তুষারে রক্তের দাগ – ২

০২.

বাইরে যা আবহাওয়া, দিন না রাত্রি, বোঝা খুব কঠিন। সারা আকাশ ঘন ধূসর। সূর্য আছে কি নেই কে বলবে? ঘড়ি চলছে, আটটা-কুড়ি। বেশ হাওয়া দিচ্ছে। আর বরফগুড়ি ঝরে পড়ছে সমানে। তার মধ্যে স্কি করতে বেরোনো–বেশ। দমে গেল ধ্ৰুব।

সোনালি বেচারা ঘরেই রয়ে গেছে। কর্নেল তার কাছে বসে আছেন। রিস্তায় একজন মাত্র ডাক্তার আছেন। তার কাছে এই দুর্যোগে তিনি ছাড়া শের সিংকে পাঠানো কারও পক্ষে সম্ভব ছিল না।

ধ্রুব স্টোরে টাকা জমা দিয়ে দুটো স্কি বুট, স্কি, স্কি-পোল নিল। লন থেকে বরফঢাকা পথ সোজা চলে গেছে পাহাড়ের তলায়। ওখানে লাইনে দাঁড়িয়ে, হুইলচেয়ারের জন্যে অপেক্ষা করতে হবে। ধ্রুবর কিছু অভ্যাস আছে। অসুবিধে হবে না। হুইলচেয়ার তখন স্থির নাগরদোলার মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে। গুনে দেখল আটটা চেয়ার আছে মোটমাট। প্রত্যেকটায় দুজন বসার মতো চওড়া। পালাক্রমে উঠে বসতে হবে। আস্তে ঘোরানো হবে এই নাগরদোলা লিফট। পাহাড়ের ওপরে পর্যায়ক্রমে একটা করে চেয়ার পৌঁছবে। আর তক্ষুনি স্কিয়ার লাফ দেবে। বরফের গড়ানে স্কি করে চলে যাবে এদিকে-ওদিকে।

লাইনে অনেক লোক–পনেরজনেরও বেশি। মাঝামাঝি দাঁড়িয়েছিল ধ্রুব। হাওয়ার ঝাপটানি, তাই সবারই মুখ অব্দি পুরো ঢাকা। চোখে প্রত্যেকেই গগল্স পরেছে। ওই জোব্বার ভিতর কে পুরুষ কে মেয়ে চেনা যাচ্ছে না। মাত্র নাকের ডগাটা খোলা, চিবুক অব্দি স্কার্ফ জড়ানো সকলের। একেবারে আনাড়িদের ক্ষেত্রে একজন ইনস্ট্রাক্টার সাহায্য করবে–সে স্কিয়ারের পাশে বসবে উড়ুক্কু চেয়ারটাতে; তাই ডবল সিটের ব্যবস্থা। অন্যান্যরা একা পুরো চেয়ার দখল করবে। ধ্রুব জানিয়ে দিয়েছে লিফটম্যানকে–সে একা বসবে।

স্কি-পোল দুটো চার ফুট উঁচুলোহার রড। তার ডগায় গোল হাতল হাতে ধরার জন্য। অবিকল যেন তলোয়ারের মুঠো। রডের শেষপ্রান্তে একটা হালকা কাঠ আর রবারের একফুট বাই চার ইঞ্চি বাস্কেট, তলাটায় পাতলা লোহার মসৃণ পাত আছে। ওই পোল দুটো দুহাতে ধরে স্কিয়াররা সরু ছিপ নৌকোর মতো লম্বাটে স্কি চালিয়ে ছোটাছুটি করবে।

চেয়ারে ওঠার সময় যথেষ্ট ক্ষিপ্রতা চাই। কারণ দুপায়ে ওই স্কি পরে ওঠা ভারি কঠিন ব্যাপার। শরীর সামনের দিকে বেঁকিয়ে একলাফে পাশ থেকে শূন্যের ওপর দিয়ে চেয়ারে উঠতে হবে–পায়ের কোন সাহায্য এ অবস্থায়। পাওয়া অসম্ভব। ধ্রুবর একটু অস্বস্তি হচ্ছিল। পড়ে গিয়ে পা ভেঙে না যায় ওই শ্রীবাস্তবের মতো।

সে পিছনে আর সামনে তাকাল। কতকগুলো এস্কিমোর মূর্তি যেন স্থিরভাবে অপেক্ষা করছে। কিংবা কতকগুলো অদ্ভুত যন্ত্র যেন। কাকেও মানুষ বলে মনে হচ্ছে না। গায়ের ওপর দিয়ে অবিশ্রান্ত বরফ গড়াচ্ছে। টুপিতে কিছু জমে উঠছে–আবার খসে পড়ছে ঘাড়ে–ঘাড় থেকে পিঠে, পিঠ থেকে নিচে।

লিটম্যানের মূর্তিটি অস্পষ্ট। মাত্র ফুট বিশেক দূরে সব ভাসাভাসা লাগছে। লিফটম্যানের পাশে আরও দুজন সাহায্যকারী দাঁড়িয়ে রয়েছে। এতক্ষণ পরে লিফটম্যানের গর্জন শোনা গেল–বি রেডি এভরিবডি। ওয়ান টু থ্রি…।

লিফট-হুইল নড়ে উঠল। আস্তে ঘুরতে থাকল। ওপর থেকে দুলতে দুলতে দেবযানের মতো চেয়ার নেমে আসছে। আস্তে আস্তে ধ্রুবর সামনের লোকগুলো। পটপট করে উধাও হয়ে যাচ্ছে আকাশপথে। কোথায় পৌঁছচ্ছে একটুও দেখা যাচ্ছে না। একে সব ঝাপসা–তার ওপর চোখে গগল্স। হঠাৎ ধ্রুব দেখল, তার সামনের লোকটি নেই। অমনি সে ওপরে তাকাল। পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রি কোণ থেকে শুন্যে একটা, এগিয়ে আসা চেয়ার দেখতে পেল। সে তৈরি হলো মুহূর্তেই। তারপর সামনে ঝুঁকে লাফ দিয়ে চেয়ারে উঠে বসতেই হাত ফসকে তার স্কি-পোল দুটো পড়ে গেল। সর্বনাশ। সে চেঁচিয়ে উঠল সঙ্গে সঙ্গে–লিফটম্যান! আমার স্কি-পোল!

