তিন
কৌশিক আগন্তুক ভদ্রলোককে বলেছিল, এসব তো অতীতের কাহিনী। বিশ বছর আগেকার কথা।
—আজ্ঞে না। চব্বিশ বছর আগেকার ঘটনা।
—না হয় তাই হল। কিন্তু আপনি আমার কাছে কী প্রস্তাব নিয়ে এসেছেন? কার কাছ থেকে? জগদীন্দ্রনারায়ণ?
—আজ্ঞে না। তিনি আদৌ জানেন না যে আমি আপনার সঙ্গে গোপনে দেখা করতে কলকাতায় এসেছি।
—বলেন কী! তাহলে আমাদের ক্লায়েন্ট কে? আপনি নিজে?
—আজ্ঞে তাও না। শ্রীযুক্তা শশীকলা দেবী। জমিদার গৃহিণী।
—বুঝলাম। বলে যান।
পরবর্তী ঘটনাবলী বিস্তারিতভাবে নিবেদন করতে থাকেন দুগারজী:
সমরেন্দ্রর মৃত্যুর পরে তার মৃত্যুকালীন জবানবন্দী ‘কী’ ছিল তা জানাতে অস্বীকৃত হওয়ায় জগদীন্দ্রনারায়ণের যন্ত্রণাটাও বড় কম হয়নি। কিন্তু তিনি নকশালদলের কারও নাম বলে দেননি। একটি নামই জানতেন তিনি: অতসী। তার কথা স্বীকার করেননি; বলেছিলেন, সমু তার সহকর্মীদের কারও নাম বলে যায়নি। সজ্ঞান মিথ্যাভাষণ! প্রায় বছরখানেক এ নিয়ে পুলিশের টানাপোড়েন চলছিল। তারপর পুলিশ বোধহয় বিশ্বাস করল তাঁর কথায়। সব কিছু থিতিয়ে গেলে জগদীন্দ্রনারায়ণ সত্যপ্রসন্নকে পাঠিয়ে দিলেন অতসীর সন্ধানে। অতসীর গ্রামের নামটা সমরেন্দ্র বলে গিয়েছিল। অতসীর কাকার নামটাও। অতসী মেয়েটি ছিল অনাথ—পিতৃমাতৃহীন। কাকার সংসারে মানুষ হচ্ছিল। ওদের গ্রামটা রামপুরহাট আর কাটোয়ার মাঝামাঝি। একটি বর্ধিষ্ণু খ্রিস্টান গ্রাম, যোসেফনগরের গা-ঘেঁষা হিন্দু পল্লী। অতসী ওই যোসেফনগর স্কুলের ছাত্রী। দুর্দান্ত রেজাল্ট করে স্কলারশিপ নিয়ে প্রেসিডেন্সিতে পড়তে এসেছিল। সেখানেই সমুর সঙ্গে ওর আলাপ। দুজনে গোপনে নকশাল দলে নাম লেখায়।
অনেক খুঁজে খুঁজে কিছুটা পদব্রজে, কিছুটা গো-গাড়িতে পাড়ি দিয়ে একদিন সত্যপ্রসন্ন এসে হাজির হলেন অতসীর ভিটায়। ওর কাকা আর খুড়িমা আগন্তুককে মারতে বাকি রেখেছিল। কোনও সৌজন্যমূলক হেতুতে নয়—প্রহার করলে কথাটা গ্রামে জানাজানি হয়ে যাবে, এই ভয়ে।
নগণ্য গ্রাম। সকলেই সকলের হাঁড়ির খবর রাখে। কুমারী গ্রাম্য মেয়ের পক্ষে গর্ভিণী হয়ে পড়া এমন বৈচিত্র্যহীন গ্রাম্য পরিবেশে একটা মস্ত মুখরোচক চাঞ্চল্যকর কেচ্ছা। অতসী যে গোপনে ওই নকশাল দলে নাম লিখিয়েছিল একথা গ্রামের কুকুরগুলো পর্যন্ত বুঝতে পেরেছিল। তাকে ধরিয়ে দিতে পারলে দু-টুকরো রুটি-মাংস নিশ্চয় পাওয়া যাবে। তাই অতসীর ঠাঁই হয়নি নিজ গ্রামে। সেখানে আত্মগোপনের চেষ্টা করলে ধরা পড়ে যাবার সমূহ সম্ভাবনা—একথা ভাল মতো জানা ছিল তার। তবু নিতান্ত নিরুপায় হয়ে কাকার আশ্রয়েই খোঁড়াতে খোঁড়াতে ফিরে এসেছিল সেই গর্ভিণী কুমারী মেয়েটি। বুলেটটা তখনও তার ডান গোড়ালিতে