দর্পণে প্রতিবিম্বিত কাঁটা – ১৩

তেরো

হরেন্দ্রনাথ বললেন, যাক বাবা! রাত পোহাবার আগেই আপনার সমস্যার সমাধানটা হয়ে গেল। অর্থাৎ কেন সাবেক উকিলকে ছেড়ে রায়বাহাদুর ‘ব্যারিস্টারকে তলব করেছিলেন। তাছাড়া আমরা এতক্ষণে বুঝতে পেরেছি মাসখানেক ধরে কোন্ দুশ্চিন্তা বৃদ্ধকে খোঁচাচ্ছিল। ওই এম. এল. এ. সাহেবের ধনুর্ধর পুত্রটি।

বাসু জানতে চান, ‘ধনুর্ধর পুত্র’ বলছেন কেন?

— ছেলেটি কী করে জানেন?

–শুনলাম তো : থিয়েটার করে।

–হ্যাঁ, কিন্তু যখন থিয়েটার করে না, তখন?

–তখন?

–‘পাইয়ে দেবার দালালি’ করে। এম্লে-সাহেবের এজেন্ট-হিসাবে। বাসপারমিটই হোক, অথবা চাকরি। নায্য উপরওয়ালাকে সুপরাসিড করে প্রমোশনই হোক অথবা লোয়েস্ট টেন্ডারকে টপকে ঠিকাদারী। তবে আপনি যেন কাউকে বলে বসবেন না, আমি এসব কথা বলেছি। মোটকথা রায়বাহাদুরের আত্মহত্যা করার কারণটা এতক্ষণে পরিষ্কার বোঝা গেল। আশাকরি এখন আর আত্মহত্যার ব্যাপারে আপনার কোনও সন্দেহ নেই?

বাসু বিরক্ত হয়ে বলেন, কিসের আত্মহত্যা মশাই? অমন মানুষ কখনো আত্মহত্যা করতে পারে?

–পারে না? হাতের কাছে লোডেড রিভলভার থাকলেও?

–না, পারে না। সাইকোলজিক্যালি পারে না। আত্মহত্যা করে দু-জাতের মানুষ। এক, যাদের মনের জোর কম! বাইরের আঘাতে যারা সহজেই ভেঙে পড়ে। হার মেনে নেয়। নাইন্টি-নাইন পার্সেন্ট সুইসাইডাল কেসের সেটাই হচ্ছে মূল হেতু। বাকি এক পার্সেন্টের মনের জোর অসম্ভব দৃঢ়। তারা হার মেনে নিয়ে আত্মহত্যা করে না! ওই যে অলক্ষ্য নাট্যকার আমাদের সামনে সমাধানের অতীত সমস্যা ফেলে দিয়ে বলেন না, ‘এবার?” তখন সেই মৃত্যুঞ্জয়ী মানুষ মৃত্যুকে জয় করতেই আত্মহত্যা করে!

হরেন্দ্র দত্ত আপ্রাণ চেষ্টা করল। চোখ পিটপিট করল, কান চুলকালো। তবু বুঝতে পারল না। বলল, দু একটা উদাহরণ যদি দিতেন, স্যার?

–যেমন প্রীতিলতা ওয়েদ্দদার, যেমন যতীন দাশ, যেমন মাতঙ্গিনী হাজরা!

–মাতঙ্গিনী হাজরা আত্মহত্যা করেছিলেন, স্যার?

–হ্যাঁ, যদিও আগ্নেয়াস্ত্রটা ছিল পুলিসের হাতে। রায়বাহাদুরের সামনে তেমন কোনও অবস্থার কথা আমরা জানি না। তাছাড়া ভেবে দেখ, হরেনবাবু— এর কি যৌক্তিকতা? ধর আমি রায়বাহাদুর এই চেয়ারে বসে আছি।

বাসু রায়বাহাদুরের চেয়ারে বসলেন।

–যে কোনও কারণেই হোক, আমি সিদ্ধান্ত নিলাম : আত্মহত্যা করব। আমি উঠে সব কটা জানলা ভেতর থেকে ছিটকিনি বন্ধ করলাম। দরজাটা বন্ধ করে, চাবিটা পকেটে রেখে টেবিলের সামনে চেয়ারে এসে বসলাম। ‘আত্মজীবনীর’ পাতায় লিখলাম ‘সরি’। আমি নিশ্চয় তখন উত্তরমুখী। তারপর? ড্রয়ার থেকে রিভলভার বার করলাম। সেটা যদি লোডেড না থাকে তা লোড করলাম। তারপর? তারপর আমি কী করলাম?

