দশ । ওয়াটার্লু (১৮ জুন, ১৮১৫)
ওয়াটার্লু হচ্ছে দিগবিজয়ী নেপোলিয়নের শেষ যুদ্ধ। এই যুদ্ধের পরেই তাঁর মহা পতন। অস্টারলিটজের পরিপূর্ণ সূর্য ওয়াটার্লু ক্ষেত্রে এসে শেষ কিরণ বিকিরণ করে অস্তমিত হয়।
কেউ কেউ মতপ্রকাশ করেছেন, ওয়াটার্লু যুদ্ধের সময়ে নেপোলিয়নের যুদ্ধপ্রতিভা দুর্বল হয়ে এসেছিল। কিন্তু গোড়া থেকে শেষ পর্যন্ত বিচার করে দেখলে, এ মত সম্পূর্ণ ভ্রান্ত বলেই প্রমাণিত হয়।
কারণ, বিশেষজ্ঞরা স্বীকার করেছেন, নেপোলিয়নের পরিকল্পনা ছিল নিখুঁত ও অপূর্ব। কিন্তু তাঁর পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করা হয়নি। দৈবের মহিমায় তাঁর ‘প্ল্যান’ ব্যর্থ হয়ে গিয়েছিল।
ওয়াটার্লু যুদ্ধে জয়ী হয়ে ডিউক অফ ওয়েলিংটন অমর নাম কিনেছেন। কিন্তু তিনি প্রথম শ্রেণির সেনাপতি ছিলেন না। আজ পর্যন্ত ইংল্যান্ড এমন কোনও রণবীর প্রসব করেনি, চেঙ্গিজ, আলেকজান্ডার, সিজার, হানিবল, তৈমুর, নাদির বা নেপোলিয়নের সঙ্গে যাঁর তুলনা করা চলে। ওয়াটার্লু যুদ্ধে ওয়েলিংটন উল্লেখযোগ্য কোনও রণকৌশলই দেখাতে পারেননি। তাঁর সম্বন্ধে কেবল এইটুকুই বলা যায় যে, তিনি ছিলেন দস্তুরমতো নাছোড়বান্দা। এই যুদ্ধে তাঁর চেয়ে বেশি সুখ্যাতি করা যায় ইংরাজ সৈন্যদের—তাদের অসাধারণ সাহস ও সহ্যক্ষমতার জন্যে।
এই যুদ্ধে নেপোলিয়নের পরাজয়ের প্রধান দুটি কারণ হচ্ছে, চৌত্রিশ হাজার সৈন্য নিয়ে তাঁর সেনাপতি গ্রাউচিতর অনুপস্থিতি ও জার্মান সেনাপতি ব্লুচারের যথাসময়ে আবির্ভাব। এমনকী গ্রাউচিন্যর অভাবও পূরণ হতে পারত, ব্লুচার যদি না আসতেন। ব্লুচার না এলে ইংরেজদের রক্ষা পাওয়ার কোন উপায়ই ছিল না। ব্লুচারও ভালো সেনাপতি নন। নেপোলিয়নের সামনে কোনও দিনই তিনি দাঁড়াতে পারেননি। কিন্তু আগেই বলা হয়েছে তাঁর একটা মস্ত গুণ ছিল এই যে, যতবারই তিনি হেরেছেন, ততবারই পালিয়ে গিয়ে আবার ‘যুদ্ধিং দেহি’ বলে ফিরে এসেছেন। এই ব্লুচারই হয়েছিলেন নেপোলিয়নের কাল।
পলাতক ব্লুচারের পিছনে চৌত্রিশ হাজার সৈন্যশুদ্ধ সেনাপতি গ্রাউচিকে পাঠিয়ে, নেপোলিয়ন সসৈন্যে এলেন ওয়েলিংটনকে ধ্বংস করতে। ওয়েলিংটন তখন ওয়াটার্লু ক্ষেত্রে সৈন্য সমাবেশ করেছেন। তাঁর অধীনে ছিল সত্তর হাজার ইংরেজ ও নানাজাতীয় সৈন্য।
এতক্ষণ যে-সব লড়াই হচ্ছিল, তাদের ওয়াটার্লু যুদ্ধেরই প্রস্তাবনা বলে গ্রহণ করা যায়।
ওয়াটার্লু ক্ষেত্রে নেপোলিয়নের অধীনে সৈন্য ছিল বাহাত্তর হাজার—অর্থাৎ প্রায় ওয়েলিংটনেরই সমান। কিন্তু ফরাসিদের কামান ছিল ইংরেজদের চেয়ে অনেক বেশি।
ব্লুচারের সঙ্গে ওয়েলিংটনের আগেই বোঝাপড়া হয়ে গিয়েছিল, তাঁদের একজন ফরাসিদের দ্বারা আক্রান্ত হলে অন্যজন আসবেন সাহায্য করতে। এই আশায় বুক বেঁধে ওয়েলিংটন নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে দণ্ডায়মান হলেন। কিন্তু ভিক্টর হুগো দেখিয়েছেন, যুদ্ধের কিছুই তিনি উপলব্ধি করতে পারেননি। তাঁর ‘বুলেটিন’গুলো পড়লে মনে হয়, তিনি যেন ধাঁধায় পড়ে গিয়েছিলেন! তিনি কেবল এইটুকু স্থির করেছিলেন, যতক্ষণ না ব্লুচার আসবেন ততক্ষণ যেমন করে হোক আত্মরক্ষা করবেন। কিন্তু দৈব সহায় না হলে তিনি যে আত্মরক্ষাও করতে পারতেন না, হুগো সেটাও দেখিয়েছেন।
