তৃতীয় খণ্ড – বিচার ও বিচারের ফল

তৃতীয় খণ্ড – বিচার ও বিচারের ফল

প্রথম পরিচ্ছেদ – বিচারালয়ে

ম্যাজিস্ট্রেটের কোর্টে আজ লোকে লোকারণ্য। আজ রস্তমজীর বিচার আরম্ভ হইবে। আদালতে আজ দেশের লোক ভাঙিয়া পড়িয়াছে। রস্তমজীকে অনেকেই চিনিত, হরমসজীর ব্যাঙ্কের কেসিয়ার বলিয়া তাঁহার নাম অনেকেরই জানা ছিল। বিশেষতঃ এই খুনের বিষয় কাগজে অনেক লেখা-লেখিও হইয়াছিল। এই নূতন প্রকার খুনের বিচার কিরূপ হয়, লোকে ইহা দেখিবার জন্য নিতান্ত কৌতূহলাক্রান্ত হইয়া উঠিয়াছিল।

বিচার-গৃহে এত লোক জমিয়াছিল যে, কোর্টে আর তিলার্দ্ধ স্থান ছিল না। অনেকে ভিতরে প্রবিষ্ট হইতে না পারিয়া বাহিরে থাকিয়া ভিতরে কি হইতেছে, দেখিবার চেষ্টা পাইতেছিল।

বহুকষ্টে সার্জ্জন ও কনেষ্টবলগণ গোল থামাইবার চেষ্টা পাইতেছিল, কিন্তু এত জনতা হইয়াছিল যে, কিছুতেই গোল থামিতে ছিল না। সকলেই আসামীকে দেখিবার জন্য ব্যগ্র হইয়া গোলযোগ করিতেছিলেন।

বেলা এগারটায় কিঞ্চিৎ পূর্ব্বে কনেষ্টবল পরিবেষ্টিত হইয়া আসামী কাঠগড়ার ভিতরে আসিয়া দাঁড়াইলেন। এক সময়ে সকলে যাঁহাকে সম্মান-সম্ভ্রম করিত, আজ তাঁহাকে এরূপ অবস্তায় দণ্ডায়মান হইতে হইলে যে কি হয়, তাহা এ অবস্থায় যিনি না পড়িয়াছেন, তিনি বুঝিতে পারিবেন না। রস্তমজী মুখ তুলিয়া কোন দিকে চাহিতে সাহস করিলেন না।

এই কয়দিনে রস্তমজীর আকৃতির বিশেষ পরিবর্ত্তন হইয়াছে। সহসা দেখিলে তাঁহাকে চিনিতে পারা যায় না। তাঁহার চোখ মুখ বিবর্ণ মলিন। তিনি মনে মনে বুঝিয়াছিলেন, তাঁহার রক্ষা পাইবার কোন উপায় নাই। তিনি সকল কথা প্রকাশ করিয়া বলিলে রক্ষা পাইতে পারেন, কিন্তু ইহা তিনি কিছুতেই পারিবেন না। পরের খুনের জন্য তিনি ফাঁসী যাইতেছেন, এই অল্প বয়সে তাঁহার সকল আশা-ভরসা শেষ হইয়া গেল, জীবনে কত সুখী হইবেন, কত কাজ করিবেন, দৈবদুর্বিপাকে আজ সকলই ঘুচিয়া গেল। খুন করিল একজন, আর ফাঁসী যাইতেছেন তিনি! রক্ষা পাইবার উপায় নাই!

একবার তিনি অত্যন্ত ব্যাকুলভাবে আদালতের চারিদিকে চাহিলেন। চারিদিকে লোকে লোকারণ্য। তিনি পরিচিত লোক কাহাকেও দেখিতে পাইলেন না। বিশেষতঃ তিনি চোখে আর ভাল দেখিতে পাইতেছিলেন না।

একবার ফ্রামজীর কথা তাহার মনে পড়িল। ভাবিলেন, তিনি নিশ্চয়ই তাঁহাকে বাঁচাইবার জন্য চেষ্টা করিবেন। তাঁহার নিকটে টাকা আছে, নিশ্চয়ই ভাল উকীল দিয়াছেন, কিন্তু উকীলে কি করিবে? তিনি যে নিজে মুখ ফুটিয়া কিছুই বলিতে পারিতেছেন না।

তিনি ফ্রামজী আসিয়াছেন কি না দেখিবার জন্য চারিদেকে চাহিলেন, কিন্তু ফ্ৰামজীকে দেখিতে পাইলেন না। তাঁহার হৃদয়ের অন্তস্তল হইতে একটি দীর্ঘনিশ্বাস বহির্গত হইল। তিনি মনে মনে বলিলেন, “হায়, বিপদে পরম বন্ধুও পর হইয়া যায়!”

একবার সেই বৃদ্ধ মারাঠীর কথা তাঁহার মনে পড়িল। ভাবিলেন, তিনি আমার জন্য অনেক চেষ্টা পাইতেছেন। এখন ও নিশ্চয়ই পাইবেন। কিন্তু তিনিই বা কি করিতে পারেন?”

এই সময়ে আদালতে একটা গোল উঠিল। সমস্ত লোক উঠিয়া দাঁড়াইলেন। ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব আসিয়া আদালতে বসিলেন। অমনই চারিদিকে গভীর নিস্তব্ধতা বিরাজ করিল।

সাহেব প্রথমে কতকগুলি কাগজ-পত্রে সহি করিতে লাগিলেন। সেগুলি শেষ করিয়া তিনি আসামীর দিকে চাহিলেন। অমনই সরকারী উকীল উঠিয়া দাঁড়াইলেন। বলিলেন, “এ সেই গাড়ীতে খুনের কেস্।”

ম্যাজিস্ট্রেট জিজ্ঞাসা করিলেন, “আসামীর পক্ষে কেহ আছেন?”

এই প্রশ্নে রস্তমজী উদ্বিগ্নচিত্তে উকীলগণ যেখানে বসিয়াছিলেন, সেইদিকে চাহিলেন। তাঁহার পক্ষে কোন উকীল আছেন কিনা, তাহা তিনি নিশ্চিত জানিতেন না। কিন্তু দেখিলেন, একজন উকীল উঠিয়া দাঁড়াইলেন, বলিলেন, “আমি আসামীর পক্ষে আছি।”

রস্তমজী ইঁহাকে চিনিতেন। ইনি বোম্বে আদালতের একজন সর্ব্বপ্রধান উকীল। ইঁহাকে একদিন ফ্রামজী জেলে তাঁহার নিকটে লইয়া গিয়াছিলেন। ভাবিলেন, ফ্রামজী তাহা হইলে তাঁহাকে ভুলেন নাই। রস্তমজী জানিতেন, তাঁহার রক্ষার কোন উপায় নাই। তিনি ইচ্ছা করিয়াই প্রাণ দিতেছিলেন—তবুও এই উকীল তাঁহার পক্ষে আছেন জানিয়া, তাঁহার মন অনেকটা আশ্বস্ত হইল।

ম্যাজিস্ট্রেট আসামীর উকীলকে সম্বোধন করিয়া বলিলেন,—“এ সেসন কেস্—আপনি এ কোর্টে নিশ্চয় আসামীর পক্ষ সমর্থন করিবেন না।”

আসামীর উকীল। না হুজুর—আমি এই আদালতেই সব করিব। এ মোকদ্দমা সেসন পৰ্য্যন্ত যাইবার প্রয়োজন হইবে না।

ম্যজিষ্ট্রেট সাহেব একটু আশ্চর্যান্বিত হইয়া সরকারী উকীলের দিকে চাহিলেন। তিনি উঠিয়া বলিলেন, “আমার বন্ধু কি এইখানে সাক্ষীদিগের জেরা করিতে চাহেন?”

আঃ উকীল। হাঁ—কেবল জেরা নয়, আমার যে যে সাক্ষী আছে তাহা আমি এইখানেই ডাকিব।

ম্যাজিস্ট্রেট। তা হইলে আপনি বলিতে চাহেন যে, আসামী নিৰ্দ্দোষ।

আঃ উকীল। সাক্ষী-সাবুদ লওয়া হইলে হুজুরও তাহাই বলিবেন।

ম্যাজিস্ট্রেট। খুনী-মোকদ্দমা সেসনে পাঠানই নিয়ম।

আঃ উকীল। যদি আসামীর বিরদ্ধে কোন প্রমাণ না থাকে, তবে পাঠান নিষ্প্রয়োজন।

ম্যাজিস্ট্রেট। এরূপ হইলে আমি এখানেই আসামীকে খালাস দিতেও পারি।

সরকারী উকীল। এ সকল গুরুতর মোকদ্দমা সেসনে জুরীর সম্মুখে হওয়াই উচিত; তবে আমার বন্ধু যদি এ দায়িত্ব নিজ স্কন্ধে গ্রহণ করেন, তবে আমার কোনই আপত্তি থাকিতে পারে না।

আঃ উকীল। আমি দায়িত্ব লইয়াছি।

ম্যাজিস্ট্রেট সরকারী উকীল মহাশয়কে বলিলেন, “আপনি মোকদ্দমা আরম্ভ করিতে পারেন।

তিনি তাঁহার কাগজ-পত্র গুছাইয়া লইয়া উঠিয়া দাঁড়াইলেন।

মোকদ্দমা আরম্ভ হইল।

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ – বিচার আরম্ভ

সরকারী উকীল মহাশয় বলিলেন, “আসামী রস্তমজী এখানকার বিখ্যাত ব্যাঙ্কার হরমসজীর কেসিয়ার ছিলেন। সম্প্রতি এই ব্যাঙ্কে লক্ষ টাকা চুরি গিয়াছে—এই চুরির জন্য আসামী রস্তমজীকেই পুলিসে ধৃত করেন; কিন্তু তাঁহার বিরুদ্ধে যথেষ্ট প্রমাণ না পাওয়ায় তাঁহাকে জামিনে খালাস দেওয়া হইয়াছে। যে রাত্রে ব্যাঙ্কে চুরি হইয়াছে, সেই রাত্রে এই খুনও হইয়াছিল। রস্তমজীর চরিত্র পূর্ব্বে অতিশয় ভাল ছিল; কিন্তু বৎসরেক হইতে তিনি মদ্যপ, বেশ্যাসক্ত ও জুয়ারী হইয়াছেন। হরমসজী হুজুরের সম্মুখে আসিয়া এ সকল কথা বলিবেন। এমন কি, আসামীর বিশেষ বন্ধু ফ্রামজীও ইহা স্বীকার করিবেন। হরমসজী আরও বলিবেন যে, তাঁহার কন্যার সহিত আসামীর প্রণয় ছিল, তাঁহার চরিত্র কলুষিত না হইলে তিনি তাঁহার সহিত কন্যার বিবাহ দিতেন। এই সময়ে কলিকাতা হইতে একটি সম্ভ্রান্ত যুবক হরমসজীর কোন বন্ধুর নিকট হইতে পত্র লইয়া তাঁহার বাড়ীতে আসেন। ইঁহারই নাম পেষ্টনজী এবং এই হতভাগ্য যুবকই খুন হইয়াছেন। হরমসঙ্গী এই পেষ্টনজীর সহিত নিজ কন্যার বিবাহ দেওয়া একরূপ স্থির করিয়াছিলেন। ইহাতে বলা বাহুল্য, আসামী পেষ্টনজীর উপর অতিশয় ক্রোধান্বিত হইয়াছিলেন উভয়ে আলাপ হইয়াছিল সত্য, কিন্তু উভয়ের প্রতি উভয়ের বিজাতীয় দ্বেষ ছিল। আসামীর নিজের চাকর বলিবে যে, একদিন সে দুইজনকে মারামারি করিতে দেখিয়াছিল। আরও শুনিয়াছিল, আসামী বলে, ‘যদি তোমার রক্ত না দেখি, তবে আমার নাম রস্তমজী নয়।’ আসামীর আর একটা পরিচিত বন্ধু মাঞ্চারজী খুনের রাত্রে তাঁহাকে রাত্রি এগারটার সময় গিরগামের নিকট দেখিয়াছিলেন। আসামী পুলিসের নিকট এ কথা স্বীকার করিয়াছেন; আরও স্বীকার করিয়াছেন যে, তাঁহার সহিত পেষ্টনজীর ঐস্থানে দেখা হইয়া ছিল। নিতান্ত মাতাল দেখিয়া তাহাকে তিনি একখানা গাড়ীতে তুলিয়া দিয়াছিলেন। সেই গাড়ীর কোচিমান্ বলিতেছে, যে ব্যক্তি গাড়ী ডকিয়া পেষ্টনজীকে গাড়ীতে তুলিয়া দেন, তিন প্রথমে কিয়দ্দূর চলিয়া গিয়াছিলেন বটে, কিন্তু আবার ফিরিয়া আসিয়া বলেন, ‘না, আমি এঁকে বাড়ী পৌঁছাইয়া আসিতেছি।’ এই বলিয়া সেই লোক গাড়ীতে বসেন এবং শেষে গিরগামের মোড়ে নামিয়া যায়। গাড়োয়ান কিছুদূর আসিয়া গাড়ীর ভিতরের লোককে মৃত দেখিতে পায়। আর একজন গাড়োয়ান বলিরে যে, গিরগামের মোড় হইতে একজন লোক তাহার গাড়ীতে চড়িয়া কলবাদেবী রোডে নামিয়া যায়। সে যে সময় বলে, ঠিক সেই সময়ের কিছু পূর্ব্বে গাড়ীর ভিতরে খুন হইয়াছিল। সে সেই ব্যাক্তির যে রূপ বর্ণনা করে, তাহাতে দুই ব্যক্তিই যে এক, ইহাতে কোন সন্দেহ থাকে না। তাহার পর কলবাদেরীর বিটের পাহারাওয়ালা রাত্রি বারটার সময় এক ব্যাক্তিকে গাড়ী হইতে নামিতে দেখে। প্রথমে সে তাঁহাকে ফ্রামজী মনে করিয়াছিল, কিন্তু এখন সে শপথ করিয়া বলিবে, তিনি ফ্রামজী নহেন—রস্তমজী। ফ্রামজী ও রস্তমজী একই রকম পোষাক পরিয়া থাকেন। এ কথা আসামী ও ফ্রামজী উভয়েই স্বীকার করিয়াছেন, সুতরাং সে ব্যক্তি রস্তমজী ব্যতীত যে আর কেহ নহেন, তাহাতে কোন সন্দেহ নাই। এই ঘটনার পূর্ব্বদিনে ফ্রামজী একশিশি ক্লোরাফর্ম্ম কিনিয়াছিলেন; কেন কিনিয়াছিলেন, তাহার কারণ স্পষ্ট বলিতে পারেন না। তিনি বন্ধু রস্তমজীর জন্যই কিনিয়াছিলেন, সে বিষয়ে সন্দেহ কি? ডাক্তার পরীক্ষা করিয়া বলিয়াছিলেন যে, পেষ্টনজীর ক্লোরাফর্ম্মে মৃত্যু হইয়াছে। যে রুমালে ক্লোরাফর্ম্ম মাখান হইয়াছিল, তাহাতে ফ্রামজীর নাম লিখিত ছিল। ফ্রামজী বলিবেন যে, তাঁহার রুমাল রস্তমজী সর্ব্বদাই ব্যবহার করিতেন। তবে আসামীর স্বপক্ষে আমার ইহা বলাও কর্তব্য যে, ডাক্তার পরীক্ষা করিয়া বলিয়াছেন, যে ক্লোরাফর্ম্ম করিয়াছিল, তাহার খুন করিবার ইচ্ছা ছিল না। পেষ্টনজী ঘোরতর মাতাল না থাকিলে তাঁহার মৃত্যু হইত না। এরূপ স্থলেও রস্তমজী ব্যতীত আর অন্য কাহারই পেষ্টনজীকে খুন করিবার সম্ভাবনা নাই। আমার বন্ধু যদি আসামীকে নিৰ্দ্দোষ সপ্রমাণ করিতে পারেন, তাহাতে আমি সন্তুষ্ট ব্যতীত অসন্তুষ্ট হইব না। যেমন দোষী যাহাতে দণ্ড পায়, তাহা দেখা আমার কর্তব্য, নিদোষী যাহাতে কোনরূপে দণ্ডিত না হয়, তাহা দেখা আমার তেমনই কর্ত্তব্য। এখন আমি একে একে আমার সাক্ষী ডাকিব।”

ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব বলিলেন, “পুলিস যে রিপোর্ট দিয়াছে, তাহা আমি দেখিতে চাই।”

আসামীর উকীল উঠিয়া বলিলেন, “হুজুর, ডিটেটিভ ইনস্পেক্টর লালুভাই এ মোকদ্দমার তদন্ত করিয়াছেন। তাঁহার রিপোর্টই আদালতে উপস্থিত হইয়াছে। কিন্তু আমরা শুনিয়াছি যে, তাঁহার রিপোর্ট সম্পূর্ণ নহে। ডিটেটিভ সুপারিন্টেণ্ডেন্ট এ মোকদ্দমায় পুনরায় রিপোর্ট দিবার অনুমতি চাহিয়াছেন। আমাদের প্রার্থনা, হুজুর তাঁহার এ পত্র ও তলব করিয়া দেখুন।”

ম্যাজিস্ট্রেট। অবশ্য তাহাও দেখিব।

আসামীর উকীল। আমরা ইনস্পেক্টর লালুভাইকে দুই-একটি প্রশ্ন করিতে চাহি। আশা করি, হুজুর আদালত হইতে তাঁহাকে তলব করিবেন।

ম্যাজিস্ট্রেট। আপনি এ বিষয়ে দরখাস্ত করিলে আমি বিবেচনা করিব। সরকারী উকীলের এ বিষয়ে কোন আপত্তি আছে কি?

সরকারী উকীল। না হুজুর—ইহাতে আমার কোন আপত্তি নাই—থাকিতেও পারে না।

ম্যাজিস্ট্রেট। আচ্ছা, আমি ইনস্পেক্টর লালুভাইকে সাক্ষী দিবার জন্য তলব করিলাম।

পরে ম্যাজিস্ট্রেট আসামীর দিকে ফিরিয়া বলিলেন, “তোমার বিরুদ্ধে খুনের মোকদ্দমা হইয়াছে। এ বিষয়ে তোমার কিছু বলিবার আছে?”

আসামীর উকীল উঠিতেছিলেন,—কিন্তু তাঁহার উঠিবার পূর্ব্বেই রস্তমজী বলিলেন, “আমি নিদোষ, ইহা ছাড়া আমার যাহা কিছু বলিবার আছে, আমার উকীল বলিবেন।”

ম্যাজিস্ট্রেট সরকারী উকীলকে বলিলেন “আপনি সাক্ষী ডাকিতে পারেন।”

সরকারী উকীল। ১নং কোচম্যান।

কনেষ্টবল কোচম্যানকে চীৎকার করিয়া ডাকিতে লাগিল। দর্শকগণ উদ্‌গ্রীব হইলেন।

তৃতীয় পরিচ্ছেদ – এজাহার

প্রথম সাক্ষী কোচম্যান আসিয়া কাঠগড়ায় উঠিল। পেস্কার তাহাকে শপথ করাইলেন। সে নাম ধাম বলিয়া পুলিসের নিকট যাহা বলিয়াছিল, এখন আদালতেও তাহাই বলিল

আসামীর উকীল জেরা করিতে উঠিলেন। সাক্ষীকে জিজ্ঞাস করিলেন, “যে লোক পেষ্টনজীকে গাড়ীতে তুলিয়া দিয়াছিল, সেই কি আবার গাড়ীতে উঠিয়াছিল

কোচম্যান। হাঁ।

আঃ উকীল। শপথ করিয়া বলিতেছ?

কোচম্যান। হাঁ।

রহস্য-বিপ্লব

আঃ উকীল। কেমন করে জানলে সেই লোক—অপর নয়?

কোচম্যান। আমি ঠিক বলতে পারি।

আঃ উকীল। তুমি তার মুখ ভাল করে দেখেছিলে?

কোচম্যান। তা ঠিক বলতে পারি না।

আঃ উকীল। তা হলে দুজনের এক রকম পোষাক পরা ছিল বলে, আন্দাজ করে বল্‌ছ যে, সেই লোকই গাড়ীতে উঠেছিল?

কোচম্যান। সে না হলে বলবে কেন, ‘আমার বন্ধু মাতাল হয়েছে, আমিই তাকে বাড়ী পৌঁছাইয়া আসি।’

আঃ উকীল। এ কথা তোমার বেশ মনে আছে?

কোচম্যান। খুব মনে আছে।

আঃ উকীল। প্রথম লোকের আর দ্বিতীয় লোকের গলায় আওয়াজ কিছু তফাৎ বলে তোমার মনে হয়েছিল কি না?

কোচম্যান। না, তবে এই পর্য্যন্ত মনে পড়ে যে, প্রথমে যখন সেই লোক আমার সঙ্গে কথা কয়েছিল, তখন সে খুব চেঁচিয়ে কথা কয়েছিল, শেষে খুব আস্তে কথা কয়েছিল।

আঃ উকীল। সে রাত্রে তোমার মাথা ঠিক ছিল?

কোচম্যান। কেন থাকবে না?

আঃ উকীল। হুজুরের সম্মুখে শপথ করে বল যে, সে রাত্রে তুমি তাড়ী খাও নাই। কোচম্যান। যদি খেয়ে থাকি, তবে কারও ক্ষতি করি নাই।

আঃ উকীল। সে কথা শুনতে চাই না, হাঁ কি না?

কোচম্যান। খেয়েছিলাম।

আঃ উকীল। কিছু বেশী খেয়েছিলে?

কোচম্যান। তা বলতে পারি না।

আঃ উকীল। গাড়ী খুব জোরে হাঁকাচ্ছিলে—হাঁ কি না?

কোচম্যান। তা মনে নাই।

আঃ উকীল। তোমাকে পাহারাওয়ালা আস্তে যেতে বলেছিল কি না? সাক্ষী দিতে এসে মিথ্যা বলে জেলে যেতে হয়, তা জান?

কোচম্যান। একজন পাহারাওয়ালা বলেছিল।

আঃ উকীল। তা হলে চোখে ভাল দেখতে পাচ্ছিলে না?

কোচম্যান। কেন?

আঃ উকীল। কেন? তাড়ী খাবার জন্য। যেখানে তুমি এই ভদ্রলোকদের তুলে নেবার জন্য দাঁড়িয়েছিলে, সেখান থেকে গ্যাসের আলো কত দূরে ছিল?

কোচম্যান। ঠিক মনে নাই। অত দেখি নাই।

আঃ উকীল। সে জায়গাটায় ভাল আলো ছিল না?

কোচম্যান। বোধ হয়।

আঃ উকীল। তা হলে তুমি সে দুজন লোককে ভাল করে দেখতে পাও নাই? কোচম্যান। না।

আঃ উকীল। তা হলে শপথ করে বলতে পার কি, যে তারা দুজনে এক লোক?

কোচম্যান। না।

আঃ উকীল। দেখ দেখি আসামীর দিকে, এই কি সেই লোক? শপথ করে বল।

কোচম্যান। না আমি তা ঠিক বলতে পারি না। আমি তাকে ভাল করে দেখি নাই। আসামীর উকীল বলিলেন, “ইহাকে আর কিছু জিজ্ঞাসার নাই।”

তিনি বসিলে সরকারী উকীল দ্বিতীয় নম্বরের কোচম্যানকে ডাকিলেন। এই দ্বিতীয় সাক্ষী কোচম্যান, পুলিসের নিকট যাহা বলিয়াছিল, এখনও তাহাই বলিল। পরে আসামীর উকীল উঠিলেন।

আঃ উকীল। তুমি যখন সেই লোকটিকে গাড়ীতে তুলিয়াছিলে, তখন রাত্রি কটা?

২য় কোচম্যান। সাড়ে এগারটা।

আঃ উকীল। কেমন করিয়া জানিলে সাড়ে এগারটা?

২য় কোচ্। একটু আগে পাহারাওয়ালাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম।

আঃ উকীল। যে লোক তোমার গাড়ীতে উঠেছিল, তার মুখ ভাল করে দেখেছিলে?

২য় কোচম্যান। না।

আঃ উকীল। কেন?

২য় কোচম্যান। তিনি গাছের নীচে অন্ধকার ছিলেন, মুখ ভাল করে দেখতে পাই নাই। আঃ উকীল। তবে কেমন করে তার পোষাক দেখলে?

২য় কোচম্যান। তিনি কলবাদেবী রোডে আলোতে নেমেছিলেন, তাতেই পোষাক দেখেছিলাম।

আঃ উকীল। বটে, তিনি ভাড়া দিলেন কখন?

২য় কোচম্যান। নেমে।

আঃ উকীল। তখনও মুখ দেখতে পেলে না?

২য় কোচম্যান। তিনি মাথা নীচু করে ভাড়া দিয়েই চলে যান, আমি উপরে পয়সা গুণছিলাম, ভাল করে তার মুখ দেখি নাই।

আঃ উকীল। তা হলে তুমি সে লোককে দেখলে চিনতে পারবে না?

২য় কোচম্যান। না।

আঃ উকীল। দেখ দেখি আসামীর দিকে। সে রাত্রে যিনি তোমার গাড়ীতে এসেছিলেন, তিনিই কি ইনি?

২য় কোচম্যান। তা বলতে পারি না।

আঃ উকীল। ভাল করে দেখ।

২য় কোচম্যান। তাঁকে ভাল করে দেখি নাই, কেমন করে বলব।

আঃ উকীল। আচ্ছা যাও।

প্রায় সন্ধ্যা হইয়াছিল। সেদিন এই পৰ্য্যন্ত হইয়া স্থগিত রহিল। আবার কাল হইবে বলিয়া ম্যাজিস্ট্রেট উঠিয়া গেলেন। কনেষ্টবল বেষ্টিত হইয়া রস্তমজী আবার হাজতে গেলেন। দর্শকগণ আপনাপন মতামত প্রকাশ করিতে করিতে গৃহে ফিরিল।

চতুর্থ পরিচ্ছেদ – এজাহার—ক্রমশঃ

পরদিবস আদালতে সেইরূপই জনতা হইল। বরং পূর্ব্বদিন অপেক্ষা লোকসংখ্যা আরও বৃদ্ধি পাইয়াছে। যতক্ষণ ম্যাজিস্ট্রেট না আসিলেন, ততক্ষণ সকলে আসামীর উকীল কোন্ সাক্ষী ডাকিবেন, তাহারই আলোচনা করিতে লাগিলেন।

ম্যাজিস্ট্রেট আসিয়া এজলাসে বসিলে সরকারী উকীল তাঁহার তৃতীয় সাক্ষী ডাকিলেন। কলবাদেবী রোডের পাহারাওয়ালা আসিয়া কাঠগড়ায় দাঁড়াইল। সে পুলিসকে যাহা বলিয়াছিল, এখনও তাহাই বলিল।

সরকারি উকীল জিজ্ঞাসা করিলেন, “তুমি এখন কিরূপে জানিলে যে, সে লোক ফ্রামজী নয়?”

পাহারাওয়ালা বলিল, “আমি ভাল করিয়া তাঁহার মুখ দেখি নাই। ফ্রামজী সাহেবের মত পোষাক ছিল বলিয়া ভাবিয়াছিলাম, তিনি ফ্রামজীই হইবেন। এখন ভাল করিয়া ভাবিয়া দেখিয়া মনে হইতেছে যে, সে লোক ফ্রামজী হইতে লম্বা ছিলেন।”

“আসামীর দিকে দেখ। বল, এই লোক সেই লোক কি না।”

“হাঁ, এই সেই লোক।”

আসামীর উকীল উঠিলেন; জিজ্ঞাসা করিলেন, “তখন রাত্রি কটা?”

পাহারাওয়ালা বলিল, “প্রায় একটা।”

“কেমন করে জানিলে?”

“একটু আগে ইনস্পেক্টর সাহেব আসিয়াছিলেন, তিনি বলিয়া ছিলেন, একটা বাজে।”

“যখন সেই গাড়ী আসে, তখন তুমি বসেছিলে, কি দাঁড়িয়েছিলে?’

“বসেছিলাম।”

“শপথ করে হাকীমকে বল, তুমি তখন ঝিমুচ্ছিলে কি না?”

“কেন ঝিমুব?”

“কেন ঝিমুবে, তাহা জিজ্ঞাসা করিতেছি না—ঝিমুচ্ছিলে কিনা?”

“আমার ঠিক মনে নাই।”

“পাহারা দিবার নিয়ম কি, বসিয়া থাকা না বেড়াইয়া বেড়ান?”

‘বেড়াইয়া বেড়ান।”

“তা হইলে ঘুম পাইলে বসিয়া থাক? হাঁ, কি না?”

“পা ব্যথা হইলে বসি।”

“এরূপ অবস্থায় বলে ঘুম পায় কিনা?’

“না।”

“কখনও এ রকম বসে থাকলে তোমার ঘুম পেয়েছে কিনা?”

“কখন হতে পারে।”

“কতদূর থেকে তুমি গাড়ী দেখতে পেয়েছিলে?”

“বেশী দূর থেকে নয়।”

“তা হলে তুমি গাড়ী কাছে এলে তবে সেই গাড়ীর শব্দে উঠে দাঁড়িয়েছিলে?”

“হাঁ।”

“চোখ মুছতে মুছতে উঠে দাঁড়ালে?”

“তা আমার মনে নাই।”

“তোমার লণ্ঠন কোথায় ছিল?”

“হাতেই ছিল।”

“যে গাড়ী থেকে নেমেছিল, তার মুখের উপর লণ্ঠনের আলো ফেলেছিলে কিনা?”

“মনে নাই।”

“মনে করে বলতে হবে—মনে কর?”

