বসে ছেলের শোকে মাথা খুঁড়ে বিলাপ করতে লাগল।
অসমঞ্জবাবু ও সুজাতাদেবী বাপ্পাকে সঙ্গে নিয়ে পূজার ডালি হাতে মন্দিরে প্রবেশ করলেন।