দানবের অপমৃত্যু
শক্তি ও সাহসের জন্য কয়েকটি শক্তিমান মানুষ জগৎজোড়া নাম কিনেছেন। এইসব বিশ্ববন্দিত শক্তিসাধকদের নিয়ে আমি আজ প্রবন্ধ লিখতে বসিনি; আমার কাহিনির নায়ক একজন অখ্যাত মানুষ–নাম তার চার্লস কটার।
এই অখ্যাত লোকটি কোনোদিনই খ্যাতিমান হওয়ার চেষ্টা করেনি, তবে তার অমানুষিক শক্তি। ও দুর্জয় সাহস ভুবনবিখ্যাত ব্যায়ামবীরদের চাইতে কোনো অংশেই কম নয়।
এমনকী প্রসিদ্ধ টারজানের বীরত্বের কাহিনিও কটারের চমকপ্রদ কীর্তিকলাপের কাছে ম্লান হয়ে যায়।
কাল্পনিক টারজানের লীলাক্ষেত্র ছিল আফ্রিকার বনভূমি। আমাদের কাহিনির নায়ক আফ্রিকার বাসিন্দা বটে কিন্তু আফ্রিকা তার স্বদেশ নয়–এদিক থেকে টারজানের সঙ্গে তার কিছুটা মিল আছে।
চার্লস কটারের জন্মভূমি ছিল ওকালাহামা প্রদেশে। আফ্রিকায় আসার আগে সে ছিল ওখানকার শেরিফ।
ওকলাহামা জায়গাটা বড়ো বেয়াড়া।
কোনো ভদ্রলোকই ওকলাহামাকে পছন্দ করবে না।
সেখানকার পথেঘাটে ও দোকানে বাজারে যে মানুষগুলি ভিড় জমায় তারা খুব নিরীহ স্বভাবের নয়।
কথায় কথায় সেখানে ঝগড়া বাধে।
ঝগড়া বাধলে মীমাংসার প্রয়োজন।
ওকলাহামার মানুষ বেশি কথাবার্তা পছন্দ করে না, চটপট ঘুসি চালিয়ে তারা ঝগড়া-বিবাদের মীমাংসা করে দেয়।
অনেকে আবার মুষ্টিবদ্ধ হস্তের পক্ষপাতী নয়।
রিভলভারের ঘন ঘন অগ্নিবৃষ্টির মুখেই তারা বিবাদের নিষ্পত্তি করতে চায়।
এমন চমৎকার জায়গায় শেরিফ হয়ে আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখতে হলে যেমন মানুষের দরকার ঠিক তেমন মানুষ ছিল চার্লস কটার।
যেসব মানুষ বৃহৎ দেহের অধিকারী হয় সাধারণত তাদের চালচলন হয় শ্লথ এবং মন্থর, কিন্তু ছ-ফুট চার ইঞ্চি লম্বা এই নরদৈত্য ছিল নিয়মের ব্যতিক্রম।
প্রয়োজন হলে মুহূর্তের মধ্যে কোমর থেকে রিভলভার টেনে নিয়ে সে অব্যর্থ সন্ধানে লক্ষ্যভেদ করত।
ওকলাহামার মতো জায়গায় শেরিফের কাজ করে কটারের মনের গতি হয়েছিল খুবই স্পষ্ট আর সহজ।
একটা মানুষকে হয় সে পছন্দ করবে আর নয়তো পছন্দ করবে না। এই পছন্দ-অপছন্দর। মাঝামাঝি কিছু নেই।
কাউকে অপছন্দ হলেই সে তার ওপরে প্রয়োগ করত মুষ্টিবদ্ধ হস্তের মুষ্টিযোগ।
চার্লস কটারের জীবনদর্শনে একটুও জটিলতা ছিল না। কটারের অস্বাভাবিক দীর্ঘ হাত দু-খানায় ছিল অমানুষিক শক্তি। তার ওপর সর্বদাই তার ডান হাতে থাকত একটা বেঁটে মোটা বাঁশের লাঠি আর কোমরে ঝুলত গুলিভরা রিভলভার।
ওকলাহামার দুর্দান্ত গুন্ডারাও বুঝল চার্লস কটার যতদিন শেরিফ আছে অন্তত সেই কটা দিন তাদের আইন মেনে চলতে হবে।