লিফট কিন্তু বন্ধ হলো না। ধ্রুব ভীষণ ভয় পেয়ে গেল। চেয়ার দুলতে দুলতে উঠে পড়েছে ওপরে। আবছা দেখা গেল তার পোল দুটো ছিটকে চলে যাচ্ছে নিচে। স্কি-পোল ছাড়া নিচে নামা যে অসম্ভব। কোনমতেই অ্যাকসিডেন্ট ঠেকানো যাবে না।

তার চেয়ার চুড়োয় পৌঁছলেও সে লাফ দিয়ে নামতে পারল না। চুপচাপ বসে পড়ল। এবার তলা দিয়ে যাচ্ছে তার চেয়ার। ভয় হলো, লাইনের কাছে ফিরে যাওয়ামাত্র কেউ লাফ দিয়ে নির্ঘাত তার ওপর চড়ে বসবে এবং হয়তো অ্যাকসিডেন্ট ঘটাবে। সে লিটম্যানের কাছ ঘেঁষে যাবার সময় তাকে ডেকে বিপদটা বলার জন্যে যেই চেঁচিয়েছে, অমনি–অবাক কাণ্ড, তার চেয়ারের সামনেই পোলদুটো দেখতে পেল–নিচে লিফটম্যান চেঁচাল, হাই ম্যান। তোমার পোল। খাপ করে ধরে ফেলতে চেষ্টা করল ধ্রুব–কিন্তু পারল না।

পাশ দিয়ে যাবার সময় ওদের হো-হো হাসি শুনতে পেল সে। যাক, আবার ঘুরে এলে চেষ্টা করবে। অবশ্যি যদি ফের পোলদুটো ওরা এগিয়ে দেয় তাকে।

তার চেয়ার ফিরে এল লাইনের কাছে। কিন্তু আর কোন লোক নেই লাইনে। সব উঠে গেছে এবং চুড়ো থেকে নেমে পড়েছে অনেকে। ওপাশের উপত্যকায় এতক্ষণ জোর স্কি শুরু হয়েছে। আফসোস হতে লাগল ধ্ৰুবর।

তার মাথার ওপর যে চেয়ারটা–তা অন্তত ছফুট দূরে। ওঠবার মুখে আবছা দেখা গেল যেন দুজন পাশাপাশি বসে রয়েছে। তাহলে অবশ্যই একজন ইনস্ট্রাক্টার, অন্যজন নতুন স্কিয়ার। ওপরে ওঠার পর সে লক্ষ্য করল ওই চেয়ার থেকে দুটো স্কি-পোল হঠাৎ নিচে পড়ে গেল। কীভাবে পড়ে গেল্প, বুঝতে পারল না ধ্রুব। এত আবছায়া স্পষ্ট কিছু বোঝা গেল না। এও আনাড়ি একজন–তার চেয়েও হয়তো আনাড়ি। বরফবৃষ্টির মধ্যে স্পষ্ট দেখার চেষ্টা দিয়ে নামতে এবং প্রচণ্ড বেগে স্কি করে অদৃশ্য হতে দেখল ধ্রুব। আরেকজন বসে রইল–তার মতোই বেচারা! তাকে নিয়ে চেয়ার তলা দিয়ে ঘুরে চলে গেল আগের মতো।

ধ্রুবর কানে লিফটম্যানের সেই হাসিটি ভাসছিল। এ মুহূর্তে মনে পড়ামাত্র সে খেপে গেল। রোসো ব্যাটারা! ধ্রুব চৌধুরী নিজে তার পোল কুড়িয়ে আনবে।

সে লাফ দিল।

কিন্তু তেমন কিছু ঘটল না। বরফের ওপর আটকে গেল তার দু পায়ের দুটো স্কি–কিন্তু আর নড়াচড়া করা কঠিন–ব্যালান্স রাখা যাবে না। সে খুব তাড়াতাড়ি হেঁট হয়ে স্কি দুটো খুলে রাখল পা থেকে। তারপর ঘুরে দাঁড়াল।

যতক্ষণ একজন স্কিয়ারও চেয়ারে থাকবে, লিফট বন্ধ হবে না–ঘুরতে থাকবে। সেই চেয়ারটা লক্ষ্য করল ধ্রুব। ভীষণ অস্পষ্ট দেখাচ্ছে। একটু পরে মাথার ওপর এলে কিছু স্পষ্ট হলো। তখন চমকে উঠল সে।

স্কিয়ারের বুকের ওপর কী যেন উঁচু হয়ে আছে। কেমন অস্বাভাবিক দেখাচ্ছে লোকটাকে। ওভাবে বসে থাকা চেয়ারটা নিচের দিকে ঘুরে যাবার মুহূর্তে সেই উঁচু জিনিসটা আবছা দেখতে পেল–একটা স্কি-পোল। কিন্তু ওভাবে বুকের ওপর অর্ধেকটা হাতলশুদ্ধ উঁচু হয়ে আছে কেন?

ওই চেয়ারে ছিল চারটে স্কি-পোল–দুজনের। দুটো পড়ে যেতে দেখেছে। বাকি দুটো নিয়ে ওর সঙ্গী স্কি করতে চলে গেছে। তাহলে ওটা এল কোত্থেকে? অবশ্য দক্ষ স্কিয়ার একটা পোলের সাহায্যেও স্কি করতে পারে। কিন্তু পোলটা ওভাবে ওর বুকের ওপর কেন?

 লিফট এখনও থামেনি। স্কি দুটো বগলে ধরে ধ্রুব হামাগুড়ি দিতে দিতে বরফ ভেঙে উঠতে থাকল। সেইসময় চমকাল দ্বিতীয়বার।

সাদা বরফের ওপর চাপচাপ কালোরঙের ওগুলো কী?

গগলস খুলল সে। পিটপিটে চোখে দেখল, রক্ত। রক্ত! মুহূর্তে শিউরে উঠল ধ্রুব। পোলটা বুকের ওপর ওই ভাবে থাকার স্পষ্ট অর্থ টের পেল সে। মার্ডার–খুন! ওই স্কিয়ারটার বুকে পোলটা বিঁধিয়ে দিয়েছে কে।

ভাঙা গলায় চেঁচিয়ে উঠল সে– লিফটম্যান! স্টপ দা হুইল! থামাও! রোখকে!

