উপন্যাস
বড় গল্প
সংকলন
রচনা

তৃতীয়। ভারতের দ্বারে প্রথম বার

তৃতীয়। ভারতের দ্বারে প্রথম বার

মরুভূমি—আরক্ত, অনুর্বর, বিপুল শূন্যতার রাজ্য! তারই বুক-চেরা পায়ে চলা পথে রাঙা মাটির প্রলেপ—রোদের তাতে পুড়ে শুকিয়ে ফেটে চৌচির। দুপুরের বাতাস গরম ফুঁ দিয়ে হু হু করে বালি ছড়িয়ে এমন উড়ন্ত যবনিকার সৃষ্টি করে যে, প্রভাত ও বিকাল ছাড়া অন্য কোনও সময়ে তার ভিতর দিয়ে নজর চলে না।

কিন্তু এ আসল মরুভূমি নয়। কারণ এরই মধ্যে মাঝে মাঝে দেখা যায় শুষ্ক নদীর বাঁকা রেখা—তারা এগিয়ে গিয়েছে বৃহত্তর নদী আমুদরিয়ার কোলের দিকে। এসব নদীর ধারে ধারে ছোট ছোট লতাগুল্ম ও শরবন দেখা যায়। মাঝে মাঝে পাওয়া যায় কূপ। সেসব কূপের জল মানুষের ব্যবহারযোগ্য না হলেও, জন্তুরা তা পান করে সাগ্রহেই। এবং যেখানে যেখানে জল কতকটা চলনসই, সেখানেই তুর্কি জাতীয় যাযাবররা তাঁবু ফেলে বসে থাকে—দলে হালকা পথিকদের সাংঘাতিক অভ্যর্থনা করবার জন্যে!

স্থানীয় ভাষায় এই মরু-প্রান্তরের নাম হচ্ছে, ‘রাঙা বালি’।

পলাতক তৈমুর নিলেন এই রাঙা বালির আশ্রয়। সঙ্গে তাঁর সহধর্মিণী আলজাই এবং জনকুড়ি বিশ্বস্ত অনুচর। প্রত্যেকেই অশ্বারোহী ও সশস্ত্র।

দিন কয় পথ চলবার পর এইখানেই তৈমুর তাঁর শ্যালক আমির হুসেনের দেখা পেলেন। তিনিও পলাতক ও রাজ্যহারা। হুসেনেরও সঙ্গে ছিলেন তাঁর স্ত্রী বিখ্যাত সুন্দরী দিলসাদ আগা, এবং এ-দলেও কয়েকজন সৈনিক ছিল।

তৈমুর প্রথমে খিভা শহরের দিকে যাত্রা করলেন; কিন্তু সেখানকার শাসনকর্তা তাদের আশ্রয় না দিয়ে করলেন সসৈন্যে আক্রমণ!

তৈমুর ও হুসেন আত্মরক্ষার জন্যে তাড়াতাড়ি একটা পাহাড়ের বা গিরিসঙ্কটের উপরে গিয়ে উঠলেন। শত্রুরা সংখ্যায় অনেক বেশি হলেও তৈমুরের অধীনস্থ তাতাররা একটুও ভয় পেলে না—কারণ ঘোড়ার পিঠে আসন পেতে ধনুক-বাণ ধরতে পারলে তাতার সৈনিকরা যমের সঙ্গেও লড়তেও পিছপা নয়!

তাতারদের এক কোমরে থাকে ছিলা-জোড়া ধনুক আর এক কোমরে বাণ-ভরা তূণ। তাদের ছোট ঢাল বাঁধা থাকে উপর হাতে এবং তরবারি বা গদাও তারা সঙ্গে রাখে; কিন্তু অন্য অস্ত্রের চেয়ে তারা ধনুক-বাণ ব্যবহার করতেই বেশি ভালোবাসে।

বিকট চিৎকার করতে করতে তাতাররা শত্রু দলের ভিতর গিয়ে পড়ল এবং বাণ ছুড়তে লাগল বৃষ্টিধারার মতন। শত্রুরাও উত্তর দিতে ছাড়লে না। দেখতে দেখতে দুই পক্ষের অনেকগুলো ঘোড়া হল আরোহীশূন্য।

তাতারদের মধ্যে একজন বীরের নাম এলচি বাহাদুর। তিনি শত্রুদের মাঝখানে গিয়ে এমন বেপরোয়ার মতন লড়াই করতে লাগলেন যে, তৈমুর নিজে গিয়ে হাত ধরে তাঁকে টেনে আনলেন।