ওয়াটার্লু ক্ষেত্রে ইংরেজদের উপরে ফরাসিরা পাঁচবার আক্রমণ করেছিল। (১) ইংরেজদের বাম পার্শ্বের উপরে আক্রমণ। (২) ইংরেজদের দক্ষিণ পার্শ্বের উপরে আক্রমণ। (৩) ফরাসি অশ্বারোহী সৈন্যদের প্রবল আক্রমণ—ইংরেজরা যা সহ্য করতে পেরেছিল। (৪) মার্শাল নে’র সফল আক্রমণ—যা ফরাসিদের জয়লাভের সম্ভাবনা আনে। (৫) ফরাসি রক্ষী সৈন্যের আক্রমণ—এইখানেই ইংরেজদের পতন হত, কিন্তু ঠিক এই সময়েই ব্লুচারের অধীনস্থ প্রুশিয়ানদের আবির্ভাবে ও গ্রাউচির অনুপস্থিতিতে যুদ্ধের গতি ফিরে যায়।
অমর ফরাসি লেখক ভিক্টর হুগো ওয়াটার্লু যুদ্ধের যে অপূর্ব শব্দ-ছবি এঁকেছেন, বিশ্ব-সাহিত্যের ইতিহাসে তা অতুলনীয় হয়ে আছে। আমরা এখানে তার কয়েকটি অংশ উদ্ধার করলুম :
১৮১৫ খ্রিস্টাব্দের সতেরোই এবং আঠারোই তারিখের মাঝখানে যদি বৃষ্টি না হত, তাহলে ইউরোপের ভবিষ্যৎ ভিন্ন আকার ধারণ করত। মাত্র কয়েক ফোঁটা জলের জন্যে হল নেপোলিয়নের পতন। ওয়াটার্লুকে অস্টারলিটজের উপসংহারে পরিণত করবার জন্যে বিধাতার দরকার হল এক পশলা বৃষ্টি! বেলা সাড়ে এগারোটার আগে ওয়াটার্লু যুদ্ধ শুরু করা সম্ভবপর হল না। কেন? বৃষ্টিতে মাটি ভিজে ছিল বলে! এই যুদ্ধে নেপোলিয়ন তাঁর কামান-সংখ্যার উপরে অত্যন্ত নির্ভর করে ছিলেন। ওয়েলিংটনের মাত্র ১৫৯টা কামান ছিল এবং তিনি ছিলেন ২৪০ কামানের অধিকারী। মাটি খানিকটা না শুকোলে কামান ব্যবহার করা চলে না।
মাটি যদি শুকনো থাকত, ওয়াটার্লু যুদ্ধ আরম্ভ হত ভোর ছ’টার সময়ে এবং নেপোলিয়ন জয়ী হয়ে যুদ্ধ শেষ করে ফেলতেন বেলা দুটোর সময়—অর্থাৎ প্রুশিয়ানদের আগমনের তিন ঘণ্টা কাল আগে।
ইংরেজরা ছিল উচ্চভূমির উপরে, ফরাসিরা নিম্নভূমিতে। এজন্যে ইংরেজদের খুব সুবিধা হয়েছিল।
যুদ্ধ আরম্ভ হল বিষম তেজে। এতটা নেপোলিয়নও আশা করতে পারেননি। ফরাসিদের বাম পার্শ্ব আক্রমণ করলে ইংরেজরা, নেপোলিয়ন আক্রমণ করলেন ইংরেজদের মধ্যভাগ। সেনাপতি নে ফরাসিদের দক্ষিণ পার্শ্ব নিয়ে ইংরেজদের বাম পার্শ্বকে আক্রমণ করলেন। প্রথম আক্রমণ সফল হল। ফরাসিরা কয়েকটা স্থান দখল করলে। তারপর যুদ্ধের গতি ফিরতে লাগল একবার এদিকে, একবার ওদিকে।
অপরাহ্ন-কালে যুদ্ধের অবস্থা অনেকটা স্পষ্ট হয়ে এল। বেলা প্রায় চারটের সময়ে ইংরেজদের অবস্থা হয়ে উঠল শোচনীয়। ইংরেজদের পক্ষে হল্যান্ড-বেলজিয়মের সৈন্যচালনা করছিলেন প্রিন্স অফ অরেঞ্জ; দক্ষিণ পার্শ্বের নায়ক ছিলেন হিল; বামপার্শ্বের নায়ক পিক্টন।
প্রিন্স অফ অরেঞ্জ নিজের সৈন্যদের ডেকে মরিয়ার মতন চ্যাঁচাতে লাগলেন, ‘পালিয়ো না—পিছনে পালিয়ো না!’
হিল এমন ভেঙে পড়লেন য়ে, ওয়েলিংটনের গায়ে না ভর দিয়ে দাঁড়াতে পারলেন না।
পিক্টনের মৃতদেহ রণশয্যাশায়ী!
