দিঘা সৈকতে আতঙ্ক – ১

এক

বাপ্পার চোখদুটো আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠল।

পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই যে এইরকম একটা সুযোগ এসে যাবে, তা ও ভাবতেও পারেনি। অঘ্রাণের এই সোনাঝরা দিনে দিঘা সৈকতের হাতছানি ওকে যেন পাগল করে তুলল।

ওয়ারেন হেস্টিংস একদা যে দিঘাকে আবিষ্কার করেছিলেন এবং আজও যে দিঘার আকর্ষণে শতসহস্র মানুষ ছুটে যায়, সেই স্বপ্নের দিঘায় বেড়াতে যাবার সাধ কি ওর একদিনের? ওরই স্কুলের রঞ্জন, পিনাকী, দেবাশিস ওদের বাবামায়ের সঙ্গে কতবার দিঘা গেছে। তাদের মুখে কত গল্প শুনেছে ও। তা ছাড়া ওদের এলাকা থেকে রিজার্ভ বাস তো বছর-বছরই ছাড়ে। বছরের প্রায় সব সময়ই একটা না একটা দীঘা স্পেশাল’ ছেড়েই থাকে। দলে দলে লোক যায়। দিঘা সৈকতে ভ্রমণ করে অপার আনন্দ নিয়ে ফিরে আসে। আর খবরের কাগজগুলো তো দিনের পর দিন লোভনীয় বিজ্ঞাপনে সুন্দরী দিঘায় আসার আমন্ত্রণ জানায় মানুষকে। সেই সব বিজ্ঞাপনের স্কেচ দেখে, এরওর মুখে গল্প শুনে, মনে মনে দিঘা সম্বন্ধে একটা ধারণাই করে ফেলেছে বাপ্পা। তাই মা’র মুখে দিঘার কথা শুনেই লাফিয়ে উঠল সে। আনন্দের উচ্ছ্বাসে মায়ের দু’হাত আঁকড়ে ধরে বলল, সত্যি! কবে যাবে মা?

বাপ্পার মা সুজাতাদেবী সস্নেহে ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন, বাপি সন্ধের পর বাড়ি আসুক। তারপর দিনটা ঠিক হবে। যদি ছুটি পান তো কালই।

মা! আবেগে বাপ্পার গলা দিয়ে যেন শব্দ বেরোতে চায় না। সত্যি বলছ বাপি যদি ছুটি পান তো কালই?

হ্যাঁ রে হ্যা। যদি ছুটি পান তো কালই। না হলে যেদিন ছুটি পাবেন সেদিনই, মোটকথা তোর বাপি এতদিনে রাজি হয়েছেন দিঘায় যেতে।

আনন্দে অভিভূত বাপ্পা ঘরে বসেই যেন ওর মানসচোক্ষে সমুদ্রকে দেখতে পেল।

বাপ্পার বাবা কলকাতার গোয়েন্দা পুলিশের একজন পদস্থ অফিসার। নাম অসমঞ্জ রায়। এমনিতে পুলিশের লোক বলতে সাধারণত যেরকম হয়, উনি কিন্তু তার সম্পূর্ণ বিপরীত। অত্যন্ত সাদামাটা সুদর্শন লোক। মুখে হাসিটি লেগেই আছে সবসময়। স্ত্রী সুজাতাদেবী এবং বারো বছরের বাপ্পাকে নিয়ে সুখের সংসার। এই সৎ ও ভদ্র মানুষটি অঞ্চলের সকলের কাছেই অত্যন্ত জনপ্রিয়। যাই হোক! মা’র মুখে দিঘার কথা শোনার পর বাপ্পা যেন অস্থির হয়ে উঠল।

বাপি যে কখন সন্ধের পর বাড়ি আসবেন, সেই আশাতেই অধীর হয়ে উঠল সে। আনন্দের বন্যাটা মনের মধ্যে প্রবল বেগে আলোড়িত হলেও, সেটা অবশ্য ছড়িয়ে পড়তে পারল না। তার কারণ, ওই যে মা বললেন ‘যদি ছুটি পান তো কালই।’ কিন্তু যদি ছুটি না-পান? তা হলে? তা হলে কবে, কতদিনে? দিন স্থির করলেও কি যাওয়া হবে? হয়তো তখন এমন একটা জরুরি কাজ এসে পড়বে যে, যাত্রা স্থগিত রেখে বাপিকে তখন ছুটির দিনেও ছুটোছুটি করতে হবে।

