তুরুপের তাসের খেলা

তুরুপের তাসের খেলা

 ডি সি ডি ডি অরিজিৎ লাহিড়ীর ফোন এল রাত পৌনে এগারোটায়। …কর্নেল! কী ব্যাপার?

কর্নেল বললেন, তুমি বাড়ি থেকে ফোন করছ নিশ্চয়!

হ্যাঁ। অফিসে গিয়ে শুনলুম আপনি রিং করেছিলেন। তখন ভীষণ টায়ার্ড। তাই ঠিক করলুম বাড়ি ফিরে আপনাকে ঘুম থেকে ওঠাব।

অরিজিতের হাসি ভেসে এল। কর্নেল হাসলেন না। বললেন, তোমার। অপেক্ষা করছিলুম। তাছাড়া বারোটার আগে আমি ঘুমোইনে।

হ্যাঁ, বলুন!

 রক্তমাখা জামাকাপড়ের মালিককে হয়তো খুঁজে বের করেছি।

মরেনি সে?

অরিজিৎ হাসছিল। কর্নেল বললেন, তুমি এই কেসটাকে গুরুত্ব দিচ্ছ না। ডার্লিং!

কর্নেল, বর্তমান নিয়েই হিমশিম খাচ্ছে যে, অতীত নিয়ে ঝামেলা পাকাতে তার ফুরসত কোথায়?

সেই অতীতের সঙ্গে বর্তমানের যোগাযোগ রয়ে গেছে, অরিজিৎ! রবীন্দ্রনাথের কবিতাটি পড়োনি? অতীত বর্তমানের মধ্যেও গোপনে-গোপনে কাজ করে?

আসলে ব্যাপারটা কী হয়েছে বলি? আপনি একজনের আত্মহত্যার নিমিত্ত হয়েছেন বলে প্রচণ্ড অনুশোচনায় ভুগছেন, কর্নেল!

দ্যাটস রাইট। তবে ওই যে বললাম, অতীত বর্তমানের ভেতর কাজ করে করছে। বাই দা বাই, তোমাকে সুশোভন রায়ের ঠিকানা দিয়েছিলুম। ৫/১ গোবিন্দ নস্কর লেন। দশ বছর আগে কে বা কারা তাকে খুন করেছিল। তার বোনের নাম কেয়া। ওর মা বেঁচে আছেন। দুজনকে দিয়ে রক্তমাখা প্যান্ট-শার্ট সোয়েটার সনাক্ত করানো দরকার।

মাই গুডনেস!

তথাকথিত তপেশ–যে হাথিয়াগড়ে সুইসাইড করেছে, সে ছিল কেয়ার দাদা সুশোভনের বন্ধু। কেয়ার সঙ্গে তার গোপনে রেজিস্ট্রি বিয়ে হয়েছিল। সুতরাং কেয়া এখন বিধবা।

এরকম ট্রাজেডি সবসময় ঘটছে। যাই হোক, সকালে ওদের মা-মেয়েকে নিয়ে ফরেন্সিক ল্যাবরেটরিতে যাব। আর কিছু?

সুশোভন সম্পর্কে পুলিশ রেকর্ডে কী আছে, খুঁজে বের করা দরকার। কেয়া ও তার মায়ের কাছে সুশোভন খুন হওয়ার দিন তারিখ পেয়ে যাবে।

এনিথিং মোর।

 আপাতত এই।…

 কর্নেল ফোন রেখে দিলেন। কিছুক্ষণ ফোন থেকে হাত তুললেন না। — আর একটা কী যেন বলার কথা ছিল, অন্যমনস্কতায় ভুলে গেছেন। জীবনে কখনও এমন বিষাদগ্রস্ত আর অন্যমনস্ক হননি কর্নেল। চিরকাল হাসিখুশি মানুষ। রসিকতায় ফেটে পড়েন একটুতেই। অথচ গভীর অপরাধবোধ তার বুকে চেপে বসেছে। কেন যে নাক গলাতে গেলেন তপেশের ব্যাপারে? দশ হাজার টাকার নোট কেউ বুকপোস্টে পাঠাচ্ছে, সে নিষিদ্ধ মাদকের চোরাকারবারি হবেই তার মানে কী? অথচ তার হাতের স্যুটকেসটি এবং টাকা পাঠানোর অদ্ভুত ব্যবস্থা তাকে গণ্ডগোলে ফেলে দিয়েছিল। বরং স্যুটকেসটি না বদলে তার সঙ্গে ভাব জমাতে পারতেন। সহজে ভাব জমানোর ক্ষমতা তো তার আছে। তা না করে তাকে আত্মহত্যার পথে ঠেলে দিলেন

কিন্তু এখানেই আবার বড় খটকা। একটা খুনের প্রমাণ বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছিল সে এবং সেটা হাতছাড়া হওয়াই কি শুধু তার আত্মহত্যার কারণ?

