পাঁচ
গল্পটা থামিয়ে এখানে কিছু কৈফিয়ৎ দেবার প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। ‘মোহনলাল’ ঐতিহাসিক ব্যক্তি। নিঃসন্দেহে। বস্তুত ইংরেজদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা সংগ্রামের শহিদ হিসেবে যৌথভাবে তিনিই প্রথম। মোহনলাল ও মীরমদন। সেই যে বিনিসুতোর মালাটা আছে না?–মঙ্গল পাণ্ডে, লক্ষ্মীবাঈ, তাঁতিয়া তোপী—চাপেকার ব্রাদার্স, ক্ষুদিরাম, প্রফুল্ল, মাস্টারদা, বিনয়, বাদল, দীনেশ—ভগত সিং, আজাদ, নেতাজী সুভাষ–তার আদ্যসূরী যৗথভাবে ওই মোহনলাল আর মীরমদন। অত্যন্ত দুঃখের কথা, বাঙালি তা মনে করে াখেনি। শহিদ মোহনলাল আর শহিদ মীরমদনের যৌথ স্মৃতিচিহ্ন স্বাধীনতার পর আমরা ানাইনি। সে মানসিকতা ছিল না সদ্য-গদি-আসীনদের। তাঁরা অক্টারলোনি মনুমেন্টের মাথায় ক কোট লাল রঙের পোঁচড়া লাগিয়ে বলেছিলেন—ওই অক্টারলোনি মনুমেন্টটাই হল গিয়ে হিদ মিনার। বিহারের রাজধানীতে তবু দেবীপ্রসাদের একটি অনবদ্য ভাস্কর্য আছে, কল্লোলিনী লকাতায় নেই! হতো—যদি নেতাজী ফিরে আসতেন। কোথায় হতো জানেন? ঠিক যেখানে মূল হলওয়েল মনুমেন্টটা, সেখানে।
অত্যন্ত দুঃখের কথা: সংসদ বাঙালি চরিতাভিধানে (ডিসেম্বর ১৯৯৮ এডিশন) তাঁর ঠাঁই হয়নি। বিশ্বাসঘাতক ‘মীরজাফর’ উপস্থিত; সিরাজকে যিনি পলাশী যুদ্ধান্তে ধরিয়ে দিতে সাহায্য করেন সেই ‘মীরকাসেম’ও আছেন। ষড়যন্ত্রকারীরা সবাই—রায়দুর্লভ, রাজবল্লভ, জগৎশেঠ, প্রেমচাঁদরা সবাই হাজির। মীরমদনেরও একটা এন্ট্রি আছে। অনুপস্থিত শুধুই হতভাগ্য এই—মোহনলাল!
সমসাময়িক ইতিহাসে কিন্তু তিনি স্বীকৃত। সিয়ার-উল-মুতাক্ষরিনের মতে, শত্রুদের হাতে মীরজাফরের আদেশে বন্দী অবস্থায় তিনি নিহত হন।
ঐতিহাসিক ‘হিল’ তা মেনে নেননি। তাঁর মতে, মোহনলাল মর্মান্তিক আঘাতে যুদ্ধক্ষেত্রে আহত হন বটে, তবে তাঁর মৃত্যু হয় অন্যত্র। অধ্যাপক তপনমোহন চট্টোপাধ্যায় তাঁর ‘পলাশীর যুদ্ধ’ গ্রন্থে মোহনলালের মৃত্যু প্রসঙ্গে আসেননি। বলেছেন, “সেনাপতি মোহনলাল মীরজাফরের উপদেশমতো লড়াই বন্ধ করে দিতে রাজি হলেন না। তিনি বললেন, ওই সামান্য ব্যাপারে তাঁরা যদি পিছিয়ে যান, তাহলে তো ওইখানেই যুদ্ধ খতম। তাঁদের চূড়ান্ত হার হবে। কাল আর কিছু করে উঠতে হবে না। মোহলাল আবার ইংরেজদের আক্রমণ করার জন্য উদ্যোগী হলেন।” ব্যস! ওইটুকুই!