তাই এক দারুণ উত্তেজনায় ছটফট করতে লাগল বাপ্পা। অথচ বাপিটা কী! আগে থেকে অফিসকে না জানিয়ে কিছুতেই অফিস কামাই করবেন না। বাপি নিজেই তো বলেন, সারা বছরের কত ছুটিই তাঁর পচে যায়। বাপ্পা ভেবেই পায় না ছুটি কী করে পচে। ছুটি কি আলু, না বরফচাপা মাছ? ছুটি-ছুটিই। তবুও বাপির ছুটি নাকি পচে যায়। যাই হোক, বাপি আগে থেকে অফিসকে না-জ়ানিয়ে ছুটি নেবেন না। এবং রবিবার বা অন্য কোনও ছুটির দিন কোথাও বেড়াতে যাবেন না। বাপির ধারণা ছুটির দিনে নাকি কোনও বেড়ানোর জায়গায় যেতে নেই। তা হলে নাকি খুব একটা ভিড়ভাট্টার মধ্যে পড়ে যেতে হয়। অনেক সময় পছন্দমতো ঘর পাওয়া যায় না। সত্যিই কি? হয়তো তাই। বাপি তো অনেক বোঝেন। বাপি বুদ্ধিমান লোক। তবে বাপ্পা যদি বাপির মতো হত, তা হলে যখন যেখানে মন চাইত, চলে যেত।

যাই হোক, সারাদিনের দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান হল বিকেল চারটেয়। অসমঞ্জবাবু বাপ্পাকে চমকে দিয়ে হঠাৎই এসে পড়লেন বিকেলে। বাপ্পা বাপিকে দেখেই অবাক হয়ে বলল, কী হল বাপি! তুমি এত সকাল-সকাল ফিরলে যে?

অসমঞ্জবাবু সস্নেহে বাপ্পাকে কাছে টেনে নিয়ে বললেন, রোজই তো দেরি করে আসি। তাই আজ একটু সকাল করেই, ফিরলাম। বলে বাপ্পার চিবুক ধরে একটু আদর করে বললেন, কেন, মামণি কিছু বলেননি তোমাকে?

হ্যা। তুমি ছুটি পেয়েছ বাপি?

পেয়েছি।

তা হলে কালই যাচ্ছি আমরা?

কালই। খু-উ-ব সকালে। তুমি কিন্তু আজ একটু তাড়াতাড়ি ঘুমোবে এবং কাল খুব ভোরে উঠবে। অনেক বেলা পর্যন্ত ঘুমিয়ে রোদ উঠলে তারপর উঠবে, এইরকম যেন করবে না, বুঝলে?

না-না-না। তুমি দেখে রেখো, আনন্দে হয়তো আমার সারারাত ঘুমই হবে না।

আমি খু-উ-ব ভোরে উঠব। তোমরা ওঠার অনেক আগেই উঠে পড়ব আমি। আমিই তোমাদের ঘুম থেকে ডেকে তুলব।

অসমঞ্জবাবু ঘরে এসে মুখহাত ধুয়ে জামাপ্যান্ট ছেড়ে সোফায় দেহটা এলিয়ে দিলেন। বাপ্পার মা সুজাতাদেবী কফি আর টোস্ট এনে বললেন, তা হলে কালই যাচ্ছ তো?

বাপ্পার বাবা সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়লেন।

এদিকে ছেলে তো শুনেই লাফালাফি শুরু করে দিয়েছে। না-গেলে দারুণ মন খারাপ হয়ে যেত ওর।

অসমঞ্জবাবু টোস্টে কামড় দিয়ে হাসিমুখে কফির পেয়ালায় চুমুক দিয়ে বললেন, তোমার মন খারাপ হত না? তারপর বললেন, দিন চারেকের মতো ছুটি পেয়েছি। অনেকদিন ধরেই যাব যাব ভাবছি, অথচ যাওয়া আর হয়ে উঠছে না। তা ছাড়া বাপ্পাটা প্রায়ই দিঘা দিঘা করে। পুরী তো তিন-চার বার গেলাম। এবার দিঘাতেই যাই। পশ্চিম বাংলার উপকূলে এমন চমৎকার সমুদ্রসৈকত রয়েছে অথচ আমরা অবহেলা করে যাই না।

