দক্ষিণরায়

দক্ষিণরায়

চাটুজ্যেমশায় বলিলেন—’বাঘের কথা যদি বল, তো রুদ্রপ্রয়াগের বাঘ। ইয়া কেঁদো কেঁদো। সোঁদরবন থেকে সেখানে গ্রীষ্মকালে হাওয়া বদলাতে যায়। কিন্তু এমনি স্থানমাহাত্ম্য যে কাউকে কিছু বলে না, সব তীর্থযাত্রী কিনা। কেবল সায়েব ধ’রে ধ’রে খায়।’

বিনোদ উকিল বলিলেন—’খাসা বাঘ তো। এখানে গোটাকতক আনা যায় না? চটপট স্বরাজ হয়ে যেত,—স্বদেশী, বোমা, চরকা, কাউন্সিল—ভাঙা কিছুই দরকার হ’ত না।’

সন্ধ্যাবেলা বংশলোচনবাবুর বৈঠকখানায় গল্প চলিতেছিল। তিনি নিবিষ্ট হইয়া একটি ইংরেজী বই পড়িতেছেন—How to be happy though married। তাঁর শালা নগেন এবং ভাগনে উদয়, এরাও আছে।

চাটুজ্যে হুঁকায় একমিনিটব্যাপী একটি টান মারিয়া বলিলেন—’তুমি কি মনে কর সে চেষ্টা হয় নি?’

—’হয়েছিল নাকি? কই, রাউলাট—রিপোর্টে তো সে কথা কিছু লেখেনি।’

—’ভারী এক রিপোর্ট পড়েছ। আরে গবরমেণ্ট কি সবজান্তা? There are more things…কি বলে গিয়ে।’

—’ব্যাপারটা কি হয়েছিল খুলেই বলুন না।’

চাটুজ্যে ক্ষণকাল গম্ভীর থাকিয়া বলিলেন—’হুঁ।’

নগেন বলিল—’বলুন না চাটুজ্যেমশায়।’

চাটুজ্যে উঠিয়া দরজা ও জানালায় উঁকি মারিয়া দেখিলেন। তারপর যথাস্থানে আসিয়া পুনরায় বলিলেন—’হুঁ।’

বিনোদ। দেখছিলেন কি?

চাটুজ্যে। দেখছিলুম হরেন ঘোষালটা আবার হঠাৎ এসে না পড়ে। পুলিশের গোয়েন্দা, আগে থেকে সাবধান হওয়া ভাল।

বংশলোচন বই রাখিয়া কহিলেন—’ওসব ব্যাপার নাই বা আলোচনা করলেন। হাকিমের বাড়ি ওরকম গল্প না হওয়াই ভাল।’

চাটুজ্যে বলিলেন—’ঠিক কথা। আর, ব্যাপারটাও বড় অলৌকিক, শুনলে গায়ে কাঁটা দেয়। নাঃ, যাক ও কথা। তারপর, উদো, তোর বউ বাপের বাড়ি থেকে ফিরছে কবে?’

বিনোদ উদয়কে বাধা দিয়া বলিলেন—’ব্যাপারটা শুনতেই বা দোষ কি। চলুন আমার বাসায়, সেখানে হাকিম নেই।’

বংশলোচন বলিলেন, ‘আরে না না।’ এখানেই হ’ক। তবে চাটুজ্যেমশায়, বেশী সিডিশস কথাগুলো বাদ দিয়ে বলবেন।’

চাটুজ্যেমশায় বলিলেন—’মা ভৈঃ। আমি খুব বাদসাদ দিয়েই বলছি—বেশীদিনের কথা নয়, বকু দত্তর নাম শুনেছ বোধ হয়, আমাদের মজিলপুরের চরণ ঘোষের মেসো—’

বিনোদ। বকুলাল দত্ত? কপালীটোলায় যার মস্ত বাড়ি ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্ট ভাঙছে? তিনি তো মারা গেছেন, শুনেছি কাউন্সিলে ঢুকতে পারেন নি ব’লে মনের দুঃখে।

চাটুজ্যে। ছাই শুনেছ। বকুবাবু আছেন, তবে এখন চেনা দুষ্কর। এক আনা খরচ করলেই দেখে আসতে পার, কেবল রবিবার বিকেলে এক টাকা।

বিনোদ। কী রকম?

চাটুজ্যে। বুদ্ধির দোষে বেচারা সব নষ্ট করলে—অমন মান, অমন ঐশ্বর্য। বাবার কৃপা হয়েছিল, কিন্তু শেষটায় বকুর মতিচ্ছন্ন হ’ল।

বিনোদ। কোন বাবা?