আমির হুসেনও পড়লেন মহা বিপদে। তিনি ঘোড়া ছুটিয়ে শত্রুদের পতাকাবাহীর উপরে গিয়ে পড়ে তাকে বধ করলেন বটে, কিন্তু শত্রুব্যূহ ভেদ করে আর বেরিয়ে আসতে পারলেন না। তৈমুর তাড়াতাড়ি তাঁকে উদ্ধার করতে গেলেন এবং শত্রুরা তখন হুসেনকে ছেড়ে তাঁকেই আক্রমণ করলে। সেই ফাঁকে হুসেন সরে পড়লেন। তৈমুরের দুই হাতে যখন দুইখানা তরবারি শত্রুর রক্তে রাঙা হয়ে উঠেছে, অন্যান্য তাতার বীররা তখন তাঁর দুই পাশে গিয়ে দাঁড়াল।

তৈমুর চিৎকার করে বললেন, ‘এইবারে সবাই দল বেঁধে একসঙ্গে শত্রুদের আক্রমণ করো!’

হঠাৎ একটা তিরে আহত হয়ে হুসেনের ঘোড়া প্রভুকে পিঠ থেকে ছুড়ে ফেলে দিলে। হুসেনের স্ত্রী বীরনারী দিলসাদ তখনই নিজের ঘোড়া ছুটিয়ে স্বামীর পাশে এসে দাঁড়ালেন। স্ত্রীর ঘোড়ায় চড়ে হুসেন আবার যুদ্ধে যোগদান করলেন।

এসব দিকে তখন তৈমুরের দৃষ্টি ছিল না; কারণ তাঁর প্রধান শত্রু খিভার শাসনকর্তাকে তখন তিনি সামনাসামনি পেয়েছেন! তখনই বেজে উঠল তাঁর ধনুকের ছিলা, এবং সঙ্গে সঙ্গে গণ্ডদেশে আহত হয়ে শাসনকর্তা হলেন ‘পপাত ধরণীতলে!’ পরমুহূর্তে অশ্বারোহণে নিপুণ তৈমুর ঘোড়ার পিঠ থেকে না নেমেই মাটির দিকে ঝুঁকে পড়ে একটা পরিত্যক্ত বর্শা তুলে ভূপতিত শত্রুর বুকে দিলেন আমূল বসিয়ে!

নেতার শোচনীয় পরিণাম দেখে শত্রুরা পলায়ন করলে।

তৈমুর যুদ্ধে জয়লাভ করলেন বটে, কিন্তু তাঁর পক্ষে বেঁচেছিল তখন সাতজন মাত্র সৈনিক এবং তারাও প্রত্যেকেই অল্পবিস্তর আহত।

তৈমুর কঠোর হাস্য করে বললেন, ‘না, এখনও আমরা অদৃষ্ট পথের শেষে এসে হাজির হইনি!’

পাছে শত্রুরা আবার দলে ভারী হয়ে আক্রমণ করতে আসে, সেই ভয়ে তৈমুর রাত্রির অন্ধকার ভেদ করে অন্ধের মতন অগ্রসর হতে লাগলেন।

তারপর আবার এল প্রভাত এবং আবার এল রাত্রি এবং আবার দিনের আলোর পর রাত্রের অন্ধকার! এর মধ্যে আরও নতুন নতুন দুর্ভাগ্যেরও অভাব হল না।—

আমির হুসেন তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে দল ছেড়ে স্বদেশের দিকে যাত্রা করলেন। তৈমুরের সঙ্গে রইল মাত্র একজন অনুচর ও দুইটি ঘোড়া। মালবহনের জন্যে একটি ঘোড়া রেখে বাকি ঘোড়াটি স্ত্রীকে দিয়ে তৈমুর পদব্রজে চললেন মরু বালু দলন করে।

জীবনে এর অগে যিনি পায়ে হেঁটে পথ চলেননি এবং এর পরে যাঁর উপাধি হবে ‘পৃথিবী জেতা’, তাঁর দিকে তাকিয়ে আলজাই বললেন, ‘স্বামী, আমাদের অদৃষ্ট এর চেয়ে মন্দ হতে পারে না!’

বারো দিন কাটল পথে-বিপথে। তারপর হল রাঙা বালির শেষ ও নতুন দুর্ভাগ্যের আরম্ভ।

সে অঞ্চলের সর্দারের নাম আলি বেগ। পলাতক তৈমুরকে দেখে সে বুঝলে, এঁকে হস্তগত করতে পারলে প্রচুর লাভের সম্ভাবনা। আলি বেগ তখনই তৈমুর ও তাঁর স্ত্রীকে একটা গোয়ালঘরে বন্দি করে রেখে জাট মোগলদের কাছে দূত পাঠালে।

কীট-পতঙ্গ ও দুর্গন্ধ ভরা জঘন্য গোয়ালঘর। রাজার জামাই ও সবুজ শহরের কর্তা তৈমুর এবং রাজার মেয়ে আলজাই তারই ভিতরে বসে মরুভূমির তপ্ত হাওয়ায় পুড়তে পুড়তে নরক-যন্ত্রণা ভোগ করতে লাগলেন। এইভাবে কাটল দুই মাস দুই দিন।

তৈমুর এমন কষ্টের কল্পনাও করেনি কোনওদিন। বিকৃত স্বরে তিনি বললেন, ‘দোষী হোক আর নির্দোষই হোক—জীবনে কারুকে কখনও আমি বন্দি করে রাখব না!’

