তৃতীয় অধ্যায় । মানুষ-তৈরির কারখানায়
আমাদের নায়ক আলেকজেন্ডারের কথা বলবার সময় এসেছে। এতক্ষণ ফিলিপের কথা বললুম, আলেকজান্ডার কেমন বাপের ছেলে তাই দেখাবার জন্যে। ফিলিপের মতন বাপ না পেলে আলেকজান্ডার কোনওদিনই পৃথিবীজয়ী হতে পারতেন না। ছেলের জন্যে ফিলিপ সমস্ত জমিই তৈরি করে রেখে গিয়েছিলেন।
এইবারে দেখা যাক, তাঁর মা কেমনধারা? পৃথিবীতে যাঁরা মহাপ্রতিভার অবতার ও মহামানুষ বলে অমর হয়ে আছেন, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা গিয়েছে, তাঁদের জননীরা ছিলেন অসাধারণ নারী।
আলেকজান্ডারের জননীও ছিলেন এই শ্রেণির। তাঁর নাম ওলিম্পিয়াস। তিনি উত্তর গ্রিসের এপিরাসের রাজার মেয়ে।
ওলিম্পিয়াসের মন ছিল স্বপ্নসুষমাময় ও ভাবরসে স্নিগ্ধ। মাঝে মাঝে ধর্মোন্মাদে তিনি উদ্দাম হয়ে উঠতেন। মাঝে মাঝে রাগে পাগলের মতন হয়ে যেতেন। মায়ের চরিত্রের এইসব দোষগুণ ছেলের চরিত্রেও দেখা গিয়েছিল।
ওলিম্পিয়াস ছিলেন ধর্মের ক্ষেত্রে ধ্যানরহস্যের অনুগামী। এক শ্রেণির তান্ত্রিকদের প্রভাব ছিল তাঁর উপরে প্রবল। আলেকজান্ডারের সম্বন্ধেও ওই কথা বলা যায়। ওলিম্পিয়াস কারুর প্রতিদ্বন্দ্বিতা সহ্য করতে পারতেন না। আলেকজান্ডারও তাই।
এ শ্রেণির স্ত্রী নিয়ে ঘর করা কঠিন। ফিলিপও পারলেন না। তিনি মাসিডনের আর এক রাজকন্যাকে প্রাসাদে এনে রাখলেন। সেকালে গ্রিসে বহুবিবাহ প্রচলিত ছিল।
আলেকজান্ডার মাকে ভক্তি করতেন দেবীর মতো। বাবা তাঁর মাকে অবহেলা করবেন, এটা তিনি সইতে পারলেন না। তিনি বাবার সঙ্গে করলেন ঝগড়া। তারপর মাকে নিয়ে অন্য জায়গায় চলে গেলেন।
এর কিছুকাল পরে তিনি যখন রাজা হয়ে এশিয়ায় যাত্রা করেন, তখন নিজের প্রতিনিধিরূপে মাসিডনে রেখে যান আন্টিপেটার নামে এক রাজকর্মচারীকে।
একদিন আন্টিপেটারের কাছ থেকে অভিযোগ পত্র এল : ‘রাজা, আপনার মা রাজ্য সংক্রান্ত নানা বিষয়ে হস্তক্ষেপ করে বাধা দিচ্ছেন।’
পত্র পাঠ করে আলেকজান্ডার ক্রুদ্ধস্বরে বললেন, ‘কী, আমার মায়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ! আন্টিপেটারের মতন নির্বোধ জানে না যে, কোনও জননীর একফোঁটা চোখের জলে এমন দশহাজার পত্র কোথায় ভেসে যেতে পারে!’
