দর্পণে প্রতিবিম্বিত কাঁটা – ১০

দশ

প্রথম দুই-তিন সেকেন্ড প্রবেশপথের বাইরে গোটা দলটা তড়িতাহতের মতো দাঁড়িয়ে রইল। তারপর বাসু প্রবেশ করলেন স্টাডিতে। মোহান্তিমশাই একটা স্বগতোক্তি করে বসেন, কী সর্বনাশ! রায়বাহাদুর আত্মহত্যা করেছেন!

তৎক্ষণাৎ পিছনে একটা পতনধ্বনি শুনে বাসু ফিরে দাঁড়ালেন. শশীকলার কণ্ঠ দিয়ে কোনও শব্দ নির্গত হয়নি। কিন্তু তাঁর চরণযুগল দেহভার রক্ষা করতে পারছিল না। তিনি মূর্ছিত হয়ে দোরগোড়াতেই লুটিয়ে পড়লেন।

বাসু বললেন, সঞ্জয়, ওঁকে ধরাধরি করে ভিতরে নিয়ে যাও।

কে যে ওই মূর্ছাহতা মহিলাকে সরিয়ে নিয়ে গেল বাসু আর তা দেখলেন না। তিনি এগিয়ে গেলেন চেয়ারে-বসা রায়বাহাদুরের মৃতদেহের দিকে।

হঠাৎ পিছন থেকে কে যেন বলে উঠল, তাহলে তখন আমরা যে শব্দটা শুনেছিলাম তা কোনও গাড়ির ব্যাকফায়ারের আওয়াজ নয়?…ওটা পিস্তলের শব্দ!

বাসু আবার এদিকে ফিরে দেখলেন। কথাটা বলেছে কক্ষে উপস্থিত একমাত্র অচেনা মহিলাটি। সালোয়ার পাঞ্জাবি পরা, শ্যামলা কিন্তু সুতনুকা মেয়েটির বয়স বাইশ-চব্বিশ হতে পারে। সম্ভবত এই মোহনপুরেরই বাসিন্দা। আজ রাত্রে হয়তো তারও আমন্ত্রণ ছিল সায়মাসে। সলিলের বোন কি? বুঝে উঠতে পারলেন না।

বাসু জানতে চান, থানাটা কতদূরে? টেলিফোন করা যাবে? সত্যপ্ৰসন্নবাবু?

সত্যপ্রসন্ন জবাবে কিছু বলার আগেই অপরাজিতা যেন আর্তনাদ করে ওঠে, না!

—না? ‘না’ মানে? পুলিসকে তো জানাতেই হবে।

এবার সত্যপ্রসন্ন এগিয়ে আসেন। অপরাজিতার পিঠে একটা হাত রেখে বলেন, তুমি ভিতরে যাও জিতা, দেখ, তোমার মা কেমন আছেন। তাঁর কাছে-কাছে থাক। আমরা এদিকটা সামলাচ্ছি।

অপরাজিতা শাড়ির আঁচলে মুখ ঢেকে দ্রুতপায়ে বাড়ির ভিতর দিকে চলে যায়। সত্যপ্রসন্ন এদিকে ফিরে বাসুসাহেবকে বলেন, মোহনপুরেই থানা হেডকোয়ার্টার। টেলিফোনে খবর দিতে কোনও অসুবিধা নেই। এ বাড়িতেও ফোন আছে। থানাতেও। ফোনটা কি আপনি করবেন?

বাসু বলেন, না, আপনারা যে কেউ করুন। আমি ততক্ষণ ঘরটা খুঁটিয়ে দেখি। পুলিস আসার আগেই। তবে কোনও কিছু আমি ছোঁব না। বাই দ্য ওয়ে, আপনি কি আমাকে চিনতে পেরেছেন মিস্টার দুগার?

