তৃতীয়দ্যূতসভা

তৃতীয়দ্যূতসভা

মহাভারতে আছে প্রথম দ্যূতসভায় যুধিষ্ঠির সর্বস্ব হেরে যাবার পর ধৃতরাষ্ট্র অনুতপ্ত হ’য়ে তাঁকে সমস্ত পণ ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। পাণ্ডবেরা যখন ইন্দ্রপ্রস্থে ফিরে যাচ্ছিলেন তখন দুর্যোধনের প্ররোচনায় ধৃতরাষ্ট্র যুধিষ্ঠিরকে আবার খেলবার জন্য ডেকে আনান। এই দ্বিতীয় দ্যূতসভাতেও যুধিষ্ঠির হেরে যান এবং তার ফলে পাণ্ডবদের নির্বাসন হয়।

শকুনি—যুধিষ্ঠির কিরকম পাশা খেলেছিলেন? তাঁদের খেলায় ছক আর ঘুঁটি ছিল না উভয় পক্ষ পণ উচ্চারণ করেই অক্ষপাত করতেন, যাঁর দান বেশী পড়ত তাঁরই জয়। মহাভারতে দূতপর্বাধ্যায়ে যুধিষ্ঠিরের প্রত্যেকবার পণ ঘোষণার পর এই শ্লোকটি আছে—

এতচশ্রুত্বা ব্যবসিতো নিকৃতিং সমুপাশ্রিতঃ

জিতমিত্যেব শকুনির্যুধিষ্ঠিরমভাষতঃ।।

অর্থাৎ পণঘোষণা শুনেই শকুনি নিকৃতি (শঠতা) আশ্রয় ক’রে খেলায় প্রবৃত্ত হলেন এবং যুধিষ্ঠিরকে বললেন—জিতলাম। এতে বোঝা যায় যে পাশা ফেলবার সঙ্গে সঙ্গে এক একটা বাজি শেষ হ’ত।

অনেকেই জানেন না যে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের কিছুদিন পূর্বে যুধিষ্ঠির আরও একবার শকুনির সঙ্গে পাশা খেলেছিলেন। ব্যাসদেব মহাভারত থেকে তৃতীয়দ্যূত পর্বাধ্যায়টি কেন বাদ দিয়েছেন তা বলা শক্ত। হয়তো কোন রাজনীতিক কারণ ছিল, কিংবা তিনি ভেবেছিলেন যে আসন্ন কলিকালে কুটিল দ্যূতপদ্ধতির রহস্য প্রকাশ জনসাধারণের পক্ষে অনিষ্টকর হবে। বর্তমান বৈজ্ঞানিক যুগে প্রতারণার যেসব উপায় উদ্ভাবিত হয়েছে তার তুলনায় শকুনি—যুধিষ্ঠিরের পাশাখেলা ছেলেখেলা মাত্র, সুতরাং এখন সেই প্রাচীন রহস্য প্রকাশ করলে বেশী কিছু অনিষ্ট হবে না।

কুরুক্ষেত্র—যুদ্ধের পঁচিশ দিন পূর্বের কথা। যুধিষ্ঠির সকাল বেলা তাঁর শিবিরে ব’সে আছেন, সহদেব তাঁকে সংগৃহীত রসদের ফর্দ প’ড়ে শোনাচ্ছেন। অর্জুন পাঞ্চালশিবিরে মন্ত্রণাসভায় গেছেন, নকুল সৈন্যদের কুচকাওয়াজে ব্যস্ত। ভীম যে এক শ গদা ফরমাস দিয়েছিলেন তা পৌঁছে গেছে, এখন তিনি প্রত্যেকটি আস্ফালন করে এক এক জন ধৃতরাষ্ট্রের নামে উৎসর্গ করছেন। সব গদা শাল কাঠের, কেবল একটি কাপড়ের খোলে তুলো ভরা। এটি দুর্যোধনের ১৮নং ভ্রাতা বিকর্ণের জন্য। ছোকরার মতিগতি ভাল, দ্রৌপদীর ধর্ষণের সময় সে প্রবল প্রতিবাদ করেছিল।

সহদেব পড়ছিলেন, ‘যবশক্তু দ্বাদশ মন, চণকচূর্ণ অষ্ট লক্ষ মন, অভগ্ন চণক পঞ্চাশ লক্ষ মন—’

ফর্দ শুনে শুনে যুধিষ্ঠিরের বিরক্তি ধরছিল। কিছু আগ্রহ প্রকাশ না করলে ভাল দেখায় না, সেজন্য প্রশ্ন করলেন, ‘ওতেই কুলিয়ে যাবে?’

সহদেব বললেন, ‘খুব। মোটে তো সাত অক্ষৌহিণী, আর যুদ্ধ শেষ হ’তে বড় জোর দিন—কুড়ি, প্রতিদিন মরবেও বিস্তর। তারপর শুনুন—ঘৃত লক্ষ কুম্ভ—’

‘তুমি আমাকে পথে বসাবে দেখছি। অত অর্থ কোথায় পাব?’

‘অর্থের প্রয়োজন কি, সমস্তই ধারে কিনেছি, জয়লাভের পর মিষ্টবাক্যে শোধ করবেন। তৈল দ্বিলক্ষ কুম্ভ, লবণ অর্ধ লক্ষ মন—’

‘থাক থাক। যা ব্যবস্থা করবার ক’রে ফেল বাপু, আমাকে ভোগাও কেন। আমি রাজধর্ম বুঝি নীতিশাস্ত্র বুঝি। অঙ্ক কষা বৈশ্যের কাজ, আমার মাথায় ওসব ঢোকে না।’

এমন সময় প্রতিহার এসে জানালে, ‘ধর্মরাজ এক অভিজাত কল্প কুব্জপুরুষ আপনার দর্শনপ্রার্থী। পরিচয় দিলেন না; বললেন, তাঁর বার্তা অতি গোপনীয়, সাক্ষাতে নিবেদন করবেন।’

সহদেব বললেন, ‘মহারাজ এখন রাজকার্যে ব্যস্ত, ওবেলা আসতে বল।’

সহদেবের হাত থেকে নিস্তার পাবার জন্য যুধিষ্ঠির ব্যগ্র হয়েছিলেন। বললেন, ‘না না, এখনই তাঁকে নিয়ে এস।’

আগন্তুক বক্রপৃষ্ঠ প্রৌঢ় বলিকুঞ্চিত শীর্ণ মুণ্ডিত মুখ, মাথায় প্রকাণ্ড পাগড়ি, গলায় নীলবর্ণ রত্নহার, পরনে ঢিলে ইজের, তার উপর লম্বা জামা। যুক্তকর কপালে ঠেকিয়ে বললেন, ‘ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরের জয়।’

যুধিষ্ঠির জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কে আপনি সৌম্য?’

