তৃতীয় খণ্ড – রমণী না প্রেতিনী!
“Pal, You love her, then?
Are. Who would not?
Pal. and desire her?
Are. Before my liberty.”
Shakespeare-‘The two noble kinsmen’
প্রথম পরিচ্ছেদ – উদ্যানে
সন্ধ্যার পরে উদ্যানে কামিনীবৃক্ষ পার্শ্বস্থ একটী প্রস্তর চাতালে বসিয়া পরিমল গুন্ গুন্ করিয়া আপন মনে গাহিতেছিল,
সুষম কুসম হাসি সন্ধ্যায় শীতল কোলে,
উঠিছে ফুটিয়া হেতা, দেখিয়া মানস ভুলে।
দেখিতে এফুল হাসি, এসেছে হেতায় শশী,
সমীর, নক্ষত্র রাশি, আমিও এসেছি চলে।
ছুটিছে সৌরভ রাশি, ভরিতেছে দশদিশি,
গুণ গান গাহি অলি লুটিতেছে ফুলদলে।
হেতায় জোছনা ফুটে, ভরা তটীনি ছুটে,
পাগল মলয় লুটে, সরসীর কাল জলে।
এমন সময় সঞ্জীববাবু সহসা তথায় প্রবেশ করিলেন। গীত থামিল। পরিমল কিছু অপ্রস্তুত হইল।
সঞ্জীববাবু বলিলেন, “পরিমল, তুমি বেশ গাহিতে পার।”
পরিমল সরমসঙ্কুচিতা হইয়া বলিল, “কে বলিল? না।”
‘তোমার ‘সুষম কুসুম হাসি’ ইত্যাদি ইত্যাদি।”
“আপনি এখানে আসিলেন কেন?”
“আমি স্বইচ্ছায় আসি নাই। তোমার ‘সুষম কুসম হাসি’ আমায় অনেকদূর থেকে ডেকে এনেছে।”
“আপনি এসে ভাল করেন নাই।”
“আমি যে কিছু মন্দ করেছি এমনতও দেখছি না।”
“আপনাকে কথায় কে পরাজয় করবে?”
“কথায় না হ’ক—কার্য্যেতে করেছ।”
“আমার কোন্ কার্য্য আপনাকে পরাজয় করেছে?”
“এখন বলতে চাই না—সকল স্থানেই সুন্দর মুখের জয়।”
“আপনি আমাকে কেন বার বার অবিশ্বাস করেন?”
“যদি তোমাকে না অবিশ্বাস করি, তবে আমার নিজের চোক্ দুটাকে আমায় অবিশ্বাস করতে হয়।”
যদি সঞ্জীববাবু কথায় কথায় ভাবান্তরে তাহাকে অবিশ্বাসের কথা বলিতেছিলেন; কিন্তু দেখিলেন, সে অমলমুখশ্রী—সম্পূর্ণ নিদোষ—নিষ্কলঙ্ক—নিষ্কলুষ—নিৰ্ম্মল—পবিত্র—সরলতা— পূর্ণ—মনোহর। সে শ্রী মধ্যে আরও দেখিলেন কেমন এক হৃদয়াকার্যণী শক্তি পরিব্যাপ্ত হইয়া রহিয়াছে। সেই রাজীবনয়নে ঈষণ্ণত দৃষ্টিতে কোমলতা ও সচ্ছীলতা মিশিয়া ক্রীড়া করিতেছে।
“আপনি স্বচক্ষে কি দেখেছেন—বলুন?”
“আমি যা স্বচক্ষে দেখেছি—তা আমি তোমায় বলতে চাহি না—দেখাতে চাই।”
“বেশ ত, দেখান।”
“সময় বিশেষে।”
(উপহাসে) “আপনি যা আমাদের বিমলাকে এনে দেবেন তা আপনার বুদ্ধির আধিক্য দেখেই এখন থেকে বুঝতে পারছি।”
“আচ্ছা আমার বুদ্ধি না হয়—তিনবার তোমার কৌশলের নিকট পরাস্ত হয়েছে। এখনও সময় আছে; কিন্তু, পরিমল, নিশ্চয় জানিও আমি সহজে ছাড়বো না। তোমার কি একখানা নাম লেখা রুমাল আছে? খুঁজে দেখ” দেখি।”
“আপনি কি কথায় কি কথা আছেন? আমাকে মিথ্যা সন্দেহ করে—আপনি আপনা হ’তে আপন কার্য্যে ব্যাঘাত করছেন?”
“বাধা বিঘ্ন ব্যাঘাত—একদিনে না একদিনে লোপ কোরবো।” যখন পরিমলের সঙ্গে সঞ্জীববাবুর এবম্বিধ কথোপকথন চলিতেছিল তখন—জ্যোৎস্না ফুটিয়াছিল—সেই শুভ্র স্নিগ্ধ আলোকে সরসীর স্বচ্ছ বারিরাশি নীল—অনন্তআকাশ হীরকখচিত নীল—উদ্যানস্থ তরুলতা ঘনশ্যাম; পরিমলের চন্দ্রপতিম-আনন নিৰ্ম্মল—ধৌত ও প্রোজ্জ্বল। দিগন্ত মনোহর—লোচনানজ্জ- বিধায়ক—সমীরণ ভাসিয়া বেড়াইতেছে,–ফুলের সৌরভ ঊর্দ্ধশ্বাসে ছুটিতেছে। লজ্জানষনববধুর মত রজতবর্ণের মেঘসন্ততিদল মৃদু মৃদু আসিয়া ধীরে ধীরে দিগন্তের অন্তঃপুর—নির্জ্জন নেপথ্য পানে চলিয়া যাইতেছে।
“বাধা বিঘ্ন ব্যাঘাত একদিনে না একদিনে লোপ করবো।” শুনিয়া পরিমল ভাবিল বোধ হয় সঞ্জীববাবু রাগ করিয়াই এ কথা বলিলেন। কিন্তু—মুখপানে চাহিয়া—সে ক্ষুদ্র সন্দেহ তিরোহিত হইল। দেখিল—সে মুখমণ্ডল পূর্ব্ববৎ হাস্যপরিপূর্ণ—জ্যোৎস্নাদীপ্ত—প্রফুল্ল—শোভাযুক্ত, চিন্তালুপ্ত। সঞ্জীববাবু পরিমলের মুখপানে চাহিবামাত্র চারিচক্ষু মিলিল—সে মুখ নত করিল। বলিল, “আজ আপনি মামাবাবুর সঙ্গে দেখা করেন নাই কেন?
স। তিনি কেমন আছেন—জ্বর হয় নাইত?
প। না—ভাল আছেন।
স। আজ আমার একটু প্রয়োজন ছিল।
প। প্রয়োজন কি?
স। সে কথা তোমায় কি বলবো? তোমার মামাবাবু আমার কথা কিছু জিজ্ঞাসা করেছিলেন? প। না। তাঁর ভাব দেখে বোধ হল—আপনি সারাদিন তাঁর সঙ্গে একবার মাত্র দেখা করেন নাই বলে রাগ করেছেন।
স। আজও রাত্রে দেখা হবে না। আচ্ছা পরিমল—তোমাদের বৈঠকখানায় যে বিমলার অয়েলপেইন্টীং ছবি আছে—ও ছবি খানা কি এখনও বিমলার চেহারার সঙ্গে ঠিক মেলে?
প। কেন মিলবে না—ও যে বিমলারই চেহারা
স। না—আমি তা বলছি না—ছবিখানি তিন চার বৎসরের অধিক হল তৈয়ার হয়েছে। বিমলা এখন বড় হয়েছে—বড় হলে চেহারা কিছু তফাৎ হয়ে যায়—তাই বলছি ছবিখানাতে বিমলাকে বেশ চেনা যায় কি?