–আজ্ঞে হ্যাঁ! বছর-তিনেক আগে আমি আপনার বাড়িতেও একবার গিয়েছিলাম। তখন অবশ্য আপনার সঙ্গে আমার পরিচয় হয়নি।

—জানি। শুনুন। আপনি এ ঘরে থাকুন। সাক্ষী হিসাবে। অর্থাৎ আমি কোনও কিছু স্পর্শ করছি না এটা লক্ষ্য রাখতে। অন্য সকলে এ ঘর ছেড়ে চলে গেলেই ভাল হয়।

কেউ কোনও প্রতিবাদ করল না। বাসুর নির্দেশটা সবাই বিনা বাক্যব্যয়ে মেনে নিল। ধীরে ধীরে সকলে ঘর ছেড়ে বাইরে চলে গেল। সত্যপ্রসন্ন তাঁর পুত্রকে বললেন, সঞ্জয় দেখ, থানাতে বড় দারোগা হরেন্দ্র দত্ত আছেন কি না। মোট কথা থানায় খবরটা দিয়ে আমাকে জানিয়ে দিও।

সত্যপ্রসন্ন দরজাটা বন্ধ করার চেষ্টা করলেন, তা হল না। একবার বাইরে উঁকি মেরে দেখে নিয়ে নির্জনতা সম্বন্ধে নিশ্চিন্ত হলেন। তারপর প্রশ্ন করেন, আপনি এই মর্মান্তিক সময়ে এখানে এসে উপস্থিত হলেন কি করে?

—আপনিও কি জানতেন না আমার আসার কথা? রায়বাহাদুর যে আমাকে টেলিগ্রাম করে ডেকে পাঠিয়েছিলেন তা কি আপনিও জানেন না?

—ডেকে পাঠিয়েছিলেন? আপনাকে? কেন?

–সে বিষয়ে পরে আলোচনা করা যাবে। আপনি দরজার সামনে পাহারা দিন। আমি ততক্ষণ খুঁজে দেখি।

—কী খুঁজে দেখবেন আপনি?

—উনি ডান-কানে ফায়ার করেছিলেন, বুলেটটা বাঁ-কান দিয়ে বার হয়ে ওই দেখুন ওই আয়নাটায় আঘাত করেছিল। আয়নাটা মাকড়শার জালের মতো চৌচির হয়ে ফেটে গেছে। ফলে বুলেটটা প্রতিহত হয়ে ঘরের ভিতরেই কোথাও আছে।

বেশি খুঁজতে হল না। সামনেই সেটা পড়েছিল মার্বেলের মেঝেতে। বাসু সেটা তুলে দেখলেন এবং ঠিক যেখান থেকে কুড়িয়েছিলেন সেখানে নামিয়ে রাখলেন। এবার উনি এগিয়ে গেলেন টেবিলটার দিকে। টেবিলের ওপর কিছু কাগজপত্র। ঝুঁকে পড়ে দেখলেন রায়বাহাদুর যে ‘আত্মচরিত লিখছিলেন তারই পাণ্ডুলিপি। যে পাতাটা লিখছিলেন সেটাই খোলাই রয়েছে। পৃষ্ঠার মাথায় পৃষ্ঠা সংখ্যা : ১৩১; একটি মাত্র অনুচ্ছেদ লেখা শেষ হয়েছে। তার নিচে কাঁপা-কাঁপা হস্তাক্ষরে বেশ বড় বড় হরফে ক্যাপিটাল লেটার্সে ইংরেজিতে লেখা : সরি!

কলমটাও খোলা অবস্থায় পড়ে আছে।

বাসু এবার মৃত বৃদ্ধের পকেট হাতড়াতে থাকেন।

সত্যপ্রসন্ন জিজ্ঞেস করেন, কী খুঁজছেন বলুন তো?

—ঘরের চাবিটা। ঘরটা ভিতর থেকে তালাবন্ধ করে উনি চাবিটা নিশ্চয় বার করে নিয়েছিলেন, না হলে ছিদ্রপথে আমি ঘরের ভিতরটা…….এই তো।

বাসু ওই মৃত বৃদ্ধের পাশপকেট থেকে একটি চাবি বার করে দেখলেন এবং রুমালে তাঁর নিজের ফিঙ্গারপ্রিন্ট মুছে নিয়ে আবার পকেটে রেখে দিলেন।

সত্যপ্রসন্ন বললেন, সন্দেহের আর কোনও অবশেষ থাকল না। ভিতর থেকে ঘরটা বন্ধ করে, ওই ‘সরি’ কথাটা লিখে উনি নিজের রিভলভারে নিজেকেই হত্যা করেছেন। কিন্তু উনি আপনাকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন কেন?