আগন্তুক উত্তর দিলেন, ‘মহারাজ, ধৃষ্টতা ক্ষমা করবেন, আমার বক্তব্য কেবল রাজকর্ণে নিবেদন করতে চাই।’

যুধিষ্ঠির বললেন, ‘সহদেব, তুমি এখন যেতে পার। ছোলার বস্তাগুলো খুলে দেখ গে, পোকাধরা না হয়।’ সহদেব বিরক্ত হ’য়ে সন্দিগ্ধ মনে চ’লে গেলেন।

আগন্তুক অনুচ্চস্বরে বললেন, ‘মহারাজ, আমি সুবলপুত্র মৎকুনি, শকুনির বৈমাত্র—ভ্রাতা।’

‘বলেন কি, আপনি আমাদের পূজনীয় মাতুল। প্রণাম প্রণাম, কি সৌভাগ্য—এই সিংহাসনে বসতে আজ্ঞা হ’ক।’

‘না মহারাজ, এই নিম্ন আসনই আমার উপযুক্ত। আমি দাসীপুত্র, আপনার সংবর্ধনার অযোগ্য।’

‘আচ্ছা আচ্ছা, তবে ঐ শৃগালচর্মাবৃত বেদীতে উপবেশন করুন। এখন কৃপা ক’রে বলুন কি প্রয়োজনে আগমন হয়েছে। মাতুল, আগে তো কখনও আপনাকে দেখি নি।’

‘দেখবেন কি করে মহারাজ। আমি অন্তরালেই বাস করি, তা ছাড়া গত তের বৎসর বিদেশে ছিলাম। কুব্জতার জন্য ক্ষত্রিয়ধর্ম পালন আমার সাধ্য নয়, সে কারণে যন্ত্রমন্ত্রবিদ্যার চর্চা ক’রে তাতেই সিদ্ধিলাভ করেছি। দেবশিল্পী বিশ্বকর্মা আমাকে বরদানে কৃতার্থ করেছেন। পান্ডবরাজ শুনেছি দ্যূতক্রীড়ায় আপনার পটুতা অসামান্য, অক্ষহৃদয় আপনার নখদর্পণে।’

‘হুঁ, লোকে তাই বলে বটে।’

‘তথাপি শকুনির হাতে আপনার পরাজয় ঘটেছে। কেন জানেন কি?’

যুধিষ্ঠির ভ্রূ কুঞ্চিত ক’রে বললেন, ‘শকুনি ধর্মবিরুদ্ধ কপট দ্যূতে আমাকে হারিয়েছিলেন।’

মৎকুনি একটু হেসে বললেন, ‘দ্যূতে কপট আর অকপট ব’লে কোনও ভেদ নেই। অক্ষক্রীড়ায় দৈবই উভয় পক্ষের অবলম্বন, অজ্ঞ লোকে তাকে অকপট বলে। যদি এক পক্ষ দৈবের উপর নির্ভর করে এবং অপর পক্ষ পুরুষকার দ্বারা জয়লাভ করে, তবে পরাজিত পক্ষ কপটতার অভিযোগ আনে। ধর্মরাজ, আপনার দৈবপাতিত অক্ষ শকুনির পুরুষকারপাতিত অক্ষের নিকট পরাস্ত হয়েছে। আপনি প্রবলতর পুরুষকার আশ্রয় করুন, রাবণবাণের বিরুদ্ধে রামবাণ প্রয়োগ করুন, দ্যূতলক্ষ্মী আপনাকেই বরণ করবেন।’

‘মাতুল, আপনার বাক্য আমার ঠিক বোধগম্য হচ্ছে না। লোকে বলে শকুনির অক্ষের অভ্যন্তরে এক পার্শ্বে স্বর্ণপট্ট নিবদ্ধ আছে, তারই ভারে সেই পার্শ্ব সর্বদা নিম্নবর্তী হয় এবং উপরে গরিষ্ঠ বিন্দুসংখ্যা প্রকাশ করে।’

‘মহারাজ, লোকে কিছুই জানে না। স্বর্ণগর্ভ বা পারদগর্ভ পাশক নিয়ে অনেকে খেলে বটে, কিন্তু তার পতন সুনিশ্চিত নয়, বহুবারের মধ্যে কয়েকবার ভ্রংশ হ’তেই হবে। আপনারা তো অনেক বাজি খেলেছিলেন, একবারও কি আপনার জিত হয়েছিল?’

যুধিষ্ঠির দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বললেন, ‘একবারও নয়।’

‘তবে? শকুনি কাঁচা খেলোয়াড় নন, তিনি অব্যর্থ পাশক না নিয়ে কখনই আপনার সঙ্গে খেলতেন না।’

‘কিন্তু এখন এসব কথার প্রয়োজন কি। যুদ্ধ আসন্ন, পুনর্বার দ্যূতক্রীড়ার সম্ভাবনা নেই, শকুনিকে হারাবার সামর্থ্যও আমার নেই।’