ওয়েলিংটনের মূলস্থান ছিল দুটি—হোউগোমন্ট ও লা-হে-সেইন্ট। হোউগোমন্ট তখনও ফরাসিদের হস্তগত হয়নি বটে, কিন্তু দাউ দাউ করে জ্বলছিল। লা-হে-সেইন্ট ইংরেজদের হাতছাড়া হয়েছে। সেখানে দাঁড়িয়ে যে তিন হাজার জার্মান সৈন্য লড়াই করছিল, তাদের মধ্যে প্রাণ নিয়ে ফিরেছে মাত্র বিয়াল্লিশ জন। পাঁচজন ছাড়া নায়কদের সবাই মৃত বা বন্দি। ইংরেজ রক্ষী সৈন্যের এক সার্জেন্ট, সে ছিল বিলাতের ‘চ্যাম্পিয়ন’ মুষ্টিযোদ্ধা। সবাই জানত, কেউ তার কিছু করতে পারবে না। কিন্তু ছোট্ট এক ফরাসি ছোকরা—সে দামামা বাজাত—সে-ই বিপুলবপু মুষ্টিযোদ্ধাকে বধ করলে! বহু ইংরেজ পতাকা ফরাসিদের হস্তগত। বিখ্যাত স্কটস গ্রে ফৌজ বিলুপ্ত। নায়ক পন্সনবির অশ্বারোহী দলকে ফরাসিরা কুচি কুচি করে কেটে ফেলেছে—পন্সনবি দেহের সাত জায়গায় আহত হয়ে মাটির উপরে পড়ে। পাঁচ ও ছয় নম্বর ফৌজও (ডিভিসন) আর নেই। মেটার, মার্শাল ও গর্ডন নায়করা মৃত।
অটুট আছে কেবল ইংরেজদের মধ্যভাগ। ওয়েলিংটন চারিদিক থেকে সৈনিক ও সেনানী আনিয়ে মধ্যভাগকে দৃঢ়তর করে তুলতে লাগলেন। এখানে ঝোপঝাপের ভিতরে তিনি এমন সুকৌশলে কামান ও বন্দুকধারী সৈন্য লুকিয়ে রাখলেন যে, ফরাসিরা তাদের অস্তিত্ব আবিষ্কার করতে পারলে না।
চিন্তিত, কিন্তু প্রশান্ত মুখে ওয়েলিংটন ঘোড়ার উপরে বসে আছেন সারাদিন। চারিদিকে হচ্ছে বুলেট বৃষ্টি। তাঁর এ-ডি-কং গর্ডন তাঁর পাশেই মারা পড়লেন।
সামনেই একটা গোলা পড়ে ফেটে গেল। লর্ড হিল বললেন, ‘মাই, লর্ড, আপনি যদি নিহত হন, তাহলে আমাদের কর্তব্য কী? আপনার কোনও হুকুম আমরা তামিল করব?’
ওয়েলিংটন সংক্ষেপে জবাব দিলেন, ‘আমি যা করছি তাই করবেন। যতক্ষণ একজনেরও জীবন থাকবে, এ জায়গাটা রক্ষা করবেন।’
গতিক আরও খারাপ হয়ে এল।
ওয়েলিংটন চিৎকার করে বললেন, ‘শোনো তোমরা! আমরা কি পালাবার কথা স্বপ্নেও মনে আনতে পারি? তাহলে ইংল্যান্ডের লোক আমাদের কি বলবে?’
বেলা চারটের সময়ে ইংরেজদের পঙক্তি ভেঙে গেল। ওয়েলিংটনও পিছু হটে গেলেন।
নেপোলিয়ন বলে উঠলেন, ‘এইবারে ওদের পলায়ন শুরু হল।’ এতক্ষণ পরে তাঁর মুখে আনন্দের হাসি ফুটল। রাজধানীতে তখনই তিনি খবর পাঠিয়ে দিলেন, যুদ্ধে তাঁর জিৎ হয়েছে।
এইবারে ইংরেজদের ধ্বংস করবার সময় এসেছে! নেপোলিয়ন তাঁর অশ্বারোহী সৈন্যদের আহ্বান করলেন। আধ মাইল জায়গা জুড়ে তারা এগিয়ে এল। মস্ত মস্ত ঘোড়ার উপরে প্রকাণ্ড সব সৈনিক! তরবারি খুলে নে তাদের পুরোভাগে গিয়ে দাঁড়ালেন। তারা অগ্রসর হল। সে এক দারুণ দৃশ্য!
ছুটেছে অশ্বারোহীর দল, তরবারি সব ঊর্ধ্বে উৎক্ষিপ্ত, পতাকা ও ভেরিগুলোও শূন্যে উত্থিত,—সমতালে সম ভঙ্গিতে অগ্রসর হচ্ছে যেন একটি মাত্র বিরাট জীব! এক উপত্যকার গভীর ও ভয়াবহ গহ্বরে ঘোড়াশুদ্ধ লাফিয়ে পড়ে পুঞ্জীভূত ধোঁয়ার ভিতরে তারা অদৃশ্য হয়ে গেল এবং তারপর উপত্যকার অপর পারে গিয়ে ছায়ার ভিতর থেকে আবার তারা আবির্ভূত হল! তখনও তারা বিশৃঙ্খল নয়—মাথার উপর দিয়ে ছুটছে গোলাগুলির ঝড়, তবু তারা আগেকার মতোই শ্রেণিবদ্ধ! দ্রুত কদমে ছুটে চলেছে গম্ভীর, নির্বিকার ভৈরব অশ্বারোহীর দল! কামান-বন্দুকের ঘন ঘন গর্জনের মাঝে মাঝে শোনা যাচ্ছে বিরাট অশ্বপদ-শব্দ! পুঞ্জ পুঞ্জ ধোঁয়ার ফাঁকে ফাঁকে দেখা যাচ্ছে সেই তীব্র গতির ঝটিকা!