প। হাঁ।
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ – বনে
৯টা রাত। অনন্ত আকাশ মেঘব্যাপ্ত। মেঘ, নিবিড় কৃষ্ণ—একস্থানেস্থির—দিগন্তব্যাপী— ছিদ্রলুপ্ত—সজল-সৰ্ব্বস্থানেস্তুপী-কৃত। দেখিলে বোধহয় এখনিই খুব এক পাসলা ঢালিবে। সে মেঘে, তারা ঢাকিয়াছে—শশী লুকাইয়াছে—জ্যোৎস্না ডুবিয়াছে, নিলিমা লুপ্ত হইয়াছে—ঘোর অন্ধকার সৃজিয়াছে। দিগন্ত হইতে মধ্যস্থান অবধি তড়িদ্বিকাশ হইতেছে। বায়ুবদ্ধ। বৃক্ষাবলী নিস্তব্ধ—স্থির—কোনটা একটী পাতাও নাড়িতেছে না।
এমন সময়ে এই ঘোর দুর্যোগে—মাঠের মধ্য দিয়া, একাকী সঞ্জীববাবু চণ্ডীতলার পশ্চিম পার্শ্বস্থ বনে প্রবেশ করিয়া ক্রমাগত পশ্চিমদিকে অগ্রসর হইতেছেন। বেহালার উত্তর অংশে চণ্ডীতলা। মধ্যে বেহালা যাইবার একটা পথ। পথের পূর্ব্ব ও পশ্চিমপার্শ্বে গহন বন— বৃহদ্বক্ষাবলীতে পরিব্যাপ্ত—লতায় পাতায় বনজঙ্গলে নিবিড় দুষ্প্রবেশ্য।
আজকাল বনাংশ অনেক পরিস্কৃত হইয়াছে। মধ্যে মধ্যে ধনাঢ্য ব্যক্তিগণের ফলোদ্যান স্থাপিত হইয়াছে। দরিদ্র গৃহস্থগণ পর্ণকুটীর নির্ম্মাণ করিয়া বসতি করিতেছে। আমরা যে সময়ের কথা বলিতেছি সে সময়ে এমন ভয়ঙ্কার অরণ্য ছিল, যে দিবসে নির্বিঘ্নে কত হত্যাকাণ্ড সমাধা হইত, কেহ কিছু জানিত না। মাসৈক সময়ের মধ্যে পাঁচ সাতটী মৃতদেহ—কোনটা বক্ষবিদির্ণ, কোনটা মস্তকচূর্ণ—কোনটা মস্তকহীন—কোনটা বৃক্ষগাত্রে লৌহশলাকাবিদ্ধ হইয়া লম্বমান—কোনটা গলদেশে দড়ীর ফাঁসযুক্ত, কোনটা হস্তপদবদ্ধ—কোনটা উদরচ্ছিন্ন পাওয়া যাইত। এখনও কেহ সে পথে সন্ধ্যার পর গমন করিতে সাহস করে না।
সঞ্জীববাবু জানিতেন, রাত্রে এ বনে প্রাণ হাতে করিয়া প্রবেশ করিতে হয়; কিন্তু তিনি কোন বিপদকে বিপদজ্ঞান করে আপন অভীষ্ট কার্য্য ত্যাগ করিতেন না। তিনি যে দিন এই কার্য্যে আপনাকে নিয়োজিত করিয়াছেন—সে দিন হইতে তিনি নিজ জীবনকে তুচ্ছজ্ঞান করিয়া আসিতেছেন—কত বিপদের সঙ্গে যুদ্ধ করিয়া আসিতেছেন।
কিয়দ্দূর অগ্রসর হইয়া সঞ্জীববাবু একটা ঘনপত্রাবলীপরিবৃত বৃক্ষে আরোহণ করিলেন। বৃক্ষটি লতাদ্বারা সম্পূর্ণ আচ্ছাদিত। তাহার উপরিকার শাখায় একটা বঁকী ছিল, পাড়িলেন। (সঞ্জীববাবু অপরাহ্নে একবার এইস্থানে আসিয়া পথ, স্থান, দেখিয়া যান ও এই কাপড়ের বুচকী নিরাপদ রাখিয়া যান্।) সেই বুচকীতে মড়োয়ারীর বেশভূষা ছিল—বাহির করিলেন। নিজে পরিধান করিয়া ছদ্মবেশে সাজিলেন। মাথায় হরিদ্বর্ণের পাগড়ী দিলেন—কোমরে একছড়া স্বর্ণজলরঞ্জিত পিতলের চেইন ঝুলাইলেন—কাহার সাধ্য তাহাকে চিনে? তাহার মূর্ত্তির এবং বেশভূষার সম্পূর্ণ পরিবর্তন ঘটিল।
তাঁহার নিজের বস্ত্রাদি সেই বুচকীতে তবকে তবকে সাজাইয়া বান্ধিলেন। পরে যথাস্থানে রাখিয়া দিয়া চলিতে লাগিলেন। সঙ্গে গোপনে একখানি ছুরি, একটা পিস্তল আর সেই লণ্ঠন লইয়াছিলেন।
মস্তকের উপর দিয়া একটা পেচক কর্কশ কণ্ঠে হাঁকিয়া উড়িয়া গেল। সঞ্জীববাবু তাহাতে ভ্রুক্ষেপ করিলেন না। কিছুদূর যাইয়া একটা প্রকাণ্ড ভাঙ্গা বাড়ী দেখিতে পাইলেন। তাহার কোন কোন অংশ ভাঙ্গিয়া চুরিয়া ধুলিসাৎ হইয়াছে। ভিতরস্থ ব্যক্তি কতিপয়ের কথোপকথন শব্দ শুনা যাইতেছে—বড় অস্পষ্ট। বাটীমধ্য হইতে একটী চিরমুক্তবাতায়ন দিয়া দীপালোক আসিয়া বনে পড়িয়াছে।
তিনি বাহির হইতে দ্বারে আঘাত করিতে লাগিলেন। কয়েক মুহূৰ্ত্ত কাটিল কোন উত্তর নাই। দেখিলেন যে আলো জ্বলিতেছিল তাহা নাই—কে উঠাইয়া লইয়া গেল। আবার করাঘাত করিলেন। কাহার পদশব্দ শুনিতে পাইলেন। তৎক্ষণাৎ দ্বার উন্মুক্ত হইল। প্রদীপ হাতে লইয়া তথায় এক ব্যক্তি দেখা দিল। সেই ব্যক্তি পাঠকের পূর্ব্বপরিচিত হীরুলাল।
হীরুলাল কর্কশস্বরে জিজ্ঞাসিল, “কে তুমি–কি চাও?”
সঞ্জীববাবু হিন্দীতে বলিলেন, “আমি পথ হারায়েছি। আর এই দুৰ্য্যোগে কোথা যাব? আপনাদের এখানে আলো দেখে এসে উপস্থিত হয়েছি। আমায় আজ রাত্রিকার মতন একটা ঘর যদি অনুগ্রহ করে দেন।”
হীরুলাল কহিল, “একটা রাত্রির ভাড়া দুটাকা পড়বে, দিতে পারবেন?