–নিজের কানে রিভলভারটা লাগিয়ে ফায়ার করলেন।

–নো স্যার। অ্যান এম্‌ফ্যাটিক : নো! এরপর আমি চেয়ারটা ঘুরিয়ে পশ্চিমমুখী হলাম! কেন? কী কারণে আমি পশ্চিমমুখী হলাম? বলো? ঘরের পশ্চিম দিকের দেওয়ালে যদি কোনও প্রিয় মানুষের ফটো থাকত শশীকলার, ওঁর বাবার, কোনও ইষ্টদেবতার, মায়ের তাহলে এ-আচরণের একটা মানে থাকত। তা নেই! উনি মুসলমান নন, যে মক্কার দিকে মুখ করে আত্মহত্যা করবেন। তাহলে?

— সুতরাং?

–সুতরাং বাকি কয়জনের জবানবন্দি আমাদের নিতেই হবে। দশরথ, সঞ্জয়, ঝরনা, অপরাজিতা….

সঞ্জয় দুগার স্বীকার করল – রায়বাহাদুর তাকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন। অনেক কাজ স্ত্রী বা একান্তসচিবকে না জানিয়ে তিনি সঞ্জয়ের মাধ্যমে করতেন। যেমন, কলকাতা থেকে স্কচ হুইস্কি কিনে আনা। ডাক্তার-নির্দিষ্ট সীমা অতিক্রম করে স্টাডিরুমে রুদ্ধদ্বার কক্ষে তিনি ওইভাবে মদ্যপান করতেন। সঞ্জয় যোগান দিত – স্ন্যা, বরফ। স্ত্রীকে তো বটেই, এমনকি দশরথকেও লুকিয়ে। তবে রায়বাহাদুর যে কেন আত্মহত্যা করলেন তা সে জানে না। কোনও আন্দাজ করতে পারে না। শশীকলা অপরাজিতার গর্ভধারিণী না বিমাতা এ-প্রশ্নের জবাবে সে সপ্রতিভভাবে জানালো, বড়জ্যেঠিমা মারা যাবার অনেক পরে খুকু জন্মায় বেনারসে।

ঝরনার পরিচয় দিতে একটু লজ্জা পেল যেন। হ্যাঁ, ঝরনা ওর কলেজের বান্ধবী। সহপাঠিনী নয়, দু-ক্লাস নিচে পড়ত। ওরা পরস্পরকে বিবাহ করতে ইচ্ছুক। সত্যপ্রসন্নর আপত্তি নেই। তবে রায়বাহাদুরকে ব্যাপারটা জানানো হয়নি।

ঝরনাও স্বীকার করল তার জবানবন্দিতে যে, একটা বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে সে মোহনপুরে এসেছে। সঞ্জয়ের সঙ্গে বিবাহ হলে এই বিরাট বাড়ির কোনও একটা অংশই তার শ্বশুরবাড়ি হবে। রায়বাহাদুরের আত্মহত্যার হেতুর বিষয়ে তার কোনও আন্দাজ নেই।