লুকানো কামান-সারের পিছনে দাঁড়িয়ে ইংরেজ পদাতিকরা অপেক্ষা করছে, যারা আসছে তাদের দিকে বন্দুকের লক্ষ্য স্থির করে,—শান্ত, বোবা, স্থির! তারাও অশ্বারোহীদের দেখতে পাচ্ছে না, অশ্বারোহীরাও দেখতে পাচ্ছে না তাদের। তারা শুনছে কেবল নরবন্যা-প্রবাহের ধ্বনি, তিন হাজার ঘোড়ার খুরের শব্দ! আর শোনা যাচ্ছে অসি-ঝঞ্ঝনা আর বন্য শ্বাসপ্রশ্বাসের মতন কী একটা প্রচণ্ড ধ্বনি! তারপর হল এক গম্ভীর স্তব্ধতার সঞ্চার, তারপর জাগল তরবারির তাণ্ডব, সমুজ্জ্বল শিরস্ত্রাণ, মুখর ভেরি, পতাকার পর পতাকা এবং তিন হাজার সম্মিলিত কণ্ঠের উন্মত্ত জয়নাদ—’সম্রাট দীর্ঘায়ু হোন!’ এসে পড়ল যেন এক মূর্তিমান ভূমিকম্প!
আচম্বিতে এক ট্র্যাজেডি! ফরাসি ঘোড়সওয়ারের দক্ষিণ পার্শ্ব হঠাৎ স্তম্ভিত হয়ে পড়ল। ইংরেজদের ধ্বংস করবার উদ্দেশ্যে উত্তেজনায় উন্মত্ত হয়ে ঝড়ের তোড়ে অশ্বারোহীরা সভয়ে দেখলে, সামনেই এক সুদীর্ঘ খাত! এটা ছিল একেবারেই অভাবিত! খাতটি চওড়ায় তেরো ফুট! কিন্তু তখন আর সাবধান হওয়ার কোনও উপায়ই নেই! ধাবমান দ্বিতীয় সারের ধাক্কায় প্রথম সার এবং তৃতীয় সারের ধাক্কায় দ্বিতীয় সারের ঘোড়ারা সওয়ারদের নিয়ে হুড়মুড় করে পড়ল সেই ভয়াবহ খাতের ভিতরে গিয়ে! মুক্তিলাভ অসম্ভব! নীচে পড়ে ঘোড়াগুলো চার পা তুলে ছটফট করতে ও গড়াগড়ি দিতে লাগল—যেন জীবন্ত পেষণ-যন্ত্রে ধরা পড়ে সওয়ারদের হাড়গোড়গুলো গুঁড়ো হয়ে গেল—সমস্ত খাতটাই হয়ে উঠল রক্তাক্ত! যে উত্তেজনায় ফরাসিরা ছুটে আসছিল ইংরেজদের হত্যা করতে, সেই উত্তেজনার ঝোঁকেই তারা করলে আত্মহত্যা! যতক্ষণ না সেই নির্দয় খাত অশ্বদেহে ও নরদেহে পরিপূর্ণ হয়ে উঠবে, ততক্ষণ মিটবে না তার ক্ষুধা!…তাই হল। খাত কানায় কানায় ভরে উঠল—জলে নয়, জীবন্ত জীবের দেহে! তখন তাদের উপর দিয়ে, তখনও-জ্যান্ত দেহগুলো মাড়িয়ে ধেয়ে চলল বাকি অশ্বারোহীর দল! একটা সমগ্র ব্রিগেডের অধিকাংশ সৈন্যকে গ্রাস করে ফেললে সেই ভীষণ খাত!
এদিকে এই মারাত্মক অভিনয় চলছে, ওদিকে ইংরেজদের লুকানো কামানগুলো আরম্ভ করলে অগ্নিবর্ষণ। কিন্তু অশ্বারোহীরা থামল না, খাতের ক্ষুধার্ত উদর তাদের অনেককে গ্রাস করেছে বটে, কিন্তু তবু তারা ভগ্নোৎসাহ হয়নি। পূর্ণগতিতে ইংরেজ ফৌজের দিকে তারা ছুটিয়ে দিলে ঘোড়া! তারা ঘোড়ার লাগাম ছেড়ে দিলে, তরবারি দাঁতে কামড়ে ধরলে এবং প্রত্যেকেই দু-হাতে নিলে দুটো পিস্তল। এইভাবে করলে তারা আক্রমণ!
