তৃতীয় খণ্ড – রহস্যের অবসান
প্রথম পরিচ্ছেদ – দরিয়ার কবলে মীনা
পড়োবাড়ী ছাড়িয়া রওনা হইতেই প্রায় ভোর হইয়া গিয়াছিল। বেলা আটার সময় ইন্দ্রানন্দ বাড়ীর সন্নিকটবর্ত্তী হইলেন।
ইন্দ্রানন্দ বাড়ীর উদ্যানের ভিতর ডাণ্ডি নামাইতে বলিয়া, মীনাকে ডাকিয়া অতি মৃদুস্বরে বলিলেন, “আমি আগে বাড়ীতে খবর দিই। বল, তুমি আমায় না বলিয়া পালাইবে না।”
মীনা কহিল, “আচ্ছা, তাহাই হইবে।”
“আমি জানি, তুমি মিথ্যাকথা বলিবে না,” বলিয়া ইন্দ্রানন্দ গৃহের দিকে ছুটিলেন। মীনা বীরবিক্রমের পার্শ্বে দাঁড়াইয়া রহিল। তখনও বীরবিক্রমের সম্পূর্ণ সংজ্ঞালাভ হয় নাই।
বাড়ীতে প্রবেশ করিতে-না-করিতে ইন্দ্রানন্দ দেখিলেন—সম্মুখে দরিয়া। দরিয়া রাত্রে নিদ্ৰা যাইতে পারে নাই। দাদাকে আবার বীরবিক্রমের সন্ধানে পাঠাইয়া সে সমস্ত রাত্রি ছট্ফট্ করিয়াছে। এখন সহসা ইন্দ্রানন্দকে দেখিয়া ব্যগ্র হইয়া কহিল, “কি হয়েছে দাদা, শীঘ্র বল— তোমার চেহারা দেখিয়া আমার বড় ভয় হইতেছে।”
ইন্দ্রানন্দ বলিলেন, “সমস্ত রাত্রি ঘুমাই নাই।”
দরিয়া আরও ব্যগ্র হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, “কেন?”
“সব পরে বলিব। এখন একজনকে আনিয়াছি—তিনি পীড়িত।”
দরিয়া দুরুদুরুবক্ষে সসঙ্কোচে বলিল, “কি! কে—কে পীড়িত?”
“অধীর হইয়ো না—বীরবিক্রম পীড়িত—বড় বিপন্ন—তাঁহাকে কাহার কাছে রাখিয়া আসিব বলিয়া এখানেই আনিয়াছি।”
“তিনি কোথায়?” বলিয়া দরিয়া উত্তরের অপেক্ষা না করিয়া বাহিরের দিকে ছুটিতেছিল কিন্তু ইন্দ্রানন্দ তাহার হাত ধরিলেন।
ইন্দ্রানন্দ বলিলেন, “তুমি এত উতলা হইলে, তাঁহার পীড়া বাড়িতে পারে। বাবা কোথায়? তাঁহাকে আগে খবর দেওয়া উচিত।”
গুণারাজ ইন্দ্রানন্দের কণ্ঠস্বর শুনিতে পাইয়াছিলেন। তিনি সেইদিকে আসিলেন। তাঁহাকে দেখিয়া ইন্দ্রানন্দ বলিলেন, “মাথায় একটা আঘাত লাগায় বীরবিক্রম অজ্ঞান হইয়া গিয়াছিলেন— বাঁচিবার আশা ছিল না। তাঁহার বাড়ীতে তাঁহাকে দেখিবার লোক কেহ নাই, তাহাই তাঁহাকে সঙ্গে করিয়া আনিয়াছি।”
গুণারাজ বলিলেন, “কোথায়?”
ইন্দ্রানন্দ বলিলেন, “ডাণ্ডিতে-বাহিরে আছেন।”
গুণারাজ বীরবিক্রমকে এইরূপে বাড়ীতে আনায় যে বিশেষ প্রীত হইলেন, তাহা নহে; তবে তিনি বীরবিক্রমকে বড় ভালবাসিতেন। বলিলেন, “বাহিরে রাখিয়াছ কেন? এখনই তাহাকে ভিতরে লইয়া এস। কে আছ, এখনই ডাক্তারকে খবর দাও।”
তাঁহারা তিনজনে ডাণ্ডির নিকটে আসিলেন। মীনা মুখ নীচু করিয়া সেইখানে চিত্রিত মূর্ত্তির ন্যায় স্থিরভাবে দাঁড়াইয়া আছে। মীনাকে দেখিয়া গুণারাজ একটু বিস্মিতভাবে জিজ্ঞাসা করিলেন, “এই মেয়েটি কে?”
ইন্দ্রানন্দ কি উত্তর দিবেন, স্থির করিতে পারিলেন না। আপনা-আপনিই কেমন তাঁহার মুখ হইতে বাহির হইয়া গেল, “বীরবিক্রমের পীড়া বড় বাড়িয়াছিল, তাহাই ইহাকে সঙ্গে আনিয়াছি। এ–এ একজন শুশ্রূষাকারিণী।”
দরিয়া বলিয়া উঠিল, “দেখছ না বাবা, ইনি বীরবিক্রমের বোন—দুজনের মুখ এক? দাদা, বাবার কাছে লুকাইতেছ কেন?”
মীনা ও বীরবিক্রমের মুখাকৃতিতে যে পরস্পর সৌসাদৃশ্য ছিল, তাহা ইন্দ্রানন্দও দুই-একবার মনে করিয়াছিলেন। এখন ভগিনীর কথায় তাঁহার চোখের আবরণ যেন অপসারিত হইল। তিনি বলিলেন, “সত্যই ত দুজনের মুখ এক!”
দরিয়ার কথা মীনারও কানে গিয়াছিল। সে চমকিত হইয়া তাহার দিকে চাহিয়াছিল। তাহারও মনে হইল, হাঁ, বীরবিক্রমের মত তাহারও ত মুখ!
গুণারাজ লোকজন ডাকিয়া অতি যত্নে বীরবিক্রমকে লইয়া গিয়া শয়ন করাইয়া দিলেন। তাঁহার ভয়ানক জ্বর হইয়াছিল—তাঁহার জ্ঞান ছিল না। দরিয়া তাঁহার সঙ্গে সঙ্গে গিয়াছিল।
তখন ইন্দ্রানন্দ মীনার নিকট আসিয়া বলিলেন, “এস, যাইয়ো না।”
মীনা নিতান্ত কাতরভাবে বলিল, “দেখুন, আমায় এখন এখানে থাকিতে বলিবেন না— আপনাকে বুঝাইলে বুঝেন না কেন?”
দরিয়া বীরবিক্রমের সঙ্গে গিয়াছিল। তাঁহাকে শোওয়াইয়া রাখিয়াই সে আবার বাহিরের দিকে ছুটিয়া আসিয়া ক্ষিপ্রহস্তে মীনার হাত ধরিল। খানিকটা দূর টানিয়া আনিয়া বলিল, “এস।”
দরিয়ার ভাব দেখিয়া মীনার কণ্ঠরোধ হইয়া আসিল। অতি কষ্টে বলিল, “আমি আর কেন? কোন দরকার নাই।”
দরিয়া তাহার দিকে বিস্মিতনেত্রে চাহিয়া বলিল, “সে কি গো, দরকার নাই! তুমি তোমার দাদাকে ফেলিয়া যাইবে? না—না—তা হতেই পারে না। এ ত তোমার নিজের বাড়ী।”
মীনার দুই চক্ষু জলে পূর্ণ হইল। সে কথা কহিতে পারিল না। দরিয়া তাহাকে টানিতে টানিতে লইয়া চলিল। মীনা নীরবে চলিল। সন্তুষ্টচিত্তে হাস্যমুখে ইন্দ্রানন্দ তাহাদের পশ্চাতে চলিলেন।
সিঁড়িতে উঠিতে উঠিতে দরিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “ভাই, তোমার নামটি কী?”
মীনা অস্পষ্টস্বরে বলিল, “মীনা।”
শুনিয়া দরিয়া থ হইয়া গেল। বিস্ফারিতনেত্রে অত্যন্ত বিস্ময়ের সহিত মীনার আপাদমস্তক দেখিতে লাগিল। তাহার পর কৌতুক হাস্যপূর্ণনেত্রে একবার দাদার মুখের দিকে চাহিল। কি বলিতে যাইতেছিল, কিন্তু মুহূর্ত্ত মধ্যে সে আত্মসংবরণ করিল; এবং নিরীহ মীনার হাত ধরিয়া টানিয়া লইয়া বাড়ীর ভিতর প্রবিষ্ট হইল।
এমন সময়ে ডাক্তারকে আসিতে দেখিয়া, ইন্দ্রানন্দ সেইদিকে গেলেন। তখন ইন্দ্রানন্দের মনের অবস্থা বর্ণনা করা বৃথা। তাঁহার হৃদয়ে তখন প্রতিক্ষণে শত শত অভিনব ভাবের লহরী-লীলা চলিতেছিল।
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ – ডিটেকটিভ
বীরবিক্রমের জ্বর গিয়াছে। মীনা ও দরিয়ার শুশ্রূষায় তিনি দিন দিন ভাল হইয়া উঠিতেছেন। একদিন মধ্যাহ্নে ইন্দ্রানন্দ নিজ গৃহে চিন্তামগ্ন রহিয়াছেন, তাঁহার এখন চিন্তার বিরাম নাই। বীরবিক্রম যে দয়ামলকে খুন করিয়াছে, ইহা তাঁহার কোন মতেই বিশ্বাস হয় না। অথচ কিজন্য যে, তিনি অবিশ্বাস করিবেন, তাহাও ভাবিয়া স্থির করিতে পারেন না; ইহা এক বিষম মুস্কিল। তাহার পর মীনার চিন্তা। মীনা কে? মীনার পিতা মাতা কে? মীনা কখনই ভদ্রবংশজাত না হইয়া অন্য কিছু হইতে পারে না। তিনি জানিতেন, অজ্ঞাতকুলশীলার সহিত তাঁহার পিতা কখনই বিবাহ দিতে সম্মত হইবেন না। তিনি মনে মনে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হইয়াছিলেন যে, যদি পিতা সম্মত না হন, তাহা হইলে তাঁহার অসম্মতিসত্ত্বেও মীনাকে বিবাহ করিবেন; অন্যত্রে গিয়া বাস করিবেন। প্রণয়ের প্রথম আবেগ এইরূপ দুৰ্দ্দমনীয়—ইন্দ্রানন্দের দোষ কি? তিনি এই সকল চিন্তায় মগ্ন আছেন, এমন সময়ে কে আসিয়া তাঁহার পৃষ্ঠস্পর্শ করিল। তিনি চমকিত হইয়া ফিরিয়া দেখিলেন—মীনা।
মীনার মুখ শুষ্ক—ভীতিপূর্ণ। ইন্দ্রানন্দ দেখিয়া ব্যস্ত ও চিন্তিত হইয়া বলিলেন, “কি হয়েছে, মীনা?” মীনা অতি মৃদুস্বরে সভয়ে বলিল, “তাহারা আসিয়াছে।”
ইন্দ্ৰানন্দ বিস্মিত হইয়া বলিলেন, “কাহাদের কথা বলিতেছ?”
“তারা—পুলিস।”
‘কোথায়?”
“বাগানে।”
“কই, আমি কাহাকেও দেখি নাই।”
“আমি দেখিয়াছি। একজন লোক গোপনে কি সন্ধান করিতেছিল, বাড়ীর জানালাগুলা ভাল করিয়া দেখিতেছিল; বাগানেও যেন কাহাকে সন্ধান করিতেছিল। একটু পরে আর একজন লোক তাহার কাছে আসিল, তখন তাহারা দুইজনে কি পরামর্শ করিয়া বাগানের অন্যদিকে গেল।”
ইন্দ্রানন্দও ভীত হইলেন। বলিলেন, “যদি তাহারা বীরবিক্রমের সন্ধানেই আসিয়া থাকে, তাহা হইলে বাগানের ভিতর ওরকম গোপনে সন্ধান করিবে কেন? তাহারা নিশ্চয়ই জানিতে পারিয়াছে, বীরবিক্রম আমাদের বাড়ীতে আছেন। তাহা হইলে নিশ্চয়ই তাহারা একেবারে বাড়ীর ভিতর আসিত—বাগানে সন্ধান করিত না।”
এক পলকে মীনার মুখ চিন্তায় গম্ভীর ও উদ্বেগে বিবর্ণ হইয়া গেল। সে কেবল মাত্র বলিল, “কিরূপে বলিব।”
ইন্দ্রানন্দ বলিলেন, “আমি দেখিয়া আসিতেছি।”
এই বলিয়া তিনি উঠিলেন। বাগানের দিকে প্রস্থান করিলেন। মীনা আবার রোগীর গৃহাভিমুখে গেল।
ইন্দ্রানন্দ কিয়ৎক্ষণ অনুসন্ধানের পর দেখিলেন যে, এক ব্যক্তি গুপ্তভাবে একটা গাছের আড়ালে দাঁড়াইয়া রহিয়াছে। ইন্দ্রানন্দ সত্বর তাহার নিকটে গিয়া দেখিলেন, তিনি তাঁহার অপরিচিত নহেন। এই ব্যক্তিকে তিনি কয়েকদিন পূর্ব্বে দেখিয়াছেন। ইনিই একদিন বীরবিক্রমের সন্ধানে গিয়াছিলেন—পরদিন ইনিই আবার বীরবিক্রমের বাড়ীর নিকটে ঘুরিতেছিলেন। ইহাকে আবার থানায় দেখিয়াছিলেন। সুতরাং ইনি যে একজন পুলিসের লোক, সে বিষয়ে তাঁহার কোন সন্দেহ ছিল না।
ইন্দ্রানন্দ তাঁহার নিকট গিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “আপনি এখানে কেন?”
লোকটি তাঁহার দিকে ফিরিলেন। বলিলেন, “আপনি কি আমায় চিনিতে পারেন?”
“হাঁ, আপনাকে চিনি—আপনাকে পূৰ্ব্বে দেখিয়াছি, আপনি একজন ডিটেক্টিভ।”
“হাঁ, গোপন করিবার প্রয়োজন নাই।”
“আপনি কি জন্য এখানে আসিয়াছেন, তাহা আমি জানি।”
“না, আপনি জানেন না।”
“জানি, আপনি বীরবিক্রমের সন্ধানে আসিয়াছেন। আপনাকে গোপন করা বৃথা—তিনি আমাদের বাড়ীতে পীড়িত হইয়া আছেন।”
“তাহা আমি জানি।”
“তবে আপনি বাড়ীতে না গিয়া বাগানের মধ্যে কাহাকে খুঁজিতেছেন?”
“আমি বীরবিক্রমের জন্য আসি নাই।”
ইন্দ্রানন্দ আশ্চৰ্য্যান্বিত হইয়া তাঁহার দিকে চাহিয়া রহিলেন। দেখিয়া ডিটেক্টিভ বলিলেন, “বীরবিক্রম যে নির্দোষী, তাহাই প্রমাণ করিবার চেষ্টায় আমি আছি।’
ইন্দ্ৰানন্দ সোৎসাহে বলিলেন, “আপনি কি তাঁহাকে নিদোষী মনে করেন?’