“বোধ হয়, ফেলি নাই।”

“গাড়ী যেখানে দাঁড়াইয়াছিল, তার কোন্ দিকে তুমি ছিলে?”

“ডান্ দিকে।”

“সে লোক গাড়ীর কোন্ দিকে নেমেছিল?”

“বাঁ দিকে।”

“তা হলে তুমি তার মুখ দেখতে পাও নাই?”

“না।”

“তবে সে লোক কে, তাহা কিরূপে জানিলে?”

“সেই জন্য তাহাকে ফ্রামজী মনে করিয়াছিলাম।”

“তবে কোন্ আক্কেলে এখন বলিতেছ, সে লোক এই আসামী?”

“তার মত একে বোধ হয়।”

“ওঃ! বোধ হয়, আর আমার কিছু জিজ্ঞাসার নাই—যাও।”

পাহারাওয়ালা কাঠগড়া হইতে নামিলে সরকারী উকীল রস্তমজীর ভৃত্যকে ডাকিলেন।

ভৃত্য বলিল, “যে প্রায় পনের দিন হইল রস্তমজী ও পেষ্টনজীতে খেলা লইয়া মারামারি হইয়াছিল। রস্তমজী পেষ্টনজীকে বলিয়াছিলেন, “যদি তোমার রক্ত না দেখি, তা আমার নাম রস্তমজী নয়।”

আসামীর উকীল উঠিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “মারামারি হয় কেন?”

“খেলা নিয়ে।”

“কর্তারা মদ খেয়েছিলেন?”

“হাঁ।”

“কত মদ দুজনে খেয়েছিলেন?”

“এক বোতল।”

“ঝগড়া হবার আগে বোতল শেষ হয়েছিল কি না? হাকীমকে বল তাঁরা দুজনেই খুব মাতাল হয়েছিলেন কিনা?”

“হাঁ, খুব মাতাল—মনিবকে আমি ধরিয়া শোয়াইয়া দিই। তিনি সেদিন কিছুই খান নাই।”

“শোয়াইয়া দিতেই তিনি ঘুমিয়ে পড়েন?”

“হাঁ।”

আসামীর উকীল বসিলেন। হরমসজীর ডাক হইল। তিনি ধীরে ধীরে আসিয়া কাঠগড়ায় দাঁড়াইলেন।

সরকারী উকীল তাঁহাকে রস্তমজীর চরিত্র সম্বন্ধে প্রশ্ন করিতে লাগিলেন। রস্তমজী যে মদ্যপ, জুয়ারী প্রভৃতি হইয়াছেন, তাহা তিনি বলিলেন। আসামীর উকীল জেরায় জিজ্ঞাসা করিলেন, “আপনি রস্তমজী সম্বন্ধে এখানে যাহা যাহা বলিলেন, তাহা কি আপনি স্বচক্ষে দেখিয়া জানিয়াছেন—না পরের মুখে শুনিয়াছেন?”

হরমসজী। না, লোকে আমাকে এ সব বলিয়াছে, আমি স্বচক্ষে কিছু দেখি নাই।

আঃ উকীল। তা হইলে এ সব আপনার শোনা কথা।

হরমসজী। হাঁ।

“ওঃ”, বলিয়া আসামীর উকীল বসিলেন। পরের সাক্ষীর ডাক পড়িল।

রহস্য-বিপ্লব

পঞ্চম পরিচ্ছেদ – এজাহার-ক্ৰমশঃ

এবার মাঞ্চারজী কাঠগড়ায় আসিলেন। গিরগামের নিকট যে তিনি পেষ্টনজীর সহিত রস্তমজীকে কথা কহিতে দেখিয়াছেন, তাহা বলিলেন।

আসামীর উকীল উঠিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “মহাশয় না হরমসজীর কন্যার একজন পাণিপ্রার্থী?”

মাঞ্চারজী বলিল, “ঠিক বলিতে পারি না।”

“ইচ্ছা আছে?”

“থাকিতে পারে।”

‘এইজন্যই তার উপর আপনার বিশেষ আক্রোশ আছে?”

“তিনি আমার বন্ধু।”

“বটে? পুলিস আপনাকে এই সাক্ষীর কথা জিজ্ঞাসা করিয়াছিল, না, মহাশয় নিজে পুলিসকে সংবাদ দিয়াছিলেন?”

“আমি বলিয়াছিলাম।”

“কেন—বন্ধুত্বের জন্য? আপনি আদর্শ বন্ধু!”

“প্রকৃত খুনীর যাহাতে সন্ধান হয়, সেইজন্য বলিয়াছিলাম।”

“বটে! আপনি এত রাত্রে গিরগামে কি করিতে গিয়াছিলেন? আপনি ত থাকেন, বাইকালায়?”

“রাস্তায় বেড়াইতেছিলাম।”

“রাত্রি এগারটার সময় নিজের বাসা হইতে এক ক্রোশ দূরে বেড়াইবার কারণ কি?”

“কারণ কিছুই নাই।”

“ঠিক করে হাকীমকে বলুন, আপনি এফিনষ্টোন সার্কেল থেকে রস্তমজীর অনুসরণ করেছিলেন কি না। মনে থাকে যেন, আপনি শপথ করিয়াছেন।”

“না।”

“যদি কেহ এই আদালতে আসিয়া শপথ করিয়া বলে যে, সে আপনাকে রস্তমজীর অনুসরণ করিতে দেখিয়াছিলেন, তাহা হইলে কি তিনি মিথ্যাকথা বলিবেন?”

“তা আমি জানি না।”

“জানি না কি? আপনি অনুসরণ করেছিলেন?”

“না।”

“এঁদের দেখিতে পাইয়া আপনি কেন দেখা করিলেন না? এঁরা দুজনেই আপনার বন্ধু।”

“আমি তখন ব্যস্ত ছিলাম।”

“কিসের জন্য?”

“আমার কাজ ছিল।”

আঃ উকীল। এই বলিলেন, কোনই কাজ ছিল না, কেবল বেড়াইতেছিলেন। হাকীমকে বলুন, কি কাজ ছিল।

মাঞ্চারজী। আমি তাহা বলিব না।

ম্যাজিস্ট্রেট। বলিতে হইবে।

মাঞ্চারজী। একটি স্ত্রীলোকের সহিত দেখা করিতে যাইতেছিলাম।

আঃ উকীল। কে সে স্ত্রীলোক?

“একজন বারবনিতা।”

“তার নাম কি?”

“নাম জানি না।”

“নাম জান না, দেখা করিতে যাইতেছিলে—ঠিকানা কি?”

“তা জানিতাম না, খুঁজিয়া লইব মনে করিয়া যাইতেছিলাম।”

“তবে ঠিকানাও জানা ছিল না। কে সন্ধান দিয়াছিল?”

ম্যাজিস্ট্রেট বলিলেন, “এই সাক্ষীকে আর জিজ্ঞাসা করিয়া সময় নষ্ট করিবেন না।”

“হুজুরের আজ্ঞা শিরোধার্য্য,” বলিয়া রস্তমজীর উকীল বসিলেন।

শেষ সাক্ষী ডাক্তার সাহেবের ডাক পড়িল। তিনি আসিয়া বলিলেন, “আমি লাসের শরীর ব্যবচ্ছেদ করিয়াছিলাম। ক্লোরাফর্ম্মে লোকটির মৃত্যু হইয়াছে। যে রুমাল পরীক্ষা করিয়াছি, তাহাতে ক্লোরাফর্ম মাখান ছিল।”

আসামীর উকীল উঠিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “রুমালে যে পরিমাণে ক্লোরাফর্ম্ম মাখান সম্ভব, তাহাতে কি কাহারও মৃত্য হইতে পারে?”

ডাক্তার। না।

আঃ উকীল। তবে ক্লোরাফর্ম্মে লোকটির মৃত্যু হয় নাই?

ডাক্তার। লোকটি ভয়ানক মাতাল ছিল, সেইজন্য এই ক্লোরাফর্ম্মে তাঁহার মৃত্যু হইয়াছে।

আঃ উকীল। মাতাল না থাকিলে মরিত না?

ডাক্তার। না, কেবল অজ্ঞান হইত মাত্র।

আঃ উকীল। তাহা হইলে বলিতে হইবে, এই লোকটিকে ক্লোরাফর্ম করিয়া ইহাকে প্রাণে মারিবার ইচ্ছা ছিল না?

ডাক্তার। সম্ভব।

রস্তমজীর উকীল বসিলেন।

ম্যাজিস্ট্রেট জিজ্ঞাসা করিলেন, “আর কোন সাক্ষী আছে?”

সরকারী উকীল বলিলেন, “আমাদের ফ্রামজীকে ডাকিবার ইচ্ছা ছিল, কিন্তু তিনি আসামীর বিশেষ বন্ধু। তাঁহার নিকট কোন কথার আশা করা যায় না; সুতরাং আমরা তাঁহাকে ডাকিব না আদালত, ইনস্পেক্টর লালুভাইকে তলব দিয়াছেন, সুতরাং আমরা আর কোন সাক্ষী ডাকিবার আবশ্যকতা দেখি না।”

ম্যাজিস্ট্রেট আসামীর উকীলকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “আপনার কোন সাক্ষী ডাকিবার ইচ্ছা আছে?”

তিনি বলিলেন, “হাঁ, আছে।”

ম্যাজিস্ট্রেট। কয় জন সাক্ষী ডাকিবেন?

আঃ উকীল। বেশী নহে, কেবল তিন চারি জন।

ম্যাজিস্ট্রেট। আপনি কি সপ্রমাণ করিতে চাহেন?

আঃ উকীল। আমি প্রমাণ করিব, আসামী আদৌ পেষ্টনজীর সঙ্গে গাড়ীতে যান নাই, সুতরাং পেষ্টনজী যখন গাড়ীর ভিতরে খুন হইয়াছে, তখন নিশ্চয়ই আমার ক্লায়েন্ট খুন করেন নাই। আমরা আরও প্রমাণ দিব যে, যখন পেষ্টনজী খুন হন, তখন আসামী অন্যত্রে ছিলেন। রাত্রি এগারটা হইতে প্রায় দুইটা পর্য্যন্ত তিনি একটি মৃত্যুশয্যাগতা স্ত্রীলোকের পার্শ্বে ছিলেন। সুতরাং তাঁহার দ্বারা কখনও খুন হয় নাই। আদালত, ইনস্পেক্টর লালুভাইকে তলব দিয়েছেন, নতুবা আমরা তাঁহাকে ডাকিতাম। আমরা তাঁহার দ্বারাই দেখাইব যে, খুন প্রণয় সংক্রান্ত ঈর্ষায় হয় নাই। যে খুন করিয়াছে, তাহার অন্য কোন একটা উদ্দেশ্য ছিল।

ম্যাজিস্ট্রেট। আচ্ছা, আজ এই পর্য্যন্ত থাকিল। কাল প্রথমে লালুভাই এর সাক্ষ্য লইব; পরে আপনার সাক্ষী ডাকিবেন।

সেদিনের মত আদালত বন্ধ হইল। এখন অনেকেই বলিতে লাগিলেন, “রস্তমজী খুন করেন নাই—মুক্তি পাইবেন।”

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ – এজাহার-ক্রমশঃ

পর দিবস আদালত আরও লোকে লোকারণ্য। রস্তমজীর যে কোন সাক্ষী আছে, তাহা কেহ পূর্ব্বে ভাবেন নাই। তাঁহার সাক্ষিগণ কি বলিবেন, ইহাই জানিবার জন্য আজ সকলেই সমুৎসুক।

ম্যাজিস্ট্রেট আসিয়াই ইনস্পেক্টর লালুভাইকে ডাকিলেন। পেস্কার তাঁহাকে শপথ পাঠ করাইলে; ম্যাজিস্ট্রেট জিজ্ঞাসা করিলেন, “তোমারই রিপোর্টে আসামী গ্রেপ্তার হইয়াছে?”

লালুভাই। হাঁ, হুজুর।

ম্যাজিস্ট্রেট। আসামী তোমার নিকটে কি স্বীকার করিয়াছিলেন?

আঃ উকীল। আমরা হুজুরের এ প্রশ্নে আপত্তি করিতে পরি কিন্তু করিব না।

লালুভাই। আসামী আমাকে বলিলেন যে, তাঁহার সহিত পেষ্টনজীর সে রাত্রে দেখা হইয়াছিল। তিনি তাঁহাকে মাতাল দেখিয়া গাড়ীতে তুলিয়া দিয়াছিলেন; কিন্তু তিনি তাঁহার সঙ্গে গাড়ীতে যান নাই।

ম্যাজিস্ট্রেট। কোথায় গিয়াছিলেন?

লালুভাই। তিনি তাহা কিছুতেই বলিবেন না।

সরকারী উকীল। আপনাদের সুপারিন্টেণ্ডেন্ট সাহেব লিখিয়াছেন যে, আপনার রিপোর্ট সম্পূর্ণ নয়, ইহার অর্থ কি?

লালুভাই। রস্তমজী খুন করিয়াছেন কি না, এ বিষয়ে তাঁহার সন্দেহ আছে।

সঃ উকীল। কেন?

লালুভাই। তাহা আমি বলিতে পারি না।

ম্যাজিস্ট্রেট আসামীর উকীলকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “আপনার কি জিজ্ঞাস্য আছে?”

আঃ উকীল। কিছু আছে। লালুভাই সাহেব, আপনি পেষ্টনজীর পোষাক বেশ ভাল করিয়া পরীক্ষা করিয়া দেখিয়াছিলেন কি?

লালুভাই। আগে দেখি নাই, সুপারিন্টেণ্ডেন্ট কীর্ত্তিকর সাহেব দেখিতে বলায় দেখিয়াছিলাম।

আঃ উকীল। পরীক্ষা করিয়া কি দেখিয়াছিলেন?

লালুভাই। দেখিয়াছিলাম, তাঁহার কোটের ভিতরকার কাপড়ের নীচে দুইখানি কাগজ সেলাই করা ছিল?

আঃ উকীল। সে কাগজ কি আপনারা যখন কোট দেখিয়াছিলেন, তখন সেখানে ছিল?

লালুভাই। না।

আঃ উকীল। দুইখানি কাগজ ছিল, ইহা কিরূপে জানিলেন?

লালুভাই। ঐ দুইখানি কাগজের দুইটা কোণ কোটের সঙ্গে ছিল।

আঃ উকীল। তাহা হইলে ঐ দুইখানি কাগজ কি কেহ তাড়াতাড়ি টানিয়া লয় নাই?

লালুভাই। হাঁ, লইয়াছিল।

আঃ উকীল। কোটের কাপড় ছেঁড়া ছিল কি?

লালুভাই। হাঁ।

আঃ উকীল। কবে আপনি এই কোট পরীক্ষা করেন?

লালুভাই। খুনের পর দিন।

আঃ উকীল। ছেঁড়াটা নূতন বলিয়া আপনার বোধ হয় নাই কি!

