০১.
শ্রীনগর থেকে সোনামার্গ, তারপর কারগিল। অবশ্য কারগিলের অনেকটা আগে বাঁয়ে মোড় নিয়ে যেতে হবে স্কার্টুর দিকে। বেশ দুর্গম পথ। জায়গাটার নাম রিস্তা। শুধু রিস্তা নয়, রিস্তা ক্যাম্প নম্বর এক।
ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ। ফিনফিনে হালকা ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টির মতো বরফ পড়া শুরু হয়েছে। চারদিকের পাহাড় উপত্যকা আর টুকরোটাকরা সমতল জায়গা ক্রমশ বরফে ঢেকে সাদা হয়ে যাচ্ছে। রাস্তাও খুব বিপজ্জনক। শ্রীনগরে খবর নেওয়া হয়েছিল সোনামার্গ অব্দি তুষারবৃষ্টির পরিমাণ দু থেকে তিন ইঞ্চি। সোনামর্গে জানা গেল, সামনে এখন অন্তত ছয় থেকে আট ইঞ্চিও হতে পারে। রিস্তায় যারা যাবার, তারা নভেম্বরের মাঝামাঝি গিয়ে বসে আছে। এখন যথেষ্ট দেরি হয়ে গেছে। পৌঁছতে পারবে কি না বলা কঠিন। যাদের সঙ্গে দেখা হয়েছে, তারাই অবাক হয়েছে। বলে কী! এই বাঙালি বাঙালিনীর কী সাহস! একেই তো বলে বাঙালি বুদ্ধ! ঠাণ্ডা না হয় আটকাল গাড়ির ভিতর বসে; কিন্তু বরফে গাড়িশুদ্ধ চাপা পড়ে কবরস্থ হয়ে পড়বে যে!
আর কী প্রচণ্ড ঝোড়ো হাওয়া বইছে জায়গায়-জায়গায়। বিশীর্ণ পাইনের বন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বরফে ঢাকা পড়ছে। ভাপ উঠছে জঙ্গলের তলায়। বিস্তৃত বরফের ওপর আবছা সূর্যের ছটা কদাচিৎ নানারঙে প্রতিফলিত হচ্ছে। পরক্ষণে আবার সব আলো ঢেকে যাচ্ছে। গাড়ির হেডলাইট জ্বালতে হচ্ছে দিনদুপুরে।
সোনালি সেনের পা দুটো কখন থেকে জমে গেছে ঠাণ্ডায়, মাঝে-মাঝে অস্ফুট স্বরে জানিয়ে দিয়েছে ধ্রুব চৌধুরীকে। ধ্রুব একটু হেসেছে, কিছু বলেনি। এয়ারকন্ডিশন্ড মার্কিনি এই গাড়িটা বিশেষভাবে তৈরি। একটা তুষারদানব বললেই চলে। চাকাগুলো চমৎকার বরফ কেটে পথ চলতে পারে। কিন্তু ভিতরের কৃত্রিম ওম এবং পায়ের তলার তাপ আর শরীরে পৌঁছচ্ছে না। সমুদ্রতল থেকে হিসেব করলে কোথাও উচ্চতা আট হাজার ফুট থেকে দশ হাজার ফুট। পুরোপুরি শীতের রাজ্য। কোথাও কোন স্পন্দন নেই, প্রাণের চিহ্ন নেই–শুধু গরগর গর্জন করতে থাকা ধীরগামী এই গাড়িটা ছাড়া। কারগিলের ত্রিশ মাইল দূরত্বে বাঁদিকে রিস্তাগামী যে রাস্তা, তা নতুন। গত চীন-ভারত যুদ্ধের সময় তাড়াহুড়ো করে তৈরি। খুব অপ্রশস্ত। ওরা এ রাস্তায় নেমেই টের পাচ্ছিল, সত্যিকার বিপদের শুরু হল এবার। বরফ পড়াটা হঠাৎ বেড়ে গেল। গাড়ির উইন্ডো বেয়ে চাপচাপ বরফ পিছলে পড়তে থাকল। গাড়িটা বরফের পুরু ঢাকনায় যেন লুকিয়ে যাবার ষড়যন্ত্রে এবার লিপ্ত হয়েছে। কখনও হেডলাইটের ছটায় ঝলসে উঠছে সিল্ট-সিলুট সব গাছের কঙ্কাল। কখনও একটা বা কয়েকটা কাঠের বাড়ি পাহাড়ের খাঁজে-ধনীদের গ্রীষ্মকালীন বিলাস। তুষারের পাগড়ি আর জোব্বা পরে দরোয়ানের মতো দাঁড়িয়ে আছে গেটের কাছে দুএকটা লম্বাটে গাছ। আবার সোনালি অস্ফুট স্বরে বলে উঠল, সত্যি পা জমে গেছে, ধ্রুব।
ধ্রুব সামনে উঁচুতে একলা বাড়িটা দেখছিল। যথারীতি হাসল। আশ্রয়ের জায়গা দেখে সোনালি এবার ছটফট করে উঠেছে। রিস্তা ক্যাম্পের পাহাড়ে স্কি করার সাধ ওর নির্ঘাত চুকেছে। এখন ভালয়-ভালয় একটা গৃহকোণ আর খানিকটা আগুন তার দরকার।
সোনালি এবার একটু চটেছে এতক্ষণে।…কথা বলছ না যে? আমার পা দুটো সত্যি জমে গেছে।
সোনালি দুরন্ত খেলোয়াড় মেয়ে। তাকে এখন ভীতু গোবেচারা বালিকা দেখাচ্ছে। কয়েক স্তর পুরু পশমী পোশাকের ভিতর ও আড়ষ্ট। এবার কেঁদে ফেলবে না তো? ধ্রুবর আশঙ্কা হল। ধ্রুব বলল, আর মাত্র এক কিলোমিটার। বড়জোর পনের মিনিট লাগবে।
সোনালি কী বলতে ঠোঁট ফাঁক করল, কিন্তু বলল না। বাঁদিকে দূরে কয়েকটা আলো দেখা যাচ্ছে। সে সেদিকেই তাকিয়ে রইল।