অতদূরে নিচে তার চিৎকার শোনা অসম্ভব কারো পক্ষে। সেই চেয়ারটা আবার আসছে। ধ্রুব স্কি দুটো রেখে তৈরি হয়ে একপাশে দাঁড়িয়ে গেল।

তারপর চেয়ারটা মাথার কাছাকাছি উচ্চতায় পৌঁছানোমাত্র সে স্কিয়ার লোকটির পায়ের একটা স্কি ধরে জোরে হ্যাঁচকা টান দিল। অমনি সে ছিটকে নিচে গিয়ে পড়ল। উবুড় হয়ে পড়ায় স্কি-পোলটা হয়তো আরো ঢুকে গেল। বুকে–হয়তো পাদুটোও ভাঙল। অদ্ভুত ভঙ্গিতে পড়ে রইল লোকটা।

তর তর করে নামল ধ্রুব। ওকে দুহাতে ধরে চিত করার চেষ্টা করল। একটু কাত করা গেল মাত্র। রক্তে বরফ লাল হয়ে যাচ্ছে।

ধ্রুব লোকটার চোখের গগল্স আর স্কাফটা খুলে ফেলতেই বিস্ময়ে পাথর হয়ে গেল কয়েকমুহূর্তের জন্যে।

ললিতা–মিস ললিতা টোডমল!

স্কি-পোলের ডগা থেকে বাস্কেটটা খুলে কেউ ধারালো ডগাটা তলোয়ারের মতো ওর বুকে এফেঁড়-ওফোঁড় করে বিঁধিয়ে দিয়েছে।…

.

রিস্তায় ক্যাম্প নং একত্র একটা পুলিস ফাঁড়ি আছে মাত্র। বড় থানা ক্যাম্প নং দুই–সে আরও তিন মাইল পশ্চিমে। ফাঁড়ির চার্জে যে লোকটা সে একজন হাবিলদার। নাম গুলাব সিং। কুমড়োর মতো চেহারা। কিন্তু পাহাড় টাহাড় ওর কাছে সমতল মাঠের ব্যাপার। সঙ্গে দুজন সেপাই। সে এসে সোজা হুকুম দিল–আভি জখমী আদমীকো উঠাকে লে আও।

অমনি একজন সেপাই ললিতা টোড়মলের বুক থেকে একটানে পোলটা উপড়ে ফেলল। খানিকটা কালচে রক্ত বেরিয়ে এল। স্কিয়াররা ভিড় করে দাঁড়িয়েছিল। তাদের চোখে গগল্স–একেবারে পুতুল সব। সেপাইটা স্কিপোল অবহেলায় ধরে নাক কুঁচকে বলল, অ্যাকসিডিন হুয়া সির!

ধ্রুব চেঁচিয়ে উঠতে যাচ্ছিল–আরে করছ কী, কিন্তু ওদের ব্যাপার দেখে খারাপ লাগলেও চুপ করে থাকল। এই আবহাওয়াগত দুর্যোগ, ফোরেনসিক পরীক্ষার কোন উপায়ও নেই কীই বা করা যেতে পারে!

হ্যাঁ–অ্যাকসিডিন। জরুর! গুলাব সিং, লিম্যানের সহকারী দুজনকে হুকুম দিল–জখমী উঠাও জলদি।

লোকদুটো তাই করতে যাচ্ছিল, ধ্রুব বলল, ঠারো, ঠারো! দেখুন হাবিলদারসায়েব, এটা একটা মার্ডার কেস। অ্যাকসিডেন্ট নয়। আর কেউ জখমী আদমীও নয়–স্রেফ লাশ। মিস টোডমলকে কেউ ডেলিবারেটলি খুন করেছে।

গুলাব সিং তেড়ে বলল, আপনি দেখেছেন? নিজের চোখে?

 ধ্রুব অপমানিত বোধ করছিল। বলল, কতকটা দেখেছি বই কি।

তবে বলুন, কে খুন করেছে? আমি তাকে পাকড়াব এক্ষুনি।

এই পরিস্থিতিতে ধ্রুব কী করবে, ঠিক করতে পারল না। সে আপাতত কর্নেলের কথাই ভাবল। কর্নেল নিশ্চয় খবর পেয়ে গেছেন এতক্ষণ। আসছেন। আসছেন না কেন?

ওকে চুপ করে থাকতে দেখে ভিড়শুদ্ধ হাসিয়ে গুলাব সিং হো হো করে হাসল।… বাঙালি লোক যেখানে থাকবে, সেখানেই গোলমাল বানাবে।

ধ্রুব রেগে গেল এবার।… হাবিলদারসায়েব, এটা একটা মার্ডারকেস। এর রীতিমতো তদন্ত হওয়া দরকার–আইনের এলাকা থেকে রিস্তা রেহাই পায়নি নিশ্চয় জানেন!

হাঁ হাঁ। আইনের জিম্মাদারই তো আমি–গুলাব সিং। আবার কে?

আপনি একটা সারকেলের প্রাথমিক তদন্তের মালমশলা নষ্ট করে ফেলেছেন–আরও নষ্ট করতে হুকুম দিচ্ছেন। এর জন্যে আপনাকে উপরওলার কাছে জবাবদিহি করতে হবে।

কিউ, কিউ? গুলাব সিং একটু ভড়কে গেল এবার।

 কোন এক্সপার্ট লাশ পরীক্ষা করার আগে…

ধ্রুবর কথা কেড়ে একজন স্কিয়ার বলল, কিন্তু মিঃ চাউড্রি, এখানে এক্সপার্ট পাচ্ছেনই বা কোথায়? শ্রীনগরে ট্রাঙ্ককল করতে হবে তারপর যদি ওঁরা আসেন! সে প্রায় কমপক্ষে চব্বিশ ঘণ্টার ব্যাপার।

আরেকজন স্কিয়ার বলল, তাহলেও ট্রাঙ্ক করা দরকার ছিল। মিস টোমলের বাবা শ্রীনগরের একজন বড় ব্যবসায়ী। তাঁকে খবর দেওয়া হয়েছে?