লালুভাই। হইয়াছিল।

আঃ উকীল। আপনি কি মন করেন না যে, যখন এই লোকটি খুন হয়, অথবা ক্লোরাফৰ্ম্মে অজ্ঞান হইয়া পড়ে, তখন এই দুইখানি কাগজ কেহ তাঁহার কোটের কাপড়ের ভিতর হইতে ছিনাইয়া লইয়াছে?

লালুভাই। হাঁ, তাহাই মনে হয়।

আঃ উকীল। তা হইলে আপনার কি অনুমান হয় না যে, এই কাগজ দুইখানি লইবার জন্যই পেষ্টনজীকে কেহ ক্লোরাফর্ম্ম করিয়াছিল?

লালুভাই। হাঁ, ইহাই আমার অনুমান।

আঃ উকীল। কাগজ দুইখানির কোণ দেখিয়া জানিতে পারিয়াছেন যে, ঐ দুইখানি কাগজ কি?

লালুভাই। হাঁ—ঐ কোণে যে ছাপা আছে, উহাতে স্পষ্ট জানা, যায় যে, উহার একখানি কোন পার্শীর বিবাহের সার্টিফিকেট—আর একখানি কাহারও জন্মের সার্টিফিকেট।

আঃ উকীল। তাহা হইলে আপনি এখন কি মনে করেন না যে, কেহ ভালবাসার আক্রোশে পেষ্টনজীকে খুন করে নাই, এই দুইখানা কাগজ লইবার জন্যই খুন করিয়াছিল?

লালুভাই। হাঁ, এখন আমার তাহাই মনে হয়।

আঃ উকীল। রস্তমজী এই দুইখানি কাগজ পাইবার জন্য ব্যগ্র হইতে পারেন, এমন কোন প্রমাণ আপনি অনুসন্ধানে পাইয়াছেন কি?

লালুভাই। না।

আঃ উকীল। আমার বিজ্ঞ বন্ধু ইতিপূর্ব্বে প্রমাণ করিবার জন্য প্রয়াস পাইতেছিলেন যে, আসামী ভালবাসার আক্রোশে পেষ্টনজীকে খুন করিয়াছেন, তাহা আর খাটিতেছে না। আমার আর কিছু জিজ্ঞাস্য নাই।

সরকারী উকীল উঠিয়া বলিলেন, “এরূপ স্থলে আপনি রস্তমজীকে গ্রেপ্তার করিবার জন্য রিপোর্ট করিয়াছিলেন কেন?”

লালুভাই। রিপোর্ট দিবার প

এ দুইখানি কাগজের কথা জানিতে পারি। আঃ উকিল। তাহা হইলে এই দুইখানি কাগজ পাইবার পর হইতে আপনার বিশেষ সন্দেহ হইয়াছে যে, রস্তমজী ন করেন নাই।

লালুভাই। হাঁ।

ম্যাজিস্ট্রেট। কাহার বিবাহের সার্টিফিকেট?

লালুভাই। অনুসন্ধান করিতেছি—এখনও কিছুই জানিতে পারি নাই।

ম্যাজিস্ট্রেট। যাও।

লালুভাই সত্বর কাটগড়া হইতে নামিলেন।

ম্যাজিস্ট্রেট আসামীর উকীলকে বলিলেন, “আপনার সাক্ষী ডাকুন।

রস্তমজীর উকীল পাইদুনির ‘চলের’ সেই স্ত্রীলোককে ডাকিলেন। সে লালুভাইকে যাহা যাহা বলিয়াছিল, আদালতেও তাহাই বলিল।

আসামীর উকীল বলিলে, “আসামীর দিকে দেখুন, ইঁহাকেই কি আপনি ছোকরাকে দিয়া পত্র দিয়াছিলেন?”

স্ত্রীলোক। হাঁ।

আঃ উকীল। ইনিই কি সেই স্ত্রীলোকের নিকটে রাত এগারটা হইতে দুইটা পৰ্য্যন্ত ছিলেন?

স্ত্রীলোক। হাঁ।

সরকারী উকীল। রস্তমজীকে পত্র দিতে তিনি আপনাকে বলেন কিন্তু ইনিই যে রস্তমজী আপনি কেমন করিয়া জানিলেন?

স্ত্রীলোক। আমি সন্ধ্যা হতে হরমসঙ্গীর আফিসের কাছে রস্তমজীর তল্লাসে ছিলাম। রাত্রি দশটার সময়ে হরমসজীর দ্বরোয়ান ইঁহাকে আমায় দেখাইয়া দেয়।

সরকারী উকীল। আপনি শপথ করিয়া বলিতে পারেন, এই সেই লোক?

স্ত্রীলোক। হাঁ।

সরকারী উকীল আর কোন প্রশ্ন করিলেন না। রস্তমজীর উকীল সেই বালককে, দ্বরোয়ানকে ও মাণিকজীর কর্ম্মচারীকে ডাকিলেন। এই সকল সাক্ষীর দ্বারা সুস্পষ্ট সপ্রমাণ হইল যে, রস্তমজী এগারটার সময় পত্র পাইয়া পাইদুনির ‘চলে’ মৃত্যুশয্যায় শায়িতা স্ত্রীলোকের নিকট গিয়াছিলেন এবং তথায় প্রায় রাত দুইটা পর্য্যন্ত ছিলেন। পেষ্টনজী রাত্রি সাড়ে এগারটার পর খুন হয়েন।

“কাল রায় দিব,” বলিয়া ম্যাজিস্ট্রেট উঠিয়া গেলেন। কলরব করিতে করিতে দর্শকগণও যে যাহার গৃহের দিকে প্রস্থান করিলেন।

নানাচিন্তায় ব্যাকুলচিত্তে রস্তমজী পুনরায় জেলে চলিলেন।

সপ্তম পরিচ্ছেদ – বিচারের ফল—পুনমুক্তি

পরদিবসেও আদালতে আর লোক ধরে না। পূর্ব্বে যাঁহারা আসিয়া ছিলেন, তাঁহারাও আজ সহস্র কৰ্ম্ম পরিত্যাগ করিয়া আসিয়াছেন। তাহা ছাড়া আরও অনেক নূতন দর্শকের সমাগম হইয়াছে; দেখিয়া মনে হয়, আজ যেন সমগ্র সহরটী আদালতে ভাঙিয়া পড়িয়াছে। এমন মহা জনতা আদালতে আর কেহ কখনও দেখে নাই। সহরময় রাষ্ট্র হইয়াছে যে, যখন পেষ্টনজী খুন হইয়াছিলেন, তখন রস্তমজী অন্যত্রে ছিলেন। ম্যাজিস্ট্রেট কি রায় দেন, দেখিবার জন্য আজ হাজার হাজার লোক আদালতে সমবেত হইয়াছেন।

স্পন্দিতহৃদয়ে রস্তমজী কাঠগড়ায় আসিয়া নতমুখে দাঁড়াইলেন। তাঁহার উকীলের কার্য্যে তিনি বিশেষ আশ্চর্যান্বিত হইয়াছিলেন, তাঁহার উকীল কিরূপে জানিলেন, তিনি সে রাত্রে কোথায় গিয়াছিলেন? যাহা তিনি প্রাণ থাকিতে কাহাকেও বলিবেন না স্থির করিয়াছিলেন, তাহা কিরূপে প্রকাশ পাইল? কিরূপেই বা তিনি সার্টিফিকেটের কথা জানিলেন।

রস্তমজী সমস্ত রাত্রি এই সকল চিন্তায় নিতান্তই ব্যাকুল হইয়া ছিলেন। জীবনের মায়া নাই কাহার? এ সংসারে কে সহজে মরিতে চাহে? আদালতে কাল যে সকল ঘটনা হইয়া গিয়াছে, তাহাতে তাঁহার আশা হইয়াছে যে, হয় ত তিনি এ ঘোর বিপদ্ হইতে এ যাত্রা রক্ষা পাইলেন। তাহাই নিতান্ত উদ্বিগ্নচিত্তে ও স্পন্দিতহৃদয়ে তিনি আজ কাঠগড়ায় দণ্ডায়মান হইলেন।

অন্যান্য দিন তিনি কাষ্ঠ-পুত্তলিকার ন্যায় দণ্ডায়মান থাকিতেন। বাঁচিবার কোনরূপ আশা নাই জানিয়া, তাঁহার হৃদয়ও জড়তাপ্রাপ্ত হইয়াছিল। নিতান্তই উদ্বেগে তিনি এই কয়দিন কাটাইয়াছেন; কিন্তু আজ যেন তিনি কিছু চঞ্চল, কিছু ব্যাকুল, কিছু উদ্বিগ্ন, কখন, বিচারক আসিবেন—কি রায় দিবেন—সেজন্য উৎসুক। তাঁহার হৃদয় সবলে প্রতিক্ষণে স্পন্দিত হইতেছিল। একটা মিনিট যেন তাঁহার একটা দিন বলিয়া মনে হইতেছিল।

ঠিক এগারটার সময়ে ম্যাজিস্ট্রেট আসিলেন। চারিদিকে ঘোর নিস্তব্ধতা বিরাজ করিল। সকলেই তাঁহার দিকে কৌতূহলাচিত্তে চাহিয়া রহিলেন।

তিনি রায় পাঠ আরম্ভ করিলেন। প্রথমে খুনের আনুপূর্ব্বিক বিবরণ বলিয়া শেষ সাক্ষীদিগের কথার আলোচনা করিতে লাগিলেন। প্রথম সাক্ষী—কোচম্যান তাড়ী খাইয়া মাতাল ছিল, নিজেই স্বীকার করিয়াছে; সুতরাং স্পষ্টই জানা যাইতেছে, একই লোক যে তাহাকে ডাকিয়া পেষ্টনজীকে গাড়ীতে তুলিয়া দিয়াছিল এবং পরে তাহার গাড়ীতে উঠিয়াছিল, সেই কোচম্যান ইহা স্পষ্ট দেখে নাই, বলিতেও পারে না। দ্বিতীয় সাক্ষী কোচম্যানও কিছুই বলিতে পারে নাই। তৃতীয় সাক্ষী পাহারাওয়ালা জেরায় স্পষ্টতঃ স্বীকার করিয়াছে যে, সে ঘুমাইতেছিল। লোকটিকে ভাল করিয়া দেখে নাই এবং তাহার মুখ আদৌ দেখিতে পায় নাই। চতুর্থ সাক্ষী আসামীর চাকর উভয়ের মারামারি কথা বলিয়াছে; কিন্তু জেরায় স্বীকার করিয়াছে যে, সে মারামারি মাতলামী ভিন্ন আর কিছুই নহে। তাহার মনিবের তখন কোনই জ্ঞান ছিল না। পঞ্চম সাক্ষী মাঞ্চারজী প্রকারান্তরে স্বীকার করিয়াছে যে, সে আসামীর অনুসরণ করিয়াছিল। সে যাহা বলিয়াছে, সমস্তই মিথ্যাকথা বলিয়াছে, তাহার একটি কথাও বিশ্বাসযোগ্য নহে। ইনস্পেক্টর লালুভাই এর সাক্ষ্যে জানা গিয়াছে যে, খুন প্রণয় সংক্রান্ত ঈর্যাবশে হয় নাই, পেষ্টনজী দুইখানা সার্টিফিকেট অতি সাবধানে ও গোপনে নিজের কোটের কাপড়ের নিচে সেলাই করিয়া রাখিয়াছিল। তাহাকে অজ্ঞান করিয়া বা খুন করিয়া কেহ ঐ দুইখানি কাগজ ছিনাইয়া লইয়াছে। সুতরাং খুন এই দুইখানা কাগজের জন্য হইয়াছে, ইহার অন্য দ্বিতীয় কারণ নাই। এই দুইখানি কাগজ পেষ্টনজীর নিকটে আছে, ইহা রস্তমজী জানিতেন বা এই দুইখানি কাগজ যে তাঁহার বিশেষ প্রয়োজন, ইহার কোন প্রমাণ নাই; সুতরাং তিনি যে এই খুন করেন নাই, এ বিষয়ে বিশেষ সন্দেহের কারণ দেখা যাইতেছে। অন্য কোন সাক্ষী না থাকিলেও আমি আসামীকে এই সন্দেহের জন্য খালাস দিতে বাধ্য হইতাম। আরও আসামীর উকীল, চারিজন সাক্ষী দিয়া প্ৰমাণ করিয়াছেন যে, যখন পেষ্টনজী খুন হয়, তখন আসামী আদৌ তথায় ছিলেন না, অন্যত্রে ছিলেন। তাঁহার গতিবিধি সহজভাবে সপ্রমাণ হইয়াছে। এই সকল সাক্ষীর কথায় অবিশ্বাস করিবার বিন্দুমাত্র কারণ নাই। এরূপ স্থলে আমি আসামী রস্তমজীকে বিচারের জন্য সেসনে প্রেরণ করিবার কোনই কারণ দেখিতেছি না। ইহাতে আদালতের অনর্থক সময় নষ্ট হয় মাত্র। এইজন্য ফৌজদারী কার্যবিধি আইন অনুসারে আমি আসামী রস্তমজীকে খালাস দিলাম। উপসংহারে আমি নিম্ন মন্তব্য প্রকাশ করা কর্ত্তব্য বিবেচনা করিলাম। প্রকাশ্য রাজপথে গাড়ীর ভিতর এক ব্যক্তি খুন হইল, সেই খুনীকে পুলিস যদি ধৃত করিতে না পারে, তবে সে পুলিস যে নিতান্ত অকৰ্ম্মণ্য, তাহাতে কোন সন্দেহ নাই।

রস্তমজীর খালাস সংবাদ মুহূর্ত্ত মধ্যে চারিদিকে প্রকাশ হইল। অমনি একটা আনন্দধ্বনি আকাশ ভেদ করিয়া উঠিল। কনেষ্টবলগণ গোল থামাইবার নিষ্ফল প্রয়াস পাইতে লাগিল।

কম্পিতপদে রস্তমজী জগদীশ্বর ও বিচারপতিকে ধন্যবাদ দিয়া কাঠগড়া হইতে নামিয়া বাহিরে আসিলেন। হাজার হাজার লোক তাঁহাকে চারিদিক হইতে বেষ্টন করিল। তাঁহার মস্তক ঘুরিয়া গেল, স্পষ্ট দিবালোকেও তিনি চারিদিক অন্ধকার দেখিলেন—তিনি পড়িয়া যাইতেছিলেন, কিন্তু কে তাঁহাকে ধরিল?

তিনি মুহূৰ্ত্ত মধ্যে প্রকৃতিস্থ হইলেন। দেখিলেন, একটি অবগুণ্ঠনবতী স্ত্রীলোক। সেই স্ত্রীলোকটি রস্তমজীর হাত ধরিয়া বলিলেন, “এস।”

রস্তমজী কলের পুত্তলীর ন্যায় তাঁহার সঙ্গে সঙ্গে চলিলেন। একজন স্ত্রীলোক তাঁহার হাত ধরিয়া লইয়া যাইতেছেন দেখিয়া সকলেই পথ ছাড়িয়া দিল।

নিকটে একখানা গাড়ী ছিল। উভয়ে সেই গাড়ীতে উঠিলেন। শীঘ্রই গাড়ী সকলের দৃষ্টির বহির্ভূত হইয়া গেল।

পাঠক! এই স্ত্রীলোক কে?