তপনমোহনের ‘পলাশীর যুদ্ধ’ গ্রন্থে—এখানে মোহনলাল প্রসঙ্গের ওইখানেই ইতি।
এ. টি. দেবের ‘সরল বাংলা অভিধানে’ হাফ-আখরাই গানের প্রবর্তক মোহনচাঁদ বসুর জন্য দেড় কলম ঠাঁই জুটেছে। শহিদ মোহনলালের জন্য ছোট্ট দুটি প্যারাগ্রাফ। এই অভিধান মতে, নবাব মোহনলালকে রাজা খেতাব দিয়েছিলেন। অথচ নিরক্ষরতা দূরীকরণ সমিতির বিশ্বকোষ মতে, নবাব তাঁকে ‘মহারাজা’ খেতাব দিয়েছিলেন।
কোনও সূত্রেই তাঁর বংশপরিচয় বা পিতার নামটা পাওয়া যায় না। অধিকাংশ সূত্রমতে, তিনি কাশ্মীরী ব্রাহ্মণ অথবা ক্ষত্রিয়। তিনি বিবাহ করেছিলেন কি না, তাঁর সন্তানাদি ছিল কি না, এসব তথ্য কোনও ঐতিহাসিক বা পণ্ডিত লিখে যাননি। ‘সিরাজদ্দৌলা’ নাটকে অথবা নবীন সেনের ‘পলাশীর যুদ্ধ’ কাব্যে আমরা যে মোহনলালের পরিচয় পাই তা নাট্যকার বা কবির কল্পনামাত্র। যেমন এই কণ্টকবিদ্ধ কাহিনীতে মোহনলালকে কাহিনীকার ইচ্ছামত এঁকেছেন, তবে সজ্ঞানে ইতিহাসকে কোথাও অস্বীকার না করে।
কাহিনীতে ফিরে আসা যাক এবার :
অধ্যাপক বেণীমাধব দত্তের ধারণা— মোহনপুরের জমিদারীর আদিপুরুষ সেই মহারাজ মোহনলাল শেঠ। গ্রামের নাম মোহনপুর, রাজবাড়ির নাম মোহনমঞ্জিল, জমিদারের উপাধি ‘শেঠ। সবকিছুই ওইরকম একটা সম্ভাবনার ইঙ্গিতবাহী। তাই অধ্যাপক দত্তের প্রস্তাব, তাঁর ছাত্রী মিস রমলা স্মিথকে জমিদারমশাই দয়া করে অনুমতি দিন—সে ওই অতি প্রাচীন দলিল- দস্তাবেজ-রোজনামচা এবং হিসেবের খাতা পরীক্ষা করে দেখবে, অনুমানটা সত্য কি না।
জগদীন্দ্রনারায়ণ এককথায় রাজি হয়ে গেলেন। দুরন্ত কৌতূহল হল তাঁর। মিস স্মিথ-এর বয়স পঁয়তাল্লিশের কাছাকাছি। চুলগুলি ‘বব্-কাট ধরনের ছোট ছোট করে ছাঁটা। ধর্মে তিনি খ্রিস্টান, রোমান ক্যাথলিক। ফর্সা রঙ। টিকালো নাক, বুদ্ধিদীপ্ত উজ্জ্বল একজোড়া চোখ যদিও অ্যাংলো ইন্ডিয়ান, তবু তিনি শাড়ি-ব্লাউজই পরিধান করেন; শুধু ব্রাহ্ম মহিলাদের অনুকরণে কাঁধে একটা ব্রোচ। মাথায় ঘোমটা দেন না। শশীকলার সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা হল অপরাজিতাও কৌতূহলী হয়ে ঘনিয়ে এল জানতে : একথা সত্যি, মিস স্মিথ? এ জমিদারীর পত্তন করেছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামের আদি শহিদ মোহনলাল শেঠ?