চতুষ্কোণ ব্যূহের মধ্যে ফরাসি সৈন্যরা পাথরের মূর্তির মতন স্থির হয়ে রইল। চারিদিক থেকে তারা আক্রান্ত হল। ভয়াবহ! সে যেন ক্রুদ্ধ ঘূর্ণাবর্তের আক্রমণ! ইংরেজদের প্রথম সার মাটির উপরে হাঁটু গেড়ে বসে বন্দুকের বেওনেট তুলে অশ্বারোহীদের করলে সাংঘাতিক অভ্যর্থনা! দ্বিতীয় সার দণ্ডায়মান হয়ে বন্দুক ছুড়লে। দ্বিতীয় সারের পিছন থেকে গোলন্দাজরা কামান দাগতে লাগল। কামানের গোলার পথ খুলে দেওয়ার জন্যে চতুষ্কোণ ব্যূহের সমুখটা ফাঁক হয়ে একবার দুদিকে সরে গেল, তারপর পথ আবার বন্ধ!
অশ্বারোহীরাও আনলে মৃত্যুর বিরুদ্ধে মৃত্যু—ধ্বংসের বিরুদ্ধে ধ্বংস! তাদের ঘোড়াগুলো লাফ মেরে সেই চতুষ্কোণ ব্যূহের জীবন্ত প্রাচীর ডিঙিয়ে বেওনেটের উপর দিয়ে ভিতরে এসে পড়ল! চতুষ্কোণ ব্যূহগুলো যেন ভলকানো, আক্রান্ত হয়েছে মেঘের দ্বারা; যেন আগ্নেয়েদগার লড়ছে বজ্রবিদ্যুতের সঙ্গে। প্রথম ধাক্কাতেই ব্যূহের চতুষ্কোণ প্রায় ধ্বংস হয়ে গেল। সেখানে ছিল হাইল্যান্ডাররা। চতুর্দিকে যখন মৃত্যুর তাণ্ডবলীলা, সেই সময়ে ফৌজের ব্যাগপাইপ বাদক যেন গভীর বিস্মৃতির মধ্যে একটা দামামার উপরে বসে যুদ্ধ সঙ্গীতের সুর সৃষ্টি করতে লাগল—তার দুই চোখে নৃত্য করছিল যেন স্কটল্যান্ডের শ্যামল বন ও নীল হ্রদের প্রতিচ্ছায়া! তার হাতের তলায় থেকে ব্যাগপাইপের রাগিণী শোনাচ্ছিল যেন সুদূর পর্বতের ভাষা! এই গান শুনতে শুনতে হাইল্যান্ডাররা অন্তিম শ্বাস ত্যাগ করলে। একজন অশ্বারোহী এসে বাদকের হাত তরবারি চালিয়ে কেটে দুখানা করে দিলে—সঙ্গে সঙ্গে সঙ্গীতের অবসান!
মৃত্যু-খাত অশ্বারোহীদের সংখ্যা কমিয়ে দিয়েছে বটে এবং ইংরেজরাও সংখ্যায় তাদের চেয়ে ঢের বেশি! তবু তারা এক-একজন দশজন হয়ে লড়তে লাগল। ইংরেজ পক্ষের হ্যানোভার-দেশীয় সৈন্যদের দল ভেঙে গেল। তাই দেখে ওয়েলিংটন তখনই সমারসেট সাদি-সৈন্যদের ঘটনাস্থলে পাঠিয়ে দিলেন। সেই মুহূর্তে নেপোলিয়নও যদি তাঁর পদাতিকদের স্মরণ করতেন, তাহলে জয়লাভ করতেন তিনিই। তাঁর এই ভুল হল মারাত্মক ভুল! ফরাসি অশ্বারোহীরা দেখলে, তাদের সামনে রয়েছে ইংরেজদের চতুষ্ক-ব্যূহ এবং পিছনে এসে দাঁড়াল সমারসেট ড্রাগনের দল—সংখ্যায় ১,৪০০। সামনে, পিছনে, ডাইনে, বামে আক্রান্ত হয়েও তারা লড়তে লাগল অদম্য উৎসাহে! সে যেন সশস্ত্র বিদ্যুতের সাইক্লোন। মুহূর্ত মধ্যে দেখা গেল ১,৪০০ শত্রু সাদীদের মধ্যে বেঁচে আছে ৮০০ জন! কিন্তু চতুষ্ক-ব্যূহ তখনও অটল! উপরি-উপরি বারো বার আক্রমণ হল! চার-চারবার সেনাপতি নে-র ঘোড়া মারা পড়ল। ফরাসি অশ্বারোহীদের অর্ধেক মৃত। এই সংঘর্ষ চলল দুই ঘণ্টা ধরে।
ইংরেজ বাহিনীর তখন অত্যন্ত দুর্দশা। পথিমধ্যে মৃত্যু-খাতের দুর্ঘটনা না ঘটলে ফরাসি অশ্বারোহীরা এতক্ষণে ইংরেজদের মধ্যভাগ নিশ্চয়ই ভেঙে দিতে পারত। কিন্তু তবু তারা তেরোটি চতুষ্ক-ব্যূহের মধ্যে সাতটিকে ধ্বংস করে ফেলেছে এবং ছয়টি পতাকা দখল করে নেপোলিয়নের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছে!
ওয়েলিংটনের অবস্থা টলোমলো! ইংরেজদের রক্তে ভেসে যাচ্ছে রণক্ষেত্র। চরমকাল নিকটস্থ!