বাসু বললেন, তার চেয়েও বড় কথা, ডেকেই যখন পাঠালেন তখন আমার সঙ্গে কোনও কথাবার্তা না বলে এমন তাড়াহুড়ো করে আত্মহত্যা করে বসলেন কেন? আমি যে আসছি তা উনি আন্দাজ করেছিলেন। স্টেশনে লোক পাঠিয়েছেন, গাড়ি পাঠিয়েছেন, দশরথকেও বলে রেখেছেন। অথচ মিসেস শেঠ কিছু জানেন না, আপনি কিছু জানেন না। নাঃ! জিগ্‌স্‌-পাল- এ অনেকগুলো টুকরো এখনো আমরা খুঁজে পাইনি। সে যাইহোক, আপনি কিছু অনুমান করতে পারেন? কী এমন কাণ্ডটা ঘটল যাতে— কোনও একটা সমস্যা সমাধানের জন্য উনি আমাকে ডেকে পাঠালেন, অথচ আমার সঙ্গে কোনও কথা না বলে এভাবে-

কায়দা

—না, স্যার! আমি কিছুই আন্দাজ করতে পারছি না।

—আপনি শেষ কখন ওঁকে দেখেন?

—আজই দুপুরে। আমরা একসঙ্গেই মধ্যাহ্নভোজন করেছি। তখনো উনি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক ছিলেন।

—আপনার মনে হয়নি উনি উত্তেজিত অথবা অস্বাভাবিক মানসিক অবস্থায় আছেন?

–হ্যাঁ, একটু গম্ভীর ছিলেন। একটা পারিবারিক কারণে উনি কিছুদিন থেকেই উদ্বিগ্ন ছিলেন। কিন্তু সেটা এমন কিছু নয়। মানে, উনি যে এভাবে আত্মহত্যা…..

—বুঝেছি, বুঝেছি। আচ্ছা ওই মেয়েটি কে? বছর কুড়ি-বাইশ বয়েস। একটা মেরুন রঙের সালোয়ার কামিজ পরা? যে তখন বলল, শব্দটা তাহলে কোনও গাড়ির ব্যাকফায়ার নয়!’?

—ওর নাম ঝরনা মিত্র। ও আজ দিন-দশেক হল এ বাড়িতে আছে। মোহনপুরের মেয়ে নয়।

—হ্যাঁ, কিন্তু কোন সূত্রে? শশীকলার আমন্ত্রণে?

—আজ্ঞে না, ও ছিল আমার ছেলে সঞ্জয়ের সহপাঠিনী। সঞ্জয় লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে বম্বে চলে গিয়েছিল। মেয়েটি এম. এ. পাশ করে একটা স্কুলে পড়ায়। গ্রীষ্মের ছুটিতে বেড়াতে এসেছে।

—তা ওই মেয়েটি তখন ‘ফায়ারিং’-এর কথা কী বলেছিল। সেটা কি আপনিও শুনেছেন?

—আজ্ঞে হ্যাঁ। আমরা তখন অনেকেই বৈঠকখানায় এসে গেছি। হঠাৎ ‘দুম’ করে একটা শব্দ হল। সলিল বলল, “কিসের শব্দ ওটা,’ মিস্ স্মিথ বললেন, ‘রাস্তায় কোন গাড়ি ব্যাকফায়ার করল বোধহয়।’ তখন আমি বললাম, ‘মোহনপুরে কটাই বা গাড়ি? আর রাস্তা তো অনেকদূরে। শব্দটা ডাইনিং হল থেকে এল মনে হচ্ছে।’ অপরাজিতা বললে, ‘না, আমার মনে হল স্টাডিরুমের দিক থেকে।’

—ওটা যে পিস্তলের ফায়ারিং হতে পারে, এটা আপনাদের কারও মনে হয়নি।

—তখন হয়নি। হওয়ার কথাও নয়। এখন মনে হচ্ছে, ওটা রায়বাহাদুরের রিভলভারের শব্দই।

—সেটা আন্দাজ কয়টার সময় বলতে পারেন?