চাটুজ্যে। বাবা দক্ষিণরায়।

উদয় বলিল—’আমার এক পিসশ্বশুরের নাম দক্ষিণামোহন রায়।’

চাটুজ্যে। উদো, তুই হাসালি, হাসালি। পিসশ্বশুর নয় রে উদো—দেবতা, কাঁচা—খেকো দেবতা, বাঘের দেবতা।

চাটুজ্যে হাতজোড় করিয়া তিনবার কপালে ঠেকাইলেন। তারপর সুর করিয়া কহিতে লাগিলেন—

‘নমামি দক্ষিণরায় সোঁদরবনে বাস,

হোগলা উলুর ঝোপে থাকেন বারোমাস।

দক্ষিণেতে কাকদ্বীপ শাহাবাজপুর,

উত্তরেতে ভাগীরথী বহে যত দূর,

পশ্চিমে ঘাটাল পুবে বাকলা পরগণা—

এই সীমানার মাঝে প্রভু দেন হানা।

গোবাঘা শার্দুল চিতে লক্কড় হুড়ার,

গেছো—বাঘ কেলে—বাঘ বেলে—বাঘ আর।

ডোরা কাটা ফোঁটা—কাটা বাঘ নানা জাতি—

তিন শ তেষট্টি ঘর প্রভুর যে জ্ঞাতি।

প্রতি অমাবস্যা হয় প্রভুর পুণ্যাহ,

যত প্রজা ভেট দেয় মহিষ বরাহ।

ধুমধাম নৃত্য গীত হয় সারানিশি,

গাঁক গাঁক হাঁক ডাকে কাঁপে দশদিশি।

কলাবৎ ছয় বাঘ ছত্রিশ বাঘিনী,

ভাঁজেন তেঅটতালে হালুম্ব রাগিণী।

ডেলা ডেলা পেলা দেন শ্রীদক্ষিণ রায়,

হরষিত হঞা সবে কামড়িয়া খায়।

প্রভুর সেবায় হয় জীবহিংসা নিত্য,

পহরে পহরে তাঁর জ্ব’লে উঠে পিত্ত।

বড় বড় জন্তু প্রভু খান অতি জলদি,

হিংসার কারণে তাঁর বর্ণ হৈল হলদি।

ছাগল শুয়ার গরু হিন্দু মুছলমান ,

প্রভুর উদরে যাঞা সকলে সমান।

পরম পন্ডিত তেঁহ ভেদজ্ঞান নাঞি,

সকল জীবের প্রতি প্রভুর যে খাঁঞি।

দোহাই দক্ষিণরায় এই কর বাপা—

অন্তিমে না পাঞি যেন চরণের থাপা।’

বিনোদ বলিলেন—’ও পাঁচালি কোত্থেকে পেলেন?’

চাটুজ্যে। রায়মঙ্গল। আমার একটা পুঁথি আছে, তিন শ বছরের পুরনো। সেটা নেবার জন্যে চিমেশ মিত্তির ঝুলোঝুলি। ছোকরা তার উপর প্রবন্ধ লিখে ইউনিভার্সিটি থেকে ডাক্তার উপাধি পেতে চায়। দেড় শ অবধি দিতে চেয়েছিল, আমি রাজী হইনি। প্রবন্ধ লিখতে হয় আমিই লিখব। নাড়ীজ্ঞান আছে, ডাক্তার হতে পারলে বুড়ো বয়সের একটা সম্বল হবে।

বিনোদ। যাক তার পর?

চাটুজ্যে। বকুলালবাবুর কথা বলছিলাম। পনর বৎসর পূর্বে তাঁর অবস্থা ভাল ছিল না। পরিবার দেশে থাকত, তিনি কলকাতার একটা মেসে থেকে রামজাদু অ্যাটর্নির আপিসে আশি টাকা মাইনের চাকরি করতেন। রামজাদুবাবু তাঁর ক্লাস—ফ্রেণ্ড, সেই সূত্রে চাকরি। এখন বকুবাবুর একটু হাতটান ছিল। বিপক্ষের ঘুষ খেয়ে একটা সমন ধরাতে দেরি করিয়ে দেন। রামজাদুবাবু কড়া লোক, ছেলেবেলার বন্ধু বলে রেয়াত করলেন না। ব্যাপার জানতে পেরে বকুলালকে যাচ্ছেতাই অপমান করলেন। বকুবাবুও তেরিয়া হয়ে চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে বাসায় চলে এলেন। মন খারাপ, মেসের বামুনকে বললেন রাত্রে কিচ্ছু খাবেন না। তার পর হেদোর ধারে গেলেন মাথা ঠাণ্ডা করতে। রাগের মাথায় চাকরি ছাড়লেন, কিন্তু সংসার চলে কিসে? পুঁজি তো সামান্য। রামজাদুর উপর প্রচণ্ড আক্রোশ হ’ল। আরে উকিলবাড়ি অমন একটু—আধটু উপরি অনেকে নিয়ে থাকে, তা বলে কি পুরনো বন্ধুকে অপমান করতে হয়? আচ্ছা, এর শোধ একদিন বকুলাল নেবেনই।

রাত নটায় মেসে ফিরে এলেন। মেস খাঁ খাঁ, সেদিন শনিবার সব মেম্বার থিয়েটার দেখতে গেছে। বকুলাল নিঃশব্দে বাসায় ঢুকে দেখতে পেলেন রান্নাঘরের ভেতর—

নগেন বলিল—’দক্ষিণরায়?’

