ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ । পলাতক বিজয়ী নেতা
খুব সহজে ও অল্প সময়ের মধ্যেই চেঙ্গিজ খাঁ, আলেকজান্ডার, সিজার ও নেপোলিয়ন শত্রুসৈন্য ধ্বংস করতে পারতেন বলেই তাদের আজ এত নাম।
তাঁদের সঙ্গে বোম্বেটে মর্গ্যানের তুলনাই চলে না। কিন্তু মর্গ্যানের পানামা বিজয় যে বিশেষ বিস্ময়জনক ব্যাপার, সে বিষয়ে কোনও সন্দেহই নেই।
পূর্বকথিত দিগবিজয়ীরা এক বা একাধিক সমগ্র জাতির সাহায্য পেয়েই বড় হয়েছিলেন।
কিন্তু মর্গ্যান হচ্ছে কতকগুলো জাতিচ্যুত, সমাজ থেকে বিতাড়িত, নীতিজ্ঞানশূন্য, হীন বোম্বেটের সরদার। এবং তাদের শত্রুরা হচ্ছে অসংখ্য স্পানিয়ার্ড সৈনিক, প্রবল পরাক্রান্ত স্পেন সাম্রাজ্যের অতুলনীয় শক্তি তাদের পিছনে, অস্ত্রশস্ত্রে ও সংখ্যাধিক্যে বোম্বেটেদের চেয়ে তারা ঢের বেশি বলিষ্ঠ। তবু যে তারা এত অনায়াসে হার মানতে বাধ্য হল, এটা একটা মস্ত স্মরণীয় ব্যাপার বলে স্বীকার করতেই হবে।
পানামার পতন হল। তারপর যেসব কাণ্ড আরম্ভ হল পাঠকরা তা কল্পনাই করতে পারছেন। বোম্বেটেরা প্রথমে দু-চোখো হত্যা করতে লাগল—সৈনিক, সাধারণ নাগরিক, কাফ্রি, বালক, নারী ও শিশু—খাঁড়া পড়ল নির্বিচারে সকলেরই উপরে। বোম্বেটেরা দলে দলে ধর্মযাজক বা পাদ্রি বন্দি করলে, প্রথমে তাদেরও পাদরি হত্যা করতে বিবেকে বাধল, তাই তাদের ধরে মর্গ্যানের কাছে গিয়ে গেল।
মর্গ্যান পাদরিদের কান্নায় কর্ণপাত না করে বললে, ‘মারো, মারো, সবাইকে মারো!’
লুণ্ঠন চলতে লাগল। পলাতকরা অনেক ধনরত্ন নিয়ে পালিয়েছিল, কিন্তু তখনও শহরে ছিল প্রচুর ঐশ্বর্য। সব পড়ল বোম্বেটেদের হাতে—হিরা, চুনি, পান্না, মুক্তো, সোনা-রুপোর আসবাব ও তাল এবং টাকাকড়ি আর যা কিছু।
তারপর মর্গ্যান জনকয়েক বোম্বেটেকে আড়ালে ডেকে নিয়ে গিয়ে বললে, ‘তোমরা চুপি চুপি শহরে আগুন লাগিয়ে দিয়ে এসো।’
কেউ কিছু টের পাওয়ার আগেই একদিন অকস্মাৎ সেই বৃহৎ নগরের উপরে অগ্নির রাঙা টকটকে জিভ লকলক করে জ্বলে উঠল। স্পানিয়ার্ডরা সবাই সেই আগুন নেবাতে ছুটল, এর মধ্যে তাদের সরদারের হাত আছে না জেনে অনেক বোম্বেটেও তাদের সাহায্য করতে গেল, কিন্তু কিছুতেই কিছু হল না—দেখতে দেখতে বিরাট অগ্নির বেড়াজালের মধ্যে গোটা শহরটাই ধরা পড়ল! বড় বড় প্রাসাদ, অট্টালিকা, কারুকার্য করা গির্জা, মঠ, গৃহস্থ ও গরিবের বাড়ি সমস্তই গেল আগুনের গর্ভে! সেই অগ্নিকাণ্ডে ছোট-বড় আট হাজার বাড়ি পুড়ে একেবারে ছাই হয়ে গেল!
মর্গ্যান রটিয়ে বেড়াল—’স্পানিয়ার্ডরাই এই কাণ্ড করেছে!’