‘ধর্মপুত্র, নিরাশ হবেন না, আমার গূঢ় কথা এইবারে শুনুন। শকুনির অক্ষ আমারই নির্মিত, তার গর্ভে আমি মন্ত্রসিদ্ধ যন্ত্র স্থাপন করেছি, সেজন্য তার ক্ষেপ অব্যর্থ। দুরাত্মা শকুনি যন্ত্রকৌশল শিখে নিয়ে আমাকে গজভুক্তকপিত্থবৎ পরিত্যাগ করেছে। সে আমাকে আশ্বাস দিয়েছিল যে, পাণ্ডবগণের নির্বাসনের পর দুর্যোধন আমাকে ইন্দ্রপ্রস্থের রাজপদ দেবে। আপনারা বনে গেলে, যখন দুর্যোধনকে প্রতিশ্রুতির কথা জানালাম, তখন সে বললে—আমি কিছুই জানি না, মামাকে বল। শকুনি বললে—আমি কি জানি, দুর্যোধনের কাছে যাও। অবশেষে দুই নরাধম আমাকে ছলেবলে দুর্গম বাহ্লীক দেশে পাঠিয়ে সেখানে কারারুদ্ধ করে রাখে। আমি তের বৎসর পরে কোনও গতিকে সেখান থেকে পালিয়ে এসে আপনার শরণাপন্ন হয়েছি।’

যুধিষ্ঠির বললেন, ‘ও, এখন বুঝি আমাকেই অক্ষরূপে চালনা ক’রে রাজ্যলাভ করতে চান!’

‘ধর্মরাজ, আমার পূর্বাপরাধ মার্জনা করুন, যা হবার তা হ’য়ে গেছে, এখন আমাকে আপনার পরম হিতাকাঙ্ক্ষী ব’লে জানবেন। আমি বামন হ’য়ে ইন্দ্রপ্রস্থরূপ চন্দ্রে হস্তপ্রসার করেছিলাম, তাই আমার এই দুর্দশা। আপনি বিজয়ী হ’য়ে শকুনিকে বিতাড়িত ক’রে আমাকে গান্ধাররাজ্য দেবেন, তাতেই আমি সন্তুষ্ট হব।’

‘আপনার নির্মিত অক্ষে আমার সর্বনাশ হয়েছে তারই পুরস্কারস্বরূপ?’

মৎকুনি জিহ্বা দংশন ক’রে বললেন, ‘ও কথা তুলবেন না মহারাজ! আমার বক্তব্য সবটা শুনুন। আমি গুপ্ত সংবাদ পেয়েছি—সঞ্জয় এখনই ধৃতরাষ্ট্রের আজ্ঞায় আপনার কাছে আসছেন। দুর্যোধন আর শকুনির প্ররোচনায় অন্ধ রাজা আবার আপনাকে দ্যূতক্রীড়ায় আহ্বান করছেন। মহারাজ, এই মহা সুযোগ ছাড়বেন না।’

এমন সময় রথের ঘর্ঘর ধ্বনি শোনা গেল। মৎকুনি ত্রস্ত হ’য়ে বললেন, ‘ঐ সঞ্জয় এসে পড়লেন। দোহাই মহারাজ, ধৃতরাষ্ট্রের প্রস্তাব সদ্য প্রত্যাখ্যান করবেন না, বলবেন যে আপনি বিবেচনা ক’রে পরে উত্তর পাঠাবেন। সঞ্জয় চ’লে গেলে আমার সব কথা আপনাকে জানাব। আমি আপাতত ঐ পাশের ঘরে লুকিয়ে থাকছি।’

যথাবিধি কুশলপ্রশ্নাদি বিনিময়ের পর সঞ্জয় বললেন, ‘পাণ্ডবশ্রেষ্ঠ, কুরুরাজ ধৃতরাষ্ট্র বিদুরকেই আপনার কাছে পাঠাতে চেয়েছিলেন, কিন্তু বিদুর এই অপ্রিয় কার্যে কিছুতেই সম্মত না হওয়ায় রাজাজ্ঞায় আমাকেই আসতে হয়েছে। আমি দূত মাত্র, আমার অপরাধ নেবেন না। ধৃতরাষ্ট্র এই বলেছেন—বৎস যুধিষ্ঠির, তোমরা পঞ্চ ভ্রাতা অমার শত পুত্রের সমান স্নেহপাত্র। এই লোকক্ষয়কর জ্ঞাতিধ্বংসী আসন্ন যুদ্ধ যে কোনও উপায়ে নিবারণ করা কর্তব্য। আমি অশক্ত অন্ধ বৃদ্ধ, আমার পুত্রেরা অবাধ্য এবং যুদ্ধের জন্য উৎসুক। আমি বহু চিন্তা করে স্থির করেছি যে হিংস্র অস্ত্রযুদ্ধের পরিবর্তে অহিংস দ্যূতযুদ্ধেই উভয় পক্ষের বৈরভাব চরিতার্থ হ’তে পারে। অতি কষ্টে আমার পুত্রগণ ও তাদের মিত্রগণকে এতে সম্মত করেছি। অতএব তুমি সবান্ধব কৌরব—শিবিরে এসে আর একবার সুহৃদদ্যূতে প্রবৃত্ত হও। পণ পূর্ববৎ সমগ্র কুরুপাণ্ডবরাজ্য। যদি দুর্যোধনের প্রতিনিধি শকুনির পরাজয় ঘটে তবে কুরুপক্ষ সদলে রাজ্য ত্যাগ ক’রে চিরতরে বনবাসে যাবে। যদি তুমি পরাস্ত হও তবে তোমরাও রাজ্যের আশা ত্যাগ ক’রে চিরবনবাসী হবে। বৎস, তুমি কপটতার আশঙ্কা ক’রো না। আমি দুই প্রস্থ অক্ষ সজ্জিত রাখব, তুমি স্বহস্তে নিজের জন্য বেছে নিও, অবশিষ্ট অক্ষ শকুনি নেবেন। এর চেয়ে অসন্দিগ্ধ ব্যবস্থা আর কি হ’তে পারে? সঞ্জয়ের মুখে তোমার সম্মতি পাবার আশায় উদগ্রীব হ’য়ে রইলাম। হে তাত যুধিষ্ঠির তোমার সুমতি হ’ক , তোমাদের পঞ্চ ভ্রাতার কল্যাণ হ’ক, অষ্টাদশ অক্ষ্মৌহিণী সহ কুরুপান্ডবের প্রাণ রক্ষা হ’ক।’

যুধিষ্ঠির জিজ্ঞাসা করলেন, ‘জ্যেষ্ঠতাত কি স্বয়ং এই বাণী রচনা করেছেন? আমার মনে হয় তাঁর মন্ত্রদাতা দুর্যোধন আর শকুনি, বৃদ্ধ কুরুরাজ শুধু শুকপক্ষিবৎ আবৃত্তি করেছেন। মহামতি সঞ্জয়, আপনি আমাকে কি করতে বলেন?’