ঘড়িতে এখন বেলা তিনটে। কিন্তু কেমন ছায়াধূসর দেখাচ্ছে পরিবেশ। বরফের হালকা বৃষ্টি সামনে ঝরছে। এখন একঘেয়ে লাগে। রিস্তায় ডাক্তার আছে কি না কে জানে। সোনালি ভাবছিল। নিশ্চয় বাজার বসতি ইত্যাদি আছে। একটা সামরিক ছাউনি আছে সে জানে। তার অনেকদিনের স্বপ্ন এই দুর্গম পাহাড় অঞ্চলের তুষারে স্কি করার। রিস্তায় যেখানে যাচ্ছে, সেটা একটা প্রাইভেট কোম্পানির স্কি ট্রেনিং সেন্টার। তাদের ওখানেই থাকার ব্যবস্থা আছে–ডরমিটরি আর হোটেল আছে। আছে স্কি করার সব সরঞ্জামের স্টোর, মেরামতের ব্যবস্থা এবং কয়েকজন ইনস্ট্রাক্টার। আর আছে–সবচেয়ে যেটা আকর্ষণীয়, পাহাড়ের মাথায় ওঠার একটা লিফট-হুঁইল-ঘুরন্ত নাগরদোলার মতো। তার গোল ফ্রেমে ঝুলছে দুজন বসার মতো একটা করে চেয়ার। পাহাড়ের ওপর ওঠার সঙ্গে সঙ্গে স্কিয়াররা ঝাঁপিয়ে পড়বে একের পর এক একেকটা চেয়ার থেকে। এবং ঢালু সমতল বরফের ওপর দিয়ে অনেকটা দূর স্কি করে চলে যাবে। এভাবেই ট্রেনিং-এর প্রাথমিক পর্যায় শেষ হবে।
একটা বিশাল পাহাড়ের তলায় দোতলা আর কয়েকটা একতলা বাড়ি রয়েছে। তার কাঠের গেটে ইংরাজিতে লেখা আছে : দুগাল স্কিং ট্রেনিং সেন্টার। গেটটা খেলা। ওদের গাড়িটা সোজা ভিতরে ঢুকে গেল।
দুজন লোক দুপাশ থেকে হাত নেড়ে গ্যারেজ নির্দেশ করছিল। ধ্রুব মুচকি হেসে বলল, ব্যবস্থা ভালই মনে হচ্ছে। গাড়িটা চওড়া লনে ঘুরিয়ে সে গ্যারেজে ঢোকাল। তখন সেই লোকদুটো এগিয়ে সেলাম দিল। দরজা খুলে ধ্রুব বেরোল প্রথমে। তারপর সোনালির দাস্তানাপরা হাত ধরে তাকে বেরোতে সাহায্য করল। সোনালি সোজা দাঁড়াতে পারছিল না। ওভারকোট দস্তানাপরা লোকদুটো কাশ্মীরী–সম্ভবত গ্যারেজের চার্জে থাকে। ভাঙা ভুল ইংরাজিতে বলল, সাহায্য করতে পারি?
ধ্রুব বলল, না–ধন্যবাদ। আপনাদের অফিসটা কোথায়?
পারভিজ, তুমি সায়েবকে অফিসে পৌঁছে দাও।
গাড়ির দরজা বন্ধ করে ধ্রুব বলল, কিন্তু জিনিসপত্র রইল যে?
ভাববেন না স্যার। লোক এসে নিয়ে যাবে।
পারভিজ নামে লোকটা আগে-আগে চলল। ধ্রুব সোনালিকে ধরে তাকে অনুসরণ করল।
সোনালির বেশ কষ্ট হচ্ছিল বিশ-পঁচিশ-ফুট লন পেরোতে। বরফে পিছল হয়ে আছে। আর এবার বাইরের খোলামেলায় ঠাণ্ডাটা কী জিনিস, সে হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছিল। ধ্রুব একটু ঠাট্টা করতে ছাড়ল না, কী? কেমন মনে হচ্ছে? যা ভেবেছিলে, তেমন নয়, না?
সোনালি ঝাঁঝালো স্বরে বলল, আমার কিছু হয়নি। ভারি আমার ঠাণ্ডা!
উঁহু, বেশ গরম লাগছে আমার। ধ্রুব সকৌতুকে বলল।
সোনালি ওর হাতদুটো কাঁধ থেকে সরিয়ে খোঁড়া মানুষের মতো একটু জোরেই এগোল। ধ্রুব জানে, ও ভীষণ জেদী মেয়ে। হয়তো ওই পা নিয়েই বরফের ওপর স্কেটিং শুরু করে দেবে ধ্রুবকে তাক লাগাতে। তুষার কামড় ফস্টাইটিং কি জিনিস, তা সোনালির জানা আছে। পাহাড়ে চড়া ক্লাবের মেম্বার সে ছেলেবেলা থেকে। অনেকবার অনেক দুর্গম পাহাড়ের চুড়োয় উঠেছে সে দলের সঙ্গে। আসলে গাড়িতে আসবার সময় ওর পা জমে গেছে অসাবধানতার দরুন। প্রথমে তো খালি স্লিপার পরেই বসে ছিল। পরে অবস্থা বুঝে মোজা জুতো পরেছিল। কিন্তু যা হয়েছে, তাতেই বেশ ভোগাবে ওকে। কাল সকালের ক্লাসে ওর পক্ষে যোগ দেওয়া কঠিনই হবে।
ঢাকা বারান্দায় উঠে একটা লম্বা করিডর পেল বাঁদিকে। একটু এগিয়ে লেখা দেখল : অফিস। পারভিজ দেখিয়ে দিয়ে চলে গেল।
বন্ধ দরজায় নক করল ধ্রুব। ভিতর থেকে ইংরাজিতে শোনা গেল, আসুন।
ওরা ঢুকল। ঘরটা যথারীতি এয়ারকন্ডিশন্ড। তার ওপর পিছনে একটা ইলেকট্রিক চুল্লী থাকায় বেশ ওম জমে রয়েছে। টেবিলের সামনে ধ্রুবর বয়সী এক ভদ্রলোক বসে রয়েছেন। বেশ ছিমছাম ভদ্র চেহারা। কিন্তু কয়েকটা ভাঁজ আর চোখের নিচে কালো ছোপ থাকায় কেমন, ক্লান্ত আর বিষণ্ণ দেখাচ্ছে। ওঁর গায়ে একটা সাদা শার্ট আর তার ওপর ঢিলে হরিণের চামড়ার মতো সোয়েটার। ডানদিকে হাতের কাছেই দেয়ালে ঠেকা দেওয়া আছে দুটো ক্রাচ।
ক্রাচ দেখেই ধ্রুবর চোখ টেবিলের তলায় গেল। হ্যাঁ, ডানপায়ে হাঁটু থেকে তলা অব্দি সিমেন্টপ্লাস্টার। ধ্রুব একটু চমকে সোনালির দিকে তাকাল। সোনালিও দেখেছে। সে ধরে নিল, ধ্রুব তাকে যেন বলতে চায়–এই দেখ, নির্ঘাত স্কি করতে গিয়ে দুর্ঘটনা ঘটেছে–অতএব সাবধান। সোনালি বাঁকা ঠোঁটে অন্যদিকে তাকাল।
ধ্রুব বলল, নমস্কার।
নমস্কার।…ভদ্রলোক মিষ্টি হাসলেন..বসুন। নিশ্চয় আমাদের লেটকামার স্কিয়ার মিঃ চাউড়ি এবং মিসেস চাউড়ি?
