উপন্যাস
বড় গল্প
সংকলন
রচনা

দশ । যুদ্ধজাহাজের দুর্দশা

দশ । যুদ্ধজাহাজের দুর্দশা

উষার সিঁদুরমাখা আকাশ ঢেকে রাখতে পারলে না পাতলা কুয়াশার পরদা। খাঁড়ির বুকে এসেছে জোর জোয়ার। জলে জেগেছে কলকল করে কলহাস্য!

রাজার জাহাজ-জোড়া এগিয়ে আসছে ধীরে, ধীরে, ধীরে।

মেনার্ড নিজের লোকজনদের ভরসা দিয়ে দৃঢ়কণ্ঠে বলছিলেন, ‘কোনও ভয় নেই—আগে চল, আগে চল ভাই! বোম্বেটেরা বড় জোরে একবার কি দুইবার কামান ছোড়বার ফুরসত পাবে, তার পরেই আমরা ছুটে গিয়ে হুড়মুড় করে তাদের ঘাড়ে ঝাঁপিয়ে পড়ব, দেখব তখন পঁচিশটা বন্দুক কেমন করে সামলায় পঞ্চাশটা বন্দুকের ঠেলা! আগে চল!’

এতক্ষণ পরে কালোদেড়ের মন দোলায়মান হল সন্দেহদোলায়। কুয়াশার ফিনফিনে পরদা ফুঁড়ে দেখা যাচ্ছে, রাজার জাহাজ দুখানা এগিয়ে আসছে,—ক্রমেই এগিয়ে আসছে তার দিকে। ঘনায়মান বিপদ! একেবারে শেষ-মুহূর্তেই সে আন্দাজ করতে পারলে, শত্রুরা দলে তার চেয়ে দুগুণ বেশি ভারী। সে স্থির করলে, জাহাজ নিয়ে খাঁড়ির ভিতরে আরও দুর্গম অংশে গিয়ে আশ্রয় নেবে। সে চেঁচিয়ে হুকুম দিলে—’নোঙর তোলো, নোঙর তোলো!’

কিন্তু সময় নেই—সময় নেই! শত্রু যে শিয়রে! পালাবার পথ যে বন্ধ!

কালোদেড়ে কামান দেগে পথের বাধা দূর করতে চাইলে—হ্যাঁ, এই হচ্ছে বাঁচবার একমাত্র উপায়।

প্রচণ্ড চিৎকারে শোনা গেল তার চরম আদেশ—’কামান ছোড়ো, একসঙ্গে সব কামান ছোড়ো। আগুনের ঝড়ে উড়িয়ে দাও সামনের সব প্রতিবন্ধক!’

কর্ণভেদী বজ্রনাদ ধ্বনিত করে সোঁ সোঁ শব্দে বাতাস কেটে তীব্র বেগে ছুটে গেল সেই সর্বনাশা অগ্নিপিণ্ডগুলো—কিন্তু হায় রে হায়, তারা রাজার জাহাজকে স্পর্শ করবার আগেই জলের ভিতরে ঝুপ ঝুপ করে পড়ে তলিয়ে গেল!

মেনার্ড বিপুল পুলকে বলে উঠলেন, ‘গোলাগুলো গিয়েছে জলের জঠরে—আমরা অক্ষত! এইবারে গর্জন করুক আমাদের বন্দুকগুলো—তারা কেউ ব্যর্থ হবে না!’

গুড়ুম, গুড়ুম, গুম! গুড়ুম, গুম!

রাগে পাগলের মতো হয়ে কালোদেড়ে দেখলে, তার দুজন গোলন্দাজ হাত-পা ছড়িয়ে মৃত্যু-ঘুমে এলিয়ে পড়ল এবং তার জাহাজখানাও চড়ায় আটকে অচল হল। কণ্ঠে তার ফুটতে লাগল প্যাঁচার মতো কর্কশ চিৎকার।

আবার গুড়ুম, গুড়ুম, গুম! ওরে বাবা, গুলির ঝাঁক বনবনিয়ে ছুটছে, কানের পাশ দিয়ে। কালোদেড়ে প্রাণ বাঁচাবার জন্যে তাড়াতাড়ি হুমড়ি খেয়ে বসে পড়ল!