তারপর শ্যামলকান্তি মজুমদারের প্রপাতের ধারে অতর্কিত ধাক্কা, বিমলকুমারের আঁকা বিমূর্ত ছবিটা, এবং এ রাতে সার্কাস এভেনিউতে একটা জিপগাড়ির যেন তাড়া করে আসা…

এগুলো তার নিজেরই দেখার ভুল কি না? দিনশেষের আবছা আলোয় পায়ের কাছে বাঁকা লতা থেকে শ্যামলকান্তি সাপ ভেবে তাকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিতেও পারেন। খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। বিমূর্ত ছবিটা…।

নাঃ! চিন্তার পুনরাবৃত্তি ঘটছে। বিরক্ত কর্নেল ফোনের কাছ থেকে উঠে গেলেন। বুক কেসের সামনে একটু দাঁড়ালেন। কিছু বই পড়তে ইচ্ছে করছে না। বাতি নিভিয়ে বেড রুমে গিয়ে ঢুকলেন। শুয়ে পড়লেন।

সকালে অভ্যাসমতো ছাদের প্ল্যান্ট ওয়ার্ল্ডে কিছুক্ষণ কাটিয়ে নেমে এলেন। কাগজ পড়তে পড়তে কফি খেলেন। কাগজে তপেশ–সংক্রান্ত কোনো খবর নেই। না থাকারই কথা। তবু যেন কিছু খবর আশা করেছিলেন। এও মনের ভুল। এই কেসটা তাকে ক্রমশ যেন বিমলকুমারের আঁকা বিমূর্ত চিত্রকলার জগতে টেনে নিয়ে চলেছে দুর্বোধ্য একটা পরিপ্রেক্ষিতে।

দশটায় বেরিয়ে পড়লেন গাড়ি নিয়ে। ব্র্যাবোর্ন রোডে পারিজাত ট্রান্সপোর্টের হেড অফিস। দশতলা একটা বাড়ির পাঁচতলায় অফিসটা। কার্ড পাঠানোর সঙ্গে সঙ্গে ডাক এল ম্যানেজিং ডাইরেক্টর পরিতোষ ব্যানার্জির চেম্বার থেকে। পরিতোষবাবুর বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি। রাশভারি চেহারা। পরনে ধুতি পাঞ্জাবি। নাদুস-নুদুস গড়ন। অনবরত পান খাবার অভ্যাস। কর্নেলকে বসিয়ে করজোড়ে বললেন, বলুন স্যার, কী করতে পারি আপনার জন্য।

তপেশ বসাক–

পরিতোষবাবু নড়ে বসলেন।…ও হ্যাঁ। কাল আমি ছিলুম না। এইমাত্র এসে শুনলুম, পুলিশ এসে তপেশের খোঁজখবর করেছে। ওর আইডেন্টিটি কার্ডে নাকি অন্য লোকের ছবি আছে। আমি তো স্যার মাথামুণ্ডু কিছু বুঝতে পারছি নে। এবার আপনি এসেছেন–প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটর লেখা আছে আপনার কার্ডে।

কী ব্যাপার বলুন তো? কিসের ইনভেস্টিগেশন হচ্ছে তপেশের নামে? সে তো খুব ভাল লোক ছিল। অত্যন্ত বিশ্বস্ত কর্মচারী।

ছিল–মানে এখন নেই উনি?

পরিতোষবাবু বিরাট সেক্রেটারিয়েট টেবিলের তলায় টিনের ওয়েস্টপেপার বাস্কেটে মুখ থেকে পানের গুঁড়ো ফেলে বললেন, তপেশ বছর পাঁচেক আগে হার্ট অ্যাটাক হয়ে মারা গেছে। কোম্পানি ওর চিকিৎসার কোনো ত্রুটি করেনি।

তখন তার বয়স কত ছিল?

তা পঁচিশ-পঁচিশ হবে।

 ওঁর কোনো ছবি আছে আপনাদের অফিসে?

