দর্পণে প্রতিবিম্বিত কাঁটা – ১

এক

কফি পট থেকে পেয়ালায় কফি ঢালতে ঢালতে রানীদেবী আড়চোখে দেখলেন টেবিলের অপরপ্রান্তে বাসুসাহেব পকেট থেকে সেই চিঠিখানি তৃতীয়বার বার করছেন। রানু বলেন, বুড়ো বয়সে কার প্রেমপত্র পেলে বল তো? বার বার পড়েও তৃপ্তি হচ্ছে না?

–প্রেমপত্র! ও! এই চিঠিখানা? হ্যাঁ, সকালের ডাকে পাওয়া এই চিঠিখানা আমার মানসিক স্থৈর্যে ব্যাঘাত ঘটিয়েছে বটে। না, এবার এ-কোন মহিলার লেখা চিঠি নয়।

পেয়ালায় চামচ নাড়তে নাড়তে রানু বলেন, ‘এবার মহিলার চিঠি নয়’ মানে? কোবার ছিল মহিলার চিঠি?

—মনে নেই? বহুদিন আগে মেরীনগর থেকে মিস্‌ পামেলা জনসন আমাকে একটি দুর্বোধ্য চিঠি লিখেছিলেন।

—ও হ্যাঁ, সেই সময় সারমেয় গেন্ডুকের কাঁটায়!

—এবারও অবস্থা প্রায় সেইরকম। অথবা বলা যায় আরও রহস্যময়। কারণ সেবার পত্রপ্রেরকের ঠিকানাটা অন্তত চিঠির মাথায় লেখা ছিল। এবার তাও নেই।

—তাহলে তুমি জবাব দেবে কী করে?

—জবাব দিতে হবে না। পত্রলেখক বারণ করেছেন জবাব দিতে। অবশ্য বারণ না করলেও জবাব দিতে পারতাম না, ঠিকানার অভাবে।

—বুঝলাম। তা কী চান ভদ্রলোক?

—তুমি নিজেই পড়ে দেখ।

বছরের প্রথম। বৈশাখ মাস। বসন্ত বিদায় নিচ্ছে। নিউ আলিপুরের নিষ্পাদশ প্রাসাদারণ্যের কোনও ঝোপে-ঝাড়ে লুকিয়ে একটা কোকিল সকাল থেকে একটানা ডেকে চলেছে। বেচারি এখনও বোধকরি তার সঙ্গীনিকে খুঁজে পায়নি। বাৎসরিক মিলনোৎসবটা বন্ধ আছে এই শেষ বসন্তে।

সুজাতা আর কৌশিক কয়দিনের জন্য নিউজলপাইগুড়ি গেছে। কী একটা তদন্তে। আজই সকালের ট্রেনে ফেরার কথা। ট্রেন বোধকরি যথারীতি লেট। তাই বুড়ো-বুড়ি দুজনে সকালে ব্রেকফাস্টে বসেছেন নিরালায়। দ্বারপ্রান্তে বিশে অবশ্য দাঁড়িয়ে আছে খিদমৎগার হিসেবে।

বাসুসাহেবের হাতে বিগত তিন-চার মাস কোনও উল্লেখযোগ্য কেস আসেনি। ড্রেস- রিহার্সালের কাঁটাটি সমুৎপাটনের পরে আর কেউ বাসুসাহেবের দ্বারস্থ হয়নি। সুকৌশলীর কিন্তু কাজ আসছে। অধিকাংশই মামুলী কেস। ‘পাত্র-পাত্রী’ ফাইলটা ক্রমশ মোটা হচ্ছে। অর্থাৎ পুত্র ও কন্যার বিবাহ প্রস্তাব পাকাপাকি হবার উপক্রম হলে উদ্বিগ্ন বাবা-মা সুকৌশলীর দ্বারস্থ হন, আজকাল। পাত্রটি ড্রাগ-অ্যাডিক্ট কি না, পাত্রীটির সঙ্গে পাড়াতুতো কোনও দাদার ‘লটঘট’ আছে কি না, এসব তদন্ত করে দেখতে হয়। এ-জাতীয় কেসে ফিজ কম। কাজের হাঙ্গামাও অবশ্য কম। অন্তত বোমা-পিস্তলে আহত হবার আশঙ্কা নেই। উপরন্তু ফিজ-এর অতিরিক্ত একদিন বিয়ে কিংবা বৌভাতের নিমন্ত্রণে যুগলে ভালমন্দ আহার করে আসে। তেমনি কোনও একটা কাজে ওরা দুজনে একত্রে গেছে উত্তরবঙ্গে।

