দর্পণে প্রতিবিম্বিত কাঁটা – ৭

সাত

পলাশী- -যুদ্ধের দেশপ্রেমী শহিদ মহারাজ মোহনলালের সৎকার কর হল জিয়াগঞ্জের শ্মশানে। বস্তুত গোপনে। মীরজাফর আর মীরনের ভয়ে। শ্মশানে বেচারি সরযূবালা আসতে পারেনি। তাকে আনা হয়নি গৃহাভ্যন্তরেই সে বিধবা সাজল। তার পক্ষকাল পরে মোহনলালের দুই বিশ্বস্ত অনুচর—বলভদ্র আর বিরোচন এসে দেখা করল পুরুষোত্তমদাসের সঙ্গে। তারা পণ্ডিতজীকে পরামর্শ দিল, গোপনে জিয়াগঞ্জ ত্যাগ করে উত্তরভারতের কোনও গোপন স্থানে চলে যেতে নতুন নবাব মীরজাফরের ভয়ে মীরমদনের বিবি-বাচ্চারা রাতারাতি পূর্ণিয়ার দিকে পালিয়ে গেছে। নবাব মোহনলালের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করেছেন। এখন তার গুপ্তচরেরা মোহনলালের পিতা-মাতা-ভাইবোন-বিবি-বাচ্চাদের সন্ধান করে বেড়াচ্ছে। কিছু লোককে কোতল করে নিষ্ঠুর উদাহরণ স্থাপন না করলে বেইমানদের শায়েস্তা করা যাবে না। মীরজাফরের দৃষ্টিভঙ্গিতে মোহনলাল আর মীরমদন হচ্ছে বেইমান। তারা দুজন সিপাহসালারের আদেশ অগ্রাহ্য করে পলাশী-প্রান্তরে ইংরেজের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে! কী স্পর্ধা!

পুরুষোত্তমদাস নিতান্ত অসহায়ের মতো বলেন, কিন্তু আমি কোথায় যাব বাবা? পাঞ্জাবের সঙ্গে কোনও যোগাযোগ নেই; এই জিয়াগঞ্জেই এখন আমার দেশ, জন্মভূমি।

বলভদ্র বললে, না পণ্ডিতজী, আপনাকে পাকাপাকিভাবে জিয়াগঞ্জ ত্যাগ করে যেতে বলছি না; কিন্তু সাময়িকভাবে ভাবিজীকে নিয়ে আপনার স্থানত্যাগ করাটা নিতান্ত প্রয়োজন মীরজাফর তার গদি বাঁচাতে চতুর্দিকেই শত্রু দেখছে। তাছাড়া মীরজাফরের পুত্র মীরন এ বিষয়ে বাপকেও ছাড়িয়ে গেছে। সিরাজের বংশের যেখানে যে কেউ আছে, হত্যা করে চলেছে। আপনার ব্যবস্থা আমি করে দিচ্ছি। কাশীধামে চৌষট্টি যোগিনী ঘাটের কাছাকাছি আমার দাদামশায়ের একটি বিরাট মোকাম আছে। অসুবিধা হবে না। দাদাজী বাবা বিশ্বনাথের একজন পুরোহিত। দিদা স্বর্গে গেছেন। ফলে ভাবিজীকে পেলে বুড়োবয়সে তাঁকে হাত পুড়িয়ে রান্না করে খেতে হবে না। আমি হাতচিঠি দিয়ে দেব—

—কিন্তু কোনও যাত্রীদল কি বিশ্বনাথধামে যাবে, জিয়াগঞ্জ থেকে?

—আমি খোঁজ নিইনি। নেবও না। কারণ জিয়াগঞ্জ থেকে নৌকায় চড়া যুক্তিযুক্ত হবে না আপনি এখানকার নামকরা পণ্ডিতজী—কেউ না কেউ চিনে ফেলতে পারে। তাদের ভিতর কেউ যদি বুঝে ফেলতে পারে যে আপনার সঙ্গিনী মহারাজের বিধবা, তাহলেই সমূহ বিপদ আমি বরং খোঁজ নিয়ে দেখি, মুর্শিদাবাদ থেকে কোনও যাত্রীদল কাশীধামে যাচ্ছে কি না আপনাদের দুজনকে সেখান থেকে বজরায় চড়তে হবে। এ বাস্তুভিটার জন্য চিন্তা করবেন না আমরা দুজন এই বাড়িতেই এসে উঠব। মাস ছয়েকের মধ্যেই সবকিছু থিতিয়ে যাবে। তখন আপনারা দুজন আবার এখানে ফিরে আসতে পারবেন।