এদিকে তৈমুরের মূল্য কত হওয়া উচিত, তাই নিয়ে জাট-মোগলদের সঙ্গে দর-কষাকষি করতে করতে আলি বেগ তার লাভের সুযোগ হারাতে বাধ্য হল।

আলি বেগের দাদা ছিলেন পারস্য দেশের এক সর্দার। সমস্ত খবর শুনে তিনি বিরক্ত হয়ে ভাইকে চিঠি লিখলেন, ‘জাট-মোগলদের সঙ্গে হয়েছে সবুজ শহরের কর্তার ঝগড়া। এর মধ্যে তোমার মাথা গলানো উচিত নয়।’ সঙ্গে সঙ্গে তিনি তৈমুরের জন্যে পাঠিয়ে দিলেন অনেক মূল্যবান উপহার।

আলি বেগ অনিচ্ছাসত্বেও তৈমুরকে মুক্তি দিলে। দাদার পাঠানো উপহারগুলি বুদ্ধিমানের মতন নিজের ভাগে রেখে তৈমুরকে সে দান করলে একটা বেতো ঘোড়া ও একটা বুড়ো উট।

এত দুঃখেও মিষ্টি হাসি হেসে আলজাই বললেন, ‘স্বামী, এখনও আমরা পথের শেষে আসিনি!’

শরৎকালের বৃষ্টি এল—এই সময়ে আমু নদীর তীরে এক নির্দিষ্ট স্থানে হুসেনের সঙ্গে তৈমুরের যোগদান করবার কথা।

কিন্তু তৈমুর একবার লুকিয়ে নিজের দেশটা দেখে আসবার লোভ সামলাতে পারলেন না। বিশেষত, একেবারে খালি হাতে সঙ্গীহীন কাঙালের মতন কুটুম্বের কাছে যাওয়ার ইচ্ছাও তাঁর হল না। হুসেন ছিলেন রীতিমতো জাঁকি মানুষ। তিনি নিজেকে কেবল তৈমুরের চেয়ে বুদ্ধিমান নয়, উচ্চশ্রেণির লোক বলেই মনে করতেন।

আলজাইকে কাছাকাছি একটা গ্রামে লুকিয়ে রেখে ছদ্মবেশী তৈমুর এসে হাজির হলেন সমরখন্দ শহরে।

কিন্তু সেখানকার গতিক সুবিধার নয়। জাট-মোগলদের দোর্দণ্ডপ্রতাপে সবাই সেখানে ভয়ে থরহরি কম্পমান। সমরখন্দের তাতারীরা চিরদিনই যোদ্ধা নেতার অনুগামী হতে অভ্যস্ত। মুসলমানদের মতন তাদের মধ্যে ধর্মান্ধতার প্রভাব ছিল না—তারা বীরধর্মে দীক্ষিত, যুদ্ধ ছাড়া আর কোনও কিছু নিয়ে মাথা ঘামাতে চাইত না। যে নেতা তাদের বীর্যকে জাগ্রত ও বিজয় গৌরবের পথে চালনা করতে পারতেন, তারা হত তাঁরই বিশ্বস্ত অনুচর।

কিন্তু তৈমুর হচ্ছেন যুবক ও সহায়-সম্বলহীন। তাঁর অনুগামী হয়ে দুর্দান্ত জাট-মোগলদের বিষ-দৃষ্টিতে পড়বার জন্যে তাদের আগ্রহ দেখা গেল না। তবু কয়েকজন ডানপিটে লোক তৈমুরের সঙ্গী হতে রাজি হল।

ওদিকে এরই মধ্যে মোগলরা তৈমুরের পুনরাবির্ভাব আবিষ্কার করে ফেললে। তৈমুর সঙ্গীদের নিয়ে সেখান থেকে অদৃশ্য হয়ে চুপিচুপি সবুজ শহরের ভিতরে প্রবেশ করলেন।

তাঁর প্রিয় সবুজ শহর! এইখানেই তাঁর জন্ম এবং এইখানেই কেটেছে তাঁর স্বপ্নময় শৈশব ও আনন্দময় প্রথম যৌবন!