মায়ের সঙ্গে আলেকজান্ডারের সম্পর্কের কথা বলা হল। এইবারে তাঁর বাল্যবয়সের কথা কিছু কিছু বলি।
ফিলিপ কর্মসাগরে ঝাঁপ দিয়েও পুত্রের প্রতি পিতার কর্তব্যের কথা ভোলেননি।
তাঁর দৃষ্টি ও বুদ্ধি দুইই ছিল সমান তীক্ষ্ণ। বালক পুত্রের কথাবার্তা ও ধরনধারণ দেখেই তিনি বুঝলেন, এ কাঁচা বাঁশ নয়—একে নোয়ানো কঠিন। এর মন তেজে পরিপূর্ণ হলেও উচিতমতো শিক্ষার ব্যবস্থা করলে একে দিয়ে বড় কাজ করানো যাবে।
আরিস্টটলের নাম তখন গ্রিসের দেশে দেশে বিখ্যাত। প্লুটো তাঁর গুরু এবং গ্রিসে প্লুটোর পরেই তাঁর আসন। দর্শনশাস্ত্র ও জীববিজ্ঞানে তাঁর তুলনা মেলে না। ফিলিপ তাঁকেই নির্বাচন করলেন পুত্রের শিক্ষকরূপে। আলেকজান্ডারের বয়স তখন চৌদ্দো বৎসর। ফিলিপ যে ভুল নির্বাচন করেননি এবং আলেকজান্ডার যে গুরুর মানরক্ষায় অক্ষম হননি, পৃথিবী চিরদিন মুক্তকণ্ঠে সে কথা স্বীকার করবে।
পিতার কাছ থেকে পুত্র লাভ করতে লাগলেন সামরিক শিক্ষা। বলা বাহুল্য, এ বিভাগে ফিলিপের চেয়ে শ্রেষ্ঠ শিক্ষক গ্রিসে আর দ্বিতীয় ছিল না। পিতার কাছ থেকে তিনি আর একটি মস্ত গুণ পেয়েছিলেন। তা হচ্ছে দৃঢ়ব্রত।
তখন গ্রিসে ওলিম্পিক ক্রীড়ার বড় ধূম। ওই খেলায় একটি প্রধান দ্রষ্টব্য ছিল, রথের দৌড়।
ফিলিপের নিজের রথ এই দৌড় প্রতিযোগিতায় যোগ দিত। একদিন তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আলেকজান্ডার, তুমিও কি এই খেলায় যোগ দিতে চাও?’
আলেকজান্ডার সগর্বে উত্তর দিলেন, ‘হ্যাঁ,—যদি রাজারাজড়াদের প্রতিযোগীরূপে পাই!’
আর একদিন বালক আলেকজান্ডার নিজের দুঃসাহস ও পর্যবেক্ষণ-শক্তির পরিচয় দিলেন।
জনৈক অশ্ব-ব্যবসায়ী রাজসভায় একটি ঘোড়া বিক্রি করতে এসেছে। সেকালে যোদ্ধাদের কাছে ভালো ঘোড়ার দাম ছিল সোনাদানা ও মণিমুক্তারও চেয়ে বেশি। ব্যবসায়ী ঘোড়ার খুব চড়া দাম হাঁকলে।
ফিলিপ ঘোড়ায় চড়তে পটু এমন কয়েকজন লোককে ঘোড়াটিকে পরীক্ষা করতে বললেন।
কিন্তু সে হচ্ছে বিষম তেজি ঘোড়া! অনেক চেষ্টার পরেও তার পিঠে চড়ে কেউ তাকে বাগ মানাতে পারলে না। আরোহী পিঠে উঠলেই সে চার পা তুলে লাফালাফি করতে থাকে।
ফিলিপ বললেন, ‘দূর করে দাও এই দস্যি ঘোড়াকে!’
বালক আলেকজান্ডারও সেখানে হাজির ছিলেন। তিনি বললেন, ‘আমি এ ঘোড়াকে বাগে আনতে পারি। এমন ঘোড়াকে হারানো উচিত নয়। রাজসভায় ভালো সওয়ার নেই।’
ফিলিপ ক্রুদ্ধস্বরে বললেন, ‘এ তোমার আস্পর্ধার কথা! আমার সভার পাকা যোদ্ধারা যা পারলে না, তুমি তা করতে পারবে?’
আলেকজান্ডার বললেন, ‘হ্যাঁ বাবা! ঘোড়ার যা দাম সেই টাকা আমি বাজি রাখতে রাজি আছি।’
ফিলিপ বললেন, ‘তাই নাকি? বেশ, দেখা যাক!’