“হাঁ, তিনি খুন করেন নাই। যে খুন করিয়াছে, তাহাকে ধরিবার চেষ্টায় আমি আছি। বীরবিক্রমকে নিদোষী সপ্রমাণ করিবার পক্ষে আপনি আমাদের সাহায্য করিতে পারেন?“
“বলুন, কি করিতে হইবে। আমাকে যাহা বলিবেন, আমি তাহাই করিব।”
“পড়োবাড়ীতে একটি বালিকা থাকিত, তাহার নাম মীনা—আমি একবার তাহার সঙ্গে দেখা করিতে চাই।”
ইন্দ্রানন্দের মনে সন্দেহ হইল। তিনি ভাবিলেন, এ ত মীনাকে গ্রেপ্তার করিতে আসে নাই? পুলিসকে বিশ্বাস নাই। যখন এ জানিয়াছে, মীনা এই বাড়ীতে আছে, তখন অনায়াসেই বাড়ীতে গিয়া তাহাকে গ্রেপ্তার করিতে পারে।
ইন্দ্রানন্দ ইতস্ততঃ করিতেছেন দেখিয়া তিনি বলিলেন, “মীনা আপনাদের বাড়ীতে আছে, তাহা আমি জানি।”
ইন্দ্রানন্দ বলিলেন, “আসুন।”
ডিটেকটিভ নড়িলেন না।
তৃতীয় পরিচ্ছেদ – প্রশ্নবর্ষণ
ডিটেকটিভ বলিলেন, “আমি যে এখানে আসিয়াছি, তাহা আমি কাহাকেও জানিতে দিতে ইচ্ছা করি না। আমি এই বালিকার সহিত গোপনে দেখা করিতে চাই।”
কথাটা ইন্দ্রানন্দের ভাল লাগিল না, সুতরাং নীরবে রহিলেন। ইন্দ্রানন্দ কোন উত্তর দিতেছেন না দেখিয়া ডিটেক্টিভ বলিলেন, “অবশ্য আপনি সেখানে থাকিবেন।”
অগত্যা ইন্দ্রানন্দ বলিলেন, “বালিকা এ বিষয়ের কিছুই জানে না।”
“ভালই—আমি দুই-একটি কথা জিজ্ঞাসা করিব মাত্র। ইহাতে আপনার বন্ধুর উপকার ভিন্ন কোন অনিষ্ট হইবে না।”
“তবে আপনি এখানে অপেক্ষা করুন, আমি তাহাকে ডাকিতেছি।”
ইন্দ্রানন্দ বাড়ীর ভিতরে গিয়া মীনাকে একপার্শ্বে ডাকিয়া সব বলিলেন। পুলিস আসিয়াছে জানিয়া সে পূৰ্ব্বেই অতিশয় ব্যাকুল হইয়াছিল। এখন সে ভয় পাইয়া কহিল, “তবে সত্যই এসেছে?”
ইন্দ্রানন্দ বলিলেন, “হাঁ, তবে তিনি বীরবিক্রমকে গ্রেপ্তার করিতে আসেন নাই।”
“তবে তিনি এখানে কি করিতে আসিয়াছেন?
“তিনি তোমার সঙ্গে দেখা করিতে চান।”
“আমার সঙ্গে?”
“হাঁ, তোমাকেই দুই-একটা কথা জিজ্ঞাসা করিবেন।”
“আমাকে কি জিজ্ঞাসা করিবেন? আমি তাঁহার সঙ্গে দেখা করিব না।”
“তিনি বলিতেছেন, বীরবিক্রম খুন করেন নাই। যে খুন করিয়াছে, তিনি তাহারই সন্ধানে আছেন। তোমাকে দুই-একটা কথা জিজ্ঞাসা করিবেন মাত্র। তিনি বলিতেছেন, তাহাতে বীরবিক্রমের কোন অনিষ্ট হইবে না।”
“তা হইলে ত আমাকে সব কথা বলিতে হইবে।”
“তিনি যখন বীরবিক্রমকে নিদোষী বলিতেছেন, তখন বোধ হয়, তাঁহারা সবই জানেন।”
মীনা কিয়ৎক্ষণ নীরবে দাঁড়াইয়া রহিল। অবশেষে নিরুপায়ভাবে কহিল, “চলুন।”
ইন্দ্রানন্দ তাহাকে ডিটেক্টিভের নিকটে লইয়া আসিলেন। ডিটেকটিভ কিয়ৎক্ষণ ধরিয়া সাভিনিবেশদৃষ্টিতে মীনার আপাদমস্তক লক্ষ্য করিতে লাগিলেন। মীনার মুখ একেবারে লাল হইয়া গেল। সে সলজ্জভাবে মাথা নীচু করিল।
তিনি বলিলেন, “তোমাকে আমি দুই-একটা কথা জিজ্ঞাসা করিতে চাই।”
মীনা মুখ না তুলিয়া সংক্ষেপে কহিল, “বলুন।”
“তুমি যাহাকে দাদিয়া বল, তাহার কাছে তুমি কতদিন আছ?”
“প্রায় তিন-চার মাস হল।”
“তাহার আগে, তুমি বাছা কোথায় ছিলে?”
“একটি স্ত্রীলোক আমাকে মানুষ করিয়াছিলেন, তাঁহার কাছেই ছিলাম।”
“তিনি কে—কোথায় থাকেন?”
মীনা ইন্দ্রানন্দের মুখের দিকে চাহিল। তৎপরে ফিরিয়া বিরক্তভাবে বলিল, “সে কথা শুনিয়া আপনার কি হইবে?”
ডিটেক্টিভ বলিলেন, “একটু প্রয়োজন আছে, আমি তোমাকে সত্যকথা বলিতেছি, ইহাতে তাঁহার কোন অনিষ্ট হইবার সম্ভাবনা নাই।”
মীনা নাম ও ঠিকানা বলিল। ডিটেকটিভ উহা নিজের পকেটবুকে পেন্সিল দিয়া লিখিয়া লইলেন। লিখিয়া বলিলেন, “তোমাকে তিনি যদি ছেলেবেলা হইতে মানুষ করিলেন, তবে তিনি সহজে কেন এই দাদিয়ার হাতে তোমাকে ছাড়িয়া দিলেন?”
মীনা বলিল, “তিনি আমায় বলেছিলেন যে, দাদিয়া আমার মার মা, দাদিয়াই তাঁর কাছে আমাকে রেখে গিয়েছিল—দাদিয়াই বরাবর তাঁহাকে আমার খরচ দিয়াছিল, কাজেই দাদিয়া ফিরে এসে আমাকে চাহিলে তিনি কিছুতেই আমাকে আর রাখতে পারেন না।”
“তোমার মা বাপ কে ছিল, তিনি কখনও তোমাকে তাহা বলিয়াছিলেন?”
“না।”
“এই দাদিয়া কখনও বলিয়াছিল?”
“না।”
“তুমি কখনও তাঁহাদিগকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিলে?”
মীনা ডিটেটিভের এই প্রশ্নবর্ষণে মহা বিরক্ত হইয়া বলিল, “আপনাকে এত কথা আমি বলিতে পারি না।”
ডিটেক্টিভ বলিলেন, “বিরক্ত হও ত জিজ্ঞাসা করিব না—তবে এ সকল কথা জানিতে পারিলে দয়ামলকে যে খুন করিয়াছে তাহাকে আমরা ধরিতে পারি, আর বীরবিক্রমও নিদোষী সপ্রমাণ হয়—তোমারও উপকার হয়—তোমার বাপ মা কে, তাহাও তুমি জানিতে পার।”
মীনা কোন উত্তর না দিয়া দাঁড়াইয়া রহিল।
ডিটেক্টিভ জিজ্ঞাসা করিলেন, “যেদিন দয়ামল পড়োবাড়ীতে খুন হয়, তখন তুমি সেই বাড়ীতে ছিলে। তুমি কি একজন লোককে খুন করিতে দেখিয়াছিলে? তখন রাত্রি কত বলিতে পার?”
“বোধ হয়, নয়টা হইবে।”
“রাত নয়টার সময় বীরবিক্রম নিজের বাড়ীতে ছিলেন। এগারটার সময় পড়োবাড়ীতে আসেন আবার বারটার সময় বাড়ী ফিরে যান; সুতরাং দেখিতেছি, তাহা হইলে বীরবিক্রম দয়ামলকে খুন করেন নাই।”
“তবে কে খুন করিল?”
“এখন সেই কথাই হইতেছে। যে লোকটা খুন করে, তাহাকে তুমি দেখিয়াছিলে; তাহার চেহারা কেমন?”
মীনা এবার ইন্দ্রানন্দের দিকে চাহিল; কোন উত্তর দিল না। ইন্দ্রানন্দও নীরবে রহিলেন। ডিটেক্টিভ বলিলেন, “বীরবিক্রম খুন করেন নাই, আমরা এ বিষয়ে নিশ্চিত হইয়াছি; তবে তাঁহার চেহারার মত আর একজন লোক খুন করিয়াছিল—কেমন না?”
ইন্দ্রানন্দ ও মীনা উভয়েই ডিটেক্টিভের কথায় বিস্মিত হইয়া নীরবে রহিলেন; এবং ইনি এ সকল কিরূপে জানিলেন ভাবিয়া আশ্চৰ্য্যান্বিত হইলেন।
চতুর্থ পরিচ্ছেদ – প্রশ্নবর্ষণ—ক্রমশঃ
ইন্দ্রানন্দ বলিলেন, “মহাশয় এ সকল কথা কিরূপে জানিলেন? “
ডিটেক্টিভ মৃদু হাস্য করিয়া বলিলেন, “ইন্দ্রানন্দ সাহেব, পুলিসে চাকরী করিতে হইলে অনেক কথাই জানিতে হয়। আপনি সখের গোয়েন্দাগিরি করিতে গিয়া পুলিসের হাতে গ্রেপ্তার হইয়াছিলেন; কিন্তু হতাশ হইবেন না। আপনি বড়লোকের ছেলে—চাকরীর প্রত্যাশা রাখেন না, নতুবা আমরা আপনাকে পুলিসে লইতাম। আপনি ইচ্ছা করিলে একজন বিচক্ষণ ডিটেকটিভ হইতে পারেন।”
এই প্রশংসায় ইন্দ্রানন্দ যে সন্তুষ্ট হইলেন না, তাহা নহে। তিনিও হাসিয়া বলিলেন, “গোয়েন্দাগিরি করিতে গিয়া যে লাঞ্ছনা ভোগ হইয়াছে, তাহাতে আর এ কাজে ইচ্ছা নাই।”
ডিটেক্টিভ হাসিয়া বলিলেন, “আপনার ইচ্ছা না থাকিলেও বিশেষতঃ আমরা এ কাজটায় আপনাকে ছাড়িতেছি না।”
ইন্দ্রানন্দ বলিলেন, “আমাকে কি করিতে বলেন?
ডিটেক্টিভ বলিলেন, “পরে বলিব, এখন ইহাকে আর কষ্ট দিব না, আর দুই একটা কথা জিজ্ঞাসা করিব।”
মীনা তাঁহার মুখের দিকে চাহিল। তখন ডিটেক্টিভ বলিলেন, “বীরবিক্রম খুনের সময় উপস্থিত ছিলেন না, পরে গিয়াছিলেন; ইহা আমরা অনুসন্ধানে জানিয়াছি। তুমি কি অপর কোন লোককে, তোমার দাদিয়ার কাছে অনেক রাত্রে আসিতে দেখিয়াছ?”
মীনা ইন্দ্রানন্দের দিকে চাহিল। ইন্দ্রানন্দ বলিলেন, “যাহা জান, বল।”
মীনা ধীরে ধীরে বলিল, “হাঁ, আমি দু-তিনবার অপর একজন লোককে অনেক রাত্রে ঐ বাড়ীর ভিতরে দেখিয়াছি; কিন্তু তার মুখ ভাল করিয়া দেখিতে পাই নাই।
“তুমি উপরে শুইতে গেলে সেই লোকটা আসিত, তোমার দাদিয়াকে দরজা খুলে দিতে নিশ্চয়ই শুনিয়াছ।”
“না, বরং আমি জানালা দিয়া গোপনে দেখিয়াছি যে, দরজা কেহ খুলে কি না—না, কেহই দরজা খুলিত না।”
“তবে এই বাড়ীতে যাইবার কোন গুপ্তদ্বার আছে। যে বাড়ী থেকে মড়া ভাসিয়ে দিবার পথ আছে, সে বাড়ীতে গোপনে প্রবেশ করিবার নিশ্চয়ই কোন গুপ্তদ্বার আছে। তা হলে তোমার মনে হইয়াছিল, সেই লোকটা বীরবিক্রম।”
“হাঁ।”
“তা হলে বীরবিক্রমের চেহারার মত আর একজন লোকও আছে। কিছুই আশ্চৰ্য্য নয়। এই দেখ না কেন, তোমার চেহারা অনেকটা বীরবিক্রমের মত, হঠাৎ দেখিলে তোমাদের দুইজনকে ভাই-ভগিনী বলিয়া বোধ হয়।“
ইন্দ্রানন্দ ও মীনা উভয়েই বিস্মিতভাবে চাহিলেন। ডিটেকটিভ বলিলেন, “আর তোমাকে কষ্ট দিব না—আর একটা মাত্র কথা জিজ্ঞাসা করিব। তুমি কি জান, তোমার কোন ভাই আছে কি না?”
এ কথা ইন্দ্রানন্দ বা মীনা উভয়ের কাহারই কখনও পূর্ব্বে মনে হয় নাই। তবে কি যথার্থই মীনার কোন ভাই আছে? সেই কি গোপনে দাদিয়ার সঙ্গে দেখা করিত? সেই কি তবে দয়ামলকে খুন করিয়াছে? ডিটেক্টিভের এই কথায় উভয়েই স্তম্ভিত হইলেন। কেহ কোন কথা কহিতে পারিলেন না।
ডিটেক্টিভ আবার জিজ্ঞাসা করিলেন, “তোমার কোন ভাই আছেন, এ কথা কখনও কি শুনিয়াছ?” মীনা সংক্ষেপে কহিল, “না।”
ডিটেকটিভ কিয়ৎক্ষণ তাহার দিকে চাহিয়া থাকিয়া বলিলেন, “তোমাকে অনেক কষ্ট দিলাম, ক্ষমা করিবে। আর আমার কিছু জিজ্ঞাস্য নাই।”
মীনা কোন কথা না কহিয়া তথা হইতে প্রস্থান করিল। তখন ইন্দ্রানন্দ জিজ্ঞাসা করিলেন, “মহাশয়, তবে কি আপনি মনে করেন, মীনার কোন সহোদর আছে—সে-ই খুন করিয়াছে?”