অষ্টম পরিচ্ছেদ – আলোচনা

কীর্ত্তিকর নিজ আফিসে উপবিষ্ট। লালুভাই ও দাদাভাস্কর সম্মুখস্থ টেবিলের দুইদিকে দুইজন বসিয়া আছেন।

কীর্ত্তিকর কতকগুলি কাগজ-পত্ৰ লইয়া শ্রেণীবদ্ধ করিয়া সাজাইয়া রাখিতেছিলেন। পরে সেই কাগজগুলি একে একে একটি বাণ্ডিলে পরিণত করিয়া লালুভাই এর দিকে চাহিলেন।

লালুভাই তাঁহার তীক্ষ্ণদৃষ্টির দিকে চক্ষু রাখিতে না পারিয়া মস্তক অবনত করিলেন। কীর্ত্তিকরের সেই ভীষণ দৃষ্টির দিকে কেহই চাহিতে পারিত না!

কিয়ৎক্ষণ এইরূপ চাহিয়া থাকিয়া কীর্ত্তিকর বলিলেন, “লালুভাই সাহেব, ম্যাজিস্ট্রেটের রায়ে যেরূপ মন্তব্য প্রকাশ করিয়াছেন, তাহা দেখিয়াছেন কি?”

লালুভাই। হাঁ, দেখিয়াছি।

কীর্ত্তি। আমাদের তিনি গাধা বলিয়াছেন।

দাদা। ঠিক এ কথা বলেন নাই।

কীর্ত্তি। তোমার মত পণ্ডিত পুলিসে আছে বলিয়াই এরূপ গালি খাইতে হয়।

দাদা। মাষ্টার, তিনি বলিতেছেন, যদি আমরা না ধরিতে পারি, তবে আমরা অপদার্থ—

কীৰ্ত্তি। ঠিকই বলিয়াছেন; কিন্তু ধরিবার কি করিয়াছ? দুই জনেই ত অন্ধকারে হাতড়াইয়া বেড়াইতেছ। ধরিবার আশা আছে কি? দেখ, কমিশনার সাহেব কি লিখিয়াছেন।

এই বলিয়া কীর্ত্তিকর একখানা কাগজ দাদাভাস্করের দিকে ফেলিয়া দিলেন। দাদাভাস্কর সেখানি পাঠ করিয়া লালুভাইএর দিকে ঠেলিয়া দিলেন। তিনি কাগজখানিতে যাহা লিখা ছিল, পাঠ করিলেন।

কীৰ্ত্তি। দেখিলে কমিশনার সাহবে কি লিখিয়াছেন?

দাদা। তিনি লিখিবেন না কেন, তাঁহাকে ত নিজের হাতে কিছু করিতে হয় না?

কীর্ত্তি! তোমারা কিন্তু খুব বাহাদুরী দেখাইয়াছ। তুমি একজনকে চোর বলিয়া ধরিলে, শেষে নিজেদেরই ভুল স্বীকার করিয়া তাহাকে ছাড়িয়া দিতে হইল। লালুভাই সাহেব খুনী বলিয়া আবার তাড়াতাড়ি তাহাকেই গ্রেপ্তার করিলেন। ম্যাজিস্ট্রেট তাহাকে খালাস দিয়া আমাদিগকে গাধা বলিলেন। কমিশনার সাহেবের ভারি অপরাধ যে, তিনি এরূপ পত্র লিখিয়াছেন! এই যে একজন নিরপরাধ ভদ্রসন্তানকে লইয়া নাস্তানাবুদ করিলে, ইহাতেই একটা খুব ডিটেক্‌টিভগিরী হইয়া গেল!

দাদা। তিনি একমাস সময় দিয়াছেন—তাহার পর ত! একমাসে নিশ্চয়ই চোর আর খুনী দুই ধরা পড়িবে।

কীর্ত্তি। না ধরিতে পারিলে কেবল বদনাম নয়, বিশেষ কিছু ব্যবস্থা করিবেন।

দাদা। দেখা যাবে; কিন্তু আপনি যে, আমরা যাহাই করিতে যাই, তাহাতেই আগে প্রতিবন্ধক দেন।

কীর্ত্তি। কি রকম?

দাদা। এখন চুরি কে করেছে, তা বেশ জানা গেছে—আপনি অনুমতি করিলেই ত রাজা বাঈকে গ্রেপ্তার করি।

কীর্ত্তি। রাজাবাঈ চুরি করে নাই।

দাদা। ওই ত!

লালু। হরমসজী যে খুন করিয়াছে, তাহাতে কি আর সন্দেহ আছে?

কীৰ্ত্তি। লালুভাই সাহেব, আপনি বৃদ্ধ হইয়াছেন; দাদাভাস্করকে যাহা মুখে আসে, বলিতে পারি, কিন্তু আপনাকে আমি যাহা তাহা বলিতে পারি না। এবার যদি কাহাকে গ্রেপ্তার করেন, আর সে খালাস হইয়া যায়, তাহা হইলে আপনাকে বাধ্য হইয়া পেন্সন লইতে হইবে কিনা? আর আমাকেও চাকরী ছাড়িয়া পলাইতে হইবে কি না, ভাবিয়া দেখুন দেখি, ব্যাপারটা হইতেছে কি, আমাদের সকলেরই যে একদম মাথাকাটা যাইতেছে। শুনিতেছি আবার, রস্তমজীর কে একজন পিতৃবন্ধু—নাম কাশীনাথ নায়েক, বয়সে বৃদ্ধ, তিনি নাকি রস্তমজীকে নির্দোষ সপ্ৰমাণ করিবার জন্য খুব চেষ্টা করিতেছেন। শুনিয়াছি, তিনি অনেকদূর অগ্রসরও হইয়াছেন, তাঁহার দ্বারাই যদি এই কেসটা হাসিল হইয়া যায়, তাহা হইলে আমাদের তিনজনেরই মুখে চুণ-কালী পড়িবে না কি? আমরা কি আর মুখ তুলিতে পারিব?

লালুভাই বলিলেন, “আমরা কি করিব বলুন, প্রাণপণে চেষ্টা করিতেছি—কাজে কিছুই করিয়া উঠিতে পরিতেছি না।”

কীর্ত্তিকর বলিলেন, “তাহারই নাম অকৰ্ম্মণ্যতা।”

দাদাভাস্কর বলিলেন, “সেই কাশীনাথ নায়েকের সঙ্গে একবার দেখা করিলে হয় না? তাঁহার কথা কই পূৰ্ব্বে ত শুনি নাই, এই আপনার মুখে প্রথম শুনিলাম। আচ্ছা, আজই আমি একবার তাঁহার সঙ্গে দেখা করিব—তিনি কতদূর কি করিয়াছেন, সে কথাগুলা তাঁহার নিকট হইতে বাহির করিয়া লইব।”

কীর্ত্তিকর রুক্ষস্বরে বলিলেন, “তাহা হইলেই খুব বাহাদুরী হইল আর কি! নিজে পুলিস লাইনে এতগুলা বৎসর অতিবাহিত করিয়া কিছুই করিতে পারিলে না, আর একজন বাজে লোকের দোহাই দিয়া এখন এই পুলিস-মালার কিনারা করিতে হইবে! লোকে ইহা জানিলে বলিবে কি?”

দাদা। লোকে জানিবে কি করে? ছদ্মবেশে।

কীর্ত্তি। আরও দুই-চারিদিন যাইতে দাও—যখন একান্ত না পারিবে—তখন তাঁহারই দোহাই দিয়া কার্য্যোদ্ধার করিয়ো।

লালু। তবে এখন আমরা কি করিব, বলুন।

কীর্ত্তি। সেই বিষয়ের আলোচনার জন্য আপনাকে ডাকিয়াছি।

দাদা। মাষ্টার যাহা হুকুম করিতেছেন, তাহাই ত আমরা করিতেছি। আপনি ওরূপ না করিলে রস্তমজী কিছুতেই খালাস হইতে পারিত না।

কীৰ্ত্তি। দাদাভাস্কর, দোষী হউক, আর নিদোষী হউক, জেলে বা ফাঁসী-কাঠে ঝুলাইতে পারিলেই হইল, ইহা পুলিসের কাজ নহে। তোমাদের পুনঃপুনঃ বলিয়াছি, আবার বলিতেছি, দোষী যাহাতে দণ্ড পায়, তাহা দেখা যেমন পুলিসের কর্ত্তব্য—নিদোষী যাহাতে কোনরূপে দণ্ডিত না হয়, তাহা দেখাও সেইরূপ কত্তব্য। যে পুলিস-কর্ম্মচারী ইহা না করে-সে পাষণ্ড। এবং তাহারা মানুষ হইলে তাহাদের ভিতরে মনুষ্যত্ব নামক পদার্থের একান্ত অভাব জানিবে।

দাদা। মাষ্টার, আমি এ কথা সৰ্ব্বদাই মনে রাখি।

কীৰ্ত্তি। তাহাই ত এইমাত্র তোমার কথায় জানিতে পারিলাম।

লালু। যাহাই হউক, এখন কি করিব, বলুন।

কীৰ্ত্তি। বাজে কথায় সময় নষ্ট করিয়া ফল নাই। বর্জরজী ও মাঞ্চারজীর বিষয় অনুসন্ধান করাই এখন আমাদের প্রধান কাজ।

দাদা। সে কাজেই ত বেটার চাকর পর্য্যন্ত হইয়াছিলাম। তেমন বদমাইসের চাকর হওয়া সহজ ব্যাপার নয়।

কীৰ্ত্তি। হাঁ, কিন্তু জানিলে কি?

দাদা। জানিলাম, বেটা একটি ভয়ানক বদমাইস।

কীর্ত্তি। ব্যাস্—তবেই আর কি। তাহাতে চুরির বা খুনের কি সন্ধান হইল?

দাদা। তাহা হইলে আপনি কি মনে করেন যে, এই বেটাই সব করেছে—যত নষ্টের মূল?

কীর্ত্তি। আবার সেই ‘মনে করা’। আমি দুশোবার তোমাকে বলিয়াছি যে, আমি কিছুই মনে করি না।

দাদা। এর বিরুদ্ধে কোন প্রমাণ নাই।

কীর্ত্তি। মাঞ্চারজীর বিরুদ্ধে?

দাদা। কিছু আছে।

কীর্ত্তিকর। কি?

দাদা। সে সেই রাত্রে রস্তমজীর সঙ্গ লইয়াছিল।

কীর্ত্তিকর মহা উৎসাহের সহিত বলিয়া উঠিলেন, “বহুৎ আচ্ছা, দাদাভাস্কর, বহুৎ আচ্ছা! চেষ্টা ও যত্ন থাকিলে, তুমি এক সময়ে ডিটেটিভ লাইনে উন্নতি করিতে পারিবে।”

দাদাভাস্কর নতমস্তকে কহিলেন, “সে গুরুদেবের আশীৰ্ব্বাদ।”

লালুভাই বলিলেন, “আপনি বলিলেন, এই দুইজন লোকের উপর নজর রাখিতে; আপনার কথা মত তাহাই করা যাক।”

কীর্ত্তিকর বলিলেন, “আমি ইহাদের সংবাদ যাহা যাহা জানিয়াছি, তাহা আপনাদিগকে বলি, ইহাতে আপনাদের অনুসন্ধানের কিছু কিছু সাহায্য হইবে।”

নবম পরিচ্ছেদ – রাজাবাঈ সম্বন্ধে

কীর্ত্তিকর টেবিলের উপর হইতে এক বাণ্ডিল কাজ টানিয়া লইয়া বলিলেন, “হরমসজীর স্ত্রী রাজাবাঈ সম্বন্ধে সুরাটের পুলিস কি লিখিয়াছেন, শুনুন।”

দাদা। আপনি তবে এ সন্ধান করিবার জন্য সুরাটের পুলিসকে লিখিয়াছিলেন?

কীৰ্ত্তি। হাঁ, রাজাবাঈ-এর পূর্ব্ববৃত্তান্ত জানিতে পারিলেই সম্ভবতঃ জানা যাইবে, কেন সে বর্জরজীকে এত ভয় করে।

দাদা। তা ত নিশ্চয়।

কীর্ত্তি। সুরাটের পুলিস লিখিতেছে;

“সুরাটের ডোসাভাই নামক এক ব্যক্তির দুইটি কন্যা ছিল। রাজাবাঈ তাহার এক কন্যা। ডোসাভাই সামান্য একটি দোকান চালাইয়া সংসার-যাত্রা নির্ব্বাহ করিত। অতি কষ্টে কোন গতিকে তাহাদের দিনাতিবাহিত হইত।

“রাজাবাঈ-এর বয়স পনের বৎসর হইলে তাহার সহিত তাহাদিগের বাড়ীর নিকটস্থ ধনাঢ্য জেমসেটজীর পুত্র হরেকজীর বড় সম্প্রীতি জন্মে। হরেকজী বড়লোক, সম্ভবতঃ তিনি রাজাবাঈকে বিবাহ করিতে পারেন ভাবিয়া রাজাবাঈ-এর পিতা ইহাতে কোন কথা কহিতেন না। যাহাই হউক, হরেকজীর সহিত রাজা বাঈ এর বিবাহ হইল না।

জেমসেটজীর মৃত্যু হইলে হরেকজী অতুল ধনের অধিপতি হইলেন। অনুসন্ধানে জানা গিয়াছে, রাজাবাঈ-এর পিতা তাঁহাকে অনেক গালি-গালাজ দিতেন এবং প্রকাশ্যভাবে তাঁহাকে সয়তান পাষণ্ড বলিতেন। সে কারণেই হউক, হরেকজী কনিষ্ঠ বর্জরজীর উপর বিষয়-সম্পত্তির ভার দিয়া কলিকাতায় চলিয়া যান, আর কখনও সুরাটে প্রত্যাগমন করেন নাই।

“এই সকল ঘটনার এক বৎসর পরে হরমসজীর সহিত রাজাবাঈ-এর বিবাহ হয়। হরমসজী বোম্বে সহরে ব্যবসা-বাণিজ্য করিয়া কিছু অর্থ সঞ্চয় করিয়াছিলেন। তিনি স্বদেশে বিবাহ করিতে স্থির করিয়া সুরাটে আসিলেন। শেষে রাজাবাঈকে বিবাহ করিয়া লইয়া আবার বোম্বে ফিরিয়া যান। সেই পর্য্যন্ত রাজাবাঈ আর সুরাটে আসে নাই।

“তাঁহার বিবাহের এক বৎসর পরে রাজাবাঈ-এর অপর ভগ্নীর বিবাহ হয়। তাঁহাকে লইয়া তাঁহার স্বামী রেঙ্গুণে ব্যবসা করিতে গমন করেন। কিন্তু সেইখানে গিয়া তাঁহাদের উভয়েরই বিসূচিকা রোগে মৃত্যু হয়। এই সংবাদ পাইয়া তাঁহাদের শোকে রাজাবাঈ-এর পিতাও কালগ্রাসে পতিত হইয়াছিলেন।

