দর্শনচর্চা
মাদ্রাজে দর্শন শাস্ত্রের ছাত্রগণের এক সভায় শ্রীযুক্ত রাজাগোপলাচারী বলেন, ‘প্রাচীনকালে চরম ও পরম সত্যের অন্বেষণার জন্য যাঁহারা দর্শনশাস্ত্রের অধ্যয়ন প্রবর্তন করেন, তাঁহারা ইহাকে কেবল বাস্তব ক্ষেত্রে সম্ভবপর বলিয়াই মনে করিতেন না, তাঁহারা ইহাকে অতিশয় প্রয়োজনীয় বলিয়াও মনে করিতেন। ক্রমে ক্রমে পরবর্তীকালে দার্শনিকগণ যে সমস্যা লিখিলেন, তাহা অর্থহীন হইয়া পড়িল এবং শেষ পর্যন্ত সে সমস্ত কথা একত্র গ্রথিত কতকগুলি কথার মালা ব্যতীত আর কিছুই হইল না।’
ঠিক এই উক্তিটিই আজকাল নানা গুণী জ্ঞানীর মুখে শুনতে পাওয়া যায় বলে এ সম্বন্ধে কিঞ্চিৎ আলোচনা প্রয়োজন।
এককালে দর্শনচর্চার প্র্যাকটিকাল মূল্য ছিল, এখন আর নেই; এখন দার্শনিকদের কেতাবে শুধু শব্দ আর শব্দ, এই হল রাজাজির মূল বক্তব্য।
এককালে ‘ক’ ছিল এখন ‘খ’ হয়ে গিয়েছে, সে কথা কেউ বললেই দার্শনিকরা তার জবাবে বলেন, কারণ বিনা কার্য হয় না, অতএব দেখতে হবে দর্শনের বাস্তব মূল্য হঠাৎ উবে গেল কেন।
এ কথা যদি প্রমাণ করা যায় যে, দার্শনিকেরা আস্তে আস্তে চরম ও পরম সত্যের সন্ধান ছেড়ে দিয়ে একদিন অসত্যের সন্ধানে লেগে গেলেন তা হলে অবশ্য এটা অসম্ভব নয় যে, সেই কারণেই তাদের পুস্তকরাজি আজ অবোধ্য হয়ে উঠেছে; কিন্তু এ যাবৎ, কি এদেশে কি বিদেশে, কেউ তো দার্শনিকদের এরকম সন্দেহের চোখে কখনও দেখেনি। বরঞ্চ বেশ জোর দিয়ে বলতে হবে, সত্য দার্শনিক চরম সত্য ছাড়া অন্য কোনও জিনিসের সন্ধান কখনও করেনি– ধাপ্পাবাজি জাল-জোচ্চুরি করার ক্ষমতা যার আছে, সে দর্শনশাস্ত্র অধ্যয়নে মন দেবে কেন, এসব তো করে অন্য লোকেরা। এই দার্শনিকই তাই। দুঃখ করে বলেছেন,
প্রতারণাসমর্থজনে বিদ্যমা কিম
প্রয়োজনম!
অর্থাৎ যে প্রতারণা করতে জানে তার বিদ্যার কী প্রয়োজন। তার পরই তিনি আবার বলেছেন ঠিক ওই একই বাক্য,
প্রতারণাসমর্থজনে বিদ্যয়া কিম্
প্রয়োজনম!
কিন্তু এবারে প্রতারণাসমর্থ শব্দের সন্ধি ভাঙতে হবে প্রতারণা + অসমর্থ দিয়ে অর্থাৎ তুমি যদি প্রতারণা না করতে জান তবে বিদ্যে নিয়ে তোমার কী কাজ হবে?