সুজাতাদেবী বললেন, আমরা অবহেলা করে যাই না বলতে যদি তুমি আমাদের পরিবারের কথা বলো, তা হলে অবশ্য আলাদা। না হলে আমরা সবাই দিঘায় যেতে চাই। দলে দলে মানুষ দিঘার হাতছানি পেয়ে দিঘার ছুটছে। তুমিই শুধু বলো পুরীর কাছে দিঘা! তুমিই তো বলো, কী আছে দিঘায়? গঙ্গার জলের মতো ঘোলা জল, ছোট ছোট ঢেউ, একেবারে বাজে জায়গা। ওতে সমুদ্র দেখার সাধ মেটে না। দিঘায় যাওয়া মানেই গঙ্গার বড় একটু আকার দেখতে যাওয়া।

বাপ্পা চোখদুটো বড় করে বলল, সেকথা ঠিক। শুধু বাপি কেন, অনেকেই সেকথা বলে। পুরীর কাছে দিঘা হয়তো কিছুই নয়। তবুও দিঘা দিঘাই। দিঘার কোনও বিকল্প নেই। জানো বাপি, আমি শুনেছি দিঘায় অনেক ঝাউবন আছে। খুব ঘন ঝাউবন। দিঘায় অনেক উঁচু উঁচু বালিয়াড়ি আছে।

সুজাতাদেবী বললেন, এই তো সেদিন কীসে যেন পড়লাম, দিঘা উন্নয়ন পরিকল্পনা দিঘাকে আরও মনোরম, আরও সুন্দর করে গড়ে তুলতে চারশো চুয়াল্লিশ একর জায়গা নিয়ে দিঘাকে সৌন্দর্যময়ী করে তুলছেন। এখানে তৈরি হবে ডিয়ার পার্ক। সুন্দর একটি মিনি বোটানিক্যাল গার্ডেন। একশো একর জায়গা নিয়ে তৈরি হবে একটি কৃষি গবেষণাগার। সে যাই হোক, দিঘার সবচেয়ে বড় আকর্ষণ হল সমুদ্র এবং তার সুন্দর শক্ত ও মসৃণ সৈকত। হাঁটলে পায়ে কাদা লাগে না। সমুদ্রপ্রেমিক পর্যটকরা দিঘার সি বিচকে পৃথিবীর বিখ্যাত ‘মিয়ামি সি বিচের’ সঙ্গেও তুলনা করেন।

বাপ্পা তার ডাগর-ডাগর চোখ মেলে মায়ের মুখের দিকে তাকিয়েছিল এতক্ষণ, সব শুনে বলল, বলো কী! ‘মিয়ামি সি বিচের’ কথা বইতে পড়েছি। রেডিয়োতেও একদিন শুনছিলাম। তার সঙ্গে দিঘার তুলনা! আজকেই কাগজে পশ্চিমবঙ্গ সরকার দিঘা সৈকতের একটা ছবি দিয়ে বিজ্ঞাপন ছেপেছে। দেখবে? বলেই ফুড়ুত করে ঘর থেকে উধাও হয়ে গেল বাপ্পা।

অসমঞ্জবাবু কফির পেয়ালায় শেষ চুমুক দিয়ে হাসতে হাসতে বললেন, পাগল ছেলে কোথাকার।

সুজাতাদেবী সস্নেহে বাপ্পার চলে যাওয়া দেখলেন। তাঁর বুকের গভীরে তখন অপূর্ব সুখের অনুভূতি। প্রাণোচ্ছল সন্তানের এই ভ্রমণের উন্মাদনা তাঁর মনকেও মাতিয়ে তুলেছে।

পরদিন খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠলেন অসমঞ্জবাবু। পাছে ঘুম ভাঙতে দেরি হয় তাই ঘড়িতে অ্যালার্ম দিয়ে রেখেছিলেন।

সুজাতাদেবীরও ঘুম ভাঙল। আর বাপ্পা? তাকে ডাকার সঙ্গে সঙ্গেই ফিক করে হেসে ফেলল সে। বলল, আমি তোমাদের চেয়েও অনেক আগে উঠেছি। লেপের গরমে চুপচাপ শুয়েছিলাম শুধু। বুঝলে? কিন্তু বাপি, শীতটা তো বেশ জাঁকিয়ে পড়েছে। এত ভোরে গেলে তোমার কষ্ট হবে না? তুমি যে বেশি শীত একদম সহ্য করতে পার না।

