দর্পণে প্রতিবিম্বিত কাঁটা – ২

দুই

স্নানপর্ব শেষ হলে মধ্যাহ্নভোজনের টেবিলে প্রসঙ্গটার পুনরবতারণ করল কৌশিক—সেই জগদীন্দ্রনারায়ণের কাহিনীটা

প্রায় বছর-তিনেক আগে সুকৌশলীর অফিসে এসে দেখা করেছিলেন একজন সৌম্যদর্শন বৃদ্ধ। সত্তরের কাছাকাছি বয়স। কোঁচানো ধাক্কাপাড় ধুতি, গিলে-করা আদ্দির পাঞ্জাবি, হাতির দাঁতের সৌখিন মুঠওয়ালা ছড়ি। দেখেই বিশে আন্দাজ করেছিল খদ্দের ‘রহিস’ আদমি।। যত্ন করে তাঁকে বসিয়ে ভিতরে খবর দিয়ে এসেছিল কৌশিককে। আগন্তুকের সাজ-পোশাকের বর্ণনা বিশুর মুখে শুনে সুজাতা বাধ্য করেছিল কৌশিককে গেঞ্জির ওপর পাঞ্জাবিটা গায়ে চড়িয়ে বাইরের ঘরে যেতে। কৌশিক যুক্ত করে ভিতরের দরজা দিয়ে ঢুকতে ঢুকতে দেখল, বিশে ইতিপূর্বেই ফ্যানটা চালিয়ে দিয়ে গেছে।

আগন্তুক উঠে দাঁড়িয়ে যুক্ত করে নমস্কার করলেন।

কৌশিক বলেছিল, বসুন রসুন—নিজেও বসে একটা সোফায়।

আগন্তুক পুনরায় উপবেশন করে বলেন, আপনাদের প্রতিষ্ঠানটার সুনাম শুনেছি। টেলিফোন নম্বরটা জানা ছিল না। তাই বিনা অ্যাপয়েন্টমেন্টেই চলে এসেছি।

কৌশিক কার্ড-হোল্ডার থেকে ওর নামাঙ্কিত একটি ভিজিটিং কার্ড বার করে বাড়িয়ে ধরল। বলল, টেলিফোন ডাইরেক্টরিতেই নম্বরটা পেয়ে যেতেন কিন্তু।

—তা হয়তো পেতাম, তবে ‘শেয়ালদ’ স্টেশনে নেমে আর ডাইনে-বাঁয়ে তাকাইনি। ঠিকানা জানা ছিল—একটা ট্যাক্সি নিয়ে চলেই এসেছি।

—বেশ করেছেন। সকালে আমার কোনও অ্যাপয়েন্টমেন্ট নেই। আপনি সবিস্তারে আপনার কেসটা বলতে পারেন; কিন্তু তার আগে ওই রেজিস্টারে আজকের তারিখে আপনার নাম-ঠিকানা আর টেলিফোন নম্বরটা দয়া করে লিখে দেবেন।

বৃদ্ধ ইতস্তত করে বললেন, আপনি আমাদের শর্তে কেসটা নিলে তা নিশ্চয় লিখে দেব; কিন্তু তার পূর্বে—

—কী আপনার শর্তটা?

—আমাদের কেসটা নিন বা নিন, আমি যা বলব, কথা দিন, তা এই চার দেওয়ালের বাইরে যাবে না?

কৌশিক মাথা নেড়ে বলেছিল, তাহলে দুঃখিত। কথা দিতে পারছি না। আমার জুনিয়র পার্টনার এখন এই চার দেওয়ালের বাইরে আছেন, তাঁকে না-জানিয়ে—

—না, না, সেকথা বলিনি। সুজাতাদেবীকে বলবেন তো নিশ্চয়ই।

কৌশিক বুঝে নেয়, ও নিজে ওই বৃদ্ধের বিষয়ে কিছু না জানলেও আগন্তুক ওদের সম্বন্ধে অনেক কিছু খবর রাখেন। সেকথাই বললে। গোপনীয়তা নিশ্চয়ই রক্ষিত হবে, আপনার পরিচয়টা এবার দিন।

