দর্পণে প্রতিবিম্বিত কাঁটা – ১৪

চৌদ্দ

পরদিন সকাল নয়টায় ডাইনিং হলে প্রাতরাশে বসেছেন সবাই। ব্রেকফাস্ট টাইম সকাল সাতটায়। কিন্তু সে ছিল রায়বাহাদুরের জমানায়, গতকাল পর্যন্ত। তাছাড়া কাল শয্যাগ্রহণে সকলেরই যথেষ্ট দেরি হয়ে গেছে। গৃহকর্ত্রীর জ্বর হয়েছে, ‘শক্’-এ। সলিল তাই সকাল-সকাল এসে তাঁকে পরীক্ষা করে ব্যবস্থা দিয়েছে। ব্রেকফাস্ট টেবিলে তিনি অনুপস্থিত। বাকি সবাই আছেন : সত্যপ্রসন্ন, সঞ্জয়, ঝরনা, অপরাজিতা, রমলা এবং সলিল। মোহান্তি আর কামালুদ্দীন শুধু অনুপস্থিত। দশরথ আর বামুনঠাকুর খাবার পরিবেশন করে চলেছে।

আহারান্তে বাসু সত্যপ্রসন্নের দিকে ফিরে বললেন, আজ বিকালের কোনও গাড়িতে আমি ফিরে যাব। আপনি কাইন্ডলি গাড়ির ব্যবস্থাটা করে দেবেন। মিসেস শেঠরায়কে আর বিরক্ত করব না। তাঁকে আমার সমবেদনা আর নমস্কার জানাবেন।

সত্যপ্রসন্ন বললেন, আপনি কি হরেনবাবুর সঙ্গে একবার

–হ্যাঁ, হরেনবাবু ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই আসবেন। তাকে আমার ওপিনিয়ন জানিয়ে যাব। আমার মতে, পোস্টমর্টেম হয়তো প্রয়োজন হবে না। আমি আজ খুব ভোরে উঠেছিলাম। তখনও আপনারা কেউ ওঠেননি। শুধু একজন মালি বাগানে কাজ করছিল। আমার মনে যে সংশয় ছিল তা মিটে গেছে।

ডক্টর মিত্র বলে ওঠে, অর্থাৎ আপনি বুঝতে পেরেছেন, রায়বাহাদুর কেন আত্মহত্যা করেছেন?

বাসুসাহেব তার দিকে পূর্ণদৃষ্টিতে তাকিয়ে বলেন, তা আমি বলিনি, ডক্টর মিত্র। আমি বলিনি যে, আমি বুঝতে পেরেছি কেন রায়বাহাদুর আত্মহত্যা করেছেন।

–আমাদের তো মনে হয়েছে সেটাই একমাত্র সমস্যা। তা যদি না হয় তবে কী বলতে চাইছেন আপনি? কী সংশয় ছিল আপনার?

বাসু উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, আমি বলতে চেয়েছি যে, আমি জানি, কীভাবে রায়বাহাদুরের মৃত্যু হয়েছে। এখন নয়টা কুড়ি। আমি ওই স্টাডিরুমে গিয়ে বসছি। ঠিক দশ মিনিট পরে আপনারা সবাই আসুন। আমি কী বুঝেছি তা বুঝিয়ে দিয়ে আমি কলকাতা ফিরে যাব। রায়বাহাদুর আমার ক্লায়েন্ট। কিন্তু তাঁকে এখন ওয়েল, প্লিজ মিট মি অ্যাট নাইন-থার্টি অ্যান্ড ওবে ফর দ্য লাস্ট-টাইম দ্য পাঙ্কুচুয়ালিটি ইম্পোজড বাই দ্য লেট ল্যামেন্টেড আনফরচুনেট পার্সন!

দশ মিনিট পরে।

.

বাসু স্টাডিরুমের চারদিকে তাকিয়ে দেখলেন। দশরথ খানকতক বাড়তি চেয়ার সাজিয়ে রেখেছে। সবাই উন্মুখ হয়ে অপেক্ষা করছে। সত্যপ্রসন্ন, সঞ্জয়, সলিল, ঝরনা, জিতা, রমলা- এমনকি দশরথও কপাটের ওপাশে উৎকর্ণ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অনুপস্থিত শুধুমাত্র অসুস্থা গৃহকর্ত্রী।

এবার অপরাজিতা বলে, আপনি শুরু করুন, মিস্টার বাসু। কী মর্মান্তিক কারণে বাপি আত্মহত্যা করলেন, তা কি আপনি বুঝতে পেরেছেন?