বিঁধে আছে। অসাধারণ সহ্যশক্তি তার। দৈহিক এবং মানসিক। গভীর রাতে এসে পৌঁছাল গাঁয়ে। পাড়ার কুকুরগুলো তারস্বরে সারমেয় প্রতিবাদ করেছিল। খুড়ো-খুড়িও করেছিলেন, তবে তারস্বরে নয়, চাপা আক্রোশে, দেহান্ত-বাপের পুনরায় বাপান্ত করে, জানাজানি হয়ে যাবার ভয়ে। বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা, পুলিশে ছুঁলে ছত্রিশ! রাত ভোর হবার আগেই টাপর-তোলা গো-গাড়িতে হতচ্ছারিকে উঠিয়ে নিয়ে কাকা রওনা দিয়েছিলেন যোসেফনগর।
যোসেফনগর গার্লস স্কুলের হেডমিস্ট্রেস মিস মল্লিকা মল্লিকের অত্যন্ত প্রিয় ছাত্রী অতসী। নকশাল আন্দোলনের প্রতিও তাঁর গোপন সহানুভূতি ছিল। স্বাধীন ভারতের শাসকেরা দিন দিন শোষক হয়ে যাচ্ছে দেখে সেই শিক্ষাব্রতী মহিলাটি আন্তরিক ক্ষুব্ধ ছিলেন। তিনি নিজের পক্ষপুটে তাঁর সমূহ বিপদ বিষয়ে সম্পূর্ণ অবহিত হয়েও—ওই অসহায় মেয়েটিকে আশ্রয় দিয়েছিলেন। কাকপক্ষীতেও টের পায়নি।
খুড়োমশায়ের কাছ থেকে এইটুকু সংবাদ সংগ্রহ করতে সত্যপ্রসন্নের কালঘাম ছুটে গিয়েছিল। অবশেষে তিনি ভয় দেখালেন, অতসী যে গ্রামে ফিরে এসেছিল এ-তথ্যটা তাঁর জানা। খুড়োমশাই সব কথা না জানালে তিনি বাধ্য হয়ে পুলিশের দ্বারস্থ হবেন। তারা খুঁজে বার করুক: কোথায় গেল মেয়েটি— তখনই খুড়োমশাই নরম হলেন। ভাইঝির সম্বন্ধে যেটুকু জানা ছিল তা ব্যক্ত করতে বাধ্য হয়েছিলেন। বললেন, বিশ্বাস করুন, এর বেশি আমি কিছু জানি না। বুলেটটা ওর পা থেকে বার করা গিয়েছিল কি না তাও জানি না। ওর সন্তান আদৌ হয়েছিল কি না তাও আমার জানা নেই। কী করব বলুন? আপন ভাইঝি! কিন্তু রাক্ষসী যে নকশাল হয়ে গেল!
সেই সূত্র ধরে সত্যপ্রসন্ন এসে হাজির হলেন যোসেফনগরে। সত্যপ্রসন্ন যে পুলিশের লোক অথবা ‘টিকটিকি’ নন, এটা ভালভাবে সমঝিয়ে নিয়ে মিস মল্লিকা মল্লিক প্রকৃত তথ্যটা জানাতে স্বীকৃত হলেন। বিশেষ, সত্যপ্রসন্ন যখন জানালেন যে, জমিদার গৃহিণী শশীকলা অতসীর সন্তানটিকে গ্রহণ করতে চান ও ‘দত্তক’ নিতে চান
হেডমিস্ট্রেস মিস মল্লিক জানালেন, অতসী নির্বিঘ্নে প্রসব করেছিল। তার পায়ের ঘা-টাও সারিয়ে তোলা সম্ভব হয়। ইতিমধ্যে খবরটা যে কোনও সূত্রে হোক কিছুটা জানাজানি হয়ে যায়। পুলিশের গোয়েন্দা যাতয়াত শুরু করেছিল যোসেফনগরে। বাধ্য হয়ে অতসী পুনরায় নিরুদ্দেশ যাত্রায় রওনা হয়ে পড়ে। একটি দুগ্ধবতী ধাত্রীর সহায়তায় মিস মল্লিক অতসীর মেয়েটিকে মানুষ করে তুলছেন-
—মেয়ে? ছেলে নয়?–আর্তকণ্ঠে প্রশ্ন করেন সত্যপ্রসন্ন।
—আজ্ঞে হ্যাঁ। কন্যাসন্তান। এবার বলুন, শশীকলা দেবী কি সেই শিশুটিকে নিয়ে যেতে চান এবং দত্তক নিতে চান?