তাই বিদ্যা বিদ্যারই জন্য, দর্শন দর্শনেরই জন্য। অর্থাৎ সত্যানুসন্ধান সত্যানুসন্ধানেরই জন্য। সত্য নিরূপিত হলে সেই যদি তোমার-আমার কাজে না লাগে তবে সত্যের সেটা দোষ নয়। শিবলিঙ্গ দিয়ে যদি মশারির পেরেক ঠোকা না যায় তবে সেটা শিবলিঙ্গের দোষ নয়।
মানুষ কোনও যুগেই সম্পূর্ণ সত্য সন্ধান পায়নি– পেয়ে থাকলে তার আর অবনতি উন্নতি কিছুই হত না। সম্পূর্ণ সত্য ভগবানের হাতে, মানুষের কাজ হচ্ছে প্রাণপণ চেষ্টা করা সেই সত্যের যতদূর সম্ভব কাছে পৌঁছানোর। তাই করতে গিয়ে তার প্রচেষ্টার ফল যদি অবাস্তব (ইমপ্র্যাকটিকাল) হয় তবু তাকে সত্যেরই সন্ধান করতে হবে।
এ স্থলে আর একটি কথা ওঠে। সত্য নিরূপিত হলে তাকে কাজে লাগাবার ভার কার হাতে? এখানে বিজ্ঞান থেকে একটি উদাহরণ নেওয়া যাক। এটম বম বানাবার সূত্রটি বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার করলেন তার পর এটম বম্ বানানো হবে কি না এবং হলে পর সেটা হিরোশিমার মাথায় ফাটানো হবে কি না সেটা স্থির করেন রাজনৈতিকরা, সমাজপতিরা, জাঁদরেলরা। তাঁরা যদি না চান, তবে বৈজ্ঞানিকদের সাধ্য নেই যে, তারা এটম বম্ হাতে নিয়ে ভুবনময় দাবড়ে বেড়াবেন। এবং শেষ পর্যন্ত এটম বানানো হোক আর নাই হোক, ভালো কাজে লাগুক আর মন্দ কাজেই লাগুক, এটম বম্ তৈরি করার পিছনে যে বৈজ্ঞানিক সত্য সূত্র আবিষ্কৃত হল সেটা সত্যই থেকে যাবে।
কিন্তু এগুলো হল আংশিক সত্য–বৈজ্ঞানিকের সন্ধানের আদর্শ। দার্শনিক সন্ধান করেন চরম সত্যের। সে সত্য কখনও কারও অমঙ্গল করতে পারে না। কারণ পৃথিবীর সর্বত্রই স্বীকৃত হয়েছে, যাহা সত্য তাহাই শিব এবং তাহাই সুন্দর। এই তিনের চরম রূপ কখনই একে অন্যকে আঘাত করতে পারে না।
বৈজ্ঞানিক তথ্যের বেলা যে-রকম, দার্শনিক সত্যের বেলাও ঠিক তেমনি। রাজনৈতিক, সমাজবি এবং আর পাঁচজন স্থির করবেন দার্শনিক-সত্যের কতখানি মানব-সমাজে ব্যবহার করা যেতে পারে। রাজাজি দার্শনিকদের প্রতি কটাক্ষ করে বলেছেন, “আধুনিক যুগের দার্শনিকগণের আরম্ভ সংশয়ে, পরিসমাপ্তি সংশয়ে এবং তারা চিরসংশয়বাদী। এই সংশয় ধর্মবিশ্বাসের স্থান অধিকার করিয়াছে।’ যদি বা এ মন্তব্য স্বীকার করে নিই, তবু আবার বলতে হবে, সংশয়বাদ ধর্মের আসন কেড়ে নেবে কি না সে কথা স্থির করবেন সমাজপতিরা। দার্শনিকেরা সত্য নিরূপণ করাটাই তাঁদের চরম স্বধর্ম বলে বিশ্বাস করেন, সে নিরূপণ সমাজে কী স্থান নেবে, সে সম্বন্ধে তারা উদাসীন। এককালে চিত্রকলা, সঙ্গীত, নৃত্য ইত্যাদি সর্বকলা-শিল্প-ধর্মের সেবা করত। ছবি আঁকা হত দেবদেবীর, গান গাওয়া হত দেবদেবীর, নৃত্য করা হত দেবতার সামনে। আজ নন্দলাল দেবদেবীর ছবি আঁকেন, আবার খোয়াইডাঙারও ছবি আঁকেন (এবং নন্দলালও টি বৈজ্ঞানিক এবং দার্শনিকের ন্যায় সম্পূর্ণ উদাসীন যে, লোকে তার দেবদেবীর ছবিকে পূজা করছে কি না, তিনি সুন্দরের রূপ দিয়েই আনন্দিত), রবীন্দ্রনাথ রচেছেন শত শত বর্ষার গান, উদয়শঙ্করের আপন রচা সার্থক নৃত্যের বেশিরভাগ সামাজিক সমস্যাকে কেন্দ্র করে। তাই বলে আজ কি কেউ এ অপবাদ দেয় যে, এঁদের কলাসৃষ্টি প্র্যাকটিকাল নয়, রবীন্দ্রনাথের গান ‘একত্র গ্রথিত কতকগুলো কথার মালা ব্যতীত আর কিছুই নয়’, উদয়শঙ্করের নৃত্যে আছে শুধু কতকগুলো অর্থহীন অঙ্গসঞ্চালন এবং পদবিন্যাস!
মোদ্দা কথা এই, যারা ‘ধর্মপ্রাণ’ তাঁরা এঁদের সৃষ্টিকর্ম, বৈজ্ঞানিকের তথ্য, দার্শনিকের সত্য, ধর্মের সেবায় নিয়োজিত করতে পারছেন না বলে দোষ দিচ্ছেন বৈজ্ঞানিককে, কলাকারকে, দার্শনিককে।
কেন পারছেন না, এ প্রশ্ন যদি কেউ শুধায় তবে অপ্রিয় সত্য বলতে হবে, এবং আজ যখন অপ্রিয় সত্য দিয়েই তত্ত্বালোচনা আরম্ভ করেছি তবে সেই আলাপই এখন তালে চলে আসুক। আসল কথা হচ্ছে এই, আজ যারা ‘হা ধর্ম হা ধর্ম’ করেন, তাঁদের অধিকাংশই (রাজাজির কথা বলছিনে, তিনি সত্যই ধর্মপ্রাণ কি না সে বিষয়ে আমার ব্যক্তিগত কোনও অভিজ্ঞতা নেই) ধর্মে একনিষ্ঠ নন। স্বধর্মে, সত্য ধর্মে, সনাতন ধর্মে যদি তাঁদের শ্রদ্ধা ঐকান্তিক এবং অবিচল হত তবে তারা আজ দার্শনিককে, কাল বৈজ্ঞানিককে হিরণ্যকশিপু, হিরণক্ষ্য নামে অভিহিত করতেন না।
কিন্তু আমি কে, আমার ছোট মুখে বড় কথা কেন?