চাটুজ্যে বলিলেন—’রান্নাঘরের ভেতর মেসের ঝি বকুবাবুর পশমী আসনে—যেটা তাঁর গিন্নী বুনে দিয়েছিলেন—তাইতে বসে তাঁরই থালায় লুচি খাচ্ছে, মেসের ঠাকুর তাকে বাতাস করছে। ঝি আধ হাত জিব কেটে দেড় হাত ঘোমটা টানলে। অন্য দিন হ’লে বকুবাবু কুরুক্ষেত্র বাধাতেন, কিন্তু আজ দেখেও দেখলেন না। চুপটি ক’রে ওপরে গিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লেন।

তার পর অগাধ চিন্তা। কি করা যায়? কোত্থেকে টাকা আসবে? তাঁর এক বিধবা পিসী হুগলীতে থাকেন, বিপুল সম্পত্তি, ওয়ারিশ একটিমাত্র ছেলে ভুতো। ভুতোছোঁড়া অতি হতভাগা, অল্প বয়সেই অধঃপাতে গেছে। কিন্তু পিসী তাকে নিয়েই ব্যস্ত, অমন উপযুক্ত ভাইপো বকুলালের দিকে ফিরেও তাকান না। বুড়ীর কাছে কোনও প্রত্যাশা নেই।

বকুলাল ভাবলেন, ভগবানের কি বিচার! লক্ষ্মীছাড়া ভুতো হ’ল দশ লাখের মালিক, আর তারই মামাতো ভাই বকুর অদ্যভক্ষ—ধনুর্গুণ। তাঁর ক্লাসফ্রেণ্ড—ঐ বজ্জাত রামজাদুটা—মক্কেল ঠকিয়ে লক্ষ লক্ষ টাকা উপায় করছে, আর তিনি একটি সামান্য চাকরির জন্য লালায়িত। দুত্তোর ভগবান।

কিন্তু বকুলাল তাঁর এক ভক্ত বন্ধুর কাছে শুনেছিলেন, ভগবানকে যদি একমনে ভক্তিভরে ডাকা যায় তা হ’লে তিনি ভক্তের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করেন। আচ্ছা, তাই একবার ক’রে দেখলে হয় না? যে কথা সেই কাজ। বকুলাল তড়াক করে উঠে পড়লেন, স্টোভ জ্বালালেন, চা ক’রে তিন পেয়ালা খেলেন। আজ তিনি ভররাত ভগবানকে ডাকবেন।

বকুলাল আলো নিবিয়ে বিছানায় হেলান দিয়ে শুয়ে তপস্যা শুরু করলেন।— ‘হে ভক্তবৎসল হরি! হে ব্রহ্মা, হে মহাদেব, দয়া কর। সেকালে তোমরা ভক্তের আবদার শুনতে, আজ কেন এই গরিবের প্রতি বিমুখ হবে? হে দুর্গা, কালী, লক্ষ্মী, তোমাদের যে কেউ ইচ্ছে করলে আমার একটা হিল্লে লাগিয়ে দিতে পার। বর দাও—বর দাও—বেশী নয়, মাত্র এক লাখ। উঁহু, এক লাখে কিছুই হবে না,—গিন্নীই গয়না গড়িয়ে অর্ধেক সাবাড় করবেন। রামজেদোটার কিছু কম হবে তো দশ লাখ আছে। আমার অন্তত পাঁচ লাখ চাই—না, না, দশ লাখ। দোহাই দেবতারা, তোমাদের কাছে এক লাখও যা দশ লাখও তাই, তাতে এই বিশ্বসংসারের কোনও ক্ষতিবৃদ্ধি হবে না। অনেককে তো কোটি কোটি দিয়ে থাক, আমায় না হয় মাত্র দশ লাখ দিলে। লাখ টাকায় একটা বাড়ি, হাজার—পঞ্চাশ যাবে ফার্নিচার করতে, তারপর আরও পঞ্চাশ হাজার যাবে এটা—সেটায়। এই ধর একটা ভাল মোটরকার। উঁহু একটায় হবে না, গিন্নীই সেটা আঁকড়ে ধরে থাকবেন, হরদম থিয়েটার আর গঙ্গাস্নান। আচ্ছা তাঁর জন্যে না হয় একটা ফোর্ড গাড়ি মোতায়েন করে দেওয়া যাবে,—সেকেন্ডহ্যাণ্ড ফোর্ড, —মেয়েছেলের বেশী বাড় ভাল নয়। আর ঐ রামজাদুটা—রাসকেলকে কেউ যদি বেঁধে নিয়ে আসে তো ফুটপাথের ওপর তার হামদো মুখখানা ঘষি। ঘষি আর দেখি, যতক্ষণ না চোখ মুখ খয়ে গিয়ে তেলপানা হয়ে যায়। হে বুদ্ধদেব, যিশুখ্রীষ্ট, শ্রীচৈতন্য, আজকের মতন তোমরা আমায় মাপ কর, তোমরা এসব পছন্দ কর না তা জানি। দোহাই বাবাসকল, আজ আমার এই তপস্যায় তোমরা বাগড়া দিও না, এরপর তোমাদের একদিন খুশী করে দেব। হে নারায়ণ, হে দর্পহারী কৃষ্ণ, হে পয়গম্বর, হে ব্রাহ্মের ব্রহ্ম, ইহুদীর যেহোভা, পার্সীর অহুর, দেব দৈত্য যক্ষ রক্ষ, শয়তান—অ্যাঁ! রামো রামো। তা শয়তানেই বা আপত্তি কি, না হয় শেষটায় নরকে যাব। যাক, অত বাছলে চলে না। হে তেত্রিশ কোটির যে কেউ দয়া কর—দয়া কর। আমি একান্তঃকরণে ভক্তিভরে ডাকছি—ধনং দেহি, ধনং দেহি।’

বিনোদবাবু বলিলেন—’ আচ্ছা চাটুজ্যেমশায়, আপনি বকুবাবুর মনের কথা জানলেন কি ক’রে?’