রাজসভার বড় বড় যোদ্ধারা বালকের বাচালতা দেখে উপহাসের হাসি হাসতে লাগল।
কিন্তু আলেকজান্ডার একটুও দমলেন না। কারণ এতক্ষণ ধরে তিনি লক্ষ করছিলেন, ঘোড়াটা রয়েছে সূর্যের দিকে পিছন ফিরে এবং তার সামনের দিকে মাটির উপরে পড়েছে তার চঞ্চল ছায়া। সেই ছায়া দেখেই ঘোড়ার মেজাজ খারাপ হয়ে যাচ্ছে।
আলেকজান্ডার এগিয়ে গিয়ে ঘোড়ার মুখ ফিরিয়ে দিলেন সূর্যের দিকে। ফলে সে আর নিজের ছায়া দেখতে পেলে না।
ঘোড়ার পিঠে চড়ে তিনি রাশ ধরলেন—কিন্তু জোরে টেনে নয়। তারপর তাঁর নির্দেশ মতো ঘোড়া পরম শান্তভাবে ছুটাছুটি করতে লাগল।
বালক-পুত্রের কীর্তি দেখে ফিলিপের আনন্দ আর ধরে না। বললেন, ‘বৎস, তোমার যোগ্য কোনও বৃহৎ রাজ্য হস্তগত করো। এই ক্ষুদ্র মাসিডনে তোমাকে ধরবে না!’
এ কি কথার কথা? না, বিচক্ষণ পিতার ভবিষ্যদ্বাণী?
সেইদিন থেকে ঘোড়াটি হল আলেকজান্ডারের নিজস্ব। তিনি তার নাম রাখলেন, ‘বুকোফেলাস’ বা ‘ষণ্ডমুণ্ড’। তাঁর প্রত্যেক অভিযানে ঘোড়াটি সঙ্গী হত। সে ছিল তাঁর প্রিয় বন্ধু—এমনকি আত্মীয়ের মতো!
আরিস্টটল মানসিক চর্চায় আলেকজান্ডারকে উৎসাহিত করে তুলতে লাগলেন। বুঝিয়ে দিলেন কেমন করে প্রকৃতিকে দেখতে ও জানতে হয়। ভেষজ সম্বন্ধেও শিক্ষা দিতে ত্রুটি করলেন না। গুরুর কাছে শিক্ষা পেয়ে আলেকজান্ডার অত্যন্ত পুস্তকপ্রেমিক হয়ে উঠলেন। হোমারের কাব্য তাঁকে মাতিয়ে তুলত। আশ্চর্য নয়, কারণ ভবিষ্যতে যে পৃথিবীজয়ী হবে, হোমারের বীররস না হলে তার মনের ক্ষুধা মিটবে কেন?
তাঁর জীবনে এই পুস্তক-অনুরাগ বরাবরই লক্ষ করা গিয়েছে। তিনি যখন সুদূর এশিয়ার অন্তঃপুরে, যখন চারিদিকে তাঁর যুদ্ধ-কোলাহল, নবনব উত্তেজনা এবং দুশ্চিন্তা ও অনিশ্চয়তা, তখনও তাঁর দুর্লভ অবসর মুহূর্তগুলি কেটে যেত গভীর অধ্যয়নের মধ্য দিয়ে। সেই দূর প্রবাসেও তিনি স্বদেশ থেকে নিয়মিত ভাবে আনাতেন অন্যান্য বহু গ্রন্থের সঙ্গে ইস্কিলাস (Aeschylus), সোফোক্লেস (Sophocles) ও এইরিপিদেশের (Euripides) নাট্যকাব্যগুলি। এই পুস্তাকানুরাগই প্রমাণিত করে, আলেকজান্ডারের মন সাধারণ সংস্কৃতিহীন যোদ্ধার মতো ছিল না।
বন্ধুদের সঙ্গে খাবারের টেবিলের ধারে বসে কাটিয়ে দিতেন তিনি ঘণ্টার পর ঘণ্টা! এটা তাঁর ভোজনবিলাসিতার লক্ষণ নয়। আহারে বসে তিনি অনেকক্ষণ ধরে নানা শ্রেণির গুণী ও রসিকদের সঙ্গে ধর্ম, ইতিহাস ও কাব্য নিয়ে আলাপ আলোচনা করতে ভালোবাসতেন।