“অনেক অনুসন্ধান করা হইয়াছে, রাজাবাঈ-এর ভগ্নীর যে কোন সন্তানাদি হইয়াছিল, এমন কোন সন্ধান পাওয়া যায় নাই। এর অনুসন্ধানে যতদূর জানা গিয়াছে, তাহাতে বোধ হইতেছে যে, রাজাবাঈ-এর পিতার রাজাবাঈ ও হরমসজী ব্যতীত আর কোন আত্মীয় স্বজন জীবিত নাই।

“বর্জরজী অতুল সম্পত্তির মালিক হইয়া দুই হস্তে ধূলি-মুষ্টির ন্যায় স্বর্ণ-মুষ্টি উড়াইতে থাকেন। বোধ হয়, দুই তিন বৎসরেই তিনি তাঁহার অংশের সমস্ত সম্পত্তি উড়াইয়া দিয়াছিলেন। পরে নানারূপ জাল জুয়াচুরি করিয়া বড়-মানুষী চাল চালাইতেছিলেন; কত লোকের যে সর্ব্বনাশ করিয়াছিলেন, তাহার স্থিরতা নাই। কত ঋণ করিয়াছিলেন, তাহাও স্থির বলা যায় না।

“গত কয়েক বৎসর হইতে পুলিস তাঁহার উপরে বিশেষ দৃষ্টি রাখিয়া ছিলেন; কিন্তু বিশেষ কোন প্রমাণ না পাওয়ায় তাঁহাকে গ্রেপ্তার করিতে পারা যায় নাই। দুই বৎসর হইল সহসা তিনি সুরাট পরিত্যাগ করিয়া যান। সুরাটে আর থাকা তাঁহার পক্ষে অসাধ্য হইয়াছিল।

“তাঁহার অন্তর্দ্ধানের পরে তাঁহার নামে অনেক নালিশ হইয়াছিল; কিন্তু তাঁহার অনেক অনুসন্ধান সত্বেও তাঁহার আর কোন সন্ধান পাওয়া যায় নাই। এখনও তাঁহার নামে দুই-তিনখানি ওয়ারেন্ট পুলিসের হস্তে আছে।”

সুরাট পুলিসের রিপোর্টটি পাঠ করিয়া কীর্ত্তিকর বলিলেন, “এখন কতক বুঝিলেন?”

দাদা। আমাদের বর্জরজী, যে সেই বর্জরজী, তাহার প্রমাণ কি?

“আছে”, বলিয়া কীর্ত্তিকর টেবিলের মধ্য হইতে একখানি ফটোগ্রাফ বাহির করিলেন; বলিলেন, “দেখ দেখি, এইখানা কাহার ফটোগ্রাফ বলিয়া বোধ হয়?”

উভয়েই দেখিয়া বলিলেন, “হাঁ, এখানা নিশ্চয়ই বর্জরজীর ফটোগ্রাফ, তবে সে নিজের চেহারা এখন অনেকটা বদ্‌লাইয়া ফেলিয়াছে।”

কীৰ্ত্তি। হাঁ, যাহা হউক, এ যে তাহারই ফটোগ্রাফ তাহাতে সন্দেহ নাই। আমি সুরাট পুলিসের রিপোর্ট পাইয়া তাহাদের বর্জরজীর কোন ফটোগ্রাফ যদি থাকে, তবে তাহা পাঠাইয়া দিতে লিখিয়াছিলাম।

দাদা। এ না হইলে আপনি এত বড় হইবেন কেন?

কীৰ্ত্তি। বাজে কথা কহিয়ো না। এখন বর্জ্যরজীর কতক সন্ধান পাইলে? এ আগে হইতেই রাজাবাঈকে জানিত

দাদা। স্পষ্ট ইহাও জানা যাইতেছে যে, ছেলেবেলায় রাজাবাঈ-এর সহিত বর্জরজীর দাদার প্রণয়ও ছিল।

কীৰ্ত্তি। সম্ভবতঃ কুসম্বন্ধও ঘটিয়াছিল।

দাদা। চোখ খুলিয়া গিয়াছে। ওঃ! এখন কি জন্য রাজাবাঈ তাহাকে ভয় করে, তাহা স্পষ্ট বুঝা যাইতেছে। বদমাইস তাহার স্বামীকে তাহার গতজীবনের কুকীর্ত্তি বলিয়া দিবার ভয় দেখাইয়া তাহাকে হাত করিয়াছে—ভয় দেখাইয়া টাকা লইতেছে।

কীৰ্ত্তি। ব্যস্ত হইয়ো না। এখন কলিকাতার পুলিস কি লিখিতেছে, শুন।

দাদা। কলিকাতায়ও আপনি পত্র লিখিয়াছিলেন? বুদ্ধি থাকিলে ঘরে বসিয়া কেল্লা মারা যায় দেখিতেছি। আপনার বুদ্ধির কাছে আমরা গাধাই বটে।

কীর্ত্তিকরের চক্ষু জলিয়া উঠিল। বিরক্তির সহিত কহিলেন, “তুমি নিজের কথাই বল, ‘আমরা’ বলিয়া লালুভাইকে জড়াইয়ো না। লালুভাই বয়সে আমার অপেক্ষা অনেক বড়। দুই-একটা কাজে তাঁহার ভুল হইলেও তিনি আমার নিকটে সম্মান।

দশম পরিচ্ছেদ – হরেকজী সম্বন্ধে

কীর্ত্তিকর আর একটি বাণ্ডিল টানিয়া বাহির করিলেন; বলিলেন, সুরাটের রিপোর্ট পাইয়া আমি হরেকজীর সন্ধান লইবার জন্য কলিকাতা পুলিসকে লিখিয়াছিলাম। সেখানে পার্শীর সংখ্যা খুব কম, তাহাদের মধ্যে একজন পার্শীর সন্ধান লওয়া কঠিন নহে।

দাদা। তাহারা কি লিখিয়াছে?

কীর্ত্তি। শোন, তাহারা কি লিখিতেছে;—

“প্রায় বিশ বৎসরের অধিক হইল, সুরাটের ধনাঢ্য বণিক জেমসেটজীর পুত্র হরেকজী কলিকাতায় আসিয়া বাস করেন। তিনি বিশেষ জাক্-জমকে থাকিতেন না; তাঁহার বন্ধু-বান্ধব ও অধিক ছিল না। তিনি দুই-তিন বৎসর কলিকাতায় থাকিবার পর একটি বসস্থা স্ত্রীলোক একটি চারি-পাঁচ বৎসর বয়স্ক বালক লইয়া তাঁহার বাড়ীতে বাস করে। অনুসন্ধানে জানা গিয়াছে যে, হরেকজী এই স্ত্রীলোকটিকে তাঁহার বিশেষ আত্মীয়া বলিয়া পরিচয় দিয়াছিলেন। বালকটি এই স্ত্রীলোকেরই একমাত্র পুত্র। বিধবা হওয়ায় রমণী হরেকজীর নিকটে আসিয়া ছিলেন।

“হরেকজী বিবাহ করেন নাই, সুতরাং এই বিধবা তাঁহার বাটীতে থাকায় অনেকে অনেক কথা কহিত। তিনি যেরূপ ছেলেটিকে ভালবাসিতেন, তাহাতে অনেকে ভাবিয়াছিল যে, ছেলেটি তাঁহারই ঔরসজাত।

যাহাই হউক, এই স্ত্রীলোক ও এই বালক হরেকজীর মৃত্যু পর্যন্ত তাঁহার বাড়ীতে ছিল। প্রকৃতপক্ষে বালকটি হরেকজীর দত্তক-পুত্র রূপেই তাঁহার বাড়ীতে বাস করিত।

“হরেকজীর অর্থের অভাব ছিল না। তিনি বালকের জন্য যথেষ্ট খরচ করিতেন; কাজেই বালক যৌবনে পদার্পণ করিয়া ক্রমেই চরিত্রহীন হইয়া পড়িল। অনুসন্ধানে জানা গিয়াছে, তাহার চরিত্র নিতান্তই খারাপ হইয়া গিয়াছিল। তাহার বয়ঃক্রম এখন প্রায় চব্বিশ বৎসর হইবে। ইহার নাম মাঞ্চারজী।

“তিন বৎসর হইল, একটি পার্শী ভদ্রলোক আসিয়া হরেকজীর বাড়ীতে বাস করিতে থাকেন। হরেকজী ইহাকে মাঞ্চারজীর শিক্ষক বলিয়া সকলকে পরিচয় দেন।

“এই পার্শীর আগমনের একমাস পরেই সহসা হরেকজীর মৃত্যু হয়। অনেকেই সেই সময়ে অনুমান করিয়াছিলেন যে, হরেকজীর স্বাভাবিক মৃত্যু হয় নাই; নিশ্চয়ই কেহ তাঁহাকে বিষ খাওয়াই মারিয়াছে, কিন্তু কোন প্রমাণ না পাওয়ায় পুলিস কিছুই করিতে পারে নাই।

“হরেকজীর মৃত্যুর পর যুবক মাঞ্চারজী, সেই স্ত্রীলোক ও মাঞ্চারজীর মাষ্টার, এই তিনজনে হরেকজীর বাড়ীতেই বাস করিতে থাকেন। মাঞ্চারজী পূর্ব্বে যেরূপ খরচ করিত, এক্ষণে তাহাপেক্ষা শতগুণে অধিক খরচ করিতে লাগিল। তাহার ব্যয়ের সীমা ছিল না।

“অনুসন্ধানে জানা গিয়াছে, হরেকজীর মৃত্যুর পর দুই বৎসর যাইতে না যাইতে মাঞ্চারজী তাহার সমস্ত বিষয়-সম্পত্তি উড়াইয়া দিয়াছিল। শেষে তাহাদের কেবল ঋণের উপর চলিতেছিল। তাহার নামে দুই একটি নালিশও হইয়াছিল।

“অনুসন্ধানে আরও জানা গিয়াছে যে, মাঞ্চারজীর মাষ্টারটি ভাল লোক নহেন। তিনি নাকি দুই-একটা গুরুতর জাল জুয়াচুরিও করিয়াছিলেন, কিন্তু কোন প্রমাণ পাওয়া যায় নাই।

“এক বৎসর হইল, মাঞ্চারজী তাহার মাষ্টারকে লইয়া কলিকাতা ত্যাগ করিয়া গিয়াছে। অনুসন্ধানে জানিলাম, সে বোম্বে বেড়াইতে গিয়াছে, সম্ববতঃ সে সেইখানেই এখন আছে।

“সেই স্ত্রীলোকটি এখনও হরেকজীর বাড়ীতেই বাস করিতেছে। তাহার বয়স এখন অনেক হইয়াছে। জিজ্ঞাসা করিলে কোন কথা বলিতে চাহে না। তবে মাঞ্চারজীকে নিমকহারাম প্রভৃতি বলিয়া গালি দেয়। মাষ্টারের কথা তাহাকে জিজ্ঞাসা করা হইয়াছিল, তাহাতে সে বলিয়া উঠিয়াছিল, ‘মাষ্টার—মাষ্টার ওর বাবা।

“যদি এ সম্বন্ধে আরও কোন সন্ধান লইতে চাহেন, তবে ওখান হইতে একজন সুদক্ষ ডিটেক্‌টিভ পাঠাইলেই ভাল হয়। স্বভাবতই তিনি পার্শী সমাজ ভালরূপ অবগত আছেন, সুতরাং সকল সংবাদ সহজে ও শীঘ্র সংগ্রহ করিতে পারিবেন।”

পাঠ শেষ করিয়া কীর্ত্তিকর বলিলেন, “আমাদের বর্জরজীর আরও কিছু সংবাদ পাইলে?”

দাদা। কই, মাঞ্চারজীর পাওয়া গেল বটে।

লালুভাই। তোমার মত লোকের বুঝিবার কার্য্য নয়। এটাও বুঝিলে না যে, মাষ্টারটিই বর্জরজী।

দাদা। হাঁ, তাই ত!

কীর্ত্তি। হরেকজীর স্বাভাবিক মৃত্যু হয় নাই, সম্ভবতঃ বিষে মৃত্যু হইয়াছে; বর্জরজী ভাইএর বাড়ী উপস্থিত হইবার দুই মাসের মধ্যেই তাহার মৃত্যু হইয়াছে—

দাদা। কি ভয়ানক, বেটা কি তবে নিজের ভাইকে খুন করেছিল?

কীৰ্ত্তি। হাঁ, নিশ্চয়ই। ভাইকে খুন না করিলে তাহার বিষয় হস্তগত হয় কিসে?

দাদা। আর সেই ভাই পাছে পুলিসে ধরে বলিয়া ভাইকে মাষ্টার সাজাইয়া নিজের বাড়ীতে লুকাইয়া রাখিয়াছিল। বেটাকে সাত বার ফাঁসী দিলেও যে রাগ যায় না!

কীর্ত্তি। তাহার বিরুদ্ধে সে খুনের কোন প্রমাণ নাই।

দাদা। না থাকে, এ খুনের প্রমাণ হবে।

কীর্ত্তিকর হাসিয়া বলিলেন, “দাদাভাস্কর, বিনা প্রমাণ সংগ্রহ করিয়া কাহারও নামে কিছু বলিয়ো না। সম্প্রতিই ত এই হঠকারিতার জন্য তোমাকে যথেষ্ট লজ্জিত হইতে হইয়াছে— লালুভাইও বাদ পড়েন নাই। রস্তমজীকে যদি গ্রেপ্তার না করিয়া, তাঁহার উপর সতর্ক দৃষ্টি রাখিয়া কেবল প্রমাণ সংগ্রহের চেষ্টা করা হইত, তাহা হইলে এরূপ ঢলাঢলিটা আর হইত না— অথচ সকল দিক্ বজায় থাকিত।”

কীর্ত্তিকর আর একটি বাণ্ডিল বাহির করিলেন। দেখিয়া দাদাভাস্কর বলিলেন, “এটাতে আবার কার রিপোর্ট? দেখিতেছি, আরও একটা বাণ্ডিল আছে?”

