দশম অধ্যায় । ঝিলামের যুদ্ধ এবং তারপর
শিয়ালকোটের মাইল পঞ্চাশ উত্তর-পশ্চিমে ঝিলাম শহর। তার পাশে কারি প্রান্তর। সেইখানে খ্রিস্টপূর্ব ৩২৬ অব্দে জুনের শেষে কিংবা জুলাইয়ের প্রথম দিকে আলেকজান্ডারের সঙ্গে পুরুর ইতিহাসপ্রসিদ্ধ যুদ্ধ হয়। যুদ্ধটি ইতিহাসপ্রসিদ্ধ বটে, কিন্তু বিশেষ বড় যুদ্ধ নয়। গ্রিক ও অন্যান্য পাশ্চাত্য লেখকরা আলেকজান্ডারের মহিমাকীর্তনের জন্যেই একটি সাধারণ যুদ্ধকে অসাধারণ বলে প্রতিপন্ন করতে চেয়েছেন। এর চেয়ে ঢের বড় যুদ্ধ হয় সেলিউকসের সঙ্গে চন্দ্রগুপ্তের। কিন্তু সেখানে গ্রিকরা পরাজিত হয়েছিল, তাই গ্রিক লেখকরা তার কোনও বর্ণনাই দেননি।
পাহাড়ের বরফ গলা জল নদীতে এসে পড়েছে, ফুলে উঠেছে তাই ঝিলামের বুক।
নদীর এক পারে গ্রিক ফৌজ, আর এক পারে ভারতীয় শিবির।
গ্রিকদের ভাবভঙ্গি দেখে পুরু ভাবলেন, নদীর জল না কমলে আলেকজান্ডার পার হবার চেষ্টা করবেন না। পুরুকে ঠকাবার জন্যেই আলেকজান্ডার এই কৌশল অবলম্বন করেছিলেন।
এক দুর্যোগের রাত। বৃষ্টি পড়ছে মুষলধারে। আলেকজান্ডার গোপনে একদল সৈন্য নিয়ে খানিকটা দূরে সরে গিয়ে নদী পার হলেন।
পুরু কিছুই জানতে পারলেন না। তিনি নদীর পরপারের গ্রিক সৈন্যদের সামনাসামনি জায়গা বেছে ব্যূহ রচনা করেছিলেন। হঠাৎ অন্যদিক থেকে গ্রিকরা আক্রমণ করতে আসছে দেখে তাড়াতাড়ি ব্যূহের মুখ ফেরাতে গেলেন, এমন সময়ে ওপার থেকেও গ্রিকরা নদী পার হতে লাগল। তিনি কোন দিক সামলাবেন বুঝতে না বুঝতেই প্রায় চারিদিক থেকেই আক্রান্ত হলেন। তাঁর সামনে আলেকজান্ডার, পিছনে ওপারের গ্রিক ফৌজ।
আলেকজান্ডারের চমৎকার রণকৌশলে পুরুকে পরাজিত হতে হল।
পুরু নিজে বীরের মতন শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ করেছিলেন। তার পর দেহের নয় জায়গায় আহত হয়ে যখন প্রায় অচেতন হয়ে পড়েছেন, তখন গ্রিকরা তাঁকে বন্দি করতে পারলে।
পুরুকে নিয়ে যাওয়া হল গ্রিক দিগবিজয়ীর শিবিরে।
আলেকজান্ডার মুগ্ধ বিস্ফারিত নেত্রে দেখলেন, সাড়ে-ছয় ফুট দীর্ঘ, বলিষ্ঠ ও গৌরবর্ণ দেহ। সর্বাঙ্গে রক্ত ঝরছে, যুদ্ধশ্রমে ও রক্তপাতে ক্লান্ত শরীর—মাথা তবু উঁচু, দৃষ্টি তবু তেজে পরিপূর্ণ! মূর্তিমান বীরত্ব!