—পারি। ‘আন্দাজ’ নয়, ঠিক, আটটা পঁয়তাল্লিশ। কারণ শব্দটা শোনার পরেই আমার নজরে পড়েছিল বৈঠকখানার বড় দেওয়াল ঘড়িটায়। ওটা ঠিক তখনই শব্দ করে বেজে উঠল। প্রতি পনের মিনিট অন্তর ওই ঘড়িটা জলতরঙ্গের মতো শব্দ করে।

—বুঝলাম। এবার বলুন, তখন বৈঠকখানা ঘরে কে কে ছিল?

—আমরা সবাই ছিলাম।

—প্লিজ বি স্পেসিফিক। ঠিক কে কে?

—কেন বলুন তো? ও আয়াম সরি, বলছি বলছি। আমি ছিলাম, মোহান্তি ছিলেন, সঞ্জয়, সলিল. কামাল, জিতা সবাই ছিলাম।

—মিসেস শেঠ, ঝরনা, দশরথ, অথবা ডঃ মিস স্মিথ?

—না, শশী একটু পরে আসে। ঝরনা আর রমলাদেবী ছিলেন কি না মনে পড়ছে না। তবে দশরথ তখন ঘরে ছিল না।

—এই যে একটু আগে বললেন, “মিস স্মিথ বললেন ‘রাস্তায় কোন গাড়ি ব্যাকফায়ার করল বোধহয়।’

—বলেছিলাম না কি? হ্যাঁ তাই! মিস স্মিথই ও কথাটা বলেন! এখন মনে পড়েছে।

বাসু পকেট থেকে নোটবই বার করে ঘরের বিভিন্ন আসবাবপত্র ঘটনাস্থলের একটা স্কেচ করে নিলেন। স্টাডিরুমটা পূর্ব-পশ্চিমে লম্বা। একটামাত্র দরজা পশ্চিমের দেওয়ালে, এক্কেবারে উত্তরপ্রান্তে ঘেঁষে। দরজা খুলে সামনেই সেক্রেটারিয়েট টেবিলটা, তার সামনে গদি-আঁটা চেয়ার। সেটা পশ্চিমদিকে মুখ করে আছে। রায়বাহাদুর পশ্চিমদিকে মুখ করে বসে আছেন। টেবিলের দিকে ফিরে নয়। ঘরে তিনটি জানলা, সবগুলিই শার্সিপাল্লার এবং ভিতর থেকে ছিটকিনি-বন্ধ। চেয়ারের বিপরীতে দক্ষিণের দেওয়ালে ভাঙা আয়নাটা। তার পাশেই ছোট ছোট দুটি টেবিলে দুটি ব্রোঞ্জ ভাস্কর্য। একটি মিকেলাঞ্জেলোর ডেভিড, অপরটি নটরাজ। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সব কিছু দেখছিলেন।

এই সময় দরজার বাইরে থেকে সঞ্জয় ঘোষণা করল, থানা থেকে ওঁরা এসে গেছেন। এখানে নিয়ে আসব কি?

প্রশ্নটি বাহুল্য। আত্মহত্যা কেসে তদন্তে এসে থানা অফিসার গৃহস্বামীর ‘আসতে আজ্ঞা হোক’ আমন্ত্রণের জন্য অপেক্ষা করে না। সঞ্জয়কে একপাশে সরিয়ে দিয়ে জনাতিনেক অফিসার আর দুজন পুলিশ ঘরে প্রবেশ করে। বড়-দারোগা দরজার কাছ থেকেই ঘরের চারিদিকে দৃষ্টি বুলিয়ে নিলেন। চেয়ারে বসে থাকা মৃতদেহটাকে একনজর দেখে নিয়ে সত্যপ্রসন্নকে প্রশ্ন করেন: কখন ঘটল এটা?

ওপাশ থেকে বাসুসাহেব বলে ওঠেন,’ সম্ভবত আটটা পঁয়তাল্লিশে। কারণ ফায়ারিং-এর শব্দটা সেই সময় অনেকেই শুনেছেন।

এতক্ষণে এপাশ ফিরে বক্তাকে ভাল করে নজর করেন থানা অফিসার, হরেন দত্ত। অবাক হয়ে বলে ওঠেন, একী! স্যার, আপনি! এখানে?