এই ভয়ানক মানুষটি যখন স্বদেশের মায়া কাটিয়ে পূর্ব-আফ্রিকার কেনিয়া অঞ্চলে পাড়ি জমাল তখন নিশ্চয়ই ওকলাহামার গুন্ডারা হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিল। অবশ্য এটা আমার অনুমান-কটারের জীবন-ইতিহাসের কোনো পাতায় ওকলাহামার অধিবাসীদের মনস্তত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করা হয়নি।
আফ্রিকাতে এসে চার্লস কটার শিকারির পেশা অবলম্বন করল। একাজে অর্থ উপার্জনের যথেষ্ট সুযোগ থাকলেও কাজটা অতিশয় বিপজ্জনক। তবে চার্লস কটারের মতো মানুষের পক্ষে এই ধরনের পেশা পছন্দ হওয়াই স্বাভাবিক।
কটার ছিল বিবাহিত পুরুষ। তার পরিবারটির নেহাত ছোটো ছিল না। ছ-টি কন্যা এবং দুটি পুত্রসন্তান নিয়ে কটার প্রবল পরাক্রমে শিকারির ব্যাবসা চালিয়ে যাচ্ছিল।
এইসব ব্যাবসা-সংক্রান্ত কথাবার্তা চলত টেলিগ্রাফের সাহায্যে। অফিসের কেরানিদের মধ্যে একধরনের লোক দেখা যায় যারা আইনের প্যাঁচ কষে সাধারণ মানুষকে ব্যতিব্যস্ত করে তোলে।
এই ধরনের কোনো কেরানি যখন চিঠি লিখে চার্লস কটারকে আইন এবং শাসনতন্ত্র সম্বন্ধে উপদেশ দিতে চেষ্টা করত তখনই তার মেজাজ যেত বিগড়ে বন্দুকের বদলে কলম হাতে নিয়ে সে করত যুদ্ধ ঘোষণা।
আগেই বলেছি চার্লসের জীবনদর্শন ছিল খুব সহজ ও স্পষ্ট।
গভর্নমেন্টের বেতনভোগী কর্মচারীর সঙ্গে মারামারি করা যায় না তাই মূল্যবান উপদেশপূর্ণ চিঠিকে বাজে কাগজের ঝুড়িতে নিক্ষেপ করে সে কাগজ কলম নিয়ে চিঠি লিখতে বসত।
চিঠির ভাষা ছিল খুব সহজ—
মহাশয়,
আপনার চিঠিটা এইমাত্র আমার সামনে ছিল। এখন সেটা আমার পেছনে কাগজের ঝুড়ির মধ্যে আছে।
চার্লস-কটার
এমন সুন্দর চিঠি পেলে কোনো মানুষই খুশি হতে পারে না। ডাকবিভাগের কেরানিরা ও ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ কটারের ওপর খঙ্গহস্ত ছিলেন। বেয়াড়া চিঠিপত্র লেখার জন্য প্রায়ই তার ওপর আদালতের সমন জারি হত। আদালতে দাঁড়াতে হলেই তার মেজাজ হয়ে উঠত খাপ্পা তখনকার মতো বিচারকের নির্দেশ পালন করে সে ঘরে ফিরে আসত বটে কিন্তু মহামান্য আদালত তার চরিত্র একটুও সংশোধিত করতে পারেননি। বেয়াড়া চিঠিপত্র লেখার জন্য বহুবার চার্লস কটারকে আদালতে দাঁড়াতে হয়েছে…
এই উদ্ধত মানুষটি তার জীবনে দু-দুবার লেপার্ডের সঙ্গে হাতাহাতি লড়াইতে নেমেছিল। হিংস্র শ্বাপদের শানিত নখর তার দেহের বিভিন্ন স্থানে সুগভীর ক্ষতচিহ্ন এঁকে দিয়েছিল বটে, কিন্তু সেই জীবন-মরণ যুদ্ধে প্রত্যেকবারই বিজয়লক্ষ্মীর বরমাল্য দুলেছে চার্লসের কণ্ঠে!