ধ্রুব বসে গম্ভীর মুখে বলল, না–মিস সোনালি সেন। আপনাদের রেজিস্টার দেখুন–এই নামেই বুক করা হয়েছে শ্রীনগর থেকে।
দুঃখিত, খুবই দুঃখিত মিঃ চাউড্রি।..ভদ্রলোক ব্যস্তভাবে রেজিস্টারের পাতা ওল্টাতে থাকলেন। তারপর দেখে নিয়ে বললেন, হা–তাই বটে। আপনাদের রুম নাম্বার আট আর নয়–দোতলায়। কিন্তু আবার দুঃখিত অ্যাটাচড বাথ মাত্র আট নম্বরে, আপনি সেটা মিস সেনের জন্যে বুক করেছেন। এদিকে ওটার সেন্ট্রাল হিটিং ব্যবস্থা নেই। নয়েরটায় আছে কিন্তু সেটার সঙ্গে কোন বাথ নেই। আপনাকে বাথের জন্যে একটু কষ্ট করে নিচে নামতে হবে। না–নিচের বাথ একা আপনারই। আসলে জায়গা ছিল না ওপরে, তাই এই ব্যবস্থা।
ধ্রুব খাপ্পা হয়ে বলল, সে কী! এসব তখন তো আপনার কোম্পানি আমাকে বলেনি!
ভুল ধরিয়ে দিলেন ভদ্রলোক–কোম্পানির ডাইরেক্ট কোন বুকিং সেন্টার শ্রীনগরে নেই স্যার। ওটা করে কোম্পানির এজেন্ট–একটা ট্রাভেল এজেন্সি। তাদের এসব জানার কথা নয়।
আশ্চর্য তো। ধ্রুব সোনালির দিকে তাকাল।
সোনালি ভুরু কুঁচকে বলল, আট থেকে নয়ে ঢোকার দরজা নেই?
কেন।
তুমি আমার আটের বাথ ব্যবহার করবে।
কিন্তু তোমার আট তো মড়ার মতো ঠাণ্ডা।
সোনালি কী বলতে যচ্ছিল, ভদ্রলোক বললেন, ক্ষমা করবেন। আপনারা কি বাংলাভাষায় কথা বলছেন পরস্পর?
ধ্রুব বলল, হ্যাঁ। কেন?
ভারি মিঠে ভাষা আপনাদের। রবীন্দ্রনাথ ট্যগোর! ওঃ চমৎকার। এবং শেখ মুজিবের বাংলাদেশ
ধ্রুব থামিয়ে দিয়ে বলল, দেখুন–ওসব তত্ত্ব আলোচনা পরে হবে, মিঃ, দুগাল। এখন…
পাল্টা ভদ্রলোক ওকে থামালেন।…আমি মিঃ দুগাল নই। মোহন শ্রীবাস্তব। মিঃ দুগাল গতকাল একটা জরুরী ব্যাপারে শ্রীনগর হয়ে দিল্লি গেছেন। এক সপ্তাহ বাদে ফিরবেন।
আপনি ম্যানেজার?
উঁহু–তাও নই। শ্রীবাস্তব মিটিমিটি হাসতে থাকল।
ধ্রুব ধমকের সুরে বলল, তবে কে আপনি?
আমি ট্রেনিং সেন্টারের একজন ইনস্ট্রাক্টার। মিঃ দুগাল নিজেই সব দেখাশোনা করেন। হঠাৎ চলে যেতে হলো বলে আমাকে এই দায়িত্ব দিয়ে গেছেন।
আর আপনি চমৎকার দায়িত্ব পালন করছেন।
শ্রীবাস্তব রাগল না–এমন চেহারার মানুষ রাগতে জানে না সম্ভবত। বলল, মিথ্যে অনুযোগ করছেন মিঃ চাউড্রি। আট নম্বরের সেন্ট্রাল হিটিং বরাবরই নেই–ওটা বাড়তি জিনিসপত্রে ঠাসা থাকে। তবে কেউ শেষের দিকে বুক করলে খালি করে দেওয়া হয়। তাছাড়া ওঘরে আপনাদের মোমবাতি জ্বেলে কাজ করতে হবে।
আর বরফজলে স্নান করতে হবে!
না–বাথে ইলেকট্রিসিটি আছে। গরম জল পাবেন।
ধ্রুব সোনালির দিকে তাকিয়ে ইংরেজিতেই বলল, কোন মাথামুণ্ড বুঝতে পারছি না। ভারি অদ্ভুত তো! বাথে ইলেকট্রিসিটি আছে–অথচ ঘরে নেই। কী কাণ্ড।
সোনালি বাংলায় বলল, হয়েছে বাবা! যা হয়, শিগগির করো। আমার কষ্ট হচ্ছে।
শ্রীবাস্তব বোর্ড থেকে দুটো চাবি এগিয়ে দিল কাচুমাচু মুখে। বলল, সত্যি, কোন মানে হয় না। আমি অনেকবার বলেছি মিঃ দুগালকে–উনি কানেই নেন না। বলেন, কাহাতক বাড়তি খরচা! যাক গে, মিস সেনের পায়ে কি আঘাত লেগেছে?
