দর্পণে প্রতিবিম্বিত কাঁটা – ৮

আট

বাসুসাহেব বলেন, কাল দুপুরের কেষ্টপুর-লোকালে রায়বাহাদুর আমাকে যেতে বলেছেন। কৌশিককে নিয়ে যাই, কি বল?

রানু বলেন, না। আমি তো বলেই দিয়েছিলাম, সুজাতার ছেলে হবার আগে ওদের আর কোনও দায়িত্ব তুমি দেবে না।

বাসু বলেন, প্রথম কথা, সুজাতার আদৌ ছেলে হবে না। হবে মেয়ে। কিন্তু আসল কথা সেটা নয়। আসল কথা হচ্ছে, আমি তো সুজাতাকে নিয়ে যেতে চাইছি না। কৌশিককে নিয়ে গেলে ক্ষতি কী?

—কী আশ্চর্য! তুমি বোঝ না কেন? কোনও একটা এমার্জেন্সি হলে আমি একা কী করে সামলাব? তোমাকে তো আমি বলেছিলাম : এই পাগল রায়বাহাদুরের কথায় নেচ না! তুমি শুনলে?

সেকথা সত্যি! রানীদেবীর প্রবল আপত্তি ছিল। কৌশিকের কাহিনী শুনে তাঁর মনে হয়েছিল এই রায়বাহাদুর লোকটা একটা মেগালোম্যানিয়াক হামবাগ!

এইখানে আবার কিছু পূর্বকথন প্রয়োজন হয়ে পড়ছে। না, না, মোহনমঞ্জিলের রায়বাহাদুরের পূর্বকথন নয়, নিউ আলিপুরের বাসুসাহেবের বাড়ির কিছু পূর্বকথা :

পূর্ববর্তী ড্রেস-রিহার্সালের কাঁটা কাহিনী রচনার সময় এক স্কুল-দিদিমণির খপ্পরে পড়েছিলাম, সেকথা আগেই বলেছি। সেই যিনি বলেছিলেন—সুজাতা-কৌশিকের এখনই একটা বাচ্চা হওয়া উচিত। দিদিমণির কাছে ধমক খেয়ে পরের সংখ্যা নবকল্লোলে আমি গল্পের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিলাম।

সেই সময় কাহিনীর ঘূর্ণাবর্তে বাসুসাহেব বেশ উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলেন। ড্রেস রিহার্সালের কাঁটায়। পুলিশ তখনও কাউকে অ্যারেস্ট করেনি। তাই বাসুসাহেবের কোনও মক্কেল নেই। অথচ তার আগেই জোড়াখুন হয়ে গেছে। বাসুসাহেব বন্ধুকৃত্য করতে ‘সু-মটো তদন্ত শুরু করে দিয়েছেন। সম্ভাব্য চার-পাঁচ জন অপরাধীর মধ্যে ইন্দ্রকুমার জানিয়েছিল যে, খুনের সময় সে ছিল ঘটনাস্থল থেকে অনেকটা দূরে: গালুডিতে, মানে ঘাটশিলায়, সুবর্ণরেখা হোটেলে। বাসু সেই অ্যালেবাইটা যাচাই করতে সুজাতা আর কৌশিককে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন ঘাটশিলায়।

পরদিন সকালে প্রাতরাশের টেবিলে রানী বললেন, একদিক থেকে ওদের দুজনকে ঘাটশিলা পাঠানোটা ভালই হয়েছে।

বাসু জানতে চেয়েছিলেন, কোনদিক থেকে?

তোমার পাল্লায় পড়ে ওরা দুটিতে তো গোল্লায় যেতে বসেছে। দিবা-রাত্র কর্তা-গিন্নি শুধু চোর-পুলিশ খেলছে। খুন-জখম, তদন্ত-মদন্ত নিয়ে মেতে আছে। ওরা হয়তো এতদিনে ভুলেই গেছে যে, ওদের সম্পর্কটা শুধু ‘সুকৌশলী’-র পার্টনার হিসেবেই শেষ হয়ে যায় না। ওরা আসলে স্বামী-স্ত্রী। যাক, দু’দিন ঘাটশিলায় ফূর্তিফার্তা করে আসুক।

বাসু হাসতে হাসতে বললেন, তা ঠিক!