‘ধর্মপুত্র, আমি কুরুরাজ্যের আজ্ঞাপতি বার্তাবহ মাত্র, নিজের মত জানাবার অধিকার আমার নেই। আপনি রাজবুদ্ধি ও ধর্মবুদ্ধি আশ্রয় করুন, আপনার মঙ্গল হবে।’

‘তবে আপনি কুরুরাজকে জানাবেন যে তিনি আমাকে অতি দুরূহ সমস্যায় ফেলেছেন, আমি সম্যক বিবেচনা ক’রে পরে তাঁকে উত্তর পাঠাব। এখন আপনি বিশ্রামান্তে আহারাদি করুন, কাল ফিরে যাবেন।’

‘না মহারাজ, আমাকে এখনই ফিরতে হবে, বিশ্রামের অবসর নেই। ধর্মপুত্রের জয় হোক।’ এই ব’লে সঞ্জয় বিদায় নিলেন।

মৎকুনি পাশের ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বললেন, ‘মহারাজ, আপনি ঠিক উত্তর দিয়েছেন। এইবার আমার মন্ত্রণা শুনুন। আজই অপরাহ্নে ধৃতরাষ্ট্রের কাছে একজন বিশ্বস্ত দূত পাঠান, কিন্তু আপনার ভ্রাতারা যেন জানতে না পারেন। আপনার দূত গিয়ে বলবে—হে পূজ্যপাদ জ্যেষ্ঠতাত, আপনার আজ্ঞা শিরোধার্য, অতি অপ্রিয় হ’লেও তৃতীয়বার দ্যূতক্রীড়ায় আমি সম্মত আছি। আপনার আয়োজিত অক্ষে আমার প্রয়োজন নেই, আমি নিজের অক্ষেই নির্ভর করব। শকুনিও নিজের অক্ষে খেলবেন। আপনি যে পণ নির্ধারণ করেছেন তাতেও আমার সম্মতি আছে। শুধু এই নিয়মটি আপনাকে মেনে নিতে হবে যে শকুনি আর আমি প্রত্যেকে একটিমাত্র অক্ষ নিয়ে খেলব এবং তিনবার মাত্র অক্ষক্ষেপণ করব, তাতে যার বিন্দুসমষ্টি অধিক হবে তারই জয়।’

যুধিষ্ঠির বললেন, ‘হে সুবলনন্দন মৎকুনি, আপনি সম্পর্কে আমার মাতুল হন,কিন্তু এখন বোধ হচ্ছে আপনি বাতুল। আমি কোন ভরসায় আবার শকুনির সঙ্গে খেলতে স্পর্ধা করব? যদি আপনি আমাকে শকুনির অনুরূপ অক্ষ প্রদান করেন তাতে সমান সমান প্রতিযোগ হবে, কিন্তু আমার জয়ের স্থিরতা কোথায়? ধৃতরাষ্ট্রের আয়োজিত অক্ষে আপত্তির কারণ কি? আমার ভ্রাতাদের মত না নিয়েই বা কেন এই দ্যূতক্রীড়ায় সম্মতি দেব? তিনবার মাত্র অক্ষ ক্ষেপণের উদ্দেশ্য কি? বহুবার ক্ষেপণেই তো সংখ্যাবৃদ্ধির সম্ভাবনা অধিক। আর আপনি যে দুর্যোধনের চর নন তারই বা প্রমাণ কি?’

মৎকুনি বললেন, ‘মহারাজ, স্থিরোভব। আপনার সমস্ত সংশয় আমি ছেদন করছি। যদি আপনি ধৃতরাষ্ট্রের আয়োজিত অক্ষ নিয়ে খেলেন তবে আপনার পরাজয় অনিবার্য। ধূর্ত শকুনি সে অক্ষে খেলবে না, হাতে নিয়ে ইন্দ্রজালিকের ন্যায় বদলে ফেলে নিজের আগেকার অক্ষেই খেলবে। আমি এতকাল বাহ্লীক দুর্গে নিশ্চেষ্ট ছিলাম না, নিরন্তর গবেষণায় প্রচণ্ডতর মন্ত্রশক্তিযুক্ত অক্ষ উদভাবন করেছি। আপনাকে এই নবযন্ত্রান্বিত আশ্চর্য অক্ষ দেব, তার কাছে এলেই শকুনির পুরাতন অক্ষ একেবারে বিকল হয়ে যাবে। মহারাজ, আপনার জয়ে কিছুমাত্র সংশয় নেই। আপনার ভ্রাতারা যুদ্ধলোলুপ, আপনার তুল্য স্থিরবুদ্ধি দূরদর্শী নন। তাঁরা আপনাকে বাধা দেবেন, ফলে এই রক্তপাতহীন বিজয়ের মহা সুযোগ আপনি হারাবেন। আপনি আগে ধৃতরাষ্ট্রকে সংবাদ পাঠান, তার পর আপনার ভ্রাতাদের জানাবেন। তাঁরা ভর্ৎসনা করলে আপনি হিমালয়বৎ নিশ্চল থাকবেন।’

‘কিন্তু দ্রৌপদী? আপনি তাঁর কটুবাক্য শোনেন নি।’

‘মহারাজ, স্ত্রীজাতির ক্রোধ তৃণাগ্নিতুল্য, তাতে পর্বত বিদীর্ণ হয় না। কদিনেরই বা ব্যাপার, আপনার জয়লাভ হ’লে সকল নিন্দুকের মুখ বন্ধ হবে। তারপর শুনুন—আমার যন্ত্র অতি সূক্ষ্ম, সেজন্য এক দিনে অধিকবার অক্ষক্ষেপণ অবিধেয়। শকুনির অক্ষও দীর্ঘকাল সক্রিয় থাকে না, সেজন্য সে আনন্দে আপনার প্রস্তাবে সম্মত হবে। আপনার জয়ের পক্ষে তিনবার ক্ষেপণই যথেষ্ট। অক্ষ আমার সঙ্গেই আছে, পরীক্ষা ক’রে দেখুন।’