দশরথ স্বীকার করল : বড়কর্তার আত্মহত্যার ব্যাপারটা নিতান্ত অস্বাভাবিক বলে তার মনে হয়েছে। বড়কর্তাকে সে শেষবারের মতো দেখেছে সন্ধ্যে সাড়ে ছয়টা-সাতটা নাগাদ রমলা দেবীর সঙ্গে বসে তিনি কথাবার্তা বলছিলেন। সেই কী একটা বই লেখার ব্যাপারে। রমলা প্রতিদিনই এই সময় এসে দেড়-দুধন্টা কাটিয়ে যান। দশরথ রোজই সেই সময় এক পেয়ালা চা আর বিস্কুট দিয়ে যায় রমলাকে। কাপ-ডিশ উঠিয়েও নিয়ে গিয়েছিল আন্দাজ সাতটা নাগাদ।

হরেন্দ্রনাথ জানতে চান, তখন তুমি কী দেখেছিলে মনে করতে পার? ঘরের তিনটে জানলাই কি বন্ধ ছিল?

–আজ্ঞে হ্যাঁ। না হলে সন্ধ্যার ঝাঁকে বড় মশার উপদ্রব হয়।

বাসু জানতে চান, দেখ দশরথ আমরা আপ্রাণ চেষ্টা করছি বুঝে নিতে যে, কেন রায়বাহাদুর এভাবে আত্মহত্যা করলেন। তাই তোমার সাহায্য চাইছি। তুমি যা জান তা আমাদের ঠিক ঠিক জানাও দেখি। প্রথম কথা, জিতাদিদি কি জানে তার গর্ভধারিণী মায়ের নাম? তুমি যে তা জান, তা আমি জানি।

দশরথ বুদ্ধিমান। সে নতনেত্রে বলে, দিদিমণিও তা জানে।

–তার গর্ভধারিণী মা কীভাবে মারা যান, সেটাও কি জিতা জানে?

দশরথ এবার চোখ তুলে তাকায়। বলে, আজ্ঞে সেটা আমি নিজেই জানি না, হুজুর। দিদিমণি জানে কি না তাও জানি না।

—তুমি কিছু আন্দাজ করতে পারছ? কী কারণে রায়বাহাদুর এভাবে আত্মহত্যা করলেন?

আবার দশরথ নতনয়ন হল। দুদিকে মাথা নেড়ে জানালো সে কোনরকম আন্দাজ করতে পারে না।

হরেন্দ্র বললেন, তুমি তাহলে যেতে পার।

বাসু বললেন, দাঁড়াও, তুমি বহুদিনের মানুষ। কতদিন এ-বাড়িতে কাজ করছ, দশরথ?

–তা চল্লিশ বছর হবে, হুজুর। জিতাদিদিকে আমিই কোলে-পিঠে করে মানুষ করেছি।

–সেক্ষেত্রে তুমি নিজে থেকে কি কিছুই বলতে পার না?

দশরথ আবার বাসুসাহেবের চোখে-চোখে তাকালো। বলল, একটা কথা, ওই যে মেমসাহেব বড়কর্তার জীবন-বেত্তান্ত লিখছেন, ওঁর ডান পায়ে বাত আছে। উনি একটু খুঁড়িয়ে হাঁটেন।

হরেন্দ্রনাথ ধমকে ওঠেন, এটা কী এমন জরুরী কথা? তোমার মাথায় গোবর!

–আজ্ঞে হ্যাঁ, না, মানে এই কথার কথা বলছিলাম আর কি।

দশরথ পালাবার পথ পায় না।

.

শেষ জবানবন্দি দিতে এল জিতা। অপরাজিতা।

সকলের মতো সেও স্বীকার করল, কেন যে রায়বাহাদুর এভাবে আত্মহত্যা করলেন সেটা ওর আন্দাজের বাইরে। বাসু জানতে চান, তুমি কি জান, রায়বাহাদুরের উইলে কী প্রভিশন্স আছে?

–হ্যাঁ, জানি। বাপিই আমাকে নিজে থেকে বলেছিল.

— তুমি যে শশীকলা দেবীর কন্যা নও, দত্তক কন্যা, একথা তুমি কত বয়সে জানতে পার? কে জানায়?