সোনালি বলল, না–ঠাণ্ডা। আপনাদের এখানে ডাক্তার নেই?
আছে সে অনেকটা দূরে। ওদিকের রাস্তায় তো আজ দুপুর অব্দি খবর একফুট বরফ। ডাক্তার আসবেন কি না বলা কঠিন। তবে আমাদের কিছু ব্যবস্থা আছে।…শ্রীবাস্তব সহানুভূতির সঙ্গে বলল।…বুঝতেই পারছেন, স্কি করতে গিয়ে প্রায়ই ছোটখাটো দুর্ঘটনা তো হয়ই–সেজন্যে চিকিৎসা ব্যবস্থা নিজেরাই রেখেছি।
ধ্রুব ভুরু কুঁচকে চাবি দুটো নাড়াচাড়া করছিল। সে কিছু বলল না। সোনালি প্রশ্ন করল, আপনি নিশ্চয় অ্যাকসিডেন্ট করেছিলেন?
শ্রীবাস্তব কেমন চমকাল যেন। তারপর চোখ বুজে মাথা দোলাল। শেষে বলল, ওঃ, সে এক ভীষণ ব্যাপার। হুইল লিফটের চেয়ার থেকে স্কিয়ারদের ট্রেনিং দিচ্ছিলুম। হঠাৎ কীভাবে পড়ে গেলুম-আর ডান স্কিটা পা থেকে খুলে গিয়েছিল। তারপর তো…যাক গে। কফি বলি–আপনারা আমাদের সম্মানিত অতিথি!
সোনালি হেসে বলল, আপনি ইনস্ট্রাক্টার–কাজেই আমরা আপনার ছাত্র।
হো-হো করে হেসে উঠল শ্রীবাস্তব। ঘণ্টার চাবি টিপতে হাত বাড়াল। তখন ধ্রুব দুম করে দাঁড়িয়ে বলল, না–ধন্যবাদ। আমরা এখন ক্লান্ত-ঘরে যেতে চাই। আপনি কি দয়া করে আপনার লোক দিয়ে জিনিসগুলো ঘরে পাঠাবেন?
শ্রীবাস্তব শশব্যস্তে বলল, নিশ্চয়–অবশ্যই। এ আমাদের কর্তব্য।
ধ্রুব বেরোবার মুখে ঘুরে বাঁকা হেসে বলল, হ্যাঁ–একজন ঠাণ্ডায় পা জমে যাওয়া অসুস্থ মহিলাকে হিমঘরে বাসের বন্দোবস্ত করাও আপনাদের কর্তব্য বইকি!
শ্রীবাস্তব ভারতীয় ধরনের করজোড়ে অনুনয় করল, প্লিজ প্লিজ মিঃ চাউড্রি! ব্যক্তিগতভাবে সত্যি আমি দারুণ লজ্জিত। কিন্তু কোম্পানি কোন কথা কানে নেয় না–প্রাইভেট কনসার্ন তো! আমরা নিতান্ত বেতনভোগী কর্মী মাত্র।
ঘোরালো সিঁড়ি দিয়ে সরু ওপরের করিডরে পৌঁছল ওরা। সোনালির খুবই কষ্ট হচ্ছিল। বরফের কুচি দিয়ে ডললে অনেক সময় আড়ষ্টতাটা কেটে যায়। আগে এখন ঘর এবং বিছানাটাই জরুরী। তারপর দেখা যাবে।
ধ্রুব আট নম্বরের তালা খুলতে যাচ্ছিল, সোনালি বলল, এই! তুমি এত নৃশংস তা তো জানতুম না! ওই হিমঘরে আমাকে ঢোকাতে চাও! আমাকে আলু পেয়েছে–না কী?
ধ্রুব বলল, না–আমি এ ঘরে থাকব।
সোনালি বলল, এ ঘরে তোমার কোন অধিকার নেই। সত্যি বলছি, আমি পুলিস ডাকব। ওটা আমার নামে বুকড।
তাহলে আমি শোব কোথায়?
তোমার ন’য়ে।
আর তুমি?
বিপন্ন নারীকে একটু আশ্রয় দেবে।
সে কী! ওটা তো সিঙ্গল বেড রুম। মেঝেতে শোওয়া অসম্ভব।
বারে! তোমাকে মেঝেতে শুতে বলব–আমি কি অত হৃদয়হীন?
কিন্তু তোমাকেই বা মেঝেয় শুতে দেব, আমি এত হৃদয়হীন?
মোটেও না। একটা বেড়ে দুজনে কীভাবে শুতে হয়–সে ট্রেনিং আমার আছে। চল তো বাবা, আর তর্ক করে না। সে খোঁড়াতে খোঁড়াতে ওকে টানল।
ন নম্বরের দরজা খুলে ধ্রুব অসহায় মুখে বলল, কিন্তু আমার যে ট্রেনিং নেই!