বাসুসাহেব রানীদেবীর দিকে বাড়িয়ে ধরেন সকালের ডাকে পাওয়া বিচিত্র চিঠিখানি। মোটা কাগজের দামী লেফাফা। রানীদেবী ভিতর থেকে যে চিঠিখানি বার করলেন সেটাও দামী কাগজ। পত্রলেখক মোটা মোটা ইংরেজি হরফে চিঠিখানি লিখেছেন। পত্রে নিজের নাম ও ইংরেজি হরফে আংশিক ঠিকানাটার উল্লেখ আছে। পুরো ঠিকানা নয়। অনুবাদে চিঠিটি এইরূপ নেবে :

“মোহনমঞ্জিল মোহনপুর

শ্রীল শ্রীযুক্ত বাবু প্রসন্নকুমার বাসু,

মহিমাৰ্ণবেষু,

এ মঞ্জিলে এমন একটি সমস্যা ঘনিয়ে উঠেছে যা অত্যন্ত সাবধানে এবং সংগোপনে সমাধান করার প্রয়োজন। আপনার কণ্টকাকীর্ণ পথের বিভিন্ন মোড়ে বিচিত্র সাফল্যের বিষয়ে আমি সমধিক অবহিত। তাই সম্পূর্ণ দায়িত্বটা আপনার বিচক্ষণ হস্তেই প্রদান করতে ইচ্ছুক। অতি সম্প্রতি আমি বুঝতে পেরেছি যে, আমার সম্মান এবং আমাদের পারিবারিক সুনাম ভূলুণ্ঠিত করার একটি ষড়যন্ত্র সঙ্গোপনে করা হয়েছে। আমি পুলিশ বা আইনের সাহায্য নিতে অসমর্থ এবং অনিচ্ছুক। গোপনীয়তার হেতুতে। এদিকে যা করণীয় তা আমি করছি, কিন্তু হয়তো আপনাকে সশরীরে উপস্থিত হয়ে আমার সমস্যার চূড়ান্ত সমাধানটি করে দিয়ে যেতে হবে। সে প্রয়োজন হলেই আমি আপনাকে টেলিফোন/টেলিগ্রাম করব। আপনি তৈরি হয়ে থাকবেন। এ চিঠির উত্তর না পেলেই আমি খুশি হব। ইতি—

ভবদীয়

রায়রায় জগদীন্দ্রনারায়ণ শেঠ বাহাদুর।”

—রানীদেবী বললেন, ‘রায়’-এর দ্বিত্ব প্রয়োগটা হল কী কারণে?

একটা ‘রায়’ হচ্ছে উপাধি; দ্বিতীয়টা ‘রায়বাহাদুরের’ মুণ্ডুটা। বোঝা যায় লোকটার অনেক টাকা। ‘রায়বাহাদুর’ উপাধি পেয়েছিল অনেকদিন আগে। প্রাকৃস্বাধীনতা যুগে। ফলে যথেষ্ট বয়স। হয়তো আমার চেয়ে বয়সে বড়। এ ছাড়া বেশ দাম্ভিক। একবারও তার মনে হয়নি যে, আমি কাজটা নাও নিতে পারি। ফিজ-এর প্রসঙ্গ তোলেইনি। যেন আমি তার হুকুমে চলব! কিন্তু নিজের ঠিকানাটা সে গোপন করল কেন? বেশ বোঝা যায়, একটা ‘লেটারহেড থেকে কাগজটা ছিঁড়ে নেওয়া হয়েছে, আর তারপর কাঁচি দিয়ে ঠিকানাটা কেটে বাদ দেওয়া হয়েছে।

—সেটা বুঝলে কেমন করে?

—লক্ষ্য করে দেখ, কাগজটার ওপরের প্রান্ত নিচের প্রান্তের সঙ্গে সমান্তরাল নয়। অর্থাৎ কাঁচি দিয়ে কাটবার আগে সেট-স্কোয়ার ধরে পেনসিলের দাগ দিয়ে দেওয়া হয়নি।

—তা তুমি কী স্থির করলে? যাবে? না যাবে না?

—বলটা এখন জগদীন্দ্রনারায়ণের কোর্টে। আগে দেখি তিনি ফোরহ্যান্ড ড্রাইভ করেন, না ব্যাকহ্যান্ড।

—অর্থাৎ টেলিগ্রাম করেন, না টেলিফোন, এই তো? টেলিফোন করলে তবু তাঁর সঙ্গে দুটো কথা বলার সুযোগ পাবে; কিন্তু টেলিগ্রাম করলে? যাবে?