–বোঝবার মতো বয়স যখন হল তখন মা-ই আমাকে বলেছিল। আর কাউকে বলতে বারণ করেছিল। বলেছিল কথাটা মাত্র চারজন জানে। বাপি, মা, কাকামণি আর দশরথদা ছাড়া আর কেই জানে না। এমন কি সঞ্জয়দাও জানে না।

–তাহলে মায়ের বারণ না শুনে তুমি সেকথা ডাক্তার সলিল মিত্রকে বলে দিলে কেন?

–কে বলেছে? সলিল?

–কে বলেছে সেটা বড় কথা নয়। তুমি কি অস্বীকার করতে চাও?

–না, চাই না। আমি তাকে বলেছি। ডাক্তারের কাছে কিছু গোপন করতে নেই বলে।

–তুমি কি জান, রায়বাহাদুর একটা নতুন উইল করতে যাচ্ছিলেন?

–না, জানি না। বাপি বা মা আমাকে কিছু বলেনি।

–তোমার মা সেকথা জানেন না। সেই উইলটা সই হয়নি। হলে, তাতে প্রভিশন থাকত যে, তুমি সম্পত্তির অধিকারী হবে একটা বিশেষ শর্ত মানলে। যদি তুমি সঞ্জয় দুগারকে বিবাহ কর!

অপরাজিতা দশ সেকেন্ড নির্বাক তাকিয়ে থাকল। বলল, বাপি ছিল বদ্ধ পাগল। দিন পনের আগে মা আমাকে ওই কথা বলে। আমি মাকে বলেছিলাম যে, সঞ্জয়দা আর আমি খুড়তুতো জ্যাঠতুতো ভাইবোনের মতো মানুষ হয়েছি। ছেলেবেলা থেকে। আমরা দুজনেই দুজনকে ভালবাসি, কিন্তু ভাইবোনের মতো। তাছাড়া সঞ্জয়দা তো স্থির করে রেখেছে ঝরনাদিকে বিয়ে করবে বলে…

–সঞ্জয় কি রায়বাহাদুরকে জানিয়েছিল যে, সে ঝরনাকে বিয়ে করতে চায়?

–না জানায়নি। সাহস পাচ্ছিল না। আমাকে অন্তত ঝরনাদি তাই বলেছে।

বাসু জানতে চান একটা কথা জিজ্ঞেস করি জিতা–প্রশ্নটা একটু ডেলিকেট— তুমি কিছু মনে কর না–

অপরাজিতা বলে, আপনি খোলা মনে যা ইচ্ছে প্রশ্ন করতে পারেন, স্যার। আমি অফেন্স নেব না। অশোভন প্রশ্ন মনে করলে জবাব দেব না। কী জানতে চান?

–তোমার পক্ষে স্টেজে অভিনয় করাটায় কি রায়বাহাদুরের আপত্তি ছিল?

–ও এই কথা! হ্যাঁ ছিল। বাপির আশঙ্কা ছিল আমি ওই কামালদাকে বিয়ে করে বসব। বাপি গোঁড়া হিন্দু। অসবর্ণ বিয়ে কিছুতেই মেনে নিত না।

বাসু বললেন, তর্কের খাতিরে যদি ধরে নিই যে তোমার বাবা একটা উইল করে গেলেন যে, তুমি সঞ্জয় দুগারকে বিয়ে না করলে সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হবে সেক্ষেত্রে তুমি কী করতে? সঞ্জয়কে বিয়ে করতে? না, সম্পত্তিটা ত্যাগ করতে?

অপরাজিতা উঠে দাঁড়ালো। বলল, জাস্ট আ মিনিট, স্যার। আমি এখনি আসছি।

গটগট করে সে ঘরে ছেড়ে বেরিয়ে গেল। দশ-পনের সেকেন্ড পরে ফিরে এল ডাক্তার সলিল মিত্রের হাত দৃঢ়ভাবে ধরে। বললে, এই নিন, স্যার, আমার জবাব। দিস্ ইজ মাই হাজব্যান্ড, ডক্টর এস. মিত্র। আমরা দিন পনের আগে কলকাতায় গিয়ে রেজিস্ট্রি ম্যারেজ করেছি। খবরটা মোহনপুরের কেউ জানে না, এই যা।

ডক্টর মিত্র অবাক হয়ে বলে, কী ব্যাপার? এমন নাটকীয়ভাবে …

বাসু বললেন, আই কংগ্র্যাচুলেট য়ু। ডক্টর মৈত্র, আই মীন মিত্র!

