দশম। মরীচিকার অবসান
নিয়তি বড় নিষ্ঠুর, বহুবার নির্মূল করেছে সে মানুষের বহু উচ্চাকাঙ্ক্ষা।
শশাঙ্ক ভেবেছিলেন, মালবরাজ দেবগুপ্তের সঙ্গে সম্মিলিত হয়ে পশ্চিম উত্তরাপথকে করতলগত করবেন। কিন্তু দেবগুপ্ত পড়লেন মৃত্যুমুখে। রাজা ও নেতার পতনের সঙ্গে সঙ্গে মালব-সৈন্যরা হয়ে গেল ছত্রভঙ্গ এবং শশাঙ্কও হলেন তাদের মূল্যবান সাহায্য থেকে বঞ্চিত।
তারপর অভাবিত উপায়ে রাজ্যবর্ধনকে পথ থেকে সরিয়ে শশাঙ্ক আবার কিঞ্চিৎ আশান্বিত হয়ে উঠেছিলেন বটে। কিন্তু দৈবচক্রে আবার নিবু-নিবু হল তাঁর আশার বাতি।
অকস্মাৎ সৈন্যদলের মধ্যে দেখা দিলে এমন মহামারী যে, শশাঙ্কের অগ্রগতি একেবারে রুদ্ধ হয়ে গেল। রাজ্যবর্ধনের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই তিনি যদি কান্যকুব্জ ও থানেশ্বর আক্রমণ করতে পারতেন, তাহলে তাঁর সাফল্য ছিল সুনিশ্চিত। কারণ অপ্রস্তুত শত্রু দমন করা কঠিন নয় কিছুমাত্র।
শশাঙ্কের সে সৌভাগ্য হল না। একই স্থানে অচল হয়ে বসে বসে অসহায়ভাবে তিনি দিনের পর দিন চোখের সামনে দেখতে লাগলেন, বিনা যুদ্ধে কেবলমাত্র মহামারির কবলগত হয়ে ক্রমেই ক্ষীণ হয়ে পড়ছে তাঁর বিপুল বাহিনী। অবশেষে কয়েক মাস পরে মহামারি শান্ত হল বটে, কিন্তু সৈন্যবলের দিক দিয়ে শশাঙ্ক হয়ে পড়েছেন তখন রীতিমতো দুর্বল।
তার উপরে গুপ্তচরের মুখে শত্রুপক্ষের খবর শুনে শশাঙ্কের দুশ্চিন্তা ক্রমেই বেড়ে উঠতে লাগল। পরামর্শের জন্য তিনি সেনাপতি ও মন্ত্রীগণকে আহ্বান করলেন।
শশাঙ্ক বললেন, ‘থানেশ্বরের রাজপুত্র হর্ষবর্ধন আমাকে আক্রমণ করবার জন্যে অসংখ্য সৈন্যসংগ্রহ করছেন। এখনও তাঁর সৈন্যসজ্জা সম্পূর্ণ হয়নি, এখনও যদি আমরা থানেশ্বর আক্রমণ করতে পারি, তাহলে হয়তো বিজয়লাভ করব আমরাই। কিন্তু বর্তমান অবস্থায় আমাদের পক্ষে সেটা সম্ভবপর হবে কি?’
সেনাপতি বললেন, ‘অসম্ভব মহারাজ, অসম্ভব। মড়ক আমাদের অর্ধেক সৈন্যকে হত্যা করেছে। যারা বেঁচে আছে তাদের ও অধিকাংশ দেহ আর মন এত দুর্বল যে মৃতপ্রায় বললেও চলে। এখন আমরা আক্রমণ করব কী, কোনওরকমে আত্মরক্ষা করতে পারব কি না সন্দেহ।
শশাঙ্ক বললেন, ‘জানি সেনাপতি, আমিও সে কথা জানি। কিন্তু আরও দুঃসংবাদ আছে। আপনারা সকলেই জানেন, কিছুকাল আগে কামরূপরাজকে যুদ্ধে আমরা পরাজিত করেছিলুম। আজ আমার বিপদ দেখে কামরূপ আবার সাহস সঞ্চয় করেছে। শুনলুম, আমার বিরুদ্ধে হর্ষবর্ধনের সঙ্গে যোগ দেওয়ার জন্যে কামরূপের রাজপুত্র ভাস্করবর্মা প্রবল এক সৈন্যদলের সঙ্গে অগ্রসর হয়েছে। এখন আমার কী করা উচিত?’