লিফটম্যান বলল, হ্যাঁ–মিঃ শ্রীবাস্তব ট্রাঙ্ককল বুক করেছেন।

একজন মেয়ে স্কিয়ার অস্ফুটকণ্ঠে মন্তব্য করল, শ্রীবাস্তব বেচারার কপাল! স্কি-সিজন শেষ হলেই ললিতার সঙ্গে ওর বিয়ে হত।

ধ্রুব একথাটা শুনে উৎসাহী হয়ে বলল, দেখুন মিঃ গুলাব সিং, তাহলে বুঝতেই পারছেন–অ্যাকসিডেন্ট কেস বলে মিথ্যে রিপোর্ট দিয়ে এটা ধামাচাপা দিতে পারবেন না।

গুলাব সিং রেগেমেগে বলল, কে বলেছে আমি ধামাচাপা দিচ্ছি?

ধ্রুব বলল, বেশ তো। তাহলে আমার কথা শুনুন। আমি আপনাকে সাহায্য করতে চাই। ফোরেনসিক ব্যাপারে আমার কিছু জ্ঞান আছে। আপনি লাশটার পাহারা: রাখুন।

আপনি পাগল স্যার, নির্ঘাত পাগল! এই বরফ ঝড়ের মধ্যে লাশ পাহারা দিতে গিয়ে কেউ নিজেই লাশ হয়ে যাবে না?..গুলাব সিং হেসে উঠল–তবে আগের মতো জোরে নয়।

ধ্রুব বলল, না–ওই দেখুন, মাত্র বিশ-পঁচিশ ফুট তফাতে স্কিয়ার গার্ডদের একটা কাঠের গুমটি ঘর রয়েছে, ওখানে দাঁড়িয়ে লাশে চোখ রাখলেই চলবে– যতক্ষণ না তদন্তটিম আসে। আর আপনি আপনাদের সদর থানায় খবর দিন। দেখবেন, সব ম্যানেজ হয়ে যাবে।

সেপাই দুজন বিরক্ত হয়ে চাপা গলায় বলল, যাহা বাংগলী, উঁহা ভি জঞ্জালী! শালালোগ বহৎ ঝামেলা পছন্দ করে ভাই রাম সিং!

গুলাব সিং ততক্ষণে মতলব বদলে অন্য মানুষ। সেপাই দুজনকে কড়া হুকুম দিয়ে সেই সাতফুট উঁচু ফুট পাঁচেক চওড়া গুমটি ঘরে ঢুকিয়ে বলল, বন্দুক তাগ করে বসে থাকো। লাশের কাছে কাছে কাকেও দেখলেই হুঁশিয়ারী দেবে। অগ্রাহ্য করলে সোজা গুলি ছুঁড়বে। আসুন সায়েব, কোম্পানির অফিসে যাই। সদর থানায় ফোন করব।

স্কি বরবাদ–যতক্ষণ না একটা হেস্তনেস্ত হয়। স্কিয়াররা চুপচাপ চলে গেল একে একে। সেই রক্তাক্ত স্কি-পোলটা লাশের পাশে পড়ে আছে। মুঠোয় খুনীর কোন ছাপ থাকা সম্ভব নয় কারণ হাতে দস্তানা ছিল। থাকবেই। এই ঠাণ্ডায় হাত খোলা রাখা মানুষের পক্ষে একান্ত অসম্ভব।

ধ্রুব পোলটা পরীক্ষা করে দেখল। ডগায় যে বাস্কেট লাগানো থাকে, সেটা কোথায় গেল? পাহাড়ের কোথাও নিশ্চয় পড়ে রয়েছে। এই ডগাটা বাস্কেটের ভিতর ঢুকিয়ে দুমড়ে বাঁকা করা হয়। কিন্তু বোঝা যাচ্ছে, এটা বাঁকানোই হয়নি–কোনমতে বাস্কেটে আটকানো ছিল–যাতে সুযোগমতো বাস্কেট থেকে খুলে বিধিয়ে দেওয়া যায় ললিতার বুকে। আর, স্কি-পোলের ডগা তো এত সুচলো হয় না মোটেও! এতে বোঝা যাচ্ছে, খুনী ওটা ঘষেঘষে সূক্ষ্ম আর ধারালো করেছিল। তার মানে, খুনী আগে থেকে তৈরি হয়ে এসেছিল।

গুলাব সিং পা বাড়িয়ে বলল, আসুন স্যার, আমরা এগোই।

ওরা চলতে থাকল। যেতে যেতে গুলাব সিং গজগজ করছিল–আমার কী কসুর ছিল? ফাঁড়িতে ফোন করল–একটা অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে, আমি ভাবলাম ফি বচ্ছর তো হয়। তাই হয়েছে। গত সালে একটা লোক স্কি করতে গিয়ে বেমক্কা ঘাড় ভেঙে মারা পড়েছিল। সেইমতো রিপোর্ট করেছিলাম। এবারও ভেবেছিলাম তাই। স্কি করতে গিয়ে বুকে পোল ঢুকে গেছে-সোজা ব্যাপার!

ধ্রুব বলল, অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে বলে ফোন করেছিল কেউ?

জী হাঁ।

কে ফোন করেছিল?

কোম্পানির ম্যানেজার-ট্যানেজার হবে। আবার কে?

নাম বলেনি?

এক মিনিট।..পকেট থেকে নোট বই বের করতে গিয়ে থামল গুলাব সিং।…চলুন, বলছি। বরফবৃষ্টির মধ্যে খাতা খোলা সম্ভব নয়।

 লন পেরিয়ে করিডরে একবার দাঁড়িয়ে নোটবই দেখল সে। বলল, হ্যাঁ–মিঃ–সঞ্জয় ওয়াড়েকার।

সঞ্জয় ওয়াড়েকার! ধ্রুব বিস্মিত হল। লিফটম্যানকে সে তক্ষুনি অফিসে শ্রীবাস্তবের কাছে জানিয়ে থানায় ফোন করতে বলেছিল। সারাক্ষণ ধ্রুব ললিতার লাশের কাছেই ছিল–অন্তত চারঘণ্টা। বরফের মধ্যে অতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল কীভাবে, এখন ভাবলে অবাক লাগে। হয়তো উত্তেজনা আর মার্ডারকেস সম্পর্কে তীব্র অনুসন্ধিৎসাই তাকে প্রতিকূল পরিবেশে তাপ যোগাচ্ছিল। এখন তার শরীর ক্রমশ যেন জমে যাচ্ছে ঠাণ্ডায়। ভারি ক্লান্তি লাগছে। কিন্তু সে বিস্মিত যে সঞ্জয় ওয়াড়েকার কে–সে কেন অ্যাকসিডেন্ট বলে ফোন করল? এই নির্বোধ গুলাব সিং এখানে এসে প্রথমে কি তার সঙ্গে দেখা করেনি? ধ্রুব বলল, সঞ্জয় ওয়াড়েকার সঙ্গে দেখা হয়েছে আপনার?