ডক্টর মিত্র বলেন, তা তো করছেন; কিন্তু হঠাৎ এমন নাটকীয়ভাবে কথাটা জিতা ঘোষণা করল কেন?

বাসু জবাব দেবার আগেই অপরাজিতা বলল, তোমাকে পরে আমি বুঝিয়ে বলব। এখন তুমি যাও। আমার জবানবন্দিটা এখনো শেষ হয়নি। তাই নয়, বাসুসাহেব? কিন্তু এত জবানবন্দি নেওয়ার প্রয়োজন হচ্ছে কেন বলুন তো?

বাসু বললেন, আমরা স্থির-নিশ্চয় হতে চাই : এটা একটা আত্মহত্যার কেস!

–স্থির-নিশ্চয় হওয়ার কী আছে? ঘরটা ভিতর থেকে তালাবন্ধ। সমস্ত জানলা ভিতর থেকে ছিটকিনি বন্ধ। রিভলভারটা বাপির। চাবিটা পাওয়া গেল তার পকেট থেকে। এ-ক্ষেত্রে এটা যে আত্মহত্যার কেস তাতে সন্দেহ থাকবে কেন?

বাসু বললেন, দুটো বিষয়ে আমরা স্থির-নিশ্চয় হতে চাই। প্রথম কথা, কেন তিনি আত্মহত্যা করলেন। দ্বিতীয় কথা কেন তিনি আমাকে টেলিগ্রাম করে ডেকে পাঠিয়েছিলেন।

একটু ইতস্তত করে অপরাজিতা বললে, হয়তো আমার বোকামিতে! কিন্তু আমি দুঃস্বপ্নেও ভাবিনি যে, বাপি এমন একটা ড্রাটিক স্টেপ নিয়ে বসবে। আঘাত করলে সে চিরদিন প্রত্যাঘাতই করেছে তো। এভাবে সে যে হার মেনে নিতে পারে, তা ছিল আমার দুঃস্বপ্নের অগোচর!

–তোমার কী ‘বোকামি’-র কথা বলছ, জিতা?

অপরাজিতা কিছুক্ষণ নতনেত্রে কী যেন চিন্তা করল। তারপর বলল, আগেই বলেছি, বাপির ইচ্ছে ছিল যে, সঞ্জয়দার সঙ্গে আমার বিয়ে হয়। কিন্তু আমাদের দুজনের কেউ তা চাইছিলাম না। সঞ্জয়দা ঝরনাদিকে পছন্দ করে রেখেছে; সাহস করে বাপিকে বলতে পারছে না। এদিকে আমি…

বাসু বলেন, এখন আর লজ্জা করার কী আছে, জিতা? এখন তো তোমরা স্বামী-স্ত্রী।

–আমি ইচ্ছে করেই কামালদার সঙ্গে বাড়াবাড়িরকম মেলামেশা করেছিলাম। আমি জানতাম, সলিলকেও বাপি মেনে নিতে চাইবে না; কিন্তু কামালদার বিকল্প হিসাবে বাপি সলিলকে মেনে নেবে–

হরেনবাবু বলে, তা ঠিক। রায়বাহাদুর ছিলেন কট্টর হিন্দু! তুমি কামালকে বিয়ে করতে চাইছ বলেই তিনি ব্যারিস্টারসাহেবের সাহায্য চেয়েছিলেন। বাসুসাহেব যদি বলতেন ‘কামাল নয়, সলিল’

তাহলে ‘এনি পোর্ট ইন দ্য স্টর্ম’ আইনে উনি এককথায় তা মেনে নিতেন। বাসু বললেন, কিন্তু তা তো হল না, হরেনবাবু! তার আগেই কেন উনি এমন অবিমৃষ্যকারীর মতো…

অপরাজিতা বললে, নিয়তি। মৃত্যু বাপিকে টানছিল! তাই অগ্রপশ্চাৎ বিচার না করে সে নিজের রিভলভারে নিজেকে … স্যাড কেস …

হরেন্দ্রনাথ বলে, ভেরি-ভেরি-স্যাড!