না, ছয়মাসের মধ্যে ওঁরা কাশী থেকে বঙ্গভূমে ফিরে আসতে পারেননি। দেরি হয়েছি আড়াই বছর। পাক্কা আড়াই বছর চুটিয়ে নবাবী করেছিল মীরজাফর আলি খাঁ। নামমহিমায় লোকটা বাংলাভাষায় বিশ্বাসঘাতকতার সমার্থক হয়ে গেছে। বিশ্বাসঘাতক তো ছিল এক ঝাঁব খ্যাঁকশিয়াল—তার ভিতর মীরন নিহত হয় বজ্রাঘাতে; দুর্লভরাম সর্বস্বান্ত হয়ে পথের ভিখার হয়ে যায়—উন্মাদ অবস্থায় তার মৃত্যু ভয়াবহ। দুর্লভরামের প্রতি যে বিশ্বাসঘাতকত করেছিল—বেইমানির বনিয়াদে গেঁথে তুলেছিল ব্রিটিশ বণিক রাজ্য—সেই লর্ড ক্লাইভ অর্থকৃচ্ছ্রতায় আর অপমানে কোণঠাসা হতে হতে শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যা করেছিল লন্ডনে, পলাশী-যুদ্ধের সতেরো বছর পরে। তাদের বিশ্বাসঘাতকতার কথা ইতিহাস ভুলে গেছে; ভোলেনি ওই মীরজাফরের বেইমানিটা। বোধকরি শুধু ধন-দৌলত নয়, গদিটার লোভের জন্যই শুধু মীরজাফরই বেইমান!

বাংলাদেশের প্রজা অর্ধাহারে থেকেও সর্বোচ্চ হারে যে খাজনা দিতে পারে তার দ্বিগুণ কর দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল গদি-লোভী মীরজাফর। সে প্রতিশ্রুতি রাখতে পারল না বেইমানটা। অঙ্কশাস্ত্রমতে তা সম্ভবও ছিল না। তাই গদির মোহে মাতাল মীরজাফরকে গদিচ্যুত করল ইংরেজ বেনিয়া সরকার, ১৯৬০-এ। তারপরে আরও পাঁচবছর বেঁচেছিল মীরজাফর। বজ্রাঘাতে মীরনের মৃত্যু সংবাদ পাওয়ার পর সে কুষ্ঠরোগে আক্রান্ত হয়। পরিবারবর্গ তাকে ত্যাগ করে। পথ প্রান্তে পর্ণকুটীরে ভিখারির মতো প্রাণত্যাগ করে কুবেরীতি ধনের অধিকারী নবাব মীরজাফর আলি খাঁ বাহাদুর! —বেইমান নবাব!

কাশীতে বসে সে সংবাদ পেলেন পুরুষোত্তমদাসজী। নবাবের ছেলে নবাব হবে, সে জমানা আর নেই। এখন কোম্পানির রাজত্ব। নিলামের ডাকে যে সর্বোচ্চ ডাক দেবে তাকেই গদিতে বসিয়ে দেওয়া হবে। এই হল নতুন রেওয়াজ। মীরজাফরের পদচ্যুতিতে গদিতে উঠে বসলেন মীরকাসেম আলি।

মীরকাসেম আলি মীরজাফরের দামাদ। মীরজাফরের কন্যা ফতিমাকে সাদি করে তিনি বিশিষ্ট ওমরাহ হয়ে ওঠেন। পলাশীর যুদ্ধে তিনি ষড়যন্ত্র-দলে ছিলেন এমন প্রমাণ নেই; কিন্তু যুদ্ধান্তে সিরাজ যখন পলাতক, তখন শ্বশুরমশায়ের আদেশে সিরাজকে বন্দী করায় সচেষ্ট হন। পরে রাজস্ব আদায়ের ব্যর্থতায় যখন মীরজাফরের পদচ্যুতি ঘটল, তখন মীরকাসেম একটি নতুন শর্তে বেনিয়াদের প্রলুব্ধ করে গদিলাভ করলেন। ইংরেজ কোম্পানিকে তিনি মেদিনীপুর, বর্ধমান আর চট্টগ্রামের জমিদারি ‘বিনামূল্যে বিক্রয়’ করে দিলেন। অর্থাৎ শর্ত হল, মীরকাসেম বাংলার নবাব হবেন কিন্তু ওই তিনটি পরগণা থেকে খাজনা সরাসরি আদায় করবে বেনিয়া ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারীরা। নবাবকে এজন্য কোনও খাজনা দেওয়া হবে না। বলা যায় ইংরেজের সরাসরি রাজ্যলাভের সেটাই সূত্রপাত।