অসমঞ্জবাবু বললেন, না। তবে তুমি কিন্তু চট করে দাঁত মেজে, মুখ ধুয়ে তৈরি হয়ে নাও। হিরুদা এখুনি আসলেন বলে। এখন ঠিক চারটে। আর পাঁচ-দশ মিনিটের মধ্যে এসে পড়বেন হিরুদা।

বাঁধা-ছাঁদা যা করবার, তা রাত্রেই করে রেখেছিলেন ওরা। এখন শুধু বাথরুমের কাজ সেরে তৈরি হয়ে নেওয়া। ওরা যখন তৈরি হচ্ছেন, ঠিক সেই সময়ই বাইরে মোটরের হর্ন শোনা গেল।

অসমঞ্জবাবু হেঁকে বললেন, এক মিনিট।

বাপ্পা দরজা খুলে বাইরে এল। হিরুকাকা মোটরের ভেতর থেকেই চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কত দেরি?

বাপ্পা বলল, হয়ে গেছে।

অসমঞ্জবাবু ও সুজাতাদেবী ঘরের আলো নিভিয়ে বাইরে এসে দরজায় তালা দিলেন। তারপর মোটরে উঠে পিছনের সিটে বাপ্পাকে নিয়ে শালমুড়ি দিয়ে তিনজনে গুছিয়ে বসতেই, হিরুকাকা ঝড়ের গতিতে উড়িয়ে নিয়ে চললেন অ্যামবাস্যাডারটাকে।

কী প্রচণ্ড শীত আজ। রক্তমাংসের শরীরের ভেতর যে হাড়গুলো আছে, সেগুলো পর্যন্ত কনকনিয়ে উঠল ঠান্ডায়।

খুব অল্প সময়ের মধ্যেই সল্টলেক থেকে হাওড়ায় এসে পড়লেন ওঁরা। এতে ভোরে রাস্তা-ঘাট সব ফাঁকা। কাজেই বিলম্ব হল না। বিনা বাধায়, বিনা ট্রাফিক জ্যামে নির্ধারিত সময়ে পৌঁছে গেলেন।

এবার ট্রেনের পথ। হাওড়া থেকে লোক্যাল ট্রেনে মেচেদা। ঝক্কি কী কম? এরপর আবার ট্রেন থেকে নেমে বাস। সেই বাসে চেপে চার পাঁচ ঘণ্টা হু হু করে ছোটার পর দিঘা।

মেচেদায় ওরা যখন ট্রেন থেকে নামল, তখন সকাল সাতটা। সারি সারি বাস এই জেলার বিভিন্ন প্রান্তে যাবার জন্যে অপেক্ষা করছে। সোনারোদ্দুর ঝরে পড়ছে অকৃপণভাবে। শীতের সকালে এই রোদের ঝলমলানি খুবই ভাল লাগল বাপ্পার।

অসমঞ্জবাবুকে দেখেই কয়েকজন কন্ডাক্টর ছুটে এল, দিঘা যাবেন নাকি বাবু?

এই যে দিঘার বাস দাঁড়িয়ে আছে এখানে। এই বাসটা আগে ছাড়বে। অসমঞ্জবাবু বললেন, কিন্তু ও-বাস তো ভরতি। আমরা একটু ভাল করে আরামে বসে যেতে চাই।

এতেও বসার জায়গা পাবেন বাবু। ড্রাইভারের পাশে সামনের দিকে ভাল বসার সিট আছে।

অসমঞ্জবাবু উঠলেন। উঠে ড্রাইভারের পাশে চারজনের বসার মতো লম্বা গদিওয়ালা সিট দেখে খুব খুশি হয়ে সুজাতাদেবীও বাপ্পাকে ডাক দিলেন। বেশ ভাল বাস। ঝকঝকে-তকতকে। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। চমৎকার। বাপ্পা তো দারুণ খুশি।

সামনের কাচ দিয়ে চারদিক কী সুন্দর দেখা যাচ্ছে। প্রাইভেট বাস। অথচ লাক্সারি বাসের মতো। ক্যাসেটের গানও শোনা যাচ্ছে। হিন্দি গান অবশ্য, সময় কাটানোর পক্ষে এই-ই বা মন্দ কী?