কীর্ত্তি। হ্যাঁ, আরও একটা আছে। এটা পেষ্টনজী সম্বন্ধে রিপোর্ট।

লালুভাই। পেষ্টনজীর পূর্ব্ব ইতিহাস জানিতে পারিলে খুন কে করিয়াছে, তাহার কতক সন্ধান হইতে পারে।

কীর্ত্তিকর। হা, এই জন্যই পেষ্টনজীর সন্ধান লইতে রেঙ্গুণ পুলিসকে অনুসন্ধান করিতে লিখিয়াছিলাম। পেষ্টনজী রেঙ্গুণ হইতে হরমসজীর নিকট পত্র লইয়া আসিয়াছিল।

দাদা। সে সন্ধান আমি পাইয়াছিলাম।

একাদশ পরিচ্ছেদ – পেষ্টনজী সম্বন্ধে

কীর্ত্তিকর বলিলেন, “শোন, পুলিস কি রিপোর্ট করিতেছে। তাহারা আমার পত্রের উত্তরে লিখিতেছে;

“পেষ্টনজী এখানে একজন সম্ভ্রান্ত ব্যবসায়ী ছিলেন এবং এখনও আছেন। পেষ্টনজী এণ্ড কোম্পানি বহুদিনের সম্ভ্রান্ত ফার্ম্ম। ইঁহাদের কাজকৰ্ম্ম খুবই বিস্তৃত।

“কয়েক বৎসর হইল, পেষ্টনজীর পিতার মৃত্যু হইয়াছে। তদবধি তিনিই ফার্ম্মের কাজ দেখিতেছেন।

“গুপ্ত অনুসন্ধানে জানিলাম, পেষ্টনজীর বরাবরই একটি করিয়া রক্ষিতা স্ত্রীলোক আছে। কয়েক বৎসর হইতে একটি মারাঠী স্ত্রীলোক তাঁহার রক্ষিতা আছে। ইহার দাসীর নিকটে জানিতে পারিলাম, স্ত্রীলোকটী যদিও মারাঠী বেশ পরিধান করে, তাহা হইলেও সে মারাঠী নয়; সম্ভবতঃ সে পার্শী। আরও জানতে পারা গিয়াছে যে, পেষ্টনজীর ঘোড়দৌড়ের সখ অতিশয় প্রবল আছে। অনুসন্ধানে জানা গিয়াছে, যে, তিনি ঘোড়দৌড়ে অনেক টাকা বাজি ধরিতেন।

“কয়েক বৎসর হইতে তিনি হারিয়াই আসিতেছেন। বোধ হয়, অনেক টাকা হারিয়াছেন। ইহাতে তাঁহার ফার্ম্মের অবস্থা খারাপ হইয়া গিয়াছে। গত এক বৎসর হইতে তাঁহার ফার্ম্ম একরূপ বন্ধ, বাজারে দেনাও অনেক। শীঘ্র কিছু টাকা কোন রূপে সংগ্রহ করিতে না পারিলে তাঁহার বা তাঁহার ফার্ম্মের রক্ষা পাইবার কোনই উপায় নাই। তাঁহার অবস্থা অতি সঙ্কটাপন্ন।

“কয়েকমাস গত হইল, তিনি বোম্বে গিয়াছেন। শোনা যায়, বোম্বের প্রধান ব্যাঙ্কার হরমসজীর কন্যাকে বিবাহ করিবার উদ্দেশ্যেই বোম্বে গিয়াছেন। যদি হরমসজীর কন্যার সহিত তাঁহার বিবাহ হয়, তাহা হইলে তাঁহার আর ভয় নাই—তিনিই হরমসজীর অতুল সম্পত্তির অধিপতি হইবেন।

“প্রায় তিনমাস হইল, তাঁহার রক্ষিতা মারাঠী রমণীটিও নিরুদ্দেশ হইয়াছে। কেহ তাহার কোন সন্ধান বলিতে পারে না। পেষ্টনজী বোম্বে যাত্রা করিবার মাসখানেক পরেই সে তাহার বাড়ী হইতে চলিয়া গিয়াছে।

“আপনি যাহা যাহা জানিতে চাহিয়াছিলেন, আশা করি, তাহা সমস্তই বলা হইয়াছে। এতদ্ব্যতীত আর যদি কিছু জানিতে চাহেন, আমরা আনন্দের সহিত তাহা আপনাকে জানাইব।” বাণ্ডিলটি ধীরে ধীরে বাঁধিয়া কীর্ত্তিকর জিজ্ঞাসা করিলেন, “দাদাভাস্কর কি বুঝিলে?” দাদা। পেষ্টনজী কমলাকে বিবাহ করিবার চেষ্টায় বোম্বে আসিয়াছিল।

কীর্ত্তিকর। কি পণ্ডিত! সে কথা ত তাহারাই লিখিয়াছে।

লালুভাই। ওঁর বুঝিবার বিলম্ব আছে। যে স্ত্রীলোকটি মরিয়াছিল এবং যাহার নিকটে খুনের রাত্রে রস্তমজী গিয়াছিলেন, সে পেষ্টনজীর রক্ষিতা, সেই মারাঠী স্ত্রীলোক।

কীর্ত্তিকর। সে পত্র তাহার বাক্সে আপনি পাইয়াছেন, তাহাতে সে ত তাহা বলিয়াছে।

লালুভাই। হাঁ, আরও জানা যাইতেছে, এই স্ত্রীলোকটি প্রকৃত পক্ষে মারাঠী নহে, পার্শী- আর এ হরমজীর বিবাহিত স্ত্রী ছিল।

কীৰ্ত্তি। এ সব ত পূৰ্ব্বেই জানা গিয়াছে। এখন নূতন কি জানিলেন?

লালুভাই। নূতন এই যে হরমসঙ্গী নিজের মেয়ের বিবাহ তাহার সঙ্গে দিতে অসম্মত হইলে, সে তাহার পূর্ব্ব বিবাহের কথা বলিয়া ভয় দেখায়। বলে, “দেখ, যদি তোমার মেয়ের বিবাহ আমার সঙ্গে না দাও, তবে তোমার অপদস্থ করিব—তুমি জেলে যাইবে। জানই ত এক থাকিতে আর এক বিবাহ করিলে পার্শীর জেল হয়।”

দাদা। এই মহা সঙ্কটে পড়িয়া, হরমসজী নিজের বিবাহের সার্টিফিকেটখানি পেষ্টনজীর নিকট হইতে যে কোন প্রকারে হস্তগত করিতে ব্যগ্র হয়েন। তার পর এই ক্লোরাফর্ম্ম ও খুন

কীর্ত্তিকর। দাদাভাস্কর, পেষ্টনজীর সহিত বর্জরজীর বিষয়ও বিবেচনা কর। পেষ্টনজী ও সর্ব্বস্বান্ত হইয়া টাকার চেষ্টায় হরমসজীর নিকট আসিয়াছিল, বর্জরজীও মাঞ্চারজীকে লইয়া হরমসজীর নিকট হইতে টাকার চেষ্টায় আসিয়াছিল। পেষ্টনজী প্রাণ হারাইল। বর্জরজী অনেক টাকা পাইয়াছে ও পাইতেছে। গণেশমলের গদীতে রাজা বাঈএর গহনা বাঁধা দেখিয়াই তাহা স্পষ্ট বোঝা যায়।

দাদা। হরমসজী খুন করিয়াছে, ইহা কি আপনার বিশ্বাস হয় না?

কীর্ত্তিকর। হরমসজীই কি নিজের টাকা নিজে চুরি করিয়াছে?

দাদা। না—তার স্ত্রী।

কীর্ত্তিকর। আচ্ছা, এ বিষয় পরে আলোচনা করিব। এখন আর একটা রিপোর্ট শুন।

দ্বাদশ পরিচ্ছেদ – রতনবাঈ সম্বন্ধে

কীৰ্ত্তিকর আর একটি বাণ্ডিল টানিয়া লইলেন। বলিলেন, “এটি রতনবাঈ-এর ইতিহাস।”

দাদা। সে এখন কোথায়? আপনি ত আমার চোখে ধূলো দিয়া তাহাকে সরাইয়াছিলেন। সে হাতে থাকিলে আমি অনেক সন্ধান পাইতাম।

কীৰ্ত্তি। সে আমাকে অনেক সাহায্য করিতেছে।

দাদা। কাজেই; যাহার দ্বারা কাজ হইবে, তাহাকে আমাদের হাত হইতে কাড়িয়া লইয়া, তাহার পর আমাদের গাধা বলা ন্যায়সঙ্গত সন্দেহ নাই।

কীর্ত্তি। তোমার হাতে সে থাকিলে, তুমি তাহাকে দিয়া কোন কাজই করিতে পারিতে না।

দাদা। হাতে পাইতাম—তাহা হইলে বুঝিতাম।

লালু। আপনি অনেক কথা তাহারই নিকটে জানিতে পারিয়া ছিলেন; আমরা কিরূপে জানিতে পারিব?

কীর্ত্তি। আপনারা চেষ্টা করেন নাই কেন?

দাদা। কিরূপে করিব? আপনি তাহাকে একেবারে কোথায় অদৃশ্য করিয়া দিলেন, কিছুই জানিবার যো নাই।

কীৰ্ত্তি। আচ্ছা, সে সব কথা পরে হইবে। এখন রতনবাঈ-এর কথা কিছু শোন।

দাদা। তাহার কথা শুনিয়া লাভ কি?

কীৰ্ত্তি। পরে বুঝিতে পারিবে।

দাদা। পড়ুন, শুনি।

কীর্ত্তিকর পাঠ করিতে লাগিলেন; “রতনবাঈ-এর যখন দশ এগার বৎসর বয়স, তখন একজন মারাঠী স্ত্রীলোক গঙ্গাবাঈ নামে একটি গুজরাটি স্ত্রীলোকের নিকটে তাহাকে বোম্বে রাখিয়া অন্যত্রে চলিয়া যায়। বোধ হয়, তাহার লালন-পালনের জন্য কিছু টাকাও সে তাহাকে দিয়া গিয়াছিল; কিন্তু গঙ্গাবাঈ সে টাকার এক পয়সাও খরচ করিত না। তাহাকে দিয়া ভিক্ষা করাইত। কোনদিন ভিক্ষায় কিছু না পাইলে তাহাকে নিষ্ঠুরভাবে প্রহার করিত।

“রতন বাঈ দেখিতে বড় সুন্দরী ছিল, ইহার উপর তাহার গলা বড় সুমিষ্ট। সে আপনা-আপনি শুনিয়া বেশ গান গাইতে পারিত; সুতরাং প্রত্যহ সে ভিক্ষায় বাহির হইয়া বিস্তর পয়সা পাইত। ঘটনাক্রমে একদিন রস্তমজী তাহাকে দেখিতে পান। তিনি তাহার মুখে তাহার দুঃখের বৃত্তান্ত শুনিয়া বড়ই দয়ার্দ্র হন। তিনি গঙ্গাবাঈ-এর সহিত দেখা করেন, তাহাকে আর ভিক্ষায় পাঠাইতে নিষেধ করেন। তাহার ভরণ পোষণের জন্য তিনি মাসে মাসে টাকা দিতে প্রতিশ্রুত হন। তিনি গঙ্গাবাঈকে রতনের জন্য নিয়মিত টাকা দিতেন; কিন্তু গঙ্গাবাঈ সে টাকা সমস্তই আত্মসাৎ করিত। তাহাকে তবুও বড় কষ্ট দিত। এইরূপে আরও পাঁচ-ছয় বৎসর অতিবাহিত হইল, যৌবন-লাবণ্যে রতনবাঈ-এর সর্ব্বাঙ্গ ভরিয়া উঠিল। পাপিয়সী গঙ্গাবাঈ সুযোগ বুঝিয়া পয়সার লোভে লোভে তাহাকে পাপপথে লইয়া যাইবার চেষ্টা পাইতে লাগিল। রতনবাঈ এ কথা কখন রস্তমজীকে বলে নাই। রস্তমজী তাহাকে নিজ সহোদরা ভগ্নীর ন্যায় ভালবাসেন; কিন্তু রতনবাঈ তাঁহাকে হৃদয়ের অধিষ্ঠাতা দেবতা করিয়াছিল।

“সহসা রতনবাঈ এক দিবস অন্তর্হিতা হইল। গঙ্গাবাঈ প্রাতে উঠিয়া দেখিল যে, রতনবাঈ গৃহে নাই। অনেক অনুসন্ধান করিল, কোথায়ও তাহাকে পাইল না। রস্তমজীও তাহার অন্তর্ধানে হৃদয়ে বড়ই বেদনা পাইলেন। তিনি তাহার অনেক অনুসন্ধান করিয়াছিলেন, কিন্তু কিছুতেই রতনবাঈ-এর সন্ধান পাওয়া গেল না। সে নিশ্চয়ই বোম্বে সহর পরিত্যাগ করিয়া চলিয়া গিয়াছিল।

“এক বৎসর হইল, রস্তমজী এক হাসপাতাল হইতে এক পত্র পাইলেন। হাসপাতালে একটি মুমূর্ষু রমণী তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিতে চাহে, এই সন্ধান পাইয়া তিনি হাসপাতালে গিয়াছিলেন।

“প্রায় ছয় বৎসর পরে তিনি নানা পীড়ায় পীড়িতা কঙ্কালসার রতনবাঈকে হাসপাতালের খট্টায় শায়িতা দেখিলেন। সে তাঁহাকে দেখিল; তখন তাহার কথা কহিবার শক্তি ছিল না। রস্তমজীকে দেখিয়া কেবল তাহার দুই চক্ষু দিয়া দরবিগলিত ধারে অশ্রু বহিতে লাগিল। রস্তমজীও চক্ষুর জল সম্বরণ করিতে পারিলেন না। তিনি সেইদিনই তাহার জন্য একটি বাটী ভাড়া করিলেন। তাঁহাকে পাইয়া রুগ্না রতনবাঈ-এর পীড়া দিন দিন কমিতে লাগিল। ডাক্তারেরা যেদিন বলিলেন, যে এখন তাহাকে হাসপাতাল হইতে লইয়া যাইতে পারা যায়, সেই দিনই তিনি তাহাকে সেই বাটীতে লইয়া আসিলেন। দিনে দিনে রতনবাঈ আরোগ্য লাভ করিয়া উঠিল। তাহার পূর্ব্বের সৌন্দর্য্য ফিরিয়া আসিল। এই সময়ে রস্তমজী হরমসজীর বাটী হইতে দূরীভূত হইলেন; কাজেই তিনি এখন সময় পাইলেই রতনবাঈ-এর গৃহে বিশ্রাম করিতেন। যাহাতে রতনবাঈ সুখী হয়, তাহাই তিনি করিতে লাগিলেন। ভাল ভাল বহুমূল্য আবাবে তাহার বাড়ী সজ্জিত করিলেন। সুন্দর সুন্দর বেশভূষায় তাহাকে সাজাইলেন। সর্ব্বদাই রতনবাঈ এর বাড়ী আমোদ-প্রমোদের প্রবাহ ছুটিল, সকলেই জানিত, রতনবাঈ রস্তমজীর রক্ষিতা।”

সহসা কীর্ত্তিকর মাথা তুলিয়া বলিলেন, “এই পর্য্যন্ত, তাহার পর দাদাভাস্কর তুমি সুকৌশলে তাহাকে তোমার বাড়ী লইয়া যাও; তাহার পর যাহা হইয়াছিল, তাহা ত তুমি বেশ জান।”

দাদা। বেশ জানি, দাদাভাস্করকে গাধা বানাইয়া তাহার পর আপনি তাহাকে নিজের হাতে রাখিয়াছেন।

কীৰ্ত্তি। সে আমার নিকটে নাই। সে এখন হরমসজীর বাড়ীতে কমলাবাঈ-এর দাসী।

দাদাভাস্কর মহা বিস্ময়ে চোখ-মুখ কপালে তুলিয়া অবাঙ্মুখে কীর্ত্তিকরের মুখের দিকে চাহিয়া রহিলেন।

ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ – কীর্ত্তিকরের যুক্তি

দাদাভাস্করের ভাব দেখিয়া কীর্ত্তিকর হাসিয়া উঠিলেন। বৃদ্ধ লালুভাই হাস্য সম্বরণ করিতে পারিলেন না।

কীর্ত্তিকর হাসিতে হাসিতে বলিলেন, “দাদাভাস্কর, ইহাতে আশ্চর্য্য হইবার কি আছে?”

