উপন্যাস
বড় গল্প
সংকলন
রচনা

ত্রয়োদশ। ভিখারি হর্ষবর্ধন

ত্রয়োদশ। ভিখারি হর্ষবর্ধন

আর্যাবর্তে আবার ফিরে এল রামরাজত্ব।

হর্ষবর্ধনের সাম্রাজ্যের পশ্চিম সীমান্ত ছিল আরব সাগর। জলন্ধর ও নেপাল ছিল উত্তর সীমান্ত এবং তার দক্ষিণ সীমান্ত দিয়ে প্রবাহিত হত নর্মদা নদী। এমন প্রকাণ্ড সাম্রাজ্য পাঁচ-সাত বৎসরে হর্ষবর্ধনের হস্তগত হয়নি। আর্যাবর্তকে একই ছত্রের ছায়ায় আনতে তাঁর কেটে গিয়েছিল সুদীর্ঘ সাঁইত্রিশ বৎসর কাল।

কিন্তু কেবল অসি নয়, মসিকেও করেননি তিনি অবহেলা। যখনই অবকাশ পেতেন বাণভট্টের সঙ্গে করতেন কাব্য আলোচনা এবং একান্ত সাহিত্য সাধনার ভিতর দিয়ে তাঁর কেটে যেত দিনের পর দিন। তাঁর বিচিত্র সাহিত্য সাধনার অমর নিদর্শন আছে তিনখানি সুবিখ্যাত নাটকের মধ্যে—’নাগানন্দ’, ‘রত্নাবলী’ ও ‘প্রিয়দর্শিকা’। তিনি কবি হলেও তাঁর ব্যাকরণ সম্পর্কীয় রচনাও আছে এবং সুন্দর হস্তাক্ষরের জন্যে তাঁর নাম খুব বিখ্যাত। তাঁর হস্তাক্ষরের নমুনা আজও বিদ্যমান আছে।

উপরন্তু তিনি কেবল নাট্যকার নন, অভিনেতাও ছিলেন। স্বরচিত নাটকে ভূমিকা গ্রহণ করে অবতীর্ণ হতেন রঙ্গমঞ্চে। বোঝা যাচ্ছে, তাঁর প্রতিভা ছিল সর্বতোমুখী।

পরামর্শ দেওয়ার জন্যে মন্ত্রীরা ছিলেন বটে, কিন্তু রাজ্যচালনা করতেন তিনি স্বয়ং। প্রজাদের ভালোমন্দ দেখতেন স্বচক্ষে এবং তাদের অভিযোগ শ্রবণ করতেন স্বকর্ণে।

থানেশ্বর থেকে তিনি রাজধানী তুলে নিয়ে গিয়েছিলেন কান্যকুব্জে—সেখানকার মহারানি ছিলেন তাঁর সহোদরা রাজশ্রীদেবী। কিন্তু রাজকার্যের জন্যে রাজধানীতে তিনি স্থির হয়ে বসে থাকতে পারতেন না। দেশে দেশে যুদ্ধক্ষেত্রে করতেন যোদ্ধার কর্তব্য পালন এবং অসি যখন কোশবদ্ধ হত তখন তিনি করতেন রাজধর্ম পালন। বর্ষাকাল ছাড়া বৎসরের আর সব সময়েই সাম্রাজ্যের বিভিন্ন প্রদেশে তিনি ভ্রমণ করতেন যাযাবরের মতো। অসাধুকে দিতেন শাস্তি, সাধুকে দিতেন পুরস্কার।

দেশ থেকে দেশান্তরে যাবার ব্যবস্থা ছিল এই রকম। হর্ষবর্ধন ভ্রমণের জন্যে লতা-পাতা-শাখা দিয়ে তৈরি করিয়ে নিতেন একটি চলন্ত প্রাসাদ। যখন যেখানে গিয়ে থামতেন, তখন সেইখানেই ওই প্রাসাদ স্থাপন করা হত এবং তিনি তা ত্যাগ করলে সেটিকে পুড়িয়ে ফেলা হত।

তাঁর সঙ্গী হত হাজার হাজার লোকজন। এবং কয়েক শত দামামা-বাদক। রাজার প্রত্যেক পদক্ষেপের তালে তালে বাজিয়ে চলত শত শত সোনার দামামা। অর্থাৎ রাজা যদি একশো বার পা ফেলতেন, তাদের দামামা বাজাতে হত একশো বার। আর্যাবর্তের আর কোনও সামন্তরাজার এই অধিকার ছিল না।

