উপন্যাস
বড় গল্প
সংকলন
রচনা

ত্রয়োদশ । আঙ্গোয়ার যুদ্ধ

ত্রয়োদশ । আঙ্গোয়ার যুদ্ধ

ইউরোপের সঙ্গে এশিয়ার শক্তি পরীক্ষা। ও নতুন দৃশ্য নয়। স্মরণাতীত কাল থেকেই এ দৃশ্যের অভিনয় হয়েছে বারংবার। এবং প্রাচীন ও মধ্যযুগের ইতিহাসেও এজন্যে অমর হয়ে আছে পারসি দরায়ুস, গ্রিক আলেকজান্ডার, হুন আটিলা ও মোগল চেঙ্গিজ খাঁয়ের নাম। বেয়াজিদও এই অভিনয়ে যোগ দিয়ে সফল হয়েছেন।

কিন্তু ইউরোপ বিজেতার সঙ্গে এশিয়া বিজেতার শক্তি পরীক্ষার কথা আগে শোনা যায়নি। সুতরাং সারা পৃথিবী যে এই অপূর্ব পরীক্ষার ফলাফল দেখবার জন্যে উন্মুখ হয়ে থাকবে, এ হচ্ছে খুবই স্বাভাবিক কথা।

আগেই বলা হয়েছে, নিজের জয়ের সম্বন্ধে সম্পূর্ণ নিশ্চিন্ত হয়ে বেয়াজিদ আঙ্গোরা শহরের কাছে ছাউনি ফেলেছেন। তিনি স্থির করেছেন, বহুদূর থেকে আগত তৈমুরের পথশ্রান্ত সৈন্যদের বিশ্রামের অবকাশ না দিয়েই আক্রমণ ও পরাজিত করবেন।

বেয়াজিদ বসে বসে অপেক্ষা করছেন—অপেক্ষাই করছেন! এক দিন, দুই দিন, তিন দিন। সিভা শহর থেকে এদিকে আসবার একমাত্র পথে বিরাজ করছে কেবল ধু ধু শূন্যতা। ক্রমে সাত দিন কেটে গেল। তবু তৈমুরের দেখা নেই। গুপ্তচররা চারিদিক থেকে ফিরে এসে বললে,—তৈমুরের সসৈন্যে সিভা থেকে বেরিয়ে পড়েছেন বটে, কিন্তু তিনি যে এখন কোথায়, কেউ তা জানে না।

শত্রু যুদ্ধযাত্রা করেছে, অথচ একবারে অদৃশ্য! বেয়াজিদ এমন বেয়াড়া ও আজব ব্যাপার কল্পনায় আনতে না পেরে হতভম্ব হয়ে গেলেন। তাঁর সৈন্যরা হালিজ নদীর ধারে ব্যূহ রচনা করে যুদ্ধের জন্যে প্রস্তুত হয়ে আছে। কিন্তু তারা কার সঙ্গে যুদ্ধ করবে? শত্রু কোথায়?…বেয়াজিদ ছাউনি তুলে ব্যূহ ভেঙে নানাদিকে ছুটোছুটি করতে লাগলেন।

তারপর তৈমুরের খবর পাওয়া গেল। তিনি সিভার পথ ধরেননি। হালিজ নদীর অন্য তীর দিয়ে যাত্রা করে একেবারে আঙ্গোরা নগর অবরোধ করে বসেছেন। এই আঙ্গোরাই ছিল তুর্কিদের প্রধান আশ্রয়—ওখানেই জমা করা ছিল তাদের যা কিছু রসদ!

তৈমুরকে খোঁজবার জন্যে আশ্রয় ছেড়ে দূরে এসে পড়ে কী অন্যায়ই যে করেছেন, এতক্ষণে বেয়াজিদ তা ভালো করেই বুঝলেন। কিন্তু এখন আর অন্য উপায় নেই, এখান থেকে আঙ্গোরা সাত দিনের পথ—এখন এই দীর্ঘ পথই করতে হবে তাঁকে অতিক্রম। প্রথম চালে জিতে গেলেন তৈমুর।

তৈমুরকে বাধা দেওয়ার জন্যে বেয়াজিদ ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটলেন। কিন্তু যতই অগ্রসর হন ততই তাঁর চক্ষু স্থির হয়ে যায়। তৈমুর সমস্ত গ্রাম ও শস্যখেত লুণ্ঠন করেছেন—কোথাও এককণা খাবার নেই। পথিমধ্যে যত জলাশয় বা উৎস ছিল, তাতাররা সব নষ্ট করে দিয়েছে—কোথাও একফোঁটা জল নেই, এমনকী আঙ্গোরা শহরের সুমুখ দিয়ে যে নদীটি বইত, তৈমুর বাঁধ দিয়ে তারও মোড় ফিরিয়ে দিয়েছেন। সে নদী বইছে এখন তাতার সৈন্যদের পিছন দিকে। দ্বিতীয় চালেও তৈমুরের জিৎ।