এবার আর আপত্তি করলেন না বৃদ্ধ।

আগন্তুকের নাম : সত্যপ্রসন্ন দুগার। রায়বাহাদুর জগদীন্দ্রনারায়ণ শেঠ রায়-এর সেক্রেটারি। প্রাক্-স্বাধীনতা যুগে ছিলেন জমিদারমশায়ের এস্টেটের দেওয়ান। এখন জমিদারী নেই -সেটা নানান ইন্ডাস্ট্রি এবং বিজনেসে রূপান্তরিত হয়ে গেছে। সেই সূত্রে দেওয়ানজী হয়ে গেছেন সেক্রেটারি।

জগদীন্দ্রনারায়ণ শেঠ-এর আদি নিবাস পাঞ্জাব। প্রায় তিনশো বছর আগে ওঁদের পূর্বপুরুষ সেখান থেকে চলে এসেছিলেন বহরমপুরে, জগৎশেঠের পূর্বপুরুষের সঙ্গে। গঙ্গাতীরে জিয়াগঞ্জের কাছাকাছি একটা ভূখণ্ডে। তারপর আট-দশ পুরুষ ধরে ওঁরা এই বাংলা মুলুকেই আছেন। পুরোপুরি বাঙালী ‘বনে’ গেছেন।

কৌশিক অনুমান করে শেঠজী পুরোপুরি বাঙালী হয়ে গেছেন কি না তা এখনও অজানা, তবে তাঁর সচিব দুগারজী যে হয়নি, তা ওই বাঙালী ‘বনে যাওয়া’ ক্রিয়াপদেই প্রমাণিত।

বেলডাঙা স্টেশন থেকে গঙ্গার তীর বরাবর মাইল-দশেক উত্তরে গেলে পড়বে মোহনপুর গ্রাম। জমিদারের বাড়িটা সেখানেই। বাড়িটা দুর্গের মতো, উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। বয়স প্রায় দেড়-দুশো বছর। পাথর ও তল্লাটে পাওয়া যায় না, তবু বাড়িটা আদ্যন্ত বালিপাথরে চুন- সুরকির গাঁথনিতে গড়া। বোধকরি কোনও পূর্বপুরুষ গঙ্গা-ভাগীরথী দিয়ে নৌকাযোগে রাজমহল অঞ্চল থেকে এই প্রস্তরখণ্ডের আমদানি করেছিলেন। বংশের আদি পুরুষটির প্রকৃত পরিচয় জগদীন্দ্রনারায়ণ জানতেন না, তবে এই গ্রামে জমিদারী পত্তন যিনি করেছিলেন—আন্দাজ করা যায়-তাঁর নাম ছিল মোহনলাল শেঠ। কারণ গ্রামের নাম ‘মোহনপুর’ জমিদারবাড়ির পোশাকি নাম ছিল ‘মোহনমঞ্জিল’। জমিদারের উপাধি শেঠ।

জগদীন্দ্রের পরমপূজ্য পিতৃদেবের ছিল দুইটি বিবাহ। বড় রানীমা জগদীন্দ্রের জননী। তারপর জগদীন্দ্র শেঠের জননী স্বর্গারোহণ করলে জমিদারমশাই তিন কুড়ি বছর অতিক্রম করার পর আর একটি দারপরিগ্রহ করেছিলেন। বৃদ্ধ বয়সে সেই ছোট রানীমার গর্ভে তিনি দ্বিতীয়বার পুত্র সন্তানের জনক হয়ে পড়েন। তখন তাঁর প্রথম পুত্র সন্তান ত্রিশ বছরের যুবাপুরুষ। জগদীন্দ্র শেঠ তার পাঁচ-সাত বছর আগেই একটি সুন্দরীকে বিবাহ করেছিলেন কিন্তু তাঁদের কোনও সন্তানাদি হয়নি। জগদীন্দ্রের যখন পিতৃবিয়োগ হয় তখনও তাঁর কোনও সন্তান জন্মায়নি; দ্বিতীয়বার বিবাহ করা সত্ত্বেও। ফলে বৈমাত্রেয় ভাইকেই তিনি সন্তানসম পালন করতে থাকেন।

