তৃতীয় পরিচ্ছেদ । ‘পিটার দি গ্রেট’—বোম্বেটের আদিপুরুষ
টর্টুগা দ্বীপে সর্বপ্রথমে যে জলদস্যু বিশেষ নামজাদা হয়, জাতে সে ফরাসি। তার নাম ছিল ইংরেজিতে ‘পিটার দি গ্রেট’। সে একলা নিজের বুদ্ধিতে জনকয় লোকের সাহায্যে যে অসম্ভবকে সম্ভব করেছিল, তাইতেই তার ডাকনাম চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে।
একদিন সে একখানা বড় নৌকোয় চড়ে হাইতি দ্বীপের কাছে সমুদ্রে শিকারের সন্ধানে ফিরছিল এবং তার সঙ্গে ছিল আঠাশজন বোম্বেটে।
কয়েকদিন ধরে শিকারের অভাব, নৌকোয় খাবার ফুরিয়ে এল বলে। সকলকার মন বড় খারাপ,—পেট চলবে কেমন করে?
এমন সময়ে সমুদ্রের বুকে দেখা গেল, স্পেনের এক ‘ফ্লোটা’। ফ্লোটা হচ্ছে অনেকগুলো বড় বড় জাহাজের সমষ্টি এবং তাদের কাজ হচ্ছে ইউরোপের জিনিস আমেরিকার বন্দরে আনা ও আমেরিকার মাল ইউরোপে নিয়ে যাওয়া।
দেখা গেল, মস্ত একখানা জাহাজ ‘ফ্লোটা’র দলছাড়া হয়ে অনেক দূরে এগিয়ে পড়েছে।
পিটার তখন মরিয়া হয়ে উঠেছে। সে বলল, ‘ভাইসব! যা থাকে কপালে! ওই দলছাড়া জাহাজখানাকে আমরা আজ দখল করবই করব!’
পিটার অসম্ভব কথা বললে। একখানা নৌকো, উনত্রিশজন মাত্র তার আরোহী! এরই জোরে শত শত লোকের সঙ্গে লড়াই করে অতবড় জাহাজ দখল করা আর লতা দিয়ে হাতি বাঁধবার চেষ্টা করা একই কথা।
কিন্তু পিটারের দলের লোকেরাও আসন্ন অনাহারের সম্ভাবনায় তারই মতন মরিয়া। তারাও পিটারের কথায় সায় দিয়ে বলল, ‘তাই সই, সরদার!’
নৌকো বেয়ে জাহাজের কাছে এসে বোম্বেটেরা বুঝল, দিনের আলোয় এমন অসাধ্যসাধন করা একেবারেই অসম্ভব। জাহাজের লোকরা একবার দেখতে পেলে মরণের মুখ থেকে তাদের কেউ বাঁচাতে পারবে না। অতএব তারা বুদ্ধিমানের মতো সন্ধ্যার অন্ধকারের অপেক্ষা করতে লাগল।
সন্ধ্যা এল।
পিটার বললে, ‘আমাদের নৌকোর তলায় ছ্যাঁদা করে দিই এসো! সেই ছ্যাঁদা দিয়ে জল ঢুকে আমাদের নৌকোখানাকে ডুবিয়ে দিক। এই অকূল সমুদ্রে নৌকো ডুবে গেলে আমাদের আর বাঁচবার কি পালাবার কোনও উপায়ই থাকবে না। তাহলে আমরা আরও বেশি মরিয়া হয়ে লড়তে পারব আর আরও তাড়াতাড়ি জাহাজে ওঠবার জন্যে চেষ্টা করব। অত বড় জাহাজ আমাদের পক্ষে এখন ভয়ের কারণ বটে। কিন্তু তখন ওই জাহাজকেই মনে করব আমাদের একমাত্র আশ্রয়!’
তখনই এই অদ্ভুত প্রস্তাব অনুসারে কাজ করা হল, ছ্যাঁদা করা নৌকো ধীরে ধীরে অতলে তলিয়ে যেতে আরম্ভ করল।
কিন্তু তার আগেই সাঁঝের আবছায়ায় গা ঢেকে বোম্বেটেরা চুপিচুপি একে একে জাহাজের উপর উঠতে লাগল—ছায়ামূর্তির সারির মতো। তাদের প্রত্যেকেরই কাছে একটি করে পিস্তল ও একখানা করে তরবারি ছাড়া আর কোনও অস্ত্র নেই!
জাহাজের এক কামরায় বসে কাপ্তেন ও আরও কয়েকজন লোক নিশ্চিন্ত আরামে তাস খেলছিলেন।
আচম্বিতে একটা লোক কামরায় ঢুকে কাপ্তেনের বুকের উপরে পিস্তল ধরে বললে, ‘একটু নড়েচ কি গুলি করেছি!’
কাপ্তেন একেবার থ। এ যে বিনামেঘে বজ্রাঘাত!
কাপ্তেনের অন্যান্য সঙ্গীরা সচকিতকণ্ঠে বলে উঠল, ‘যিশু আমাদের রক্ষা করুন! কে এরা? কোত্থেকে এল? এরা কি সাক্ষাৎ শয়তান!’