সঞ্জীববাবু কহিলেন, “পারবো।”
হীরুলাল মনে করিল, “লোকটা ধনী বটে—সঙ্গে আছেও কিছু—বিশেষতঃ ওই মোটা চেইন ছড়াটা। শিকার আপনি শিকারীর কাছে এসে উপস্থিত হয়েছে—মনে করেছিলেম্ এত দুৰ্য্যোগে আজ কিছু হবে না—খুব সুযোগই হয়ে গেল।” প্রকাশ্যে বলিল, “আসুন, মশাই, ভিতরে আসুন।”
তৃতীয় পরিচ্ছেদ – প্রেমারা
হীরুলালের সঙ্গে সঞ্জীববাবু প্রাঙ্গণে উপস্থিত হইলেন। প্রাঙ্গণ অতি অপরিষ্কার; কোথায় একটা ভাঙ্গা বোতল—কোথায় রন্ধনের চূর্ণ হাঁড়ী—কোথায় রাশীকৃত জঞ্জাল—কোথায় টুকরা টুকরা বাঁশ—কোথায় ছিন্ন বস্ত্রাংশ—কোথায় অর্দ্ধশুষ্ক বমনরাশি—কোথায় তরুর শুষ্ক শাখা প্রশাখা। আলোক না থাকিলে সে স্থান অতিক্রম করা যায় না।
প্রাঙ্গণ-সম্মুখে ভগ্নচণ্ডীমণ্ডপ। তাহাতে একখানি অতিছিন্ন সতরঞ্চ বিস্তৃত। তদুপরি একপার্শ্বে অতিমলিন ছিদ্রময় তিনটী তাকিয়া। ভিত্তিগাত্র নিষ্টিবণ কলঙ্কিত; ছাদতল গাঢ় কৃষ্ণবর্ণের ঝুলরাশিদ্বারা আবৃত। একটা বৃহৎ প্রদীপ মশালের মত জ্বলিতেছে। আলোক সম্মুখে তিন ব্যক্তি উপবিষ্ট; পার্শ্বে মদপূর্ণ বোতল—পানের গেলাস। একযোড়া তাস সম্মুখে পড়িয়া।
ব্যক্তি ত্রয়ের মধ্যে একজন যুবক—খৰ্ব্বাকৃতি; দেখিতে বলসম্পন্ন–বর্ণ গৌর—কুঞ্চিত কেশ। দ্বিতীয় ব্যক্তির বয়ক্রম সাতচল্লিশ বৎসর হইবে; দীর্ঘাকৃতি—গঠন বলিষ্ঠ—মুখশ্রী পাপকালিমাঙ্কিত এই ব্যক্তিকেই সঞ্জীববাবু, রামকুমারবাবুর উদ্যানে বৃক্ষচ্ছায়ে পরামর্শ করিতে দেখিয়াছিলেন এবং বন্দী করিয়াছিলেন। অপরজন—বিকটাকার—কৃষ্ণমূৰ্ত্তি—গুণ্ডা বিশেষ।
যুবক বলিল, “কে লোকটা বল দেখি—মহেন্দ্ৰ, গোবা শালা নয়ত?”
মহেন্দ্ৰ বলিল;–”গোবাটা তার মামার বাড়ী গেছে, সে কি আজ আর ফিরেছে! মহীন্দ্ৰনাথ, আর এক পাত্র ঢাল বাবা!”
যুবকের নাম মহীন্দ্রনাথ। বলিল; “দাঁড়াও দাদা—আগে দেখি লোকটা কে।”
এমন সময় হীরুলাল সমভিব্যাহারে সঞ্জীববাবু তথায় প্রবেশিলেন। তাঁহাকে দেখিবামাত্র— মহেন্দ্ৰ কুঞ্চিত ললাট আরও কুঞ্চিত করিল।
সঞ্জীববাবু তাহাকে দেখিবামাত্র চিনিলেন। বুঝিলেন, তিনি স্বীয় গন্তব্য স্থানেই আসিয়া উপস্থিত হইয়াছেন। মৃদু হাসিলেন।
মহীন্দ্র জিজ্ঞাসিল, “মহাশয়ের নাম?”
সঞ্জীববাবু উত্তরিলেন, “শিউপ্রসাদ মল।”
ম। এখানে আসা হয়েছে কেন?
স। একটা খদ্দের-বাড়ীতে যাবার বরাত ছিল; কিন্তু এ রাত্রে এ দুর্যোগ দেখে আর যেতে সাহস করলেম না। কাজেই আপনাদিগের আশ্রয় নিতে হয়েছে।
ম। মহাশয়ের কি ব্যবসা করা হয়?
স। আমার বড়বাজারে সুতার কারবার আছে। ব্যবসাতে বিলক্ষণ অর্থ উপার্জ্জন করেছি সত্য; কিন্তু—এবারে বোধহয় আমাকে সৰ্ব্বস্বান্ত হতে হবে। অফিসের টাকা দিয়ে উঠতে পারছি না— মালও নিতে পারছি না।”
ম। মহাশয়ের কি নেশা টেশা আসে, এই মদ?
স। না—মাপ করবেন।
ম। খেলা টেলা আসে, তাস?
স। না, আমি জানি না।
ম। সে কি! বড়বাজারে থাকেন—আর জানেন না! মিথ্যাকথা। বড়বাজারের প্রায় অনেক স্থানেই জুয়াখেলা হয়। এ কথা কি বিশ্বাস হয়? আপনাকে খেলতেই হবে।”
স। এ মহাশয়দের অন্যায় কথা। আর আপাততঃ আমার কাছে দুখানা গিনি ছাড়া আর কিছুই নাই।
ম। তাই নয় দুহাত খেলুন।
স। তা খেলছি। কিন্তু আর আমায় অনুরোধ করবেন না।
হী। আর আপনাকে অনুরোধই বা করতে যাব কেন? আপনার কাছে ত আর কিছু বেশী নাই। স। আচ্ছা, প্রথমতঃ একখানা গিনি।
একবার—দুইবার—দুইখানি গিনি হারিলেন। তিনবার—চেন্ গাছটী গিনির দশা প্রাপ্ত হইল। সঞ্জীববাবু উঠিয়া দাঁড়াইলেন।
ম। বসুন—কখনই উঠতে পারবেন না—আর এক হাত।
স। আর আমার কাছে কিছু নাই।
ম। না থাকে কাগজে সই করে দিবেন। আর এক হাত খেলুন। হয়ত আপনার চেন গিনি আবার জিতে নিতে পারেন। চেন গিনির যত মূল্য সেই মূল্য অনুসারে বাজী রাখুন–হয় আপনার চেন্ গিনি ফিরিয়ে পাবেন—নয় তার মূল্য সই করে দিবেন; সময় মত আদায় করে নেব
আর এক বাজী—সঞ্জীবাবুর হার হইল। তিন শত টাকার খৎ করিয়া হিন্দীতে জাল্ নাম সহি করিলেন।
আবার মহীন্দ্র পীড়াপীড়ি আরম্ভ করিল। এককালে ছয় শত টাকা। আবার খেলা—সঞ্জীব বাবুর হার—সহি করিয়া দিয়া উঠিয়া দাঁড়াইলেন। বিরক্তির ভাবে বলিলেন, “ঢের হয়েছে যথেষ্ট হয়েছে, আর না।”
মহীন্দ্র বলিল, “সেকি হয়, আর এক হাত
স। (মৌখিক ক্রোধে) না, এখন আমার সে সময় নয়,—যা হবার তা হয়েছে। (হীরুলালের প্রতি) কি মহাশয়, একটা ঘর টর্ দেবেন কি না বলুন?
হীরুলাল হাসিতে হাসিতে বলিল, “আমার সঙ্গে আসুন।”
সঞ্জীববাবু চলিলেন। চণ্ডীমণ্ডপের পার্শ্ব দিয়া একটা সুঁড়ি পথ গিয়াছে, সেই পথ দিয়া চণ্ডীমণ্ডপের পশ্চাদ্দিকে, একটা নাতিবৃহৎ, গোলপাতার ঘর ছিল—সেই ঘরে হীরুলালের সঙ্গে উপস্থিত হইলেন।
হীরুলাল বলিল, “তবে আপনি এই ঘরে থাকুন; কোন ভয়ের কারণ নাই। আমরা নিকটেই আছি, আমি নিজে সারারাত চণ্ডীমণ্ডপে পড়ে থাকি।”
সঞ্জীববাবু কহিলেন, “না, ভয় আর কি তবে আপনারা এ দুর্যোগে যে আশ্রয় দিয়েছেন—এই যথেষ্ট।”
“তবে আমি আসি?” হীরুলাল চলিয়া গেল।
ছদ্মবেশী সঞ্জীববাবু এতক্ষণ ছদ্মভাষে (হিন্দী) কথা কহিতেছিলেন।
চতুর্থ পরিচ্ছেদ – ষড়যন্ত্র
মহীন্দ্রকে মহেন্দ্রনাথ, হীরুলাল ফিরিয়া আসিলে, বলিল, –
“কে জান?”
মহী। না। কে?
ম। কিছুই বুঝতে পারনি? তোমার ও মাড়ওয়ারী নয়।
মহী। কে তবে, চেন কি?