দাদা। কিছুই না। এমন গোয়েন্দা হাতে থাকিলে আমিও অনেক বাহাদুরী দেখাইতে পারি।

কীৰ্ত্তি। ছিল ত হাতে।

দাদা। ছিল—কিন্তু এখন ত নাই; আপনি যে আমার চোখে ধূলি দিয়ে তাকে সরিয়ে নিলেন।

কীৰ্ত্তি। চোখে ধুলি দিতে দিলে কেন?

দাদা। গুরুদেবের সঙ্গে কে পারে?

কীৰ্ত্তি। যাক্, এখন কথা হইতেছে যে, এই চোর—এই খুনীকে আমাদের ধরিতেই হইবে।

লালু। সে কথা আবার দু’বার করে বলতে!

কীৰ্ত্তি। তাহাও শীঘ্র।

দাদা। তাহা না হইলে কমিশনার সাহেবের নিকট চাকরী বজায় রাখা দায় হইবে।

কীৰ্ত্তি। আলোচনা করে দেখা যাক, এ চোরই বা কে, আর এ খুনই বা কে করিয়াছে?

দাদা। বলুন।

কীর্ত্তি। তোমাদের মনে যাহা হয়, তাহাও বল, নতুবা সত্য বাহির হয় না। তর্কেই সত্যের নিরাকরণ হইয়া থাকে।

দাদা। তা ত নিশ্চয়।

কীর্ত্তি। তোমার ঘন ঘন ‘নিশ্চয়ের’ জ্বালায় আমি অস্থির।

লালু। দাদাভাস্কর চুপ করিয়া বসিয়া থাক

কীর্ত্তি। এটা স্থির, রস্তমজী এ চুরি করে নাই, খুনও করে নাই।

দাদা। নিশ্চয়।

লালু। আবার?

দাদা। আর কথা কহিব না। একেবারে চুপ করিয়া থাকিলাম।

কীর্ত্তি। কেন একেবারে চুপ করিবে? আমার কথা যেটা মনে লাগিবে না, সেটার তোমার স্বাধীন মত প্রকাশ করিবে। আর যেটা মনে লাগিবে, সেটার বেলায় চুপ করিয়া থাকিলেই হইল।

দাদা। তাহা হইলেই একেবারে চুপ করা। আপনার কথা মনে লাগিবে না, এমন ত কখনও হয় নাই। আপনার যুক্তি অখণ্ডনীয়।

কীৰ্ত্তি। বাজে কথা যাক্—তাহা হইলে এখন থাকিল হরমসজী, ফ্রামজী, মাঞ্চারজী ও বর্জরজী,—এই চারি জনের প্রত্যেকেরই খুন করা সম্ভব।

লালু। এখন গুরুতর সন্দেহ হরমসজীর উপর।

কীর্ত্তি। হরমসজী বুদ্ধিমান্ লোক, এ কাজ নিজের হাতে যে করিতে যাইবে, তাহা সম্ভব নহে। সে এ কাজ ফ্রামজীকে দিয়াও করাইয়া লইতে পারে।

দাদা। ফ্রামজীর বিরুদ্ধেও প্রমাণ অনেক।

কীৰ্ত্তি। হাঁ কিন্তু আমাদের দুইটি বিষয় মনে করিতে হইবে।

দাদা। বলুন।

কীর্ত্তি। ফ্রামজীর বাড়ী হইতে যে তাহার কোট চুরী গিয়াছিল, তাহা যে সে কেবল বলিতেছে, তাহা নহে—নীচের দোকানদারও একজনকে কোট লইয়া যাইতে দেখিয়াছে। তাহার মিথ্যা বলিবার কোন কারণ নাই।

দাদা। এ কথা ঠিক।

কীর্ত্তি। দাদাভাস্কার, ‘নিশ্চয়টারই’ রূপান্তর ‘একথা ঠিক’। হরমসজীর, ফ্রামজীর কোট চুরী করিবার কোন কারণ দেখা যায় না। তিনি ফ্রামজীর নিকট কোট চাহিলেই পাইতেন, অথবা তাঁহার টাকার অভাব নাই, ঠিক সেইরূপ একটি কোট গোপনে প্রস্তুত করাইতেও পারিতেন।

দাদা। তা হইলে বোঝা যাইতেছে, অপর কেহ এই কোট চুরী করিয়াছিল।

কীৰ্ত্তি। তাহাই সম্ভব, আর সেই এ খুন করিয়াছে। আরও একটা বিষয় আছে, তাহাতে হরমসজীকে খুনী বলিয়া মনে হয় না।

দাদা। বলুন।

কীৰ্ত্তি। যে স্ত্রীলোকটি মারা গিয়াছে, এবং যে প্রকৃত পক্ষে হরমসজীর স্ত্রী ছিল; সে তাহার পত্রে বলিতেছে যে, পেষ্টনজী তখনও হরমসজীর সার্টিফিকেটের বা বিবাহের কথা হরমসজীকে বলে নাই। কেবল কমলাবাঈকে বিবাহের চেষ্টায় ছিল। নিতান্ত হরমসজীও অসম্মত হইলে তবে তাহার ব্রহ্মাস্ত্র সার্টিফিকেট বাহির করিত। ইহাই সম্ভব, সহজে কাজ হাঁসিল হইলে, কে ভাবি-শ্বশুরের সহিত অসদ্ভাব করিতে চায়?

লালু। তাহা হইলে আপনি কি বলেন যে, হরমসজী সার্টিফিকেটের কথা আদৌ জানিতেন না?

কীর্ত্তি। সম্ভব। স্ত্রীলোকের চিঠির ভাব দেখিয়া স্পষ্টই বোধ হয়, মৃত্যুর দিন বা তাহার পূৰ্ব্ব দিন সে এ পত্র লিখিয়াছিল।

দাদা। তা হইলে হরমসজী বা ফ্রামজী দুজনের মধ্যে একজনেরও খুন করা সম্ভব নহে তাহারা সার্টিফিকেটের বিষয় যদি আদৌ জানিত না, তবে কেন খুন করিবে?

কীর্ত্তি। এইজন্য আমার বোধ হয়, অপর কেহ এই সার্টিফিকেটের কথা জানিতে পারিয়াছিল। পেষ্টনজীকে সরাইয়া, সার্টিফিকেট হস্তগত করিয়া, কমলাবাঈকে বিবাহ করা ও হরমসজীর টাকা হস্তগত করাই তাহার উদ্দেশ্য ছিল।

দাদা। এ বর্জরজী ভিন্ন আর কাহারও কাজ নহে।

কীর্ত্তি। তাহার বিরুদ্ধে এখনও আমরা কোন প্রমাণই পাই নাই; বরং মাঞ্চারজীর বিরুদ্ধে একটু আছে। সে সেই রাত্রে রস্তমজীর অনুসরণ করে।

দাদা। মাঞ্চারজী ছোকরা—বর্জরজীর হাতের পুতুল, তার এত সাহস হইবে না। এ সেই গেঁটে বদমাইস বর্জরজীর কাজ।

কীর্ত্তি। যদি আমরা এরূপ প্রমাণ পাই যে, বর্জরজী পেষ্টনজীর নিকটস্থ সার্টিফিকেটের বিষয় জানিতে পারিয়াছিল, তাহা হইলে আমরা সন্দেহ করিতে পারি—এখন নহে। লালুভাই সাহেব, আপনি ইহার সন্ধানে থাকুন।

লালু। এখন ব্যাপার বুঝিয়াছি—খুবই থাকিব।

কীৰ্ত্তি। ব্যস্ত হইয়া পূর্ব্ব হইতে কোন ধারণা করিবেন না। গোয়েন্দাগিরির সেটি একটি প্রধান ভূল। কাজ চালাইতে চালাইতে যেটুকু বুঝিতে পারিবেন, তাহাই ঠিক।

চতুৰ্দ্দশ পরিচ্ছেদ – মতামত

উভয়েই উঠিতেছিলেন। কীর্ত্তিকর তাঁহাদের বসিতে অনুরোধ করিলেন। বলিলেন, “খুনের বিষয়ে যাহা হউক, কতকটা মীমাংসা হইল, এখন চুরির বিষয়ে একটু আলোচনা করা প্রয়োজন।”

দাদভাস্কর। এ আমার কেস, আমার যে ধারণা হইয়াছে, তাহা আমি আপনাকে বলি। এখন আমরা জানিয়াছি যে, হরমসজীর স্ত্রী রাজাবাঈ-এর সহিত বর্জরজীর বড় ভাই এর অবৈধ প্রণয় ছিল। বর্জরজী নিজের ও ভাই-এর সমস্ত সম্পত্তি উড়াইয়া দিয়া টাকার চেষ্টায় বোম্বে আসে। হরমসজীর স্ত্রীকে তাহার পূর্ব্ব ইতিহাস বলিয়া দিবার ভয় দেখাইয়া টাকা আদায় করাই তাহার মতলব। এখানে আসিয়া রাজাবাঈ-এর সঙ্গে দেখা করে। সে তাহার ভয়ে যাহা সে করিতে বলিয়াছে, করিয়াছে—মাঞ্চারজীকে ভগ্নীর পুত্র বলিয়া স্বামীর নিকটে পরিচয় দিয়াছে, বর্জরজীকেও আত্মীয় বলিয়াছে। তার পর ভয়ে সর্ব্বদাই ইহাদের দুই জনকে টাকা দিয়াছে, গহনা দিয়াছে, যাহা কিছু ছিল সব দিয়াছে। ইতিমধ্যে মহা পাষণ্ড বর্জরজী মাঞ্চারজীকে রাজাবাঈ-এর উপপতি বানাইয়াছে—তাহাকে এইরূপে সরাইয়া নিজে কমলাবাঈকে বিবাহের চেষ্টায় আছে। সৰ্ব্বদাই দুইজনে ‘টাকা টাকা করিত, আর টাকার কোন উপায় না দেখিয়া রাজাবাঈ ব্যাঙ্কের সিন্দুক হইতে টাকা চুরি করিয়া ইহাদিগকে দিয়াছে।

কীর্ত্তিকর। সব বুঝিলাম, এখন কথা হইতেছে, রাজাবাঈ সিন্দুক খুলবার গুপ্ত সঙ্কেত কিরূপে জানিল? হরমসঙ্গী এ কথা প্রকাশ করিবার লোক নহে।

দাদা। কোন রকমে জানিতে পারিয়াছিল।

কীর্ত্তিকর। রস্তমজী মাতাল হইয়াছিল, বরং এই কি অধিক সম্ভব নয় যে, সে মাতাল হইয়া কোন দিন কাহাকে বলিয়া দিয়াছিল?

দাদা। সম্ভব।

কীর্ত্তিকর। তাহা হইলে বোঝা যাইতেছে যে, সম্ভবতঃ রস্তমজী মাতাল হইয়া গুপ্তকথা হয় বর্জরজী কিম্বা মাঞ্চাজীরকে বলিয়াছিল।

দাদা। কেন?

কীর্ত্তিকর। কেন? আমরা জানিয়াছি, চোর ভিতর দিক্কার সিঁড়ী দিয়া আসিয়াছিল; সুতরাং রাজাবাঈ-এর সাহায্যে আসিয়াছিল। অথবা সে জানিয়াও ভয়ে এ কথা কাহাকেও বলে নাই। মাঞ্চারজী বা বর্জরজী ভিন্ন আর কেহ হরমসজীর বাড়ীর ভিতর দিয়া যাইতে পারে না।

দাদা। তা নিশ্চয়।

কীর্ত্তিকর। তাহা হইলে এই দুইজনের একজন টাকা চুরী করিয়াছে। সম্ভবতঃ রাজাবাঈ সিন্দুক খুলিবার সময় প্রতিবন্ধক দিয়াছিল।

দাদা। এখন দেখিতেছি, তাহাই সম্ভব।

কীর্ত্তিকর। তাহা হইলে রাজাবাঈ চুরী না করিতেও পারে।

দাদা। খুব সম্ভব।

কীর্ত্তিকর। এখন আমাদের সন্ধান করিয়া বাহির করিতে হইবে, কোন সময়ে কাহার সম্মুখে রস্তমজী গুপ্তকথা প্রকাশ করিয়াছিল।

দাদা। তাহা হইলে ত চোরকে তখনই জানিতে পারা যাইবে।

কীর্ত্তিকর। এখন এইটা জানিবার বিশেষ চেষ্টায় থাক। এই দুই জনের মধ্যে কে সর্বদা রস্তমজীর সহিত মিশিত, তাহা জানা নিতান্ত আবশ্যক।

দাদা। এ কাজ আপনি না করিলে আমার দ্বারা কিরূপে হইবে?

কীর্ত্তিকর। কেন?

দাদা। যে এ সন্ধান দিবে, সে আপনার হাতে থাকিল।

কীর্ত্তিকর। কে সে?

দাদা। কেন, রতনবাঈ।

কীর্ত্তিকর। সে কিরূপে জানিবে?

দাদা। তাহার বাড়ীতেই আড্ডা ছিল। সেইখানেই সকলের আমোদ-প্রমোদ চলিত; যদি গুপ্তকথা রস্তমজী মাতাল হইয়া প্রকাশ করিয়া থাকে, তবে সে সেইখানেই বলিয়াছে।

কীর্ত্তিকর। ইহারা ত অন্যত্রেও আড্ডা দিত।

দাদা। হাঁ, আমি সে সন্ধান লইব। তবে আমার বিশ্বাস, যদি প্রকাশ করিয়া থাকে, তবে রতনবাঈ-এর বাড়ীতেই প্রকাশ করিয়াছে।

কীর্ত্তিকর। খুব সম্ভব। আশ্চর্য্য! আমি এ কথা তাহাকে এত দিন জিজ্ঞাসা করি নাই।

দাদা। তা হইলে গুরুদেবেরও ভুল হয়?

কীর্ত্তিকর। ভুল কার না হয়?

দাদা। তাহাই বলিতেছি।

কীর্ত্তিকর। এখন দুইটা বিষয়েরই কতকটা স্থির হইল। আর এক সপ্তাহের মধ্যে দুইটা কেসের আসামী ধরাই চাই।

দাদা। গুরুদেবের আশীর্ব্বাদ।

তখন সভা ভঙ্গ করিয়া তিনজনে ভিন্ন ভিন্ন দিকে প্রস্থান করিলেন।