ততক্ষণে পিস্তল বাগিয়ে ও তরবারি উঁচিয়ে আরও কয়েকজন বোম্বেটে কামরায় এসে হাজির হয়েছে এবং দলের বাকি কয়েকজন লোক সর্বাগ্রে গিয়ে জাহাজের অস্ত্রশালা দখল করে বসেছে! কেউই এই অতর্কিত আক্রমণের জন্যে প্রস্তুত ছিল না, যারা বাধা দেওয়ার চেষ্টা করলে তাদের প্রত্যেককেই মরতে হল!
তখন জাহাজের বাকি সকলেই ভয়ে ভয়ে বোম্বেটেদের কাছে আত্মসমর্পণ করল!
পরে শোনা গেল, সন্ধ্যার আগে কেউ কেউ নৌকোখানাকে দেখতে পেয়ে নাকি বলেছিল, ‘ওখানা বোম্বেটে-নৌকো!’
জবাবে কাপ্তেন বুক ফুলিয়ে বলেছিলেন, ‘বয়ে গেল! আমার এত বড় জাহাজ, এত লোকবল, আমি কি ওই খুদে পিঁপড়ের মতো নৌকোখানাকে দেখে ভয় পাব? আমার জাহাজের সমান জাহাজ এলেও আমি থোড়াই কেয়ার করি।’
জাহাজের জনকয় মাহিনা করা নাবিককে দলে রেখে, পিটার বাকি সবাইকে ডাঙায় নিয়ে গিয়ে নামিয়ে দিলে। তারপর সেই মূল্যবান মালে বোঝাই সুবৃহৎ জাহাজ নিয়ে ফ্রান্সের দিকে যাত্রা করলে। পিটার আর কখনও আমেরিকায় ফিরে আসেনি।
টর্টুগার যে সব লোক স্পানিয়ার্ডদের অত্যাচারে অবিচারে কাবু হয়ে হাহাকার করছিল, তারা যখন পিটারের এই অদ্ভুত বিজয়কাহিনি ও অপূর্ব সম্পদ লাভের কথা শুনলে, তখন একবাক্যে বিপুল উৎসাহে বলে উঠল, ‘আমরাও তবে বোম্বেটে হব,—স্পানিয়ার্ডদের ওপরে প্রতিশোধ নেব!’
কিন্তু জল-ডাকাত হতে গেলে আগে দরকার অন্তত একখানা করে ছোট জাহাজ বা একখানা করে বড় নৌকো। তার মূল্য কে দেয়? ভেবেচিন্তে তারা উপায় আবিষ্কার করল।
বন্দরে বন্দরে স্পানিয়ার্ডরা ছোট ছোট নৌকো করে চামড়া ও তামাক প্রভৃতি সংগ্রহ করত। তারপর তারা সেই সব মাল নিয়ে হাভানা শহরে গিয়ে হাজির হত। কারণ ইউরোপ থেকে স্পানিয়ার্ডরা সেইখানেই ব্যবসা করতে আসত।
নতুন বোম্বেটেরা দল পাকিয়ে সেই সব মালবোঝাই জাহাজ স্পানিয়ার্ডদের কাছ থেকে কেড়ে নিতে আরম্ভ করল। তারপর সেই লুটের মাল বেচে তারা বড় বোম্বেটে হওয়ার মূলধন সংগ্রহ করে ফেলল। ব্যাপারটা শুনতে খুব সোজা বটে, কিন্তু এরজন্যে বড় কম মারামারি, রক্তপাত ও নরহত্যা হল না।
তার মাসখানেক পরেই স্পেনদেশীয় ব্যবসায়ীদের বড় বড় দু-খানা জাহাজ বোম্বেটেদের হাতে ধরা পড়ল—সে জাহাজ দুখানার ভিতরে ছিল প্রচুর সোনা ও রুপো।
টর্টুগার যে সব লোক তখনও নতমাথায় অত্যাচার সহ্য করছিল, তারাও আর লোভ সামলাতে পারল না, তারাও বোম্বেটেদের দলে যোগ দিল! বছর দুইয়ের মধ্যেই লুটের ঐশ্বর্যে টর্টুগারও যেমন শ্রীবৃদ্ধি হল, ব্যাঙের ছাতার মতো বোম্বেটের দলও তেমনই বাড়তে লাগল! তখন এই দ্বীপটি একরকম বোম্বেটেদেরই স্বর্গ হয়ে দাঁড়াল—স্পানিয়ার্ডরা সেখান থেকে একেবারেই পিঠটান দিতে বাধ্য হল!
দেখতে দেখতে টুর্টুগা দ্বীপে বোম্বেটে জাহাজের সংখ্যা হয়ে দাঁড়াল কুড়িখানারও বেশি।
বুকে বসে এই দাড়ি ওপড়ানো স্পানিয়ার্ডরা আর সইতে পারল না দেশে—অর্থাৎ স্পেনে খবর পাঠিয়ে আত্মরক্ষা ও বোম্বেটে দমন করবার জন্যে প্রকাণ্ড দুখানা যুদ্ধজাহাজ আনাবার বন্দোবস্ত করল।