না। কী দরকার? এসেই তো ওখানে দৌড়ে গেছি।…গুলাব সিং বলল।

অফিসে শ্রীবাস্তবকে এক অদ্ভুত অবস্থায় দেখা গেল–সেটাই স্বাভাবিক। অন্তত সেই স্কিয়ার মেয়েটির মুখে সবিশেষ জানার পর। বাগদত্তা স্ত্রীর এই আকস্মিক মৃত্যুতে বেচারা একেবারে ভেঙে পড়েছে। দুহাতে মুখ ঢেকে টেবিলে হুমড়ি খেয়ে পড়ে নিঃশব্দে কাঁদছে।

এদের দেখে– সে মুখ তুলল। চোখ দুটো লাল ফুলো মুখ ভিজে। …আসুন। বসুন। মিঃ গুলাব সিং, কী দেখলেন বলুন? সত্যি কি ললিতা খুন হয়েছে? নাকি নিছক অ্যাকসিডেন্ট? আমি যে কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছি না–অত ভালো মেয়েকে কেউ খুন করবে! ওঃ ঈশ্বর! এ তুমি কী করলে?

এরা গম্ভীর মুখে বসল। গুলাব সিং আফসোসে মাথা দোলাল। ধ্রুব বলল, মিঃ শ্রীবাস্তব, সঞ্জয় ওয়াড়েকার কে?

একটু চমকাল যেন শ্রীবাস্তব। ..কেন? সে আমাদের একজন নতুন স্কিয়ার।

ধ্রুব বলল, তার সঙ্গে একবার কথা বলতে চাই।

শ্রীবাস্তব নড়ে উঠল। হঠাৎ দুহাতে চুল আঁকড়ে ধরে বিকৃত মুখে বলল, আমার এই পা–এই পাটা! উঃ ঈশ্বর, এই ভাঙা পায়ের জন্যে কিছু করা যাবে না! আমার ললিতাকে খুন করে শয়তানটা চোখের সামনে দিয়ে কেটে পড়ল। সে পাগলের মতো টেবিলে মাথা ঠুকতে লাগল।

ধ্রুব ওকে শান্ত করতে চেষ্টা করল। গুলাব সিং উত্তেজিত হয়ে উঠেছে। সে বলল, তাহলে ওই ব্যাটাই মিছিমিছি অ্যাকসিডেন্ট বলে ফোন করে মিসগাইড করতে চেয়েছিল? কী মুশকিল! কই সে, কোথায় সেই শুওরের বাচ্চা? তাকে এক্ষুনি আমি পাকড়াতে চাই।

ধ্রুব বলল, শান্ত হোন মিঃ শ্রীবাস্তব। কী হয়েছে বলুন!

ভাঙা গলায় শ্রীবাস্তব বলল, জাস্ট নটায় সে আমার কাছে এসেছিল। বললাম, আপনি স্কি ছেড়ে ফিরে এলেন যে? ও বলল, হঠাৎ টেলি এসেছে মায়ের খুব অসুখ। বাধ্য হয়ে তাকে এক্ষুনি ফিরতে হবে। শ্রীনগর থেকে চার্টাড প্লেনের ব্যবস্থা করেছে ওর বাবা। সেই প্লেনে পুনায় গিয়ে মায়ের সঙ্গে দেখা করবে। আমি একটুও টের পাইনি। তক্ষুনি ও চেকআউট করল। গাড়ি নিয়ে চলে গেল। শ্রীবাস্তব হাঁফাতে লাগল।

ধ্রুব মনে মনে হিসেব করল–হ্যাঁ, ললিতা লিট চেয়ারে খুন হয়েছে। সকাল সাড়ে আটটা থেকে নটার মধ্যেই। এতে কোন ভুল নেই। কিন্তু যদি নটা থেকে সাড়ে নটার মধ্যে সে চেকআউট করে থাকে তাহলে গুলাব সিংকে সে ফোন করে খবর দিল কীভাবে? আর শ্রীবাস্তবই বা অমন খবরের পর থানায় না জানিয়ে চুপচাপ আছে কেন? বড় গোলমেলে ব্যাপার। সে বলল, মিঃ শ্রীবাস্তব, একটা কথা স্পষ্ট বলুন। সঞ্জয় ওয়াড়েকার নতুন স্কিয়ার বলছেন। সে মিস টোডমলকে খুন করবে কেন?

টেবিলে ঘুষি মেরে সখেদে শ্রীবাস্তব বলল, প্রতিহিংসা! আমি আগে টের পেয়েছিলাম অথচ–অথচ…আমার এই ব্লাডিবাচ্চা পা!

কিসের প্রতিহিংসা, মিঃ শ্রীবাস্তব?

ওই মারাঠি ললিতার সঙ্গে প্রেম করতে উঠে পড়ে লেগেছিল। ভেবেছিল, ব্যবসায়ী বাবার পয়সা আছে–সেই জোরেই ও ললিতার মন পাবে। আজ সকালে স্কিতে যাবার আগে ললিতা আমাকে জানিয়েছিল, গত রাত্রে শয়তানটা ওকে ভীষণ জ্বালাতন করেছে। আমি সঞ্জয়কে সতর্ক করে দেব ভাবছিলাম। তারপর তো ও টেলি পেয়ে চলে গেল, তখন ভাবলাম–যাক গে, আপদ গেল। কিন্তু তখন হারামী কুত্তা–ওঃ! শ্রীবাস্তব দুহাতে মুখ ঢাকল।

ধ্রুবর মনে পড়ল গত রাতের সেই উত্তেজিত সংলাপের কথা। হ্যাঁ, ঠিকই এ তথ্য।

গুলাব সিং বলল, রেজিস্টারে ওর ঠিকানা আছে নিশ্চয়। বলুন।

আছে। দিচ্ছি। বলে রেজিস্টারের পাতা ওল্টাতে ব্যস্ত হলো শ্রীবাস্তব।

 ধ্রুব বলল, মিঃ গুলাব সিং, আপনি ওই একটাই ফোন পেয়েছিলেন?

জী হ্যাঁ।

 তখন কটা বাজে?