মৎকুনি তাঁর কটিলগ্ন থলি থেকে একটি গজদন্তনির্মিত অক্ষ বার করলেন। যুধিষ্ঠির লক্ষ্য করলেন, অক্ষটি শকুনির অক্ষেরই অনুরূপ, তেমনিই সুগঠিত সুমসৃণ, ধার এবং পৃষ্ঠগুলি ঈষৎ গোলাকার, প্রতি বিন্দুর কেন্দ্রে একটি সূক্ষ্ম ছিদ্র।

মৎকুনি বললেন, ‘মহারাজ, তিনবার ক্ষেপণ ক’রে দেখুন।’

যুধিষ্ঠির তাই করলেন, তিনবারই ছয় বিন্দু উঠল। তিনি আশ্চর্য হয়ে নেড়ে চেড়ে দেখতে লাগলেন, কিন্তু মৎকুনি ঝটিতি কেড়ে নিয়ে থলির ভিতর রেখে বললেন, ‘এই মন্ত্রপূত অক্ষ অনর্থক নাড়াচাড়া নিষিদ্ধ, তাতে গুণহানি হয়।’

যুধিষ্ঠির বললেন, ‘আপনার অক্ষটি নির্ভরযোগ্য বটে। কিন্তু এর পর আপনি যে বিশ্বাসঘাতকতা করবেন না তার জন্য দায়ী কে?’

‘দায়ী আমার মুণ্ড। আপনি এখন থেকে আমাকে বন্দী ক’রে রাখুন, দুজন খড়গপাণি প্রহরী নিরন্তর আমার সঙ্গে থাকুক। তাদের আদেশ দিন—যদি আপনার পরাজয়ের সংবাদ আসে তবে তখনই মুণ্ডুচ্ছেদ করবে। মহারাজ, এখন আপনার বিশ্বাস হয়েছে?’

‘হয়েছে। কিন্তু শকুনির কূট পাশক যদি আমার কূটতর পাশকের দ্বারা পরাভূত হয় তবে তা ধর্মবিরুদ্ধ কপট দ্যূত হবে।’

‘হায় হায় মহারাজ, এখনও আপনার কপটতার আতঙ্ক গেল না! আপনারা দুজনেই তো যন্ত্রগর্ভ কূট পাশক নিয়ে খেলবেন, এতে কপটতা কোথায়? মল্লযুদ্ধে যদি আপনার বাহুবল বিপক্ষের চেয়ে বেশী হয় তবে সেকি কপটতা? যদি আপনার কৌশল বেশী থাকে সে কি কপটতা? শকুনির পাশাতে যে কূট কৌশল নিহিত আছে তা আমারই, আপনার পাশাতে যে কূটতর কৌশল আছে তাও আমার। ধর্মরাজ, এই তৃতীয়দ্যূতসভায় বস্তুত আমিই উভয় পক্ষ, আপনি আর শকুনি নিমিত্তমাত্র।’

যুধিষ্ঠির বললেন, ‘মৎকুনি, আপনার বক্তৃতা শুনে আমার মাথা গুলিয়ে যাচ্ছে। ধর্মের গতি অতি সূক্ষ্ম, আমি কঠিন সমস্যায় পড়েছি। এক দিকে লোকক্ষয়কর নৃশংস যুদ্ধ, অন্য দিকে কূট দ্যূতক্রীড়া। দুইই আমার অবাঞ্ছিত, কিন্তু যুদ্ধে আহ্বান প্রত্যাখ্যান করা যেমন রাজধর্মবিরুদ্ধ, সেইরূপ জ্যেষ্ঠতাতের আমন্ত্রণ অগ্রাহ্য করাও আমার প্রকৃতিবিরুদ্ধ। আপনার মন্ত্রণা আমি অগত্যা মেনে নিচ্ছি, আজই কুরুরাজের কাছে দূত পাঠাব। আপনি এখন থেকে সশস্ত্র প্রহরী দ্বারা রক্ষিত হয়ে গুপ্তগৃহে বাস করবেন, কুরুপাণ্ডব কেউ আপনার খবর জানবেন না। যদি জয়ী হই, আপনি গান্ধাররাজ্য পাবেন। যদি পরাজিত হই তবে আপনার মৃত্যু। এখন আপনার পাশকটি আমাকে দিন।’

‘মহারাজ, আপনার কাছে পাশক থাকলে পরিচর্যার অভাবে তার গুণ নষ্ট হবে। আমার কাছেই থাকুক, আমি তাতে নিয়ত মন্ত্রাধান করব এবং দূতযাত্রার পূর্বে আপনাকে দেব। ইচ্ছা করেন তো আপনি প্রত্যহ একবার আমার কাছে এসে খেলে দেখতে পারেন।’

যুধিষ্ঠির বললেন, ‘মৎকুনি, আপনার অতি তুচ্ছ জীবন আমার হাতে, কিন্তু আমার বুদ্ধি রাজ্য ধর্ম সমস্তই আপনার হাতে। আপনার বশবর্তী হওয়া ভিন্ন আমার এখন অন্য গতি নেই।’