ম। চিনি বৈকি—খুব চিনি। এখন এককাজ করতে হবে। বেটা যে ঘরে শুয়েছে, সেই ঘরের শিল্পী বন্ধ করে চালাখানায় আগুন দিয়ে দাও।
মহী। তাতে হবে কি? খতের টাকাগুলো মারা যাবে।
ম। খৎ! ও তোমার নাকে খৎ। সব মিছিমিছি; গিনি গিল্টি করা, চেইন গিল্টি করা।”
মহী। (সবিস্ময়ে) সত্যি নাকি!
হীরু। কই দেখি।
তখন সকলে মিলিয়া সঞ্জীববাবুর পণের গিনি ও চেইন পরীক্ষা করিয়া দেখিতে লাগিল। মহেন্দ্রনাথের কথাই ঠিক।
মহী। তাইত হে! (উদ্দেশে) বেটা, আমাদের কাছে ওড়নঘাই!
ম। এখন দেরি করবার সময় নয়। শালাকে পুড়িয়ে মার।
হী। তা কি হয়; অত বড় ঘরখানা কি জ্বালিয়ে দেওয়া যায়।
মহী। তা’ত ঠিক কথা, ও ঘরখানা আমাদের কত দরকারে আসে।
ম। ঘর রাখিতে গেলে—প্রাণ যাবে, বলে দিলেম।
মহী। তোমার হেঁয়ালি ছাড় না, দাদা; পষ্ট করে, ভেঙে চুরে সব বল।
ম। ও একজন সাধারণ লোক নয়।
মহী। কে? যেই হোক, এখানে কাকেও ভয় করি না।
ম। গোয়েন্দা।
হীরু ও মহী। (সবিস্ময়ে) অ্যা, অ্যা! গোয়েন্দা! কি করে জালে তুমি?”
ম। সেদিন বেটা আমাকে মেরেই ফেলেছিল। বেটার গায়েও বিলক্ষণ ক্ষমতা আছে, তা আমি এক দিনেই জেনে নিয়েছি। ভারী ধড়ীবাজ। সে দিন তোকে (হীরুর প্রতি) কি করেছিল জানিনি? শেষে বেটা তোর মত কথা কয়ে, আমাদের ভয় দেখিয়ে, সরিয়ে দিলে; আমাদের কাজে গাফিলি হয়ে গেল। শালা ভারি তোখড়। আমি জানি ও যেকালে পিছু নিয়েছে আর আমাদের নিস্তার নেই।
হী। ক্ষতি কি আমরা চারজন আছি।
ম। আমাদের মত আট জন হলেও কিছু করতে পারবে না।
মহী। এখন কী করা যায়?
ম। যা বল্লুম, বেটাকে ঘরে বন্ধ করে ঘর শুদ্ধ জ্বালিয়ে দাও। মহী। সে কি হয়?
ম। তবে যা হয় তুমি কর।
মহী। বেটা ঘুমুলে বুকে ছুরি বসাবো।
ম। (হাস্য)
মহী। হাসছো যে? পারি কি না—দেখে নিও
ম। কি বোকা তুমি! একেই বলে নিরেট বোকা। ওকি আমাদের এখানে ঘুমাবার জন্যে এসেছে নাকি?
মহী। হ্যাঁ—তা ঠিক্ তো—তবে কি করি। অন্য উপায় বল।
হী। আচ্ছা—একটা পরামর্শই স্থির কর না। এত ব্যস্ত হ’য়ে পড়লে কি হবে?
পঞ্চম পরিচ্ছেদ – গুপ্ত-গৃহে
সঞ্জীববাবু এতক্ষণ চুপ করিয়া বসিয়াছিলেন না। হীরুলালের প্রস্থানের পরক্ষণেই তিনি কুটীরমধ্যে হইতে বহির্গত হইলেন। উত্তরদিকে কিঞ্চিৎ অগ্রসর হইয়া দেখিলেন, একটা ভাঙ্গা সোপান ঊর্দ্ধমুখে উঠিয়াছে; ইহা দ্বারা উপরতলে উঠা যায় অনুমান করিয়া—উঠিতে লাগিলেন। একটী কক্ষসম্মুখে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। কবাট চাপা ছিল। নিঃশব্দে খুলিলেন। গৃহমধ্যে প্রবেশ করিয়া হস্তস্থিত লণ্ঠনের আবরণ উন্মোচন করিলেন। দেখিলেন—সেটী কাহার শয়নগৃহ। একপার্শ্বে একটী অর্দ্ধ-মলিনশয্যা। অপরপার্শ্বে একখানা টেবিল ও তদুপরি একখানা বৃহদাকার—দুই. একস্থান ফাটা—অতি-পুরাতন দর্পণ। সে দিকে আলোকগতি ফিরাইবামাত্র সঞ্জীববাবু চমকিত এবং শিহরিত হইলেন। দেখিলেন, মেজের উপরে একখানি বেগুনী রঙ্গের নূতন বারাণসীসাটী আর একটা সবুজ মখমলে প্রস্তত সম্মাচুকীর কাজকরা জ্যাকেট। তিনি তন্মুহূর্ত্তেই প্রকৃতিস্থ হইয়া সেগুলি উল্টাইয়া পাল্টাইয়া দেখিতে লাগিলেন। যাহা দেখিলেন তাহাতে তাঁহার দৃঢ়তা দূর হইল। সাটী ও জ্যাকেটের স্থানে স্থানে রক্তের দাগ। জ্যাকেটের বক্ষস্থলের এক অংশ দীর্ণ—বোধ হয় ছুরি প্রবিষ্ট হইয়াছিল। বুঝিলেন, এ বিবাহের পোষাক বিমলার। বিমলা মরিয়াছে। তাঁহার সকল উদ্যম এখন ব্যর্থ হইল। দেবিদাসকে মিথ্যা প্রবোধ দিয়াছেন। তাঁহাকে শুধু নয়, রামকুমারবাবুকে পর্য্যন্ত তিনি মিথ্যা- আশ্বাসে, ক্ষুদ্র সান্ত্বনার কথা বলিয়া নিশ্চিন্ত রাখিয়াছেন। সহসা তাঁহার মনে উদয় হইল, যদি এই পোষাক বিমলার হয়—তবে বিমলার মৃতদেহ এই স্থানে থাকা নিতান্ত সম্ভব—সে অনুসন্ধান এখনই করা কর্তব্য।
এই ভাবিয়া তিনি যেমন সেই সাটী ও জ্যাকেট মেজের উপর রাখিতে যাইবেন, দৰ্পণমধ্যে দেখিলেন, এক নিরুপমা রমণীমূর্ত্তি প্রতিবিম্বিত হইয়া তন্মুহূর্ত্তে বিলীন হইয়া গেল। ছায়া সরিয়া গেল। কিন্তু, সেই নিমেষ মাত্র সময়ের মধ্যেও সঞ্জীববাবু সেই প্রতিবিম্ব চিনিলেন। আর কাহারই নহে-পরিমলের। আবার ভাবিলেন, হয় ত এ তাঁহার নিজের মনের অলীক খেয়াল মাত্র।
লন্ঠনের আলোক ঢাকিয়া তিনি তথা হইতে বাহিরে আসিতেছেন, এমন সময় তাঁহার সম্মুখ দিয়া—একটী রমণী বিদ্যুদ্বেগে ছুটিয়া চলিয়া গেল। তাহার দ্রুতগতি-বিক্ষিপ্ত বায়ু সঞ্জীববাবুর গাত্রস্পর্শ করিল। এই রমণীই কি সেই ছায়ার কায়া? পরিমল? সঞ্জীববাবু মনে করিতে লাগিলেন, পরিমল কি করে এখানে আসিল? আমি তাহাকে এইমাত্র রামকুমারবাবুর বাটীতে দেখে আছি— সে কি প্রকারে আমার অগ্রে, সামান্য বালিকা হইয়া, এখানে আসিয়া উপস্থিত হইল? কখনই পরিমল নয়। পরিমলই বা নয় কেন? তবে আমার চোখ দুটা চোখ নয়, এটা বুঝিতে হয়।