মীরকাসেম কিন্তু দাস-মনোবৃত্তিওয়ালা শাসক ছিলেন না। ঐশ্বর্য ও বিলাসে আকণ্ঠ ডুবে থাকাকেই তিনি পরমার্থ মনে করতেন না, সিরাজ বা মীরজাফরের মতো। তীক্ষ্ণবুদ্ধি মীরকাসেম বোধহয় দেশকে ভালবাসতেন, তাই বুঝতে পেরেছিলেন, ওই লালমুখো বহিরাগত পিশাচদের তাড়াতে না পারলে কী হিন্দু, কী মুসলমান— ভারতবাসীর শান্তি নেই। স্বীকার্য—তিনি সিরাজকে ধরিয়ে দিতে সাহায্য করেছিলেন। কিন্তু প্রথম কথা, মীরকাসেমের দৃষ্টিতে প্রায় কিশোর সিরাজ অত্যন্ত উচ্ছৃঙ্খল। তার নাবীতে রানী ভবানীর বিধবা কন্যা তারাসুন্দরী পর্যন্ত নিরাপদে পূজা-অর্চনা নিয়ে থাকতে পারতেন না। তাই সিরাজের চরিত্রের যেটা গুণ : দেশপ্রেম, দুঃসাহসিকতা—তাকে ছাপিয়ে মীরকাসেমের দৃষ্টিতে ধরা পড়েছিল—সিরাজের মাদকাসক্তি, তার ইন্দ্রিয়াসক্ত বেলেল্লেপনা। দ্বিতীয় কথা : সিরাজকে তিনি বন্দী করেছিলেন শ্বশুরের নির্দেশে, সেনাপতির আদেশে।

মীরকাসেম বুঝতে পেরেছিলেন যে, ফোর্ট উইলিয়ামের এত কাছে, মুর্শিদাবাদে বসে নবাবী করায় বিপদ আছে। তাই তিনি তাঁর রাজধানীকে সরিয়ে নিয়ে গেলেন সুদূর মুঙ্গেরে। গঙ্গাতীরে প্রাচীন মুঙ্গের দুর্গকে সংস্কার করে সেখানেই সপরিবারে এবং সাংসদ বাস করতে থাকেন। ধাপে ধাপে, ধীরে ধীরে, নবাব তাঁর প্রভাব বিস্তার করতে থাকেন। তাঁর শ্বশুর—মীরজাফর আলি—অঙ্গীকার করেছিল. ইংরেজ বণিক বিনা শুল্কে বাণিজ্য করতে পারবে। এই একচেটিয়া অধিকার লাভ করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্ণধারেরা তাদের প্রতিযোগী ব্যবসায়ীদের—ফরাসি, দিনেমার, পর্তুগীজদের মাথায় চাঁদির পয়জার মারতে শুরু করেছিল মীরজাফরি জমানায়। প্রতিযোগীরা ব্যবসা গুটিয়ে নেওয়ার আয়োজন করতে থাকে। একচেটিয়া ব্যবসা মানে ইচ্ছেমতো নিত্য ব্যবহার্য পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি। নতুন নবাবের কিছু করার নেই! নবাব তাঁর পূর্ববর্তী নবাব মীরজাফরের জারি করা ফর্মান প্রত্যাহার করতে পারেন না—তাহলেই প্রত্যক্ষ সংঘাত। তাই ভালোমানুষের মতো অন্যান্য ব্যবসায়ীদেরও-ফরাসি- দিনেমারদেরও তিনি বিনা শুল্কে বাণিজ্য-অধিকার প্রদান করে বসলেন। এতে আইনত ইংরেজ কোম্পানি কিছু বলতে পারল না; কিন্তু তাদের ‘বাড়াভাতে ছাই পড়ল’। প্রতিযোগিতার মাধ্যমে বাজারে সমতা ফিরে এল, যদিও রাজ সরকারের রোজগারে টান ধরল।