ওরা বসার সঙ্গে সঙ্গেই ড্রাইভারও উঠল। অসমঞ্জবাবু ড্রাইভারকে বললেন, বাস কখন ছাড়বে? একটু চা-টা খেয়ে আসা যাবে?

ড্রাইভার বলল, না না। এখনই ছাড়বে বাস। এখন চা খেতে যাবেন না। কাঁথির আগে বড় স্টপেজও কিছু নেই। কাঁথিতে বাস দশ মিনিট থামবে। ওইখানে যা ইচ্ছে খাবেন। সবকিছু পাওয়া যাবে ওখানে। বলতে বলতেই ছেড়ে দিল বাস।

তমলুকের ওপর দিয়ে গিয়ে নরঘাটের হলদি নদীতে মাতঙ্গিনী সেতু পেরিয়ে বাস উল্কার গতিতে ছুটে চলল। তারপর বিভিন্ন গ্রামগঞ্জ পার হয়ে বেলা এগারোটা নাগাদ বাস এসে পৌঁছুল কাঁথিতে।

বাপ্পা বলল, বাপি, কাঁথিকেই তো কণ্টাই বলে, তাই না?

হ্যাঁ। এখানে কাজু বাদামের চাষ হয়। আর এই কাঁথি থেকেই ন’কিলোমিটার দূরে জুনপুট। জুনপুটের নির্জন সমুদ্রতীরও ভারী মনোরম জায়গা।

শংকরপুর, খেজুরি, হিজলি সবই এখান থেকে কাছাকাছি। তা ছাড়া বঙ্কিমচন্দ্রের বিখ্যাত কপালকুণ্ডলার মন্দির এইখান থেকেই দেখতে যায় লোকে। আমরা যাব না বাপি?

ফেরার দিন যদি সময় পাই তো যাব।

সুজাতাদেবী বললেন, খুব চা-তেষ্টা পাচ্ছে বাপু আমার। একটু চায়ের ব্যবস্থা করো।

অসমঞ্জবাবু বললেন, অবশ্যই। যা ঠান্ডা, তাতে এবার একটু চা না-খেলেই নয়। তার ওপর এতখানি জার্নির পর খিদেও পেয়েছে। এবার পেটেও কিছু দিতে হবে।

ড্রাইভার বলল, যা করার তাড়াতাড়ি করুন।

অসমঞ্জবাবু আর বাপ্পা নীচে নামল। কাছেই চায়ের দোকান। গরম গরম কিছু শিঙারা আর জিলিপি ঠোঙাভরতি কিনে সুজাতাদেবীর হাতে দিয়ে, অসমঞ্জবাবু চায়ের অর্ডার দিলেন। চা তৈরি হলে এক কাপ চা সুজাতাদেবীকে এগিয়ে দিয়ে নিজেরা দোকানে বসেই খেয়ে নিলেন।

ড্রাইভার তখন হর্ন বাজিয়ে বাস ছাড়বার উপক্রম করছে।

বাপ্পা তাড়াতাড়ি উঠে বসল। অসমঞ্জবাবুও উঠলেন। বাস ছাড়ল। এবার দ্রুতগামী বাসের ভেতরে বসে চারদিক দেখতে দেখতে শিঙারা-জিলিপি খাওয়া।

কাঁথি থেকে দিঘা ঘণ্টাখানেকের পথ। বেলা প্রায় বারোটা নাগাদ ওরা যখন দিঘায় পৌঁছল, তখন আনন্দে নেচে উঠল মন।

বাসে বসেই সমুদ্র দেখতে পেয়েছিল ওরা। বাস ওদের নামিয়ে দিয়ে আরও একটু দূরে কিয়াগেড়িয়ায় ওড়িশাসীমান্তে চলে গেল।

ওদের এখন সামনে সমুদ্র। সমুদ্রের নীল-নীল জলরাশি, সফেন জলোচ্ছ্বাস। দিঘার নির্জন সৈকতের ঝাউবনে সামুদ্রিক বাতাস লেগে সোঁ সোঁ শব্দ হচ্ছে। দিঘার অথই নীল জলরাশি নিয়ে বঙ্গোপসাগর যেন ওদের সবাইকে সমুদ্রস্নানের জন্য হাতছানি দিয়ে ডাকছে। কী সুন্দর—কী সুন্দর—কী আশ্চর্য সুন্দর তার রূপ।