বাসু বললেন, আমাকে চেনেন মনে হচ্ছে—

—বিলক্ষণ! আপনাকে চিনব না? থানার চার্জ পাওয়ার আগে পাঁচ-পাঁচটা বছর হোমিসাইডে ছিলাম যে। কতবার আদালতে আপনার ভেল্কি দেখেছি।

বাসু বললেন, সেসব কথা থাক। ভালই হল আপনি আমাকে চেনেন। নটা বেজে তিন কি চার মিনিটে ওই দরজা ভেঙে আমরা রায়বাহাদুরকে আবিষ্কার করি। অর্থাৎ ফায়ারিং-এর শব্দটা কয়েকজন শুনতে পাওয়ার প্রায় কুড়ি মিনিট পরে। আপনি কাজ শুরু করে দিন হরেনবাবু, রাত বাড়ছে।

.

প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট পরের কথা। বাসুসাহেব ঘরের পূর্বপ্রান্তে একটা সোফায় বসে ধূমপান করছেন। ভাঙা দরজাটাকে আর স্বস্থানে বসানো যায়নি, তাই দ্বারপ্রান্তে পেতলের ঘণ্টার কাছে একজন পুলিশ প্রহরায় আছে। হরেনবাবুর সঙ্গে যাঁরা এসেছিলেন, ক্যামেরাম্যান আর ফিঙ্গারপ্রিন্ট এক্সপার্ট, তাঁরা কাজ শেষ করেছেন। হরেনবাবুর অনুমতি নিয়ে তাঁরা বিদায় হলেন। মৃতদেহটি মর্গের উদ্দেশে অ্যাম্বুলেন্সে চেপে রওনা হয়ে গেছে। হরেন্দ্রনাথ বাসুসাহেবের পাশে এসে বসলেন। একটা সিগ্রেট ধরিয়ে একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে বললেন, ক্লিয়ার কেস! রূদ্ধদ্বার কক্ষে, নিজের রিভলভারের গুলিতে রায়বাহাদুর আত্মহত্যা করেছেন। বেশ বোঝা যায়, উনি ডান হাতে ডান কানে গুলি করেন। সেটা মস্তিষ্ক ভেদ করে বাঁ কান দিয়ে বার হয়ে যায়। আয়নায় প্রতিহত হয়ে মেঝেতে পড়ে। সেটাও পাওয়া গেছে। ঘরের প্রতিটি শার্শিপাল্লা ভিতর থেকে ছিটকিনি বন্ধ। জানলায় গরাদ বা গ্রিল না থাকলেও কোনও জানলা খোলা ছিল না। তাছাড়া দরজার চাবিটা রায়বাহাদুরের পকেট থেকেই পাওয়া গেছে। ক্লিয়ার কেস অব সুইসাইড।

—আপনার মনে তাহলে কোনও খটকা নেই?

—আজ্ঞে না। একটা সমস্যার সমাধান হয়নি অবশ্য।

— সেটা কী?

—আপনার উপস্থিতিটা। এই মর্মান্তিক সময়ে আপনি কলকাতা থেকে এখানে কেন? বাসু নিঃশব্দে পকেট থেকে দুটি কাগজ বার করে দিলেন। প্রথমটা সাতদিন আগে পাওয়া চিঠিটা; দ্বিতীয়টা কালরাত্রে পাওয়া টেলিগ্রাম।

সে দুটি খুঁটিয়ে দেখে হরেনবাবু বললেন, যাচ্চলে! সব যে আবার গুলিয়ে দিলেন আপনি! কী ব্যাপার বলুন তো, স্যার?