পরিতোষবাবু হাসলেন।..ছবি রাখার প্রশ্ন ওঠে না। সে নিতান্ত রিপ্রেজেনটেটিভ ছিল। বাইরে টাকাপয়সা আদায়ে যেত। তাছাড়া আমাদের হাউস জার্নালও বেরোয় না যে কর্মচারীদের ছবি খুঁজে পাবেন।

ওঁর বাড়ির ঠিকানা নিশ্চয় পাওয়া যাবে অফিস রেকর্ডে!

 যাবে। তবে কালই পুলিশ নিয়ে গেছে হয়তো–এক মিনিট। ভেরিফাই করে নিই।

পরিতোষবাবু বেলের সুইচ টিপে একজন বেয়ারাকে ডেকে বললেন, সত্যবাবুকো বোলাও। একটু পরে স্মার্ট এবং প্যান্ট শার্ট টাই পরা এক ভদ্রলোক এসে দাঁড়ালেন। কর্নেলের দিকে তাকিয়ে নিয়ে একটু হেসে বললেন, এঁকে কোথায় দেখেছি যেন?

পরিতোষবাবু বললেন, সত্য! উনি কর্নেল নীলাদ্রি সরকার প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটর। তপেশ সম্পর্কে ইনভেস্টিগেট করতে এসেছেন। কাল পুলিশও এসেছিল বললে!

সত্যবাবু এসে বললেন, তপেশকে নিয়ে এত দিন পরে কিসের তদন্ত? সে তো হার্ট অ্যাটাকে মারা পড়েছে নাইনটিন সেভেনটি সিক্সের ফোর্থ জুলাই।

কর্নেল বললেন, ওঁর বাড়ির ঠিকানাটা দরকার।

 দিচ্ছি। একটু বসুন।

সত্যবাবু উঠে গেলে পরিতোষবাবু বললেন, তপেশের কোনো ইনসিওরেন্স পলিসি নিয়ে ঝামেলা বেধেছে কি স্যার?

কর্নেল মাথাটা একটু দোলালেন। হ্যাঁ বা না দুই-ই বোঝায় এতে।

সত্যবাবু ফিরে এলেন একটা পুরনো ডাইরি নিয়ে। বললেন, ভাগ্যিস ডাইরিগুলো ফেলে দিইনি। এই যে! লিখে নিন স্যার। ৫৩/১ ই মির্জাপুর স্ট্রিট। অবশ্যি যদুর মনে পড়ছে, ওটা ওদের ভাড়ার বাড়ি ছিল। ওর আত্মীয়স্বজনের খবর জানি না। কলকাতায় যা বাসার প্রব্লেম, ওঁরা ওই বাড়িতে থাকতেও পারেন।

কর্নেল ঠিকানাটা নোট বইয়ে টুকে নিয়ে উঠে পড়লেন। সত্যবাবু করিডোরে পৌঁছে ফের বললেন, খালি মনে হচ্ছে আপনাকে কোথায় যেন দেখেছি, অথচ কিছুতেই মনে পড়ছে না। নামটাও চেনা মনে হচ্ছে।

কর্নেল চুপচাপ এগিয়ে গেলেন লিফটের দিকে।…

মির্জাপুর স্ট্রিটের নতুন নাম সূর্য সেন স্ট্রিট। ৫৩/১ ই নম্বর বাড়িটা দোতলা এবং জরাজীর্ণ। অনেকগুলি পরিবারের বাসা। বারো ঘর এক উঠোন’ বলা চলে। এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক বেরিয়ে এসে কর্নেলকে দেখে একটু ভড়কে গেলেন। কর্নেল নমস্কার করে বললেন, আমি তপেশ বসাকের সম্পর্কে একটু খোঁজ নিতে এসেছি।

আমি তপেশের বাবা। কিন্তু তপেশ তো—

জানি। উনি ১৯৭৬ সালের ৪ জুলাই হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছেন।

বৃদ্ধ আরও হকচকিয়ে গিয়ে বললেন, কী ব্যাপার স্যার? আমরা নিরীহ সজ্জন লোক। প্রতিবেশীদের জিগ্যেস করলেই জানতে পারবেন।

তপেশবাবুর স্ত্রী কোথায় আছেন? আন্দাজে একটা ঢিল ছুঁড়লেন কর্নেল।

বৃদ্ধ কাঁপাকাঁপা গলায় বললেন, আমার কাছেই থাকে। আমার তো আর কেউ নেই। তপেশের ছেলে আছে-বছর সাতেক বয়স। আর বউমা। ট্রান্সপোর্টে চাকরি করত তপেশ। সেখানে বউমা কাজ পেল না। অগত্যা

বিধবা যুবতীদের দেখলে কর্নেল বিচলিত বোধ করেন। বৃদ্ধের পেছনে সে দাঁড়িয়ে ছিল। বৃদ্ধের কথা থামিয়ে সামনে এসে বলল, কী ব্যাপার?