সঞ্জীববাবু তথা হইতে বহির্গত হইয়া কিয়দ্দূর অগ্রসর হইলেন। সহসা তাঁহার পদতলে কি ঠেকিল, তিনি আলোকের আবরণ খুলিয়া দেখিলেন, শুষ্ক রক্তের দাগ ক্রমাগত একদিকে চলিয়া গিয়াছে। তিনি হস্তস্থিত আলোকটী আবৃত করিয়া পার্শ্বদেশ একটু মাত্র উদ্ঘাটিত রাখিয়া – সেই অস্পষ্ট আলোকে রক্তচিহ্ন লক্ষ্য করিয়া পশ্চিমাস্যে চলিলেন। কিয়দ্দূর গমনান্তর দেখিলেন— রক্তচিহ্নের সীমা একটি চাবিবন্ধ দ্বার পর্য্যন্ত। তিনি বিনা চাবি দ্বারা তালা খুলিবার বহুবিধ কৌশল জানিতেন—তালা খুলিয়া ফেলিতে বিশেষ বিলম্ব হইল না।
সেই গৃহদ্বার উন্মোচনে দেখিতে পাইলেন, ভিতরে একটী সোপান ক্রমশঃ নিম্নে চলিয়া গিয়াছে। সোপানাবতরণ করিতে লাগিলেন। মধ্যে দুই একবার পদভ্রষ্ট হইলেন; ক্রমে অন্ধকারময় গৃহতলে অসিয়া উপস্থিত হইলেন।
গৃহস্থ বদ্ধবায়ু দুর্গন্ধে পূর্ণ; বোধ হইল, নিকটেই কোন শবদেহ পচিয়া পড়িয়া আছে। লণ্ঠনের কৌশলাবরণ মুক্ত করিলেন। কেন্দ্রীভূত উজ্জ্বল আলোকে ঘরটা আলোকিত হইয়া উঠিল।
সঞ্জীববাবু গৃহতলের চারিদিক অনুসন্ধান করিয়া দেখিতে লাগিলেন; কোথায় কিছু দেখিতে পাইলেন না; কেবল মনুষ্যের নির্ম্মাংস কঙ্কালরাশি ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত রহিয়াছে; এ দুর্গন্ধের মূলবস্তু নাই।
একপার্শ্বে একটী দেবদারুকাষ্ঠের বড় সিন্দুর ছিল। সেটার নিকটস্থ হইবামাত্র দুর্গন্ধের পরিমাণ কিছু বাড়িল বলিয়া বোধ হইল। সেই সিন্দুকের ফাটলে নাসিকা দিইবা মাত্র আর কোন সন্দেহ রহিল না। সিন্দুকের ডালা তুলিয়া ফেলিলেন। দেখিলেন, অতি ভয়ানক ভীতিপ্রদ দৃশ্য—একটী সুন্দর রমণীর মৃতদেহ তন্মধ্যে পড়িয়া, পচিয়া, ফুলিয়া উঠিয়াছে। একরাশ কেশে মৃতার মুখমণ্ডল আচ্ছাদিত।
তখন এত দুর্গন্ধ বাহির হইল যে সে গৃহে এক পল অবস্থান করা মনুষ্যের সাধ্যাতীত। সঞ্জীববাবু আপন নাসিকা রুমাল দ্বারা মাথার উপর দিয়া ঘুরাইয়া বাঁধিয়া—সেই মৃতদেহ পৰ্য্যবেক্ষণ করিতে লাগিলেন।
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ – “বুলবুলের সাধ্য কি বটফল গেলা?”
এদিকে মহীন্দ্র ও তৎসহচরগণ বিপদ বুঝিয়া অস্থির হইতেছে। সকলে মিলিয়া নানাবিধ উপায় নিরূপণ করিতেছে; কিন্তু কোনটাতে মঙ্গলের চিহ্ন দেখিতে পাইতেছে না। যত বিলম্ব ঘটিতেছে, ততই তাহারাও শঙ্কিত ও অধৈর্য্য হইতেছে।
এমন সময়ে তথায় দ্রুতপদ সঞ্চালনে এক রমণী প্রবেশ করিল। তাহার ওষ্ঠদ্বয় আশঙ্কাকম্পিত।
মহীন্দ্র তাহাকে জিজ্ঞাসা করিল, “ব্যাপার কি?”
রমণী বলিল, “সর্বনাশ! গোয়েন্দা আমাদের পিছু নিয়েছে।”
মহীন্দ্র বলিল, “কে,—জান তুমি?”
র। খুব জানি—সঞ্জীব।
মহে। আর কোন উপায় নাই—যা হবার তা হয়েছে। এত দিনের পরিশ্রম আজ বিফল হল।
ম। বিফল হবে কি?
মহে। কিছুই না। কিছু পরে জানতে পারবে। সঞ্জীব সহজ লোক নয়—ও বেটার হাড়ে ভেল্কী লাগে।
ম। তুমি বেশ জান যে ওর নাম সঞ্জীব?
মহে। নিশ্চয়। আর আমি যদি না ঠিক জানি, সে নিজেই খানিকপরে জানাবে সে সঞ্জীব কি না, কোন সন্দেহ নাই।
ম। বেশ ত, বেটাকে মেরে ফেলা যাক্। বেটার বেশী বিক্রমটা এখন থেকেই ঘুঁচে যাক্।
মহে। মুখের কথা নয়—কাজে করাই ভাল।
ম। এ পর্য্যন্ত যে যে এ বাড়ীতে এসেছে, কেউ জ্যান্ত ফিরে যায় নাই; একথা কি ভুলে গেছ নাকি?
মহে। এইবার এই লোক সে নিয়ম রদ্ করবে। এ বাড়ীতে থেকে প্রাণ নিয়ে যাওয়া সম্বন্ধে এই ব্যক্তি প্রথম হবে।
ম। আমরা চার পাঁচ জন আছি; ভয়ের কারণটা কি এত?
মহে। তার কাছে একজন যেমন, পাঁচজনও তেমন।
ম। তুমি কি ভয় খাচ্ছ?
মহে। না, কিছু মাত্র না; কি করবে কর। ভয় কি?
ম। (রমণীর প্রতি) তুমি তাকে কোথায় দেখলে?
র। আমার নিজের ঘরে।
ম। তুমি তখন কোথায় ছিলে?
র। আমি পাশের ঘরে ছিলেম।
ম। সে তোমার ঘরে ঢুকে কি করছিল?
র। সন্ধান নিচ্ছিল।
ম। কিছু সন্ধান পেয়েছে?
র। বিয়ের রক্ত মাখা কাপড় জামাগুলো।
মহীন্দ্রনাথ আপন পিস্তল বাহির করিল। বলিল,–-“যা দেখেছ, তা তার প্রাণের সঙ্গেই লোপ করবো। এখন কি, সে তোমার ঘরের মধ্যে আছে?”
রমণী বলিল, “না। ঘর থেকে বেরিয়ে রক্তের দাগগুলো দেখতে দেখতে পশ্চিমদিকে যাচ্ছে।”
এই কথা শুনিবামাত্র সকলেই শঙ্কিত হইল। উঠিয়া দাঁড়াইল। এক একটা পিস্তল লইল। রমণী তাহাদিগের মুখপানে চাহিয়া বুঝিল, তাহারা এখনি এক ভীষণকার্য্যে প্রবৃত্ত হইবে। তথা হইতে প্রস্থান করিল।
মহেন্দ্রলাল বলিল, “এখনিই সৰ্ব্বনাশ হবে। বেটাকে যেমন করেই হক্ মেরে ফেলতেই হবে।”
সকলে বলিল, “ধরই না, বেটা মরেছে।”
মহে। যা করবার শীঘ্র কর; সময় নষ্ট করলে চলবে না।
হী। বেটাকে না কায়দা করতে পারলে, কিছুতেই কিছু হবে না; এক মহা হাঙ্গামা উপস্থিত হবেই।
ম। সে একলা যাই করুক—পরিত্রাণ নাই।
হী। এখন কোনখানে তাকে ধরা যায় বল দেখি?