চাটুজ্যে বলিলেন— ‘সে তোমরা বুঝবে না। কলিকাল, কিন্তু প্রকৃত ব্রাহ্মণ দু—চারটি এখনও আছেন। গরিব বটে, কিন্তু কাশ্যপ গোত্র, পদ্মগর্ভ ঠাকুরের সন্তান। কেদার চাটুজ্যের এই বুড়ো হাড়ে ঋষিদের গুঁড়ো বর্তমান। একটু চেষ্টা করলে লোকের হাঁড়ির খবর জানতে পারি, মনের কথা তো কোন ছার। তার পর বকুলালবাবু ঐ রকম একমনে তপস্যা করতে লাগলেন। তাঁর দু—চোখ বেয়ে ধারা বইতে লাগল, বাহ্যজ্ঞান নেই, কেবল ধনং দেহি। এমন সময় নীচে থেকে একটি আওয়াজ এল—টিংটিং। বকুলাল লাফিয়ে উঠে দেশলাই জ্বাললেন, বারান্দায় দাঁড়িয়ে উঠোনে আলো ফেলে দেখলেন—’

নগেন রোমাঞ্চিত হইয়া আবার বলিয়া ফেলিল—’দক্ষিণরায়!’

চাটুজ্যেমশায় মুখ খিঁচাইয়া ভেংচাইয়া বলিলেন—দাক্ষিণরায়! তোমার ম্যাথা! গ্যাল্পোটা তুমিই ব্যালো না, আমি আর ব’কে মরি কেন।’

উদয় খুশি হইয়া বলিল— ‘নগেন মামার ঐ মস্ত দোষ, মানুষকে কথা কইতে দেয় না। আমার শালীর পাকাদেখার দিন—’

চাটুজ্যে অস্থির হইয়া বলিলেন—’আরে গ্যালো যা! একজন থামলেন তো আর একজন পোঁ ধরলেন! যা আমি আর বলব না।’

বিনোদবাবু বলিলেন—’আহা কেন তোমরা রসভঙ্গ কর! ব্রাহ্মণকে বলতেই দাও না।’

চাটুজ্যে বলিতে লাগিলেন—’বকুলালবাবু উঠোনে দেখলেন—ব্রহ্মার হাঁস, শিবের ষাঁড়, বিষ্ণুর গড়ুর কেউই নেই, শুধু এক কোণে একটি লাল বাইসাইকেল ঠেসানো রয়েছে। হেঁকে বললেন—কোন হ্যায়? টেলিগ্রাফ পিয়ন সিঁড়ির দরজায় ধাক্কা দিতে গিয়েছিল, এখন সামনে এসে বললে—তার হ্যায়।

কিসের তার? বকুবাবুর বুক দুরদুর ক’রে উঠল। কই, তিনি তো লটারির টিকিট কেনেন নি। তবে কি গিন্নীর কি ছেলেপিলের অসুখ? আজ বিকেলেই তো চিঠি পেয়েছেন সব ভাল। বকুলাল হুড়মুড় করে নেমে এলেন।

তারের খবর— ভুতো হঠাৎ মারা গেছে, পিসীও এখন তখন, শীগগির চলে এস। বকুবাবু ইয়া আল্লা বলে লাফিয়ে উঠলেন, তার পর মানিব্যাগটি পকেট থেকে বার করে পিয়নের হাতে উবুড় ক’রে দিলেন। পিয়ন বেচারা আসবার আগেই জেনে নিয়েছিল যে খারাপ খবর, বকশিস চাওয়া চলবে না। এখন অযাচিত তিন টাকা ছ আনা পেয়ে ভাবলে শোকে বাবুর মাথা বিগড়ে গেছে। সে সই নিয়েই পালাল।

ভুতো তা হলে মরেছে? সত্যিই মরেছে? বা রে ভুতো, বেড়ে ছোকরা! নিশ্চয় মদ খেয়ে লিভার পচিয়েছিল। জাঁকিয়ে শ্রাদ্ধ করতে হবে। বকুবাবু সেই রাত্রেই হুগলী রওনা হলেন।

বকুবাবুর বরাত ফিরে গেল। তবে দশ লাখ নয়, মাত্র পাঁচ লাখ টাকা। টাকাটা কম হওয়ায় প্রথমটা একটু মন খুঁতখুঁত করেছিল, কিন্তু ক্রমে সয়ে গেল। বাড়ি হ’ল, গাড়ি হ’ল, সব হ’ল। বকুলাল নানারকম কারবার ফাঁদলেন। তারপর যুদ্ধ বাধল, বকুলাল একই মাল পাঁচবার চালান দিতে লাগলেন, ধুলো—মুঠো সোনা—মুঠো হতে লাগল। টাকার আর অবধি নেই, কিন্তু বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বকুর বুদ্ধিটা মোটা হয়ে পড়ল। এই রকমে বছর চোদ্দ কেটে গেল।’….

এই পর্যন্ত বলিয়া চাটুজ্যেমশাই তামাক টানিয়া দম লইতে লাগিলেন। বিনোদবাবু বলিলেন—’কই চাটুজ্যেমশায়, বাঘ কই?’