পরদিন যুধিষ্ঠির তাঁর ভ্রাতৃবৃন্দকে আসন্ন দ্যূতের কথা জানালেন। ধর্মরাজের এই বুদ্ধিভ্রংশের সংবাদে সকলেই কিয়ৎক্ষণ হতভম্ব হয়ে থাকবার পর তাঁকে যেসব কথা বললেন তার বিবরণ অনাবশ্যক। যুধিষ্ঠির নিশ্চল হয়ে সমস্ত গঞ্জনা নীরবে শুনলেন, অবশেষে বললেন, ‘ভ্রাতৃগণ, আমি তোমাদের জ্যেষ্ঠ, আমাকে তোমরা রাজা ব’লে থাক। অপরের বুদ্ধি না নিয়েও রাজা নিজের কর্তব্য স্থির করতে পারেন। যুদ্ধে অসংখ্য নরহত্যার চেয়ে দ্যূতসভায় ভাগ্যনির্ণয় আমি শ্রেয় মনে করি। জয় সম্বন্ধে আমি কেন নিঃসন্দেহ তার কারণ আমি এখন প্রকাশ করতে পারব না। যদি তোমরা আমার উপর নির্ভর করতে না পার তো স্পষ্ট বল, আমি কুরুরাজকে সংবাদ পাঠাব—হে জ্যেষ্ঠতাত, আমি ভ্রাতৃগণ কর্তৃক পরিত্যক্ত, তারা আমাকে পাণ্ডবপতি বলে মানে না, দ্যূতসভায় রাজ্যপণের অধিকার আমার আর নেই, আমার অঙ্গীকার—ভঙ্গের প্রায়শ্চিত্তস্বরূপ অগ্নিপ্রবেশে প্রাণ বিসর্জন দিচ্ছি আপনি যথাকর্তব্য করবেন।’

তখন অর্জুন অগ্রজের পাদস্পর্শ ক’রে বললেন, ‘পাণ্ডবপতি, আপনি প্রসন্ন হ’ন, আমাদের কটুক্তি মার্জনা করুন, আমাকে সর্ববিষয়ে আপনার অনুগত ব’লে জানবেন।’

তারপর ভীম নকুল সহদেবও যুধিষ্ঠিরের ক্ষমা ভিক্ষা করলেন। যুধিষ্ঠির সকলকে আশীর্বাদ করে তাঁর গৃহে চলে গেলেন।

দ্রৌপদী এতক্ষণ কোনও কথা বলেন নি। যে মানুষ এমন নির্লজ্জ যে দু—দু বার হেরে গিয়ে চূড়ান্ত দুঃখভোগের পরেও আবার জুয়ো খেলতে চায় তাকে ভর্ৎসনা করা বৃথা। যুধিষ্ঠির চ’লে গেলে দ্রৌপদী সহদেবের দিকে তীক্ষ্ন দৃষ্টিপাত ক’রে বললেন, ‘ছোট আর্যপুত্র, হাঁ ক’রে দেখছ কি? ওঠ, এখনই দ্রুতগামী চতুরশ্বযোজিত রথে দ্বারকায় যাত্রা কর, বাসুদেবকে সব কথা ব’লে এখনই তাঁকে নিয়ে এস। তিনিই একমাত্র ভরসা, তোমরা পাঁচ ভাই তো পাঁচটি অপদার্থ জড়পিণ্ড।’

দশ দিনের মধ্যে কৃষ্ণকে নিয়ে সহদেব পাণ্ডবশিবিরে ফিরে এলেন। রথ থেকে নেমে কৃষ্ণ বললেন, ‘দাদাও আসছেন।’ যুধিষ্ঠির সহর্ষে বললেন, ‘কি আনন্দ, কি আনন্দ! দ্রৌপদী অতি ভাগ্যবতী, তাঁর আহ্বানে কৃষ্ণ বলরাম কেউ স্থির থাকতে পারেন না।’

ক্ষণকাল পরে দারুকের রথে বলরাম এসে পৌঁছলেন। রথ থেকেই অভিবাদন ক’রে বললেন, ‘ধর্মরাজ, শুনলাম আপনারা উত্তম কৌতূকের আয়োজন করেছেন। কুরুপাণ্ডবের যুদ্ধ আমি দেখতে চাই না, কিন্তু আপনাদের খেলা দেখবার আমার প্রবল আগ্রহ। এখানে নামব না, আমরা দুই ভাই পাণ্ডবদের কাছে থাকলে পক্ষপাতের অপযশ হবে, তা ছাড়া এখানে পানীয়ের ভাল ব্যবস্থা নেই। কৃষ্ণ এখানে থাকুক, আমি দুর্যোধনের আতিথ্য নেব। দ্যূতসভায় আবার দেখা হবে। চালাও দারুক।’ এই ব’লে বলরাম কৌরবশিবিরে চ’লে গেলেন।

মহা সমারোহে দ্যূতসভা বসেছে। ধৃতরাষ্ট্র স্থির থাকতে পারেন নি, হস্তিনাপুর থেকে দুদিনের জন্য কৌরবশিবিরে এসেছেন, খেলার ফলাফল দেখে ফিরে যাবেন। শকুনির দক্ষতায় তাঁর অগাধ বিশ্বাস, কুরুপক্ষের জয় সম্বন্ধে তাঁর কিছু মাত্র সন্দেহ নেই।

সভায় কৃষ্ণবলরাম, পঞ্চপাণ্ডব, দুর্যোধনাদি সহ ধৃতরাষ্ট্র, শকুনি, দ্রোণ, কর্ণ প্রভৃতি সকলে উপস্থিত হ’লে পিতামহ ভীষ্ম বললেন, ‘আমি এই দ্যূতসভার সম্যক নিন্দা করি। কিন্তু আমি কুরুরাজের ভৃত্য, সেজন্য অত্যন্ত অনিচ্ছাসত্ত্বেও এই গর্হিত ব্যাপার দেখতে হবে।’

দ্রোণাচার্য বললেন, ‘আমি তোমার সঙ্গে একমত।’

ভীষ্ম বললেন, ‘মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র, এই সভায় দ্যূতনীতিবিরুদ্ধ কোনও কর্ম যাতে না হয় তার বিধান তোমার কর্তব্য। আমি প্রস্তাব করছি শ্রীকৃষ্ণকে সভাপতি নিযুক্ত করা হ’ক।’

দুর্যোধন আপত্তি তুললেন, ‘শ্রীকৃষ্ণ পাণ্ডবপক্ষপাতী।’

কৃষ্ণ বললেন, ‘কথাটা মিথ্যা নয়। আর, আমার অগ্রজ উপস্থিত থাকতে আমি সভাপতি হ’তে পারি না।’