এই প্রসঙ্গে লেপার্ডের একটু পরিচয় দেওয়া দরকার। ভারতবর্ষেও লেপার্ড আছে, বাংলায় তাকে চিতাবাঘ বলে ডাকা হয়। আফ্রিকার জঙ্গলে চিতা নামে বিড়াল জাতীয় যে জানোয়ার বাস করে তার দেহচর্মের সঙ্গে লেপার্ডের কিছুটা সাদৃশ্য থাকলেও দেহের গঠন ও স্বভাব-চরিত্রে চিতার সঙ্গে লেপার্ডের কোনো মিল নেই–চিতা এবং লেপার্ড সম্পূর্ণ ভিন্ন জানোয়ার।
চিতা লাজুক ও ভীরু প্রকৃতির জন্তু।
লেপার্ড হিংস্র, দুর্দান্ত!
জে হান্টার, জন মাইকেল প্রভৃতি শিকারিরা লেপার্ডকে আফ্রিকার সবচেয়ে বিপজ্জনক জানোয়ার বলে ঘোষণা করেছেন।
সিংহের মতো বিপুল দেহ অথবা প্রচণ্ড শক্তির অধিকারী না হলেও ধূর্ত লেপার্ডের বিদ্যুৎচকিত আক্রমণকে অধিকাংশ শিকারি সমীহ করে চলে।
লেপার্ডের আক্রমণের কায়দা বড়ো বিশ্রী।
লতাপাতা ও ঘাস ঝোপের ভেতর থেকে হঠাৎ বেরিয়ে এসে যে যখন বিদ্যুদবেগে শিকারির ওপর লাফিয়ে পড়ে তখন অধিকাংশ সময়েই আক্রান্ত ব্যক্তি হাতের অস্ত্র ব্যবহারের সুযোগ পায় না। প্রথম আক্রমণেই লেপার্ড, তার সামনের দুই খাবার তীক্ষ্ণ নখ দিয়ে শিকারির চোখ দুটোকে অন্ধ করে ফেলার চেষ্টা করে, সঙ্গেসঙ্গে একজোড়া দাঁতালো চোয়ালের মারাত্মক দংশন চেপে বসে শিকারির কাঁধে আর পেছনের দুই থাবার ধারালো নখগুলির ক্ষিপ্র সঞ্চালনে ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় হতভাগ্যের উদরদেশ!
