দর্পণে প্রতিবিম্বিত কাঁটা – ১২

বারো

এরপর সঞ্জয় জানিয়ে গেল, অ্যাডভোকেট লালমোহন এসেছেন। রাত তখন সাড়ে এগারোটা। লালমোহন প্রৌঢ় মানুষ। কলকাতায় প্র্যাকটিস করেন। পারিবারিক প্রয়োজনে দিন-চারেক আগে মোহনপুরে দেশের বাড়িতে এসে আছেন। দুঃসংবাদটা দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়েছিল মোহনপুরে। লালমোহন তাই ফোন করে জানতে চেয়েছিলেন, গুজবটা সত্য কি না।

হ্যাঁ, তিনিই ছিলেন রায়বাহাদুরের অ্যাটর্নি। আইনসংক্রান্ত পরামর্শদাতা। টেলিফোনে রায়বাহাদুরের সঙ্গে প্রায়ই কথাবার্তা হত। লিগ্যাল ড্রাফ্ট লালমোহন কলকাতায় বসে বানাতেন। সিনিয়র অথবা জুনিয়র দুগার কলকাতা-অফিস থেকে সিল করা কাগজপত্র নিয়ে আসতেন।

জিজ্ঞাসিত হয়ে লালমোহন স্বীকার করলেন, হ্যাঁ, তিনি রায়বাহাদুরের নির্দেশমতো একটি উইল প্রণয়ন করেছিলেন। বছর চারেক আগে। ওঁর দুজন ল-ক্লার্ক তার সাক্ষী। উইলের এক কপি আছে রায়বাহাদুরের কলকাতার ব্যাঙ্কের লকারে, এককপি লালমোহনের হেপাজতে।

উইল মোতাবেক শশীকলা যাবজ্জীবন মোহনমঞ্জিলে বসবাস করতে পারবেন, কিন্তু বন্ধক দিতে বা বিক্রি করতে পারবেন না। শশীকলার দেহান্তে মোহনমঞ্জিলের মালিক হবে অপরাজিতা। ওঁর অস্থাবর সম্পত্তি মোটামুটি দু-ভাগে বিভক্ত হবে; কিছু অবশ্য বন্টিত হবে গৃহভৃত্যদের মধ্যে এবং একটা বড় অংশ সত্যপ্রসন্ন ও তাঁর পুত্রের।

হরেন্দ্র দত্ত জানতে চান, মোদ্দা ব্যাপারটা তাহলে দাঁড়ালো এই যে, রায়বাহাদুরের মৃত্যুতে কেউই লাভবান হচ্ছে না। তাই তো?

লালমোহন একটু নড়েচড়ে বসে ওকালতি জবাব দিলেন, আপনার ওই অভিমতটা একটা ‘কনক্লুশন’। আমি শুধু ফ্যাক্টস্-এর কথাই বলতে পারি।

বাসু মাঝপথে বলে ওঠেন, ঠিক কথা। তা উইলে অপরাজিতাকে কি ‘কন্যারূপে চিহ্নিত করা হয়েছে?

—আজ্ঞে না। ‘দত্তক কন্যা!’

হরেন্দ্র বলেন, সে কী মশাই! অপরাজিতা দেবী রায়বাহাদুরের কন্যা নন?

–আমার জ্ঞানমতে: নয়। তাকে বহুদিন পূর্বে রায়বাহাদুর এবং শশীকলা দত্তক নিয়েছিলেন—বেনারসে!

—কী আশ্চর্য! গ্রামের কেউ তা জানে না?

–‘কেউ জানে না’ বলাটা ঠিক হবে না। আমি জানি। ওঁর একান্তসচিব সত্যপ্রসন্ন জানেন, কিন্তু গ্রামে সাধারণভাবে এ-কথা কেউ জানে না। নিঃসন্তান অবস্থায় ওঁরা তীর্থ করতে যান। প্রায় দেড়বছর বাদে সদ্যোজাত কন্যা সমেত ফিরে আসেন এটাই মোহনপুরের লোক জানে।

–অপরাজিতা নিজে কি সেকথা জানে?

–আমি বলতে পারব না। তাকে জিজ্ঞেস করে দেখবেন। আপনারা কি আমার কাছে আর কিছু জানতে চান?

হরেন্দ্র দত্ত বলেন, নো থ্যাংকস্। আপনি আসুন। গুড নাইট!

লালমোহন সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন।

বাসু তাঁর পাইপে তামাক ঠেসতে ব্যস্ত ছিলেন। বললেন, আর-একটা শেষ প্রশ্ন, এই চার বছরের মধ্যে রায়বাহাদুর কি কখনো এমন কথা বলেননি যে, তিনি উইলটা বদলাতে চান?

লালমোহন আবার বসে পড়েন। বলেন, আজ্ঞে হ্যাঁ। বলেছিলেন। গত সপ্তাহে। কিন্তু সেই মোতাবেক কোনও ড্রাফট্ই তৈরি করা হয়নি। উইল তো দুরের কথা। ওঁর নিজের হাতে লেখা একটা খসড়া অবশ্য ছিল।

এঁরা দুজনেই চমকে ওঠেন। হরেন্দ্রনাথ বলেন, কী আশ্চর্য! সেকথা তো আপনি এতক্ষণ বলেননি মশাই?