চাটুজ্যে বলিলেন—’আসবে, আসবে, ব্যস্ত হয়ো না, সময় হলেই আসবে। বকুবাবু যেদিন পঞ্চান্ন বৎসরে পড়লেন, সেই রাত্রে বঙ্গমাতা তাঁকে বললেন— ‘বৎস বকু, বয়স তো ঢের হ’ল, টাকাও বিস্তর জমিয়েছ। কিন্তু দেশের কাজ কি করলে? বকুলাল জবাব দিলেন—মা, আমি অধম সন্তান, বক্তৃতা দেওয়া আসে না, ম্যালেরিয়ার ভয়ে দেশে যেতে পারি না, খদ্দর আমার সয় না—সুখের শরীর—দেশী মিলের ধুতিতেই পেট কেটে যায়। আর—বোমা দূরে থাক,—একটা ভুঁই—পটকা ছোঁড়বার সাহসও আমার নেই। কি কর্তব্য, তুমিই বাতলে দাও। খাটুনির কাজ আর এ বয়সে পেরে উঠব না, সোজা যদি কিছু থাকে তাই ব’লে দাও মা। বঙ্গমাতা বললেন—কাউন্সিলে ঢুকে পড়।

মা তো ব’লে খালাস, কিন্তু ঢোকা যায় কি ক’রে? বকুলাল মহা ফাঁপরে পড়লেন। অনেক ভেবে—চিন্তে একজন মাতব্বর সায়েবকে ধ’রে বললেন—তিন হাজার টাকা ড্রংকেন সেলার্স হোমে দিতে রাজী আছেন যদি গবরমেণ্ট তাঁকে কাউন্সিলে নমিনেট করে। সায়েব বললেন—টাকা তিনি গ্ল্যাডলি নেবেন, কিন্তু প্রতিশ্রুতি দিতে পারবেন না, কারণ গবরমেণ্ট যার—তার কাছে ঘুষ নেয় না। বকুবাবু মুখ চুন ক’রে ফিরে এলেন। তার পর একজন রাজনীতিক চাঁইকে বললেন—আমি ইলেকশনে দাঁড়াতে চাই, আমায় দলে ভরতি ক’রে নিন, ক্রীড কি আছে দিন সই করে দিচ্ছি। চাঁইমশাই বললেন—দুত্তোর ক্রীড, আগে লাখ টাকা বার করুন দেখি, আমাদের নিখিল—বঙ্গীয়—সর্পনাশক ফাণ্ডের জন্য—সাপ না মারলে পাড়াগাঁয়ের লোক সাপোর্ট করবে কেন? বকুবাবু বললেন—ছি ছি, দেশের কাজ করব তার জন্যে টাকা? ঘুষ আমি দিই না। ফিরে এসে স্থির করলেন, সব ব্যাটা চোর। খরচ যদি করতেই হয়, তিনি নিজে বুঝে সুঝে করবেন।

কলকাতায় সুবিধে করতে না পেরে বকুবাবু ঠিক করলেন, সাউথ—সুন্দরবন—কনস্টিটুয়েন্সি থেকে দাঁড়াবেন। সেখানে সম্প্রতি কিছু জমিদারি কিনেছিলেন, সেজন্য ভোট আদায় করা সোজা হবে। ইলেকশনের দু—তিন মাস আগে থেকেই তিনি উঠে—পড়ে লেগে গেলেন।

তারপর হঠাৎ একদিন খবর এল যে বকুলালের পুরনো শত্রু রামজাদুবাবু রাতারাতি খদ্দরের সুট বানিয়ে বক্তৃতা দিতে শুরু করেছেন। তিনিও ঐ সোঁদরবন থেকে দাঁড়াবেন। বকুবাবুর দ্বিগুণ রোখ চেপে গেল—তিনি টেরিটিবাজার থেকে একটি তিন নম্বরের টিকি কিনে ফেললেন, দেউড়িতে গোটা—দুই ষাঁড় বাঁধলেন, আর বাড়ির রেলিং এর ওপর ঘুঁটে দেয়ার ব্যবস্থা করলেন।

খবরের কাগজে নানারকম কেচ্ছা বার হ’তে লাগল। বকুলাল দত্ত—সেটাকে কে চেনে? চোদ্দ বছর আগে কার কাছে চাকরি করত? সে চাকরি গেল কেন? কেরানীর অত পয়সা কি করে হ’ল? হে দেশবাসিগণ, বকুলাল অত সোডাওআটার কেনে কেন? কিসের সঙ্গে মিশিয়ে খায়? বকুর বাগানবাড়িতে রাত্রে আলো জ্বলে কেন? বকুলাল কালো, কিন্তু তার ছোট ছেলে ফরসা হ’ল কেন? সাবধান বকুলাল, তুমি শ্রীযুক্ত রামজাদুর সঙ্গে পাল্লা দিতে যেয়ো না, তা হ’লে আরও অনেক কথা ফাঁস ক’রে দেব। বকুবাবুও পালটা জবাব ছাপতে লাগলেন, কিন্তু তত জুতসই হ’ল না, কারণ তাঁর তরফে তেমন জোরালো সাহিত্যিক—গুণ্ডা ছিল না।

বকুবাবু ক্রমে বুঝলেন যে তিনি হটে যাচ্ছেন, ভোটাররা সব বেঁকে দাঁড়াচ্ছে। একদিন তিনি অত্যন্ত বিমর্ষ হয়ে ব’সে আছেন এমন সময় তাঁর মনে পড়ল যে চোদ্দ বৎসর আগে দেবতার দয়ায় তাঁর অদৃষ্ট ফিরে যায়। এবারেও কি তা হবে না? বকুলাল ঠিক করলেন আর একবার তেমনি ক’রে কায়মনোবাক্যে তিনি তেত্রিশ কোটিকে ডাকবেন। শুধু বঙ্গমাতার ওপর নির্ভর করা চলবে না, কারণ তিনি তো আর সত্যিকার দেবতা নন—বঙ্কিম চাটুজ্যের হাতে গড়া। তাঁর কোনও যোগ্যতা নেই, কেবল লোককে খেপিয়ে দিতে পারেন।