বাসু বললেন, ও-ঘরে একবার বলেছি, আবার বলছি, না! রায়বাহাদুর আদৌ আত্মহত্যা করেননি। ইটস্ আ ডেলিবারেট ফার্স্ট ডিগ্রি কেস অব মার্ডার।

বাসুসাহেবের উচ্চারিত শেষ শব্দটা দু-তিনজনের কণ্ঠে প্রতিধ্বনিত হল! সত্যপ্রসন্ন সামলে নিয়ে বলেন, কী বলছেন, স্যার? ‘মার্ডার’ মানে? ঘর তালাবন্ধ, জানলাগুলো ভিতর থেকে বন্ধ। তাহলে হত্যাকারী ঘর ছেড়ে বার হয়ে গেল কি করে?

সঞ্জয় বলল, ভেন্টিলেটার দিয়ে নয় নিশ্চয়।

বাসু উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, লক্ষ্য করে দেখুন, শার্শিপাল্লায় যে টাওয়ার-বোল্ট বা ছিটকিনি আছে তা সব নিচের দিকে। এই দেখুন, আমি দেখাচ্ছি কীভাবে বন্ধ জানলা দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়া যায়।

কায়দা

তিনি কায়দাটা দেখালেন। শার্শিপাল্লার ছিটকিনিটা আলগাভাবে উঁচু করে রেখে দুটো পাল্লা টেনে বন্ধ করে একটু ঝাঁকালেই নিচেকার ফুটোয় ছিটকিনিটা পড়ে যায়।

বাসু বললেন, এই কায়দায় একজন মানুষ ঘর ছেড়ে জানলা দিয়ে বাইরে গিয়ে ঝাঁকানি দিয়ে ছিটিকিনিটা ফুটোর মধ্যে ফেলে দিতে পারে। তখন মনে হবে, ঘরের ভিতর যে আছে সেই লোকটাই প্রতিটি জানলা ও দরজা বন্ধ করেছে। এই কায়দায় ঘর ছেড়ে একজন বাইরে যেতে পারে; কিন্তু বাইরে থেকে ছিটকিনি-বন্ধ ঘরে সে ঢুকতে পারে না।

রমলা বলে ওঠে, কে, কেন, এ-কাজ করবে?

বাসু তার দিকে ফিরে বলেন, ওটা আমার অঙ্কের শেষ ধাপ ডক্টর স্মিথ। ‘কেন’ এবং ‘কে’। তার আগে দেখতে হবে ‘কী-ভাবে’! প্রথম কথা, হত্যা যে করেছে সে ঘরের লোক, বাইরের নয়। তাকে রায়বাহাদুর বিশ্বাস করেন, স্নেহ করেন। তাই সে নিকট সান্নিধ্য থেকে ওঁকে গুলি করার সুযোগ পায়। হয়তো রায়বাহাদুর তখন কিছু লিখছিলেন, হত্যাকারী তাঁর পাশেই দাঁড়িয়েছিল। নিঃশব্দে টেবিলের ড্রয়ার খুলে রিভলভারটা সে বার করে নেয়। টে- ল্যাম্পের জোরালো আলোয় বাইরের ব্যাপারটা নজর হয়নি রায়বাহাদুরের। হত্যাকারী ওঁর দক্ষিণ কর্ণমূলে গুলি করে। উনি তখন উত্তরমুখী হয়ে টেবিলে বসেছিলেন। গুলিটা ওঁর মস্তিস্ক বিদীর্ণ করে পশ্চিমদিকের খোলা দরজা দিয়ে বাইরে চলে যায়। পিতলের ঘন্টায় প্রতিহত হয়ে করিডোরের দিকে চলে যায়। জানলা তিনটি বন্ধই ছিল। আততায়ী দরজাটা বন্ধ করে চাবিটা রায়বাহাদুরের পকেটে ফেলে দেয়। নিজের ফিঙ্গারপ্রিন্টটা মুছে নিয়ে রিভলভারটায় ওঁর ডান হাতের আঙুলের ছাপ তুলে দেয়। দ্রুত হাতে ‘সরি’ কথাটা ব্লক ক্যাপিটালে লিখে সে চেয়ারটা নব্বই উগ্রি ঘুরিয়ে দেয়। গুলিটা যে খোলা দরজা দিয়ে বেরিয়ে যায়নি, অর্থাৎ গুলি করার আগেই যে দরজা বন্ধ করা হয়েছে, এটা প্রমাণ করতে হত্যাকারী এই কাণ্ডটা করে। নটরাজের মূর্তিটা তুলে নিয়ে আয়নাটায় আঘাত করে চুরমার করে দেয়। তারপর পশ্চিমদিকের জানলার ছিটকিনি খুলে –যে-কায়দা আমি দেখিয়েছি–সেই কায়দায় ঘর ছেড়ে বাইরে লাফিয়ে নামে।