সত্যপ্রসন্ন জানিয়েছিলেন, পুত্র হোক, কনা হোক, সেই শিশুটিকে ওঁরা গ্রহণ করতে ইচ্ছুক। মিস মল্লিক বলেন, আমি সম্মত। কিন্তু আমি তো অছি মাত্র। খুকুর মাকে জিজ্ঞেস করে আপনাকে জানাব। এসব কথা তো চিঠিপত্রে লেখা যায় না। আপনি কি দিন পনেরো পরে আর একবার আসতে পারবেন?
—পারব। অতসী কোথায় আত্মগোপন করে আছে আপনি তাহলে তা জানেন?
–এ প্রশ্ন অবান্তর। আরও একটা কথা। আমি জানি, অতসী অত্যন্ত আর্থিক দুরবস্থায় আছে। বস্তুত সে একটি গৃহস্থবাড়িতে পরিচারিকা হিসেবে কাজ করে। কাপড় কাচে, ঘর ঝাঁট দেয়, এমনকি এঁটো বাসন মাজে। অথচ আমি নিশ্চিত যে, বিপ্লবী দলে নাম না লেখালে এতদিনে সে ইতিহাসে ফার্স্ট ক্লাস অনার্স পেয়ে যেত। হয়তো এম.এ. পড়ত অথবা স্কুলে শিক্ষকতা করত। আপনার জমিদারমশাই কি এক্ষেত্রে—
সত্যপ্রসন্ন বলেছিলেন, চেষ্টা করে দেখব।
শশীকলার আগ্রহার্তিশয্যে জগদীন্দ্রনারায়ণ সমরেন্দ্রর শিশুকন্যাটিকে তাঁর নিজের সংসারে নিয়ে এসেছিলেন। এমন কি পরে তাকে ‘দত্তকও নেন। নাম রাখেন অপরাজিতা।
কৌশিক জানতে চেয়েছিল, কেন? ‘দত্তক নেওয়ার প্রয়োজন কেন হল? ওঁর তো নিজের সন্তানাদি নেই—ওঁরা স্বামী-স্ত্রী গত হলে সমরেন্দ্রর কন্যাই তো সমস্ত সম্পত্তির মালিক হবে।
—নিশ্চিতভাবে সেকথা বলা যায় কি?
প্রথম কথা, জগীন্দ্রনারায়ণ সংবাদটা গোপন রাখতে বাধ্য হয়েছিলেন। আসল তথ্যটা জানতেন ওঁরা স্বামী-স্ত্রী দুজনে, আর সত্যপ্রসন্ন। না, আরও একজন জানে, পরিবারের পুরাতন-ভৃত্য, দশরথ জানা। ওঁরা প্রকাশ করতে চাননি যে, ওই ফুলের মতো বাচ্চা মেয়েটি সমরেন্দ্রর সন্তান। তাতে নানান প্রশ্ন উঠতে পারে। পুলিশের কাছে দেওয়া জগদীন্দ্রের পূর্ববর্তী জবানবন্দি যে মিথ্যা ছিল এটা প্রমাণিত হয়ে যাবার আশঙ্কা আছে। তাঁকে নতুন করে জেরার সম্মুখীন হতে হবে, ভ্রাতুষ্পুত্রীকে তিনি কীভাবে, কোথা থেকে খুঁজে পেলেন। তা থেকে স্বতই প্রশ্ন হবে : খুকীর মা কোথায়? কেন এতদিন সেই ফেরারি আসামীর সন্ধান জগদীন্দ্রনারায়ণ গোপন রেখেছিলেন। দ্বিতীয় কথা, মেয়েটি যে সমরেন্দ্রর আত্মজা এটা প্রমাণ করা অত্যন্ত কঠিন। সে শেঠ রায় বংশের সন্তান এটা প্রতিষ্ঠা করতে হলে সমরেন্দ্রর বিবাহটা যে বৈধ সেটা সর্বাগ্রে প্রমাণ করার প্রয়োজন। সেই কাজটা প্রায় অসম্ভব। ফলে, ভবিষ্যতে লতায়- পাতায় সম্পর্ক ধরে কেউ না কেউ এসে সম্পত্তির দাবিদার হতে পারে। এজন্যই দত্তক নেওয়া।
কৌশিক জানতে চায়, অতসী তাহলে রাজি হয়ে গেল ওই ‘শ্রেণীশত্রু’-র হাতে তার সন্তানকে তুলে দিতে?