এই হিংস্র অথচ সুন্দর জানোয়ারটাকে কটার ভীষণ ঘৃণা করত। সে প্রায়ই বলত, আঃ! বেটাদের নখে কী দারুণ ধার! আঁচড় দিলে মনে হয় যেন ক্ষুর চালাচ্ছে! শয়তানের বাচ্চা
হ্যাঁ, এ-কথা অবশ্য সে বলতে পারে।
তার হাতপায়ের যেসব অংশ পরিচ্ছদের বাইরে দৃষ্টিগোচর হয় সেদিকে একবার তাকালেই চোখে পড়ে অজস্র ক্ষতচিহ্ন–অভিজ্ঞ মানুষ সহজেই বুঝতে পারে যে ক্রুদ্ধ লেপার্ডের নখের আঘাতেই ওই গভীর ক্ষতচিহ্নগুলোর সৃষ্টি হয়েছে।
কিন্তু লেপার্ডের নখ কটারের শরীরে দাগ কাটলেও মনের মধ্যে একটুও দাগ বসাতে পারেনি। ওকলাহামা শহরে যে মানুষ গুন্ডার রিভলভারকে পরোয়া করেনি, আফ্রিকার লেপার্ডের দাঁত আর নখকেও সে সমীহ করতে শিখল না।
একদিনের ঘটনা বলছি…
বনের মধ্যে একটা গাছের ডালে ঝুলছে মরা কুকুরের টোপ আর খুব কাছেই ঝোপের আড়ালে গা-ঢাকা দিয়ে অপেক্ষা করছে রাইফেলধারী কটার। কুকুরের মাংস লেপার্ডের প্রিয় খাদ্য। কটার জানত মরা কুকুরের গন্ধে গন্ধে লেপার্ড আসবেই আসবে…
একটু পরেই ঘটনাস্থলে একটা লেপার্ড আত্মপ্রকাশ করলে।
জন্তুটার দিকে তাকিয়ে কটার হতাশ হল–লেপার্ডটা আকারে বিশেষ বড়ো নয়, তার গায়ের চামড়াটাও কটারের কাছে লোভনীয় মনে হল না।
গ্রামের আশেপাশে যেসব লেপার্ড ঘোরাঘুরি করে তাদের দেহের আকার খুব বড়ো হয় না, গায়ের চামড়া হয় অনুজ্জ্বল, ফ্যাকাশে। কিন্তু ঘন জঙ্গলের মধ্যে যে লেপার্ডগুলো বাস করে সেগুলো সত্যিই বৃহৎ বপুর অধিকারী, তাদের চামড়া অতি উজ্জ্বল ও সুন্দর।
কটার আশা করেছিল একটি বেশ বড়োসড়ো লেপার্ড তার ফাঁদে পা দেবে, কিন্তু এই জন্তুটাকে দেখে তার মেজাজ হয়ে গেল খাপ্পা।
লেপার্ড ধূর্ত জানোয়ার–সে তখন কুকুরের মৃতদেহটার কাছে ঘোরাঘুরি করছে, তবে ভোজের জিনিসে মুখ দেয়নি। কিছুক্ষণ পরে তার মনে হল এই ভোজটা সম্ভবত নিরাপদ, এখানে কামড় বসালে বোধ হয় বিপদের আশঙ্কা নেই–সে নীচু হয়ে বসে পড়ল, এইবার একলাফে গাছে উঠে মরা কুকুরটাকে নামিয়ে আনবে।
চার্লসের মেজাজ আগেই খারাপ হয়েছিল, তার লেপার্ডকে ইতস্তত করতে দেখে সে আশা করলে জন্তুটা হয়তো চলে যেতে পারে। কিন্তু লেপার্ড যখন লাফ দিতে উদ্যত হল তখন তার আর ধৈর্য বজায় রইল না। ইচ্ছে করলে কটার অনায়াসেই গুলি করে লেপার্ডকে হত্য করতে পারত কিন্তু সে তা করলে না–হাতের রাইফেল ফেলে দিয়ে হঠাৎ কটার ছুটে এসে জন্তুটার পেছনের ঠ্যাং দুটো ধরে ফেললে!
পরক্ষণেই দুই সবল বাহুর আকর্ষণে লেপার্ডের শরীরটা শূন্যে নিক্ষিপ্ত হয়ে সশব্দে ধরাশয্যায় আছড়ে পড়ল!