আমির কাজগানের রণপ্রবীণ বাহাদুররা তখনও সবুজ শহরে বসে নিজেদের গৌরবোজ্জ্বল রক্তাক্ত অতীতের কথা ভেবে দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে। তৈমুরের আগমন সংবাদ তাদের কাছে পৌঁছোতে দেরি লাগল না। ছুটে এল এলচি বাহাদুর, জাকু বার্লাস প্রমুখ বীরবৃন্দ।

তারা বললে, ‘তৈমুর, তৈমুর! ভগবানের ধরণী যখন এখন বিপুলা, তখন আমরা আর সংকীর্ণ শহরে চার দেওয়ালের মধ্যে আবদ্ধ থাকি কেন?’

তৈমুর দৃপ্ত কণ্ঠে বললেন, ‘থামো বচনবাগীশের দল! কী তোমরা করতে চাও? তোমরা কি বাজপাখির মতন শিকারের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারবে? না, তোমরা হচ্ছ কাক, জাট-মোগলদের উচ্ছিষ্ট কুড়িয়ে খেয়েই দিনের পর দিন কাটাবে?’

বাহাদুররা বললে, ‘ইয়ে আল্লা! আমরা কাক নই!’

নিজের ছোটখাটো দলটি নিয়ে তৈমুর চললেন হুসেনের সঙ্গে দেখা করতে। এ দলের অধিকাংশ লোকই সৈনিক বলে আত্মপরিচয় দিতে পারে না—তাদের কেউ হচ্ছে বন্য তুর্কিজাতীয় লোক, কেউ বা বিপদপ্রিয় আরব। উচ্চাকাঙ্ক্ষা বলতে তারা খালি বোঝে হানাহানি ও লুঠতরাজ! সৈনিক হিসাবে উচ্চশ্রেণির না হলেও তৈমুর পা দিয়েছেন যে দুর্গম পথে, তারা তার পক্ষে যোগ্য সহযাত্রীই বটে!

এ পথ দুর্বলের পথ নয়। মাইলের পর মাইল, এমনি পাঁচ শত মাইল ধরে নতোন্নত পথ চলেছে সুদীর্ঘ পর্বতশ্রেণির ভিতর দিয়ে—সর্বাঙ্গে মেঘচুম্বী শিখরের পর শিখরের ছায়া। গিরিসঙ্কটের মধ্যবর্তী এক নদীর তীর ধরে এই উচল পথ ঊর্ধ্বে, ঊর্ধ্বে,—ক্রমে আরও ঊর্ধ্বে গিয়ে ডুবে গিয়েছে প্রায় দেড় ফুট পুরু তুষাররাশির মধ্যে এবং অবশেষে গিয়ে পড়েছে একেবারে আফগানিস্তানের বুকের উপরে!

মহাপর্বতের হিমানী ক্ষেত্রের পর হিমানী ক্ষেত্র! তুষারার্ত ঝঞ্ঝাবায়ু হা হা রবে বয়ে যায় অধিত্যকার উপর দিয়ে—ধ্বনি-প্রতিধ্বনি জাগিয়ে পাহাড়ের রন্ধ্রে রন্ধ্রে! সেইখানে পড়ে যাত্রীদের তাঁবু। দিনের বেলায় কোনওদিকে ভালো করে তাকানো যায় না—কারণ, তুষার ক্ষেত্রের উপর তীব্র সূর্যকর পড়ে লক্ষ লক্ষ তীক্ষ্ণ ছুরির জ্বলন্ত শিখার মতন অন্ধ করে দেয় দৃষ্টিকে!

ঘোড়াদের গায়ে পশমি আবরণ, মানুষদের পরনে নেকড়ে ও নকুলজাতীয় পশুর চর্মে প্রস্তুত পোশাক। মাঝে মাঝে স্থানীয় গিরিদুর্গের ভিতর থেকে ভেসে আসে প্রহরী ও কুকুরের চিৎকার। মাঝে মাঝে লোভী আফগানিরা হিংস্র জন্তুর মতন এসে হানা দেয়! কিন্তু তারা জানত না যে কোন শ্রেণির বেপরোয়া গোঁয়ারদের সঙ্গে পাল্লা দিতে যাচ্ছে! প্রত্যেক বারেই তৈমুরের দল তাদের হারিয়ে যথাসর্বস্ব কেড়ে নেয়!

অবশেষে হিন্দুকুশের তুষার মুল্লুক ছাড়িয়ে তৈমুর কাবুলের উপত্যকার ভিতরে গিয়ে পড়লেন।

কাবুলের সিংহাসন দখল করেছেন তখন জাট-মোগলবংশের এক ব্যক্তি। আমির হুসেন স্বরাজ্য ত্যাগ করে পলাতক।