ডিটেক্টিভ বলিলেন, “এখন কিছুই ঠিক বলিতে পারি না। কেবল সন্দেহ মাত্র।” এই বলিয়া তিনি কিয়ৎক্ষণ ইন্দ্রানন্দের মুখের দিকে নীরবে চাহিয়া রহিলেন; তাহার পর সহসা জিজ্ঞাসা করিলেন, “আপনি এই মীনাকে কিরূপ মনে করেন?
ইন্দ্রানন্দ বিস্মিতভাবে বলিলেন, “কি মনে করি—কোন বিষয়ে?“
“এ যে সত্য কথা বলিতেছে, তা কি আপনি বিশ্বাস করেন?”
“নিশ্চয়।”
“কেবল ত দু-চারদিন হতে এর সঙ্গে আপনার পরিচয়, ইহাতে এত নিশ্চিত হইলেন কিরূপে?”
“যে জন্যই হউক না কেন, আপনি নিশ্চিত জানিবেন, মীনা কখনও মিথ্যাকথা বলিতে পারে না।” ডিটেক্টিভ ইন্দ্রানন্দের মুখের দিকে চাহিয়া মৃদুহাস্য করিয়া বলিলেন, “আপনার বয়স কম। আপনি এখনও স্ত্রীলোককে ঠিক চিনিতে পারেন নাই। এই মীনার মুখ দেখিয়া আপনি ভুলিয়াছেন, তাহাতেই আপনি এ কথা মনে করিয়াছেন।”
ক্রোধে ইন্দ্রানন্দের মুখ আরক্ত হইল। ক্রোধে তাঁহার কণ্ঠরোধ হইল; তিনি অতিকষ্টে আত্মসংযম করিলেন। নতুবা হয় ত তিনি এই ব্যক্তিকে দুই ঘা বসাইয়া দিতেন। রুদ্ধপ্রায় কণ্ঠে বলিলেন, “আপনি এ কথা পুনরায় মুখে আনিবেন না।”
ডিটেক্টিভ মৃদুহাস্য করিয়া বলিলেন, “যদি আমরা বলি, এই মীনা দয়ামলকে খুন করিয়াছে, তাহা হইলে আপনি কি বলেন?”
“কি সৰ্ব্বনাশ!”
ডিটেক্টিভের এই কথা শুনিয়া ইন্দ্রানন্দ স্তম্ভিত হইলেন। ইহা যে তাঁহার পক্ষে স্বপ্নাতীত ইহা কখনই সম্ভব নহে—মীনা এরূপ ভয়াবহ কাজ কখনই করিতে পারে না। তিনি অতি দৃঢ়ভাবে বলিলেন, “মিথ্যাকথা।“
ডিটেক্টিভ স্থিরভাবে বলিলেন, “সম্ভব। আমি বলিতেছি না যে, মীনা দয়ামলকে খুন করিয়াছে, তবে তাহারও খুন করা সম্ভব।”
পঞ্চম পরিচ্ছেদ – খুনী কে?
ইন্দ্রানন্দ উদ্বিগ্নভাবে বলিলেন, “সে কেন খুন করিবে?”
ডিটেক্টিভ বলিলেন, “কেন খুন করিবে? তাহার কারণ আছে। আমি যাহা বলিতেছি, যথাৰ্থ যে তাহা ঘটিয়াছে, এমন বলি না, সম্ভবতঃ এইরূপ ঘটিতে পারে।”
“কি ঘটিতে পারে বলুন।”
“দয়ামল বীরবিক্রমের পিতার নিকট চাকরী করিত, সে তাঁহার সম্বন্ধে সকল কথা জানিত। দাদিয়ার সহিত দয়ামলের বন্ধুত্ব ছিল। দুজনে চক্রান্ত করিয়া তাঁহার সর্ব্বস্ব ফাকী দিয়া লইয়াছিল। অধিকন্তু এই দাদিয়া বীরবিক্রমের ভগিনী মীনাকে ছেলেবেলায় চুরি করিয়া লইয়া পলাইয়াছিল। বলুন, এটা সম্ভব কি না?”
“হাঁ, এমন হইতে পারে।”
“আচ্ছা, পাছে ধরা পড়ে বলিয়া দাদিয়া এ দেশ ছাড়িয়া পলাইয়াছিল। মেয়েটিকে কাহারও কাছে রাখিয়া গিয়াছিল। যতদিন বীরবিক্রমের পিতা জীবিত ছিলেন, ততদিন আর এদেশে আসে নাই।”
এই বলিয়া ইন্দ্রানন্দের দিকে চাহিলেন; কিন্তু ইন্দ্রানন্দ কোন কথা কহিলেন না। ডিটেকটিভ বলিলেন, “তার পর বীরবিক্রমের পিতার মৃত্যু হইলে দাদিয়া দেশে ফিরিয়া আসিয়া মীনাকে লইয়া এই পড়োবাড়ীতে লুকাইয়াছিল। ভয়ে লোকালয়ে থাকিতে সাহস করে নাই। বলা বাহুল্য, দয়ামলকে সে সকল কথাই বলিয়াছিল। দয়ামল মীনাকেও দেখিয়াছিল। দয়ামল যে ঘোর পাষণ্ড ছিল, তাহা সকলেই জানে, কিশোরী সুন্দরী মীনাকে দেখিয়া মহাপাপী তাহাকে লাভ করিবার জন্য উন্মত্তপ্রায় হইল। দাদিয়াও তাহার সহায় ছিল—সে-ও তাহার এ বিষয়ে সাহায্য করিতে লাগিল। তাহার পর কি হইল, আপনি কি মনে করেন?”
ডিটেক্টিভের কথায় ইন্দ্রানন্দ প্রথমে ক্রুদ্ধ হইয়াছিলেন, পরে অবিশ্বাস করিয়াছিলেন। ক্রমে এই সকল কথা সম্ভব বলিয়া তাঁহার বোধ হইতে লাগিল। তাঁহার মস্তক বিঘুর্ণিত হইল। তিনি বলিলেন, “মহাশয়, আমি কিছুই বুঝিতে পারিতেছি না।”
ডিটেক্টিভ বলিলেন, “তবে আরও শুনুন; একদিন অনেক রাত্রে দয়ামল গুপ্তদ্বার দিয়া পড়োবাড়ীতে যায়। যে ঘরে মীনা শয়ন করিয়াছিল, পা টিপিয়া টিপিয়া সেই ঘরে প্রবেশ করিল। মীনা নেপালী গুর্খার কন্যা—সর্ব্বদাই সে সঙ্গে সঙ্গে এক ছোরা রাখিত। দয়ামল তাহার উপর অত্যাচার করিতে উদ্যত হইলে সে তাহার ছোরা দয়ামলের বুকে বসাইয়া দিল। তাহাতেই দয়ামলের লীলাবসান হইল। কেমন—এখন কি রকম মনে করেন? এ কি সম্ভব নয়?”
ইন্দ্রানন্দ মনে মনে বুঝিলেন, ইহা নিশ্চয়ই সম্ভব। এরূপ অবস্থায় মীনা যে দয়ামলের বুকে ছুরি বসাইবে, তাহা খুব সম্ভব। তবে যদি তাহার ছুরিতে দয়ামল খুন হইয়া থাকে, তাহা হইলে মীনা কি তাঁহাকে অকুণ্ঠিতভাবে রাশি রাশি মিথ্যাকথা বলিয়াছে? ইন্দ্রানন্দকে চিন্তিত দেখিয়া ডিটেকটিভ বলিলেন, “মীনা যে খুন করিয়াছে, তাহার আরও প্রমাণ আছে। যে ছোরায় দয়ামল খুন হইয়াছে, সে ছোরা আমরা পাইয়াছি।”
ইন্দ্রানন্দ ভয় ও বিস্ময়ে কেমন এক রকম হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “কোথায় পাইলেন?”
“আমরা বীরবিক্রমের বাড়ী খানা-তল্লাসী করিয়াছিলাম। তাঁহার বাড়ীতেই সেই ছোরা পাওয়া গিয়াছে। সে ছোরা যে মীনার, তাহাতে কোন সন্দেহ নাই—ছোরার বাঁটে “মীনা” লেখা আছে।”
বীরবিক্রমের রক্তাক্ত হাত ও রক্তাক্ত ছোরা নিমেষ মধ্যে ইন্দ্রানন্দের চোখের সম্মুখে উদিত হইল। তিনি বলিয়া উঠিলেন, “বীরবিক্রমও খুন করিতে পারেন।”
ডিটেক্টিভ বলিলেন, “হাঁ, তাহাও সম্ভব। আমি বলিতেছি না যে, মীনাই ঠিক খুন করিয়াছে। আমি কেবল এই খুনের বিষয় লইয়া আপনার সহিত একটু আলোচনা করিতেছি।”
“আমার সহিত আলোচনা করিয়া লাভ?”
“একটু আছে—পরে বলিতেছি।”
“তবে আপনার দৃঢ় বিশ্বাস যে, মীনাই—”
“না, এ কথা বলি না। তবে মীনা খুন করিলে তাহার কোন ভয়ের কারণ নাই। সে আত্মরক্ষার জন্য দয়ামলের বুকে ছোরা মারিয়াছিল; এ অবস্থায় খুন করিলে সকলেই বেকসুর খালাস হইয়া থাকে। দয়ামলের মত পাষণ্ডের এরূপভাবে মৃত্যু হওয়ায় কেহই দুঃখিত হইবে না।”
“তবে কি মীনা আমাকে এত মিথ্যাকথা বলিয়াছে—এখনও বলিতেছে?”
“না, তা না হইতে পারে। সম্ভবতঃ সে যাহা বলিয়াছে, সত্যই বলিয়াছে। এখন বীরবিক্রম খুন করিয়াছেন কিনা, তাহারই আলোচনা করা যাউক।”
ইন্দ্রানন্দ ডিটেক্টিভের কথায় ক্রমশঃ অধিকতর বিস্মিত হইতে লাগিলেন। তাঁহার মুখ দিয়া কোন কথা নির্গত হইল না।
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ – প্রমাণাভাব
ডিটেক্টিভ বলিতে লাগিলেন, “বীরবিক্রমের বিরুদ্ধেও প্রমাণ যথেষ্ট। তাঁহার বাড়ীতেই রক্তমাখা ছোরা পাওয়া গিয়াছে, তিনি রাত্রি এগারটা হইতে বারটা পর্য্যন্ত বাড়ীতে ছিলেন না, তিনি সেই বাড়ীতে সেই রাত্রে এসেছিলেন। লোকে তাঁহাকে এখান হইতে ছুটিয়া বাহির হইতে দেখিয়াছে; তারপর মীনা তাঁহার মত একজন লোককে দয়ামলকে খুন করিতে দেখিয়াছে। কেবল একটা কথা মীনা বলিতেছে, দয়ামল নয়টার সময় খুন হয়; সুতরাং তখন বীরবিক্রম পড়োবাড়ীতে আসেন নাই। তবে মীনার ভুল হইতে পারে, যখন সে রাত্রি নয়টা ভাবিয়াছিল, তখন রাত্রি এগারটা হইতে পারে।” ইন্দ্রানন্দ বলিলেন, “মীনার ছোরা তিনি পাইবেন কোথা? যেদিন দয়ামলের মৃতদেহ আমরা জলে ভাসিতে দেখি, তাহার আগে তিনি কখনও মীনাকে দেখেন নাই।”
“এ বড় আশ্চর্য্য নয়। সম্ভবত মীনা ছোরা কোথাও ফেলে রেখেছিল। বীরবিক্রম তাহা দেখিতে পাইয়া তুলিয়া লইয়াছিলেন।”
“বীরবিক্রম দয়ামলকে কেন খুন করিবেন?”
“যথেষ্ট কারণ আছে। দয়ামল তাঁহার পিতৃ-শত্রু—দয়ামল তাঁহার সৰ্ব্বস্ব ফাকী দিয়া লইয়াছিল।” ডিটেক্টিভ ইন্দ্রানন্দের দিকে চাহিয়া বলিলেন, “তিনি কি বলেন?”
ইন্দ্রানন্দ ডিটেক্টিভের এই প্রশ্নে প্রথমে চমকিত হইয়াছিলেন। পরে বলিলেন, “তিনি আমাকে কিছুই বলেন নাই।”
ডিটেক্টিভ তাঁহার দিকে আবার কিয়ৎক্ষণ চাহিয়া রহিলেন। তৎপরে ধীরে ধীরে বলিলেন, “বীরবিক্রমের বিরুদ্ধে আরও প্রমাণ আছে।”
ইন্দ্রানন্দ ব্যগ্রভাবে বলিলেন, “কি?”
তিনি বলিলেন, “কে বেনামী করে মনিঅর্ডারে দয়ামলের স্ত্রীকে টাকা পাঠায়। আমরা অনুসন্ধানে পরে জানিয়াছি, সে টাকা বীরবিক্রমই পাঠাইয়াছেন। তিনি যদি খুন না করিবেন, তবে তাঁহার পিতৃশত্রুর স্ত্রীর প্রতি এত দয়া কেন? এই কথার উপর নির্ভর করিয়া ম্যাজিস্ট্রেট তাঁহার বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট বাহির করিয়াছেন।”
ইন্দ্রানন্দ বলিলেন, “তবে তাঁহাকে গ্রেপ্তার করিতেছেন না কেন?”
ডিটেকটিভ বলিলেন, “কারণ আছে। এই খুনের মোকদ্দমার তদন্তের ভার আমার উপর পড়িয়াছে। আমি পূৰ্ব্বেই আপনাকে বলিয়াছি যে, বীরবিক্রম খুন করিয়াছেন, এ বিষয়ে আমার ঘোরতর সন্দেহ জন্মিয়াছে। সেজন্য বীরবিক্রমকে গ্রেপ্তার করি নাই। একজনকে একবার গ্রেপ্তার করিলে পরে যথার্থ দোষীকে ধৃত করা বড় কঠিন।”
“আপনি তাহা হইলে মীনাকেই দোষী স্থির করিয়াছেন?”
“আপনাকে পূর্ব্বে বলিয়াছি, আমি মীনাকে দোষী বলি না।”
“তবে কে খুন করিয়াছে, আপনি মনে করেন?”
“আপনাকে আমার একটু প্রয়োজন, সেইজন্য আপনার সহিত এত কথা কহিতেছি। মীনা ও বীরবিক্রম দয়ামলকে খুন না করিলেও আর দুইজন তাহাকে খুন করিতে পারে।”
“কে তাহারা।”
“প্রথমে দাদিয়ার বিষয় আলোচনা করা যাক। এই বৃদ্ধা ভাল লোক নয়, নিশ্চয়ই কোন গুরুতর দোষ করিয়াছে, নতুবা লুকাইয়া পড়োবাড়ীতে বাস করিবে কেন?”