বাম পার্শ্ব থেকে ইংরেজ সেনাপতি কেম্পট আরও সৈন্য চেয়ে পাঠালেন।
ওয়েংলিটন জানালেন, ‘আর সৈন্য নেই। কেম্পটকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মরতে বলো।’
ফরাসিদেরও যাই-যাই অবস্থা! নে পদাতিকদের সাহায্য চাইলেন।
নেপোলিয়ন বললেন, ‘পদাতিক? কোথায় পাব? আমি কি পদাতিক তৈরি করব?’
কিন্তু ইংরেজদের অবস্থাই অধিকতর শোচনীয়। দলে দলে সৈন্য মারা পড়েছে। বড় বড় জেনারেলরা মৃত—তাদের স্থানে দাঁড়িয়ে কাজ চালাচ্ছে ক্যাপটেন বা লেফটেন্যান্টরা। হানোভার হুসারের দল প্রাণপণে পলায়ন করছে! অন্য যেদিকে তাকানো যায়, সেদিকেও ওই দৃশ্য! পলাতকের পর পলাতকের দল ছুটেছে!
ওয়েলিংটনের মুখ প্রশান্ত, কিন্তু তাঁর ঠোঁট সঙ্কুচিত। বেলা পাঁচটার সময়ে তিনি ঘড়ি বার করে বললেন, ‘হয় ব্লুচার, নয় রাত্রি আসুক।’
ঠিক এই মুহূর্তেই বহুদূরে দেখা গেল জ্বলন্ত বেওনেটের দীর্ঘ রেখা! এইখানেই হল এই বৃহৎ নাটকের দৃশ্য-পরিবর্তন!
নেপোলিয়ন আশা করেছিলেন চৌত্রিশ হাজার সৈন্য নিয়ে তাঁর সেনাপতি গ্রাউচি এইবারে এসে উপস্থিত হবেন। কিন্তু তাঁর বদলে এলেন প্রুশিয়ান সেনাপতি ব্লুচার! জীবনের বদলে মৃত্যু! ব্লুচার আর একঘণ্টা পরে এলে রণক্ষেত্রে ইংরেজদের দেখা পেতেন না, সেখানে শুনতেন কেবল ফরাসিদের জয়ধ্বনি।
পাঁচটার সময়ে রণক্ষেত্রে এসে দাঁড়িয়ে ব্লুচার দেখলেন ওয়েলিংটনের অবস্থা বিষম সঙিন! নিজের সেনাপতিকে ডেকে তিনি বললেন, ‘বুলো, ফরাসিদের আক্রমণ করো—ইংরেজদের একটু হাঁপ ছাড়বার সময় দাও!’
আক্রমণ করলে প্রুশিয়ানরা—তাদের ছিয়াশিটা নতুন কামান অগ্নি উদ্গার করতে লাগল! নতুন পদাতিক দল, নতুন অশ্বারোহী দল! ফরাসিরা হটে আসতে লাগল। আসন্ন সন্ধ্যার অন্ধকারে বিশৃঙ্খল, শ্রান্ত ফরাসিরা আবার এক নতুন যুদ্ধে যোগ দিতে বাধ্য হল। সমগ্র ইংরেজ বাহিনী আবার আক্রমণ করতে অগ্রসর হল। সামনে ধ্বংস, পাশে ধ্বংস। ফরাসিদের এই চরম কালে নেপোলিয়ন আহ্বান করলেন তাঁর বিশ্ববিখ্যাত ‘ইম্পিরিয়াল গার্ড’ দলকে।
গার্ডরা যখন শুনলে তাদের নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে ঝাঁপ দেওয়ার জন্যে আহ্বান করা হয়েছে, তখন তারা দৃপ্ত কণ্ঠে চেঁচিয়ে উঠল—’সম্রাট দীর্ঘায়ু হোন!’
সারাদিন আকাশ ছিল মেঘাচ্ছন্ন। হঠাৎ এখন মেঘ সরে গেল। দিকচক্রবালরেখা রঞ্জিত হয়ে উঠল অস্তগামী সূর্যের রক্তরাগ মহিমায়! গার্ডরা এমনি আরক্ত সূর্য দেখেছিল একদিন অস্টারলিটজের উদয়াচলে! বহু যুদ্ধে বারংবার পরীক্ষিত এই প্রাচীন ও দুর্ধর্ষ রক্ষী-সৈনিকরা সন্ধ্যা-রাগরক্ত আকাশের দিকে তাদের ঈগল-চিহ্নিত পতাকা আন্দোলিত করে চোখে-মুখে দৃঢ় প্রতিজ্ঞার ইঙ্গিত জাগিয়ে তালে তালে পা ফেলে অগ্রসর হল, তখন প্রত্যেক শত্রুর হৃদয় অভিভূত হল ফ্রান্সের প্রতি গভীর শ্রদ্ধায়। তাদের মনে হল যেন দলে দলে শরীরী বিজয় রণাঙ্গনে আবির্ভূত হয়েছে! এখন যারা জয়ী, তারাও পরাজিতের মতন সঙ্কুচিত হয়ে পিছিয়ে পড়তে লাগল পায়ে পায়ে!
ওয়েলিংটন প্রমাদ গুণে চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘এগিয়ে এসো রক্ষীগণ! আক্রমণ করো!’