রাত্রি দশটার সময় বকুবাবু তাঁর আপিস—ঘরে ঢুকে দরোয়ানকে ব’লে দিলেন যে তাঁর অনেক কাজ, কেউ যেন বিরক্ত না করে। এবার আর শোবার ঘরে নয়, কারণ গিন্নী থাকলে তপস্যার বিঘ্ন হ’তে পারে। বকুলাল ইজিচেয়ারে শুয়ে এই মর্মে একটি প্রার্থনা রুজু করলেন।—’হে ব্রহ্মা বিষ্ণু মহেশ্বর দুর্গা কালী ইত্যাদি, পূর্বে তোমরা একবার আমার মান রেখেছিলে, আমিও তোমাদের যথাযোগ্য পুজো দিয়েছি। তার পর নানান ধান্দায় আমি ব্যস্ত, তোমাদের তেমন খোঁজখবর নিতে পারি নি—কিছু মনে ক’রো না বাবারা। কিন্তু গিন্নী বরাবরই তোমাদের কলাটা মুলোটা যুগিয়ে আসছেন, সোনা—রুপোও কিছু কিছু দিয়েছেন। ঐ যে তাঁর রুপোর তাম্রকুণ্ড, কোষাকুষি, ঘণ্টা, পঞ্চপ্রদীপ, শালগ্রামের সোনার সিংহাসন, সে তো আমারই টাকায় আর তোমাদেরই জন্যে। আর আমিও দেখ, এখন একটু ফুরসৎ পেয়েই ধম্ম—কম্মে মন দিয়েছি, টিকি রেখেছি, গো—সেবা করছি। এখন আমার এই নিবেদন, রামজাদু ব্যাটাকে ঘায়েল কর। ওকে ভোটে হারাবার কোনও আশা দেখছি না। দোহাই তেত্রিশ কোটি দেবতা, ওটাকে বধ কর। কিন্তু এক্ষুনি নয়, নমিনেশন—পেপার দেবার দুদিন পরে,—নয়তো আর একটা ভূঁইফোড় দাঁড়াবে। কলেরা, বসন্ত, বেরিবেরি, হার্টফেল, গাড়িচাপা যা হয়। আমি আর বেশী কি বলব, তোমরা তো হরেক রকম জান। দাও বাবারা, বজ্জাত ব্যাটার ঘাড় মটকে দাও—রেমোর রক্ত দাও—রক্তং দেহি, রক্তং দেহি।’ …..বকুলালবাবু নিবিষ্ট হয়ে এই রকম সাধনা করছেন, এমন সময়ে সেই ঘরে টুপ ক’রে একটি শব্দ হ’ল।’

নগেনের ঠোঁট নড়িয়া উঠিল। আস্তে আস্তে বলিল—’দ—’

চাটুজ্যে গর্জন করিয়া বলিলেন—’চোপরাও। —বকুবাবুর আপিসের কড়িকাঠে একটি টিকটিকি আটকে ছিল । সে যেমনি হাই তুলে আড়মোড়া ভাঙবে অমনি খ’সে গিয়ে টুপ করে বকুলালের টেবিলে পড়ল। বকুলাল চমকে উঠে দেখলেন—টেবিলের ওপর একটি টিকটিকি, আর তার নীচেই একখানা পোস্টকার্ড।

পোস্টকার্ডটি পূর্বে নজরে পড়ে নি। এখন বকুবাবু প’ড়ে দেখলেন তাতে লিখেছে—মহাশয়, শুনেছি আপনি ইলেকশনে সুবিধে করে উঠতে পারছেন না। যদি আমার সাহায্য নেন আর উপদেশ—মত চলেন তবে জয় অবশ্যম্ভাবী। কাল সন্ধ্যায় আপনার সঙ্গে দেখা করব। ইতি। শ্রীরামগিধড় শর্মা।

বকুলালবাবু উৎফুল্ল হয়ে বললেন—জয় মা কালী, জয় বাবা তারকনাথ ব্রহ্মা বিষ্ণু পীর পয়গম্বর। এই পোস্টকার্ডখানি তোমাদেরই লীলা, তা আমি বেশ বুঝতে পারছি। কাল তোমাদের ঘটা ক’রে পুজো দেব, নিশ্চিন্ত থাক। তার পর খুব মনে মনে বললেন—যাতে দেবতারাও টের না পান—উঁহু বিশ্বাস নেই, আগে কাজ উদ্ধার হ’ক তখন দেখা যাবে।

সমস্ত রাত, তারপর সমস্ত দিন বকুবাবু ছটফট ক’রে কাটালেন। যথাকালে রামগিধড় শর্মা দেখা দিলেন। ছোট্ট মানুষটি, মেটেমেটে রং, ছুঁচলো মুখ, খাড়া—খাড়া কান। পরনে পাটকিলে রঙের ধুতি—মেরজাই গায়ের রঙের সঙ্গে বেশ মিশ খেয়ে গেছে। কথা কন কখনও হিন্দী, কখনও বাংলা। বকুলাল খুব খাতির করে বললেন—বইঠিয়ে। আপনি আর্যসমাজী? রামগিধড় বললেন—নহি নহি। বকু জিজ্ঞাসা করলেন—মহাবীর দল? প্যাক্টওয়ালা? কৌসিল—তোড়? চরখা—বাজ? রামগিধড় ওসব কিছুই নন, তিনি একজন পলিটিক্যাল পরিব্রাজক। বকুবাবু ভক্তিভরে পায়ের ধুলো নিলেন। রামগিধড় বললেন—বস হুয়া হুয়া।