লেপার্ডের ঊর্ধ্বতন চোদ্দো পুরুষ কেউ কখনো এমন ব্যবহার সহ্য করেনি। আকারে ছোটো হলেও লেপার্ড হচ্ছে লেপার্ড; তুচ্ছ মানুষের হাতে আছাড় খেয়ে মুখের গ্রাস ফেলে পালিয়ে যেতে সে রাজি হল না।
ভীষণ আক্রোশে গর্জন করে সে শত্রুর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। কিন্তু কটারের অস্বাভাবিক লম্বা হাতগুলো এড়িয়ে জন্তুটা শত্রুর দেহে দাঁত বসাতে পারলে না। লোহার মতো শক্ত দু-খানা হাত লেপার্ডের গলা টিপে ধরল।
সামনের থাবার ধারালো নখগুলি কটারের হাত দু-খানা রক্তাক্ত করে দিলে, তবুও কটার জন্তুটা গলা ছাড়ল না।
ঝটাপটি করতে করতে মানুষ ও পশু মাটির ওপর গড়িয়ে পড়ল। লেপার্ডের পেছনের থাবা দুটিও নিশ্চেষ্ট রইল না, তীক্ষ্ণ নখের আঘাতে আঘাতে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল কটারের সর্ব-অঙ্গ কিন্তু লৌহকঠিন অঙ্গুলির নিষ্ঠুর বন্ধন একটুও শিথিল হল না…
অবশেষে কঠিন নিষ্পেষণে রুদ্ধ হয়ে এল জন্তুটার কণ্ঠনালী, উন্মুক্ত মুখগহ্বরের ভেতর থেকে উঁকি দিলে দীর্ঘ দাঁতের সারি আর সেই অবস্থায় নিশ্বাস নেবার ব্যর্থ চেষ্টা করতে করতে লেপার্ড প্রাণত্যাগ করল।
চার্লস কটারের সর্বাঙ্গ থেকে তখন ঝরছে গরম রক্তের স্রোত, টপটপ করে গড়িয়ে পড়ছে সেই উষ্ণ তরল ধারা মৃত লেপার্ডের দেহের ওপর।
সে এবার কী করবে?
ক্ষতগুলিতে ওষুধ দেবার জন্য কি এখন ফিরে যাবে বাড়িতে? পাগল! কটার সে জাতের মানুষই নয়!
রক্তাক্ত ক্ষতগুলিতে মোটামুটি খানিকটা ব্যান্ডেজ লাগিয়ে সে পরবর্তী শিকারের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল।
একটু পরেই সেখানে এসে উপস্থিত হল আরেকটি লেপার্ড। এবারের লেপার্ডটা আকারে খুব বড়ো, তার গায়ের চামড়াটিও খুব সুন্দর। কটার বুঝল এই জানোয়ারটা গভীর অরণ্যের বাসিন্দা।
নিশানা স্থির করে সে রাইফেলের ঘোড়া টিপল।
অব্যর্থ সন্ধান! একটিমাত্র গুলিতেই লেপার্ডের প্রাণহীন দেহ মাটিতে লুটিয়ে পড়ল।
এই ঘটনার পরে কয়েকটা দিন কেটে গেছে।
জঙ্গলের পথ ধরে এগিয়ে চলেছে চার্লস কটার।
আচম্বিতে গাছের ওপর ঘন লতাপাতার আড়াল থেকে তার ঘাড়ের ওপর লাফিয়ে পড়ল দু-দুটো ছোটো জাতের লেপার্ড!
যে-জানোয়ারটা কটারের সঙ্গে মল্লযুদ্ধে নিহত হয়েছিল এই লেপার্ড দুটো তারই পরিবারভুক্ত কি না জানি না, কিন্তু সমস্ত ঘটনাটা শুনলে এটাকে প্রতিশোধের ব্যাপার বলেই মনে হয়।
এমন অভাবিত ও অতর্কিত আক্রমণের জন্য কটার প্রস্তুত ছিল না। সমস্ত ব্যাপারটা সে যখন বুঝল তখন লেপার্ডের দাঁত ও নখের আঘাতে তার দেহ রক্তাক্ত হয়ে উঠেছে।
কিন্তু চার্লস কটার হচ্ছে চার্লস কটার।
মুহূর্তের মধ্যে সে কর্তব্য স্থির করে ফেললে!