“দাদিয়ার দয়ামলকে খুন করিবার কারণ কি? আপনি বলিলেন, দয়ামলের সঙ্গে তার বন্ধুত্ব ছিল।”
“যেখানে বন্ধুত্ব সেইখানেই বিসম্বাদ। ইহা কিছুমাত্র আশ্চর্য্য নয়; বোধ হয়, দয়ামল কোন বিষয়ে এইমাত্র বুড়ীকে ফাকী দিয়াছিল। হয়ত সেই রাত্রে এই বিষয় লইয়া তাহাদের ঝগড়া হইয়াছিল; দাদিয়া রাগ সামলাইতে না পারিয়া তাহার বুকে ছোরা বসাইয়াছিল।”
ইন্দ্রানন্দ ব্যগ্রভাবে বলিলেন, “সম্ভব। সে বুড়ী সব করিতে পারে।”
ডিটেক্টিভ বলিলেন, “হঠাৎ কোন স্থির-সিদ্ধান্ত করিয়া ফেলা ঠিক নয়। বিশেষত বুড়ীর বিরুদ্ধে কোন প্রমাণ নাই। কেবল সন্দেহের বশে কাহাকে ফাঁসী দেওয়া যায় না।”
ইন্দ্রানন্দ হতাশভাবে বলিলেন, “উপায় একটা কিছু হইবে—আজ না হয়, দুইদিন পরে। মীনা, বীরবিক্রম, বৃদ্ধা তিনজনই দয়ামলকে খুন করিতে পারে। কিন্তু দাদিয়ার বিরুদ্ধে কোন প্রমাণ নাই। আর একজনও এই ব্যাপারে জড়িত আছে বলিয়া বোধ হয়—কোন একজন লোক, যাহার চেহারা বীরবিক্রমের মত; সম্ভবতঃ সে মীনার সহোদর, দাদিয়ার হাতের লোক। সে-ও খুন করিতে পারে।”
ইন্দ্রানন্দ বলিলেন, “আপনি আমাকে কি করিতে বলেন?”
ডিটেক্টিভ বলিলেন, “আপনি আমাদের এ বিষয়ে সাহায্য করিতে পারেন। করিবেন কি?”
ইন্দ্ৰানন্দ সোৎসাহে বলিলেন, “মীনা ও বীরবিক্রমকে নিদোষী সপ্রমাণ করিবার জন্য আমি সব করিতে পারি।”
ডিটেক্টিভ একটু হাসিলেন। কল্য নইনিতালে উভয়ে সাক্ষাৎ করিয়া যাহা করা প্রয়োজন স্থির করিবেন, এইরূপ বন্দোবস্ত করিয়া উভয়ে উভয় দিকে প্রস্থান করিলেন।
সপ্তম পরিচ্ছেদ – মনিয়া কি বলে?
ডিটেক্টিভ তথা হইতে বহির্গত হইয়া চিন্তিতমনে কিয়দ্দূর আসিয়া শিশ্ দিতে লাগিলেন। তাঁহার শিশ্ শুনিয়া জঙ্গলের ভিতর হইতে এক ব্যক্তি বাহির হইয়া আসিল।
ডিটেক্টিভ তাহাকে বলিলেন, “তুমি গুণারাজের বাড়ীর উপর নজর রাখ। দেখিয়ো, কেহ যেন তোমায় দেখিতে না পায়।”
সে উত্তর করিল, “যে রকম বলিতেছেন, ঠিক সেইরূপই করিব।”
“যদি সেই বালিকা বা বীরবিক্রম কোথাও যায়, তবে তুমি তোমার জুড়ীদারকে তাহাদের পিছনে লাগাইয়ো। দেখিয়ো, যেন কোন রকমে এই দুইজনের একজনও তোমার নজরের বাহিরে না যাইতে পারে; খুব সাবধান।”
“যে আজ্ঞা।”
“তুমি গুণারাজের বাড়ী, বাগান নজর রাখিবে। সে নিশ্চয়ই সেইখানে আসিয়াছে এবং কোথাও লুকাইয়া আছে। আর যদি না এসেও থাকে, তবে সে নিশ্চয়ই এখানে আসিবে।”
“আপনি যেরূপ হুকুম করিতেছেন, সেইরূপই করিব।”
“খুব সাবধান, এই তিনজনের একজনও যদি তোমার চোখ এড়াইয়া যায়, তবে রক্ষা থাকিবে না।”
এই সময়ে তথায় এক ব্যক্তি একটা ঘোড়া লইয়া আসিল। ডিটেকটিভ-ইনস্পেক্টর সেই ঘোড়া ছুটাইয়া নইনিতালের দিকে চলিলেন। পূর্ব্বোক্ত ব্যক্তি আবার জঙ্গলে লুকাইল।
ডিটেক্টিভ নইনিতালে আসিয়া প্রথমেই দয়ামলের বাড়ীতে উপস্থিত হইলেন। তিনি দয়ামলের স্ত্রীর সহিত সাক্ষাৎ করিলেন। বলিলেন, “কয়েকটা কথা জিজ্ঞাসা করিবার জন্য আপনার কাছে আবার আসিলাম।”
দয়ামলের স্ত্রী বস্ত্রাঞ্চলে চক্ষু মুছিতে মুছিতে বলিল, “বলুন।”
“দাদিয়া নামে কোন বুড়ী দয়ামলের কাছে কখন আসিত কি?”
“কই, কখন ত দেখি নাই।”
“কখন—অনেক রাত্রে লুকিয়ে দয়ামলের নিকট কেহ আসিত কি?”
“না, আমি কখনও কাহাকেও দেখি নাই।”
“চৌদ্দ-পনের বৎসরের একটা মেয়ে কখনও আসিয়াছিল? তার নাম মীনা।”
“না, আমি তাকে কখনও দেখি নাই।”
“পড়োবাড়ীতে কোন লোক আছে, আপনি কি তা কখনও জানিতেন?”
“না।”
“ঠিক মনে করে দেখুন দেখি, সেদিন দয়ামল কখন বাড়ীর বাহির হন?“
“ঠিক সন্ধ্যার সময়।”
ডিটেক্টিভ বিরক্তভাবে তথা হইতে নিষ্ক্রান্ত হইলেন। তিনি মনে মনে বলিলেন, “এ মাগীও সহজ নয়, ইচ্ছা করিয়াই কোন কথা বলিতেছে না। খুব সম্ভব, মাগী অনেক কথা জানে, তবে বলিতেছে না কেন? এর মিথ্যাকথা বলিবার স্বার্থ কি?”
এই সকল ভাবিতে ভাবিতে তিনি পড়োবাড়ীর দিকে চলিলেন। তথায় আসিয়া নিজের একজন অনুচরকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “তাহাকে পাওয়া গিয়াছে?”
সে উত্তর করিল, “হাঁ হুজুর।”
ডিটেকটিভ দেওপাট্টা ঘাটে আসিলেন। তথায় আর একজন অনুচর মনিয়ার নৌকা ধরিয়া বসিয়া আছে।
ডিটেক্টিভ নিকটে গিয়া মনিয়াকে ডাকিলেন। সে ভয়ে কাঁপিতে কাঁপিতে নিকটে আসিয়া দাঁড়াইল। ডিটেক্টিভ বলিলেন, “তোর কোন ভয় নাই। যা জিজ্ঞাসা করি, ঠিক ঠিক উত্তর দে।”
সে ভয় পাইয়া বলিল, “আচ্ছা, হুজুর।”
“তুই নটা-দশটার সময় সেদিন এই ঘাটে নৌকার উপর ছিলি?”
“হাঁ হুজুর।”
“এখানে তখন কেউ এসেছিল?”
“হাঁ হুজুর।”
“সে কি করছিল।”
‘সে এসে গা ধুচ্ছিল, কাপড় কাচ্ছিল।”
“তার মুখ দেখেছিলি—বীরবিক্রম সাহেবের মত একজন লোক?”
“হাঁ, হুজুর।”
“তুই বীরবিক্রমকে চিনিস?”
“হাঁ, হুজুর।”
“কেমন করে চিলি?”
“মীনা আমায় ভালবাসে, যত্ন করে। আমার মা বাপ কেউ নাই—আমি এইখানে নৌকায় নৌকায় থাকি। মীনা পড়োবাড়ীতে থাকে বলে আমি রাত্রে প্রায়ই এ ঘাটে নৌকায় থাকতেম।”
“বীরবিক্রমকে কেমন করে চিনলি তাই বল।”
“বীরবিক্রম সাহেব প্রায়ই এই বাড়ীতে আসতেন। তাই তাকে দেখে একদিন মীনাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, তিনি কে?”
“মীনা কি বলেছিল?”
“বলেছিল, তাঁর নাম বীরবিক্রম।”
“যে লোক রাত্রে গা ধুইতেছিল, তাহার চেহারা যে বীরবিক্রমের মত, তা কেমন করে জানলি?”
“আমি নৌকায় ছিলাম। হঠাৎ কার পায়ের শব্দ শুনেই সেই দিকে চেয়ে দেখি। মনে হল, হয়ত কোন দরকারে মীনা আমাকে খুঁজতেই আছে। সে এমন মাঝে মাঝে আসত—কিন্তু দেখি, সে নয়। রাস্তার আলোর পাশ দিয়ে সে লোকটা আছিল—তাকে বেশ ভাল করে দেখেছিলাম, তার সর্ব্বাঙ্গ রক্তমাখা—সব লালে লাল — “
সহসা মধ্যপথে থামিয়া গিয়া মনিয়া সশঙ্কভাবে চারিদিকে চাহিতে লাগিল।
অষ্টম পরিচ্ছেদ – কে এই ব্যক্তি?
ভয় পাইয়া মনিয়া অত্যন্ত কাঁপিতে লাগিল। সেই রক্তাক্ত মূর্ত্তি যেন তাহার সম্মুখীন। ভয়ে তাহার কণ্ঠরোধ হইয়া আসিল।
ডিটেক্টিভ তাহাকে আশ্বস্ত করিবার জন্য বলিলেন, “ভয় নাই, তারপর কি হল?”
মনিয়া ভয়ে ভয়ে বলিল, “তারপর সে ঘাটে এসে তার কাপড়ের রক্ত ধুতে লাগল।”
“তবে সে লোক বীরবিক্রম?”
“না, সে বীরবিক্রম সাহেব নয়।”
“কেমন করে জানলি।”
“আমি বীরবিক্রম সাহেবকে অনেক দিন দেখেছি—এ লোক সে নয়।”
“কিসে জানলি?”
“এই লোক বীরবিক্রম সাহেবের চেয়ে অনেক বড়। তবে মুখখানা এক—আরও-” মনিয়া মধ্যপথে থামিয়া গেল।
“আরও কি?”
“খানিক পরে বীরবিক্রম সাহেব এ পথ দিয়ে গিয়ে বাড়ীর ভিতরে ঢুকেছিলেন।”
“সে লোক কোথায় গেল?”
“সে গা ধুয়ে পড়োবাড়ীতে চলে গেল।”
“তার পর কি হল? “
“আধ ঘণ্টা পরে বীরবিক্রম তাড়াতাড়ি এই পথ দিয়া নইনিতালের দিকে চলে গেলেন।”
“সেদিন আর মীনাকে দেখতে পেয়েছিলি?”
“না।”
“তার পর দিন?”
“না, আমি একটা ভাড়া পেয়ে ওপারে চলে যাই। তিন দিন পরে ফিরে এসেছিলাম।”
“ফিরে এসে খুনের কথা শুনেছিলি?”
“হাঁ, তাই কনষ্টেবলকে এ কথা বলেছিলাম।”
বেশ, ভাল কাজ করেছিস। সরকার তোকে বক্সিস দিবেন।”
মনিয়া চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া রহিল। তখন ডিটেকটিভ গমনে’ উদ্যত হইয়া চিন্তিতভাবে বলিলেন, “তবে সে লোক বীরবিক্রম নয়?”
মনিয়া উত্তর করিল, “না, আমি বীরবিক্রম সাহেবকে অনেকবার দেখেছি।”
“দাদিয়া সেদিন কোথায় ছিল?”
“তা জানি না।”
“সে রাত্রে তাকে দেখিয়াছিলি?”
“না।”
“সে রাত্রে আর কাহাকেও দেখেছিলি?”
“না।”
“তুই কখন এই ঘাটে এসেছিলি?”
“ঠিক নটার সময়।”
“কেমন করে জানলি?”
“ঘড়ী বাজতে শুনেছিলাম।”
ডিটেক্টিভ চিন্তিতমনে গৃহাভিমুখে চলিলেন। তিনি ভাবিলেন, এ নিশ্চয় বীরবিক্রম দয়ামলকে খুন করে নাই। নয়টার সময় তাহাকে খুন করিতে মীনা দেখিয়াছে—নয়টার পরেই মনিয়া একজনকে কাপড়ের রক্ত ধুতে দেখেছে। এগারটার সময় বীরবিক্রম এখানে এসেছিল। নিশ্চয়ই দয়ামল খুন হয়েছে দেখে ভয়ে এখান থেকে তাড়াতাড়ি চলে গিয়েছিল। সে নয়টার আগে এখানে আসে নাই, তার যথেষ্ট প্রমাণ আছে। তবে তাহার বাড়ীতে ছোরা যায় কেন? সমস্যা বটে। তার পর মীনা—সে-ও খুন করিতে পারে, ভারি তেজিয়ান—ভারি রাগী—চালাক—কিন্তু প্রমাণ কই? যাহাই হউক, এই বীরবিক্রমের চেহারার আর একজন লোককে খুঁজিয়া বাহির করিতেই হইয়াছে। মনিয়া মিথ্যাকথা বলে নাই—সে যাহা বলিয়াছে, সত্যই বলিয়াছে; সে এখন মিথ্যাকথা বলিতে শিখে নাই। সে স্পষ্ট রাস্তার আলোকে সেই লোককে দেখিয়াছিল। আবার মনিয়া বলিতেছে, সে বীরবিক্রম নয়—তবে চেহারা অনেকটা বীরবিক্রমের মত। সে যে-ই হউক, সেই দয়ামলকে খুন করিয়াছে। মীনা আর বীরবিক্রম পালায় নাই, তাহাতেও বোঝা যায়, তাহারা খুন করে নাই। কিন্তু দাদিয়া আর এই লোকটা দুইজনেই ফেরার, সুতরাং স্পষ্টই বোঝা যাইতেছে যে, ইহাদের একজনে বা দুইজনে একত্রে দয়ামলকে খুন করিয়াছে। দেখা যাক, কতদূর কি হয়। এক দিন ধরা পড়িতেই হইবে–রক্ষা পাইবার উপায় নাই। দাদিয়া যে গুণারাজের বাড়ী গিয়াছিল, তাহার প্রমাণ পাওয়া গিয়াছে। সে সেইখানেই কোনখানে লুকাইয়া আছে; তাহাকে ধরা শক্ত হইবে না। তবে এই লোকটা সম্বন্ধেই গোল। ইহাকে কেবল দুইজন দেখিয়াছে—মীনা আর মনিয়া। অনেক রাত্রে মীনা অন্তরাল হইতে ইহাকে লুকাইয়া দেখিয়াছে, মীনা ইহাকে স্বচক্ষে দয়ামলকে খুন করিতে দেখিয়াছে—মনিয়া ইহাকে স্পষ্ট রক্ত ধুতে দেখিয়াছে; কেবল এই দুইজনেই দেখিয়াছে আশ্চর্য্যের বিষয়, আর কেহ কখনও ইহাকে দেখে নাই। সুতরাং ইহাকে ধরা একটু শক্ত দেখিতেছি। স্পষ্টতঃই লোকটা ভারি চালাক, খুব সাবধান; এ কখনও কাহারও সম্মুখে বাহির হয় নাই, কখনও এই পড়োবাড়ীতে কাহারও সম্মুখ দিয়া আসে নাই এবং এত সাবধানে এসেছে এত সাবধানে এখান থেকে চলে গেছে যে, কেহ কখনও ইহাকে দেখে নাই—দেখিতে পায় নাই। খুব আশ্চৰ্য্য সন্দেহ নাই। কেবল দেখিয়াছে, মীনা আর মনিয়া; কিন্তু তাহারা ইহার কোন সংবাদই দিতে পারে না। এত বড় বড় কেস কিনারা করিয়া ফেলিলাম—কত রহস্য ভেদ করিলাম। শেষে কি এই ব্যাপারে হার মানিতে হইল।”
ডিটেক্টিভ মহা চিন্তিতমনে গৃহে ফিরিলেন, তাঁহার এই ব্যাপারে প্রায় আহার নিদ্রা বন্ধ হইয়াছে।
নবম পরিচ্ছেদ – সন্দেহ-বৈষম্য
যেরূপ স্থির ছিল, পরদিন ইন্দ্রানন্দ ডিটেক্টিভের সহিত সাক্ষাৎ করিলেন। ডিটেকটিভ ইন্দ্রানন্দকে দেখিয়া বলিলেন, “আসুন, আমি আপনার প্রতীক্ষায় বসিয়া আছি।”
ইন্দ্রানন্দ বলিলেন, “আর কোন সন্ধান পাইলেন?”