—কোন্ চুলোয়?

—’চুলোর’ নির্দেশ নিশ্চয় থাকবে টেলিগ্রামে।

বাসুসাহেব জবাব দেবার সুযোগ পেলেন না। তখনি একটা ট্যাক্সি এসে দাঁড়ালো বাইরের পোর্টিকোতে। দ্বারপ্রান্তে দণ্ডায়মান বিশে ঘোষণা করে, দাদাবাবুরা এসে গেলেন মনে লাগে।

একটু পরেই স্যুটকেস আর কাঁধব্যাগ নিয়ে সুজাতা আর কৌশিক প্রবেশ করল। বাসু বললেন, কত লেট ছিল আজ, কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেস?

কৌশিক সেকথার জবাব না দিয়ে জানতে চায়, কফি পটে তলানিতে কিছু আছে?

এবার জবাব দেয় বিশে, ঠাণ্ডা-কফি খাবেন কেন? এক্ষুনি গরম কফি নেদিচ্ছি? আর কিছু? ডিম-টোস্ট?

সুজাতা বলল, না রে। সকালে ট্রেন লেট হচ্ছে দেখে আমরা ব্রেকফাস্ট ট্রেনেই সেরে নিয়েছি। তাই শুধু দু-কাপ কফি নিয়ে আয়। আমারটা-র।

ওরা দুজন বসল দুটি সোফায়।

রানী বলেন, তোমাদের মামু আজ সকালের ডাকে একটা মিস্টিরিয়াস চিঠি পেয়েছেন—

সুজাতা মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলে, ‘সারমেয় গন্ডুকের’ উল্লেখ আছে নাকি তাতে?

বাসু বললেন, না নেই। তবে সেই জাতীয় রহস্যময়ই। চিঠিটা পড়ে দেখ।

সুজাতা হাত বাড়িয়ে চিঠিখানা নিয়ে পড়ল। তারপর বাড়িয়ে ধরল তার সিনিয়ার পার্টনারের দিকে।

কৌশিকও পড়ল। দুজনের দৃষ্টি বিনিময় হল। কৌশিক বললে, উই আর ইন দ্য সেম বোট, সুজাতা। মামুকে সব কথা খুলে বলতে পার।

—সব কথা মানে? কিসের কথা? জানতে চান বাসু।

—’রায় রায় জগদীন্দ্রনারায়ণ শেঠ বাহাদুর’ এককালে আমাদের ক্লায়েন্ট ছিলেন। বছর তিনেক আগে তাঁর পত্নীর আহ্বানে ওই ‘মোহনমঞ্জিল’-এ আমাদের দুজনকে আতিথ্য নিতে হয়েছিল—ওঁর একটা সমস্যার সমাধানে।

—আই সি! তা ‘মোহনমঞ্জিল’টা কোথায়?

—মুর্শিদাবাদ বা লালগোলা লাইনে বেলডাঙা স্টেশন থেকে মাইল দশেক ভিতরে একটা বর্ধিষ্ণু গ্রাম ‘মোহনপুর’-এ।

—মোহনপুরের মোহনমঞ্জিল? এই শ্রীল শ্রীযুক্ত ‘মোহন’টি কে? জগদীন্দ্রনারায়ণের পূর্বপুরুষ?

—আপনি ঠিকই ধরেছেন মামু! কিন্তু এখনও বুঝতে পারেননি যে, ওই ‘মোহন ‘ আপনারও সুপরিচিত।

—আমার সুপরিচিত? গত শতাব্দীর দুজন ‘মোহনকে আমি চিনি। দুজনেই সঙ্গীতজ্ঞ। মোহনচাঁদ বোস- ‘হাফ-আখড়াই’ গানের প্রবর্তক। আর একজন মোহন বৈরাগী -ঢপ কেত্তনে নাম করেছিলেন। তা ইনি কি–

—না, মামু। ইনি সঙ্গীতজ্ঞ নন। অসিচালনায় দক্ষ ছিলেন। গত শতাব্দীরও নন। তার আগের শতাব্দীতে। পলাশী যুদ্ধের শহিদ – মীরমদনের সতীর্থ মোহনলাল!

বাসু রীতিমতো চমকে ওঠেন, বল কি! সেই মোহনলালের উত্তরপুরুষ এই জগদীন্দ্রনারায়ণ শেঠ?