আমি দেব ট্রেনিং। সোনালি সুইচ টিপে আলো জ্বালাল।
ধ্রুব এতক্ষণে স্বাভাবিক হাসল।…সে তো তোমরা মেয়েরা মেয়েরা শুয়েছে। আমি যে পুরুষ। বিপজ্জনক হয়ে ওঠার চান্স থাকতে পারে।
বিপজ্জনক বস্তু বা প্রাণীকে কীভাবে শায়েস্তা করতে হয়–সেও ট্রেনিং নেওয়া আছে। বাবা রে বাবা। এত বকাটে মানুষ তো দেখিনি।
খাঁটি বাঙালি মেয়ের ঢঙে সোনালি এ কথা বলে আলখাল্লা ছাড়তে ব্যস্ত হলো। মেঝেয় বরফকুচি পড়ল অজস্র। ধ্রুবও ওভারকোট খুলতে খুলতে সেন্ট্রাল হিটারর চাবি ঘুরিয়ে দিল। ক্রমশ ঘরটা চমৎকার তাপে ভরে উঠতে থাকল। দুজন বিছানায় পাশাপাশি বসল। ধ্রুব এবার আরাম করে চুরুট জ্বালাল।
একটু পরেই দরজায় কে নক করল। কোম্পানির লোক। ওদের জিনিসপত্র বয়ে এনেছে। ধ্রুব সব গোছগাছ করতে ব্যস্ত হলো। সোনালি বলল, এই লোকটা নিশ্চয় ইংরেজি বোঝে না।
ধ্রুব লোকটাকে দেখে নিয়ে বলল, যা দেখছি–সবাই মনে হচ্ছে বোঝে। বলেই দেখ না।
সোনালি ইংরেজিতে বলল, কী নাম তোমার?
লোকটা–হ্যাঁ, ইংরেজিতেই জবাব দিল–আমার নাম শের সিং।
তুমি কাশ্মীরি?
না ম্যাডাম, পাঞ্জাবি।
তুমি কি আমাদের দেখাশোনা করবে?
আমি সকলেরই দেখাশোনা করি, ম্যাডাম।
আর লোক নেই?
দরকার হয় না।
আমাদের খাবার আনবে কে?
নিচে ডাইনিং হলে যেতে হবে ম্যাডাম। সেলফ-সারভিস সিসটেম।
সর্বনাশ! দেখছ তো আমার পা গেছে!
শের সিং তার বিশাল জোব্বা থেকে একটা কাঠের বড় কৌটো বের করে বলল, ভুলে গিয়েছিলাম–শ্রীবাস্তব পাঠিয়েছেন। মলম আছে। হুঁশিয়ার ম্যাডাম, আগুনে পা সেঁকবেন না।
জানি। শোনো শের সিং, দু কাপ গরম কফি খাওয়া দরকার।
মাফ করবেন, সব সেলফ-সারভিস সিসটেম।
ধ্রুব চটে বাংলায় বলল, ভ্যাট। আমি আনব। ওকে বিদেয় করো তো!
শের সিং, তুমি আসতে পারো।
শের সিং চলে গেল সেলাম বাজিয়ে। ধ্রুব বলল, যা ব্যাপার দেখছি, স্কিইং-এর সাধ জন্মের মতো ঘুচে-যাবে। এ তো সুইজারল্যান্ড নয়, ভারতবর্ষ। বললেই তো বলবে–আরে রাখো রাখো! এখনও কোটি কোটি লোকের ভাত কাপড়ের সংস্থানই করা হয়ে ওঠেনি তো তোমাদের ওই স্কি-বিলাস!
সোনালি বলল, দমে গেছে মনে হচ্ছে।
যাঃ। ধ্রুব ফের ওভারকোট চড়িয়ে মাথায় টুপি ঢেকে এগোল।…আমি কফি নিয়ে আসি। তুমি পোঁটলা খোলো ততক্ষণে। স্ন্যাকসের প্যাকেট বের। করো।
সোনালি বিছানায় পা তুলে দিয়ে মোজা খুলতে খুলতে বলল, রোখো বাবা! আগে ওষুধ লাগাই। এই পা নিয়ে যে আমার সব প্ল্যান ভেস্তে যাবে। ও মা, আমি কী করব! কান্নার ভান করে ঠোঁট কোঁচকাল সে–চোখে দুষ্টু হাসি।
ধ্রুব দরজা খুলে ঘুরে বলে গেল, বাইরে গেলে তোমার বাঙালি মেয়েসুলভ ন্যাকামিটা বেরিয়ে আসে সোনালি। কেন বল তো?
আনন্দে। বলে সোনালি কাঠের মোড়কটা খুলতে ব্যস্ত হল।
.
বেচারা সোনালি–তার দুর্ভাগ্য! ধ্রুব দুঃখিত হয়েছিল খুবই। নিচে অফিসের লাগোয়া ছোট্ট হল ঘরে ডিনারের আয়োজন। কাউন্টারে বড়ো বড়ো প্লেটে দেশী-বিদেশী পদ সাজানো হয়েছে। যে-যা খাবে, তুলে নিয়ে দাঁড়িয়ে খাচ্ছে এখানে ওখানে এবং পরস্পর গল্প-গুজব করছে। একটা জানালা খোলা আছে–তার ওধারে টিনের শেড দেওয়া লম্বা চওড়া আরেকটা হল দেখা যাচ্ছে। তার মেঝে পুরু বরফে ঢাকা। আলোও উজ্জ্বল। সেখানে কয়েকজন স্কি-চর্চা করছে। তাদের মধ্যে সোনালির বয়সী সুশ্রী একটি মেয়ে রয়েছে। স্কেটিং জুতো পরে একদিকে দাঁড়িয়ে সে কী সব নির্দেশ দিচ্ছে। এদের তাহলে মহিলা ইনস্ট্রাক্টারও রয়েছে। মাঝে মাঝে সে কারও হাত থেকে প্রায় চারফুট লম্বা স্কিপোল দুটো নিয়ে সম্ভবত শরীরের ব্যালান্স রাখার কৌশল বুঝিয়ে দিচ্ছে। ধ্রুব লক্ষ্য করছিল, আগের বছর সোনামার্গের কাছে একটা জায়গায় স্কি করতে গিয়ে যে স্কি দুটো সে পায়ে ব্যবহার করেছিল, এদের স্কি তার চেয়ে অনেক বড়ো–ক্ষুদ্র ছিপ নৌকোর মতো। তার সংশয় হলো, ওই পাঁচ-ছ ফুট একজোড়া স্কি পরে সোনালি সামলাতে পারবে কি না। অবশ্য এখন তো ওর পা জখম।
ট্রেনিং-এর দৃশ্যটা তন্ময় হয়ে দেখছিল ধ্রুব। সেইসময় তার পিছনে কে পরিষ্কার শুদ্ধ বাংলায় বলে উঠল, আপনি কি বাঙালি?