“একটু পাইয়াছি। এখন আমার বিশ্বাস হইয়াছে যে, এই ব্যাপারে আর এক ব্যক্তি আছে, সে-ই এ খুন করিয়াছে।”
“সে কে?”
“সেইটাই সমস্যা—তাহাকে মীনা ও মনিয়া ভিন্ন আর কেহ কখনও দেখে নাই; কেবল তাহার চেহারা কতকটা বীরবিক্রমের মত, এ ছাড়া আর কিছুই জানা যাইতেছে না।”
“তাহা হইলে এখন কি করিবেন?”
“এখন আমরা দুইজনে একবার পড়োবাড়ীটা দেখিব।”
তখন উভয়ে পড়োবাড়ীর দিকে চলিলেন। পথে ডিটেকটিভ কোন কথা কহিলেন না; চিন্তিতমনে চলিলেন। ইন্দ্রানন্দও কোন কথা কহিতে সাহস করিলেন না।
অনেকদূর গিয়া সহসা ডিটেক্টিভ জিজ্ঞাসা করিলেন, “ইন্দ্রানন্দ সাহেব, একটা কথা সত্য ৱলিবেন কি?”
ইন্দ্রানন্দ বিস্মিত ও ক্রুদ্ধ হইয়া তাঁহার দিকে চাহিলেন। বলিলেন, “মিথ্যাকথা বলা আমার অভ্যাস নাই।”
“না, সে কথা বলিতেছি না, তবে আমি জানিতে চাহি, আপনার সঙ্গে মীনার আলাপ কত দিনের?”
“মহাশয়, আপনি মনে করিবেন না যে, আমি আপনাকে মিথ্যাকথা বলিয়াছি। যথার্থই খুনের দুইদিন পরে অন্ধকারে আমি পড়োবাড়ীর বাহিরে তাহাকে প্রথমে দেখিতে পাই।”
“আপনি রাত্রে এ রকম স্থানে কিজন্য আসিয়াছিলেন?”
“আপনাকে সত্য কথা বলিতে কি, বীরবিক্রমের ভাবের পরিবর্তন হওয়ায় আমার ভগিনী তাঁহার সন্ধানে আমাকে পাঠায়। আমি তাঁহার বিছানায় একখানা পত্র দেখিতে পাই।”
“তাহাতে কি লেখা ছিল?”
“বীরবিক্রমকে পড়োবাড়ীতে আসিবার জন্য কে অনুরোধ করিয়াছিল
“স্ত্রীলোকের হাতে লেখা, কি পুরুষের হাতের লেখা?”
“পুরুষের।”
“আপনি সেইজন্য বীরবিক্রমের সন্ধানে এখানে আসিয়াছিলেন?”
“হাঁ।”
ডিটেক্টিভ ইন্দ্রানন্দের মুখের দিকে স্থিরদৃষ্টিতে চাহিয়া বলিলেন, “তাহার পূর্ব্বে আপনার সঙ্গে মীনার পরিচয় ছিল না?”
ইন্দ্রানন্দ ক্রুদ্ধ হইলেন। বলিলেন, “মহাশয় আপনি কি তবে মনে করেন যে, আমিই দয়ামলকে খুন করিয়াছি?”
ডিটেক্টিভ মৃদু হাসিয়া বলিলেন, “ইন্দ্রানন্দ সাহেব, হঠাৎ রাগ করিবেন না। সংসারে এমন অনেক জিনিষ হয়, যাহা কেহই সন্দেহ করে না। আমি মনে করি না, আপনি দয়ামলকে খুন করিয়াছেন, তবে লোকে আপনাকেও সন্দেহ করিলে করিতে পারে।”
ইন্দ্রানন্দ যুগপৎ বিস্মিত ও ক্রুদ্ধ হইয়া বলিলেন, “আমাকে!” ডিটেকটিভ স্থিরভাবে বলিলেন, “হাঁ, আপনাকে।”
“আমাকে সন্দেহ করে কে?”
“ইচ্ছা করিলে করা যায়।”
“কেন?”
“তবে স্থির হয়ে শুনুন—প্রথমতঃ আপনি মীনাকে যে রকম ভালবাসেন–“
ইন্দ্ৰানন্দ বিস্মিত হইয়া মুখ তুলিলেন। কি বলিতে যাইতেছিলেন, ডিটেকটিভ তাহাতে বাধা দিয়া বলিলেন, “একটু স্থির হয়ে শুনুন।”
অগত্যা ইন্দ্রানন্দ নীরবে রহিলেন।
ডিটেক্টিভ বলিতে লাগিলেন, “আপনি মীনাকে যেরূপ ভালবাসেন, তাহাতে আপনি যে কেবল তাহাকে খুনের দুইদিন পরে প্রথম দেখিয়াছিলেন, তাহা কেহ সহজে বিশ্বাস করিবে না। স্থির হউন, আমি যাহা বলি প্রথমে ‘ শুনুন, পরে আপনার কথা শুনিব। হাঁ, তাহার পর ইহাতে সহজেই মনে হয়, আপনার সঙ্গে মীনার অনেকদিনকার আলাপ। আপনি যে বীরবিক্রমের সন্ধানে এই পড়োবাড়ীতে আসেন, এ কথা সহজে কেহ বিশ্বাস করিবে না। আপনি মীনার জন্যই গোপনে এখানে আসিয়াছিলেন। দয়ামলের দৃষ্টিও মীনার উপর ছিল, তাহাতে এখন এই দাঁড়াইতেছে যে, আপনি ঈর্ষা ও রাগে একদিন রাত্রে দয়ামলের সঙ্গে মীনাকে দেখিয়া তাহার ছোরা কাড়িয়া লইয়া দয়ামলকে খুন করিয়াছিলেন। আপনাকে রক্ষা করিবার জন্য মীনা ও মনিয়া এই নূতন লোকের নাম সৃষ্টি করিয়াছে। বীরবিক্রমের চেহারায় আর অপর কোন লোকের অস্তিত্ব নাই।”
এই ভয়াবহ কথা শুনিয়া ইন্দ্রানন্দের মুখ শুকাইয়া গেল।
দশম পরিচ্ছেদ – দগ্ধ পত্রাংশ
ইন্দ্রানন্দ ভাবিলেন, নিশ্চয়ই ত তাহার উপর সন্দেহ হইতে পারে। তবে কি তাঁহাকে খুনের মোকদ্দমায় পড়িতে হইবে? তিনি কম্পিতস্বরে বলিলেন, “তবে কি আপনারা আমাকে সন্দেহ করেন?”
ডিটেকটিভ মৃদুহাস্য করিলেন। হাসিতে হাসিতে বলিলেন, “আমরা কেহই আপনাকে সন্দেহ করি নাই; তবে আপনাকে যে সন্দেহ করা যায় না, এমন ভাবিবেন না। তাহাই আপনাকে বুঝাইতেছিলাম। এখন আসুন, এই ত সেই বাড়ী—বাড়ীটা ভাল করিয়া দেখা যাক। আপনাকে সঙ্গে আনিবার উদ্দেশ্য আছে, আপনি এই বাড়ীর সম্বন্ধে অনেক বিষয় আমাকে বুঝাইতে পারিবেন।”
ইন্দ্রানন্দ নীরবে ডিটেক্টিভের সহিত পড়োবাড়ীতে প্রবেশ করিলেন। তিনি প্রথম দিন মীনার সহিত আসিয়া যাহা যাহা দেখিয়াছিলেন, আজও তাহাই দেখিলেন। দাদিয়া এখান হইতে চলিয়া গিয়াছে বটে, কিন্তু তাহার কোন দ্রব্যাদিই লইয়া যায় নাই। যেখানকার যাহা সেইরূপই আছে।
ডিটেক্টিভ পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে প্রত্যেক ঘর দেখিতে লাগিলেন। নীচের সমস্ত ঘর দেখিয়া পরে উপরে আসিলেন। তথায়ও সমস্ত ঘরগুলি ভাল করিয়া দেখিলেন। ইন্দ্রানন্দ দরিয়ার সহিত আসিয়া রাত্রে যাহা দেখিয়াছিলেন, এখনও তাহাই দেখিলেন।
সমস্ত ঘর দেখিয়া ডিটেকটিভ নীচে নামিয়া আসিলেন। দেখিলেন, এক স্থানে কতকগুলি কাগজ কে আগুন দিয়া পুড়াইয়াছে, তবে কতকগুলি কাগজের কতকাংশ পুড়ে নাই। ডিটেকটিভ সেইগুলি কুড়াইয়া লইয়া ভাল করিয়া দেখিতে লাগিলেন। বহুক্ষণ পরে ইন্দ্রানন্দের দিকে ফিরিয়া বলিলেন, “মীনা বা মনিয়া দুজনের কেহই মিথ্যাকথা বলে নাই।”
ইন্দ্ৰানন্দ ব্যগ্র হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “কিসে জানিলেন?”
ডিটেক্টিভ চিন্তিতভাবে ধীরে ধীরে বলিলেন, “এই কাগজের টুকরাগুলি দেখিয়া।” ইন্দ্ৰানন্দ ব্যগ্র হইয়া কাগজগুলি দেখিতে অগ্রসর হইলেন। ডিটেকটিভ কতকগুলি তাঁহার হাতে দিলেন। ইন্দ্রানন্দ সেগুলি দেখিয়া কিছুই বুঝিতে পারিলেন না; ডিটেক্টিভের দিকে চাহিলেন।
ডিটেক্টিভ হাসিয়া বলিলেন, “কিছু বুঝিতে পারিলেন?”
ইন্দ্রানন্দ বলিলেন, “না, আমি ত কিছুই বুঝিতে পারিতেছি না।”
“কেন, এই হাতের লেখা ভাল করিয়া দেখুন। কাহার হাতের লেখা বলিয়া বোধ হয়?”
“কাহার হাতের লেখা কেমন করিয়া বলিব? এ হাতের লেখা আমি আর কখনও দেখি নাই, তবে—”
“তবে কি?”
“তবে এ পুরুষের হাতের লেখা–স্ত্রীলোকের নয়।”
“তা হলে দাদিয়া বা মীনার নয়?”
“না, মীনার হাতের লেখা আমি দেখিয়াছি।”
“তা হলে নিশ্চয়ই একজন পুরুষ এখানে আসিত।”
“তা না হইতেও পারে।”
“কেন?”
“কেহ দাদিয়াকে এই সকল চিঠি লিখিতেও ত পারে, সে যে এখানে এসেছিল তার প্রমাণ কি? এ সকল চিঠি দয়ামলেরও হইতে পারে।”
“না, দয়ামলের হাতের লেখা নয়—তাহার হাতের লেখা আমরা দেখিয়াছি। যে এই সকল লিখিয়াছিল, সে এইখানে আসিত—দেখুন।
ডিটেকটিভ ইন্দ্রানন্দের হাতে এক টুকরা কাগজ দিলেন, তাহাতে লেখা আছে,
“আজ তোমাকে আসিতে
এস নাই—পড়োবাড়ী কি তোমার”
ডিটেক্টিভ বলিলেন, “কি বুঝিলেন?”
“কিছুই ভাল বুঝিতে পারিতেছি না।”
‘কেন? এই ব্যক্তি লিখিয়াছিল, আজ তোমাকে আসিতে লিখিয়াছিলাম, কিন্তু যে কারণে হউক, এস নাই—পড়োবাড়ী কি তোমার পছন্দ হয় না।”
ইন্দ্রানন্দ ডিটেকটিভের বুদ্ধি দেখিয়া যথার্থই বিস্মিত হইলেন। কোন কথা কহিলেন না। ডিটেকটিভ তখন তাঁহার হাতে আর এক টুকরা কাগজ দিলেন। তাহাতে লেখা আছে,—
“আজ এতদিনের সাধ
তার বুকের রক্ত দেখে
মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হয়েছে—”
ডিটেক্টিভ বলিলেন, “এখন স্পষ্টই বুঝিলেন যে, এই লোক দয়ামলকে খুন করিয়াছে; যে কোন কারণে হউক, দয়ামলের উপর ইহার বিশেষ রাগ ছিল। হঠাৎ রাগে তাহাকে খুন করে নাই— সে অনেক দিন থেকে এই চেষ্টায় ছিল।”
ইন্দ্রানন্দ বলিলেন, “এখন তাহাই বোধ হইতেছে।”
ডিটেক্টিভ কিয়ৎক্ষণ নীরবে দাঁড়াইয়া কি চিন্তা করিতে লাগিলেন। সহসা ইন্দ্রনাথকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “আপনি যে পত্র বীরবিক্রমের বিছানায় দেখিয়াছিলেন, তাহা আপনার কাছে আছে?”
“আছে।”
“দেখুন দেখি ভাল করে, সে হাতের লেখা এ হাতের লেখা এক কি না?”
ইন্দ্রানন্দ ভাল করিয়া দেখিয়া বলিলেন, “বোধ হয়, যেন এক।”
ডিটেক্টিভ বলিলেন, “ঠিক এই হাতের লেখায় একখানা চিঠি আমরা বীরবিক্রমের বাড়ীতে পাইয়াছি।”
“তাহাতে কি লেখা আছে?”