লুণ্ঠনের পর নির্যাতন। গুপ্তধনের সন্ধান। নির্যাতনের শত শত দৃষ্টান্তের মধ্যে একটা এখানে দেখাচ্ছি জনৈক ধনী ভদ্রলোক বোম্বেটেদের ভয়ে ধনরত্ন নিয়ে পালিয়ে যান। তাঁর গরিব চাকরটা মনিবের একটা দামি পোশাক পেয়ে বুদ্ধির দোষে সেটা নিজে পরে ফেললে। কাঙালের ঘোড়ারোগ বরাবরই সাংঘাতিক। বোম্বেটেরা তাকে দেখেই ধরে নিলে, সে কোনও মস্তবড় লোক।
তার কাছ থেকে তারা টাকা দাবি করলে। সে কোত্থেকে টাকা দেবে? সে বললে, ‘আমি চাকর ছাড়া আর কিছু নই। এ পোশাক আমার মনিবের।’
বোম্বেটেরা বিশ্বাস করলে না। তখন প্রথমেই তারা সে বেচারার হাত দুখানা দুমড়ে একেবারে ভেঙে দিলে। তাতেও মনের মতো জবাব না পেয়ে তারা সেই চাকরের কপালের উপর দড়ির ফাঁস লাগিয়ে এমন জোরে পাকাতে লাগল যে, চামড়ায় টান পড়ে তার চোখদুটো ডিমের মতো বড় হয়ে ঠিকরে পড়বার মতো হয়ে উঠল। তখনও গুপ্তধনের সন্ধান মিলল না। তারপর তাকে শূন্যে দড়িতে ঝুলিয়ে রেখে ঘুষি ও চাবুক মারা হতে লাগল। তার নাক ও কান কেটে নেওয়া হল—জ্বলন্ত খড় নিয়ে মুখে ছ্যাঁকা দেওয়া হতে লাগল। শেষকালে সে এই পৈশাচিক যাতনা থেকে মুক্তি পেলে বর্শার আঘাতে। অভাগা মরে বাঁচল।
তিন হপ্তা পরে দুরাত্মা মর্গ্যান পানামার ভস্মস্তূপ ছেড়ে বিদায় গ্রহণ করলে।
সঙ্গে করে নিয়ে চলল ছয়শো বন্দিকে—প্রচুর টাকা না পেলে সে তাদের ছাড়তে রাজি নয়। সেই ছয়শত স্ত্রী, পুরুষ, শিশু, বালক, যুবা ও বৃদ্ধ বন্দির মিলিত ক্রন্দনে আকাশ যেন ফেটে যাওয়ার মতো হয়ে উঠল।
ভেড়ার পালের মতো বন্দিদের আগে আগে তাড়িয়ে নিয়ে বোম্বেটেরা অগ্রসর হল। মর্গ্যানের হুকুমে বন্দিদের পানাহারও প্রায় বন্ধ করে দেওয়া হল।
অনেক নারী আর সইতে না পেরে মর্গ্যানের পায়ের তলায় হাঁটু গেড়ে বসে কাতর মিনতির স্বরে বললে, ‘ওগো, আর আমরা পারি না। আপনার পায়ে পড়ি, আমাদের ছেড়ে দিন—আমরা স্বামী-পুত্রের কাছে ফিরে যাই! আমাদের যথাসর্বস্ব গেছে, তবু পাতার কুঁড়ে তৈরি করে স্বামী-পুত্রের সঙ্গে বাস করব!’
নিরেট লোহার মতো সুকঠিন মর্গ্যান বললে, ‘আমি এখানে কান্না শুনতে আসিনি—এসেছি টাকা রোজগার করতে। টাকা দিলেই ছাড়ান পাবে, নইলে সারাজীবন বাঁদি হয়ে থাকবে!’
সমুদ্রের ধারে গিয়ে মর্গ্যান বোম্বেটেদের সঙ্গে লুটের মাল ভাগ করতে বসল। নিজের মনের মতো হিসাব করে সকলকে সে অংশ দিলে।
কিন্তু সে অংশ সন্দেহজনক। এতবড় শহর লুটে এত পরিশ্রমের পর এই হল পাওনা, এত কম টাকা!
প্রত্যেক বোম্বেটে বিষম রাগে গরগর করতে লাগল। তাদের দৃঢ়বিশ্বাস হল, মর্গ্যান তাদের ফাঁকি দেওয়ার জন্যে বেশিরভাগ দামি মালই সরিয়ে ফেলেছে! মর্গ্যানকে তারা মুখের উপরে কিছু খুলে বলতে সাহস করল না বটে, কিন্তু প্রত্যেকেই মারমুখো হয়ে রইল।
মর্গ্যান বুঝলে, গতিক সুবিধার নয়, এরা প্রত্যেকেই মরিয়া লোক, যে-কোনও মুহূর্তে সে বিপদে পড়তে পারে।
আচম্বিতে একদিন দেখা গেল, চারখানা জাহাজ ও জনকয়েক খুব বিশ্বাসী লোক নিয়ে চোর মর্গ্যান একেবারে অদৃশ্য হয়েছে! একরাত্রেই সে সমস্ত ধনরত্ন নিয়ে চলে গেল—বোম্বেটেরা তাকে ধরতে পারলে না। ধরতে পারলে কী হত বলা যায় না।
তারপর? তারপর মর্গ্যান আর কখনও বোম্বেটেদের সরদার হয়নি। হওয়ার উপায়ও ছিল না, হওয়ার দরকারও ছিল না।
মর্গ্যানের চূড়ান্ত সৌভাগ্যের কথা আগেই উল্লেখ করেছি। তার নামডাক শুনে ইংলন্ডের রাজা তাকে দেখতে চাইলেন। তার সঙ্গে বন্ধুর মতো ব্যবহার করলেন। তাকে স্যার উপাধি দিলেন। তাকে জামাইকা দ্বীপের গভর্নর করে পাঠালেন। চোর, জোচ্চোর, খুনি, চরিত্রহীন, ডাকাত ও বোম্বেটে মর্গ্যান হল হাজার হাজার সাধুর দণ্ডমুণ্ডের কর্তা—স্যার হেনরি মর্গ্যান!
বিশ্বের শিয়রে মহাবিচারক মাঝে মাঝে ঘুমিয়ে পড়েন!
কিন্তু স্পানিয়ার্ডদেরও শাস্তির দরকার হয়েছিল। তাদের ভীষণ অত্যাচারে আমেরিকা নিদারুণ যন্ত্রণায় হাহাকার করছিল। ভগবানের মূর্তিমান অভিশাপেরই মতো হয়তো তাই মর্গ্যান, লোলোনেজ, পোর্তুগিজ ও ব্রেজিলিয়ানোর দল এসে আবির্ভূত হয়েছিল স্পানিয়ার্ডদের মাঝখানে।