ম। যেখানে তার চিতাশয্যা হবে—সেইখানে।
সপ্তম পরিচ্ছেদ – “উত্তুরে লোক পরিপাটী। দেখে লাগে দাঁতকপাটী।”
সকলে সশস্ত্র। দস্যুদল একত্রে মিলিয়া সঞ্জীববাবুর অনুসরণে অগ্রসর হইল। দেখিতে পাইল, তাহাদিগের গুপ্তগৃহে আলোক জ্বলিতেছে।
যখন সঞ্জীববাবু মৃতা রমণী কে তাহা জানিবার জন্য যেমন তাহার মুখে আলোক ধরিলেন, তখন সকলে সেই গৃহদ্বারে উপস্থিত হইল। মহীন্দ্র তদ্দণ্ডে বন্দুক ছুড়িল। মহীন্দ্র যেরূপ ভাবিয়াছিল, ঠিক তাহা ঘটিল না। মনে করিয়াছিল আলোকধারীকে নিহত করিবে; কিন্তু বন্দুকের গুলি আলোকধারীর আলোক নির্ব্বাপিত করিল মাত্র; লন্ঠান চুর্ণ হইল। দুরীভূত আঁধার গৃহমধ্যে পুনঃ অধিকার লাভ করিল। সঞ্জীববাবু বুঝিলেন, দস্যুরা তাঁহাকে আক্রমণ করিতে আসিয়াছে; এখনই জীবন-মৃত্যুর সংগ্রাভিনয় আরম্ভ হইবে; মাথা হেট করিয়া গৃহতলে বসিয়া পড়িলেন।
মহীন্দ্র, মহেন্দ্রনাথকে বলিল, “তুমি এই সিঁড়ির উপরে দাঁড়াও; যে কেহ তোমার কাছে আসবে তার বুকে ছুরি বসাবে। এইবার আমাদের কার্য্য সিদ্ধ হবে; বেটাকে ত ধরেছি—বেটা ত জালে পড়েছে।” অপর সঙ্গীদিগকে বলিল, “এ ঘরটা বড়; সহজে ওকে ধরা যাবে না। তিনজনে তিনদিক দিয়ে বেটাকে ঘিরে ফেলি এস, আমি মাঝে থাকি; তোমরা দুই পাশে থাক— ছুরি বাগিয়ে নাও।”
আদেশমত কাৰ্য্য হইল। সঞ্জীববাবু দেখিলেন, ভয়ানক বিপদে তিনি পড়িয়াছেন; কাহার নিকট তিলপরিমাণ কৃপা পাইবার সম্ভাবনা নাই—কেহ করিবেও না। আমরা পূর্ব্বেই বলিয়াছি, তিনি সকল প্রকার শব্দ অনুকরণ করিতে পারিতেন, আরও তাঁহার এরূপ ক্ষমতা ছিল, তিনি নিকটে থাকিয়া এরূপ স্বরে কথা কহিতেন যেন অনেক দূর হইতে সে স্বর আসিতেছে বলিয়া বোধ হইত। তিনি সেই গৃহের দক্ষিণ কোণ হইতে মহীন্দ্রনাথের স্বর অনুকরণ করিয়া—যেন বহুদূর হইতে উচ্চারিত হইতেছে, কহিলেন,–”হীরু—এদিকে—এদিকে।” গৃহের বাম দিকে সরিয়া গেলেন। কোন উত্তর নাই; কেবল পদ শব্দ।
এমন সময়ে তিনি আর এক ফিকির খেলিলেন; যেন যোঝাবুঝি হইতেছে, এইটুকু দেখাইবার জন্য নিজের পিস্তল ও ছুরি লইয়া পরস্পরে ক্রমান্বয়ে আঘাত করিতে ও গ্যাঙানি শব্দ করিতে লাগিলেন। বুঝিলেন, তাঁহার ফিকির সফল হইয়াছে। সকলেই সেই দিকে অগ্রসর হইতেছে।
সঞ্জীববাবু গৃহটী পূর্ব্বে তন্নতন্ন করিয়া দেখিয়া লইয়াছিলেন। বিরোধীদিগকে অগ্রসর হইতে দেখিয়া, তিনি নির্বিঘ্নে, নিঃশব্দে অথচ দ্রুত, সোপানের উপর আসিয়া উপস্থিত হইলেন। সোপান শ্রেণীর উপরিভাগে মহেন্দ্রনাথ দণ্ডায়মান ছিল। তিনি তাহাকে আপন পিস্তলের নল দ্বারা বুকে আঘাত করিলেন। মহেন্দ্রনাথ গৃহতলে সশব্দে নিপতিত হইল, সঞ্জীববাবু উপরে আসিলেন।
আমাদিগের এই বর্ণিত অধ্যায়ের এই পর্য্যন্ত পাঠ করিতে পাঠক মহাশয়ের যত সময় ব্যয় হইয়াছে তাহার শতাংশের এক অংশ সময়ের মধ্যে সমস্ত ঘটনা সম্পন্ন হইয়াছিল।
মহেন্দ্রনাথের পতনশব্দে সকলে চমকিত হইল। ফিরিল। মহেন্দ্রনাথ কেবল গোঁ গোঁ শব্দ করিতেছিল; কেহ তাহাকে অন্ধকারে চিনিতে পারিল না; গোয়েন্দা বলিয়া সন্দেহ জন্মিল। সকলে তাহাকেই চাপিয়া ধরিল। মহীন্দ্র আলো আনিতে ছুটিল; যাইবার সময় বলিয়া গেল, “বেশ করে চেপে ধর—আঘাত করো না; আমি আগে একটা আলো আনি।”
যেমন মহীন্দ্রনাথ সোপানাতিক্রম করিয়া উপরে উঠিয়াছে; সঞ্জীববাবু তাহাকে সজোরে ধাক্কা মারিলেন; কাতরোক্তি করিয়া মহীন্দ্র সোপানতলে নিপতিত হইল।
অনেক ব্যক্তি এরূপ বিপদে, পরিত্রাণ পাইলে আপনার সৌভাগ্য বিবেচনা করিয়া পলাইত; কিন্তু সঞ্জীববাবু সে প্রকৃতির লোক নহেন। তাঁহার উদ্যম, সাহস, দৃঢ়তা প্রাণের ভয় দুর করিয়াছিল। তিনি তাহাদিগকে শুনাইয়া সজোরে পদ শব্দ করিতে করিতে, উপর ছাদে উঠিতে লাগিলেন। কিয়দ্দূর অগ্রসর হইয়া সহসা থামিলেন। শুনিতে পাইলেন;–
মহীন্দ্রনাথের উক্তি, “অ্যাঁ! আমরা এতগুলো! ফাঁকি দিলে বেটা; দস্তুরমত ফাঁকি দিয়েছে! বেটা উপরে উঠছে; চল, এবারে একটা মশাল জ্বেলে বেটাকে পুড়িয়ে মারি—অন্ধকারে বেটার কিছুই করতে পারবো না।”
হীরুলালের উক্তি, “আমি সেই প্রদীপটা চণ্ডীমণ্ডপ থেকে নিয়ে আছি—তখনই নিয়ে এলে এত কাণ্ড হত না।’
হীরুলাল চলিয়া গেল। সকলে বাহিরে আসিল। সঞ্জীববাবু মৃদু হাসিলেন। অল্পক্ষণ পরেই হীরুলাল আলো হস্তে আসিয়া উপস্থিত। যেমন প্রদীপটা মহীন্দ্রনাথের হস্তে দিতে যাইবে— সঞ্জীববাবু দেয়াল হইতে একটা বড় ইট্ খসাইয়া প্রদীপের উপর নিক্ষেপ করিলেন। প্রদীপ চূর্ণ বিচূর্ণ; ঘোর অন্ধকার হইল।
মহীন্দ্রনাথ বলিল, “দূর হোক্—বেটা ভারি তোখড়—থাক্ আলো থাক্—অন্ধকারে কাজ সারবো।”
সঞ্জীববাবু উপর তলের সোপান হইতে শব্দ করিয়া জানাইলেন, যে তিনি তাদের অপেক্ষায় দণ্ডায়মান।