জগদীন্দ্রনারায়ণের পিতৃদেব ছিলেন রায়সাহেব। জগদীন্দ্র পিতৃবিয়োগের পূর্বেই রায়বাহাদুর খেতাব পেয়েছিলেন ইংরেজ সরকারের কাছে। নিতান্ত যুবাবয়সে। স্বাধীনতার পর তিনি নতুন সরকারের সঙ্গে তেমন সুবিধা করতে পারেননি। ইংরেজ আমলের ইংরেজি কেতাই ছিল তাঁর মনপসন্দ। নিতান্ত দুর্ভাগ্যের কথা, ওঁর বৈমাত্রেয় ভাইটি হয়ে উঠল দৈত্যকুলে প্রহ্লাদ। পড়াশোনায় সে ভালই ছিল। ডিস্ট্রিক্ট স্কলারশিপ পেয়ে ভর্তি হল প্রেসিডেন্সি কলেজে। থাকত ইডেন হোস্টেলে। বছর দুয়েকের মধ্যে সেখানেই তার স্কন্ধে উপবেশন করল নকশালবাড়ির এক উপদেবতা। রাতারাতি ফেরার হয়ে গেল সমরেন্দ্রনারায়ণ। তিন-চার বছর সে ছিল নিরুদ্দেশ। না পুলিশ, না জগদীন্দ্রনারায়ণ—কেউই তার সন্ধান পায়নি।

তারপর একদিন। থানার বড়-দারোগা জিপে চেপে এসে হাজির হলেন মোহনমঞ্জিলে। সংবাদ গুরুতর : সমরেন্দ্রনারায়ণ গ্রেপ্তার হয়েছে। বিচারের অপেক্ষায় আছে কলকাতার আলিপুর জেলা হাসপাতালে। হাসপাতালে? কেন? কী হয়েছে তার? হ্যাঁ। তাই—সমরেন্দ্র মরণাপন্ন! রায়বাহাদুর ছুটে গেলেন কলকাতায়। সমরেন্দ্রর তখনও জ্ঞান ছিল। পুলিশের সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে সে মর্মান্তিকভাবে আহত। ডাক্তারবাবুরা হাল ছেড়ে দিয়েছেন। ওঁরা দুজনে সম্পর্কে বৈমাত্রেয় ভাই, কিন্তু শ্রদ্ধা-প্রীতি-ভালোবাসার সম্পর্কটা ছিল পিতা-পুত্রের। সমরেন্দ্র তখন চব্বিশ বছরের সুঠামদেহ যুবাপুরুষ, আর রায়বাহাদুর পক্ককেশ পঞ্চাশোর্ধ্ব

গ্রেপ্তার হবার পর সমরেন্দ্র কোনও জবানবন্দি দেয়নি। তার শারীরিক অবস্থায় পুলিশ কোনও ‘থার্ড-ডিগ্রি’র ব্যবস্থা করতে সাহস পাচ্ছিল না। ফলে, দলে আর কে কে ছিল পুলিশ সেকথা জানতে পারেনি। জগদীন্দ্র যখন হাসপাতালে এসে পৌঁছালেন তখন সমরেন্দ্রর শেষাবস্থা। সে একটা ‘ডায়িং স্টেটমেন্ট দেবার ইচ্ছা প্রকাশ করে—তবে কোনও ফার্স্টক্লাস ম্যাজিস্ট্রেটকে নয়, তার দাদাকে। উপায়ান্তরবিহীন হয়ে পুলিশ এবং হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সে ব্যবস্থাতেই রাজি হয়ে যায়।

সমরেন্দ্র তার একজন মাত্র সহযোদ্ধার নাম জানিয়ে যায়, বিশেষ কারণে। বলে, দলে আমরা ছিলাম চারজন। তিনজন পুরুষ, একজন মহিলা। আমিই মারাত্বক আহত হয়ে ধরা পড়ি, ওরা পালিয়ে যেতে পেরেছে।

জগদীন্দ্রনারায়ণ বাধা দিয়ে বলেছিলেন, এসব কথা আমাকে কেন বলছিস, সমু? তুই কী বলে গেলি, কার নাম করলি, পুলিশ তো এখনই আমার কাছে জানতে চাইবে—