—আমি জানি না। এটুকু জানি, কোন একটা প্রচণ্ড দুশ্চিন্তা রায়বাহাদুরকে খোঁচাচ্ছিল। তিনি সেই সমস্যার সমাধানের জন্য আমার সাহায্য চেয়েছিলেন। স্টেশনে লোক পাঠিয়েছিলেন। গাড়ি পাঠিয়েছিলেন। আমাকে তিনি প্রত্যাশা করছিলেন। এক্ষেত্রে আমি এসে পৌঁছনোর ঠিক আগেই তিনি এভাবে…

—তা ঠিক। কিন্তু ঘরটা ভিতর থেকে তালাবন্ধ ছিল, স্যার! আর জানলাগুলো সব ছিটিকিনি বন্ধ, চাবিটা রায়বাহাদুরের পকেটে….

—আমি তা অস্বীকার করছি না। কিন্তু আমার প্রশ্নটার জবাব কই? কী মর্মান্তিক সমস্যায় বিচলিত হয়েছিলেন রায়বাহাদুর? যে জন্য সাতদিন আগে ওই চিঠি লেখেন? স্ত্রীকে জানাননি, কন্যা বা একান্তসচিবকে পর্যন্ত জানাননি, অথচ আমাকে টেলিগ্রাম করে আসতে বলেছেন! কী সেই মর্মান্তিক সমস্যাটা? আর আমি আসছি জেনেও এসময়ে…

—আমরা কি তাহলে একে একে সকলের জবানবন্দি নিতে থাকব? রাত পোয়াবার আগেই? যাতে কেউ ভেবেচিন্তে জবাব না বানাতে পারে?

—আমি একমত। তবে যাঁরা বাইরে থেকে এসেছেন তাঁদের তিনজনকে আগে ডাকা যাক। মোহান্তি, কামাল আর ডক্টর মিত্র। রাত এগারোটা প্রায় বাজে।

সেইমতোই ব্যবস্থা হল।

প্রথমে এলেন বলভদ্র মোহান্তি। রায়বাহাদুরের সাম্প্রতিক কোনও সমস্যার বিষয়ে তিনি কোনও আলোকপাত করতে পারলেন না। ইদানীং ওঁরা রবিবারের সন্ধ্যায় দাবা খেলতে বসেন না।

হরেনবাবু জানতে চান, আজ রাতে আপনার নিমন্ত্রণ ছিল, তাই না? কিন্তু উপলক্ষটা কী?

—হ্যাঁ, নিমন্ত্রণ ছিল; কিন্তু হেতুটা কী তা উনি পরিষ্কার করে বলেননি। শুধু বলেছিলেন, আজ কলকাতা থেকে ওঁর একজন মেহমান আসবেন। তাঁরই সম্মানে এই নৈশভোজ। দেখুন, এই আত্মহত্যার ব্যাপারে আমি কোনও কিছুই জানি না। এবার বলুন, স্যার, আমি কি নিজের বাড়িতে ফিরে যেতে পারি?

—হ্যাঁ, নিশ্চয়। অনেকক্ষণ আপনাকে আটকে রেখেছি।

রায়বাহাদুরের গাড়িতে বলভদ্র মোহান্তিকে তাঁর বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা হল। দশরথ খুব করিৎকর্মা। এই মর্মান্তিক পরিস্থিতিতেও সে মোহনমঞ্জিলের আতিথেয়তার কথাটা ভুলে যায়নি। ড্রাইভারের হাতে একটা বড় খাবারের প্যাকেট ধরিয়ে দিল।

মোহান্তিমশাই-এর পরে জবানবন্দি দিতে এল যে ছেলেটি তার নাম কামালুদ্দীন রহমান। বছর ত্রিশের সুঠাম যুবক। স্থানীয় বিধায়ক জয়নাল রহমানের একমাত্র পুত্র। জয়নাল রহমান সাহেব এই এলাকা থেকে পরপর দুবার নির্বাচিত হয়েছেন, শাসকদলের পক্ষে। রাষ্ট্রমন্ত্রী হতে হতেও শেষ পর্যন্ত হতে পরেননি। এ-এলাকায় তাঁর দুর্দান্ত প্রভাব। অর্থনৈতিক বিচারে হয়তো রায়বাহাদুরকে টপকে যেতে পারেননি এখনো, কিন্তু প্রতাপ-প্রতিপত্তি তাঁর অনেক বেশি। কামাল অপরাজিতার সহপাঠী। শুধু তাই নয়, মোহনপুরে একটি নাট্যদলের ওরা দুজন পাণ্ডা মাঝে মাঝেই অভিনয় হয়। ওরা হিরো-হিরোইন সাজে। ব্যাপারটা আদৌ পছন্দ নয় রায়বাহাদুরের; কিন্তু উপায় নেই। ইচ্ছার বিরুদ্ধে যেমন হিন্দু কোড বিল, জমিদারী অ্যাবলিশন, অ্যাডাল্ট ফ্র্যাঞ্চাইজকে মেনে নিতে হয়েছে তেমনি এটাকেও মেনে নিতে বাধ্য হয়েছেন। কামালের আজ নৈশভোজের নিমন্ত্রণ ছিল না। কিন্তু ঘটনাচক্রে সেও উপস্থিত ছিল।