বৃদ্ধ এককথায় জবাব দিলেন না। চোখ থেকে চশমাটা খুলে কাচটা মুছতে মুছতে বলেন, আপনি সেই হতভাগিনীর মানসিক যন্ত্রণার কথাটা কাইন্ডলি একবার বিচার করুন, স্যার! হায়ার সেকেন্ডারিতে সে তিনটে ‘লেটার’সহ স্টার মার্কস পেয়েছিল, ইতিহাসে বি. এ.-তে ফার্স্ট পার্টে ফার্স্ট ক্লাস সেকেন্ড হয়েছিল—তারপর আদর্শের জন্য বন্দুক হাতে পুলিশের বিরুদ্ধে পুরুষ বন্ধুদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করেছিল, আহত হয়ে খোঁড়াতে খোঁড়াতে আত্মগোপন করেছিল। তার পরেও সে দেশপ্রেমের ‘অপরাধে’ সমাজে অপাংক্তেয়। ঝি-গিরি করে গ্রাসাচ্ছাদন করছে-
বাধা দিয়ে কৌশিক বলেছিল, ঠিক আছে। বুঝলাম—
সত্যপ্রসন্ন ওকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, আজ্ঞে না স্যার, বোঝেননি। বুঝলে ওই ‘শ্রেণীশত্রু’ শব্দটা ব্যবহার করে অতসীকে ব্যঙ্গ করতেন না। তাই বাকিটুকুও শুনুন। অতসী জানত যে, ওই নিষ্পাপ শিশুটি একটি পিতৃমাতৃহীনা জননীর সন্তানই শুধু নয়, সে এক ঐতিহ্যময় ধনী পরিবারের সন্তানও বটে। তাই সে রাজি হয়েছিল। কিন্তু সে ওই ধনকুবেরের তাচ্ছিল্যভরা আর্থিক দান প্রত্যাখ্যান করেছিল, একথাও সত্য।
—তাচ্ছিল্যভরা দান’ মানে?
—জগদীন্দ্রনারায়ণ ওকে বেশ কিছু টাকা অর্থসাহায্য করতে ইচ্ছাপ্রকাশ করেছিলেন একটি মাত্র শর্তে। যদি ওই পলাতকা মেয়েটি কোনওদিন কারও কাছে স্বীকার না করে যে, জগদীন্দ্রের পালিতা কন্যার জননী সে।
—এমন শর্ত করার মানেটা কী?
—আভিজাত্যের নীলরক্তের অহমিকা হবে হয়তো। আমি ঠিক জানি না। অতসী ধরা পড়লে হয়তো তার ফাঁসিই হয়ে যেত। এক্ষেত্রে অমন শর্ত করার কোনও অর্থই হয় না। তবু তিনি অমন একটা অদ্ভুত শর্ত আরোপ করেছিলেন।
—অতসী তাতে রাজি হয়নি?
—আজ্ঞে না। সেই কথাই তো বলছি। সে ঝি-গিরিই করে গেছে! দেশের শাসকবর্গ নকশালদের খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মেরেছে। ওর সন্ধান পায়নি।
—তারপর? মেয়েটি বেঁচে আছে? ওই অতসী নামের সেই অদ্ভুত মেয়েটি?
—ও প্রশ্নটা আপনি আমাকে করবেন না, স্যার। করব আমি। আপনাকে।
—তার মানে?
—এটাই আপনার ‘অ্যাসাইন্ড ওয়ার্ক’। মানে শশীকলা দেবী এটাই সুকৌশলীকে সন্ধান করে দেখতে বলেছেন।
—কিন্তু কেন? হঠাৎ এতদিন পরে সে খোঁজের কী প্রয়োজন হল? অতসী যখন মাতৃত্ব লাভ করেছিল সেটা তো আপনাদের মতে বিশ-পঁচিশ বছর আগেকার কথা। আজ হঠাৎ…
—তাহলে স্যার, আপনাকে ধৈর্য ধরে আরও কিছুটা অতীত কাহিনী শুনতে হবে।
—উপায় নেই। বলে যান—