নটা কুড়ি। নোট করা আছে।

শ্রীবাস্তব খাতা থেকে মুখ তুলে বলল, তাহলে যাবার সময় সে ফোন করে মিসগাইড করে গেছে। হ্যাঁ–এই যে ওর ঠিকানা।

গুলাব সিং ঠিকানা নোট করে নিয়ে সদর থানায় ফোন করতে ব্যস্ত হলো।– ধ্রুব বলল, আপনাদের ফোনের কটা এক্সটেনসান, মিঃ শ্রীবাস্তব?

দুটো। একটা ডাইনিং হলে, অন্যটা স্টোর রুমে।

 তাহলে যে কোন একটা ফোন সঞ্জয় ব্যবহার করতে পারে।

স্টোরেরটা নিশ্চয় নয়। কারণ, ঘর তালাবন্ধ ছিল। ডাইনিং হল তখন ফাঁকা ছিল–আর দরজাও সবসময় খোলা থাকে।

আচ্ছা মিঃ শ্রীবাস্তব, আপনি, লিফটম্যানের কাছে খবর পান ঠিক কটায়?

ধরুন–সঞ্জয় ওয়াড়েকার চলে যাবার আধঘণ্টা পরে। তার মানে–প্রায়। দশটার কাছাকাছি। একটু আগেও হতে পারে। মনে পড়ছে না।

 কিন্তু আমি লিফটম্যানকে আটটা পঁয়তাল্লিশে পাঠিয়েছিলাম খবর দিতে।

সে কী! শ্রীবাস্তব চমকাল।..ওখান থেকে আসতে ওর তো মাত্র মিনিট দশেক লাগবার কথা। এতক্ষণ কী করছিল সে? ব্যাটাকে এক্ষুনি ডাকছি। সব ষড়যন্ত্র। বুঝলেন? সঞ্জয় ওকে নির্ঘাত ঘুষ খাইয়েছে।

হ্যাঁ, ডাকুন। কিন্তু আপনি কি খবর পেয়ে কোন ফোন করেছিলেন?

শ্রীবাস্তব উত্তেজিত মুখে বলল, কী বলছেন মশায়! আমি এখানকার সবকিছুর দায়িত্বে আর আমি চুপচাপ বসে থাকব? প্রথমে ফাঁড়িতে ফোন করলাম। জবাব এল-কোথায় কী অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে–সেখানে গেছেন ওদের অফিসার। আমি বললাম, স্কি ট্রেনিং কি? ওরা বলল, তাই হবে। তখন ভাবলাম, কোন স্কিয়ার আগেই বুদ্ধি করে খবর দিয়েছে। তার দোষ কী? ভাবলাম–হঠাৎ ললিতা খুন হয়েছে, এ বিশ্বাস করা তো কারো পক্ষে শক্ত। আমিও তো বিশ্বাস করতে পারছিলাম না!

ললিতার বাবা-মায়ের কাছে কোন খবর দিয়েছেন?

নিশ্চয়। তক্ষুনি ট্রাঙ্ককল বুক করেছি। এখনও লাইন পাইনি। দুগালকেও খবর দিতে হবে। এসবের জন্যেই তো ফোনের কাছে বসে থাকতে হয়েছে। আমাকে। আমার ললিতা খুন হয়েছে আর আমি এমনি বসে থাকব? কী বলছেন!

আপনি লিফটম্যানকে একবার ডাকবেন?

ডাকছি। শ্রীবাস্তব হঠাৎ ভুরু কুঁচকে বলল, কিন্তু আপনি–মানে আপনার এত ব্যস্ত হবার বা খোঁজ-খবর করার কারণ আমি বুঝতে পারছি না মিঃ চাউড্রি। আপনি কে? একজন স্কিয়ার বলেই তো জানি আপনাকে। আপনি কি কোন। ডিটেকটিভ অফিসার?

ধ্রুব একটু ঘাবড়ে গেল। সেও তো ঠিক। সে কে? সে একটু কেশে বলল, আমি ফোরেনসিক ব্যাপারে কিছু বুঝি। দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয়ে ও-বিষয়ে একজন লেকচারার। তাই আমার এত কৌতূহল, মিঃ শ্রীবাস্তব। তাছাড়া ললিতা আপনার বাগদত্তা স্ত্রী শুনলাম। এ অবস্থায় যদি আমি কোন সাহায্য করতে পারি আপনাকে আপনার কি সেটা অবাঞ্ছিত হবে?

শ্রীবাস্তব আক্ষেপে মাথা দোলাল।..কিন্তু ললিতা মারা গেছে। আর তো তাকে আমি পাব না মিঃ চাউড্রি। ইচ্ছে করছে, সব ফেলে কোথাও একলা গিয়ে চুপচাপ শুয়ে থাকি। অথচ দুগাল আমাকে এইসব দায়িত্ব দিয়ে গেছেন! সে একটু থেমে ফের বলে উঠল, কিন্তু আপনি কী ফোরেনসিক তদন্ত করতে চান? বুঝিয়ে বলবেন একটু?

বলব। এখন প্লিজ একবার লিফটম্যানকে ডাকুন।

গুলাব সিং ফোনে কার সঙ্গে এতক্ষণ চাপাস্বরে কথা বলছিল। এবার ফোন রেখে সে হাত তুলল, সবুর, সবুর! সদর থানা থেকে অফিসাররা আসছেন। তারা কাকেও কিছু জিগ্যেস করার আগে আমি আপনাকে এ ব্যাপারে আর এগোতে নিষেধ করছি মিঃ চাউড্রি। হা-অফিসিয়ালি। প্লিজ, আপনি নিজের ঘরে যান। মিঃ শ্রীবাস্তবের সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে।

গম্ভীর হয়ে তক্ষুনি বেরিয়ে এল ধ্রুব। বেশ অপমানিত বোধ করছিল সে। তাই এবার ভাবল, মরুক গে। তার এতে নাক গলিয়ে লাভ নেই। সোনালি বেচারার দুটোর কী অবস্থা এখন কে জানে? আর কর্নেল ভদ্রলোকই বা কোথায় গেলেন? সোনালির কাছে ডাক্তার এল কি না দেখা দরকার। তবু যাবার সময় একবার সে কর্নেলের দরজা হয়ে গেল। বাইরে থেকে বন্ধ–উনি নেই। স্কি করতে তো যাননি–এ বয়সে ওঁর পক্ষে তা সম্ভব নয়। নাকি এখনও সোনালির ঘরেই বসে আছেন?