হরেনবাবুর প্রশ্নের জবাবে কামাল জানালো, সে এসেছিল বিকালে। অপরাজিতার সঙ্গে ওদের মোহনপুর ড্রামাটিক ক্লাবের ব্যাপারে কথা বলতে। মিস্টার রাসু যখন আসেন তখনো সে চলে যায়নি। ডিনারের বেল বাজতে সে সতর্কিত হয়ে ওঠে। বুঝতে পারে রাত করে ফেলেছে; কিন্তু তার প্রস্থানের আগেই বাসুসাহেব ঘরে প্রবেশ করেন।

হরেনবাবু বলেন, তার মানে আটটা পঁয়তাল্লিশে যখন পাশের ঘরে ফায়ারিং হয় তখন তুমি বৈঠকখানায়?

—ইয়েস স্যার।

—তখন ঘরে কে কে ছিল?

—আমার যতদূর মনে পড়ে মোহান্তিজেঠু ছিলেন, সঞ্জয়, ডাক্তার মিত্র, কাকু-আই মীন দুগার কাকু, অপরাজিতা ছিল।

—অপরাজিতার মা আর ডক্টর স্মিথ?

—না জ্যেঠিমা ছিলেন না। রমলা দেবী তার মিনিটখানেক আগেই ঘরে ঢুকেছেন। অথবা হয়তো দেড় মিনিট—

বাসু জানতে চান, এক-মিনিট না দেড় মিনিট! এভাবে বলার মানে?

কামাল হেসে বললে, কৌশিকবাবুর ‘কাঁটা সিরিজে’র অনেক গল্পই আমার পড়া আছে, স্যার। আমি বলতে চাই : স্টাডিরুমে ফায়ার করে বৈঠকখানায় এসে পৌঁছতে যে সময় লাগে তার চেয়ে কম সময়। তাছাড়া ঘরটা ভিতর থেকে বন্ধ ছিল, স্যার। এটা সিম্পল কেস অব সুইসাইড।

হরেনবাবু জানতে চান, আপনি স্যার এঁকে আর কিছু জিজ্ঞাসা করবেন?

বাসু বললেন, না!

কামালুদ্দীন রহমানের পরে এল ডক্টর সলিল মিত্র। প্রতি সপ্তাহে সে একবার করে মোহনমঞ্জিলে আসে। বুড়ো-বুড়ির রক্তচাপ পরীক্ষা করতে। সলিল মোহনপুরেই প্র্যাকটিস করে। সবাইকে খুব ভালভাবে চেনে। গতকালই সে রায়বাহাদুরের রক্তচাপ পরীক্ষা করে দেখেছে। সেটা স্বাভাবিকই ছিল। ও যখন রুগী দেখতে আসে অপরাজিতা ‘রক্তচাপ খাতা’- খানা হাতে হাজিরা দেয়। বুড়োকর্তার বি. পি. দেখা শেষ হলে ডাক্তার মিত্রকে পথ দেখিয়ে তিনতলায় নিয়ে যায়। শশীকলার প্রেশার দেখাতে। তারপরেও কিন্তু ডাক্তারবাবুর ছুটি হয় না। অপরাজিতার ঘরে তাকে গিয়ে বসতে হয়। দশরথদা নানানরকম খাবার বানিয়ে নিয়ে আসে, অপরাজিতার নির্দেশমতো—হিঙের কচুরি, মাছের চপ, ছানার জিলিপি, ক্যারামেল পুডিং—এক-একদিন এক-একরকম। ফলে সলিল প্রায় ঘরের মানুষ হয়ে গেছে। রক্তচাপ দেখে যাবার জন্য সে কিছুতেই কোনও ‘ফি নেয় না। হয়তো সেজন্যই অপরাজিতার ঘরে বসে তাকে আতিথেয়তার বিড়ম্বনা সহ্য করতে হয়। সলিলও জানালো, রায়বাহাদুরের শরীর বা মনে ইদানীংকালে তেমন কিছু পরিবর্তন হয়নি। প্রায় দিনদশেক হল তিনি একটু অতিরিক্ত মাত্রায় গম্ভীর হয়ে গিয়েছিলেন শুধু। পরপর দু-সপ্তাহ দাবা খেলেননি। পুকুরে স্নান করতে যাওয়া ত্যাগ করেছিলেন। তবে আত্মহত্যা করার মতো মর্মান্তিক কোনও ঘটনার বিষয়ে কোনও কথা সে জানে না।

