উপন্যাস
বড় গল্প
সংকলন
রচনা

দশম । ভারতবর্ষ

দশম । ভারতবর্ষ

তৈমুর আজ বনস্পতির মতন; তাঁর মাথা ছাড়িয়ে উঠেছে আর সকলের মাথার উপরে।

আশপাশের রাজা-রাজড়ারা ভয় পেয়ে একসঙ্গে জোট বাঁধলেন। তাঁদের মধ্যে প্রবীণ হচ্ছেন বোগদাদ এবং মিশরের সুলতান।

বোগদাদ প্রাচীন শহর, তার প্রতিষ্ঠা ৭৬৩ খ্রিস্টাব্দে। আরব্য উপন্যাসে অমর হারুন-অল-রশিদের রাজধানী রূপে বোগদাদ সুখ-সৌভাগ্যের চরম শিখরে আরোহণ করেছিল। তৈমুরের সময়ে বোগদাদের সুলতান ছিলেন আমেদ।

সুলতান আমেদ জানতেন, বোগদাদের ঐশ্বর্য তৈমুরকে লুব্ধ করে তুলবেই। তাই তিনি আগে থাকতেই তৈমুরকে খুশি রাখবার জন্যে দামি দামি ভেট পাঠিয়ে দিলেন।

কিন্তু তৈমুর কি এত সহজে খুশি হওয়ার ছেলে? হাত বাড়ালেই যেখানে সাত রাজার ধন মানিক পাওয়া যায়, সেখানে দু-এক খানা রঙিন কাচের টুকরো পেয়ে তুষ্ট হতে পারে কে? তৈমুর বোগদাদ দখল করবার জন্যে যাত্রা করলেন।

যুদ্ধ অবশ্য হল। কিন্তু সুলতান আমেদ ছিলেন শৌখিন ব্যক্তি। ফুলের বাগানে আরামে বসে ঠান্ডা শরবত পান করতেন আর কবিতা লিখতেন। জন্ম যোদ্ধা তৈমুরের সামনে দাঁড়িয়ে তরবারি চালনা করবার ক্ষমতা তাঁর ছিল না। সুতরাং যুদ্ধের নামে হল প্রহসনের অভিনয়। সুলতান দারুণ আতঙ্কে অন্তঃপুরের ছেলেমেয়েদের পিছনে ফেলেই সিরিয়ার মরুভূমি পার হয়ে দামাস্কাস শহরে গিয়ে হাজির হলেন। দামাস্কাস তখন মিশরের সুলতানের অধীন।

তৈমুর সমরখন্দে ফিরে এলেন। কিন্তু এত বড় হয়েও তিনি তৃপ্ত হতে পারলেন না—তাঁর মন তখন হারিয়ে গিয়েছে উচ্চাকাঙ্ক্ষার অসীমতার মধ্যে।

তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করল ভারতবর্ষ।

প্রধান প্রধান সর্দারগণের ইচ্ছা নয় যে ভারতবর্ষে যান। এমনকী তৈমুরের পৌত্র মহম্মদ সুলতানও বললেন, ‘ভারতের পথে অনেক বাধা। প্রথমত, বড় বড় নদী; দ্বিতীয়ত, দুরারোহ পর্বত ও দুর্ভেদ্য অরণ্য; তৃতীয়ত, বর্মধারী সৈন্য; এবং চতুর্থত, নরহত্যাকারী হস্তীদল।’

একজন ভারত ফেরত ওমরাও বললেন, ‘ওখানকার জলহাওয়া ভারী খারাপ, আমাদের সৈন্যরা দুর্বল ও রুগ্ন হয়ে পড়বে।’

কিন্তু আর একদল বলল, ‘ভারত হচ্ছে রত্নাকর। ভারতের ঐশ্বর্য পেলে আমরা বিশ্বজয় করতে পারব।’

আর একদল বললেন, ‘ভ্রমণকারী ইবন বতুতার মতে পৃথিবীর মধ্যে বড়ো রাজা আছেন ছয়জন : কনস্তান্তিনোপলের সম্রাট, চিনের সম্রাট, তাতারের অধিপতি, ভারতের বাদশাহ, বোগদাদের নরপতি ও মিশরের সুলতান। আমির তৈমুর যদি সর্বশ্রেষ্ঠ হতে চান তবে তাঁকে এঁদের সকলকে বশীভূত করতে হবে।’

তৈমুরেরও মনের বাসনা তাই। অনন্ত আকাশে থাকে একমাত্র সূর্যই। তিনিও হতে চান দুনিয়ার সর্বেসর্বা। এর জন্যে পৃথিবী যদি রক্তে ডুবে যায়,—ডুবে যাক। সে রক্তসাগরে সাঁতার দেওয়ার শক্তি তাঁর আছে।

তৈমুর বললেন, ‘আমি ভারতবর্ষে যাত্রা করব। ভারতের ধনরত্ন এনে আমি সমরখন্দের পায়ে ঢেলে দেব। আমি তাতার যোদ্ধা, আমাকে বাধা দেয় কে? তাতারির তরবারি হচ্ছে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ তরবারি। তোমরা কি সে কথা বিশ্বাস করো না?’