ধ্রুব ঘুরে দেখল এক ভদ্রলোক মাথায় টাক মুখে সাদা দাড়ি আর পিছনে কিছু শনের মতো চুল, খুব অমায়িক চেহারা, তার দিকে তাকিয়ে আছেন হাসিমুখে। হনুমান টুপিটি তার কাঁধে ঝুলছে। পোশাকের অবস্থা দেখে মনে হলো, এ আবহাওয়ায় বেশ অভ্যস্ত। এই বুড়োও কি স্কি খেলতে এসেছে। নাকি? তার অবাক লাগল। তার ওপর বাঙালি বুড়ো! এ বয়সে যার কিনা নাতিপুতি নিয়ে মাঠে ময়দানে বসে থাকার কথা।
ভদ্রলোক একটু হেসে নিজে থেকেই পরিচয় দিলেন।..আমি নীলাদ্রি সরকার-কর্নেল নীলাদ্রি সরকার। মিঃ দুগাল আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। প্রতি নভেম্বরে আমি রিস্তা ক্যাম্পে চলে আসি। কিন্তু এবার আবহাওয়ার গতিক ভালো দেখছি না, মাই ইয়ং ফ্রেন্ড!
ধ্রুব তক্ষুনি লাফিয়ে উঠল।…কর্নেল নীলাদ্রি সরকার! কী আশ্চর্য!
কর্নেল অবাক হয়ে বললেন, আপনি আমাকে চেনেন?
ধ্রুব বলল, চিনি মানে আপনার কথা আমি মামার কাছে ভীষণ শুনেছি। আমার মামা কেন্দ্রীয় তদন্ত ব্যুরো থেকে সম্প্রতি রিটায়ার করেছেন–অমলেশ রায়। মামার কাছে।
কী কাণ্ড, কী কাণ্ড! কর্নেল ওর কাঁধে হাত রাখলেন। অন্তরঙ্গভাবে ওকে দেখতে দেখতে বললেন, রায়ের ভাগ্নে তুমি! তুমি বলছি, ইয়ংম্যান। কিছু মনে করো না। নাম কী তোমার? স্কিতে ভীষণ নেশা আছে নিশ্চয়? ওঃ, বলো না–এর মতো চমৎকার গেম আর নেই। টানতে টানতে টেবিলের কাছে নিয়ে গেলেন ওকে। পাশাপাশি বসলেন।
ধ্রুব তার পরিচয় দিয়ে বলল, আমি দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয়ে ফেরেনসিক বিভাগের লেকচারার। আমার নাম ধ্রুব চৌধুরী।
কর্নেল পরিহাস করে বললেন, হা ঈশ্বর! গোয়েন্দা ফোরেনসিক সবকিছু এই দুঃসময়ে ঠাণ্ডা পাহাড়ে এসে জমেছে বাকি থাকল কী? জাস্ট এ মার্ডার–একটা খুন। অ্যাঁ? হা হা করে হেসে উঠলেন তিনি।
ধ্রুব কথার ঝোঁকে বলল, সেও বাকি নেই, কর্নেল। আমার এক মহিলাবন্ধু– নাম শুনে থাকবেন, সোনালি সেন–অনেক পাহাড়ে চড়েছে…
সোনালি–সোনালি সেন! হ্যাঁ, হ্যাঁ কাগজে অনেকবার তার নাম পড়েছি মনে হচ্ছে। কোন পর্বত অভিযাত্রী দলের সদস্যা যেন। যাক গে, কী হলো সোনালি সেনের?
হাফ মারডার্ড! ধ্রুব হেসে উঠল।…পা জমে প্রায় খোঁড়া হয়ে গেছে।
পুওর গার্ল! কত নম্বরে বুকড় হয়েছে তোমরা?
এবার ধ্রুব একটু বেকায়দায় পড়ে গেল। একঘরে থাকছে বা শুতেই হচ্ছে–একই বিছানায় এই গুরুজনতুল্য ভদ্রলোকের সামনে সেটা প্রকাশ হয়ে পড়া লজ্জার ব্যাপার। অবশ্য সোনালি তার–যাকে বলে, বাগদত্তা বউ। একই বেড়ে শোওয়াটা যা কদিন আগে-পরের ব্যাপার। একদিন তো শোবেই দুজনে একখাটে। ধ্রুব বলল, আট আর নয়–দোতলায়।
চলো, আলাপ করে আসব। আমি অল্পস্বল্প ওষুধপত্তরও জানি ঠাণ্ডা বিষয়ে। কর্নেল উৎসাহী হয়ে উঠলেন।
ধ্রুব আরও আড়ষ্ট হলো। সোনালির জন্য খাবারের একটা প্যাকেট ব্যবস্থা করে নিয়ে সে বেরোল।
ওপরে উঠে ন নম্বরে নক করলে সোনালি খোঁড়াতে খোঁড়াতে এসে দরজা খুলে দিল। তারপর কর্নেলের দিকে জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে বিছানায় বসল। ডাক্তার পাওয়া গেছে নির্ঘাত। ধ্রুব অসাধারণ ছেলে।
কর্নেল নিজে থেকে আত্মপরিচয় দিয়ে একেবারে পাশে বসলেন তার।
ডাক্তার নয়। সোনালি ক্ষুণ্ণ হতে গিয়েও অবশ্য খুশি হলো।
সে বলল, ভারি খুশি হলুম, কর্নেল। আমি আপনার কথা কোথায় যেন শুনেছিলুম।
ধ্রুব বলল, মামার কাছে শুনে থাকবে।
সোনালি চোখ পাকিয়ে বলল, আজ্ঞে না। তোমার মামা গোয়েন্দা বলেই তো সবজান্তা নন।
কী মুশকিল! মামা যে কর্নেলের বুজুমফ্রেন্ড!