ঝোপের ভিতরে আত্মপ্রচ্ছন্ন করে ইংরেজদের লাল পল্টন এতক্ষণ অপেক্ষা করছিল, এইবারে তারা এগিয়ে এল—বিষম গুলিবৃষ্টিতে ফরাসিদের ত্রিবর্ণ পতাকা শতচ্ছিন্ন হয়ে গেল। দুই পক্ষই ঝাঁপিয়ে পড়ল পরস্পরের উপরে—আরম্ভ হল প্রচণ্ড হত্যাকাণ্ড! ইম্পিরিয়াল গার্ডের সৈনিকরা অন্ধকারে অনুভব করলে, তাদের চারিদিক দিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে ফরাসি সৈন্যেরা! তাদের প্রাণে প্রাণে জাগল পরাজয়ের নিরাশা! সম্রাটের নামে জয়ধ্বনির পরিবর্তে শুনতে পেলে ‘পালাও পালাও’ রব! কিন্তু এ-শব্দের বিভীষিকা উপলব্ধি করেও ইম্পিরিয়াল গার্ড অটল পদে অগ্রসর হতে লাগল! পদে পদে মৃত্যু, তবু তারা এগিয়ে যাচ্ছে পদে পদে! কেউ ইতস্তত করলে না, কেউ কাপুরুষতা দেখালে না! আত্মহত্যা করবার ভয়েও জনপ্রাণী হল না পশ্চাৎপদ!
নে-র দেহের তলায় পঞ্চম ঘোড়া মারা পড়ল! মৃত্যুপণ করে তিনি ষষ্ঠ ঘোড়ায় চেপে আবার ঝাঁপ দিলেন রক্তসাগরে! তখন তাঁর দুই চক্ষু আসন্ন আত্মবিসর্জনের তীব্র আকাঙ্ক্ষায় জ্বল-জ্বল করে জ্বলছে, মুখ দিয়ে ফেনা বেরুচ্ছে, বোতাম-ছেঁড়া জামা ঝল-ঝল করে ঝুলছে। তাঁর পোশাকের উপরে কোথাও তরবারির এবং কোথাও বুলেটের দাগ—কর্দমাক্ত, রক্তাক্ত, তবু অপূর্ব সেই বীর ভাঙা তরবারি তুলে ছুটে এসে বললেন, ‘তোমরা দেখো, ফরাসিদের সেনাপতি কেমন করে সম্মুখযুদ্ধে প্রাণ দেয়!’ কিন্তু বৃথা! বৃথা! নে-র মৃত্যু হল না!
অসংখ্য শত্রু মুষ্টিমেয় ফরাসিদের উপরে অশ্রান্ত গোলাগুলি বৃষ্টি করছে দেখে নে চিৎকার করে উঠলেন, ‘এখানে কি আমার জন্যে কিছুই নেই? হায়! আমার ইচ্ছা ইংরেজদের সমস্ত বুলেট আমারই দেহে প্রবেশ করুক!’ হা হতভাগ্য, ইংরেজ বুলেট নয়, তোমার জন্যে তোলা অছে ফরাসি বুলেট! (নেপোলিয়নের পতনের পর নতুন ফরাসি সম্রাটের হুকুমে মহাবীর নেকে গুলি করে মেরে ফেলা হয়!)
গার্ডরা যখন প্রাণ বিলিয়ে দিচ্ছে, অন্যান্য দিকে ফরাসি বাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল আচম্বিতে! ‘পালাও পালাও’ রবের সঙ্গে শোনা গেল ‘বিশ্বাসঘাতকতা, বিশ্বাসঘাতকতা!’ সেনাদলের ধ্বংস হচ্ছে তুষার গলে যাওয়ার মতন। তখন সমস্তই ব্যর্থ হয়, ছিঁড়ে যায়, ভেঙে যায়, ভেসে যায়, গড়িয়ে যায়, ডুবে যায়, ধাক্কা খায়, পালায়, পতিত হয়। নে তাড়াতাড়ি একটা ঘোড়ায় চড়ে টুপিহীন, গলাবন্ধহীন, অস্ত্রহীন অবস্থায় পলাতকদের ফিরিয়ে আনতে ছুটলেন—কিন্তু সে যেন হল বন্যার মুখে বালির বাঁধ দেওয়ার দুশ্চেষ্টার মতন! পলাতকরা সসম্ভ্রমে চিৎকার করে উঠল—’সেনাপতি নে দীর্ঘায়ু হোন!’ কিন্তু তারপরেই বেগে পলায়ন করতে লাগল! আতঙ্কের সময়েই হয় বেশি হাঙ্গামা, অন্ধের মতন পালাতে গিয়ে বন্ধু করে বন্ধু হত্যা! ইম্পিরিয়াল গার্ডের অবশিষ্ট অংশ নিয়ে নেপোলিয়ন স্বয়ং পলাতকদের বাধা দিতে গেলেন—কিন্তু বৃথা! তিনি তাদের মিনতি করতে, ভয় দেখাতে, উৎসাহ দিতে চেষ্টা করলেন—কিন্তু বৃথা! সকালে যারা চেঁচিয়েছিল ‘সম্রাট দীর্ঘায়ু হোন’ বলে, এখন তারা যেন তাঁকে চিনতেই পারলে না!