কিন্তু এসব ঘটনা আমাদের কাহিনীর পরবর্তীকালের। মুঙ্গেরে যখন মীরকাসেম জাঁকিয়ে বসেছেন তখন একদিন বঙ্গদেশ থেকে ওরা দুই বন্ধু কাশীতে এসে হাজির হল—বলভদ্র আর বিরোচন।

মোহনলালের পুত্র ‘রাহুল’–নামটা পণ্ডিতজীই দিয়েছিলেন—তখন আড়াই বছরের শিশু। হাতে খাড়ু, মাথায় কাকপুচ্ছ। তাকে কোলে নিয়ে কত আদর করল ওরা দুজন—মোহনলালের দুই অনুচর। তারপর তারা পণ্ডিতজীকে অনুরোধ করল নোঙর তুলে ফেলতে। বলভদ্র আর বিরোচন দুজনেই ইতিমধ্যে মুঙ্গেরে চলে এসেছে। মীরকাসেমের বাহিনীতে যোগদান করেছে। ওরা খবর পেয়েছিল যে, নতুন নবাব শহিদ মীরমদনের স্ত্রীকে ‘যাবৎ জীবন’ অথবা যাবন্নিকা’ একটি মাসোয়ারার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। নবাবের মীর মুন্সীর কানে ওরা দু’বন্ধু মোহনলালের বিধবা এবং শিশুপুত্রের প্রসঙ্গটা তুলে দেয়। নবাব তা শুনে খুশি হয়ে ওদের বলেছেন, মোহনলালের বিধবা ও শিশুপুত্রটিকে মুঙ্গেরে নিয়ে যেতে। শহিদ পিতার অবর্তমানে তার শিশুপুত্রকে তিনি কিছু ‘তওবা’ প্রদান করবেন।

কাহিনী দীর্ঘায়িত করে লাভ নেই। বলভদ্র আর বিরোচনের ব্যবস্থাপনায় বৃদ্ধ পণ্ডিতজী তাঁর বিগতভর্তা কন্যা ও দৌহিত্রকে নিয়ে গঙ্গার স্রোতধারা বহে চলে এলেন মুঙ্গেরে। নবাব মীরকাসেম আলি খান বাহাদুর মোহনলাল শেঠের বালকপুত্রকে ‘শেঠরায়’ খেতাব দিলেন। আর এই সঙ্গে মুর্শিদাবাদের দক্ষিণে বেলডাঙ্গা পরগণায় একটি জমিদারি প্রদান করলেন। গড়ে উঠল মোহনপুর গ্রাম আর তার কেন্দ্রস্থলে মোহনমঞ্জিল।

এই ঘটনার পর মাত্র দুই বৎসর রোজনামচা লিখে যাবার সুযোগ পেয়েছিলেন পণ্ডিত পুরুষোত্তমদাস শেঠ। তিনিই ছিলেন নাবালকের তরফের অছি।

কাশীর বাজারে একরকম রঙরেরঙের কাঠের কৌটো পাওয়া যায় দেখেছেন? কৌটো খুললেই দেখবেন তার ভিতর আর একটি কৌটো। সেটা খুলুন; আবার কৌটো! সেটা খুললে আবার কৌটো। এইভাবে ক্রমান্বয়ে কৌটোর ভিতর কৌটো।

আমাদের গোয়েন্দা গল্পটাও সেই জাতের হতে বসেছে। এতটা পথ চলে এলাম খুন- জখমের নামগন্ধ নেই, লাশ নেই, ফিঙ্গারপ্রিন্ট নেই, হোমিসাইড তদন্তকারী নেই—শুধু কৌটোর মধ্যে কৌটো।

বাসুসাহেবকে গল্প শোনাচ্ছে কৌশিক। কী গল্প?

না, সত্যপ্রসন্ন গল্প শোনাচ্ছেন কৌশিককে। কী গল্প?

না, অধ্যাপক বেণীমাধব গল্প শোনাচ্ছেন রায়বাহাদুরকে। কী গল্প?

না, ডক্টর মিস স্মিথ গল্প শোনাচ্ছেন সব্বাইকে!