সবাই একসঙ্গে হেসে উঠল।
প্রায় দুটি ঘণ্টা নানা ব্যাপারে কথা বলে কর্নেল যখন উঠলেন, তখন রাত প্রায় সাড়ে এগারোটা। ধ্রুব ভাবছিল, যাক্ গে–কর্নেল আট নম্বরের রহস্য টের পাননি-লজ্জার হাত থেকে বাঁচা গেছে।
কিন্তু কর্নেল দরজার কাছে হঠাৎ ঘুরে দাঁড়ালেন।…ইয়ে–ব। আমার মনে হচ্ছে, তোমাদের আট নম্বর ঘরটা অকেজো। সেন্ট্রাল হিটারটা নাকি জ্বলে গেছে আজ সকালে। শ্রীবাস্তব খুব ছোটাছুটি করছিল মিস্ত্রী নিয়ে। বলছিল, দুগাল যাবার সময় টের পেলে বলে দিত–কী একটা পার্টস গেছে, নতুন না হলে চলবে না। দুগাল আসবার সময় নিয়ে আসত।
ধ্রুব অবাক হয়ে গেল। সে কী! শ্রীবাস্তব তো অন্যরকম বলছিল তাকে। ঘরটায় নাকি বরাবর সেন্ট্রাল হিটিং ব্যবস্থা নেই। দুগালকে অত বলেও নাকি ফল হয়নি। আশ্চর্য তো! ব্যাটা আসলে হয়তো ভেবেছে, হিটার আছে জানলে বোর্ডার আবার মিস্তিরি ডাকানো আর মেরামতের জন্যে চাপ দেবে–তার কী অত হাঙ্গামার দায় পড়েছে। সে তো ম্যানেজার নয়–একজন ইনস্ট্রাক্টার। কাজেই কেন অত বাড়তি ঝুটঝামেলা করা! সে মিথ্যে বলে রেহাই পেতে চেয়েছে! তা না হলে অ্যাটাচড বাথে ইলেকট্রিসিটি আছে, ঘরে নেই–এ তো হয় না!
ধ্রুব অবশ্য কর্নেলকে ওসব ব্যাপার বলা দরকার মনে করল না। এখন ঝট করে শুয়ে পড়তে ইচ্ছে করছে। ভারি ক্লান্ত সে। কথায় কথা বাড়ে। কর্নেল আরও দেরি করিয়ে দিতে পারেন। সে শুধু বলল, হ্যাঁ–ঘরটা একেবারে ফ্রিজ।
তাহলে তো তোমার শোওয়া একটা ভীষণ সমস্যা!
ধ্রুব মাথা চুলকে বলল, না–দেখছি কী করা যায়!
উঁহু। শোন–নিচে আমার ঘরে একটা স্ট্রেচার আছে–জাস্ট এ স্ট্রেচার। তুমি এসো আমার সঙ্গে খুব হাল্কা! নিজেই বয়ে আনতে হবে কিন্তু। এদের সাহায্য পেতে পেতে তোমার রাত কাবার হয়ে যাবে। দুগালটা ভারি হিসেবী কি না–কম লোক দিয়ে জব্বর কাজ আদায় করতে চায়। এস, চলে এস এক্ষুনি।
ধ্রুব বলল, কেন? ও ঘরের খাটটা এ ঘরে আনব বরং।
পাগল! সারাদিনের ঠাণ্ডায় যা অবস্থা হয়েছে, শোবার উপযুক্ত হতে অন্তত বারো ঘণ্টার কড়া তাপ দরকার। আমি এ সব জানি, মাই ডিয়ার ইয়ংম্যান। বিলো জিরো ডিগ্রি টেম্পারেচার গেছে আজ। ফসিল হবার সাধ কেন? চলে এসো।
সোনালি মিটিমিটি হাসছিল! ধ্রুব করুণ চোখে তার দিকে একবার তাকিয়ে কর্নেলের সঙ্গে বেরোল।
নিচে কারো ঘুমোবার তাগিদ দেখা যাচ্ছিল না। করিডরে স্কিয়াররা আনাগোনা করছে, পায়ে স্কি-বুট। কাঠের মেঝেয় খটাখট আওয়াজ উঠছে সবখানে! সেই ট্রেনিং রুম থেকে কথাবার্তা আর হল্লার মৃদু আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। বাইরের দুর্যোগ কল্পনা না করাই স্বস্তিকর অবশ্য।
কর্নেলের ঘর থেকে ভাঁজ করা খাটিয়াটা বয়ে আনছিল ধ্রুব। সিঁড়িতে ওঠার মুখে আটকে গেল–সিঁড়িটা খুব সংকীর্ণ কাঠের। তার ওপর ঘোরালো। সমস্যায় পড়ে গেল ধ্ৰুব। নিচে একজন ধরে উঁচু করে তুললে তবে খাটিয়া ওঠানো সম্ভব হয়। এখন কাকেই বা সাহায্য করতে বলবে। স্কিয়াররা নিজের তালে ঘুরছে। এখনও কারো সঙ্গে আলাপ হয়নি।
সেই সময় পাশেই দরজা খুলে বেরিয়ে এল একটি মেয়ে। ধ্রুব চিনতে পারল। স্কি রুমের সেই ইনস্ট্রাক্টার। চেহারায় মনে হয় কাশ্মীরি মেয়েই হবে। ধ্রুবর অবস্থা দেখে সে একটু হেসে বলল, আপনাকে সাহায্য করতে পারি কি?
ধ্রুব মুগ্ধ হয়ে গেল।…হা–যদি কিছু মনে না করেন…
না, না। মনে করার কী আছে? সানন্দে। বলে সে খাটিয়াটা ধরল।
ওপর অব্দি পৌঁছে দিয়ে মেয়েটি বলল, আপনি তাহলে সেই দেরি করে আসা ভদ্রলোক! আমি মিস ললিতা টোড়মাল-ইনস্ট্রাক্টার।
ধ্রুব বলল, অনেক ধন্যবাদ মিস টোমাল। আমি ধ্রুব চৌধুরী–ফ্রম ডেহি।
আপনি তো বাঙালি।
হ্যাঁ। আপনি?
এখন কাশ্মীরিই বলতে পারেন। অবশ্য আমার জন্ম সিংহলে। আচ্ছা, তাহলে এখন চলি। আবার দেখা হবে, কেমন?