ডক্টর মিত্র বাধা দিয়ে বলে, মাপ করবেন স্যার, আপনি আপ্তবাক্যের মতো ঘটনার বর্ণনা দিয়ে যাচ্ছেন। এর পিছনে কিছু যুক্তি আছে কি?

বাসু নটরাজ মূর্তিটা তুলে এনে দেখালেন তার নিচে একটা ছোট্ট কাচের টুকরো গেঁথে রয়েছে। কাচ নয়, আয়নার একটা ক্ষুদ্র অংশ। বাসু বললেন, বিরুদ্ধ যুক্তি দিয়ে তুমি আমাকে বুঝিয়ে দাও, ডক্টর মিত্র – কীভাবে ওই আয়নার টুকরোটা ব্রোঞ্জমূর্তির তলায় -গায়ে নয়, তলায়, ‘বেস’-এ –আটকে থাকতে পারে। বোঝাও, কী কারণে সুইসাইড করার আগে রায়বাহাদুর নব্বই ডিগ্রি ঘুরে বসেছিলেন।

কেউ কোনও জবাব দেয় না।

বাসু বলেন, আজ খুব ভোরে উঠে বাগানে তল্লাশি করতে গিয়ে আমি দেখেছি, স্টাডিরুমের পুবদিকের জানলার নিচে একজোড়া জুতোর ছাপ। বেশ বোঝা যায়, খোলা জানলা দিয়ে কেউ লাফ দিয়ে নেমেছিল। ওখানে ফুলের ‘বেড’ তাই মাটি ভিজে ছিল। ডানপায়ের জুতোর ছাপটা খুব স্পষ্ট। আমি তার নিখুঁত মাপ নিয়ে এসেছি।

বাসুসাহেব পকেট থেকে একটা ভাঁজ করা কাগজ বার করে টেবিলে রাখলেন। বললেন, নিঃসন্দেহে লেডিজ শ্য। পুরুষ মানুষের জুতোর ‘হিল’ এমন হয় না। ফলে সম্ভাব্য আততায়ীর জেন্ডার নির্ধারিত হল আমাদের অনুসন্ধানের ক্ষেত্রটা অনেক সংকীর্ণ হয়ে গেল।

বাসুসাহেব থামলেন। সকলে এ-ওর মুখের দিকে তাকায়। কেউ কোনও কথা বলে না। বাসুই পুনরায় বলেন, আপনারা জানেন, জুতোর মাপ থেকে পায়ের মাপ নির্ধারণ করা যায়। ক্রিমিনোলজি ও ফরেনসিক রিসার্চ বলে–আট-দশ মিলিমিটারের মধ্যে আন্দাজটা নিখুঁত হয়। আততায়ী যেহেতু বাইরের কেউ নয়, তাই আমাদের বাড়ির ভিতরেই সন্ধানটা করতে হবে। বাড়িতে চারজন মহিলা আছেন, তার ভিতর মিসেস শেঠরায়কে অনারেবল একসেপশন ধরে নিয়ে আমি বাকি তিনজনের পায়ের মাপ নিতে চাই। আপত্তি করার কিছু নেই। ইটস্‌ অ্যান অ্যাকাডেমিক অ্যানালিসিস। পুলিস এসে খুঁজে দেখবে লেডিজ-শ্যুটা কার। আশা করি আপনাদের কারও আপত্তি নেই?