আলেকজান্ডার জিজ্ঞাসা করলেন, ‘বীর, তোমার সঙ্গে কীরকম ব্যবহার করব?’
পুরু সগর্বে উত্তর দিলেন, ‘রাজার সঙ্গে রাজার মতো!’
আলেকজান্ডার তাই করেছিলেন—বীর হয়ে তিনি বীরের মর্যাদা ভুললেন না। পুরুর রাজ্যই কেবল পুরুকে ফিরিয়ে দেওয়া হল না—সেই সঙ্গে তিনি তাঁর নিজের দেশের চেয়ে বড় দেশের শাসনভার লাভ করলেন।
এই যুদ্ধকে স্মরণীয় করবার জন্যে আলেকজান্ডার ভারতে দুইটি নতুন নগর স্থাপন করলেন এবং তার একটির নাম বুকোফেলাস। তাঁর আদরের ঘোড়া ষণ্ডমুণ্ড এতদিন পরে ভারতে এসে বুড়ো হয়ে মারা পড়েছে—তার নামেই এই নগরটির নামকরণ! সে নাম আর নেই, কারণ, নগরটি আজ ঝিলাম নামে প্রসিদ্ধ।
ঝিলামের যুদ্ধ চরম যুদ্ধও নয়। কারণ, তখনও আলেকজান্ডারের চারিদিকেই শত্রু! কাজেই তাঁকে ক্রমাগত যুদ্ধে নিযুক্ত থাকতে হল। এসব যুদ্ধের বর্ণনা অনাবশ্যক।
তারপর আলেকজান্ডার স্থির করলেন, তিনি মগধের দিকে অগ্রসর হবেন! তিনি বুঝেছিলেন, আসল ভারত এখনও তাঁর নাগালের বাইরে পড়ে আছে।
সত্যই তাই। আর্যাবর্তের প্রধান সাম্রাজ্য তখন মগধ। ভারতে এসে এতদিন পর্যন্ত আলেকজান্ডার যেসব রাজ্য অধিকার করেছেন, আকারে ও ক্ষমতায় মগধের কাছে তারা নগণ্য বললেও চলে।
কিন্তু মগধের ফৌজে ছিল আশি হাজার অশ্বারোহী, দুই লক্ষ পদাতিক, আট হাজার যুদ্ধরথ ও ছয় হাজার হস্তী। মগধরাজ ইচ্ছা করলে তাঁর বাহিনীকে আরও ঢের বড় করে তুলতে পারতেন, কারণ, তাঁর জনবল ও অর্থবল ছিল অফুরন্ত।
গ্রিক সৈন্যদের কানেও এসব খবর গিয়েছিল। তারা আলেকজান্ডারের ইচ্ছার কথা শুনে প্রমাদ গুনলে।
সৈন্যদের ভাবভঙ্গি দেখে আলেকজান্ডার তাদের উৎসাহিত করবার জন্যে বললেন, ‘গ্রিক বীরগণ! স্মরণ করে দ্যাখো, গ্রিসের প্রান্ত থেকে ভারতের এই সিন্ধুনদের প্রান্ত পর্যন্ত তোমরা কী অতুল বীরত্বের ও কী অক্ষয় গৌরবের প্রতিষ্ঠা করেছ! আমার সঙ্গে অগ্রসর হও—সমস্ত এশিয়া ও তার সমস্ত ধনসম্পত্তি আমি তোমাদেরই হাতে তুলে দেব!’