—আজ্ঞে হ্যাঁ। অনেক পরিশ্রম করে তথ্যটা আমরা অবিষ্কার করেছিলাম। সে এক মস্ত কাহিনী। শুনুন-

রানীদেবী বাধা দেন, সারারাত ট্রেনের ধকল গেছে। এখন কফিটা গিলে স্নান টান সেরে ঘরোয়া হও প্রথমে।

কৌশিক বলে, না, না, আমার কিছু ক্লান্ত বোধ হচ্ছে না মামী, ট্রেন জার্নিতে–

আবার বাধা দিয়ে রানী বলেন, তোমার ক্লান্তির কথা আমি বলিনি, কৌশিক। সুজাতা, তুমি ওঠ। অসময়ে তোমাকে আবার কফি খেতে হবে না। বদ অভ্যাসটা একেবারে ছাড়তে না পার তো, এই ক-মাস আমার কথামতো একটু সামলে চল অদ্ভুত।

সুজাতা রীতিমতো অপ্রস্তুত হয়ে উঠে দাঁড়ায়। কৌশিকও বোকার মতো মাথা চুলকায়। রানী আবার বলেন, আর একটা কথা, কৌশিক। এই নিউজলপাইগুড়িই হচ্ছে তোমাদের লাস্ট টিপ। এরপর থেকে তুমি একা একাই তোমার ওই সুকৌশলীর তদন্তে যেও। সুজাতা আর বাড়ি থেকে বের হবে না! এ-কমাস।

বাসু বলেন, কারেক্ট! কাটা নিয়ে কাঁটা-ছেঁড়া অনেক হয়েছে। আর কাঁটা নয়। এখন ফুল ফোটানোর সময় —’যে পারে সে আপনি পারে, পারে সে ফুল ফোটাতে।’

আবার ধমক দেন রানী, তুমি থাম তো! তোমাকে আর কবিত্ব করতে হবে না।

বাসুও অপ্রস্তুত! বলেন, ও আয়াম সরি!

আমি—মানে এ কাহিনীর লেখকও, ‘সরি’! আমিও আপনাদের একটা জরুরি সংবাদ দিতে ভুলেছি। সেই কথা আগেই আমার বলা উচিত ছিল। একটা সুসংবাদ : ‘সকল কাঁটা ধন্য করে’ নিউ আলিপুরের ওই বাড়িটায় একটা গোলাপ ফুল ফোটার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।

এইখানে কিছুটা ব্যাখ্যার প্রয়োজন। কী জানেন, সে সময় নবকল্লোল মাসিক পত্রিকায় আমার সপ্তদশতম কাঁটার কাহিনীটা ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হচ্ছিল : ড্রেস রিহার্সালের কাঁটা। সেই সময় একটি সাহিত্য আড্ডায় এক ভদ্রমহিলার সঙ্গে আলাপ হল। বছর চল্লিশ বয়স, কোন স্কুলে বুঝি বাংলা অথবা ইতিহাস পড়ান। হঠাৎ আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, সোনার কাঁটা গল্পটা আপনি কত সালে লিখেছিলেন?

বললাম, চুয়াত্তর সালে।

—তার মানে তেইশ বছর পার হয়ে গেছে। তা… ইয়ে… শারীরিক ত্রুটিটা কার? কৌশিক না সুজাতার?

আমি বলি, ওদের কোনও শারীরিক ত্রুটি আছে বলে তো আমি জানি না।

— আপনি না জানলে সেটা কে জানবে? প্রকাশক, সম্পাদক, প্রুফ রিডার না কম্পোজিটার?

আমি হালে পানি পাই না।

উনি আবার ধমকে ওঠেন, ওদের বাচ্চা-টাচ্চা হচ্ছে না কেন? আপত্তিটা কার? যদি শারীরিক ত্রুটি না-ই থাকে? কৌশিক নয় নিশ্চয়, পুরুষ মানুষ সচরাচর এসব ব্যাপারে নির্লিপ্ত। তাহলে কার? সুজাতার? ফিগার খারাপ হয়ে যাবে? এই তো? কিন্তু তাই বলে তেইশ বছর! মাই গড! সুজাতার ন্যাকামির তো একটা সীমা থাকবে! ও কী চায়? ‘ম্যানোপজ’-এর পর বাচ্চা? আপনি নিজে কদ্দূর জানেন সেটা বলুন দেখি? ওরা দুজন কি ডাক্তার দেখিয়েছে? নাকি ওরা সেই লালত্রিকোণের চক্করে পড়েছে! ওদের মতো অত্যন্ত ইন্টেলিজেন্ট কাল-এর বাচ্চা না হলে দেশের কী হাল হবে জানেন? হাওলা-গাওলাদের অপোগণ্ড বাচ্চায় দেশটা ভরে যাবে! আপনার সেসব খেয়ালই নেই! তেইশ বছর ধরে ক্রমাগত কাঁটার পাহাড় বানিয়ে চলেছেন! ডাইনে কাঁটা, বাঁয়ে কাঁটা, সামনে কাঁটা, পিছনে কাঁটা। একটা কাঁটা উগরে ফেলতে না ফেলতে আরেকটা কাঁটা। কী পেয়েছেন আপনি! অ্যাঁ?

