তৃতীয়। হরিষে বিষাদ
নীলাকাশের অনেকখানি আচ্ছন্ন করে দাঁড়িয়ে আছে পর্বতের পর পর্বত, নীল মেঘমালার মতো। তাদের শিখরগুলো বিপুল শূন্য ভেদ করে উঠে গিয়েছে উপর দিকে, তারা যেন কোনও দুর্গম দানব-লোকের কোলে পাথরে গড়া সারি সারি পূজা-দেউল। সেই পার্বত্য রাজ্যের নীচের দিকটা আচ্ছন্ন করে আছে, বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত এক গহন অরণ্যের লতাগুল্মতরুর নিবিড় শ্যামলতা।
সেখানে বনস্পতিদের মাথার উপরে রবিকররেখার সোনার ঝালর দেখে ভেঙে গিয়েছে গানের পাখিদের রাতের ঘুম; উত্তপ্ত জীবনের আনন্দে উচ্ছ্বসিত হয়ে তারা প্রেরণ করছে আকাশে বাতাসে পৃথিবীর দিকে দিকে গীতিময়ী প্রীতির বাণী।
কিন্তু কলকণ্ঠ বিহঙ্গদের স্তম্ভিত ও স্তব্ধ করে আচম্বিতে অদূরে জেগে উঠল বৃহৎ এক জনতার উত্তেজিত কোলাহল। সঙ্গে সঙ্গে শোনা গেল হস্তীর বৃংহতি, ধাবমান অশ্বদলের দ্রুত পদধ্বনি।
চঞ্চল হয়ে উঠল অরণ্যের অমানুষ বাসিন্দারা। এসব বিপজ্জনক ধ্বনি তাদের কাছে অপরিচিত নয়। কোন অন্তরালে একটি মৃত মৃগের দেহ নিয়ে বসে চিত্রবিচিত্র ব্যাঘ্র নিশ্চিন্ত প্রাতরাশের আয়োজন করছিল; কোন ঝোপের আড়ালে শুয়ে শুয়ে মাটির উপরে লাঙ্গুল আছড়ে বাঘিনি আহ্বান করছিল তার শাবকদের খেলা করবার জন্যে। সারারাত বনে বনে ঘুরে ভল্লুক ও ভল্লুকি ক্লান্ত দেহে গিরিগুহায় ফিরে দিবানিদ্রার জন্যে প্রস্তুত হচ্ছিল; অন্ধকারের বিভীষিকা দূর হয়েছে দেখে হরিণ-হরিণীরা সাহস সঞ্চয় করে দলে দলে বেরিয়ে এসেছিল নতুন রোদে চিকন শিশিরস্নাত তৃণভূমির উপরে। সমবেত মানুষদের ভয়াল সাড়া পেয়ে তারা সবাই আতঙ্কে শিউরে উঠে যে যেদিকে পারল সরে পড়ল। বনতল শব্দিত ও কম্পিত করে একসঙ্গে মিলেমিশে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটতে লাগল বাঘ, ভালুক, বরাহ, বয়ার, নেকড়ে, হরিণ ও শশকরা। উপরেও গাছের শাখা ছেড়ে আকাশের আশ্রয় নিলে সারস, বক, হাঁস, ময়ূর ও আরও নানা জাতের পাখিরা। বানররা আরও উঁচু ডালের উপরে উঠে ঘনপত্রের আড়ালে আত্মগোপন করে কিচিরমিচির শব্দে চারিদিকে রটিয়ে দিতে লাগল একই আসন্ন বিপদের সংবাদ। বনবাসী এই সব জীব কেউ কারও বন্ধু নয় বটে, কিন্তু তারা সব চেয়ে ভয়ানক শত্রু বলে মনে করে মানুষদের। বাঘ জীবহিংসা করে কেবল নিজের প্রাণরক্ষার জন্যে, কিন্তু মানুষ হত্যা করে অকারণ আনন্দেই। হরিণরা বনে থেকে বাঘের খোরাক হতেও রাজি, তবু মানুষের কাছে লোকালয়ে আসতে প্রস্তুত নয়।
বনে আজ শিকার করতে বেরিয়েছেন থানেশ্বরের রাজকুমার হর্ষবর্ধন। সঙ্গে আছে তাঁর বয়স্যরা এবং সৈন্যগণ।
দীর্ঘদংষ্ট্রা বিপুলবহু এক বরাহ—দুই চক্ষে তার ক্রোধের অগ্নি, নাসারন্ধ্রে ঝড়ের ঝাপটা, চার পায়ে বিদ্যুতের গতি! পেছনে পেছনে ধেয়ে আসছে এক তেজি ঘোড়া, পৃষ্ঠে আসীন তরুণ হর্ষবর্ধন, দক্ষিণ হস্তে তাঁর উদ্যত বর্শাদণ্ড।
হঠাৎ অরণ্যপথে দেখা দিলে আর এক অশ্বারোহী, দূর থেকেই সে চিৎকার করে বললে, ‘রাজকুমার, রাজকুমার। ক্ষান্ত হোন—অশ্বরশি সংযত করুন।’
রাশ টেনে ধরতেই হর্ষবর্ধনের ঘোড়া দাঁড়িয়ে পড়ল এবং সেই অবসরে এক লাফ মেরে পাশের ঝোপের ভিতরে অদৃশ্য হয়ে গেল বরাহটা।
অনতিবিলম্বে অশ্বারোহী কাছে এসে পড়ল।
হর্ষবর্ধন বিরক্তিপূর্ণ স্বরে বললেন, ‘এমন অসময়ে এসে আমাকে বাধা দিলে, কে তুমি?’
অশ্বারোহী মাটির উপরে নেমে পড়ে নতমস্তকে অভিবাদন করে বললে, ‘রাজকুমার, আমি মহারাজাধিরাজ প্রভাকরবর্ধনের বার্তাবাহ।’
‘কী বার্তা তুমি এনেছ?’
‘মহারাজা মৃত্যুশয্যায় শায়িত।’
হর্ষবর্ধন সচমকে বললেন, ‘সেকী, আমি যে পিতাকে সম্পূর্ণ সুস্থ অবস্থায় দেখে এসেছি।’
বার্তাবহ বললে, ‘জীবন হচ্ছে স্রোতের ফুলের মতো—এই আছে এই নেই। মহারাজা মৃত্যুশয্যায় শুয়ে আপনাকে স্মরণ করেছেন। অবিলম্বে রাজধানীতে ফিরে না গেলে আপনি তাঁকে জীবন্ত দেখতে পাবেন না।’