—না, শুধু হাসলে হবে না। তুমি একটা জিনিস হিসেব করে দেখেছ? ওদের এতবছর বিয়ে হয়েছে অথচ আজও বাচ্চা-টাচ্চা হয়নি! কেন? বাচ্চা হয় না কেন? আপত্তিটা কার? কিসের আপত্তি?

বাসু আমতা-আমতা করে বলেন, কী আশ্চর্য! আমি তা কেমন করে জানব?

—বটেই তো! তুমি কেমন করে জানবে? বাচ্চাকাচ্চা না হবার অপরাধে ওদের তো পুলিশে ধরছে না। তাই তুমি নির্লিপ্ত! তুমি জান না; কিন্তু আমি জানি।

—কী জান?

—ওদের দুজনের মধ্যে কারও কোনও শারীরিক ত্রুটি নেই। সুজাতা আমার কাছে স্বীকার করেছে। ওদেন সন্তান হচ্ছে না কারণ ওরা সেটা চাইছে না। তাহলে নাকি ওদের সুকৌশলীর কাজের অসুবিধা হবে।

র’কফিতে একটা চুমুক দিয়ে বাসু নাকি সংক্ষেপে বলেছিলেন, আই সি

রানী তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠেন। য়ু সি নাথিং! কিছুই দেখতে পাও না তুমি। কারণ তুমি ছুঁচোর মতো অন্ধ— সাংসারিক বিষয়ে। চোর-পুলিশ খেলার বাইরে যে দুনিয়াটা আছে তার দিকে কোনদিন চোখ তুলে দেখনি তুমি! সুজাতার বয়স কত হল বল তো? এরপর ‘ফার্স্ট কনফাইনমেন্ট যে বিপজ্জনক তা কি তুমি জান না? ওদের এখনই একটা বাচ্চা হওয়া উচিত। এ সংসারে একটা চুন্নুমুন্নু এলে আমার এই বন্ধ্যাজীবন কেমন আনন্দঘন হয়ে উঠবে তা কি তুমি কোনদিন ভেবে দেখেছ?

বাসু রীতিমতো বিব্রত হয়ে বলেছিলেন, কী আশ্চর্য! তা এ বিষয়ে আমি কী করতে পারি?

—তুমিই তো যত নষ্টের গোড়া! ওদের ফুলশয্যার রাত ভোর হল কি হল না তুমি কাঁটা দিয়ে ওদের খোঁচাতে শুরু করলে। তারপর থেকে ক্রমাগত কাঁটার পাহাড় বানিয়ে চলেছ। কাঁটার পর কাঁটা। একটা শেষ হতে না হতেই আর একটা কাঁটা! কোনও বিরাম নেই—শুধু কাঁটা আর কাঁটা! তাহলে সকল কাঁটা ধন্য করে গোলাপটা ফুটবে কখন?

বাসু তাঁর পাকাচুলে আঙুল বুলিয়ে কী একটা জবাব দিতে যাচ্ছিলেনতার আগেই বেজে উঠল টেলিফোনটা

রানু ঝাঁঝিয়ে ওঠেন, ওই শুরু হয়ে গেল! ফাঁকা বাড়িতে স্বামী-স্ত্রী-তে মন খুলে দুটো কথা বলব, তারও সুযোগ নেই। তার মাঝখানে শুরু হয়ে গেল : টেলিফোনের কাঁটা!

দিন-তিনেক পরে ঘাটশিলা থেকে ওরা দুজন ফিরে এল। কৌশিক আর সুজাতা। রাত তখন সাড়ে দশটা। পাড়া সুনসান। ট্যাক্সির ভাড়া মিটিয়ে বেল বাজাতে বিশে এসে দরজা খুলে দিল।

কৌশিক জানতে চায়, কী রে বিশে? মামা-মামী শুয়ে পড়েছেন?

—না গো। শোয়ার ঘরে বসে গল্প-সল্প করছেন। সাহেব আজ আবার সেইটে বার করেছেন।

হাতের মুদ্রায় শিভাস রিগ্যালের বোতলটা দেখায়।

সুজাতা জানতে চায়, তুই খেয়েছিস?