আপনি কি তপেশবাবুর স্ত্রী?

হ্যাঁ। কিন্তু

বলছি। তবে এভাবে তো কথা বলা যাবে না মা! একটু বসতে চাই।

 আসুন।

 নিচের তলায় একটা মাত্র ঘরে বাসা। বারান্দার কোনায় ছোট্ট কিচেন। চেয়ারে বসে কর্নেল নিজের কার্ডটি এগিয়ে দিলেন তপেশের বিধবা বউকে। কার্ডটি দেখে সে জিজ্ঞাসু চোখে তাকাল। বৃদ্ধ খাটে বসেছেন। তার পা দুটো কাঁপছে। কর্নেল বললেন, তপেশবাবু পারিজাত ট্রান্সপোর্টে চাকরি করতেন। তাঁর একটা আইডেন্টিটি কার্ড ছিল। সেটা কি আছে?

বিধবা যুবতী আস্তে বলল, না। হারিয়ে গেছে।

হার্ট অ্যাটাক কোথায় হয়েছিল ওঁর?

এই ঘরেই। অফিস-যাবে বলে বেরুচ্ছে, হঠাৎ বুকে ব্যথা বলে খাটে গিয়ে বসল। তারপর

হু। ওঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের আপনি নিশ্চয় চেনেন?

একটু ভেবে নিয়ে তপেশের বউ বলল, ও তেমন মিশুকে প্রকৃতির ছিল না। বন্ধুবান্ধব বলতে শুধু বাসুদেব নামে একজন ঠিকানা জানি না।

সে কি এ বাসায় আসত?

আসত মাঝেমাঝে। বাসুদেবকে আমি পছন্দ করতুম না।

চেহারার বর্ণনা দিতে পারেন?

রোগা, শ্যামবর্ণ। চোখদুটো কেমন যেন। মেজাজ খিটখিটে।

 আপনার স্বামীর হার্ট অ্যাটাকের সময় বাসুদেববাবু এসেছিলেন?

হ্যাঁ। সেই রিকশা ডেকে এন আর এস হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল। পেছনে আরেকটা রিকশায় আমি গেলাম। হাসপাতাল থেকে ওর অফিসে ফোন করা হয়েছিল।

মেডিকেল কলেজ হসপিট্যাল তো কাছেই ছিল। এন আর এসে কেন?

ওখানে বাসুদেবের চেনা ডাক্তার ছিল। বাসুদেবের পুরো নাম মনে আছে?

তপেশের বউ একটু ভেবে বলল, বাসুদেব রায় বলে মনে পড়ছে। তবে কোথায় থাকত জানি না। কিন্তু এত দিন পরে কিসের এনকোয়ারি স্যার?

 পরে যোগাযোগ করব। বলে কর্নেল বেরিয়ে এলেন। শ্বশুর ও বউমা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল।…

কলেজ স্ট্রিট-বউবাজার মোড়ে জ্যাম। আধঘণ্টা পরে জ্যাম ছাড়ল। কর্নেল বউবাজার ছাড়িয়ে ডাইনে ঘুরলেন। তারপর সেন্ট্রাল এভেনিউ ধরে এগিয়ে দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকার অফিসের সামনে গাড়ি পার্ক করলেন। সোজা তিন তলার লাইব্রেরি রুমে গিয়ে ঢুকলেন। লাইব্রেরিয়ান এখনও আসেননি। সহকারী সুপ্রিয় কর্নেলকে দেখে লাফিয়ে উঠল। হাই ওল্ড বস! জয়ন্ত আউট অফ স্টেশন বলে কি আমরাও তাই হয়ে গেছি? বসুন, আগে কফি আনাই ক্যান্টিন থেকে।

কর্নেল বললেন, ডার্লিং! কফি পরে। আগে আমি তোমাদের কাগজের পুরনো ফাইল দেখতে চাই।

আদেশ করুন।

 ১৯৭০ সালের জুন মাসের ফাইল।

সুপ্রিয় বিশাল লাইব্রেরির বইপত্তরের র‍্যাকের ভেতর অদৃশ্য হলো। একটু। পরে বাঁধানো পুরনো দৈনিক সত্যসেবকের ফাইল এনে টেবিলে রাখল। তারপর ফোন তুলে ক্যান্টিনে কফির অর্ডার দিল।