তার পর কাজের কথা শুরু হ’ল। রামগিধড় জানতে চাইলেন বকুবাবুর রাজনীতিক মতামত কি, তিনি স্বরাজী, না অরাজী, না নিমরাজী, না গররাজী? বকু বললেন, তিনি কোনওটাই নন, তবে দরকার হ’লে সবতাতেই রাজী আছেন। তিনি চান দেশের একটু সেবা করতে, কিন্তু রামজাদু থাকতে তা হবার জো নেই। রামগিধড় বললেন—কোনও চিন্তা নেই, তুমি ব্যাঘ্রপার্টিতে জয়েন কর।

বকুবাবু আঁতকে উঠলেন। রামগিধড় বললেন—আমি অতি গুহ্য কথা প্রকাশ ক’রে বলছি শোন। এই পার্টির সভ্যসংখ্যা একেবারে গোনাগুনতি তিন’শ তেষট্টি। আমি এর সেক্রেটারি। একটিমাত্র ভেকান্সি আছে, তাতে ইচ্ছা করলে তুমি আসতে পার। কাউনসিলের সমস্ত সীট আমরাই দখল করব।

বকুর ভরসা হ’ল না। বললেন—তা পেরে উঠবেন কি ক’রে? শত্রু অতি প্রবল, হটাতে পারবেন না। নিখিল—বঙ্গীয়—সর্পনাশক ফাণ্ডের সমস্ত টাকা ওরা হাত করেছে।

রামগিধড় খ্যাঁক খ্যাঁক করে হেসে বললেন—আমরা সর্প নই। ফান্ড না থাক দাঁত আছে, নখ আছে। বাবা দক্ষিণরায় আমাদের সহায়। তাঁর কৃপায় সমস্ত শত্রু নিপাত হবে।

তিনি কে?

চেন না? তেত্রিশ কোটির মধ্যে তিনিই এখন জাগ্রত, আর সবাই ঘুমচ্ছেন। বাবা তোমার ডাক শুনতে পেয়েছেন। নাও, এখন ক্রীডে সই কর। অতি সোজা ক্রীড— কেবল বাবার নিত্যিকার খোরাক যোগাতে হবে—তার বদলে পাবে শত্রু মারবার ক্ষমতা আর কাউনসিলে অপ্রতিহত প্রতাপ।

কিন্তু গবরমেণ্ট?

‘গবরমেণ্টের মাংসও বাবা খেয়ে থাকেন—’

বংশলোচন বাধা দিয়া বলিলেন—’ওকি চাটুজ্যেমশায়!’

চাটুজ্যে কহিলেন—’হাঁ হাঁ মনে আছে,আচ্ছা, খুব ইশারায় বলছি। রামগিধড় বুঝিয়ে দিলেন, একেবারে রামরাজ্য হবে। শত্রুর বংশ লোপাট, সবাই ভাই—ব্রাদার। দিব্যি ভাগ—বাটোয়ারা ক’রে খাবে। সকলেই মন্ত্রী, সকলেই লাট।’

কিন্তু ঐ রামজাদুটা ঢিট হবে তো?

ঢিট ব’লে ঢিট! একেবার ঢ—য় দীর্ঘ ঈ ঢীট! তাকে তুমি নিজেই বধ ক’রো।

বকুবাবুর মাথা গুলিয়ে গিয়েছিল। এইবার তাঁর কৃত্রিম দন্তে অকৃত্রিম হাসি ফুটে উঠল। ক্রীড সই করে দিয়ে বললেন—বাবা দক্ষিণরায় কি জয়!

রমগিধড় বললেন—হুয়া, হুয়া, আর সব ঠিক হুয়া।

এই স্থির হ’ল যে কাল ফাইভ—আপ—প্যাসেঞ্জারে বকুবাবু তাঁর সুন্দরবনের জমিদারিতে রওনা হবেন। সেখানে পৌঁছলে রামগিধড় তাঁকে সঙ্গে ক’রে নিয়ে বাবার আশীর্বাদ পাইয়ে দেবেন।

বকুবাবুর মাথা বিগড়ে গেল। সমস্ত রাত তিনি খেয়াল দেখলেন রামগিধড় হুয়া হুয়া করছে। রামরাজ্য, কাউনসিলে অপ্রতিহত প্রতাপ, লাট, মন্ত্রী—এসব বড় বড় কথা তাঁর মনে ঠাঁই পায় নি। রামজাদু মরবে আর তিনি কাউনসিলে ঢুকবেন—এইটেই আসল কথা। তার পর রামরাজ্যই হ’ক আর রাক্ষসরাজ্যই হ’ক, দেশের লোক বাঁচুক বা বাবার পেটে যাক, তাতে তাঁর ক্ষতি—বৃদ্ধি নেই।

তারপর সোঁদরবনে গভীর অমাবস্যা রাত্রে বাবা তাঁকে দর্শন দিলেন।

বিনোদ বলিলেন—’চাটুজ্যেমশায়, আপনি বড় ফাঁকি দিচ্ছেন। বাবুর মূর্তিটা কি রকম তা বলুন?’