তখন ধৃতরাষ্ট্র সর্বসম্মতিক্রমে বলরামকে সভাপতি পদে বরণ করলেন।

বলরাম বললেন, ‘বিলম্বে প্রয়োজন কি, খেলা আরম্ভ হ’ক। হে সমবেত সুধীবৃন্দ, এই দ্যূতে কুরুপক্ষে শকুনি পান্ডবপক্ষে যুধিষ্ঠির নিজ নিজ একটিমাত্র অক্ষ নিয়ে খেলবেন। প্রত্যেকে তিনবার মাত্র অক্ষপাত করবেন। যাঁর বিন্দুসমষ্টি অধিক হবে তাঁরই জয়। এই দ্যূতের পণ সমগ্র কুরুপাণ্ডব রাজ্য। পরাজিত পক্ষ বিজয়ীকে রাজ্য সমর্পণ ক’রে এবং যুদ্ধের বাসনা পরিহার ক’রে সদলে চিরবনবাসী হবেন। সুবলনন্দন শকুনি, আপনি বয়োজ্যেষ্ঠ, আপনিই প্রথম অক্ষপাত করুন।’

শকুনি সহাস্যে অক্ষ নিক্ষেপ ক’রে বললেন, ‘এই জিতলাম।’ তাঁর পাশাটি পতনমাত্র একটু গড়িয়ে গিয়ে স্থির হ’লে তাতে ছয় বিন্দু দেখা গেল। কর্ণ এবং দুর্যোধনাদি সোল্লাসে উচ্চৈচঃস্বরে বললেন, ‘আমাদের জয়।’

বলরাম বললেন, ‘যুধিষ্ঠির, এইবার আপনি ফেলুন।’

যুধিষ্ঠিরের পাশা একবার ওলটাবার পর স্থির হ’লে তাতেও ছয় বিন্দু উঠল। পাণ্ডবরা বললেন, ‘ধর্মরাজের জয়।’

বলরাম বললেন, ‘তোমরা অনর্থক চিৎকার করছ। কারও জয় হয় নি, দুই পক্ষই এখন পর্যন্ত সমান।’

শকুনি গম্ভীরবদনে বললেন, ‘এখনও দুই ক্ষেপ বাকী, তাতেই জিতব।’

দ্বিতীয়বারে শকুনি পাশা আর গড়াল না, পড়েই স্থির হ’ল। পৃষ্ঠে পাঁচ বিন্দু। যুধিষ্ঠিরের পাশায় পূর্ববৎ ছয় বিন্দু উঠল। শকুনি লক্ষ্য করলেন তাঁর পাশাটি কাঁপছে।

পাণ্ডবপক্ষ আনন্দে গর্জন ক’রে উঠলেন। বলরাম ধমক দিয়ে বললেন, ‘খবরদার, ফের চিৎকার করলেই সভা থেকে বার ক’রে দেব।’

সভা স্তব্ধ। শেষ অক্ষপাত দেখবার জন্য সকলেই শ্বাসরোধ ক’রে উদগ্রীব হয়ে রইলেন!

শকুনি পাংশুমুখে তৃতীয়বার পাশা ফেললেন। পাশাটি কর্দম—পিণ্ডবৎ ধপ ক’রে পড়ল। এক বিন্দু।

যুধিষ্ঠিরের পাশায় আবার ছয় বিন্দু উঠল। বলরাম মেঘমন্দ্র স্বরে ঘোষণা করলেন, ‘যুধিষ্ঠিরের জয়।’

তখন সভাস্থ সকলে সবিস্ময়ে দেখলেন, যুধিষ্ঠিরের পতিত পাশা ধীরে ধীরে লাফিয়ে শকুনির পাশার দিকে অগ্রসর হচ্ছে।

সভায় তুমুল কোলাহল উঠল, মায়া মায়া, কুহক, ইন্দ্রজাল!

দুর্যোধন হাত পা ছুড়ে বললেন, ‘যুধিষ্ঠির নিকৃতি আশ্রয় করেছেন, তাঁর জয় আমরা মানি না। সাধু ব্যক্তির পাশা কখনও চ’লে বেড়ায়?’

বলরাম বললেন, ‘আমি দুই অক্ষই পরীক্ষা করব।’

যুধিষ্ঠির তখনই তাঁর পাশা তুলে নিয়ে বলরামকে দিলেন। শকুনি নিজের পাশাটি মুষ্টিবদ্ধ ক’রে বললেন, ‘আমার অক্ষ কাকেও স্পর্শ করতে দেব না।’

বলরাম বললেন, ‘আমি এই সভার অধ্যক্ষ, আমার আজ্ঞা অবশ্যপাল্য।’

শকুনি উত্তর দিলেন, ‘আমি তোমার আজ্ঞাবহ নই।’

বলরাম কিঞ্চিৎ মত্ত অবস্থায় ছিলেন। তিনি অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে শকুনির গালে একটি চড় মেরে পাশা কেড়ে নিয়ে বললেন, ‘হে সভ্যমণ্ডলী, আমি এই দুই অক্ষই ভেঙে দেখব ভিতরে কি আছে।’ এই বলে তিনি শিলাবেদীর উপরে একে একে দুটি পাশা আছড়ে ফেললেন।

শকুনির পাশা থেকে একটি ঘুরঘুরে পোকা বার হ’য়ে নির্জীববৎ ধীরে ধীরে দাড়া নাড়তে লাগল। যুধিষ্ঠিরের পাশা থেকে একটি ছোট টিকটিকি বেরিয়ে তখন পোকাটিকে আক্রমণ করলে।

বাত্যাহত সাগরের ন্যায় সভা বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠলো। ধৃতরাষ্ট্র ব্যস্ত হয়ে জানতে চাইলেন, ‘কি হয়েছে?’

বলরাম উত্তর দিলেন, ‘বিশেষ কিছু হয় নি, একটি ঘুর্ঘুর কীট শকুনির অক্ষে ছিল—’

ধৃতরাষ্ট্র সভয়ে প্রশ্ন করলেন, ‘কামড়ে দিয়েছে? কি ভয়ানক!’