“তাহাতে যাহা লেখা আছে, তাহা কিছুই বোঝা যায় না। দেখিলেই স্পষ্ট বোধ হয় যে, সেই পত্র যে লিখিয়াছে, সে ঘোর উন্মাদ।”
“এ লোক কে মনে করেন?”
“এ লোক যে-ই হউক, ইহাকে মীনা ও মনিয়াই কেবল দেখে নাই, বীরবিক্রমের সহিতও ইহার বিশেষ পরিচয় আছে। আপনি এখন যান, আমি আজ বৈকালেই বীরবিক্রম সাহেবের সহিত একবার দেখা করিব। অবশ্য তিনি এখন কিছু সুস্থ হইয়াছেন।”
একাদশ পরিচ্ছেদ – বীরবিক্রমের উদ্বেগ
অগত্যা ইন্দ্ৰানন্দ গৃহাভিমুখে চলিলেন। তিনি বাড়ীতে প্রবেশ করিতে-না-করিতে মীনা তাঁহার নিকট আসিল। ইন্দ্রানন্দ তাহার বিষণ্ণ বিশুষ্ক মুখ দেখিয়া ব্যস্ত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “ কি হয়েছে, মীনা?”
মীনা বলিল, “না, এমন কিছু নয়। বীরবিক্রম আপনার সঙ্গে গোপনে দেখা করিবার জন্য বড় ব্যস্ত হয়েছেন; আপনাকে গোপনে এ কথা বলবার জন্য আমাকে বিশেষ করে বলেছেন।”
“তাতে তুমি এত অধীর হয়েছ কেন?”
“বোধ হয়, তিনি আপনাকে সব কথা বলিবেন।”
“ভালই ত—সব জানিতে পারিলে আমরা সকলেই নিশ্চিন্ত হইতে পারি। বিশেষত আজ পুলিসের লোক বৈকালে তাঁহার সঙ্গে দেখা করিতে আসিবেন।”
মীনা ব্যগ্র হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, “কেন? “
“তাঁহার কিছু জিজ্ঞাস্য আছে। মীনা, বোধ হয়, তোমার কথাই ঠিক হয়েছে।”
“কি কথা?”
“একজন বীরবিক্রমের মত চেহারার লোক পড়োবাড়ীতে লুকিয়ে আসিত; সেই দয়ামলকে খুন করিয়াছে।”
“কিসে জান্লেন?”
“পড়োবাড়ীতে তাহার হাতের লেখা চিঠি পাওয়া গিয়াছে।”
“কই, আমি ত এমন কোন চিঠি কখনও দেখি নাই।”
“তুমি দেখিবে কিরূপে। সে সব চিঠি তোমার দাদিয়া নিশ্চয়ই খুব গোপনে রাখিত। বাড়ী ছাড়িয়া পলাইবার সময় সেগুলি পোড়াইয়াছিল।”
“তবে আপনারা কেমন করিয়া পাইলেন?”
“বোধ হয়, তাড়াতাড়ি দাদিয়া চলিয়া গিয়াছিল। কাগজগুলা সব পুড়ে নাই, তাহাতেই দেখিলাম। একখানায় সে যে খুন করিয়াছে, স্পষ্ট লিখেছে।”
“আমি তাকে দেখিয়াছিলাম।”
“হাঁ, কিন্তু আশ্চার্য্যের বিষয়, এই লোকটার সঙ্গে বীরবিক্রমেরও আলাপ ছিল।”
“কেমন করিয়া জানিলেন?”
“আমি তাঁহার বিছানায় যে পত্র পাইয়াছিলাম, সেই পত্র যে লিখিয়াছিল, এই সকল চিঠিও তাহার হাতের লেখা। পুলিসও তাহারই হাতের লেখা একখানা চিঠি বীরবিক্রমের বাড়ীতে পেয়েছে।”
এই সময়ে তথায় দরিয়া আসিয়া বলিল, “দাদা, বীরবিক্রম তোমার জন্যে বড় ব্যস্ত হয়েছেন; সকাল থেকে কেবল তোমার কথাই জিজ্ঞাসা করিতেছেন। একবার যাও।”
ইন্দ্রানন্দ সত্বর যে গৃহে বীরবিক্রম শায়িত ছিলেন, সেই গৃহের দিকে চলিলেন।
বীরবিক্রমের জ্বর গিয়াছে বটে, কিন্তু তিনি এখনও নিতান্তই দুৰ্ব্বল,—কষ্টে উঠিয়া বসিতে পারেন। এখনও তাঁহার চলিবার ক্ষমতা হয় নাই। ইন্দ্রানন্দ নিকটে গিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “এখন কেমন আছ?”
বীরবিক্রম মৃদুস্বরে বলিলেন, “ভাল আছি, তুমিই আমার প্রাণ রক্ষা করিয়াছ—”
ইন্দ্ৰানন্দ মধ্যপথে বাধা দিয়া বলিয়া উঠিলেন, “আমি কিছুই করি নাই—মীনাই সব করিয়াছে।”
“তাহার ঋণ কখন পরিশোধ করিতে পারিব না—তোমাদের যত্নও কখন ভুলিব না। যতদিন না আমি ভাল হই, ততদিন তাহাকে যাইতে দিয়ো না। সে আমার সহোদরা ভগিনীর চেয়ে অধিক।”
“কিছুতেই তাহাকে যাইতে দিব না।”
“বস, একটা কথা আছে।”
ইন্দ্রানন্দ বসিতে যাইতেছিলেন। বীরবিক্রম বলিলেন, “দরজাটা বন্ধ করিয়া দাও——দুই একটা গোপনীয় কথা আছে।”
ইন্দ্রানন্দ দ্বার বন্ধ করিয়া আসিয়া বীরবিক্রমের নিকটে বসিলেন। তিনি বুঝিলেন, বীরবিক্রম নিতান্ত বিচলিত হইয়াছেন। বীরবিক্রম কিয়ৎক্ষণ নীরবে বসিয়া রহিলেন। অবশেষে ধীরে ধীরে বলিলেন, “ইন্দ্রানন্দ, আমাকে কোন কথা লুকাইয়ো না, তা হইলে আমার পীড়া বাড়িবে।”
“কি জিজ্ঞাসা করিবে, কর।”
“পুলিস এ বিষয়ে কতদূর কি করিয়াছে?”
ইন্দ্রানন্দ ইতস্ততঃ করিতেছেন দেখিয়া বীরবিক্রম আবার বলিলেন, “দেখ তুমি আমার বিশেষ বন্ধু—বুঝিতেই পারিতেছ যে, আমি যতক্ষণ সব শুনিতে না পাইব, ততক্ষণ স্থির হইতে পারিব না— আমার পীড়া বাড়িবে।”
ইন্দ্রানন্দ অগত্যা বলিলেন, “তুমি দয়ামলের স্ত্রীকে টাকা পাঠাইতে জানিতে পারিয়া পুলিস তোমার নামে ওয়ারেন্ট বাহির করিয়াছে?”
“আমি কতকটা তাহা বুঝিয়াছিলাম।”
“কিন্তু তাহারা তোমাকে দোষী মনে করে না।”
বীরবিক্রম ক্ষিপ্রবেগে উঠিয়া বসিয়া বলিলেন, “কেন?”
ইন্দ্রানন্দ একে একে সকল কথা বলিলেন। শুনিয়া বীরবিক্রম বলিলেন, “তবে তাহারা আমার চেহারার মত আর একজন লোক খুন করেছে, তাই মনে করে তাহাকে খুঁজিতেছে।”
“হাঁ, তবে তাহারা দাদিয়াকেও খুঁজিতেছে?”
“কেন?”
“তাহারা বলে যে, সেই বুড়ীমাগী সব জানে। বোধ হয়, তাহারা দুজনে মিলিয়া দয়ামলকে খুন করিয়াছে; তা না হইলে সে-ও ফেরার হইবে কেন।”
বীরবিক্রম অতিশয় ব্যগ্রভাবে জিজ্ঞাসা করিলেন, “পুলিস কি দাদিয়ার কোন সন্ধান পাইয়াছে?” ইন্দ্রানন্দ বলিলেন, “না, তবে তাহারা সন্ধান করিয়া আমাদের বাগান পর্য্যন্ত এসেছিল। তাহারা বলে, সে এইখানেই কোথায় লুকাইয়া আছে।”
বীরবিক্রম বহুক্ষণ নীরবে রহিলেন। তৎপরে সহসা ইন্দ্রানন্দের হাত ধরিয়া ব্যাকুলভাবে বলিলেন, “ভাই, আমার নিকট অঙ্গীকার কর, এই দাদিয়াকে বাঁচাইবার জন্য তুমি প্রাণপণ চেষ্টা করিবে।”
ইন্দ্রানন্দ নিতান্ত বিস্মিত হইয়া তাঁহার মুখের দিকে চাহিয়া রহিলেন। বীরবিক্রম বলে কি!
দ্বাদশ পরিচ্ছেদ – উদ্বেগের কারণ কি?
ইন্দ্রানন্দ কোন কথা কহিলেন না দেখিয়া, বীরবিক্রম আবার ব্যগ্রভাবে বলিলেন, “ভাই, তোমাকে এ কাজ করিতেই হইবে।”
ইন্দ্রানন্দ বলিলেন, “বীরবিক্রম তোমাকে বলিতে কি, আমার বিশ্বাস, এই বুড়ীই দয়ামলকে খুন করিয়াছে—এই বুড়ীই আমাকে খুন করিবার চেষ্টা করিয়াছিল—তোমাকেও আর একটু হইলে খুন করিয়াছিল।”
বীরবিক্রম অবসন্নভাবে বলিলেন, “যাই হক, তুমি অঙ্গীকার কর, তুমি ইহাকে রক্ষা করিতে প্রাণপণ চেষ্টা করিবে।”
ইন্দ্রানন্দ বলিলেন, “তোমার কথা শুনিতে আমি বাধ্য; কিন্তু–“
“কিন্তু নয়, আমি পীড়িত হইয়া পড়িয়া আছি—আমার আর কেহ নাই যে, তাহাকে অনুরোধ করি, তুমি আমার এই একটি কথা রাখিবে না?
“আমাকে সব খুলিয়া বল, কেন তুমি—”
“আমাকে ক্ষমা কর। যদি সময় হয় ত সব পরে জানিতে পারিবে, কিন্তু এখন আমাকে কিছু জিজ্ঞাসা করিয়ো না।”
“আমি না হয়, জিজ্ঞাসা না-ই করিলাম, কিন্তু পুলিস কি নিরস্ত থাকিবে? তাদের একজন লোক এখনই তোমার সঙ্গে দেখা করিতে আসিবে।”
“কেন,” বলিয়া বীরবিক্রম ব্যগ্র ও ব্যাকুলভাবে উঠিবার চেষ্টা পাইলেন, কিন্তু পারিলেন না। তাঁহার মুখ পাংশুবর্ণ হইয়া গেল। তাঁহার চেহারা দেখিয়া ইন্দ্রানন্দ ভীত হইলেন। সত্বর লোক ডাকিতে ছুটিতেছিলেন, কিন্তু বীরবিক্রম সবলে তাঁহার হাত ধরিলেন।
তিনি কিয়ৎক্ষণ পরে কতকটা প্রকৃতিস্থ হইয়া বলিলেন, “যেয়ো না, ভয় নাই—আমি ভাল হইয়াছি। ভাই, তুমি আমার একমাত্র বন্ধু—কোন রকমে পুলিসকে আমার কাছে আসিতে দিয়ো না, অন্ততঃ এখন নয়—আমি একটু ভাল হই।”
ইন্দ্রানন্দ বলিলেন, “তিনি আসিলে কি বলিব? তিনি তোমার সঙ্গে দেখা করিবার জন্য বড় ব্যস্ত হইয়াছেন।”
বীরবিক্রম কিয়ৎক্ষণ নীরবে থাকিয়া ধীরে ধীরে বলিলেন, “দেখিতেছ, আমার শরীর ভাল নয়—বেশী কথা কহিলে আমার পীড়া বাড়িবে। কোন রকমেই যেন না আসিতে পায়—আমার কথা কহিবার ক্ষমতা নাই।”
ইন্দ্রানন্দ বলিলেন, “তাহাই করিব।”
বীরবিক্রম বহুক্ষণ কথা কহিলেন না, চক্ষু মুদিত করিয়া রহিলেন; ক্ষণপরে মৃদুস্বরে বলিলেন, “অঙ্গীকার করিলে?”
ইন্দ্রানন্দ বলিলেন, “হাঁ, করিলাম।”
বীরবিক্রম বলিলেন, “আমি একটু বিশ্রাম করি।” তৎপরে তিনি আবার চক্ষু মুদিত করিলেন। তখন ইন্দ্রানন্দ ধীরে ধীরে সে গৃহ হইতে বহির্গত হইয়া গেলেন।
তিনি বাহিরে যাইতেছিলেন। দরিয়া সত্বরপদে তাঁহার নিকট আসিয়া বলিল, “দাদা, সে-ই আবার এসেছে।”
ইন্দ্ৰানন্দ বিস্মিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “কে এসেছে?”
দরিয়া ভীতভাবে বলিল, “সেই বুড়ীমাগীটা।”
শুনিয়া ইন্দ্রানন্দের হৃদয় সবলে স্পন্দিত হইতে লাগিল। তিনি নিশ্চয় জানিতেন, দাদিয়া বুড়ীই
দরিয়াকে গুলি করিয়াছিল; তিনি ভগিনী ও বীরবিক্রম উভয়ের জন্যই ভীত হইলেন। বলিলেন, “কোথায়?”
দরিয়া বলিল, “দাসী তাহাকে দেখে ভয়ে চীৎকার করিতে করিতে ছুটে বাড়ীর ভিতরে এসেছে। সে বুড়ীটা এইখানেই কোথায় লুকাইয়া আছে।”
ইন্দ্রানন্দ বলিলেন, “আমি তাহাকে এখনই এখান থেকে লোক দিয়া বাহির করিয়া দিতেছি। তুমি বাহিরে যাইয়ো না।”
ইন্দ্রানন্দ বাহিরের দিকে ছুটিলেন। কিন্তু পার্শ্ববর্ত্তী গৃহ হইতে মীনা আসিয়া তাঁহার সম্মুখে দাঁড়াইল। বলিল, “কি হয়েছে?”
ইন্দ্রানন্দ বলিলেন, “দাদিয়া আবার এখানে এসেছে।”
“এখন কি করিবেন?“
“তাহাকে বাড়ীর বাহির করিয়া দিয়া আসি; সে একবার দরিয়াকে গুলি করিয়াছে—আর একবারও করিতে পারে।”
“তাকে কি পুলিসের হাতে দিবেন?”
“না।”
“কেন?”
“বীরবিক্রমের কাছে অঙ্গীকার করিয়াছি।”
“এই কথার জন্যই কি আপনাকে তিনি ডাকিয়াছিলেন?”