হর্ষবর্ধনের যুগে অপরাধীদের শাস্তি দেওয়ার পদ্ধতি ছিল যথেষ্ট নিষ্ঠুর। গুরুতর অপরাধের জন্য যারা ধরা পড়ত তাদের অবস্থা হত রীতিমতো শোচনীয়। তাদের মানুষ বলে গণ্য করা হত না। কেউ তাদের সাহায্য করতে পারত না। মানুষের বসতির বাইরে নিয়ে গিয়ে তাদের ফেলে দিয়ে আসা হত, তারা কেমন করে বাঁচবে বা মরবে তা নিয়ে কেউ মাথা ঘামানো দরকার মনে করত না।

কোনও কোনও অপরাধের জন্যে নাক, কান, হাত বা পা কেটে নেওয়া হত। ছেলে পিতামাতার প্রতি কর্তব্য পালন না করলেও এই রকম শাস্তিলাভ করত কিংবা কখনও কখনও লাভ করত নির্বাসন দণ্ড। লঘু পাপের জন্যে দিতে হত জরিমানা।

জল বা অগ্নি পরীক্ষারও চলন ছিল। অভিযুক্ত ব্যক্তিকে গভীর জলে বা জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করা হত। ডুবে গেলে বা পুড়ে মরলে ধরে নেওয়া হত সত্য সত্যই তারা অপরাধী। কে জানে এইভাবে মারা পড়ত কত নিরপরাধ।

আগেই বলা হয়েছে, হর্ষবর্ধন শিবকেও পূজা করতেন, সূর্যকেও মানতেন এবং সঙ্গে সঙ্গে বুদ্ধদেব ও বৌদ্ধধর্মের ও প্রতি ছিল তাঁর অটল ভক্তি। তিনি তাই নিয়মিতভাবে মঠ ও মন্দিরের জন্যে করতেন অর্থব্যয়।

আধুনিক বিহার প্রদেশে নালন্দা নামে এক বিখ্যাত মঠ ছিল, সেখানে কেবল বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা বাস করতেন না। তার মধ্যে ছিল প্রকাণ্ড এক বিশ্ববিদ্যালয়। হর্ষবর্ধনের যুগে সেখানে থেকে লেখাপড়া করত দশ হাজার ছাত্র। প্রতিদিন সেখানে একশত বেদি প্রতিষ্ঠিত হত এবং তার উপরে উপবিষ্ট হয়ে এক শত অধ্যাপক করতেন নানা শাস্ত্র নিয়ে আলোচনা। জ্ঞানার্জনের জন্য ছাত্রদের আগ্রহ ছিল এমন গভীর যে অধ্যাপনার সময়ে তাদের কেউ এক মিনিটের জন্যও অনুপস্থিত থাকত না।

এই বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য রাজা দান করেছিলেন একশত খানি গ্রাম। তারই আয় থেকে ছাত্রদের সমস্ত ব্যয় সংকুলান হত, ফলে তারা শিক্ষাগ্রহণ করতে পারত পরম নিশ্চিন্তভাবে।

প্রতি চার বৎসর অন্তর হর্ষবর্ধন আর একটি এমন কর্তব্য পালন করতেন, পৃথিবীর আর কোনও রাজা আজ পর্যন্ত তা করতে পারেননি। আধুনিক এলাহাবাদে গঙ্গা-যমুনার সঙ্গমস্থলে এখন যেখানে কুম্ভমেলার অনুষ্ঠান হয়, হর্ষবর্ধন সেখানে নিয়ে উপস্থিত হতেন সদলবলে। তার পরে গত চার বৎসর ধরে রাজভাণ্ডারে যত ঐশ্বর্য সংগৃহীত হত, তা নিঃশেষে দান করতেন সমাগত প্রার্থীগণকে।

হর্ষবর্ধন যখন নিজের সাম্রাজ্যে সুপ্রতিষ্ঠিত, সেই সময়ে (৬৪৩ খ্রিস্টাব্দে) চৈনিক পরিব্রাজক হুয়েন সাং-এর সঙ্গে তাঁর দেখা হয়। প্রয়াগের (বা এলাহাবাদের) সেই বিচিত্র দানোৎসবে হুয়েন সাং নিজে উপস্থিত ছিলেন। তিনি স্বচক্ষে সমস্ত দেখে যা বলেছেন তার সারমর্ম হচ্ছে এই :

গঙ্গা-যমুনার সঙ্গমস্থলে এসে সমবেত হয়েছেন হর্ষবর্ধনের সঙ্গে অসংখ্য রাজকর্মচারী, অনুচর, সৈন্য ও সামন্ত রাজার দল। নির্দিষ্ট দিনে সেখানে এস উপস্থিত হল বিরাট এক জনতা—তার মধ্যে ছিল বহু নিমন্ত্রিত ব্রাহ্মণ ও নানা ধর্মাবলম্বী সাধু-সন্ন্যাসী এবং অনাহুত ও রবাহূত অনাথ ও ভিখারির দল—সংখ্যায় তারা পাঁচ লক্ষের কম হবে না।