মিস স্মিথ হাসতে হাসতে বলেছিলেন, সেই রহস্যটাই তো ভেদ করতে এসেছি আমি তুমি কি আশা কর, অঙ্কের ফলাফলটা ঘোষণা করে আমি অঙ্কটা কষতে শুরু করি?
খিলখিল করে হেসে উঠেছিল অপরাজিতা। বলেছিল, আপনি ভারি মজা করে কথা বলতে পারেন, মিস স্মিথ।
রমলা বলেছিলেন, আমাকে এখানে বোধহয় কয়েকমাস থাকতে হবে। ফলে, তোমার সঙ্গে একটা সম্পর্ক পাতিয়ে ফেলা ভাল। তুমি আমাকে ‘মাসিমা’ ডেকো, কেমন?
—তা বেশ তো। আপনিও আমাকে নাম ধরে ডাকবেন, আমার নাম অপরাজিতা, জানেন নিশ্চয়।
—তার বদলে আমি যদি তোমাকে ছোট্ট করে ‘খুকু’ বলে ডাকি? তুমি কি রাগ করবে? আমার এক ভাইঝি ছিল—’খুকু’ তাকে অকালে হারিয়েছি।
—না, করব না, যদি আড়ালে তাই ডাকেন। সবার সামনে আমাকে ‘খুকু বলে ডাকলে আমার লজ্জা করবে।
সবচেয়ে বেশি অবাক হয়েছিলেন জগদীন্দ্রনারায়ণ। ‘রায়বাহাদুর’ খেতাব পেয়ে তিনি ম্যাজিস্ট্রেট, এস. ডি. ও., এ. ডি. এম., এস. পি.-দের নিয়ে মদ্যপানের আসর বসিয়েছিলেন। আর আজ তাঁকে শুনতে হচ্ছে, তাঁর বংশের আদি প্রতিষ্ঠাতা হচ্ছেন ইংরেজদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রথম শহিদ। বিরাট শহিদমালার আদ্যসূরী হচ্ছেন তাঁরই বংশের আদিপুরুষ। জগদীন্দ্রনারায়ণ রমলা স্মিথকে সবরকম সাহায্য করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হলেন, কিন্তু মনে মনে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করতে থাকেন যাতে, মিস স্মিথের গবেষণা ব্যর্থ হয়। যাতে প্রমাণিত হয়, এই জমিদার বংশের আদিপুরুষ অন্য এক মোহনলাল। তার একটা বিশেষ হেতুও আছে। ইতিহাসের দর্পণে জগদীন্দ্রনারায়ণ নিজের প্রতিবিম্বটি দেখতে পেয়েছিলেন। কিন্তু দৰ্পণটা সমতল নয়—উত্তল অথবা অবতল। তাই নিজের প্রতিবিম্বটা অতি কুৎসিত হয়ে গেছে! পুরুষোত্তমদাস শেঠজীর পুত্রসম ছাত্র মৃত্যুতীর্থের শেষ সোপানের ওপর দাঁড়িয়ে যেকথা বলেছিল, জগদীন্দ্রনারায়ণের পুত্রতুল্য ছোটভাইও মৃত্যুমন্দিরের দ্বারে দাঁড়িয়ে সেকথাই বলেছিল। দু’শ বছর আগে পুরুষোত্তমদাস ভয় পাননি—মোহনলালের বাকে বক্ষপুটে ঠাঁই দিয়ে দেশান্তরী হয়েছিলেন। তিনি নিজে কাপুরুষ, সমুর বিধবাকে স্বীকার করে নিতে পারেননি।
তবু কৌতূহলও প্রচন্ড। রোজই তিনি এসে ঘনিয়ে বসেন। গবেষণা কতদূর অগ্রসর হল জানতে চান। অপরাজিতা তো আঠার মতো সেঁটে আছে তার মাসিমার সঙ্গে। তার দর্শনে এম. এ ডিগ্রি লাভ হয়ে গেছে। বি. এড. করতে চেয়েছিল। রায়বাহাদুর রাজি হননি। কী হবে বি. এড. করে? সে তো কোনদিন মাস্টারি করতে যাবে না। সুন্দর দেখে একটি ঘরজামাই নিয়ে আসবেন স্থির করে রেখেছেন রায়বাহাদুর। মায়, পাত্রটি পছন্দও করে বসে আছেন! ফলে, অপরাজিতা রোজ সকাল-সন্ধ্যে মিস স্মিথকে সাহায্য করতে আসত।
তারপর একদিন রহস্যজাল ভেদ করা গেল।
হ্যাঁ। মোহনপুর সেই আদি শহিদ মহারাজ মোহনলালের নামেই। মোহনমঞ্জিলও তাই। কিন্তু নবাব বাহাদুর যে উপটৌকন ও ভূখণ্ড মহারাজ মোহনলালকে দিয়ে গিয়েছিলেন এ সম্পত্তি সেই টাকায় নয়। এই ভূখণ্ডও সেই ভূখণ্ড নয়।
কী করে জানা গেল?