ললিতা টোডমাল নমস্কার করে চলে গেল। ওর কণ্ঠস্বরে কী যেন আছে, কেমন সঙ্গীতময়। ধ্রুবর কানে লেগে রইল।
খাটিয়াটা ঘরে ঢুকিয়ে ধ্রুব বলল, বেঁচে গেলুম, বাবা। পাশে স্ত্রীলোক নিয়ে শোওয়ার অভ্যেস নেই। ঘুমের বারোটা বেজে যেত।
অভ্যেস বুঝি আমার আছে? সোনালি বাঁকা ঠোঁটে বলল।
থাকা উচিত।
এই যা তা বলো না!
মোটেও বলিনি। বলছি–পাশে স্ত্রীলোক নিয়ে শোবার অভ্যেস। তা কি মিথ্যে?
সোনালি হাসল। দ্যাটস রাইট। সে অভ্যেস আমার আছেই তো।
বিছানা করতে করতে ধ্রুব বলল, কর্নেল দীর্ঘজীবী হোন। কী বাঁচা না বাঁচিয়ে দিলেন।
সোনালি বলল, কীভাবে একশয্যায় শুতুম জানো? আমার মাথা যেদিকে– তার উল্টোদিকে তোমার মাথা। তার মানে আমার পা তোমার মাথার পাশে–আর তোমার পা আমার মাথার পাশে। গ্র্যান্ড হত কিন্তু লাথি খেলে দুজনেই খেতুম পরস্পরের–কেমন শোধবোধ হয়ে যেত। আর ভক্তি শ্রদ্ধা জানতে হলে সেও খুব সুবিধে ছিল। তুমি আমার পায়ে মাথা ঠেকাতে…।
ধ্রুব দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, তোমার পায়ে চুমু খেতুম বরং!.কিন্তু ঘুম। আসছিল ধ্রুবর। নিচে কি সারারাত ওরা জেগে আছে? কাঠের মেঝেয় খটখট, শব্দ অবিশ্রান্ত শোনা যাচ্ছিল।
তারপর কখন একটি ঘুমের আবেশ এসেছে–হঠাৎ নিচে একটা চাপা অদ্ভুত ধরনের ঘরঘর শব্দ থেমে-থেমে শোনা যাচ্ছে। কিসের শব্দ? যেন একটা চাকা ঘুরছে কোথাও। কিসের চাকা? ঘরঘর শব্দটা কতক্ষণ ধরে চলল। তখন স্কেটিং জুতোর খটাখট আনাগোনার শব্দ আর নেই। আর কোন শব্দ নেই শুধু ওই চাকা ঘোরার শব্দটা ছাড়া। ধ্রুব চোখ বুজে পড়ে রইল। অসহ্য লাগছিল। যেন মাথার ভিতর একটা চাকা ঘুরছে থেমে-থেমে। অথচ ভালো ঘুম না হলে সকালে স্কি জমবে না তার।
আবার একটু তন্দ্রা মতন এল। আবার জাগল ধ্ৰুব। সোনালির কোন সাড়া নেই।
সেই সময় হঠাৎ শুনতে পেল, ওপর তলায় পাশেই মেঝেতে (এখানেও কাঠের মেঝে) চাপা খটখট মচমচ একটা শব্দ হচ্ছে। কে যেন সিঁড়ি দিয়ে উঠে এল। দরজার সামনে দিয়েই চলে গেল।
এখন প্রচণ্ড স্তব্ধতা। কাজেই বাইরের ওই, সন্তর্পণ চাপা চলাফেরা শব্দ বদ্ধ ঘরের মধ্যে শুনতে পাওয়া যাচ্ছে। কে এতরাত্রে চলাফেরা করছে? অমন সাবধানে কেন?
তারপর মনে হলো, পাশেই কোন ঘরের দরজার তালা খোলার ক্লিক, তারপর দরজা খুলে যাওয়া, ফের কিছু চাপা হাঁটার শব্দ–তারপর স্তব্ধতা।
কে হয়তো নিজের ঘরে ফিরে শুয়ে পড়ল। ভাবতে ভাবতে এবার ঘুমিয়ে পড়ল ধ্রুব। সকালে সোনালি যখন তাকে ডাকাডাকি করছে, ধ্রুব তখন কিন্তু জেগে। সম্ভবত শেষরাত্রে নিচে কারা উত্তেজিত স্বরে কথা বলছিল, কিংবা ঝগড়া করছিল–সেটা স্বপ্ন কি না–সে ভাবছিল।
…খবর্দার, তুমি এসব ব্যাপারে নাক গলাবে না বলে দিচ্ছি।..স্ত্রীলোকের কণ্ঠস্বর। খুব পরিচিত লাগছিল। ললিতা নাকি?
পুরুষ কণ্ঠে : না–এটা ভীষণ অন্যায়। ইমমরাল! কেন তুমি…
স্ত্রীলোকটি : শাটআপ! এক্ষুনি চলে যাও এখান থেকে।
পুরুষটি : প্লিজ, প্লিজ! এখনও ভেবে দেখ–তুমি আমার ওপর অবিচার করছ।
স্ত্রীলোকটি : গেট আউট, গেট আউট ফ্রম হেয়ার! আই প্রমিজ..
কী সব নাটকীয় সংলাপ! ধ্রুব টের পাচ্ছিল–প্রত্যেকটি সংলাপ যখন তার মুখস্থ হয়ে গেছে, তখন সে নিশ্চয় স্বপ্নে শোনেনি। সে বলল, সোনালি, কারা সব ঝগড়া করছিল রাত্রে, শোননি?
সোনালি বলল, না। ভীষণ ঘুমিয়েছি। কিন্তু আমার পায়ের তো কোন উন্নতি হয়নি, ধ্রুব। ইস্, কী করব এখন বলো তো।
ধ্রুব উঠে বসল।…দেখি কর্নেলকে জিগ্যেস করে। কোথাও ডাক্তার পাওয়া যায় নাকি। তোমার পায়ে কি যন্ত্রণা আছে?
না–তাহলে তো ঘুমোতেই পারতুম না। মনে হচ্ছে, মলমের জন্যে যন্ত্রণা টের পাচ্ছি না। কিন্তু সত্যি পায়ে কোন সাড় নেই। সোনালি তার পা দেখতে থাকল।
.