হাতের রাইফেল আর কাজে লাগবে না বুঝতে পেরে সে অস্ত্রটাকে মাটিতে ফেলে আক্রমণের মোকাবেলা করার জন্যে রুখে দাঁড়াল।
কটারের দ্রুত প্রতি-আক্রমণের জন্য লেপার্ড দুটো প্রস্তুত ছিল না, তারা ছিটকে শত্রুর পায়ের কাছে গড়াগড়ি খেতে লাগল। সেই সুযোগে কটার চট করে একটা জানোয়ারের গলা চেপে ধরলে। এত জোরে সে লেপার্ডের গলা টিপে ধরেছিল যে জন্তুটার চোখে রক্ত জমে গেল!
কটারের শরীরও অক্ষত ছিল না!
ধারালো নখের আঘাতে বিদীর্ণ ক্ষতমুখ থেকে ছুটছে রক্তের ফোয়ারা, সুদীর্ঘ শ্বাপদ-দন্তের হিংস্র শুভ্রতাকে লাল করে দিয়ে সেই তপ্ত রক্তধারা গড়িয়ে পড়ল আক্রান্ত জন্তুটার হাঁ-করা মুখের মধ্যে!
অন্য লেপার্ডটা কটারের খপ্পরে ধরা পড়েনি।
সে এবার পিছন থেকে শত্রুর পৃষ্ঠদেশ লক্ষ করে লাফ দিলে।
কটার তখন প্রথম জানোয়ারটার সঙ্গে মারামারি করতে করতে হঠাৎ সামনে ঝুঁকে পড়েছে।
দু-নম্বর লেপার্ডের লাফটা ফসকে গেল।
লক্ষ্যভ্রষ্ট হওয়ার জন্য কটারের পিঠের ওপর না-পড়ে সে এসে পড়ল সঙ্গীর পেছনের দুটো পায়ের ওপর।
সঙ্গী তখন কটারের কবলে ছটফট করছে আর লাথি ছুড়ছে। সেই সনখ থাবার একটা লাথি এসে লাগল দুনম্বর লেপার্ডের পেটে–সঙ্গেসঙ্গে ধারালো নখের আঁচড়ে বিদীর্ণ হয়ে গেল উদরের মাংসপেশি।
কটার সেই মুহূর্তের সুযোগ নিতে ছাড়ল না।
টপ করে হাত বাড়িয়ে সে দ্বিতীয় লেপার্ডটার কণ্ঠনালী চেপে ধরলে। এইবার সমস্ত শরীরের শক্তি দিয়ে সে জন্তু দুটোকে মাটিতে চেপে ধরে গলা টিপে মারবার চেষ্টা করতে লাগল। কিন্তু লেপার্ডের মংসপেশিগুলো স্প্রিং-এর মতো। চার্লস কটারের মতো মানুষের পক্ষেও তাদের মাটিতে চেপে রাখা অসম্ভব।
জন্তু দুটো জোর করে ঠেলে উঠল। কাজেই কটারও সোজা হয়ে দাঁড়াতে বাধ্য হল, কিন্তু প্রতিপক্ষের কণ্ঠনালীর ওপরে তার আঙুলের চাপ একটুও শিথিল হল না।
নখের আঘাতে কটারের কাঁধ আর হাতে তখন ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটছে। এত রক্তপাতেও সে কাবু হল না বরং রক্ত দেখে তার মাথায় খুন চেপে গেল। ক্রুদ্ধ কটার এবার যা করলে তা প্রায় অবিশ্বাস্য একটা জন্তুর মাথার সঙ্গে সে আর একটা জন্তুর মাথা ঠুকতে লাগল সজোরে!
লেপার্ড দুটো কিন্তু এমন দারুণ মার খেয়েও অবসন্ন হল না!
তারা ক্রমাগত ছটফট করে কটারের বজ্রমুষ্টি থেকে নিজেদের মুক্ত করার চেষ্টা করছে আর তাদের থাবার ধারালো নখগুলো সমানে শত্রুর দেহে আঁচড় কেটে যাচ্ছে।
রক্তে লাল হয়ে উঠল কটারের সমস্ত শরীর। লেপার্ড দুটোর শ্বাসরুদ্ধ হয়ে এল লৌহ-কঠিন অঙ্গুলির নিষ্ঠুর পেষণে।
তবু কোনো পক্ষই পরাজয় স্বীকার করলে না!