সকলেই তাহার নির্ভীকতায় আশ্চৰ্য্যান্বিত হইল। মহীন্দ্রনাথ বলিল, “মানুষ—না, কি? এমন আমি কখন দেখিনি, যে চারজন পাঁচজন সশস্ত্র ব্যক্তির সম্মুখে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে। আচ্ছা- তোমরা সকলে ঠিক হয়ে থাক—আমি বেটাকে একলা ধরবো। এ নিশ্চয় জেন—যত বড়ই বীর হোক—যতই ক্ষমতা ওর থাকুক্—কখন ফিরিবে না—এ বাড়ী থেকে কখনই ফিরে যেতে পারবে না।”
অষ্টম পরিচ্ছেদ – “যে দিকে জল পড়ে, সেই দিকে ছাতি ধরে।”
সকলে মিলিয়া ছাদে উঠিতে লাগিল। সঞ্জীববাবুর নিকট তাহা অজ্ঞাত রহিল না। তিনি সেই সোপানের চিলের ছাদের এককোণে লুক্কায়িত রহিলেন। একে একে দস্যুগণ সকলেই তাঁহাকে অতিক্রম করিয়া ছাদে প্রবেশিল। তাহারা ছাদের অপর পার্শ্বে গমন করিলে তিনি তথাকার দ্বার ধীরে ধীরে নিঃশব্দে বন্ধ করিয়া নীচে নামিয়া আসিলেন।
অদ্য যদি তিনি সেই মৃহদেহের যথার্থ তত্ত্বানুসন্ধান না করিতে পারেন—তাহা হইলে তাঁহার এত পরিশ্রমই বৃথা। বিশেষতঃ কিছুক্ষণ পরে যে তাহা স্থানান্তরিত করা হইবে, তাহার সন্দেহ নাই— এই ভাবিয়া তিনি নির্ভয় চিত্তে যে গৃহে এতক্ষণে তুমুল বিপ্লব চলিতেছিল—তথায় পুনঃ প্রবেশ করিলেন। নিকটে দিয়াশালাই ছিল, পূর্ব্বোক্ত ভগ্নপ্রদীপের পলিতা লইয়া প্রজ্জ্বলিত করিলেন।
যে সিন্দুকে শব ছিল, তাহার আচ্ছাদনী উত্তোলন করিয়া দেখিলেন, শবদেহটী কোন নিরুপমা সুন্দরী বালিকার। অধিকদিনের মৃতদেহ বলিয়া—সহজে চিনিবার কোন উপায় নাই; স্থানে স্থানে সম্পূর্ণ বিকৃত হইয়াছে। সঞ্জীববাবু কখন বিমলাকে দেখেন নাই—কেবল পূৰ্ব্বোক্ত তৈল-চিত্ৰ দৰ্শনে বিমলার আকৃতি কিছু পরিমাণে হৃদয়ঙ্গম করিয়া লইয়াছিলেন মাত্র। তিনি সেই মৃতদেহ উল্টাইয়া পাল্টাইয়া দেখিতে লাগিলেন। যাহা দেখিলেন—স্তম্ভিত হইলেন—শব হইতে একটী হস্ত ছেদন করিয়া লওয়া হইয়াছে। ভাবিলেন, হয় ত এই শব বিমলার হইবে–কিন্তু বিমলার কি না—তাহা কিরূপে ঠিক করিব—একবার রামকুমারবাবুকে আনিয়া দেখাইতে পারি—তাহা হইলে ইহার মীমাংসা হয়।
দূর হইতে শুনিতে পাইলেন, “অ্যা—আবার ফাঁকি—বেটা দরজা বন্ধ করে নেবে গেছে—”
“বেটা ভূতগোয়েন্দা না হলে কার বাবার সাধ্যি এ জঙ্গলের ভিতর এসে এত কারখানা করে।”
“আয়—দেখি—বেটা কোথায় পালাল—এদিককার সিঁড়িটা দিয়ে নামিগে চল্।”
সঞ্জীববাবু সহজেই ৰুঝিলেন, পাষণ্ডেরা আবার নীচে আসিতেছে। তিনি আর কোন সুবিধা না বুঝিয়া বাহিরে আসিলেন। শুনিতে পাইলেন—উত্তরদিক হইতে কোন রমণীর অস্ফুট ক্রন্দনধ্বনি আসিতেছে। স্থিরকর্ণে কিয়ৎক্ষণ শুনিলেন। সেই শব্দ লক্ষ্য করিয়া সেই দিকে খানিকটা অগ্রসর হইলেন; এমন সময় ষড়যন্ত্রকারীদিগের পদধ্বনি শ্রুত হইল। বাটী ত্যাগ করিয়া জঙ্গলে আসিলেন। কাপড়ের বুচকী নামাইয়া, ছদ্মবেশ ত্যাগ করিয়া নিজের বেশ ধারণ করিলেন।
রামকুমারবাবুর বাটী অভিমুখে সঞ্জীববাবু চলিলেন। বহু পরিশ্রমে নিতান্ত ক্লান্ত হইয়াছিলেন। বৈঠকখানা গৃহে উপস্থিত হইয়া নিদ্রিত হইবার নিমিত্ত শয়ন করিলেন। দুই একটী চিন্তা আসিয়া মনোমধ্যে উদিত হইল। চিন্তা সমাপ্ত হইতে না হইতে—নিদ্রা যাইবার পূর্ব্বে বায়সকুল স্ব স্ব নীড় হইতে চিৎকার করিয়া ডাকিয়া উঠিল।
নবম পরিচ্ছেদ – শেষ রাত্রে
শয্যা ত্যাগ করিয়া সঞ্জীববাবু উদ্যানাভিমুখে চলিলেন। দেখিলেন, পরিমল যাইতেছে। সম্মুখীন হইলেন। সঞ্জীববাবুকে দেখিয়া পরিমল স্থির হইয়া দাঁড়াইল, সঞ্জীববাবুকে দেখিয়া কিছুমাত্র ভীত হইল না–আশঙ্কার কোন চিহ্ন তাহার মুখমণ্ডলে প্রকটিত হইল না।
সঞ্জীববাবু জিজ্ঞাসিলেন, “পরিমল, এরি মধ্যে তুমি ফিরে এসেছ—আশ্চৰ্য্য!”
পরিমল তাঁহার কথায় ঈষদ্বিরক্ত হইল। তাহার কপোলদ্বয় ক্রোধে ঈষল্লোহিতরাগে রঞ্জিত হইল। বলিল, “মহাশয়, আপনি কি পাগল হয়েছেন নাকি—এ সকল আপনার কি কথা? কোন রীতিতে আপনি আমাকে এমন কথা বলেন?”
স। (সহাস্যে) না, আমি এমন কিছু অন্যায়—কি মিথ্যা কথা বলি নাই, বটে; তবে, তুমিও জান—আর আমি জানি—তুমি এইমাত্র কোন গুপ্তস্থান হতে ফিরে আসছো।
প। কোথা থেকে ফিরে-
স। (বাধা দিয়া) তুমি ত জান—আমাকে কিছুক্ষণ পূর্ব্বে কি তুমি দেখ নাই?
তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাহার মুখপানে চাহিলেন।
প। মহাশয়ের কাছে—তবে অনেকক্ষণটা কিছুক্ষণ হয়ে পড়েছে।
স। তুমি বড় চতুরা; কিন্তু এ চাতুরী বড় বেশীক্ষণ সঞ্জীবের কাছে খাবে না—এটা স্থির জেন; তোমার চেয়ে তুমি আমাকে সহজ বোধ করো না।
প। আপনি কি আমায় ভয় দেখাতে এসেছেন? যদি আমার কোন দোষ থাকতো—দোষী হতেম্—তবে আপনাকে ভয় করতেম্। আমি আপনাকে একতিল ভয় করি না—তার কোন কারণও নাই। কিন্তু ভয় করা দুরে থাকুক—আপনার কথায় আপনাকে পাগল কি নিতান্ত নির্বুদ্ধি বলে আমার বোধ হচ্ছে। আপনি যে মাঝে মাঝে—মাথা মুণ্ড নেই এমন সব কথা তুলেন্—তার মানে কি?