চাটুজ্যে। বলব না, ভয় পাবে। বিশেষ ক’রে এই উদোটা।

উদয় বলিল—’মোটেই না। হাজারিবাগে থাকতে কতবার আমি রাত্তিরে একলা উঠেছি। বউ বলত—’

চাটুজ্যে বলিলেন—’বউ বলুক গে। বাবা প্রথমটা সৌম্য ব্রাহ্মণের মূর্তি ধ’রে দেখা দিয়েছিলেন। বকুলালকে বললেন—বৎস, আমি তোমার প্রার্থনায় খুশী হয়েছি। এখন বর কি নেবে বল।’

বকুবাবু বললেন—বাবা, আগে রামজাদুটাকে মার, ও আমার চিরকালের শত্রু।

বাবা বললেন—দেশের হিত?

বকু উত্তর দিলেন—হিত—টিত এখন থাক বাবা। আগে রামজাদু।

বাবা বলিলেন—তাই হ’ক। ক্রীড সই করেছ, এখন তোমায় জাতে তুলে দি—

এতেক কহিয়া প্রভু রায় মহাশয়

ধরিলেন নিজ রূপ দেখে লাগে ভয়।

পর্বত প্রমাণ দেহ মধ্যে ক্ষীণ কটি,

দুই চক্ষু ঘোরে যেন জ্বলন্ত দেউটি।

হলুদ বরন তনু তাহে কৃষ্ণ রেখা,

সোনার নিকষে যেন নীলাঞ্জন লেখা।

কড়া কড়া খাড়া খাড়া গোঁফ দুই গোছা,

বাঁশঝাড় যেন দেয় আকাশেতে খোঁচা।

মুখ যেন গিরিগূহা রক্তবর্ণ তালু,

তাহে দন্ত সারি সারি যেন শাঁখ আলু।

দু—চোয়াল বহি পড়ে সাদা সাদা গেঞ্জ,

আছাড়ি পাছাড়ি নাড়ে বিশ হাত লেঞ্জ।

ছাড়েন হুংকার প্রভু দন্ত কড়মড়ি,

জীব জন্তু যে যেখানে ভাগে দড়বড়ি।

ভয় পাঞা দেবগণ ইন্দ্রে দেয় ঠেলা,

কহে—দেবরাজ হান বজ্র এইবেলা।

ইন্দ্র বলে, ওরে বাপা কিবা বুদ্ধি দিলে,

রহিবে পিতার নাম আপুনি বাঁচিলে।

চক্ষে বান্ধ ফেটা বাপা কানে দাও রুই,

কপাট ভেজাঞা সুখা খাও ঢোঁক দুই।

বাবা দক্ষিণরায় তাঁর ল্যাজটি চট ক’রে বকুবাবুর সর্বাঙ্গে বুলিয়ে দিলেন। দেখতে দেখতে বকুলাল ব্যাঘ্ররূপ ধারণ করলেন।

বাবা বললেন,—যাও বৎস, এখন চ’রে খাও গে।’

চাটুজ্যে হুঁকায় মনোনিবেশ করিলেন। বিনোদবাবু বলিলেন—’তার পর?’

‘তারপর আবার কি! বকুলাল কেঁদেই আকুল। ও বাবা, একি করলে? আমি ভাত খাব কি ক’রে? শোব কোথায়? সিল্কের চোগা—চাপকান পরব কি ক’রে? গিন্নী যে আর চিনতে পারবে না গো!

বাবা অন্তর্ধান। রামগিধড় বললেন—আবার ক্যা হুয়া? গোল মত কর। এখন ভাগো,শত্রু পকড়—পকড়কে খাও গে। বকুলাল নড়েন না, কেবল ভেউ ভেউ কান্না। রামগিধড় ঘ্যাক ক’রে তাঁর পায়ে কামড়ে দিলে। বকুলাল ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে পালালেন।

পরদিন সকালে ক—জন চাষা দেখতে পেলে একটি বৃদ্ধ বাঘ পগারের ভেতরে ধুঁকছে। চ্যাংদোলা ক’রে নিয়ে গেল ডেপুটিবাবুর বাড়ি। তিনি বললেন—এমন বাঘ তো দেখি নি, গাধার মত রং। আহা, শেয়ালে কামড়েছে, একটু হোমিওপ্যাথিক ওষুধ দি। একটু চাঙ্গা হোক, তারপর আলিপুর নিয়ে যেয়ো; বকশিশ মিলবে।

বকুবাবু এখন আলিপুরেই আছেন। আর দেখাসাক্ষাৎ করিনে—ভদ্দরলোককে মিথ্যে লজ্জা দেওয়া।

বিনোদবাবু বলিলেন—’আচ্ছা চাটুজ্যেমশায়, বাবা দক্ষিণরায় কখনও গুলি খেয়েছেন?’

‘গুলি তাঁকে স্পর্শ করতে পারে না।’

‘তিনি না খান, তাঁর ভক্তরা কেউ খান নি কি?’

‘দেখ বিনোদ, ঠাকুর—দেবতার কথা নিয়ে তামাশা ক’রো না, তাতে অপরাধ হয়। আচ্ছা ব’স তোমরা—আমি উঠি।’