তুর্কিরা এসেছে শুনে তৈমুরও আঙ্গোরা ছেড়ে এগিয়ে এলেন। তখন যুদ্ধ করা ছাড়া বেয়াজিদের আর কোনও উপায় রইল না। তাঁর সৈন্যরা পথশ্রান্ত, দারুণ পিপাসায় প্রাণ তাদের কণ্ঠাগত। এ অবস্থায় যুদ্ধ করা সম্ভব নয়—কিন্তু তাঁকে যুদ্ধ করতেই হবে।

দুই পক্ষের সৈন্যদলের সম্মুখভাগ পনেরো মাইল দীর্ঘ। তুর্কিরা হইহই রবে করতাল ও জয়ঢাক বাজাতে বাজাতে অগ্রসর হল, কিন্তু তাতাররা দাঁড়িয়ে রইল স্তব্ধ হয়ে। সূর্য তখন প্রখর।

তৈমুর তখনও ঘোড়ায় চড়া দরকার মনে করলেন না—প্রাথমিক যুদ্ধের ভার রইল সেনাপতিদের হাতেই। পৌত্র রাজকুমার মহম্মদ ছিলেন সেনাদলের মধ্যভাগের কর্তা। এখানে বর্মাবৃত হস্তীদলও ছিল। তৈমুর ভারতবর্ষ থেকে যুদ্ধে হাতি ব্যবহার করার পদ্ধতি শিখে এসেছেন।

তাতার ফৌজের দক্ষিণ ভাগ রক্ষা করছেন তৈমুরের সবচেয়ে নিপুণ সেনাপতি নূরউদ্দিন। বেয়াজিদের পুত্র সুলেমান অশ্বারোহী সৈন্যদের নিয়ে সর্বপ্রথমে সেইদিক আক্রমণ করলেন। সঙ্গে সঙ্গে তাতারদের স্তব্ধতা ভঙ্গ হল। তারা শত্রুদের উপরে নিক্ষেপ করতে লাগল ঝাঁকে ঝাঁকে তির ও জ্বলন্ত ‘ন্যাপথা’।

তুর্কিরা ব্যতিব্যস্ত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল এবং সঙ্গে সঙ্গে তাতাররা আক্রমণ করলে প্রবল পরাক্রমে। সে আক্রমণ সইতে না পেরে অনেক তুর্কি রণক্ষেত্র ছেড়ে পালিয়ে গেল। সেই সময় তাতারদের বামপার্শ্বও তুর্কিদের উপর ভেঙে পড়ল সমুদ্রতরঙ্গের মতন। দু-দিক থেকে আক্রান্ত হয়ে তুর্কি অশ্বারোহীদের অবস্থা হয়ে উঠল বিষম শোচনীয়।

তখন তৈমুর তাঁর পৌত্রকেও বাছা বাছা সৈন্য নিয়ে তুর্কিদের অধীনস্থ সার্ভিয়ান অশ্বারোহীদের আক্রমণ করবার জন্যে হুকুম দিলেন। কাড়া-নাকাড়ার তালে তালে অস্ত্রে অস্ত্রে উঠল সে কী ঝনৎকার!

হাজার হাজার তরবারির বিদ্যুৎ-দীপ্তিতে চক্ষু হতে চায় অন্ধ এবং যোদ্ধাদের বিজয় হুঙ্কারে কাঁপতে থাকে যেন আকাশ-বাতাস!

খানিক পরে দেখা গেল, তুর্কিদের দক্ষিণ পার্শ্ব একেবারে ভেঙে গিয়েছে। সার্ভিয়ার রাজা পিটার নিহত এবং তাতার রাজকুমার মহম্মদ আহত (পরে আহত মহম্মদের মৃত্যু হয়)।

এতক্ষণ পরে সুসময় বুঝে মধ্যভাগের সেনাদল নিয়ে স্বয়ং তৈমুর অগ্রসর হলেন। তুর্কিদের বিখ্যাত ‘ওসমানলি’ পদাতিকরা তৈমুর-চালিত তাতার অশ্বারোহীদের আক্রমণ সহ্য করতে পারলে না—তারা প্রাণ নিয়ে পলায়ন করতে লাগল।

বেয়াজিদ যেন পাগলের মতন হয়ে উঠলেন! নিজের রক্ষী সৈন্যদের নিয়ে স্বহস্তে কুঠার ধারণ করে তিনি যুদ্ধ করতে লাগলেন—কিন্তু বৃথা! রক্ষী সৈন্যরা কেউ পালাল না বটে, কিন্তু একে একে সবাই মারা পড়ল এবং বেয়াজিদ হলেন বন্দি।

এর পরের দৃশ্য হচ্ছে তৈমুরের তাঁবুর ভিতরে। পুত্র শা রুখের সঙ্গে তৈমুর দাবা-বোড়ে খেলছেন। এমন সময়ে বন্দি বেয়াজিদকে নিয়ে তাতার সৈন্যদের প্রবেশ।