ঘর খালি হলে হরেন্দ্রনাথ বললেন, একটা কথা বলব, স্যার?

–বলো।

–আজ রাতের মতো ‘ক্ষ্যামা’ দেওয়া যায় না? আমরা তো অনেক অনেক তথ্য আবিষ্কার করেছি। কেন রায়বাহাদুর আপনাকে টেলিগ্রাম করেছিলেন। কেন অপরাজিতা কামালের সঙ্গে বিশ্রীভাবে ‘লটঘট করছিল। কেন সঞ্জয় সাহস করে বলতে পারেনি যে, সে ঝরনাকে বিয়ে করতে চায়। কেন অপরাজিতা গোপনে রেজিস্ট্রি বিয়ে করে বসে আছে! তাই না? এখনো কি আপনার সব সমস্যার সমাধান হয়নি? এখনো কি আপনি মেনে নিতে পারছেন না যে, রায়বাহাদুরকে কেউ খুন করেনি। ইটস্ জাস্ট এ কেস অব সুইসাইড!

বাসু ঘরময় পায়চারি করছিলেন। থমকে থেমে পড়ে বলেন, অলরাইট! আজ রাতের মতো এখানেই থামছি। কিন্তু কাল সকালে ঠিক এখান থেকেই যাত্রা শুরু করব। প্লিজ কাম ব্যাক অ্যাট টেন, টুমরো মর্নিং।

হরেনবাবু উঠে দাঁড়ায়। আড়মোড়া ভাঙে। একটা সিগারেট ধরিয়ে বলে, কী কী সমস্যার সমাধান এখনও বাকি রইল, স্যার?

–এক, কেন রায়বাহাদুর ঠিক ফায়ার করার আগে নব্বই ডিগ্রি ঘুরে পশ্চিমমুখো হয়ে বসেছিলেন। দুই, কেন রমলার হাত থেকে বেমক্কা চাবিটা মেঝেতে পড়ে গিয়েছিল …

–দ্বিতীয়টার জন্য যৌথভাবে দায়ী মাধ্যাকর্ষণ এবং রমলাদেবীর অন্যমনস্কতা।

–তিন, কেন হঠাৎ দশরথ জানার মনে হল রমলার ডান হাঁটুটে বাত আছে, সে একটু খুঁড়িয়ে চলে …

–আপনি সেই পাগলের উক্তি নিয়েও চিন্তা করছেন, স্যার?

–চার, কেন বৈঠকখানার বাইরে বাগানে এই ছেঁড়া ঠোঙাটা পড়েছিল?

–ছেঁড়া ঠোঙা! মানে?

বাসু পকেট থেকে একটা ব্রাউন রঙের ঠোঙা বার করে বললেন, এলাকাটা স্পটলেসলি ক্লিন। তাহলে ঠোঙাটা এল কোত্থেকে? কেন? কখন?

হরেনবাবু বলেন, এটা তো, স্যার প্রায় সেই জাতের প্রশ্ন হল, ‘কুমড়ো নিয়ে ক্রিকেট খেলে কেন রাজার পিসি?’

বাসু ওর কথায় ভ্রূক্ষেপ না করে বলে চলেন, পাঁচ, কি করে নটরাজ মূর্তির তলায় একটা কাচের টুকরো আটকে আছে

–নটরাজ মূর্তির তলায়? কী আছে?

বাসুসাহেব টুলের ওপর থেকে ব্রোঞ্জের নটরাজ মূর্তিটা তুলে এনে দেখালেন। তার তলায় একটা ছোট্ট কাচের টুকরো আটকে আছে। প্রথমবার ঘরটা সার্চ করার সময়েই এটা তাঁর নজরে পড়েছিল।