—ধ্যাশ্! আমি কি ওসব খাই?

—আরে না, না, রাতের খাবার কথা বলছি।

ঠিক তখনই করিডোরের ও-প্রান্তে সুইচটা জ্বলে উঠল। হুইল চেয়ারে পাক মেরে রানু এগিয়ে আসেন। বলেন, এই তো! এসে গেছ তোমরা। রাতের খাবার ফ্রিজে রাখা আছে। তোমরা হাত-মুখ ধুয়ে নাও। বিশে ততক্ষণে খাবারটা গরম করে দেবে।

কৌশিক বলে, না, মামীমা, আমি ট্রেনেই খেয়ে এসেছি। ফ্রিজে যা রাখা আছে তা কাল সকালে সদ্ব্যবহার করা যাবে। মামু কি শুয়ে পড়েছেন?

রানু বলেন, না। তাঁর এটা থার্ড পেগ চলছে। একটু আগে উনি আমাকে বলেছিলেন, খুনিটা কে, তা উনি জানেন, কিন্তু পুলিশকে জানাতে পারছেন না।

সুজাতা বলে, কেন?

—কারণ ওঁর ধারণা গিল্টি ভার্ডিক্ট হবার মতো এভিডেন্স এখনও সংগ্রহ করা যায়নি। উনি এখন পুলিশকে নামটা জানালেই সে অ্যারেস্টেড হয়ে যাবে। সে সজাগ হয়ে যাবে।

কৌশিক বলে, লোকটা কে তার নাম আপনাকে বলেছেন? মানে যাকে উনি সন্দেহ করছেন?

—না, না, সন্দেহ নয় কৌশিক। উনি বলছেন, লোকটাকে উনি সন্দেহাতীতভাবে শনাক্ত করেছেন। যা হোক, তোমরা গিয়ে প্রাথমিক রিপোর্টটা দাখিল কর; দেখি সেই মওকায় হাতসাফাই করে বোতলটা সরিয়ে ফেলতে পারি কি না।

তিনজনে এগিয়ে আসেন বাসুসাহেবের ঘরে। স্তিমিত একটা সবুজ আলোয় গৃহকর্তা একটি ইজিচেয়ারে লম্ববান। পাশের টিপয়ে গ্লাস-বোতল-স্ন্যাক্‌স্-আইস কিউব।

ওদের দেখেই বাসুসাহেব বলে ওঠেন, অ্যাই যে মিস্টার অ্যান্ড মিসেস সুকৌশলী! গুড ঈভনিং!! আপনারা দুজন যে নিরাপদে বাড়ি ফিরে আসতে পেরেছেন এতেই আমরা কৃতাৰ্থ!

বোঝা গেল, সাড়ে-তিন পেগেই বাসু-মামুর নেশাটা জমজমাট।

রানু ইতিমধ্যে কায়দা করে হুইল চেয়ারটা টি-পয়ের ওপাশে নিয়ে গেছেন। বোতলটাও দখল করেছেন। বলেন, ওদের কাছ থেকে প্রাথমিক রিপোর্টটা এবার শুনে নাও। বিস্তারিত কাল সকালে শুনো, বরং!

বাসু ব্যস্ত হয়ে ওঠেন, তা বেশ তো। কিন্তু… তুমি … মানে … ওটাকে নিয়ে যাচ্ছ কেন?

রানু ততক্ষণে বোতলটা সুজাতাকে হস্তান্তরিত করে ফেলেছেন। বলেন, তোমার বরাদ্দমতো দু-পেগ কখন শেষ হয়ে গেছে। আজ আর নয়।

প্রসঙ্গটা চাপা দিতে কৌশিক বলে ওঠে, আমাদের মিশন ইজ সাকসেসফুল, বুঝলেন মামু? বাসু চেয়ারে এলিয়ে পড়ে বলেন, রিয়্যালি? কী মিশন নিয়ে তোমরা ঘাটশিলা গেলে মিস্টার অ্যান্ড মিসেস সুকৌশলী?