কটারের সঙ্গে যে নিগ্রো সঙ্গীরা ছিল তারা প্রথমে পালিয়ে গিয়েছিল কিন্তু পরে আবার ফিরে এসেছে।
বিস্ফারিত দুই চক্ষুর ভীতিবিস্মিত দৃষ্টি মেলে তারা তাকিয়ে আছে এই আশ্চর্য দৃশ্যের দিকে–কিন্তু এখন আর কটারকে সাহায্য করার উপায় নেই, মানুষ ও পশু এমনভাবে পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে মারামারি করছে যে গুলি চালালে কটারও আহত হতে পারে।
এখন আর কটারকে সাহায্য করার কোনো উপায় নেই।
যে-পক্ষের সহ্যশক্তি বেশি সেইপক্ষই জয়লাভ করবে।
রক্তস্নাত চার্লস কটারের বিশাল দেহ অফুরন্ত শক্তির আধার–সে হঠাৎ বুঝতে পারলে তার দুই শত্রুর দেহ অবশ হয়ে আসছে, তাদের থাবার আঁচড়ে, শরীরের আস্ফালনে আর আগের মতো জোর নেই।
মহা-উল্লাসে কটার চিৎকার করে উঠল।
যে-লেপার্ডটার উদর সঙ্গীর নখের আঘাতে বিদীর্ণ হয়ে গিয়েছিল তার ক্ষতস্থান থেকে তখন অবিরল ধারায় রক্ত ঝরে পড়ছে।
কটারের অবস্থা তো আগেই বলেছি।
মানুষ ও পশুর রক্তে পিছল হয়ে উঠল রণভূমির ঘাসজমি।
কটার যখন বুঝল তার শত্রুরা দুর্বল হয়ে পড়ছে তখন সে লড়াইয়ের কায়দা বদলে ফেললে। হাত দুটোকে সোজা করে এমনভাবে সে জন্তু দুটোকে তুলে ধরলে যে তাদের থাবাগুলো আর কটারের দেহস্পর্শ করতে পারল না।
এইবার সে একটা গাছের গুঁড়ির সঙ্গে জন্তু দুটোর মাথা ঠুকতে লাগল।
মাথার ওপর পড়ছে প্রচণ্ড আঘাত, শ্বাসরুদ্ধ হয়ে আসছে লৌহকঠিন অঙ্গুলির নিষ্ঠুর পেষণে।
ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে এল দুই শ্বাপদের দেহ…
মুমূর্ষু জন্তু দুটোকে মাটির ওপর আছড়ে ফেলে কটার সোজা হয়ে দাঁড়াল।
সে এক আশ্চর্য দৃশ্য ধরাশয্যায় শুয়ে মৃত্যু-যাতনায় ছটফট করছে দু-দুটো লেপার্ড আর তাদের পাশেই ক্ষতবিক্ষত রক্তস্নাত অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে এক মহাকায় মানুষ।
গল্পের টারজান কি কটারের চেয়েও শক্তিশালী?
কটার এবার কী করবে?
বাড়ি ফিরে যাবে?
ক্ষতস্থানে ওষুধ লাগিয়ে শয্যাগ্রহণ করবে?
মোটেই নয়। চার্লস কটার হচ্ছে চার্লস কটার।
নিগ্রোদের সাহায্যে ক্ষতস্থানগুলোতে ব্যান্ডেজ লাগিয়ে সে আবার পথ চলতে শুরু করল।
কথায় আছে ডানপিটের মরণ গাছের আগায়।
চার্লস কটার অবশ্য গাছের আগায় মরেনি, তবে তার মৃত্যু হয়েছিল অত্যন্ত ভয়ানকভাবে। জন্মগ্রহণ করেছিল সে সুসভ্য আমেরিকার ওকলাহামা প্রদেশে আর তার মৃত্যু হল ঘন-বন-আবৃত আফ্রিকার অন্তঃপুরে।
একেই বলে নিয়তি!