‘কামড়ায় নি মহারাজ, শকুনির অক্ষের মধ্যে ছিল। এই কীট অতি অবাধ্য, কিছুতেই কাত বা চিত হ’তে চায় না, অক্ষের ভিতর পুরে রাখলে অক্ষ সমেত উবুড় হয়। যুধিষ্ঠিরের অক্ষ থেকে একটি গোধিকা বেরিয়েছে। এই প্রাণী আরও দুর্ধর্ষ, স্বয়ং ব্রহ্মা একে কাত করতে পারেন না। গোধিকার গন্ধ পেয়ে ঘুর্ঘুর ভয়ে অবসন্ন হয়েছিল, তাই শকুনি অভীষ্ট ফল পান নি।’

ধৃতরাষ্ট্র জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কার জয় হ’ল?’

বলরাম বললেন, ‘যুধিষ্ঠিরের। দুই পক্ষই কূট পাশক নিয়ে খেলেছেন, অতএব কপটতার আপত্তি চলে না। শুনেছি শকুনি অতি চতুর, কিন্তু এখন দেখছি যুধিষ্ঠির চতুরতর।’

যুধিষ্ঠির তখন জনান্তিকে বলরামকে মৎকুনির বৃত্তান্ত জানালেন। বলরাম তাঁকে বললেন, ‘ধর্মরাজ, আপনার কুণ্ঠার কিছুমাত্র কারণ নেই, কূট পাশকের ব্যবহার দ্যূতবিধিসম্মত।’

যুধিষ্ঠির পরম অবজ্ঞাভরে বললেন, ‘হলধর, তুমি মহাবীর, কিন্তু শাস্ত্র কিছুই জান না। ভগবান মনু কি বলেছেন শোন—

অপ্রাণিভির্ষৎ ক্রিয়তে তল্লোকে দ্যূতমুচ্যতে।

প্রাণিভিঃ ক্রিয়তে যস্তু স বিজ্ঞেয়ঃ সমাহ্বয়ঃ।।

অর্থাৎ অপ্রাণী নিয়ে যে খেলা তাকেই লোকে দ্যূত বলে, আর প্রাণী নিয়ে খেলার নাম সমাহ্বয়। কুরুরাজ আমাকে অপ্রাণিক দ্যূতেই আমন্ত্রণ করেছেন, কিন্তু দুর্দৈববশে আমাদের অক্ষ থেকে প্রাণী বেরিয়েছে। অতএব এই দ্যূত অসিদ্ধ।’

কর্ণ করতালি দিয়ে বললেন, ‘ধর্মরাজ, তুমি সার্থকনামা।’

বলরাম বললেন, ‘ধর্মরাজের শাস্ত্রজ্ঞান অগাধ, যদিও কাণ্ডজ্ঞানের কিঞ্চিৎ অভাব দেখা যায়। মেনে নিচ্ছি এই দ্যূত অসিদ্ধ। সেক্ষেত্রে পূর্বের দ্যূতও অসিদ্ধ, শকুনি তাতেও ঘুর্ঘুরগর্ভ অক্ষ নিয়ে খেলেছিলেন। কুরুরাজ ধৃতরাষ্ট্র, আপনার শ্যালকের অশাস্ত্রীয় আচরণের জন্য পাণ্ডবগণ বৃথা ত্রয়োদশ বর্ষ নির্বাসন ভোগ করেছেন। এখন তাঁদের পিতৃরাজ্য ফিরিয়ে দিন, নতুবা পরকালে আপনার নরকভোগ অবশ্যম্ভাবী।’

যুধিষ্ঠির উত্তেজিত হয়ে বললেন, ‘আমি কোনও কথা শুনতে চাই না, দ্যূতপ্রসঙ্গে আমার ঘৃণা ধরে গেছে। আমরা যুদ্ধ করেই হৃতরাজ্য উদ্ধার করব। জ্যেষ্ঠতাত, প্রণাম, আমরা চললাম।’

তখন পাণ্ডবগণ মহা উৎসাহে বার বার সিংহনাদ করতে করতে নিজ শিবিরে যাত্রা করলেন। কৃষ্ণ বলরামও তাঁদের সঙ্গে গেলেন।

ফিরে এসেই যুধিষ্ঠির বললেন, ‘আমার প্রথম কর্তব্য মৎকুনিকে মুক্তি দেওয়া। এই হতভাগ্য মূর্খের সমস্ত উদ্যম ব্যর্থ হয়েছে। চল, তাকে আমরা প্রবোধ দিয়ে আসি।’

একুট আগেই পাণ্ডবশিবিরে সংবাদ এসে গেছে দ্যূতসভায় কি একটা প্রচণ্ড গোলযোগ হয়েছে। যুধিষ্ঠিরাদি যখন কারাগৃহে এলেন তখন দুই প্রহরী তর্ক করছিল—মৎকুনির মুণ্ডচ্ছেদ করা উচিত, না শুধু নাসাচ্ছেদেই আপাতত কর্তব্য পালন হবে।

যুধিষ্ঠিরের মুখে সমস্ত বৃত্তান্ত শুনে মৎকুনি মাথা চাপড়ে বললেন, ‘হা, দৈবই দেখছি সর্বত্র প্রবল। আমি গোধিকাকে বেশী খাইয়ে তার দেহে অত্যধিক বলাধান করেছি, তাই সে কৃতঘ্ন জীবন লম্ফঝম্ফ ক’রে আমার সর্বনাশ করেছে। বলদেব তবু সামলে নিয়েছিলেন, কিন্তু ধর্মরাজ শেষটায় শাস্ত্র আউড়ে সব মাটি করে দিলেন। মুক্তি পেয়ে আমার লাভ কি, দুর্যোধন আমাকে নিশ্চয় হত্যা করবে।’

বলরাম বললেন, ‘মৎকুনি, তোমার কোনও চিন্তা নেই, আমার সঙ্গে দ্বারকায় চল। সেখানে অহিংস সাধুগণের একটি আশ্রম আছে, তাতে অসংখ্য উৎকুণ—মৎকুন—মশক—মুষিকাদির নিত্য সেবা হয়। তোমাকে তার অধ্যক্ষ করে দেব, তুমি নব নব গবেষণায় সুখে কালযাপন করতে পারবে।’

১৩৫০ (১৯৪৩)