আগেই বলেছি, তিনি রণবিদ্যা শিখেছিলেন পিতার কাছ থেকে। ধরতে গেলে, আবাল্য তিনি মানুষ হয়েছেন যুদ্ধক্ষেত্রেই এবং সৈনিকেরাই ছিল তাঁর সহচর। শিক্ষা পেয়েছেন তিনি হাতেনাতে।
খ্রিস্টপূর্ব ৩৪০ অব্দে তাঁর বয়স ষোলো বৎসর। ফিলিপ স্থির করলেন, আলেকজান্ডার নাবালক হলেও রাজার ছেলে, অতএব রাজ্যচালনা সম্বন্ধেও তাঁকে কিছু শিক্ষা দিতে হবে।
বাইজানটিয়াস (এখনকার কনস্তান্তিনোপল) হচ্ছে থ্রেসের একটি বড়ো শহর, ফিলিপ তা অধিকার করার জন্যে যাত্রা করলেন এবং যাবার সময়ে আলেকজান্ডারের হাতে দিয়ে গেলেন রাজ্য চালনার ভার।
আলেকজান্ডার স্থির করলেন, বাবাকে বুঝিয়ে দিতে হবে যে, তাঁর ছেলেও লড়াই করতে শিখেছে।
দেশের কাছাকাছি এক জায়গায় একটি জাতি বিদ্রোহী হয়েছিল। আলেকজান্ডার তাদের বিরুদ্ধে সদলবলে করলেন যুদ্ধযাত্রা। বিদ্রোহীরা পরাজিত হল। তিনি তাদের শহর কেড়ে নিলেন। তারপর আত্মগর্বে স্ফীত হয়ে নিজের নামে সেই শহরের নামকরণ করলেন। এই আত্মগর্ব থেকে তিনি কোনওদিনই মুক্তিলাভ করেননি। এর পরেও আফ্রিকায় ও এশিয়ায় আরও অনেক শহর পরিচিত হয়েছে তাঁর নিজের নামে।
যে যুদ্ধের ফলে ফিলিপ সমস্ত গ্রিসের একমাত্র নায়করূপে গণ্য হন, হাতিয়ার হাতে করে আলেকজান্ডার সে যুদ্ধেও যোগ দিয়েছিলেন। এইভাবে পিতার চোখের সামনে তিনি যুদ্ধবিদ্যায় ক্রমেই পরিপক্ক হয়ে উঠতে লাগলেন।
ফিলিপের মুখেই তিনি যে তাঁর উচ্চাকাঙ্ক্ষার কথা শুনেছিলেন, এটুকু অনুমান করা যেতে পারে। ‘পারস্য হচ্ছে গ্রিসের চিরশত্রু। সে আবার গ্রিসকে আক্রমণ করবে। তার সঙ্গে গ্রিসের যুদ্ধ অনিবার্য। এবং এবারের যুদ্ধে হয় গ্রিস, নয় পারস্যকে একেবারে খণ্ডবিখণ্ড হয়ে যেতে হবে। অতএব সমস্ত শক্তি একত্র করে আগেই আমাদের করতে হবে শত্রুকে আক্রমণ।’
ছেলেবেলা থেকেই আলেকজান্ডার শুনে এসেছেন, পারস্যের কবলে পড়ে গ্রিসকে কত দুর্দশা ভোগ করতে হয়েছে। কাজেই শিশুবয়স থেকেই রোমের বিরুদ্ধে হানিবলের মতন তাঁরও মনের ভিতরে এই চিরশত্রুর বিরুদ্ধে একটা বিজাতীয় ক্রোধ ক্রমেই পুঞ্জীভূত হয়ে উঠতে লাগল। এবং হামিলকারের মতন ফিলিপও ছেলের হৃদয়ে জ্বালিয়ে তুললেন এই দারুণ হিংসার আগুন!