বাসু জানতে চান, আমাকে তিনি ডেকে পাঠিয়েছিলেন, হেতুটা জানাননি। লিখেছিলেন, ‘সাক্ষাতেই’ কথা হবে। এক্ষেত্রে আমাদের সাক্ষাতের ঠিক পূর্বমুহূর্তে আত্মহত্যা করাটা কি অস্বাভাবিক নয়?

—কিন্তু আমরা তো জানি না, উনি কোন্ তাৎক্ষণিক আবেগে আত্মহত্যা করলেন। তাছাড়া ত্রিভুবনে ওঁর কোনও শত্রু ছিল বলে শুনিনি। তা থাকলেও রুদ্ধদ্বার কক্ষে তাঁর নিজের রিভলভারে তাঁকে কে গুলি করতে পারে?

হরেনবাবু জানতে চান, রায়বাহাদুরের অবর্তমানে সম্পত্তিটা কে পাবে?

—আমি ঠিক জানি না। উইল না করে থাকলে স্ত্রী ও কন্যা।

বাসু জানতে চান, শুনেছি রায়বাহাদুর দুবার বিবাহ করেছিলেন। সে ক্ষেত্রে প্রশ্ন : শশীকলা কি অপরাজিতার গর্ভধারিণী না বিমাতা?

ডক্টর মিত্র অসহিষ্ণুর মতো বলে ওঠে, এসব কথা কেন উঠছে?

—কী আশ্চর্য! সেকথাই তো এতক্ষণ বোঝালাম। আত্মহত্যা না হলে…

ডক্টর মিত্র দৃঢ়ভাবে দু-দিকে মাথা নেড়ে বললে, সরি স্যার, আপনার ও প্রশ্নের জবাব আমি দেব না। আপনি ‘মা’ অথবা ‘মেয়েকেই’ প্রশ্নটা জিজ্ঞাসা করে জেনে নেবেন।

—কেন? তুমি কি এ-প্রশ্নের জবাবটা জান না? –

—আমি সত্যবদ্ধ। আমি জানি, কিন্তু বলব না!–বাসু জানতে চান

—অল রাইট! দেন য়ু আর এক্সকিউজ ডঃ মৈত্র। আপনি আসতে পারেন।

সলিল উঠে দাঁড়ায়। বলে, আমার নাম ডক্টর ‘মিত্র’, ‘মৈত্র’ নয়।

বাসু শ্রাগ করে বলেন, রিয়্যালি? আপনি জানেন, কিন্তু বলবেন না শুনে আমি ভেবেছিলাম আপনার নাম ডঃ হেরম্বচন্দ্র মৈত্র।

দারোগা বলে ওঠেন, আপনি সব গুলিয়ে ফেলছেন স্যার। ‘হেরম্ব’ নয় হরেন্দ্র! কিন্তু সেটা তো আমার নাম, তাও ‘মৈত্র’ নয়, ‘দত্ত’!

বাসু আকাশপানে তাকিয়ে বললেন, আয়াম সো সরি।… ‘শিরসি মা লিখ, মা লিখ, মা লিখ!’