দর্পণে প্রতিবিম্বিত কাঁটা – ৪

চার

প্রায় মাস-তিনেক পূর্বে, অর্থাৎ সত্যপ্রসন্ন’যে-সময় সুকৌশলীর দ্বারস্থ হন তার তিন মাস পূর্বে, মোহনমঞ্জিলে অযাচিতভাবে এসে উপস্থিত হন এক পন্ডিত আগন্তুক। ডক্টর বেণীমাধব দত্ত। সরকারি কলেজের অবসরপ্রাপ্ত ইতিহাসের এক অধ্যাপক। সে সময়ে মুর্শিদাবাদস্থিত ‘হাজারদুয়ারির’ কিউরেটর। তিনি এসেছিলেন বিচিত্র একটি প্রস্তাব নিয়ে।

মোহনমঞ্জিলের খাজাঞ্চিখানায় বড় বড় সিন্দুকে আছে বিগত দুই শতাব্দীর কিছু প্রাচীন দলিল-দস্তাবেজ। তার হরফ ফার্সি না উর্দু অথবা প্রাচীন বাংলা, তা জানা নেই জগদীন্দ্রনারায়ণের। তবে তিনি তাঁর পূর্বপুরুষদের প্রতি অত্যন্ত শ্রদ্ধাশীল। তাঁর পিতা, পিতামহ এবং প্রপিতামহের মতো। এজন্য খাজাঞ্চিখানার ওই রহস্যময় দলিল-দস্তাবেজ পুঁথিপত্রগুলি আজও কীটদষ্ট হয়নি। ওঁর পূর্বপুরুষেরা তাঁদের আমলে নিম, তুঁতে, তামাক পাতার সাহায্য নিতেন। ওঁরা দু-পুরুষে দায়িত্বটা অর্পণ করেছেন কীটনাশক বিচক্ষণদের ওপর। তারা প্রতিমাসে এসে পেস্টিসাইড ঔষধ স্প্রে করে যায়।

অধ্যাপক বেণীমাধব দত্ত রায়বাহাদুরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে জানালেন যে, তাঁর একজন রিসার্চ স্কলার এই জমিদারবংশ সম্বন্ধে উদ্ধার করেছে ইতিহাসের এক অকথিত অধ্যায়। এখনও সেটা প্রমাণ হয়নি। তবে সম্ভাবনা যথেষ্ট। বিচিত্র সে ঘটনা।

গঙ্গাতীরে জিয়াগঞ্জে এক প্রাচীন জমিদারবাড়ির চৌহদ্দিভুক্ত একটি মন্দিরে ওই গবেষিকা মেয়েটি আবিষ্কার করেছে ফার্সিতে লেখা একটি অতি প্রাচীন দিনপঞ্জিকা। রোজনামচার লেখক পুরুষোত্তমদাস শেঠজী ছিলেন অষ্টাদশ শতাব্দীর মানুষ। তাঁর আদি নিবাস পাঞ্জাব অঞ্চলে। ধনকুবের জগৎশেঠের সমসাময়িক ব্যক্তি। সম্পর্কে জগৎশেঠের ভাইপো হতেন। প্রথম যুগে নবাব আলিবর্দী খাঁ-সাহেবের খাজাঞ্চিখানায় অনুকারকের কাজ করতেন। পরে সে কাজে ইস্তফা দিয়ে জিয়াগঞ্জে এসে বসবাস শুরু করেন। একটি পাঠশালা খুলে স্থানীয় ছাত্রদের বিদ্যাদান করতেন। জীবনের শেষ বিশ বছর তিনি একটি দিনলিপি লিখে যান। হয়তো আরও লিখেছিলেন যার হদিস পাওয়া যায়নি। ওই বিশ বছরের মধ্যেও দুই এক বছরের ফাঁক আছে।