হঠাৎ সেই সময় ধ্রুবর মনে পড়ে গেল, কর্নেল নীলাদ্রী সরকার একজন প্রখ্যাত প্রাইভেট গোয়েন্দা। কী আশ্চর্য! এতক্ষণ কথাটা একটুও মনে ছিল না তার! অতোবড়ো একটা সূর্যের মতো প্রতিভা এখানে বর্তমান থাকতে সে কিনা একটা খুদে পিদিম হয়ে গোয়েন্দাগিরি করতে মেতে উঠেছিল।

সিঁড়িতে হনহন করে উঠতে থাকল সে। মনে পড়ে গেল, কাল রাতে খাটিয়া ওঠানোর সময় ললিতা নিচের ঘর থেকে বেরিয়ে তাকে সাহায্য করেছিল। একবার থেমে সে একটু ঝুঁকে নিচের তলায় ললিতার ঘরটা দেখে নিল। আরে! ললিতার ঘরের ওপরই তো ধ্রুবদের সেই আট নম্বর অব্যবহৃত হিমঘরটা!

ধ্রুব দরজায় নক করল। সোনালি দরজা খুলে দিল। ধ্রুব অবাক হয়ে দেখল, সোনালি দিব্যি হেঁটে বেড়াচ্ছে। পা সেরে গেছে। আর কর্নেল ইজিচেয়ারে চুপচাপ গড়িয়ে পাইপ টানছেন। ধ্রুব খুশি হয়ে বলল, তোমার পা সেরে গেছে?

সোনালি কর্নেলকে দেখিয়ে বলল, আমার মোস্ট বিলাভেড অ্যান্ড ওয়ান্ডারফুল মামা থাকতে আমার ভাবনা? ও মামা, বলুন না ওকে কীভাবে আপনি আমার মামা হলেন?

কর্নেল হাসলেন।… ধ্রুব, সোনালির মা জয়ন্তী আমার মাসতুতো বোন বেবীর সহপাঠিনী ছিলেন লেডি ব্র্যাবোর্ন কলেজে। বেবী এখন ক্যানাডায়।

সোনালি বলল, শোন–আট নম্বরে সেন্ট্রাল হিটারটা ঠিক হয়ে গেছে। মামার কীর্তি।

সে কী! আপনি সেরে দিলেন, কর্নেল? ধ্রুব প্রশ্ন করল।

কর্নেল বললেন, দ্যাটস এ ফানি থিং, ধ্রুব। ওসব ইলেকট্রিকাল ডিভাইস আমি ভয়ে অবশ্য ছুঁইনে। তবে কী জানেনা, এ ব্যাপারটা খুব সহজেই করা গেল। ওপরের দেয়ালে যে ফিউজ বক্সটা আছে, সেটা খুলে দেখি–একটা তার ছেঁড়া। জুড়ে দিতেই সব ঠিক হয়ে গেল।

আশ্চর্য তো!

হ্যাঁ–আশ্চর্য। ওটার কথা মিস্ত্রিরা হয়তো ভাবেইনি। অবশ্য যদি সত্যি, মিস্ত্রি দেখানো হয়ে থাকে।

কেন? বলছিলেন যে শ্রীবাস্তব মিস্ত্রি নিয়ে ছোটাছুটি করছিল গতকাল।

সে তো শ্রীবাস্তবের ভাষ্য। যাক গে, শোন–দ্বিতীয় আশ্চর্য হলো, তোমার আট নম্বর রুমের কোনার দিকে মেঝেয় একটা ফুটো আবিষ্কার করলুম। এক ইঞ্চি। ওখানে চোখ দিলে নিচের ঘরের একটা অংশ পরিষ্কার দেখা যায়– মানে, বিছানাটা। এবং এই ফুটোটা খুব টাটকা ধারালো কিছু দিয়ে করা হয়েছে।  

কনেল, কর্নেল! ধ্রুব উত্তেজিতভাবে চাপা গলায় বলে উঠল। নিচের ওঘরে ললিতা টোডমল থাকত। ললিতা টোডমল খুন হয়ে গেল আজ সকালে। নিশ্চয় সব শুনেছেন ইতিমধ্যে।

কর্নেল হাত তুলে বললেন, সোনালির সঙ্গে সেই নিয়েই এতক্ষণ কথা বলছিলাম। খবর আমরা শের সিং-এর কাছে তক্ষুনি পেয়েছিলাম। তারপর সোনালিকে নিয়ে বেরিয়ে নিচেটা ঘুরেও এসেছি। খোঁজখবরও করেছি। অকুস্থলে যাইনি–কারণ, আমি যেতে পারলেও আমার প্রিয় ভাগ্নীটির পক্ষে সেটা উচিত হত না। সবে তো হাঁটিহাঁটি পা অবস্থা ওর।..কর্নেল হেসে উঠলেন।

সোনালি বলল, ডাইনিং হলের কী অবস্থা? খিদে পেয়েছে কিন্তু। আমরা তোমার জন্যেই অপেক্ষা করছিলাম। মামাকে বলছিলাম, খুন পেয়েই তো ওর এখন লোভে জিভ লকলক করে উঠেছে! ঝাঁপিয়ে পড়েছে তক্ষুনি।

ধ্রুব গম্ভীর স্বরে বলল, আমি জীব বিশেষ নই যে জিভ লকলক করবে।

কর্নেল উঠে দাঁড়ালেন।..ঝগড়াঝাটি পরে হবে কিডিজ! চলো–দেখি ডাইনিং হল কী বলছে।

রিস্তা দু নম্বর ক্যাম্প থেকে পুলিস অফিসাররা এসে পড়েছেন ততক্ষণে। সঙ্গে এসেছে ছোটখাটো একটা বাহিনী। খুব ধুমধামের মধ্যে তারা তদন্ত শুরু করেছেন–দাপটের চোটে সবাই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছে। ডাইনিং হলে বসে একে একে প্রত্যেককে ডেকে জিগ্যেস-পত্তর জেরা ইত্যাদি চলেছে। প্রথমেই অবশ্য ডাক পড়েছিল ধ্রুব চৌধুরীর–কারণ সেই ব্যাপারটা প্রথমে আবিষ্কার করে।