“হ্যাঁ।”
“কেন?”
“তা কিছুতেই বলিল না। এখন আমি দেখি, সে কোথায়।”
ইন্দ্ৰানন্দ দ্রুতপদে বাগানের দিকে আসিলেন! দেখিলেন, একটি লোক অতি সন্তর্পণে সেইদিকে আসিতেছে। তিনি তাহার নিকটস্থ হইয়া, ভাব দেখিয়া বুঝিলেন, সে পুলিসের লোক।
ইন্দ্রানন্দ জিজ্ঞাসা করিলেন, “আপনি কি পুলিসের লোক?”
লোকটি বলিলেন, “হাঁ।”
ইন্দ্রানন্দ জিজ্ঞাসা করিলেন, “আপনি কি বীরবিক্রমকে গ্রেপ্তার করিতে আসিয়াছেন?”
“আজ্ঞে না।”
“তবে এখানে কিজন্য আসিয়াছেন?”
“আর একজনকে গ্রেপ্তার করিতে।”
ইন্দ্রানন্দের হৃদয় কাঁপিয়া উঠিল। তবে কি মীনাকে ধৃত করিতে আসিয়াছে। তিনি জড়িতস্বরে বলিলেন, “তবে কাহাকে গ্রেপ্তার করিতে আসিয়াছেন?”
পুলিস-কৰ্ম্মচারী বলিলেন, “বীরবিক্রমের বাবাকে।”
ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ – এ আবার কি কাণ্ড?
এই লোকটা পাগল না বদমাইস? তাঁহাকে নিশ্চয়ই উপহাস করিতেছে—অতিশয় অসভ্য লোক। ইন্দ্রানন্দ তাহার উপর রুষ্ট হইয়া উঠিলেন। তিনি তাহাকে ক্রুদ্ধভাবে ভর্ৎসনা করিতে যাইতেছিলেন, এই সময়ে সহসা বাগানের একদিকে বহুলোক কোলাহল করিয়া উঠিল। এই গোল শুনিয়া সেই ব্যক্তি উর্দ্ধশ্বাসে সেইদিকে ছুটিল। ইন্দ্রানন্দও তাহার পশ্চাতে ছুটিলেন।
একস্থানে একটা বড় গাছের নীচে অনেক লোক জমিয়াছে; বাগানের অনেক মালী সমবেত হইয়াছে। চারিদিক হইতে লোক সেইদিকে ছুটিয়া আসিতেছে।
ইন্দ্রানন্দ ছুটিতে ছুটিতে তথায় আসিয়া উপস্থিত হইলেন। দুই হাতে লোক সরাইয়া কি হইয়াছে, দেখিবার জন্য অগ্রসর হইলেন। তাঁহাকে দেখিয়া সকলে পথ ছাড়িয়া দিতে লাগিল।
ইন্দ্রানন্দ দেখিলেন, একটা লোক গাছতলায় মরিয়া পড়িয়া আছে, সকলে বলিতেছে, “মালীরা ইহাকে তাড়া করিয়াছিল, লোকটা ছুটিয়া গাছে উঠিতে গিয়া পড়িয়া গিয়াছে।”
সকলেই দেখিল, একটা মুখস এই লোকটার মৃতদেহের নিকটে উল্টাইয়া পড়িয়া আছে; আর তাহার মুখ দেখিলেই স্পষ্ট বুঝা যায় যে, এ পুরুষ, কিন্তু পরিধানে স্ত্রীলোকের বেশ।
ইন্দ্রানন্দ মৃতব্যক্তির নিকটস্থ হইয়া, তাহার মুখ ভাল করিয়া দেখিয়া চমকিয়া উঠিলেন—ইহার মুখ অনেকটা বীরবিক্রমের মত; তবে ইহার বয়স অনেক বেশী।
ইন্দ্রানন্দ স্পন্দিতহৃদয়ে এই মুখের দিকে চাহিয়াছিলেন, এই সময় কে তাঁহার বস্ত্র ধরিয়া টানিল। তিনি চমকিত হইয়া ফিরিয়া দেখিলেন, মীনা
ইন্দ্রানন্দ মৃদুস্বরে মীনাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “এ কে বল দেখি।”
মীনা কম্পিতস্বরে বলিল, “হাঁ, এই সেই যে—“
মীনার কণ্ঠ হইতে বাক্য নিঃসরণ হইল না। এমন সময়ে পুলিস-কৰ্ম্মচারি লাসের নিকট আসিয়া তাহাকে উল্টাইয়া ফেলিল; গম্ভীরভাবে বলিল, “গাছ থেকে পড়ে এর ঘাড়টা ভেঙ্গে গেছে। তাই পড়িবামাত্রই মরেছে।”
এই বলিয়া সে মৃতব্যক্তির কাপড়খানি টানিয়া একাংশ খুলিয়া ফেলিল। বলিল, “পুরুষ, তার সন্দেহ নাই।” বলিয়া মুখসখানা হাতে তুলিয়া লইয়া বিশেষরূপে লক্ষ্য করিতে লাগিল, পরে সেইটা হাতে করিয়া ইন্দ্রানন্দের নিকটস্থ হইল; এবং মৃদু হাসিয়া মুখস তাঁহার সম্মুখে ধরিয়া বলিল, “এ মুখ চিনতে পারেন?”
স্পন্দিতহৃদয়ে বিস্ফারিতনয়নে ইন্দ্রানন্দ দেখিলেন, সেটা দাদিয়ার মুখ। তবে দাদিয়া স্ত্রীলোক নহে—পুরুষ।
পার্শ্বে মীনা চীৎকার করায় ইন্দ্রানন্দ তাহার দিকে ফিরিলেন। মীনার সর্ব্বাঙ্গ থর থর করিয়া কাঁপিতেছে; তাহার সংজ্ঞা বিলুপ্তপ্রায় হইয়াছে। ইন্দ্ৰানন্দ মুহূৰ্ত্তমধ্যে সকল বিস্মৃত হইলেন। মীনাকে বুকে তুলিয়া লইয়া তিনি গৃহাভিমুখে ছুটিলেন।
এই সকল গোলযোগ শুনিয়া গুণারাজ সত্বরপদে সেইদিকে আসিতেছিলেন; মীনাকে ক্রোড়ে লইয়া ইন্দ্ৰানন্দকে ছুটিতে দেখিয়া তিনি ভ্রুকুটি করিলেন। জিজ্ঞাসা করিলেন, “কি হয়েছে?”
ইন্দ্রানন্দের কথা কহিবার সময় ছিল না। মীনা তাঁহার ক্রোড়ে অজ্ঞান হইয়াছে; তিনি ছুটিতে ছুটিতে বলিলেন, “একজন লোক গাছ থেকে পড়িয়া মরিয়া গিয়াছে।’
গুণারাজ সত্বরপদে জনতার দিকে চলিলেন। তাঁহাকে দেখিয়া সকলে পথ ছাড়িয়া দিল। তিনি ভিড়ের ভিতর প্রবেশ করিয়া বলিলেন, “কি হয়েছে—ব্যাপার কি?”
তখন পুলিস-কৰ্ম্মচারী তাঁহার নিকটস্থ হইয়া বলিল, “এই লোকটা গাছে তাড়াতাড়ি উঠতে গিয়া পড়ে গেছে—এর ঘাড় ভেঙ্গে যাওয়ায় মরে গেছে। আমরা ইহার সন্ধানে ছিলাম।”
গুণারাজ বলিলেন, “তোমরা কে?”
পুলিস-কৰ্ম্মচারী উত্তর করিল, “আমি পুলিসের জমাদার। আমাদের ইনস্পেক্টর এখনই আসিবেন। এই লোকটা দাদিয়া নাম নিয়ে দেওপাট্টা ঘাটের পড়োবাড়ীতে ছিল; সেইখানে দয়ামলকে খুন করিয়াছে। দুঃখের বিষয় এই রকমে মরিয়া গেল—না হলে ফাঁসী হইত।”
গুণারাজ তাহার কথায় কর্ণপাত না করিয়া মৃতব্যক্তির নিকটস্থ হইলেন। তাহার মুখ দেখিয়া, তিনি চমকিত হইয়া স্তম্ভিতভাবে দাঁড়াইলেন। বিস্ফারিতনয়নে সেই মুখের দিকে মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় চাহিয়া রহিলেন।
তাঁহার ভাব দেখিয়া জমাদার বলিল, “মহাশয়, আপনি কি এই লোককে চিনেন?”
গুণারাজ তাহার কথায় কোন উত্তর না দিয়া, দুই হাতে লোক ঠেলিয়া জনতা হইতে বাহির হইলেন। তাহার পর তিনি উন্মত্তের ন্যায় নিজ গৃহাভিমুখে ছুটিলেন। তাঁহার ভাব দেখিয়া সকলেই বিস্মিত হইয়া তাঁহার দিকে চাহিয়া রহিল।
তিনি একেবারে নিজের ঘরে আসিয়া দ্বার রুদ্ধ করিলেন। এ দিকে মীনাকে লইয়া ইন্দ্ৰানন্দ ব্যস্ত, অধীর, উন্মত্ত—মীনার এখনও সংজ্ঞা হয় নাই। কাজেই জমাদার তাঁহাদের সহিত সাক্ষাৎ করিতে আসিয়া কাহারই সাক্ষাৎ পাইলেন না।
তখন পুলিস-কৰ্ম্মচারী লাস নইনিতালে লইয়া যাইবার জন্য বন্দোবস্ত করিতে লাগিল। অনেক কষ্টে লোক সংগ্রহ করিয়া লাস লইয়া রওনা হইয়াছেন, এমন সময়ে সেই ডিটেক্টিভ তথায় আসিয়া উপস্থিত হইলেন। তিনি লাস নামাইতে আজ্ঞা করিলেন।
চতুর্দ্দশ পরিচ্ছেদ – উদ্বেগ আবার বাড়িল
রোগ-শয্যায় পড়িয়া বারবিক্রম বাহিরের এই গোলযোগ শুনিতে পাইতেছিলেন। দরিয়া তাঁহার পার্শ্বে বসিয়াছিল। সে দিন রাত্রি সমভাবে তাঁহার শুশ্রূষা করিতেছিল।
দরিয়াও এই সকল গোলযোগ শুনিতে পাইতেছিল। বাহিরে কি ঘটিয়াছে, জানিবার জন্য তাহারও মন বড় ব্যাকুল হইতেছিল, কিন্তু সে উঠিল না। সে ইচ্ছা করিয়া এক মুহূর্ত্তের জন্য ও বীরবিক্রমকে ছাড়িয়া অন্যত্র যাইত না।
দরিয়া দেখিল, বীরবিক্রম এই সকল গোলযোগ শুনিয়া নিতান্ত বিচলিত হইলেন। শয্যার উপর ছট্ফট্ করিতে লাগিলেন। চারিদিকে ব্যাকুলভাবে চাহিতে লাগিলেন। কান পাতিয়া গোলযোগের শব্দ শুনিতে লাগিলেন। অবশেষে তিনি এত অস্থির হইয়া উঠিলেন যে, তাহা দেখিয়া দরিয়া বলিল, “বেশী অসুখ করিতেছে কি?”
বীরবিক্রম মনোভাব গোপন করিবার চেষ্টা পাইয়া বলিলেন, “না, বাহিরে কেন এত গোল হইতেছে?”
দরিয়া জানিত না। তাহারও জানিবার জন্য মন ব্যাকুল হইয়াছিল, সে কি বলিবে স্থির করিতে না পারিয়া বলিল, “একটা বুড়ী আমাদের বাগানে এসেছে—আর একদিনও এসেছিল।”
বীরবিক্রম উঠিবার চেষ্টা পাইলেন, কিন্তু পারিলেন না। বলিলেন, “কে বুড়ী?”
দরিয়া বলিল, “তা জানি না, ভয়ানক দেখতে—আর একবার এসেছিল, আপনার কথা জিজ্ঞাসা করেছিল—আবার আসিয়াছে। দাদা তাহাকে বাগান থেকে বার করে দিতে গিয়াছেন। বোধ হয়, মালীরা সেইজন্য গোল করিতেছে।”
বীরবিক্রম কিয়ৎক্ষণ চক্ষু মুদিত করিয়া নীরবে রহিলেন। অবশেষে কাতরভাবে বলিলেন, “ইন্দ্রানন্দকে একবার এখনই ডাক, আমার বিশেষ দরকার আছে।”
দরিয়া বলিল, “তিনি এখনই তাকে তাড়িয়ে দিয়ে আসবেন।“
বীরবিক্রম বিশেষ বিচলিত ও অস্থির হইয়া বলিলেন, “না—না—না—আমার এখনই দরকার–তুমি এখনই তাহাকে ডাক।”
তাঁহার ভাব দেখিয়া দরিয়ার ভয় হইল; সে উঠিল। বীরবিক্রম ব্যগ্রভাবে বলিলেন, “যাও, শীঘ্র যাও—তাঁহাকে বলিয়ো, যেন কেহ এই বুড়ীর উপর কোন অত্যাচার না করে—না—না— সেই বুড়ীকে শীঘ্র এখান থেকে যাইতে বল।”
বলিতে বলিতে বীরবিক্রমের চক্ষু বিস্ফারিত হইল; এবং মুখে এক ভয়াবহ ভাব দেখা দিল। দেখিয়া দরিয়া অত্যন্ত ভয় পাইয়া বলিল, “আপনি স্থির হইয়া শুইয়া থাকুন, না হলে অসুখ বাড়িবে। আমি এখনই দাদাকে বলিতেছি।”
বীরবিক্রম সেইরূপ ব্যাকুলভাবে বলিলেন, “যাও—যাও—শীঘ্র যাও!”
তাঁহাকে এ অবস্থায় ফেলিয়া দরিয়ার যাইতে ইচ্ছা ছিল না; কিন্তু না গেলে বীরবিক্রম আরও অধীর হইয়া উঠেন দেখিয়া, সে অগত্যা অনিচ্ছাসত্ত্বেও দুরুদুরুবক্ষে সসঙ্কোচপদক্ষেপে গৃহ পরিত্যাগ করিল। তাড়াতাড়ি সে দাদার ঘরে আসিয়া দেখিল, মীনা মূৰ্চ্ছিতা। দাদা তাহার শুশ্রূষায় নিযুক্ত আছেন। এ অবস্থায় সে দাদাকে কি বলিবে, কি করিবে কিছুই স্থির করিতে না পারিয়া স্তম্ভিত হইয়া নীরবে দাঁড়াইয়া রহিল।
ক্রমে মীনার মূৰ্চ্ছা ভঙ্গ হইল। সে একবার ব্যাকুলভাবে চারিদিক চাহিল; তাহার পর সহসা উঠিয়া রসিল। বসিয়া বলিল, “আমার কিছু হয় নাই, মাথাটা হঠাৎ ঘুরে গিয়েছিল। আপনারা সব এখানে! বীরবিক্রমের কাছে কে আছে?”