অধ্যাপক দত্তের একটি প্রিয় ছাত্রী সিরাজউদ্দৌল্লার ওপর রিসার্চ করে ডক্টরেট করেছে। তারপর স্বাধীন ভারত সরকার যখন মুর্শিদাবাদের হাজারদুয়ারির রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব গ্রহণ করেন তখন সে সেখানে অ্যাসিস্ট্যান্ট কিউরেটরের কাজ পায়। অধ্যাপক দত্তের অধীনে আরও গবেষণা করে চলে। সেই মেয়েটিই নিতান্ত ঘটনাচক্রে ওই মহামূল্যবান রোজনামচাটি আবিষ্কার করে বসেছে। জিয়াগঞ্জের কাছে গঙ্গাতীরে আদিনাথজীর এক জৈনমন্দিরের ধনাগারে সেই পুঁথিগুলি সযত্নে রক্ষিত ও নিত্যপূজিত হয়ে এসেছে। দশকের পর দশক শতাব্দীর পর শতাব্দী। মন্দির কর্তৃপক্ষ আধুনিক শিক্ষিত, যদিও ফার্সি পাণ্ডুলিপির পাঠোদ্ধার করার মতো মানুষ জিয়াগঞ্জে কেউ ছিলেন না। তাঁরা মিস রমলা স্মিথকে খ্রিস্টান হওয়া সত্ত্বেও, পুঁথিগুলি ছয়মাসের জন্য দেখতে দিয়েছেন। সে নোট নিয়ে ফটোকপি বা জেরক্স করিয়ে মন্দির কর্তৃপক্ষকে পাণ্ডুলিপি ফেরত দিয়ে এসেছে।

সেই রোজনামচা থেকে জানা গেছে যে, পলাশীর যুদ্ধকালে পুরুষোত্তম দাস শেঠজীর বয়স ছিল তিন কুড়ির কাছাকাছি। তিনি ছিলেন বিপত্নীক এবং সাত্ত্বিক প্রকৃতির মানুষ। সেই বহুবিবাহের যুগেও প্রথমা স্ত্রীর প্রয়াণের পর আর দ্বিতীয়বার বিবাহ করেননি। তাঁর দেখভাল করত একমাত্র কন্যা সরযূবালা। তাঁর জিয়াগঞ্জের ভিটায় প্রতিষ্ঠিত শিউজীর মন্দিরের যাবতীয় নিত্যকর্মের দায়িত্বও ছিল শেঠজীর ওই মেয়েটার। পাঠশালায় নানান ছাত্র তাঁর কাছে ‘লিখাপড়ি’ শিখতে আসত। পাঞ্জাবি ঘরানার মানুষ শেঠজী। তাঁর মেয়েকে অসূর্যম্পশ্যা করে রাখেননি। জিয়াগঞ্জের গঙ্গার জলধারার মতো জীবনও চলে যাচ্ছিল মন্দাক্রান্তা ছন্দে। হঠাৎ ফিরিঙ্গিদের সঙ্গে নবাবের যুদ্ধ বাধার উপক্রম হল। জিয়াগঞ্জের অনেক যুবক ডাক পেয়ে চলে গেল মুর্শিদাবাদ। তার ভিতর ছিল ওঁর এক প্রতিবেশী যুবক মোহনলাল। মোহন শেঠজীর পাঠশালায় এককালে পড়াশুনা করেছে। মোহনলাল ওঁর প্রিয় ছাত্র; কিন্তু পড়াশুনার চেয়ে অসিচালনাতেই তার দক্ষতা ছিল বেশি। সুদর্শন এবং অত্যন্ত বলশালী যুবক ছিল সে। পড়াশুনা মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে সে চলে গিয়েছিল মুর্শিদাবাদে। অল্পদিনের মধ্যেই বৃদ্ধ নবাব আলিবর্দীর সুনজরে পড়েছিল। নবাব তাকে দেওয়ানখানার পেশকার পদে নিযুক্ত করে দিলেন। কিন্তু পেশকারী বৃত্তি মোহনলালের পোষালো না। মসির চেয়ে অসিটাই ছিল তার কাছে প্রিয়তর। ফলে সিরাজ নবাব হয়ে তাকে ঢাই-হাজারি মনসবদার বানিয়ে দিলেন।

পুরুযোত্তম দাস শেঠজী তাঁর দিনপঞ্জিকায় লিখেছেন যে, মোহনলাল সৈন্যপত্য লাভ করেই একটা দারুণ সাফল্যলাভ করে বসে। নবাবের এক মাসতুতো ভাই ছিল পূর্ণিয়ার শাসনকর্তা। বস্তুত ঘরশত্রু বিভীষণ সে। সিরাজের বিরুদ্ধে গোপন চক্রান্তে লিপ্ত হয়েছিল ওই মাসতুতো ভাই শওকত জং বাহাদুর। সিরাজ মোহনলালকে পাঠিয়ে দিলেন পূর্ণিয়ার শাসনকর্তাকে শায়েস্তা করতে। মনিহারির যুদ্ধে ঢাই-হাজারি মনসবদার মোহনলাল সম্পূর্ণরূপে শওকত জংকে গরাজিত করে বন্দী করেন।