হুয়েন সাংকে সম্বোধন করে হর্ষবর্ধন বললেন, ‘পরিব্রাজক, আমাদের বংশে পুরুষানুক্রমে একটি রীতি পালন করা হয়। সেই রীতি অনুসারে প্রতি পঞ্চম বৎসরে আমি প্রয়াগের এই পুণ্যতীর্থে এসে, আমার সঞ্চিত সমস্ত ঐহিক সম্পত্তি জাতিধর্মনির্বিশেষে দান করে যাই। আজ তিরিশ বৎসর ধরে আমি এই কর্তব্য পালন করে আসছি। এবারে আমার ষষ্ঠ দানযজ্ঞ।’

দুই মাস পনেরো দিন ধরে চলল সেই অসাধারণ দানোৎসব।

উৎসবের প্রারম্ভে দেখা গেল, সানুচর সামন্তরাজগণের সুদীর্ঘ শোভাযাত্রা। সে এক বর্ণবহুল ও ঐশ্বর্যময় অতুলনীয় দৃশ্য, কারণ আপন আপন রাজকীয় মহিমা অক্ষুণ্ণ রাখবার জন্যে কোনও রাজাই প্রাণপণ চেষ্টায় ত্রুটি করেননি।

পাঁচ লক্ষ দর্শকের মাঝখানে উচ্চাসনের উপরে বসে আছেন মহারাজাধিরাজ হর্ষবর্ধন। তাঁর দক্ষিণ পার্শ্বে উপবিষ্টা রাজশ্রীদেবী। তারপর যথাযোগ্য নির্দিষ্ট স্থানে আসন গ্রহণ করেছেন অমাত্য ও পদস্থ রাজকর্মচারীগণ, সভাকবি বাণভট্ট ও অন্যান্য পণ্ডিতগণ।

প্রথম দিনে বুদ্ধদেবকে স্মরণ করে দানকার্য আরম্ভ হল। নদীর তটে একটি পর্ণকুটিরের মধ্যে স্থাপন করা হল বুদ্ধদেবের মূর্তি। তারপর দুই হাতে বিলি করা হল মূল্যবান সাজপোশাক ও অন্যান্য উপহার।

দ্বিতীয় ও তৃতীয় দিন হচ্ছে যথাক্রমে সূর্য ও শিবের দিন। কিন্তু বুদ্ধদেবের দিনে যত জিনিস দান করা হয়েছিল, এই দুই দিনের দানের পরিমাণ তার আধা-আধির বেশি হল না।

চতুর্থ দিবসে দান গ্রহণ করতে এলেন দশ হাজার নির্বাচিত বৌদ্ধ ধার্মিক। তাঁরা প্রত্যেকে লাভ করলেন এক শত স্বর্ণমুদ্রা, একটি মুক্তা, একটি তুলার পোশাক এবং বাছা বাছা খাদ্যসামগ্রী, পানীয়, ফুল ও গন্ধদ্রব্য।

তারপর বিশ দিন ধরে কাতারে কাতারে ব্রাহ্মণদের দল এল দান গ্রহণ করতে। ব্রাহ্মণদের পর জৈন এবং অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের পালা। তাঁদের তুষ্ট করতে লাগল পুরো দশটি দিন। বহু দূরদেশ থেকে যেসব শ্রমণ এখানে এসে জুটেছিলেন মধুলোভী ভ্রমরের মতো, তাঁরাও আরও দশ দিনের আগে খুশি হলেন না। তারপর গোটা এক মাস ধরে দান নিয়ে গেল লক্ষ লক্ষ দরিদ্র, অনাথ, পঙ্গু ও ভিক্ষুকের দল।

এইভাবে অকাতরে দান করতে করতে রাজভাণ্ডারে পাঁচ বৎসরের সঞ্চিত অর্থ একেবারে ফুরিয়ে গেল। হস্তী, অশ্ব ও সামরিক সাজসজ্জা ছাড়া রাজার নিজস্ব সম্পত্তি আর কিছুই রইল না। কিন্তু ওগুলিকে দানসামগ্রী বলে গণ্য করা চলে না, কারণ রাজ্যচালনা অসম্ভব হয়ে উঠবে তাদের অভাবে।

হর্ষবর্ধন তখন সিংহাসন ছেড়ে নেমে এসে নিজের গা থেকে মণিমাণিক্যখচিত মুকুট, জড়োয়ার কণ্ঠহার, মৌলিমালা, কর্ণের কুণ্ডল ও বাহুর বলয় প্রভৃতি—এমনকি রাজপরিচ্ছদ পর্যন্ত খুলে বিলিয়ে দিলেন হাসিমুখে।