সমরেন্দ্রও মাধপথে দাদাকে থামিয়ে দিয়ে বলেছিল, ওসব কথা আমি ভালরকমই জানি দাদা। বিশষ কারণ না থাকলে আমি এ প্রসঙ্গ তোমার কাছে উত্থাপন করতাম না। যা বলছি শোন, শেষ মুহূর্তে যে অনুরোধটুকু করছি তা রেখ—তাহলেই আমি শান্তি পাব। শোন, যেকথা বলছিলাম—দলে, আমরা ছিলাম চারজন, তার মধ্যে একজন ছিল আমার সহপাঠিনী, অতসী। প্রেসিডেন্সি কলেজেরই। তবে আমার ছিল ইকনমিক্সে অনার্স, ওর ইতিহাসে। এনকাউন্টারের সময় অতসীর পায়ে গুলি লাগে, তবু সে পালিয়ে যেতে পেরেছে।

—তুই চাস আমি ওই অতসী নামের মেয়েটার সন্ধান করি? আমি তো সাতে পাঁচে ছিলাম না, সমু। আর এ অবস্থায় আমি তাকে কী সাহায্য করতে পারি? কেনই বা করব?

—কারণ একটাই দাদা। সে তোমার ভ্রাতৃবধূ। আমার স্ত্রী।

দুঃসংবাদটায় মর্মান্তিক আহত হয়েছিলেন জগদীন্দ্রনারায়ণ। সমুর বিয়ের নানান স্বপ্ন দেখতেন তিনি—এখন ওই একটি উটকো বিধবা এসে ঘাড়ে চাপবে। সমস্ত বিরক্তি আর মর্মবেদনা গোপন রেখে তিনি জানতে চেয়েছিলেন, তা কেমন করে হয় রে সমু? তোরা তো পুলিশের নজর এড়িয়ে দু’তিন বছর বনে-জঙ্গলে পালিয়ে বেড়িয়েছিস। বিয়ে তুই করলি কী করে? পুরোহিত ডেকে? হিন্দুমতে?

সমরেন্দ্রর বোধহয় কথা বলতে কষ্ট হচ্ছিল। তবু সে নকশাল। সবরকম দৈহিক ও মানসিক যন্ত্রণা সহ্য করতে প্রস্তুত। বলল, সেসব কথা থাক না দাদা! ধর গান্ধবমতে! যিনি আমাদের দলপতি নামটা নাই বা জানলে, তিনি ওইভাবেই আমাদের বিয়েটা দিয়েছিলেন বাধ্য হয়ে! পুলিশের দৃষ্টি এড়াতে আমরা স্বামী-স্ত্রী হিসেবে একটা বাড়ি ভাড়া নিয়ে বাস করতাম। এত কথা তোমাকে জানাবার ইচ্ছা আমার ছিল না। বাধ্য হয়ে আজ জানাতে হচ্ছে। বিশেষ কারণে। আমার সময় খুব কম। অতসী আহত হয়ে আত্মগোপন করে আছে। জানি না, ইতিমধ্যে গ্যাংরিন হতে শুরু করেছে কি না—

এই পর্যন্ত বলে সে থেমে পড়ে। মৃত্যু-যন্ত্রণায় কাতরাতে থাকে। জগদীন্দ্রনারায়ণ আর স্থির থাকতে পারেননি। বলেন, তুই শান্ত হ সমু। আমার যতটুকু আর্থিক ক্ষমতা….

একটা হাত সামনের দিকে বাড়িয়ে মাঝখানেই তাঁকে থামিয়ে দেয় সমু। বলে, না। সে তোমার আর্থিক সাহায্য ভিক্ষা নেবে না। তার দৃষ্টিতে তুমি ফিউডালিজমের ধারক। শ্রেণীশত্রু! কিন্তু তার পেটে যে বাচ্চাটা আছে, তার কী অপরাধ, দাদা?

জগদীন্দ্রনারায়ণ বজ্রাহত হয়ে গিয়েছিলেন।