প্রথম অফিসারটি তাকে শাসাতে শুরু করেছিলেন গোড়ার দিকে কেন সে চেয়ার থেকে মিস টোডমলকে অমনভাবে টেনে ফেলে দিয়েছিল? এমনও তো হতে পারে যে ধ্রুব চাউড্রিই ললিতার বুকে পোলটা বিঁধিয়ে দিয়েছে। পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্য ও অবস্থাদৃষ্টে এ সন্দেহ খুব স্বাভাবিক এবং সঙ্গতভাবেই ওঠে। সুতরাং তাকে ছেড়ে দেওয়া যায় না।

কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে দ্বিতীয় অফিসার মিঃ ইউসুফ তেঙ ধ্রুবকে চেনেন। ফোরেনসিক ট্রেনিং সূত্রেই এই আলাপ। একসময় ভদ্রলোক দিল্লিতে ছিলেন। তাই ধ্রুব জোর বেঁচে গেল আপাতত।

বেঁচে গেল। কিন্তু একটা শর্তে। পুলিসের বিনা অনুমতিতে সে এই সেন্টার ছেড়ে যেতে পারবে না–অন্তত যতক্ষণ বা যতদিন না প্রকৃত খুনীকে পুলিস উপযুক্ত প্রমাণসহ আবিষ্কার করতে পারে।

সোনালি সব শুনে বলল, বাঃ, চমৎকার! নাক গলিয়ে যেখানে-সেখানে গোয়েন্দাগিরির ফলটা এবার হাতেনাতে পেয়ে যাবে।

ধ্রুব গম্ভীর হয়ে রইল। বিকেলে আবহাওয়া প্রকৃতির খামখেয়ালিতে আজ মোটামুটি ভালই বলতে হবে। বরফ সামান্য পড়ছে। কিন্তু ঝড়োহাওয়াটা নেই। মাঝে মাঝেই ক্ষীণ পাতলা কিছু রোদ বেরিয়ে পড়ছে। ঝকঝকে সাদা তুষারের ওপর অজস্র রঙের ছটা ফুটছে। খালি চোখে তাকালে চোখের ক্ষতির সম্ভাবনা আছে।

করিডরের শেষপ্রান্তে কাচের বিশাল জানলার পাশে কর্নেল দাঁড়িয়ে ছিলেন। এরা কাছে গেলে ঘুরে যেন আপনমনে অস্ফুট বলে উঠলেন, আঃ, বোকা সঞ্জয় ওয়াড়েকার।

সোনালি বলল, সঞ্জয় ওয়াড়েকারের বোকামির কী হল মামা? দিব্যি তো সে খুন করে কেটে পড়েছে!

কর্নেল বললেন, হ্যাঁ–কেটে নিশ্চয় পড়েছে। তবে—

 ধ্রুব বলল, তবে কী কর্নেল?

 বোকা, বড্ড বোকা। কর্নেল বললেন।

সোনালি বলল, হ্যাঁ মামা–ঠিকই বলেছেন। পুলিস তো ওর জন্যে ওদিকে কারগিল, আরদিকে সোনামার্গ থেকে শ্রীনগর অব্দি রেডিওতে জানিয়ে দিয়েছে। পথেই ধরা পড়ে যাবে। গাড়ি-ফাড়ি নিয়ে গেছে। কাজেই লুকোবার স্কোপ নেই।

কর্নেল বললেন, ইয়ে ধ্রুব–লিটম্যানের সঙ্গে একটু আগে আমার কথা হচ্ছিল। খুব কায়দা করে ওকে জিগ্যেস করলুম যে চাউড্রিসায়েব তোমাকে খবর দিতে বলেছিলেন শ্রীবাস্তবের কাছে, তা তুমি বাপু অত দেরি করলে কেন? ও বলল—

 ধ্রুব রুদ্ধশ্বাসে প্রশ্ন করল, কী বলল, কী বলল?

কর্নেল জবাব দিতে যাচ্ছিলেন, সেই সময় শের সিং দৌড়ে এল।…কর্নেলসায়েব, কর্নেলসায়েব! খুব খারাপ খবর, ভীষণ খারাপ। আর করিডরের অন্যদিকে স্কিয়ার, লিফটম্যান, আরও কিছু লোক বেরিয়ে উত্তেজিত মুখে জটলা করতে থাকল।

কর্নেল বললেন, শের সিং, সঞ্জয় ওয়াড়েকার..

জী সাহাব, সঞ্জয় ওয়াড়েকার খুন হয়ে পড়ে আছেন গাড়ির মধ্যে।…শের সিং উত্তেজিতভাবে বলল।..এইমাত্র সাত মাইল দূরে টোগড়ি থেকে ফোন এসেছে।

একটু পরেই সব পুরোপুরি জানা গেল।

এখান থেকে সাত মাইল দূরে টোগড়ি নামে একটা ছোট্ট বসতি আছে। বসতি নিচ দিয়ে রাস্তা গেছে এঁকেবেঁকে। আরও নিচে জঙ্গল। রাস্তা থেকে গাড়িটা মুখ ঘুরিয়ে দশফুট নিচে কিছু গাছের গুঁড়িতে আটকে রয়েছে। গাছগুলো না থাকলে তলিয়ে যেত নিচে খাদে। আর সেই গাড়ির ভিতরে সঞ্জয় ওয়াড়েকার অবিকল সেই ললিতার মতো বুকে পোল-বিদ্ধ অবস্থায় মরে পড়ে রয়েছে। এক ভেড়াওয়ালা এটা আবিষ্কার করে। এবং তক্ষুনি স্থানীয় ফাড়িতে খবর দেয়। ফাঁড়ি থেকে সঙ্গে সঙ্গে ফোনে জানিয়ে দিয়েছে এখানে।

একটা লক্ষ্য করার ব্যাপার–সঞ্জয়ের গাড়িটা ষাটসত্তর গজ পথ স্বাভাবিকভাবে যায়নি, চাকার দাগ দেখে বোঝা যায়। ভীষণ যেন ধস্তাধস্তি করে এগিয়েছে। বরফ সেখানে প্রায় একফুট পুরু। কিন্তু সম্ভবত সেকারণে গাড়ির গতি অমন হয়নি–সঞ্জয় নিজেই ড্রাইভ করছিল। তার সঙ্গে নির্ঘাত খুনীর যোঝাযুঝি হয়েছিল প্রচণ্ড।

.