অপরাজিতা রুখে ওঠে, এই অভদ্র অ্যাকাডেমিক এনকোয়্যারি থেকে আপনাকে নিবৃত্ত করা যাবে না, তা আমরা বুঝতে পারছি। তাছাড়া আপনি তো হুমকিও দিয়ে রাখলেন পুলিস এসে সেটা করবেই। সুতরাং আপনি, দেখুন–

বাসু নিঃশব্দে এগিয়ে এলেন। পকেট থেকে ছোট্ট একটা এক মিটারের মেটালিক রোলিং- টেপ বার করে এগিয়ে গেলেন ঝরনার দিকে। ঝরনা স্লিপার থেকে নিঃশব্দে তার ডান পা-টা বার করে দিল। জুতোর সেল্সম্যান যেভাবে মাপ নেয় সেই ভঙ্গিতে হাঁটু গেড়ে বসে পায়ের মাপটা নিয়ে বাসু বললেন, না! ঝরনার পা অনেক বড়। … নেক্সট ডক্টর স্মিথ।

রমলাও বিরক্ত মুখে তার ডান পা-টা বাথরুম স্লিপার থেকে বার করে বাড়িয়ে ধরল। বাসু মাপ দিয়ে বললেন, ডক্টর রমলা স্মিতের পা আবার বেশ কিছুটা ছোট। আউট বাই ফিফটিন এম. এম.। এবার অপরাজিতা এস।

অপরাজিতা উঠে পড়ে। স্যান্ডেল থেকে ডান-পা-টা বার করে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। বাসু মেটালিক টেপটা ওর পায়ের পাশে ধরে দেখলেন। উঠে দাঁড়ালেন। কোন কথা বললেন না। গুটিয়ে নিয়ে মেটালিক টেপটা পকেটে রাখলেন। নিঃশব্দে বসে পড়লেন নিজের চেয়ারে।

অপরাজিতার ভ্রূকুঞ্চন হল। বলে, কী হল? কিছু বলছেন না যে?

–আয়াম সরি, জিতা। মাপটা এবার হুবহু মিলে গেছে!

–সো হোয়াট? গর্জে ওঠে অপরাজিতা।

বাসু ধীরে ধীরে বললেন, রমলা বা ঝরনার ক্ষেত্রে মাপটা মিলে গেলেও আমাদের কিছুটা সন্দেহ থাকত। মোটিভের অভাবে। রায়বাহাদুরের জীবন-মৃত্যুর সঙ্গে ডক্টর স্মিথ অথবা ঝরনার জীবন নিঃসম্পর্কিত! কিন্তু …

বাক্যটা অসমাপ্ত রেখে বাসু থেমে গেলেন। হাসলেন।

ডক্টর সলিল মিত্র এবার গর্জে ওঠে, জিতার ক্ষেত্রেই বা কী মোটিভ দেখতে পেলেন আপনি?

–জিতা ওর বাবার ড্রয়ার ঘেঁটে একটা নতুন উইলের ড্রাফ্‌ট্ দেখতে পেয়েছিল। সে বুঝতে পেরেছিল, ওই উইলটা সই হয়ে গেলে সে সম্পত্তি থেকে সম্পূর্ণ বঞ্চিত হয়ে যাবে। রায়বাহাদুরের এস্টেটের মালিক হয়ে যাবে সঞ্জয় দুগার। এত বড় সম্পত্তির লোভটা সে …

সত্যপ্রসন্ন বলে ওঠেন, মানে? এ কথার কী অর্থ? সঞ্জয় কীভাবে…

— অপরাজিতাকে জিজ্ঞাসা করুন। সে জানে।

অপরাজিতা গর্জে ওঠে, ইটস্ আ লাই! এ ড্যামনেড লাই!

বাসু ম্লান হেসে বললেন, হত্যার পরিকল্পনাটা তুমি যেভাবে ছকেছিলে জিতা তা নিখুঁত। রায়বাহাদুর ঘটনাচক্রে আমাকে টেলিগ্রাম না করলে পুলিস মেনে নিত, এটা আত্মহত্যা! তোমাকে ধরতে পারত না।

অপরাজিতা আবার গর্জে ওঠে, আপনি… আপনি একটা বদ্ধ উন্মাদ!