সিরাজ খুশি হয়ে মোহনলালকে প্রচুর উপঢৌকনসহ ‘রাজা’ অথবা ‘মহারাজা’ উপাধি দেন এবং আড়াই হাজারি থেকে উন্নীত করে একেবার দশহাজারি মনসবদার করে দেন। শঠজী তাঁর ছাত্রের এই অপরিসীম সাফল্যে এত খুশি হন যে, তাকে নিমন্ত্রণ করে নিয়ে আসেন জিয়াগঞ্জে। পিতৃমাতৃহীন রাজা মোহনলাল —তখন সে ছাব্বিশ বছরের তরুণমাত্র—বেশ কয়েক মাস তাঁর গুরুগৃহে আতিথ্য নিয়েছিলেন।

শেঠজী টের পাননি তাঁর গৃহাভ্যন্তরে মোহলালের শৌর্য-বীর্যে আরও একজন মোহিত হয়ে গিয়েছিল। অতিথিকে সকাল-বিকেল পরিচর্যা করতে করতে সেই পঞ্চদশী মেয়েটি নিজেকে হারিয়ে ফেলল।

এর কয়েক মাস পরেই যুগান্তকারী পলাশীর যুদ্ধ। নবাবের আহ্বানমাত্র রাজা মোহনলাল চলে গেলেন মুর্শিদাবাদ। সিপাহশালার মীরজাফরের অধীনে তাঁর নিজস্ব সৈন্যদলের সৈন্যপত্য দিতে।

পুরুষোদত্তমদাসজীর দিনপঞ্জিকার সঙ্গে ঐতিহাসিক হিল এবং নবাবের সরকারি ব্যবস্থাপনায় লিখিতে পণ্ডিত সিয়ার-উল-মুতাক্ষরিনের বক্তব্য হুবহু মিলে যাচ্ছে। ১৭৫৭খ্রিস্টাব্দের তেইশে জুন পলাশী প্রান্তরে অস্তমিত হল ভারতের স্বাধীনতাসূর্য—সিপাহশালার মীরজাফরের চরম বিশ্বাসঘাতকতায়। সে মর্মন্তুদ কাহিনী আপনারা জানেন।

কী আশ্চর্য! কী অপরিসীম আশ্চর্য! এস. ওয়াজেদ আলির সেই অবিস্মরণীয় পংক্তিটি। “ভারতের সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলেছে”। আড়াই শ বছর পার হবার পরেও আজও সত্য। পলাশী-প্রান্তরে বিশ্বাসঘাতকতায় যৌথভাবে শামিল হয়েছিল মুসলমান আর হিন্দু। মীরজাফর আর জগৎশেঠ। আর ইংরেজের বিরুদ্ধে প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধের শহিদও যৌথভাবে হিন্দু- মুসলমান। মোহনলাল আর মীরমদন। আজও হিন্দু-মুসলমান একইরকম হিন্দুস্থানের সর্বনাশ ও সেবা করছে। একদল হাওলা-গাওলায় ভারতের ধনভাণ্ডার লুট করছে। আর একদল চা মজুমদার থেকে সফদার হাসমি— এই বিশ্বাসঘাতকদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে আত্মবলি দিয়েছে, কুরবানি হয়েছে। হিন্দু আর মুসলমান।

যুদ্ধের পরদিন গভীররাত্রে একজন অশ্বারোহী এসে পুরুষোত্তমদাস শেঠজীকে গোপনে সংবাদ দিল, পলাশী যুদ্ধে মারাত্বকভাবে আহত হয়েছেন মহারাজ মোহনলাল। মীরমদন ঘটনাস্থলেই গোলার আঘাতে শহিদ হয়ে যান; মোহনলাল প্রচণ্ডভাবে আহত হলেও ঘটনাস্থলে মারা যাননি। তাঁরই আদেশে দ্রুতগামী একটি ছিপ-নৌকায় তাঁকে নিয়ে আসা হয়েছে জিয়াগঞ্জের ঘাটে। রাজা মোহন উত্থানশক্তি রহিত; তিনি একবার তাঁর শিক্ষাগুরু পুরুষোত্তমদাসজীর পদধূলি শেষবারের মতো মাথায় নিতে চান।