—বাঃ! আপনার মনে নেই? ঘোষাল হত্যা মামলায় আপনি চার-চারজন সম্ভাব্য আততায়ীর কথা ভাবছিলেন। তার মধ্যে ইন্দ্রকুমারের ‘অ্যালেবাইটা’ যাচাই করে দেখতে আমাদের দুজনকে ঘাটশিলা পাঠিয়েছিলেন আপনি। আমরা তদন্ত করে দেখেছি—ইন্দ্রকুমার ইজ অনারেবলি অ্যাকুইটেড। তার অ্যালেবাইটা পাক্কা। তার মানে, চার-চারটে সম্ভাব্য কাঁটার ভিতর থেকে—

—কী? কী বল্লেন? কিসের ভেতর থেকে?

—সম্ভাব্য কণ্টক। কাঁটা—

ব্যস্! কোথাও কিছু নেই বোমার মতো ফেটে পড়লেন ব্যারিস্টার-সাহেব : তোমরা কি আমাকে একটুও শান্তিতে থাকতে দেবে না, মিস্টার অ্যান্ড মিসেস সুকৌশলী? মধ্যরাত্রে একা; বসে মৌজ করছি সেখানেও হাঁউ-মাউ-খাঁউ রাক্ষসের মতো তাড়া করে এসেছ: কাঁটা-কাঁটা- কাঁটা! কী পেয়েছ তোমরা, অ্যাঁ? শুধু কাঁটা আর কাঁটা? একটা শেষ হতে না হতেই আর একটা কাঁটা! সামনে কাঁটা, পিছনে কাঁটা, হেঁটোয় কাঁটা, মুড়োয় কাঁটা! ব্যাপারটা কী? তাহলে সকল কাঁটা ধন্য করে জোলাপটা কখন ফুটবে? আমাকে সেটা বুঝিয়ে বলতে পার মিস্টার অ্যান্ড মিসেস সুকৌশলী?

রানু কৌশিকের আস্তিন ধরে টানলেন। ওদের ইঙ্গিত করলেন নিঃশব্দে কেটে পড়তে তাই পড়ল ওরা।

বাইরে বেরিয়ে এসে সুজাতা বলে, মামু কি আজ এক্কেবারে আউট? হঠাৎ জোলাপের কথা কী যেন বললেন?

রানু হাসলেন। উনি না-হয় তিন পেগের পর মুখ ফসকে কথাটা বলেছেন, কিন্তু তোমরা দুজন তো মদ্যপান করনি। তোমরা বুঝতে পারলে না, উনি ‘জোলাপের’ কথা বলেননি আদৌ, বলতে চেয়েছিলেন : ‘গোলাপ’-এর কথা।

সুজাতা অবাক। বলে, গোলাপ! মানে?

রানু বলেছিলেন, তুমি বোধহয় এতদিনে ভুলে গেছ? ‘গোলাপ’ একটা ফুলের নাম! রাত হয়ে গেছে। যাও শুয়ে পড়। সময়মতো চিন্তা করে দেখ হঠাৎ গোলাপের কথা ওঁর কেন মনে পড়ল!

.

এ ঘটনা প্রায় মাস ছয়েক আগেকার, ইতিমধ্যে ঘোষাল-হত্যা মামলার কিনারা হয়েছে। ড্রেস রিহার্সালের কাঁটায় তার চিন্তায়িত ইতিকথা লিপিবদ্ধও হয়েছে।

সম্ভবত কৌশিক আর সুজাতা যৌথভাবে বুঝতে পেরেছে সে রাত্রে বাসু-মামু কেন জোলাপের কথা বলেছিলেন নেশার ঝোঁকে। সেই অনুপ্রেরণাতেই হোক অথবা আমি সুজাতাকে যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে রেখেছি—বিশের দিদিকে নিউ আলিপুরে নিয়ে আসব—সেটা বিশ্বাস করেই হোক ওরা সিদ্ধান্ত নিয়েছে—

সুজাতার এটা পঞ্চম মাস। এটাই ক্রিটিকাল টাইম। রানু দেবীর মতে। তাই তিনি অনুমতি দিলেন না বাসুসাহেবের সঙ্গে কৌশিককেও বেলডাঙা হয়ে মোহনপুরে যেতে। রায়বাহাদুরের পাগলামিতে যদি তালে-তাল দিয়ে পাগলামো করতে চান তাহলে বাসুসাহেবকে তা একা- একাই করতে হবে।