বাসু বলেন, আজ এখানে নিজের বাড়ির বৈঠকখানায় তুমি ও কথা বলতে পার। এটা আদালত নয়, তুমি আসামীর কাঠগোড়ায় দাঁড়িয়ে নেই। কিন্তু শেষের সেদিন ভয়ঙ্করের কথাটা ভেবে দেখ, জিতা। অনারে জাস্টিস যখন রায় দেবেন, “শি শ্যাল বি হ্যাংগড বাই দ্য নেক, আনটিল…

–না!! থামুন আপনি!

বাসুসাহেব চমকে এ-পাশে ফিরলেন।

কথাটা বলেছেন ডক্টর মিস রমলা স্মিথ। সেই অ্যাংলো ইন্ডিয়ান মহিলাটি! উত্তেজনায় তিনি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছেন। তাঁর সমস্ত শরীর থরথর করে কাঁপছে।

বাসু বললেন, জিতার ফাঁসি হবেই! ডেলিবারেট মার্ডার! সমস্ত এভিডেন্স তার বিরুদ্ধে। একমাত্র তারই ‘মোটিভ’ আছে। রায়বাহাদুরের মৃত্যুতে একমাত্র সেই লাভবান হচ্ছে। তাছাড়া জুতোর মাপ…

–হ্যাং ইয়োর জুতোর মাপ! … আমি অকাট্য প্রমাণ দেব, খুকু এ-কাজ করেনি, করতে পারে না।

–কী প্রমাণ? জানতে চাইলেন বাসু।

–আই কনফেস! হ্যাঁ, স্বীকার করছি। আমি … আমিই রায়বাহাদুরকে হত্যা করেছি। ঠিক যেভাবে আপনি বলেছেন সেইভাবে।

অপরাজিতা আবার গর্জে ওঠে, সে কী? কিন্তু কেন? কেন এই জঘন্য অপরাধটা করলেন, মাসিমা?

ডক্টর রমলা স্মিথ দুহাতে নিজের মুখটা ঢাকলেন।

বাসু এবার এগিয়ে এসে বললেন, লেডিজ অ্যান্ড জেন্টলমেন! প্লিজ লিভ আস অ্যালোন! ডক্টর মিস রমলা স্মিথের পাহারায় আমিই তো আছি। সঞ্জয়, তুমি থানায় একটা ফোন করে দাও। হরেন্দ্রবাবুকে এখনি চলে আসতে বল। ইম্মিডিয়েটলি!

একে একে সবাই ঘর ছেড়ে বার হয়ে গেলেন। নিঃশব্দে। মাথা নিচু করে। শুধু অপরাজিতা দরজার কাছে একবার ফিরে দাঁড়ালো। সেখান থেকে চাপা গলায় ভর্ৎসনা করে উঠল, ছিঃ! ছিঃ মাসিমা! আপনি … আপনি কেন এ-জঘন্য কাজটা করলেন? বাপি আপনার কী ক্ষতি করেছিল?

বাসু এগিয়ে এসে ওর হাতটা ধরলেন। দরজার বাইরে পৌঁছে দিলেন। দেখলেন, সেখানে পাথরের মূর্তির মতো স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে পুরাতন ভৃত্য দশরথ জানা।

বাসু ফিরে এসে বললেন, বস রমলা! আয়াম সরি।

রমলা হাসলেন। হাত দুটি সরালেন মুখ থেকে। তাঁর চোখে জলের দুটি ধারা। বললেন, আপনি ….আপনি বোধহয় ইচ্ছে করেই ভুল করছিলেন। আমাকে উত্তেজিত করে নিজমুখে কনফেস করানোর জন্য ডেলিবারেটলি ওভাবে খুকুকে আক্রমণ করেছিলেন। তাই নয়?

বাসু নতনেত্রে বললেন, আয়াম সরি, রমলা!

–কিন্তু কী করে চিনলেন আমাকে?