উৎসাহিত হয়ে সর্দাররা একবাক্যে বললেন, ‘হ্যাঁ, প্রভু, আমরা বিশ্বাস করি।’

‘তবে প্রস্তুত হও।’

এক লক্ষ তাতার যোদ্ধা বিপুল আগ্রহে রণসজ্জায় সজ্জিত হতে লাগল।

যে ভারতবর্ষ আক্রমণ করার জন্যে এত পরামর্শ, এত আয়োজন, তার অবস্থা কল্পনাতীত রূপে শোচনীয়।

আর্য ভারতবর্ষের অখণ্ড হিন্দু সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠাতা চন্দ্রগুপ্ত, সমুদ্রগুপ্ত ও হর্ষবর্ধনের শৌর্যকাহিনি তখন পরিণত হয়েছে অতীতের সুখস্বপ্নে। মুসলমানরাও এসে যে সাম্রাজ্যের ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তাও তখন জরাজীর্ণ ও দুর্বল হয়ে পড়েছে। মোগলবংশীয় উন্মত্ত সম্রাট মহম্মদের খামখেয়ালিতে সাম্রাজ্যের গৌরবসূর্য হয়েছে অস্তমিত। তিনি জীবিত থাকতেই সাম্রাজ্যের ভগ্নদশা আরম্ভ হয়। তাঁর সুযোগ্য খুড়তুতো ভাই ফিরোজ শা (১৩৫১-৮৮ খ্রিস্টাব্দ) বুদ্ধিমান ও সুশাসক হয়েও এবং প্রাণপণে চেষ্টা করেও সাম্রাজ্যকে অধঃপতনের কাল থেকে রক্ষা করতে পারলেন না। ফিরোজ শার মৃত্যুর পর সাম্রাজ্য গেল রসাতলে।

সমস্ত ভারতবর্ষ জুড়ে বিদ্রোহী মুসলমান ও হিন্দু যোদ্ধারা ছোট-বড়-মাঝারি খণ্ডরাজ্য স্থাপন করলেন। দিল্লির সম্রাট বলতে আর ভারতের সম্রাট বোঝায় না—দিল্লি তখন ভারতের একপ্রান্তে অবস্থিত একটি ক্ষুদ্র রাজ্য মাত্র। ভারতের একাধিক রাজা তখন দিল্লির অধিপতির চেয়ে শক্তিশালী। ধরতে গেলে দিল্লীশ্বর নাসিরুদ্দিন মামুদের রাজ্য বা শক্তি তখন সীমাবদ্ধ ছিল দিল্লি নগরের চার দেওয়ালের মধ্যেই। মোগল সাম্রাজ্যেরও শেষ দিকে দিল্লীশ্বরের অবস্থা হয়েছিল এই রকম।

তখনও ভারতবর্ষে কয়েকটি ছোট-বড় রাজ্য ছিল। কিন্তু সেগুলি দিল্লি থেকে এত দূরে অবস্থিত ছিল যে, পশ্চিম ভারতবর্ষের রাজনীতির সঙ্গে তাদের কোনওরকম সম্পর্ক ছিল না বললেই হয়। অথচ ভারতীয় রাজনীতির প্রধান রঙ্গ-মঞ্চই ছিল পশ্চিম ভারতবর্ষে—কারণ সেকালে ওইখানেই ভারতের ভাগ্য পরিবর্তন হয়েছে বারংবার, এবং একমাত্র এই কারণেই দিল্লীশ্বর তখনও ছিলেন সমস্ত ভারতবর্ষের মধ্যে সর্বপ্রধান ব্যক্তি।

দিল্লীশ্বরের আমির-ওমরাওরা যখন আপন আপন স্বার্থসিদ্ধির জন্য পরস্পরের সঙ্গে ঘরোয়া বিবাদে নিযুক্ত, আচম্বিতে তখন সংবাদ এল, দিগবিজয়ী তৈমুরের আবির্ভাব হয়েছে ভারতবর্ষে।

তৈমুরের পৌত্র পির মহম্মদ সিন্ধুনদ পার হয়েছেন। দিল্লীশ্বরের সৈন্যরা পরাজিত হয়ে মুলতান নগরের মধ্যে আশ্রয় গ্রহণ করেও আত্মরক্ষা করতে পারেনি। পির মহম্মদ মুলতান অধিকার করেছেন (১৩৯৮ খ্রিস্টাব্দে)।

এর পরে আরম্ভ হল, রক্তাক্ত নাটকের অভিনয়।