তারপর রাজশ্রীদেবীর দিকে ফিরে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘দিদি, আজ আমি সর্বহারা। আমার লজ্জা রক্ষা হয়, তোমার কাছে এমন বস্ত্র ভিক্ষা করি।

রাজশ্রী তখন সেই আশ্চর্য রাজভিখারির দিকে এগিয়ে দিলেন একটি আটপৌরে পুরাতন পোশাক।

সেই পোশাক পরে হর্ষবর্ধন প্রশান্ত মুখে প্রথমে দশ দিকের বুদ্ধদেবের উদ্দেশ্যে বন্দনা ও প্রণাম করলেন। তারপর পবিত্র আনন্দে উচ্ছ্বসিত হয়ে জোড়হস্তে বললেন, ‘এই বিপুল ঐশ্বর্য সুরক্ষিত স্থানে পুঞ্জীভূত করেও আমি নিশ্চিন্ত থাকতে পারতুম না কিন্তু আজ আমি পরম নিশ্চিন্ত। ধর্মের নামে যা দান করলুম, তা রক্ষিত হল যথাযোগ্য স্থানেই। আহা, ভবিষ্যতে আমি যেন জন্মে জন্মে এইভাবে দান করে বুদ্ধদেবের কৃপালাভ করে ধন্য হতে পারি।’

ঐতিহাসিক হর্ষবর্ধনের এই কল্পনাতীত দানশীলতার দৃষ্টান্ত দেখে বেশ বোঝা যায়, পৌরাণিক দাতাকর্ণের কাহিনি অবিশ্বাস্য নয়। সম্রাট অশোকও যাপন করে গিয়েছেন সর্বহারা ভিক্ষুর জীবন। তাঁর পিতামহ সম্রাট চন্দ্রগুপ্তও নিজের পূর্ণ গৌরবের সময়ে স্বেচ্ছায় সিংহাসন ছেড়ে সন্ন্যাস নিয়ে প্রাণত্যাগ করেছিলেন প্রায়োপবেশনে। অদ্ভুত দেশ এই ভারতবর্ষ। এখানকার মাটিতে যা জন্মায়, অন্য কোনও দেশ তা স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারে না।

কিন্তু রাজর্ষি হর্ষবর্ধন বারে বারে এইভাবে সর্বহারা হয়েও সকলকে খুশি করতে পারেননি। বৌদ্ধরা উচ্ছ্বসিত হয়ে বলত, ‘জয়, রাজাধিরাজ হর্ষবর্ধনের জয়। রাজর্ষি অশোকই আবার হর্ষবর্ধনের মূর্তি ধারণ করে অবতীর্ণ হয়েছেন ধরাধামে।’

কিন্তু ব্রাহ্মণরা হাসিমুখে তাঁর দান গ্রহণ করেও তাঁকে দুই চক্ষে দেখতে পারত না। হিন্দু রাজার এই বৌদ্ধপ্রীতি তাদের কাছে অস্বাভাবিক ও অন্যায় বলেই মনে হত। হর্ষবর্ধনের বিরুদ্ধে তারা চক্রান্ত করতে লাগল। এবং আর্যাবর্তে বিদ্রোহের আগুন জ্বালবার জন্যে গোপনে ইন্ধন জোগাতে লাগল হর্ষেরই এক মন্ত্রী, অর্জুনাশ্ব।

ইতিমধ্যে ঘটেছে কয়েকটি প্রধান ঘটনা।

মগধ-গৌড়ের মহারাজা শশাঙ্কের মৃত্যু হয়েছে (সম্ভবত ৬১৯ খ্রিস্টাব্দের পরে)। তাঁর রাজ্য এসেছে হর্ষবর্ধনের অধিকারে।

শশাঙ্কের বন্ধু চালুক্যরাজ দ্বিতীয় পুলকেশীকে আক্রমণ করতে গিয়ে হর্ষবর্ধন নিজেই পরাজিত হয়েছেন (৬২০ খ্রিস্টাব্দে)। তারপর তাঁর উচ্চাকাঙ্ক্ষা আর দাক্ষিণাত্যের দিকে দৃষ্টিপাত করেনি।

৬৪৩ খ্রিস্টাব্দে হর্ষবর্ধন গঞ্জামে গিয়ে শেষ যুদ্ধ করে তরবারি ত্যাগ করেছেন। তিনি হয়েছেন অহিংসার উপাসক।

গঞ্জামে তাঁর সঙ্গে পরিচিত হয়েছেন চিনা পরিব্রাজক হুয়েন সাঙ।