–সন্দেহ আমার প্রথম থেকেই হয়েছিল, যখন তুমি জিতাকে ‘খুকু’ বলে ডাকতে শুরু করেছিলে। কিন্তু আমার আগেই তোমাকে চিনতে পেরেছিল আর একজন। ওই দরজার বাইরে যে পাহারায় আছে—দশরথ জানা! হয়তো বুঝতে পেরেও সে সাহস করে কাউকে কিছু বলতে পারেনি। শুধু আমাকে বলেছিল, তোমার ডান পায়ে বাত, তুমি একটু খুঁড়িয়ে চল! দশরথ!

দশরথ এগিয়ে এল ঘরের ভিতর।

বাসু রমলার দিকে ফিরে বললেন, তোমার এখন একটা স্টিমুলেন্ট দরকার। কী খাবে বল? জিন উইথ লাইম? না গরম দুধ?

ডক্টর স্মিথ দশরথের দিকে ফিরে বললেন, একগ্লাস ঠান্ডা জল, দশরথ!

–যে আজ্ঞে! —মাথা নেড়ে নিঃশব্দে চলে গেল দশরথ।

বাসু বললেন, সমস্ত সন্দেহের অবসান হল তোমার ডান পায়ের গোড়ালিটা দেখে। পায়ের মাপ নেবার অছিলায় আমি তোমায় ডান পায়ের গোড়ালিটা পরীক্ষা করলাম। বিশ- পঁচিশ বছরেও বুলেট-উন্ডের দাগটা মিলিয়ে যায়নি।

— ওঁর ড্রয়ার ঘেঁটে উইলটা দেখেই আমার মাথায় আগুন ধরে গেছিল। আপনি জানেন না, লোকটাকে আমি আজও চারুদার ডেফিনিশন অনুযায়ী শ্রেণীশত্রুরূপে দেখি। খুকুকে সে গ্রহণ করেছিল, কিন্তু খুকুর মাকে অপমান করতে তার বাধেনি। আমি বুঝতে পেরেছিলাম খুকু ডাক্তার মিত্রকে ভালবাসে। কামালকে সে যে প্রশ্রয় দেয় সেটা লোকদেখানো। আমার আরও মনে হয়েছিল, খুকু ইচ্ছে করেই কামালের সঙ্গে বেশি মাখামাখি করে, যাতে কামালের বদলে ডক্টর মিত্রকে বিয়ে করে বসলে ওর বাবার স্বস্তির নিঃশ্বাস পড়বে। কিন্তু ওই মেগালোম্যানিয়াক বুড়োটা তা হতে দেবে না। সে জোর করে খুকুর সঙ্গে সঞ্জয়ের বিয়ে দেবে। উইলটা সই হয়ে গেলে খুকুর আর বাঁচবার কোনও পথ থাকবে না।

— কিন্তু তুমি কি বুঝতে পারনি এভাবে উইল করলে সেটা আদালতে টিকবে না। খুকুকে স্বেচ্ছায় দত্তক নিয়েছিলেন। তার ফান্ডামেন্টাল রাইটস্ কেড়ে নিয়ে তাকে ওভাবে সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করা যায় না।

–এখন সেকথা বুঝছি। তখন আমি বুঝিনি।

বাসু বললেন, বুলেটটাকে তুমি করিডোরে দেখতে পেয়েছিলে, তাই না? যখন আমরা স্টাডিরুমের দিকে যাচ্ছি, তখন?

— ইয়েস। চাবিটা ইচ্ছে করে হাত থেকে ফেলে দিয়ে চাবির সঙ্গে বুলেটটা কুড়িয়ে নিই কপাটটা ভেঙে ফেলার পর সবাই যখন দু-পাঁচ সেকেন্ডের জন্য বিহ্বল হয়ে পড়ে তখন সাবধানে সীসার গোলকটা স্টাডিরুমের মেঝেতে গড়িয়ে দিয়েছিলাম।

–আর সময়টা গুলিয়ে দেবার জন্য কাগজের ঠোঙাটা ফুঁ দিয়ে ফুলিয়ে ফাটিয়েছিলে?