একেবারে তাজা প্রুশিয়ান অশ্বারোহীর দল মৃত্যুর খেলা শুরু করলে। কামান নিয়ে ফরাসি গোলন্দাজরা পালাতে লাগল, অনেকে গোলার বাক্স-গাড়ির ঘোড়া খুলে নিলে—তাড়াতাড়ি পালাবার জন্যে। চারিদিকে ভিড়ের ঠেলাঠেলি—জীবন্ত ও মৃতদেহকে পদদলিত করে। রাস্তা, মেঠো-পথ, সাঁকো, ময়দান, পাহাড়, উপত্যকা, অরণ্য আচ্ছন্ন করে চল্লিশ হাজার পলাতক পালিয়ে যাচ্ছে। যারা ছিল সিংহ, তারা হল হরিণ!
সেনানী লোজে বহু চেষ্টায় তিনশত লোককে ফিরিয়ে দাঁড় করালেন। কিন্তু প্রুশিয়ানদের প্রথম ঝাঁক গুলি ছুটে আসামাত্র তারা দিগবিদিক জ্ঞান হারিয়ে আবার পালাতে লাগল—লোজে হলেন বন্দি! ব্লুচার নিষ্ঠুর ভাষায় হুকুম দিলেন ‘ফরাসিদের একেবারে ধ্বংস করে ফ্যালো! প্রুশিয়ানরা প্রাণপণে সেই চেষ্টাই করলে!
দুজন ফরাসি সেনানী একটি ছন্নছাড়া লোককে দীর্ঘ কোটের প্রান্ত ধরে টেনে ফেরাবার চেষ্টা করছেন! পলাতকদের বন্য ঠেলায় তিনি এত পিছনে হটে আসতে বাধ্য হয়েছেন, নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধেই। কিন্তু এখন তিনি ঘোড়া থেকে নেমে পড়ে লাগাম ধরে উদভ্রান্তের মতন আবার ওয়াটার্লু ক্ষেত্রের দিকে ফিরে যেতে চান। ইনি হচ্ছেন নেপোলিয়ন, স্বপ্ন তাঁর ভেঙে গেছে!
কিন্তু তখনও ইম্পরিয়াল গার্ডের বিভিন্ন দল বিভিন্ন স্থানে দাঁড়িয়ে লড়াই করছে। চতুর্দিকব্যাপী আতঙ্কের বিপুল বন্যার মাঝে মাঝে তাদের দেখাচ্ছে অটল শৈলের মতন। রাত্রি আসন্ন, মৃত্যুও আসন্ন, এই দুই আসন্ন অন্ধকার কখন তাদের আবৃত করে ফেলবে, তারা তারই প্রতীক্ষায় আছে। কোনও দলের সঙ্গে কোনও দলেরই যোগ নেই, কিন্তু প্রত্যেক দলই মৃত্যুর জন্যে বদ্ধপরিকর।
সন্ধ্যার পর এক জায়গায় এমনই একটি দলকে দেখা গেল। তাদের চারিদিকে অসংখ্য শত্রু এবং ঝরে পড়ছে গোলাগুলির ভীষণ ধারা! কিন্তু তবু তারা লড়ছে! এ-দলের নায়ক হচ্ছেন একজন অজানা সেনানী, নাম তাঁর ক্যামব্রোন। যখন দলের লোক মুষ্টিমেয়, যখন তাদের পতাকা পরিণত ছেঁড়া ন্যাকড়ার টুকরোয়, যখন তাদের গুলিশূন্য বন্দুক যষ্টি ছাড়া আর কিছু নয়, যখন মৃতের স্তূপ জীবন্তদের চেয়ে বৃহৎ, তখন আক্রমণকারী বিজয়ী শত্রুসৈন্যরাও মানুষদের এমন মহানভাবে মরতে দেখে পবিত্র এক ভয়ে আচ্ছন্ন হয়ে গেল—তারা গোলাগুলি ছোড়া বন্ধ করলে! কিছুক্ষণ সব শান্ত। তারপর আবার কামান-বন্দুকের গভীর গর্জনে কেঁপে উঠল চারিদিকের পাহাড়েরা! উঠন্ত চাঁদের আলোয় রাশীকৃত ধোঁয়া যখন মিলিয়ে গেল, তখন সেখানে আর একজনও মানুষ দাঁড়িয়ে নেই। গার্ডের দল নিঃশেষ! তাদের বুকের ভিতরে চিরনিদ্রিত হল কত যুদ্ধের গৌরবময় স্মৃতি!
ওয়াটার্লু হচ্ছে একটি প্রথম শ্রেণির যুদ্ধ, কিন্তু তার বিজয়ী হচ্ছেন দ্বিতীয় শ্রেণির সেনাপতি। সেনাপতি ওয়েলিংটনের চেয়ে উল্লেখ্য হচ্ছে ইংলন্ডের সৈন্যদল! কিন্তু তার মধ্যে সবচেয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করে দৈবের খেলা! যুদ্ধের পূর্বরাত্রে সেই অসাময়িক বৃষ্টি, সেই অভাবিত মৃত্যু-খাত, কামান-ধ্বনি শোনবার পরেও ফরাসি নায়ক গ্রাউচির সেই অনুপস্থিতি, যথাসময়ে ব্লুচারের সেই আবির্ভাব—এই-সব দৈব-দুর্ঘটনা বিচিত্রভাবে নিয়মিত হয়েছে!