মন্ত্রী বললেন, ‘মহারাজ, এই উভয়-সঙ্কট থেকে মুক্তিলাভের একমাত্র উপায় হচ্ছে আবার বঙ্গদেশে ফিরে যাওয়া।’
শশাঙ্ক মাথা নেড়ে বললেন, ‘বিনা যুদ্ধে পলায়ন? এ অঞ্চলের লোকেরা একে তো বাঙালিকে মানুষ বলে গণ্য করতে চায় না, তার উপরে বিনা যুদ্ধে শত্রুভয়ে পলায়ন করলে আর্যাবর্তে আমাদের আর মুখ দেখাবার উপায় থাকবে না। হারি আর জিতি, যুদ্ধ আমাদের করতেই হবে।’
নিরুত্তর হয়ে রইলেন মন্ত্রী ও সেনাপতি।
শশাঙ্ক অধীরভাবে এদিকে-ওদিকে পদচালনা করতে করতে বললেন, ‘এক জায়গা থেকে আমি সাহায্য পেতে পারি। দাক্ষিণাত্যের মহাপ্রতাপশালী চালুক্যরাজ দ্বিতীয় পুলকেশী আমার পরম বন্ধু। এই বিপদের সময়ে সাহায্য প্রার্থনা করলে তিনি নিশ্চয়ই আমাকে নিরাশ করবেন না। আপনারা কী বলেন?’
সেনাপতি বললেন, ‘মহারাজ, এ উত্তম প্রস্তাব। কিন্তু আমার সন্দেহ হচ্ছে, চরম মুহূর্ত উত্তীর্ণ হয়ে যাওয়ার আগে চালুক্যরাজ আমাদের সাহায্য করতে পারবেন না।’
শশাঙ্ক বললেন, ‘তবু চেষ্টা করে দেখব। ইতিমধ্যে হর্ষবর্ধন যদি আক্রমণ করেন, আমরা আত্মরক্ষার জন্যে যতটকু দরকার কেবল ততটুকু বাধাই দেব, সাধ্যমতো এড়িয়ে চলব সম্মুখযুদ্ধ। আমরা আক্রমণ করব চালুক্যরাজের সাহায্য আসবার পরেই।’
বিপক্ষের জন্যে বেশি দিন অপেক্ষা করতে হল না—যথাসময়ে উত্তর-পশ্চিমের বিশাল প্রান্তরের উপরে দেখা দিলে হর্ষবর্ধনের বিপুল বাহিনী।
শশাঙ্ক বুঝলেন, অবিলম্বে চালুক্যরাজের সাহায্য না পেলে এই বৃহৎ বাহিনীকে ঠেকিয়ে রাখবার সাধ্য তাঁর হবে না।
গোড়ার দিকে হল কয়েকটা খণ্ডযুদ্ধ। বোঝা গেল, নিপুণ সেনানায়কের মতো হর্ষবর্ধন পরীক্ষা করে দেখছেন, মগধ-বঙ্গের ব্যূহের দুর্বল অংশ কোথায়!
উভয় পক্ষই যখন বৃহত্তর শক্তিপরীক্ষার জন্যে প্রস্তুত হচ্ছে, এমন সময়ে শশাঙ্ক স্বদেশ থেকে পেলেন আর এক বিষম দুঃসংবাদ। বৌদ্ধধর্মানুরাগী হর্ষবর্ধন, শৈব শশাঙ্ককে আক্রমণ করেছেন শুনে বুদ্ধগয়া, পাটলিপুত্র ও কুশীনগরের বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা অত্যন্ত উৎসাহিত হয়ে উঠেছেন এবং তাঁদের প্ররোচনায় মগধ-বঙ্গের দিকে দিকে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে বিদ্রোহীরা। শশাঙ্কের নিজের সিংহাসন পর্যন্ত বিপদগ্রস্ত।
বিকৃত কণ্ঠে শশাঙ্ক বললেন, ‘দৈব প্রতিকূল! এর পরও আর সাম্রাজ্যের স্বপ্ন দেখা চলে না। সেনাপতি যত দিন পারেন শত্রুদের বাধা দিন, কিছু সৈন্য নিয়ে এখনই আমাকে ফিরে যেতে হবে বিদ্রোহ দমন করতে। গৃহশত্রুর চেয়ে বড় শত্রু আর নেই। বৌদ্ধরা মুখে করে অহিংসার জয়গান, অথচ আমার প্রজা হয়ে তারাই করতে চায় আমাকে পিছন থেকে দংশন! কিন্তু এই বকধার্মিকরা এখনও আমাকে ভালো করে চিনতে পারেনি—আমি হচ্ছি ধ্বংসের দেবতা শ্মশানপতি শিবের শিষ্য! বৌদ্ধদের এমন শাস্তি দেব, যা তারা আর কোনও দিনই ভুলতে পারবে না!’