স। তার মানে কি শীঘ্র তোমাকে ব্যাথ্যা করে দিব।
প। আপনি আমাকে কিছুক্ষণ পূর্ব্বে কোথায় দেখেছিলেন?
স। চণ্ডীতলার বনের মধ্যে এক ভাঙ্গা বাড়ীতে।
প। আমাকে দেখেছেন আপনি? সত্য বলুন।
স। আমি স্বচক্ষে তোমাকে দেখেছি। তোমার কথায় বিশ্বাস করতে হলে আমার নিজের চোখকে অবিশ্বাস করতে হয়।
প। শুনুন, আপনি বিশ্বাস করুন আর অবিশ্বাস করুন,—আমি ঈশ্বর সাক্ষী করে আপনাকে বলছি—আমি, অদ্য কি কখনও কোন রাত্রে একা বাড়ীর বার হই নাই। চণ্ডীতলার বনের ভাঙ্গাবাড়ীর নাম এ পৰ্য্যন্ত শুনি নাই—এই আপনার মুখে নূতন শুন্লেম
সঞ্জীববাবু বিস্মিত হইলেন।
দশম পরিচ্ছেদ – দারুণ সন্দেহ
পরিমলের প্রতিজ্ঞা সঞ্জীববাবু বিশ্বাস করিতে পারিলেন না; তিনি স্বচক্ষে যাহা দেখিয়াছেন তাহা কি প্রকারে মিথ্যা হইবে? কিন্তু তাহার মুখ দেখিয়া অনুভব করিলেন—তাহার কথা সত্য। কহিলেন, “পরিমল, সত্য বলছো যে তুমি আজ রাত্রে বাটীর বার হও নাই?”
প। না, মহাশয়!
স। আচ্ছা। যারা তোমার মামাবাবুকে খুন করতে এসেছিল, তুমি যাদের জানালা থেকে বাড়ীর ভিতরকার পথ দেখিয়ে দিয়েছিলে, তারা কে?
প। মিথ্যা কথা—আমি তাদের কখন দেখিনি—চিনি না—জানি না, কাকেও বাড়ীর মধ্যে আনি নাই।
“সকলই আশ্চৰ্য্য! তুমি ভিন্ন আর কে হবে? দুইবার তোমাকে আমি স্বচক্ষে দেখেছি; দুইবার তুমি অস্বীকার করলে; তুমি যদি না হও তবে আমি যাকে দেখেছি তাকে প্রেতিনি বুঝতে হবে কেমন কি না?”
“যা বিবেচনা করেন।”
“আর কি বিবেচনা হতে পারে? তবে এইটেই বেশী সত্য বলে বোধ হয়—যে তুমি বিমলার মৃত্যুর সকল বিষয় জেনেও গোপন করছো।”
(সদুঃখে) “ও কথা আপনি বলতে পারেন। বিমলা যদি প্রাণ পায়—আমি নিজের প্রাণ তার জন্য দিতে পারি। বিমলাকে আমি কত ভালবাসি-আপনি তার কি বুঝবেন? মহাশয়, আপনার কথায় আপনাকে সহজ বোধ হয় না। আপনি নিশ্চয় সকলই জানেন—এখন কেবল ছলনাদ্বারা- সব ঢেকে ফেলতে চান্। আপনি গোয়েন্দা বটে কিন্তু—পুলিসের নয়—ষড়যন্ত্রকারীদের।”
“একি উল্টা চাপ নাকি?”
“আপনার কার্য্যেও সেইরূপই বোধ হয়। আপনি এ পর্য্যন্ত কিছুই করতে পারলেন না। আমিই কেবল চোরদায়ে ধরা পড়েছি।”
“পরিমল, আমার একটা দিনও বৃথা যায় নি। এর মধ্যে এ গূঢ় ব্যাপার যতদুর আবিষ্কার হতে পারে—তার বেশী আমি করেছি।”
“কি করেছেন?”
“তুমি এ ষড়যন্ত্রের মধ্যে নিশ্চয়ই আছ; আমি তার অনেক প্রমাণ পেয়েছি।”
দৃঢ়স্বরে নিষ্পলকনেত্রে পরিমল বলিল, “কি কি প্রমাণ পেয়েছেন?”
সঞ্জীববাবু তখন সকল কথাই বলিলেন। সেই রক্তাক্ত রুমালের কথাও তুলিলেন।
প। মহাশয়, এর ভিতর অনেক রহস্য আছে। আপনার কথায় আমি কোন মতে বিশ্বাস করতে পারছি না। আমাকে আপনি কখন দেখেন নাই—নিশ্চয়ই দেখেন নাই। আপনি রুমালের কথা কি তুলছেন?
স। আমার নিকটেই আছে, দেখতে পার। (রুমাল প্রদান)
প। একি—এ যে রক্তে মাখামাখি! এ আপনি আমার হাতে দিলেন কেন?
স। দেখবে বলে। যেমন তুমি ফেলে এসেছ, তেমনিই আছে—ও রক্তের দাগ আমি লাগাই নাই। যার রুমাল সেই
প। (বাধা দিয়া) কার?
স। তোমার। ঐ কোণে তোমার নামের চার ভাগের তিন ভাগ এখনও দেখা যাচ্ছে, দেখতে পার। বেশী তর্ক করতে হবে না।
প। অ্যা তাইত—একি—এ সকল আর কিছু নয়—আমাকে বিপদে ফেলার মন্ত্রণা। (উদ্দেশ্য) হা মা কালি! তুমি জান, আমি দোষী কি নিৰ্দ্দোষী। তুমি মা বিচার করো—তুমি জান— বিমলাকে আমি কত ভালবাসতেম্—তার জন্যে আমার বুকের ভিতর কি যন্ত্রণা হচ্ছে?
স। তবে এ রুমালও তোমার নয়?
প। (ক্রোধে) না, যদি এ রুমাল আমার হয়—পরমেশ্বর যেন এইক্ষণে আমার মস্তকে বজ্রাঘাত করেন।
সঞ্জীববাবু কিয়ৎক্ষণ কি চিন্তা করিয়া কহিলেন, “পরিমল, তোমার কি যমজ ভগ্নি আছে?”
“না?”
“কোন আত্মীয় স্ত্রীলোক-যার সঙ্গে তোমার চেহারার কিছু সাদৃশ্য আছে?”
“কেউ নাই।”
“এ রহস্য বড় সহজ নয়—অতি গভীর। যাই হোক—আমি সমস্ত না দেখে ছাড়ছি না। তুমি কি আমাকে কোন বিষয়ে এক্ষণে সাহায্য করবে?”
“যা—আদেশ করেন বলুন। বিমলার জন্য প্রাণ দিতে প্রস্তুত আছি।”
“তুমি বিপদের মুখে অগ্রসর হতে ভরসা কর, তা যদি কর? তবে আমার সঙ্গে এস—–যথায় বিমলা আছে তোমাকে নিয়ে যাব।”
“এখান থেকে কত দূর?”
“বেশীদূর নয়—কাছেই। রাত্রি প্রভাত হবার পূর্ব্বেই আমরা ফিরবো; কিন্তু এক ভয়ানক জিনিস তোমাকে দেখাব।”
“বিমলার মৃতদেহ নাকি?”
“মৃতদেহ বটে; বিমলার কি কার—তা জানি না।”
“চলুন—যদি বিমলার হয়—তবে আমি আর ফিরবো না,—সেইখানেই মরবো; তার পাশে মরে,—তার সঙ্গে যাব।”
“আমার সম্পূর্ণ বিশ্বাস সে মৃতদেহ বিমলার নয়। বিমলা বেঁচে আছে, আমি তাকে নিশ্চয়ই উদ্ধার করবো।”
“তা যদি পারেন—তবে—আমার প্রাণ দান করবেন। আপনার উপকার তা হলে জন্মে ভুলবো না।”
“আমার উপকারের প্রতিশোধ করিবে কি?”
বালিকাসুলভ চপলতায়,–”আমার যা আছে সকলই আপনাকে দিব—আমার যত গহনা আছে—সব বিক্রয় করে যা হবে আপনাকে দিব।”
“আমি এখনও তত দূর অর্থপ্রয়াসী হই নাই।”