তখন দরিয়া ইন্দ্রানন্দকে বলিল, “দাদা, কেন জানি না, তিনি বড় অস্থির হইয়াছেন, ছট্ফট্ করিতেছেন—তোমায় ডাকিতেছেন, একবার শীঘ্র এস।”
মীনা সত্বর উঠিয়া দাঁড়াইল। ইন্দ্রানন্দ তাহার হাত ধরিয়া বসাইলেন। “তোমার অসুখ করিয়াছে, তুমি যাইয়ো না; আমি যাইতেছি।”
মীনা বসিল। দরিয়া বলিল, “দাদা, তিনি সেই বুড়ীর জন্য বড় ব্যস্ত হয়েছেন; আমাকে দেখিয়া তিনি তোমায় বলিতে বলিলেন, যেন কেহ সেই বুড়ীর উপর কোন অত্যাচার না করে।”
“আচ্ছা, আমি দেখিতে যাইতেছি; তুমি গিয়ে তাঁহাকে বল, আমি এখনই ফিরিয়া আসিতেছি।”
এই বলিয়া ইন্দ্রানন্দ সত্বর বাগানের দিকে ছুটিলেন।
দরিয়াও সত্বর বীরবিক্রমের গৃহে ফিরিয়া আসিল। তাহাকে দেখিয়া বীরবিক্রম ব্যাকুলভাবে বলিলেন, “কই, কি হল? ইন্দ্রানন্দ কোথায়?”
দরিয়া বলিল, “তিনি এখনই আসিতেছেন। বুড়ীর কথা আমি তাঁহাকে বলেছি। তিনি তাই দেখতে গিয়াছেন।”
এই সময় সেই গৃহের সম্মুখ দিয়া একজন দাসী যাইতেছিল; সে কাহাকে বলিল, “পুলিস এসেছে।”
এ কথা বীরবিক্রমের কানে গেল। তিনি চমকিত হইয়া দরিয়ার দিকে চাহিয়া বলিলেন, “পুলিস–তবে পুলিস কি এসেছে?”
দরিয়া কি বলিবে, সে তাহা কিছুই জানে না। এই কথায় তাহারও সর্ব্বাঙ্গ কাঁপিতে লাগিল। তাহার দুই চক্ষু জলে পূর্ণ হইয়া আসিল; সে রুদ্ধকণ্ঠে বলিল, “আমি ত তা জানি না।“
একটা চাপা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া বীরবিক্রম চক্ষু মুদিত করিলেন। বীরবিক্রম অবসন্ন হইয়া পড়িলেন। ওই সময়ে ব্যস্ত সমস্ত হইয়া ইন্দ্রানন্দ বীরবিক্রমের নিকট উপস্থিত হইলেন। তাঁহাকে দেখিলে সহসা চেনা যায় না—এই অত্যল্প সময়ের মধ্যে তাঁহার মুখমণ্ডলের এমনই পরিবর্ত্তন হইয়াছে।
তাঁহার পদশব্দে বীরবিক্রম চক্ষু উন্মীলন করিলেন। তিনি কোন কথা কহিতে পারিলেন না। ব্যাকুলনেত্রে ইন্দ্রানন্দের দিকে নীরবে চাহিয়া রহিলেন।
ইন্দ্রানন্দ ভগিনীর দিকে ফিরিয়া বলিলেন, “দরিয়া, তুমি একবার ঐ ঘরে যাও; বীরবিক্রমের সঙ্গে আমার দুই-একটা কথা আছে।”
দরিয়া একবার দাদার দিকে চাহিল, একবার বীরবিক্রমের দিকে চাহিল। তাহার মুখ শুকাইয়া পাংশুবর্ণ হইয়া গেল। ইন্দ্রানন্দ বীরবিক্রমকে কি বলিবেন, সে বুঝিল। সে বুঝিল যে, বীরবিক্রমকে গ্রেপ্তার করিবার জন্য পুলিস আসিয়াছে। দরিয়া কোন কথা কহিল না, তাহার কোন কথা বলিবার ক্ষমতা ছিল না; সে উদ্বেগপূর্ণ হৃদয়ে ধীরে ধীরে সে কক্ষ পরিত্যাগ করিয়া গেল।
পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ – সন্দেহ—সত্যে পরিণত
ইন্দ্রানন্দ কি কথা আগে বলিবেন—কিরূপে কথা আরম্ভ করিবেন, স্থির করিতে না পারিয়া নীরবে দাঁড়াইয়া রহিলেন।
তখন বীরবিক্রম ধীরে ধীরে বলিলেন, “তুমি যাহা বলিবে, আমি জানি—পুলিস এসেছে।”
ইন্দ্ৰানন্দ বলিলেন, “হাঁ, কিন্তু তোমাকে গ্রেপ্তার করিতে নয়।”
“তাহাও আমি জানি—তবে তাঁহাকে ধরিয়াছে। তুমি অঙ্গীকার করিয়াছ যে, তাঁহাকে রক্ষা করিবার জন্য প্রাণপণে চেষ্টা করিবে।”
ইন্দ্রানন্দ নীরবে রহিলেন; কি বলিবেন কিছুই স্থির করিতে পারিলেন না।
বীরবিক্রম বলিলেন, “তাহাকে তাহারা নিয়ে গেছে?”
ইন্দ্রানন্দ আর এরূপে নীরবে থাকা উচিত নহে ভাবিয়া বলিলেন, “তুমি যদি দাদিয়ার কথা মনে করিয়া থাক, তবে সে আর বাঁচিয়া নাই।”
“বাঁচিয়া নাই!” বলিয়া তীরবেগে বীরবিক্রম উঠিয়া বসিলেন। তিনি তখনই আবার পড়িয়া যাইতেছিলেন, সত্বরে ইন্দ্রানন্দ তাঁহাকে ধরিলেন।
বীরবিক্রম ব্যগ্রভাবে বলিলেন, “কি বলিলে, বাঁচিয়া নাই—কে বাঁচিয়া নাই?”
ইন্দ্রানন্দ বলিলেন, “তুমি একটু স্থির হও, আমি সব বলছি।”
“আগে বল, নতুবা আমি স্থির হইতে পারিতেছি না।”
“দাদিয়া বাঁচিয়া নাই।”
“যথার্থই বাঁচিয়া নাই?”
“না।”
“হা ভগবান! তুমি আমাকে রক্ষা করিলে।”
এই কথায় বিস্মিত হইয়া ইন্দ্রানন্দ তাঁহার দিকে চাহিলেন। বীরবিক্রম বলিলেন, “আমাকে শায়াইয়া দাও—ভয় নাই। আমি এবার শীঘ্র আরাম হইব।”
ইন্দ্রানন্দ তাঁহাকে শয়ন করাইয়া দিলেন।
বীরবিক্রম বলিলেন, “আমায় সব বল।”
ইন্দ্রানন্দ ইতস্ততঃ করিতেছেন দেখিয়া, বীরবিক্রম বলিলেন, “ভয় নাই, আমি আর অধীর হইব না।
ইন্দ্রানন্দ বলিলেন, “দাদিয়া—দাদিয়া—” তিনি সহসা থামিলেন।
বীরবিক্রম তাঁহার দিকে কিয়ৎক্ষণ চাহিয়া রহিলেন। কোন কথা কহিলেন না।
সহসা ইন্দ্রানন্দ বলিলেন, “এ কথা আমাদের এতদিন বল নাই কেন?”
বীরবিক্রম অন্যদিকে মুখ ফিরিয়া বলিলেন, “কি কথা?”
“এই দাদিয়া যে তোমার—”
“কেমন করিয়া জানিলে?”
“বাবা তাঁহাকে দেখেই চিনিয়াছিলেন।”
বীরবিক্রম কিয়ৎক্ষণ নীরব থাকিয়া বলিলেন, “ভাই, একটু ভাল হই, সব বলিব। পুলিস কি গহাকে এখন নিয়ে গেছে?”
“না, বাবা নিয়ে যেতে দেন নাই। দাদিয়া যে কে, পুলিস তাহা জানিতে পারিয়াছিল; তাঁহার ামেই দয়ামলকে খুন করিবার জন্য শেষে ওয়ারেন্ট বাহির করেছিল—তাঁহাকে ধরিতেই পুলিস।খানে এসেছিল।”
“তিনি কেমন করিয়া মারা গেলেন, আমাকে বল।”
“তাঁহাকে দেখিয়া মালীরা তাড়া করিয়াছিল। তিনি ছুটিয়া গিয়া একটা গাছে উঠিতেছিলেন। কন্তু একটা ডাল ভাঙ্গিয়া নীচে পড়িয়া যান, তাহাতেই তাঁহার মৃত্যু হইয়াছে।”
বীরবিক্রম কোন কথা কহিলেন না। কিয়ৎক্ষণ নীরবে থাকিয়া বলিলেন, “তাহার পর এখন গহাকে কোথায় রাখিয়াছে?”
ইন্দ্রানন্দ বলিলেন, “তাঁহার সৎকার করিবার জন্য সব বন্দোবস্ত করিয়া বাবা পাঠিয়ে দিয়েছেন।”
বীরবিক্রম কথা কহিলেন না। ইন্দ্রানন্দ কাতরভাবে বলিলেন, “আগে আমাদের এ কথা বল নাই কন? তা হলে হয় ত এতদূর ঘটিত না।”
বীরবিক্রম বলিলেন, “ভাই, এখন আমাকে কিছু জিজ্ঞাসা করিয়ো না, সব পরে বলিব। দরিয়া ঐ সব শুনেছে?”
“না, তাকে আমরা কিছু বলি নাই—সে শুনেছে, দাদিয়া গাছ থেকে পড়ে মরে গেছে।”
“মীনা?”
“না, সে-ও কিছু শোনে নাই।”
“ইন্দ্রানন্দ, সে আমার ভগিনী।”
ইন্দ্রানন্দ বিস্মিতভাবে বীরবিক্রমের দিকে চাহিয়া রহিলেন। বীরবিক্রম আর কোন কথা কহিলেন না। চক্ষু মুদিত করিলেন।
ষোড়শ পরিচ্ছেদ – পূৰ্ব্বকথা
এই ঘটনার পর বীরবিক্রম অতি শীঘ্রই আরোগ্য লাভ করিলেন। তিনি ক্রমে উঠিয়া বাহিরে আসিয়া বসিতে সক্ষম হইলেন।
তিনি শরীরে বল পাইলে একদিন গুণারাজ তাঁহার নিকটে আসিয়া বসিলেন। বসিয়া বলিলেন, “বীরবিক্রম, সকল কথা আমাকে পূৰ্ব্বে বলিলে বোধ হয়, এত গোলযোগ ঘটিত না।”
এই সময়ে ইন্দ্রানন্দও আসিয়া দাঁড়াইলেন। তিনিও বলিলেন, “আগেই আমাদের সব কথা বলিলে ভাল হইত।”
বীরবিক্রম ধীরে ধীরে বলিলেন, “আমার অবস্থা আপনারা ঠিক বুঝিতেছেন না—বলিবার উপায় থাকিলে অবশ্য বলিতাম।”
গুণারাজ বলিলেন, “যা হবার তাহা হইয়াছে; এখন সৰু বল।”
বীরবিক্রম বলিলেন, “আপনি ত জানেন, বাবা হঠাৎ নিরুদ্দেশ হন। পূর্ব্বেই তাঁহার মাথা খারাপ হইয়া গিয়াছিল। আমরা সকলেই মনে করিয়াছিলাম, তিনি বাঁচিয়া নাই। সম্ভবতঃ আত্মহত্যা করিয়াছেন।”
গুণারাজ বলিলেন, “হাঁ, আমরা ত সকলে তাহাই জানিতাম।”
বীরবিক্রম বলিলেন, “মাস কয়েক হইল, তিনি সহসা নইনিতালে ফিরিয়া আসিয়া আমার সঙ্গে দেখা করেন। সহজে তাঁহাকে কেহ পাগল বলিয়া বুঝিতে পারে না; কিন্তু আমি দু-একদিনেই বুঝিলাম যে, তিনি সব সময়ে পাগল না হইলেও সময়ে সময়ে ঘোর উন্মত্ত হন।”
“এরূপ অবস্থায় তোমার উচিত ছিল, তাঁহাকে আঙ্কাইয়া রাখা।”
বীরবিক্রম। লোকে তাঁহাকে দেখিলে পাছে পাগল ভাবিয়া পাগলাগারদে দেয়, এই ভয়ে তিনি কাহারও সঙ্গে দেখা করেন নাই; মুখে একটা মুখস লাগাইয়া স্ত্রীবেশে পড়োবাড়ীতে থাকিতেন। আমি তাঁহাকে অনেক বুঝাইয়াছিলাম; কিন্তু আমার কোন কথা শুনিলেন না। পিতা তিনি, কি করি, ভাবিলাম, যদি ঠাণ্ডা হইয়া এখানে থাকেন—ক্ষতি নাই।
গুণারাজ। তোমার উচিত ছিল, তাঁহাকে পাগলা গারদে দেওয়া।
বীরবিক্রম। আমি তাহারও চেষ্টা করিয়াছিলাম। কিন্তু এ দিকে তিনি ভারি বুদ্ধিমান ছিলেন। আমার মতলব জানিতে পারিয়া আমার উপর খুব রাগিয়া উঠিলেন। আমাকে পুনঃ পুনঃ বলিতে লাগিলেন যে, “তুমি আমার সঙ্গে এ দেশ ছেড়ে চল।” আমি অস্বীকার করায় আমার উপর আরও রুষ্ট হইলেন। কেমন করিয়া জানি না, তিনি দরিয়ার কথা জানিতে পারিয়া তাহার উপরও ক্রুদ্ধ হইলেন। দরিয়ার জন্য আমার ভয় হইল। আমি এই সকল ঘটনায় একেবারে অস্থির হইয়া উঠিলাম। এরূপ অবস্থায় আমার বিবাহ করা কোন মতেই উচিত নয় বিবেচনা করিয়া, আমি মন স্থির করিবার জন্য এ দেশ হইতে কিছুদিনের জন্য অন্যত্র গিয়াছিলাম।
গুণা। এ সব আমাদের বল নাই কেন?
বীর। বাবার এ সকল বিষয় জন-সমাজে প্রকাশ করা কষ্টকর।
গুণা। আমরা তোমার পর নই। তার পর কি হল?
বীর। তিনি প্রায়ই আমাকে চিঠি লিখিয়া ডেকে পাঠাইতেন। পাছে না গেলে বাড়ী আসিয়া কোন কেলেঙ্কারী করেন, এই ভয়ে আমি তাঁহার চিঠি পাইলেই তাঁহার সহিত দেখা করিতাম।
গুণা। তিনি কেমন করিয়া দয়ামলকে খুন করিলেন?
বীর। তাহা আমি বলিতে পারি না। তাহা ছাড়া যাহা ঘটিয়াছে তাহা আর ফিরিবে না জানিয়া আমি আর কিছু বলিতেও চাহি নাই।
ইহাই ‘বিষম-বৈসূচন’