তৈমুর হাসতে হাসতে উঠে দাঁড়ালেন।

বেয়াজিদের আত্মগর্বে আঘাত লাগল। তিনি বললেন, ‘ভগবান যাকে মেরেছেন, তাকে দেখে উপহাসের হাসি হাসা ভদ্রতা নয়।’

তৈমুর ধীরে ধীরে বললেন, ‘আমি কেন হাসছি জানো? তোমার মতন অন্ধ আর আমার মতন খঞ্জের উপরেই ভগবান দিয়েছেন কিনা পৃথিবী শাসনের ভার!’ তারপর গম্ভীর স্বরে বললেন, ‘তোমার হাতে বন্দি হলে আজ আমার কী হাল হত সেটাও অনুমান করা কঠিন নয়।’

বেয়াজিদ এ কথার জবাব দিতে পারলেন না। তৈমুর হুকুম দিলেন, ‘সুলতানের বন্ধন খুলে দাও!’

বেয়াজিদ প্রার্থনা জানালেন তাঁর পুত্রদের খোঁজখবর নেওয়ার জন্যে।

রণক্ষেত্র থেকে সুলতানের এক পুত্র—মুসাকে এনে হাজির করা হল। আর এক পুত্র যুদ্ধে মারা পড়েছেন। বাকি ছেলেরা পালিয়ে যেতে পেরেছেন।

ওদিকে নূরউদ্দিন পলাতক তুর্কিদের পিছনে ধাবিত হয়ে বেয়াজিদের রাজধানী রুসা পর্যন্ত দখল করে ফেললেন। সুলতানের সমস্ত ধনরত্ন হল তৈমুরের হস্তগত।

বেয়াজিদ যথেষ্ট আদরযত্ন পেলেন বটে, কিন্তু মুক্তি পেলেন না। এক বৎসর আগে তৈমুরকে যে অপমানকর পত্র লিখেছিলেন, আজ তারই ফলভোগ তাঁকে করতে হল। কিন্তু ইউরোপ বিজেতা বেয়াজিদকে এই চরম অধঃপতনের যন্ত্রণা বেশিদিন সহ্য করতে হয়নি। মাস কয়েক পরে বন্দি অবস্থাতেই তাঁর মৃত্যু হয়।

আঙ্গোরার যুদ্ধের ফলে তুর্কিদের বিষদাঁত একেবারে ভেঙে গেল। এরপর দীর্ঘকাল তারা আর মাথা তুলতে পারেনি। পূর্ব রোম সাম্রাজ্যের রাজধানী কনস্তান্তিনোপলও করলে নিশ্চিত পতন থেকে আত্মরক্ষা।

দুর্ধর্ষ তুর্কি সুলতানের এই কল্পনাতীত পরাজয়ে সমগ্র ইউরোপ হল বিস্ময়ে হতভম্ব। ইউরোপীয় রাজা-রাজড়ারা ভয়ও কম পেলেন না—কী জানি, যদি তৈমুরের ইউরোপ বেড়াবার শখ হয়, তাহলেই তো সর্বনাশ! ফ্রান্স, স্পেন, গ্রিস ও ইংলন্ডের রাজারা তাঁকে খুশি করবার জন্যে অভিনন্দন পাঠাতে দেরি করলেন না। মিশরও নত হয়ে তাঁর প্রাধান্য স্বীকার করলে।

কিন্তু তৈমুরের ইউরোপ ভ্রমণের ইচ্ছা হল না! ইউরোপের তখনকার রাজারা তাঁর কাছে ছিলেন নগণ্য, তাদের রাজ্যে এমন কোনও আকর্ষণ বা গৌরবজনক বস্তু নেই, তৈমুরের উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে যা করতে পারে জাগ্রত। বেয়াজিদের দেশ থেকেই তিনি আশাতীত ঐশ্বর্য লাভ করলেন। এবং তাইতেই তুষ্ট হয়ে স্বদেশে ফিরে এলেন সসৈন্যে।

কিন্তু তাঁর চিত্তকে অধিকার করে রইল আর এক উচ্চাকাঙ্ক্ষা। তাঁর জীবনের সমস্ত স্বপ্ন সত্যে পরিণত হয়েছে, বাকি আছে কেবল একটি—

‘আমি হচ্ছি সমগ্র ধরণীর একমাত্র অধীশ্বর আমির তৈমুর—পৃথিবীতে আমার কোনও প্রতিদ্বন্দ্বী রেখে যাব না!’

তৈমুরের সামনে জেগে আছে আর একটিমাত্র দেশ। তাকে দমন করতে পারলেই তাঁর সমস্ত কর্তব্য সমাপ্ত হয়!

তৈমুরের বয়স এখন ৬৯ বৎসর। তাঁর দৃষ্টিশক্তি ক্রমেই ক্ষীণ হয়ে আসছে। তিনি জানতেন, তাঁর পরমায়ু শেষ হয়ে এসেছে। মহাপ্রস্থানের আহ্বান আসবার আগেই তিনি তাড়াতাড়ি শেষ যুদ্ধযাত্রার জন্য প্রস্তুত হতে লাগলেন!