ওই দুর্বোধ্য ফার্সি দলিল-দস্তাবেজ ঘেঁটেই তথ্যটা আবিষ্কার করলেন মিস স্মিথ।
মোহনলাল যেহেতু সিপাহসালার মীরজাফরের নির্দেশ অগ্রাহ্য করে ইংরেজ সেনার বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করেছিলেন, তাই গদিতে উঠে বসেই তাকে শাস্তি দিতে চাইলেন নতুন নবাব, মীরজাফর। কিন্তু শাস্তিটা দেবেন কাকে? মোহনলাল তো ফৌত হয়ে গেছে। উনি সিরাজের গদিতে চড়ে বসার আগেই। তাই মীরজাফর ফরমান জারি করলেন ওই ‘বিশ্বাসঘাতক’ মোহনলালের যাবতীয় স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি নবাব সরকারের খাস হয়ে যাবে। মোহনলালের ওয়ারিশরা কিছুই পাবে না। মরুক তারা, ভুখা মরুক। বেইমানের বাচ্চারা!
মীর মুন্সী নতুন নবাব মীরজাফর আলি খাঁকে কুর্নিশ করে জানিয়েছিলেন মহারাজ মোহনলালের বিবি-বাচ্চা কিচ্ছু নেই জাঁহাপনা— ভাই-ভাতিজারও কোনও পাত্তা নেই। তাঁর সম্পত্তি তো এমনিতেই খাস হয়ে যাবে।
মীরজাফর বলেছিলেন, মীর মুন্সি! তোমার মুখে ওই কথাটা যেন দ্বিতীয়বার না শুনি। বেইমান মোহনলালের ‘মহারাজ’ খেতাবটাও বাজেয়াপ্ত হয়ে গেছে!
মিস স্মিথের কাছে অতীত ইতিহাসের এই বিবরণটি শুনে রায়বাহাদুর জানতে চেয়েছিলেন, তাহলে আমাদের এই জমিদারির আদিপুরুষ –সেই মহারাজ মোহনলাল নয়?
—আজ্ঞে না, তিনিই। তাঁর নামেই এই মোহনপুর গ্রাম, তাঁর নামেই এই মোহনমঞ্জিল!
—মানে! তা কেমন করে হয়?
—তারও হদিস পেয়েছি, স্যার। কিন্তু সে তো মস্ত কাহিনী। শুনবেন?
—নিশ্চয় শুনব। বল তুমি।
—তাহলে এখন নয়। সন্ধ্যাবেলা আপনার স্টাডিতে গিয়ে বিস্তারিত জানাব। দিদি আর খুকুও শুনতে উৎসুক।
—’দিদি’ আর ‘খুকু কে?
—আই মীন মিসেস শেঠ রায় আর অপরাজিতা।