এর তো শেষ হবে না মনে হচ্ছে। তারচেয়ে মূল কাহিনীতে সরাসরি ফিরে আসা যাক।

বাসুসাহেব কৌশিককে বললেন, এবার সংক্ষেপে জানিয়ে দাও দিকিন, রায়বাহাদুরের স্ত্রী এতদিন পরে হঠাৎ কেন অতসীর সন্ধান নিতে তোমাকে নিয়োগ করলেন?

কৌশিক বললে, বিশেষ কারণ ছিল। মিস রমলা স্মিথের কাছে ওই কাহিনীটা শোনার পরেই রাতারাতি একটা বিরাট পরিবর্তন হয়ে গেল রায়বাহাদুরের জীবনে। তিনি অন্তর্মুখী অর্ন্তলীন চিন্তায় একেবারে মূক হয়ে গেলেন। ঘড়ির কাঁটার ছন্দ মেনে জীবনযাপনের গ্লানিটুকুই স্বীকার করে নিলেন। আনন্দটুকু বিসর্জন দিয়ে। রবিবারের সন্ধ্যায় দাবা খেলা বন্ধ হল। পুকুরে স্নান বন্ধ হল। কলঘরে বালতিতে তোলা জলে স্নান শুরু করলেন। চোঙমুখ গ্রামাফোনটা নিষ্ক্রিয়। অপরাহ্ণে যে আত্মজীবনীটা লিখছিলেন দীর্ঘদিন ধরে, তা অসমাপ্ত রইল। কেন এই আকস্মিক পরিবর্তন? একথা কে তাঁকে সাহস করে জিজ্ঞেস করবে? শশীকলা করেছিলেন, তার জবাবে রায়বাহাদুর এককথায় শুধু বলেছিলেন, ‘ভাল্লাগে না’।

সত্যপ্রসন্ন গোপনে এসে দেখা করলেন শশীকলার সঙ্গে।

জানতে চান : কী হয়েছে বল তো শশী? রায়বাহাদুর রাতারাতি জীবনে এমন বীতরাগ হয়ে গেলেন কেন? মনে হচ্ছে, কোথায় যেন একটা কাঁটা বিঁধছে রায়বাহাদুরের অন্তরে!

শশীকলা মাথা নেড়ে বাল্য-সহচরকে বলেছিলেন, তুমি ঠিকই আন্দাজ করেছ, সতুদা। সেদিন মিস রমলা স্মিথ-এর কাহিনীটা শোনার পর ওঁর বুকে একটা মর্মান্তিক কাঁটা বিঁধে গেছে।

—কিন্তু কিসের কাঁটা?

—দর্পণে প্রতিবিম্বিত কাঁটা!

—’দর্পণে প্রতিবিম্বিত কাঁটা!’ তার মানে?

—ভেবে দেখ, দু’জনের জীবনে আড়াইশ বছর আগে-পিছে দুটি ঘটনা ঘটল, যার মধ্যে একটা আশ্চর্য যোগসূত্র আছে। এ যেন ‘হিস্ট্রি রিপিট্স ইটসেল্ফ’! পণ্ডিত পুরুষোত্তমদাসজীর অজ্ঞাতসারে তাঁর কন্যা গান্ধর্বমতে বিবাহ করল মোহনলালজীকে— যে মোহনলাল দুঃশাসকদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে প্রাণ দিলেন। ঠিক তেমনি, তোমাদের রায়বাহাদুরের ভাইও তাঁর অজ্ঞাতসারে গান্ধর্ববিবাহ করে। অপশাসকদের বিরুদ্ধে লড়াই করে শহিদ হয়ে গেল। পুরুষোত্তমদাস আর রায়বাহাদুর দু’জনেই ‘পসথুমাস চাইল্ড’ দুটিকে মানুষ করে তুললেন—এক যেন অপরের দর্পণ-প্রতিবিম্ব।

বাধা দিয়ে দুগারজি বলেছিলেন, না! তুমি শুধু সাদৃশ্যগুলিই দেখছ শশী, বৈসাদৃশ্যগুলিকে লক্ষ্য করছ না। বিধবা সরযূবালাকে পণ্ডিতজী সাদরে বুকে টেনে নিয়েছিলেন, অথচ রায়বাহাদুর সমুর বিধবাকে সাহায্য তো করেনইনি; অপমান করেছেন—

—না সতুদা, সমুর বিধবাকে উনি গোপনে অর্থাসাহায্য করতে চেয়েছিলেন—

—কিন্তু কী মর্মান্তিক শর্তে? সেকথা বল? অতসী কোনওদিন তার মাতৃত্বের দাবি নিয়ে সগৌরবে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না। তাই নয়? সে কোনওদিন শেঠরায়-বাড়ির ছোটবউ হতে পারবে না। তাই নয়?