বৃদ্ধ শেঠজী তিনপ্রহর রাত্রে মশালধারীর পিছন পিছন জিয়াগঞ্জের ফেরিঘাটে এসে উপনীত হলেন। আঘাটায় লাগানো আছে ছিপ-নৌকাটি। মৃত্যুপথযাত্রী মহারাজ মোহনলাল নৌকার পাটাতনে শায়িত। আর সবাইকে দূরে সরে যেতে বলে মোহনলাল গুরুজীকে কাছে ঘনিয়ে আসতে বললেন। কথা বলতে তাঁর কষ্ট হচ্ছিল তবু ধীরে ধীরে বলে গেলেন, গুরুজী, আপনি নিশ্চয় খুব অবাক হয়ে গেছেন এভাবে আপনাকে একেবারে শেষ সময়ে সংবাদ দেওয়ায়। কথাটা না বলে গেলে মরেও আমি শান্তি পাব না।

বৃদ্ধ অবাক হয়ে বলেন, কী এমন গোপন কথা, মোহন?

—পলাশীর যুদ্ধে সিপাহশালার মীরজাফর যদি বিশ্বাসঘাতকতা না করত তাহলে আজ আমরা যুদ্ধ জয় করে, ক্লাইভকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করে, জিয়াগঞ্জে ফিরে আসতাম। তাহলে তখন আপনাকে যুগলে প্রণাম করে আপনার আর্শীবাদ ভিক্ষা করতাম।

—’যুগলে’! তার অর্থ?

—আপনার কন্যা সরযূবালা আমার ধর্মপত্নী। আপনার অজ্ঞাতসারে গান্ধবমতে আমাদের ববাহ হয়েছিল।

বৃদ্ধের মুখে কথা ফোটেনি।

—আপনাকে আমার একান্ত অনুরোধ, সরযূকে আপনি আজীবন ভরণপোষণ করবেন। মাপনি জানেন, আমার বাবা-মা, আত্মীয়-স্বজনেরা সুদূর কাশ্মীরের বাসিন্দা। আমি কপর্দকহীন মবস্থায় বঙ্গালমুলুকে পালিয়ে আসি কিশোর বয়সে। কিন্তু আজ আমি কপর্দকহীন নই। নবাব মামাকে খেতাবের সঙ্গে প্রচুর উপটোকন দিয়েছিলেন। আপনাকে জানিয়ে যাই, আমার স্থাবর- মস্থাবর সমস্ত সম্পত্তির মালিক আপনার কন্যা, আমার স্ত্রী সরযূবালা।

বৃদ্ধ এতক্ষণে বাক্‌শক্তি ফিরে পেয়েছেন। বলেন, সে ক্ষেত্রে তোমাদের এই গান্ধর্ব- ববাহের কথাটা গোপন রাখাই ভাল হবে না কি মোহন? গ্রামের মানুষদের মতি-গতি বোঝা চার। সরযূ তোমার স্ত্রী জানতে পারলেই তাকে ধরে-বেঁধে নিয়ে গিয়ে সতী করবে। চিতার মাগুনে পুড়িয়ে তারা পৈশাচিক উল্লাসে নাচবে।

—আজ্ঞে না। পারবে না। আপনি বাধা দেবেন।

—আমার কী ক্ষমতা, বাবা?

—অসীম ক্ষমতা আপনার। আপনি সেকথা জানেন না। আমার দুই সহচর বলভদ্র আর বরোচন, সব কথা জানে। ফলে আমার দশ হাজার সৈন্য আপনার সহায়। তাছাড়া শাস্ত্রীয় নর্দেশও আপনার স্বপক্ষে।

—শাস্ত্রীয় নির্দেশ’! তার অর্থ?

—গর্ভবতী অবস্থায় কেউ সতী হতে পারে না, গুরুদেব! নারদীয় পূরাণে এমন বিধান মাছে, আপনি তো জানেনই।

বজ্রাহত হয়ে গেলেন পুরুষোত্তমদাস পণ্ডিতজী।