—না, বলিনি। আপনারা তো সেকথা জানতে চাননি। যা প্রশ্ন করেছেন আমি তারই জবাব দিয়ে যাচ্ছি।

বাসু বললেন, এবার তাহলে বলুন, উনি নতুন উইলে কী কী পরিবর্তন করতে চেয়েছিলেন এবং কেনই বা সেই মোতাবেক নতুন উইল বানানো যায়নি

–উনি যা চাইছিলেন, আমি ওঁকে বলেছিলাম, সেটা আইনত হয়তো সিদ্ধ হবে না। ওইভাবে উইল তৈরি করলে ওয়ারিশদের মধ্যে কেউ হয়তো তাতে প্রতিবাদ জানাবে এবং আমার আন্দাজ আদালত প্রতিবাদটা মেনে নেবেন। তাই আমি রায়বাহাদুরকে বলেছিলাম, উইলটা ওইভাবে না বানাতে।

–তার জবাবে উনি কী বলেছিলেন?

একটু দেরি হল জবাবটা দাখিল করতে। তারপর লালমোহনবাবু বললেন, উনি বলেছিলেন, ‘বুঝেছি! তোমার দ্বারা হবে না। যার হিম্মৎ আছে আমি তেমন লোকের ব্যবস্থা করছি।’ তখন আমি বলেছিলাম, ‘আজ্ঞে কোনও উকিলই এমন উইল তৈরি করার পরামর্শ দেবে না।’ তার জবাবে উনি বলেছিলেন, ‘জানি, সেজন্য উকিলের বদলে আমি ব্যারিস্টারের ব্যবস্থা করব।’

বাসু বললেন, নতুন উইলে উনি কী পরিবর্তন চাইছিলেন?

–শশীকলার অবর্তমানে অপরাজিতা সম্পত্তিটা পাবে একটি শর্ত মানলে। সে যদি সত্যপ্রসন্ন দুগারের পুত্র সঞ্জয়কে বিবাহ করে।

হরেন্দ্রনাথ বলেন, বুঝলাম। কোনও ছেলে বা মেয়েকে দত্তক নিয়ে তার ‘ফান্ডামেন্টাল রাইট্স’-এ হস্তক্ষেপ করে এভাবে সম্পত্তি থেকে তাকে বঞ্চিত করা আদালত হয় তো মেনে নেবে না।

বাসু জানতে চান, রায়বাহাদুর কী চাইছিলেন? ধরা যাক (ক) সঞ্জয় ওকে বিয়ে করতে রাজি হল না, সেক্ষেত্রে? ধরা যাক, (খ) রায়বাহাদুরের দেহান্তের পূর্বেই অর্থাৎ উইলটা সিল ভেঙে দেখার পূর্বেই যদি অপরাজিতা বিবাহ করে বসে থাকে। সেক্ষেত্রে?

লালমোহন বললেন, দ্বিতীয় সম্ভাবনার কথা রায়বাহাদুর ভেবে দেখেননি। তবে প্রথমটির বিষয়ে তাঁর মত, যদি সঞ্জয় রাজি থাকা সত্ত্বেও অপরাজিতা তাকে বিবাহ না করে অন্য কাউকে বিয়ে করে, তবে সম্পত্তিটা পাবে সঞ্জয় দুগার; আর যদি সঞ্জয় অস্বীকার করে জিতাকে বিবাহ করতে, তাহলে সম্পত্তি পাবে অপরাজিতাই। তখন সে অন্য কোনও হিন্দুকে বিয়ে করতে পারবে।

বাসু বলেন, কী আশ্চর্য! এর তো হাজারটা বিকল্প হতে পারে। এক নম্বর, সঞ্জয় রাজি আছে কি নেই তা সে জানাচ্ছে না। জানাতে সে তো বাধ্য নয়! দু-নম্বর, দুজনেই স্থির করল আজীবন অবিবাহিত থাকবে; তিন নম্বর, বিয়ে করে সম্পত্তিটা নিয়েই দুজন মিউচুয়াল ডিভোর্স করল। চার নম্বর…

লালমোহন বলেন, জানি, স্যার। এ-জন্যই আমি ওই উইলটা বানাতে স্বীকৃত হইনি।

— অপরাজিতা বা সঞ্জয় কি একথা জানে?

–আমি কাউকে কিছু বলিনি। আমার বিশ্বাস যে, রায়বাহাদুরও কাউকে কিছু বলেননি।

বাসু বলেন, একটা কথা, কাউন্সেল। আপনি বললেন রায়বাহাদুর ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন যে, সঞ্জয় যদি অপরাজিতাকে বিবাহ করতে স্বীকৃত না হয় তা হলে সে অন্য কোনও “হিন্দু’ যুবককে বিবাহ করতে পারে। তাই নয়? কিন্তু বিশেষ করে, ‘হিন্দু’-র কথাটা বলেছিলেন কেন? আপনার কি মনে হয়, রায়বাহাদুরের আশঙ্কা হয়েছিল অপরাজিতা কোনও অ-হিন্দুকে বিবাহ করতে পারে? মুসলমান, অথবা খ্রিস্টান?

লালমোহন বললেন, ওটা একটা কনক্লুশন…

বাসু বাধা দিয়ে বলেন, কারেক্ট। কিন্তু আপনি তো কাঠগড়ায় উঠে সাক্ষী দিচ্ছেন না। আমাদের সাহায্য করতে এসেছেন। যাতে আমরা বুঝতে পারি, কেন রায়বাহাদুর হঠাৎ আত্মহত্যা করে বসলেন? তাই নয়?

–না। ও বিষয়ে আমার কিছু বলা ঠিক হবে না। ওটা একটা কনক্লুশন!

বাসু বললেন, অসংখ্য ধন্যবাদ, কাউন্সেল। আপনি আমাদের সামনে একটা নতুন দিগন্ত খুলে দিলেন। আচ্ছা, গুড নাইট।