হ্যাঁ, নিয়তি ছাড়া আর কী বলব!
চার্লস কটারের মৃত্যুকে একটা অদ্ভুত দুর্ঘটনা ছাড়া আর কিছুই বলা চলে না আর এই দুর্ঘটনার কারণ হল একটা যন্ত্রের যান্ত্রিক ত্রুটি!
না, না, রাইফেল নয়, পিস্তল নয়।
একটা ক্যামেরার দোষেই হল সেই ভয়াবহ দুর্ঘটনা।
অর্থাৎ কটারের মৃত্যুর জন্য দায়ী একটা ক্যামেরা!
মনে হচ্ছে অবিশ্বাস্য–তাই না?
কিন্তু বাস্তব সত্য অনেক সময়ে কল্পনাকে অতিক্রম করে যায়।
আচ্ছা, ঘটনাটা খুলেই বলছি।
কটার একদিন রাইফেলের সঙ্গে ক্যামেরা ঝুলিয়ে জঙ্গলের পথে যাত্রা করলে।
ক্যামেরার view-finder টা খারাপ ছিল। (ক্যামেরার মধ্যে বসানো স্বচ্ছ কাঁচের মতো যে জিনিসটার ভেতর দিয়ে ক্যামেরাধারী বিষয়বস্তুকে লক্ষ করে সেই অংশটিকে বলে view finder)।
ক্যামেরার সামান্য ত্রুটি নিয়ে কটার বোধ হয় মাথা ঘামায়নি আর এইটুকু অন্যমনস্কতার জন্যই তাকে প্রাণ হারাতে হল।
কটার হেঁটে চলেছে জঙ্গলের পথে হঠাৎ তার চোখের সামনে আত্মপ্রকাশ করলে একটা মস্ত গণ্ডার।
রাইফেল রেখে সে ক্যামেরা বাগিয়ে ধরলে আর নিবিষ্টচিত্তে গণ্ডারের ফটো তুলতে লাগল।
হতভাগা গণ্ডার!
ফটো তুলে দেওয়ার জন্য সে একটুও কৃতজ্ঞতা বোধ করল না, একটুও খুশি হল না।
সোজা তেড়ে এল কটারের দিকে খড়্গ উঁচিয়ে!
আগেই বলেছি, ক্যামেরার view-finder টা খারাপ ছিল। ক্যামেরার যান্ত্রিক চক্ষুর ভেতর দিয়ে দৃষ্টিনিক্ষেপ করে তার ধারণা হল জন্তুটা এখনও অনেক দূরেই আছে–আসলে গণ্ডার তখন খুব কাছে এসে পড়েছে।
কটার যখন বিপদ বুঝে ক্যামেরা রেখে রাইফেল তুলে নিলে তখন আর সময় নেই।
গণ্ডারের খঙ্গ প্রায় কটারের দেহস্পর্শ করেছে।
সশব্দে অগ্নি-উদগার করলে কটারের রাইফেল।
সঙ্গেসঙ্গে গণ্ডারের সুদীর্ঘ খঙ্গ সেই অতিকায় নরদানবের দেহটাকে এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিলে।
কটারের মুখ থেকে একটা আর্তনাদও শোনা গেল না। সে তৎক্ষণাৎ মারা গেল।
চার্লস কটার জীবনে কখনো পরাজয় স্বীকার করেনি, মৃত্যুকালেও জয়লক্ষ্মী তার কণ্ঠে পরিয়ে দিলেন জয়মাল্য।
মরবার আগে সে একবারই গুলি চালাবার সুযোগ পেয়েছিল আর সেই একটামাত্র গুলির আঘাতেই তার আততায়ী মৃত্যুবরণ করল।
চার্লস কটারের মৃতদেহের পাশেই লুটিয়ে পড়ল গণ্ডারের প্রাণহীন দেহ।
[১৩৭৩]