কিন্তু সৈন্যরা আর এসব কথা শুনতে নারাজ, তারা স্তব্ধ হয়ে রইল।
অবশেষে সেনাপতি কইনস সাহস সঞ্চয় করে বললেন, ‘রাজা, আট বছর আমরা স্বদেশ ত্যাগ করে এসেছি। আমাদের অনেকেই মারা পড়েছে। যারা বেঁচে আছে তাদেরও অবস্থা ভালো নয়। এখন আমাদের দেশেই ফেরা উচিত।’
সৈনিকরা চারিধারে দাঁড়িয়ে সব শুনছিল। কইনসের কথা শেষ হতেই তারা সানন্দে চিৎকার করে সেনাপতির মত সমর্থন করলে। তাইতেই বোঝা গেল সৈনিকদের মনের গতিক।
আলেকজান্ডার অত্যন্ত মর্মাহত হলেন। কিন্তু তিনি যে মত পরিবর্তন করেছেন, এমন কোনও ভাব প্রকাশ করলেন না। জবাব না দিয়ে নিজের তাঁবুর ভিতরে গিয়ে ঢুকলেন।
এক দিন গেল, দুই দিন গেল, তাঁবুর বাইরে কেউ আলেকজান্ডারের দেখা পেলে না। সেখানে তিনি কী করছেন? ভাবছেন আর ভাবছেন। মনের ভিতরে তিনি ভবিষ্যতের জন্যে হয়তো একখানি বিশ্ব-বিস্তৃত নতুন মানচিত্র এঁকে রেখেছিলেন। হয়তো তার অনেকখানিই এখন তাঁকে গুটিয়ে ফেলতে হল। সৈনিক না পেলে দিগবিজয় অসম্ভব। কিন্তু তাঁর বিশ্বস্ত সৈনিকরাই আজ বিদ্রোহী। এদের মন তাঁর মতো বিশ্বগ্রাসী নয়। তাঁর কোনও কথাতেই ওরা আর বশ মানবে বলে বোধ হয় না।
তৃতীয় দিনে আলেকজান্ডার আবার বাইরে এসে দাঁড়ালেন। জ্যোতিষীরা এসে বললে, ‘রাজা, গুণে দেখলুম, লক্ষণ মন্দ। গ্রহদেবতারা আপনার প্রতি এখন বিমুখ।’
জ্যোতিষীদের আর মাথা না ঘামালেও চলত। আলেকজান্ডার এর আগেই মন স্থির করে ফেলেছেন। নীরস বিষণ্ণকণ্ঠে বললেন, ‘সৈন্যগণ, আমরা স্বদেশে যাত্রা করব।’ (খ্রিস্টপূর্ব ৩২৬)।
কিন্তু এ হচ্ছে প্রত্যাবর্তন, না পলায়ন? আলেকজান্ডার মগধের ভয়ে ভারত ছেড়ে সরে পড়েছিলেন, এমন কথা বললে আধুনিক ইউরোপীয়রা আমাদের তেড়ে মারতে আসবেন। কিন্তু মেগান্থেনেসের ভারতভ্রমণ নিয়ে আলোচনা করবার সময়ে প্রাচীন গ্রিক ঐতিহাসিক দায়াদরাস কী বলছেন শুনুন :
‘মাসিডনপতি আলেকজান্ডার সকলকেই পরাজিত করেছিলেন। কিন্তু তিনি মগধের সঙ্গে লড়াই করতে সাহসী হননি। তিনি ভারত অধিকারের ইচ্ছা দমন করেন মগধের সৈন্যবলের কথা শ্রবণ করে।’
এর উপরে আমাদের টীকা অনাবশ্যক।
ইতিমধ্যে গ্রিস থেকে পঁচিশ হাজার—কেউ কেউ বলেন, ছত্রিশ হাজার নতুন সৈনিক এসে পড়ল। তারা এসেছিল দিগবিজয়ে অংশ গ্রহণ করতে, কিন্তু ধুলো পায়েই তাদের আবার দেশের দিকে মুখ ফেরাতে হল। তবে তাদের পেয়ে সুবিধাই হল আলেকজান্ডারের। কারণ, প্রত্যাবর্তনের পথ কেবল সুদীর্ঘই নয়, আলেকজান্ডারের পক্ষে যথেষ্ট বিপদসঙ্কুলও হয়েছিল। সৈন্যবল অল্প হলে তাঁর অবস্থা কী হত বলা যায় না।