কিন্তু এ কী দৈব-বিড়ম্বনা! হঠাৎ স্রোতের টানে পড়ে রাজার জাহাজ দুখানার মুখ গেল ঘুরে এবং কালোদেড়েও ছাড়লে না এই দুর্লভ সুযোগ।

তৎক্ষণাৎ লাফ মেরে দাঁড়িয়ে বজ্র-কণ্ঠে সে গর্জে উঠল—’আবার কামান ছোড়ো, আবার কামান ছোড়ো!’

আবার জাগল কামানগুলোর ভৈরব হুংকার! এবারে তারা ব্যর্থ হল না এবং তাদের সঙ্গে যোগ দিতে ছাড়লে না বোম্বেটেদের বন্দুকও!

তারপর মনে হল সেখানে সৃষ্ট হয়েছে অভাবিত এক শব্দময় মহানরক! ফটাফট ফেটে গেল রাজার জাহাজ দুখানার নানা জায়গা, হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ল তাদের মাস্তুল, মৃত্যুন্মুখ যোদ্ধাদের চিৎকার ছুটে গেল দিকে দিকে! নৌসেনাদের উনত্রিশজনের মৃতদেহ পড়ে রইল পাটাতনের যেখানে-সেখানে।

বিকট উল্লাসে চেঁচিয়ে কালোদেড়ে বলে উঠল, ‘এবার ওদের পেয়েছি হাতের মুঠোর মধ্যে। আবার ছোড়ো কামান-বন্দুক! ডুবিয়ে দাও জাহাজ দুখানা! মড়াগুলোর সঙ্গে জীবন্তরা মেটাক মাছেদের ক্ষুধা!’

লেফটেন্যান্ট মেনার্ড দিকে দিকে ছুটোছুটি করে নিজের দলের হতভম্ব লোকদের উৎসাহিত করতে লাগলেন। এবং ইতিমধ্যে দুইপক্ষের জাহাজ পরস্পরের খুব কাছে এসে পড়ল।

মেনার্ড ভাবলেন একবার যদি সদলবলে ওদের জাহাজে লাফিয়ে উঠতে পারেন তাহলে আর কোনও ভাবনাই থাকে না! কিন্তু তৎক্ষণাৎ তিনি বুঝে ফেললেন, ব্যাপারটা অত সহজ নয়!

দুই পক্ষের মধ্যে ব্যবধান ক্রমেই কমে আসছে দেখে কালোদেড়ে নতুন হুকুম জারি করলে—’নিয়ে এসো হাত বোমা! সবাই হাত-বোমা ছোড়ো!’

নতুন বিপদের সম্ভাবনা দেখে মেনার্ড নিজের সৈন্যদের ডেকে বললেন, ‘তাড়াতাড়ি পাটাতনের তলায় গিয়ে গা ঢাকা দাও!’

দুই পক্ষের জাহাজে জাহাজে লেগে গেল বিষম ঠোকাঠুকি—শোনা যেতে লাগল মড়মড়িয়ে কাঠভাঙার শব্দ!

দুম, দুম, দুম! বোমার পর বোমা ফাটার বেজায় আওয়াজ, ধুমধড়াক্কা! রাজার জাহাজ দুখানার পাটাতন ভগ্ন-চূর্ণ, ধূমায়িত, অগ্ন্যুৎপাতে ভয়াবহ! চোখের সামনে যেন মারাত্মক আতশবাজির খেলা দেখতে দেখতে বিকট উল্লাসে কালোদেড়ে অট্টহাস্য করতে লাগল।