শশীকলা জবাব খুঁজে পাননি।

সত্যপ্রসন্ন বলে চলেন, পুরুষোত্তমদাসজী ছিলেন দরিদ্র, তবু বিধবা কন্যাকে বক্ষপুটে নিয়ে তিনি দেশত্যাগ করেছিলেন, অজ্ঞাতবাসে দিনযাপন করেছেন মোহনলালের বিধবাকে নিয়ে। অপরপক্ষে ধনকুবের রায়বাহাদুর সেই সম্পত্তির অধিকারী হয়েছেন উত্তরধিকার সূত্রে। ভ্রাতৃবধূ পরের বাড়ি বাসন মেজে গ্রাসাচ্ছাদন করছে জেনেও… শশীকলা বাল্যবন্ধুর মুখে হাতচাপা দিয়ে থামিয়ে দেন। বলেন, তুমি আমার একটা উপকার করবে, সতুদা? খোঁজ নিয়ে দেখবে, সেই দুঃসাহসী মেয়েটা আজও বেঁচে আছে কিনা—আমাদের খুকুর গর্ভধারিণী?

সত্যপ্রসন্ন বলেছিলেন, নাইন্টি-নাইন পার্সেন্ট চান্স : নেই। থাকুক বা না থাকুক, আমার পক্ষে পঁচিশ বছর পরে প্রকৃত সত্যটা উদ্ধার করা অসম্ভব।

—জানি! তোমাকে আমি মানস সরোবর থেকে আমার জন্য নীলপদ্ম তুলে আনতে বলছি না, সতুদা। তুমি কলকাতা চলে যাও—এই ঠিকানায় গিয়ে মিস্টার কৌশিক মিত্র অথবা তার স্ত্রী সুজাতার সঙ্গে গিয়ে দেখা কর। সমস্ত ঘটনা খুলে জানাও তাদের। ওদের একটা প্রাইভেট ডিটেকটিভ এজেন্সি আছে। পারলে তারাই সন্ধান নিয়ে জানাতে পারবে: অতসী বেঁচে আছে অথবা নেই। থাকলে কোথায় আছে, কী করছে?

—ধর সে সন্ধান পেলে, তারপর তুমি কী করবে?

—সন্ধানটা তো আগে পাই। তারপর সেকথা তোমাকে বলব।

বাসুসাহেব বললেন, বুঝলাম। তা তিনবছর আগে তোমরা সন্ধান করে কী তথ্য জানতে পারলে?

—প্রায় বিশ বছর আগে অতসী নামের মেয়েটি নিশ্চিতভাবে মারা গেছে!

–কী ভাবে?

—আবার পুলিশ এনকাউন্টারে। গোয়েন্দা পুলিশ ওই পরিচারিকার পরিচয় আবিষ্কার করে তাকে গ্রেপ্তার করতে যায়। পারে না। মেয়েটি তার পূর্বেই পালিয়ে যায়। নকশাল পার্টির কমরেডদের সঙ্গে তার যোগাযোগ ছিলই। পরে বাংলা-বিহার সীমান্তে কী একটা নদীবক্ষে একটা এনকাউন্টারে ওদের গোটা দলটা মেশিনগানের গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যায়। নৌকাটা ডুবে যায়, মৃতদেহ উদ্ধার করা যায়নি। গোয়েন্দা দপ্তর থেকে আমি খবরটা পেয়েছিলাম, সত্যপ্রসন্নের মাধ্যমে শশীকলা দেবীকে জানিয়েওছিলাম। সম্ভবত এ-সংবাদটা রায়বাহাদুরকে জানানো হয়নি। অবশ্য হয়েছিল কি হয়নি আমি জানি না। আমার জানার কথাও নয়। বাই দ্যাট টাইম আওয়ার কেস ওয়াজ ক্লোজড! শশীকলা আমাদের প্রাপ্য মিটিয়ে দিয়েছিলেন।