–হ্যাঁ! গুলিটা করেছিলাম সাড়ে সাতটায়। কিন্তু আমার শাড়িতে কিছু রক্তের দাগ লেগে যায়। তাই ঘরে গিয়ে শাড়িটা বদলে স্নান করে ফিরে আসি। ঠোঙাটা ফাটাই বৈঠকখানায় ঢোকবার মিনিটখানেক আগে। সবচেয়ে দুঃখের কথা, আমি বুঝতে পারছিলাম যে, জুতোর মাপের গল্পটা আপনার একেবারে আষাঢ়ে গল্প— কারণ তখন আমার পায়ে ছিল স্লিপার তার হিল নেই; আর আমি ওই জানলা দিয়ে আদৌ লাফ দিয়ে ফ্লাওয়ার বেডে নামিনি। আমি ঘর থেকে বার হয়েছিলাম দক্ষিণ দিকের একটা জানলা দিয়ে। সেদিকে ফ্লাওয়ার বেড নেই। কংক্রিটের পাথওয়ে। তাই বেশ বুঝতে পারছিলাম যে, জুতোর মাপের আষাঢ়ে গল্পটা আপনি বানিয়ে বলছিলেন। আরও বুঝতে পারছিলাম, আপনি আমাকে কিছুতেই চিহ্নিত করতে পারবেন না। আমার কথা কেউ জানে না, কেউ আমাকে সন্দেহ করবে না। আমার কোনও মোটিভ কেউ খুঁজে পাবে না। কিন্তু আপনি যেভাবে অজগরের মতো পাকে পাকে খুকুকে জড়িয়ে ফেলেছিলেন, তাতে আমি প্রচণ্ড উত্তেজিত হয়ে উঠেছিলাম। খুকুর মোটিভটা প্রতিষ্ঠা করা যাবে। আমার মনে হল, আপনারা পাকেচক্রে খুকুকেই ফাঁসির দড়ি থেকে ঝোলাবেন। ‘তাই আমি … মানে, নিরুপায় হয়ে মানে, আপনি যখন ড্রামাটিক্যালি বলতে শুরু করলেন, শি শ্যাল বি হ্যাংগড় বাই দ্য নেক …

বাসু বললেন, নামটাকে ছেঁটে ফেলেছ, চুলগুলো ছেঁটে ফেলেছ, ধর্মটাকেও ছেঁটে ফেলে ক্রিশ্চিয়ান হয়েছ, তবু আমার বিশ্বাস ছিল মাতৃস্নেহটাকে ওভাবে ছেঁটে ফেলা যায় না। তোমার স্বীকারোক্তি আদায় করতেই আমি অতি-নাটকীয়তার আশ্রয় নিয়েছিলাম। আয়াম সরি

–য়ু নিডন্ট বি, স্যার! একটা কথা শুনে রাখুন, পুলিস এনকাউন্টারে মরিনি, ফাঁসির দড়ি থেকেও এই বুর্জোয়া সরকার আমাকে ঝোলাতে পারবে না। আই থ্রো অ্যা চ্যালেঞ্জ টু য়ু অল—

বাসু শান্তকণ্ঠে বললেন, কিসের জোরে, এতবড় কথাটা আমাকে বলছ, অতসী? কে তোমাকে মুক্ত করে দেবে? ফাঁসির দড়ি থেকে বাঁচাবে? কে? কোথায় তিনি?

সিলিং-এর দিকে তর্জনী নির্দেশ করে অতসী বললেন, হি ইজ আপ দেয়ার, স্যার! আমি মুক্তি পাব করুণাময়ের অপার করুণায়। আমি লিউকেমিয়ার রুগী। আমার মেয়াদ আর চার- ছয় মাস। বিচারের প্রহসন শেষ হবার আগে আমি পৌঁছে যাব সমরের কাছে। জীবনের শেষ কয়েকটা সপ্তাহ মেয়ের কাছে কাছে কাটাব বলেই খুকুর কাছে চলে এসেছিলাম।

বাসু এগিয়ে এসে ডক্টর স্মিথের দুই বাহুমূল দুহাতে দৃঢ়মুষ্টিতে ধরে বললেন, গড ব্লেস য়ু, মাই চাইল্ড!

–একটা অনুরোধ করব, স্যার? রাখবেন?

–বলো, অতসী। আমি আজ দাতাকর্ণ!

–খুকু যেন কোনদিন জানতে না পারে–কেন তার মাসিমা ওই জঘন্য অপরাধটা করেছিল। না হলে বেচারি সারাটা জীবন অনুশোচনায় দগ্ধে দন্ধে মরবে।

বাসু বলেন, আমেন!