সেদিনই মনস্থির করেছিলাম, বুয়েছেন? ঘুম-না-আসা-রাত্রে কৌশিক আর সুজাতাকে পাকড়াও করলাম। প্রথমটায় ওরা কিছুতেই রাজি হতে চায় না। বলে, এতে নাকি ওদের সুকৌশলীর কাজে ঝামেলা হবে। ওরা বরং প্রয়োজনে কোনও অনাথ আশ্রম থেকে সদ্যোজাত কোনও বাচ্চা এনে প্রতিপালন করবে।

আমি ওদের বোঝাবার চেষ্টা করলাম, সেটা একদিক থেকে খুবই ভাল কথা। একটা অনাথ বাচ্চা মানুষ হয়ে যাবে। কিন্তু তোমাদের পরিবারে অজানা ‘জিনস্’-এর একটা হেরিডিটি- ফ্যাকটর এসে যাচ্ছে তো? তাছাড়া আজকাল আবার নতুন এক বখেড়া শুরু হয়ে গেছে : এইড্‌স!

কৌশিক আমাকে ধমকে ওঠে, থামুন তো আপনি! যতসব আবোলতাবোল অলুক্ষণে কথা!

সুজাতা কিন্তু আমাকে সমর্থন করলো। বলল, দাদু কথাটা কিন্তু মিছে বলেনি।

কৌশিক বলে, তার মানে তুমি রাজি?

দারুণ লজ্জা পেল সুজাতা। আমি তাড়াতাড়ি কথা ঘোরাতে বলি, তোমার কোনও অসুবিধা হবে না, সুজাতা-দিদি। বিশে তো আছেই। তাছাড়া শুনেছি, বিশের দেশের বাড়িতে এক দিদি আছে। তোমার চেয়ে বয়সে ছোট। স্বামীত্যক্তা। মানে ও নিজেই পালিয়ে এসেছে। স্বামীর মারের হাত থেকে রেহাই পেতে। যেমন মদ্যপ তেমনি নিষ্ঠুর। ছেলেপিলে নেই তাকেও বরং আলিপুরের বাড়িতে নিয়ে আসব?

সুজাতা জানতে চায়, মেয়েটা রাজি হবে তো?

আমি হেসে বাঁচিনে। বলি, কী পাগল মেয়ে গো তুমি, সুজাতা। কলমটা তো আমার হাতে! রাজি হবে না মানে? তাকে ঘাড় ধরে আলিপুরে নিয়ে আসব। তার নাম ফুট্‌কি। সেই মেয়েটাই তোমার খোকার দেখভাল করবে!

কৌশিক আমাকে এখানে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে বলে, আপনি নিশ্চিত জানেন, দাদু? ছেলেই হবে ওর? মেয়ে নয়?

কী বোকা ওরা! গবেট দুটো বোঝে না: কলমটা আমার হাতে। xx না xy তা স্থির করব আমিই। ভাগ্যবিধাতা নন। আমি সুজাতার দিকে ফিরে জানতে চাই : তোমার কী ইচ্ছে? খোকা না খুকু?

সুজাতা আমার দিকে তার বড় বড় চোখ মেলে তাকায়। কী লাজুক মিষ্টি দৃষ্টি! কী একটা কথা বলতে যায়—বলা হয় না। তার আগেই তোমাদের দিদা—মানে আমার গিন্নি, ও-পাশের খাট থেকে নেমে এসে আমাকে অ্যাইসা এক ঠেলা মারেন! বলেন, সারা রাত আপনমনে কী বকবক কর বলতো? তুমিও কি আজকাল কমলাকান্ত চাটুজ্জের মতো আফিং-টাপিং ধরেছ নাকি?

ঘুমটা ভেঙে গেল। স্বপ্নটাও। কিন্তু তখনই মনস্থির করে ফেললাম। আর কাঁটা নয়, ‘গোলাপ’!

সুজাতার এটা পাঁচ মাস!