আলেকজান্ডার স্থির করলেন, প্রত্যাবর্তন করবেন নতুন পথ দিয়ে। কেবল স্থলপথ নয়, অবলম্বন করবেন জলপথও। তাঁর মন ছিল নব নব পথের নেশায় পাগল। তিনি নূতন নূতন দেশ দেখে নতুন নতুন আবিষ্কার করে নিজের এবং পৃথিবীর জ্ঞানের সীমা বাড়িয়ে তুলতে চান। এ কেবল দিগবিজয়ীর নয়, বৈজ্ঞানিকের মন।
আলেকজান্ডার প্রায় দুই হাজার জাহাজ সংগ্রহ করলেন। খ্রি.পূ. ৩২৬ অব্দের অক্টোবর মাসের শেষাশেষি সমস্ত আয়োজন সমাপ্ত হল। যাবার সময়ে তিনি মহারাজা পুরুর রাজ্যসীমা বাড়িয়ে তাকে উত্তর ভারতের সর্বপ্রধান রাজ্যে পরিণত করে গেলেন। এইতেই বোঝা যায়, পুরুকে তাঁর ভালো লেগেছিল কতখানি! শত্রু আলেকজান্ডার যেমন ভয়াবহ, মিত্র আলেকজান্ডার তেমনি মিষ্টচরিত্র!
ভারতের জলপথ গ্রিক নৌবাহিনী নিয়ে সমুদ্রের দিকে অগ্রসর হল। মাঝে মাঝে আলেকজান্ডারকে ডাঙায় নেমে যুদ্ধ করতে হয়। ফেরবার পথেও তিনি ছোট বড় কয়েকটি যুদ্ধজয় করেছিলেন। এ পথে তাঁর সবচেয়ে বড় ও বিখ্যাত যুদ্ধ হয় মালবদেশে। এখানে আলেকজান্ডারের বিরুদ্ধে কয়েকটি জাতি একসঙ্গে সম্মিলিত হয়েছিল। এবং অস্ত্র ধরে দাঁড়িয়েছিল নাকি প্রায় এক লক্ষ লোক। শত্রুদের সংখ্যা দেখে গ্রিকরা প্রথমে ভয়ে পালাতে চেয়েছিল, পরে আলেকজান্ডারের উৎসাহ বাণী শুনে ফিরে দাঁড়ায় ও যুদ্ধে জয়লাভ করে।
এই অঞ্চলেই মুলতান নগর আক্রমণ করতে গিয়ে আলেকজান্ডার এমন আহত হয়েছিলেন যে, তাঁর বাঁচবার আশা ছিল না। মালবদেশে গ্রিক সৈন্যরা একাধিকবার বিষম হত্যাকাণ্ডের অনুষ্ঠান করেছিল। এমনকী, আত্মরক্ষায় অক্ষম নারী ও শিশুদেরও ক্ষমা করেনি।
আলেকজান্ডার তাঁর নৌসেনাপতিকে বললেন, সিন্ধুনদের মুখ থেকে বেরিয়ে নৌবহর নিয়ে পারস্য উপসাগর দিয়ে দেশের দিকে অগ্রসর হতে। এবং তিনি নিজে যাত্রা করলেন বেলুচিস্থানের ভিতর দিয়ে। ভীষণ সে যাত্রা! মরুপ্রদেশের মধ্যে গ্রীষ্মাধিক্যে, অনাহারে ও জলাভাবে দলে দলে লোক প্রত্যহ মারা পড়তে লাগল। তিন মাস কালব্যাপী নরক যন্ত্রণা ভোগ করে আলেকজান্ডার যখন পারস্যের সুসা শহরে গিয়ে পৌঁছোলেন, তখন তাঁর ফৌজের অর্ধেক সৈন্য মৃত (খ্রিস্টপূর্ব ২২৪)! ঘটনা অনেকটা নেপোলিয়ানের মস্কো থেকে প্রত্যাবর্তনের মতো।
আলেকজান্ডারের জীবনের আর এক বৎসর মাত্র বাকি আছে।