অতএব, সে আপ্তবাক্য সন্ধান করে, এক ঋষির বচন উদ্ধৃত করে তারই পশ্চাতে আশ্রয় নিই।
সে ঋষি প্রাতঃস্মরণীয় স্বর্গীয় দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর, কবিগুরুর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা। তার মতো ধর্মনিষ্ঠ ঋষি উনবিংশ শতাব্দীতে জন্মেছেন অতি কম। আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি এরকম ভগবৎপ্রেমিক আমি আমার জীবনে অল্পই দেখেছি।
তিনি লিখেছেন,
‘একটা ক্রন্দন এবং বিলাপের অভিনয় সম্প্রতি আমাদের দেশের একদল নিষ্কর্মা লোকের একটা বাতিক হইয়া দাঁড়াইয়াছে। কাঁদুনি গায়কদিগের ধুয়া এই যে, আমাদের দেশের এমন যে একটি সেকেলে পৈতৃক সম্পত্তি–বৈরাগ্য, একেলে সভ্যতার হস্তে পড়িয়া তাহার অন্তিম দশা ঘনাইয়া আসিয়াছে- তিনি আর বেশি দিন টেকেন না! এইরূপ ক্রন্দন। শুনিলে আমাদের হাসি পায়, কান্নাও পায়। হাসি পায় তার কারণ এই যে, বৈরাগ্য যদি তোমার এতই প্রিয়বস্তু, তবে তার পথ অবলম্বন কর– ক্রন্দন কেন? একেলে সভ্যতা তো আর তোমার হাত-পা বাঁধিয়া রাখে নাই; কোতোয়ালের প্রতি মহারানির (ভিক্টোরিয়া) এমন কোনও শক্ত রাজাজ্ঞা নাই যে, ‘কাহাকেও বৈরাগ্যের পথে চলিতে দেখিয়াছ কি আর অমনি তাহার শির লইবে।’ বৈরাগ্য তো আর বাজারের সামগ্রী নয় যে, সেকালের বাজারে তা সুলভ ছিল, একালের বাজারে তাহা দুর্মূল্য হইয়াছে। বাজারের সামগ্রী স্বতন্ত্র, আর অন্তঃকরণের সামগ্রী স্বতন্ত্র; বাজারের সামগ্রী ক্রয়-বিক্রয়ের বস্তু অন্তঃকরণের সামগ্রী সাধনের বস্তু। তুমি বলিবে যে কাল পড়িয়াছে শক্ত; চব্বিশ ঘণ্টা সংসারকার্যে ষোল আনা লিপ্ত থাকিলে যদি এক আনা কাজ হাসিল হয় তবে তাহাই গৃহী ব্যক্তির পরম সৌভাগ্য; দেখিতেছ না– একটা কেরানিগিরি খালি হইয়াছে কি আর অমনি দলকে দল বি এ, এম এ কাতারে কাতারে পিপড়ার পালের ন্যায় আপিস অঞ্চলে গতায়াত করিতে থাকে। ইহার উত্তরে আমি এই বলি যে, প্রকৃত বৈরাগ্য সংসারে কোনও কর্তব্য সাধনেরই প্রতিবন্ধকতাচারণ করে না– তাহা দূরে থাকুক, সেরূপ বৈরাগ্য কর্তব্য সাধনের পথ আরও পরিষ্কার করিয়া দেয়। বৈরাগ্য অভ্যাস আর কিছু না–মনের সুর বাধা; সেতারের সুর বাধা থাকিলে যেমন তাহাতে যে রাগিণী ইচ্ছা, সেই রাগিণীই বাজানো যাইতে পারে, তেমনি অন্তঃকরণে বৈরাগ্যের সুর বাঁধা থাকিলে যখন যাহা কর্তব্য তাহাই সুচারুরূপে নির্বাহ করা যাইতে পারে।’ (দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর, নানা চিন্তা; সাধনা– প্রাচ্য ও প্রতীচ্য প্রবন্ধ, পৃ ১-২, বিশ্বভারতী)।
এই উদ্ধৃতিতে যেখানে যেখানে ‘বৈরাগ্য’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে, সেখানে ‘ধর্ম’ শব্দ ব্যবহার করলেই আমার বক্তব্য সুস্পষ্ট হবে।