কর্নেল জুন মাসের পাতা ওল্টাতে থাকলেন। ১৭ জুনের কাগজে পাঁচের পাতায় দৃষ্টি আটকে গেল। শেষ কলামে খানিকটা জায়গা কেটে নিয়েছে। বাকি ১৩ দিনের পাতাগুলো ওল্টালেন। সব ঠিক আছে। সুশোভন রায় সম্পর্কে জুন মাসে কোনো খবর নেই।

সুপ্রিয় বলল, কী ব্যাপার?

 ১৭ জুনের কাগজে পাঁচের পাতায় এটা কাটা কেন সুপ্রিয়?

দেখামাত্র সুপ্রিয় জিভ কেটে কপাল চাপড়ে বলল, সর্বনাশ! কে কেটে নিয়ে গেল? কর্তৃপক্ষ জানতে পারলে চাকরি যাবে! কী কাণ্ড দেখুন তো!

আমি আসার আগে কেউ পুরনো ফাইল দেখতে এসেছিল আজ?

সুপ্রিয়কে নার্ভাস দেখাচ্ছিল। বলল, আমি কাঁটায় কাঁটায় দশটায় এসেছি। তবে লাইব্রেরি খোলে নটায়। বেয়ারাদের জিগ্যেস করি।

বেয়ারারা কেউ কিছু বলতে পারল না। সুপ্রিয় বলল, নিশ্চয় আজ এটা ঘটেনি। কেউ গতকাল কিংবা তার আগে এসেছিল ফাইল দেখতে। সেই কেটে নিয়ে গেছে। সমস্যা হলো, অসংখ্য লোক রিসার্চ পারপাসে ফাইল দেখতে আসেন। কর্তৃপক্ষের অনুমতি নেন অবশ্যি! কিন্তু ঠিক কবে কে এসে এ কম্মটি করেছে, সেটা খড়ের গাদায় সুচ খোঁজার শামিল।

কফি এল। কর্নেল কফিতে চুমুক দিয়ে একটু হাসলেন।…চেপে যাও, সুপ্রিয়। কলকাতায় আরও কাগজ বেরোয়। অসুবিধে হবে না।

সুপ্রিয় বেয়ারাদের ধমক দিচ্ছিল। ফাইল দিয়ে তারা যেন নজর রাখে।

কফি খেয়ে কর্নেল বেরুলেন। আবার ভুল করছেন না তো? ওই তারিখের কাগজে কাটা জায়গাটায় সুশোভনের মৃত্যুসংবাদ ছিল, তার প্রমাণ কী? মৃত্যুসংবাদ যদি থাকেও, তাতে এমন কী তথ্য পাওয়ার আশা করেছেন?

স্টেটসম্যানে গিয়েও একই কাণ্ড। ১৯৭০ সালের ১৭ জুনের কাগজে নিচের পাতায় তেমনি কাটা। এখানে কাটা অংশটা আরও বড়। তার মানে স্টেটসম্যান গুরুত্ব দিয়ে কোনো খবর ছেপেছিল–একটু বিস্তারিতভাবে।

একটা বেজে গেল কলকাতার সমস্ত বড় কাগজের অফিস ঘুরতে। সমস্ত কাগজে ১৯৭০ সালের ১৭ জুনের একটা জায়গা কেউ কেটে নিয়েছে। অতএব খবরটা বড় গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কিন্তু কী খবর? কেয়া বলেছে, তার দাদার বডি খুঁজে পাওয়া যায় ওই বছর জুন মাসে। ১৭ জুনের খবরটা যে সুশোভন সংক্রান্ত, তার ভিত্তি কী?

ফিয়ার্স লেনে এটা চীনা রেস্তোরাঁয় লাঞ্চ সেরে কর্নেল লালবাজার পুলিশ হেডকোয়ার্টারে গেলেন। ডি সি ডি ডি অরিজিৎ লাহিড়ীর চেম্বারের বাইরে বোর্ডে ইন’ চোখে পড়ল।

হাই ওল্ড ডাভ! অরিজিৎ হাসলেন। এত নার্ভাস দেখাচ্ছে কেন?

তুরুপের তাসের পাল্লায় পড়েছি ডার্লিং!

অরিজিৎ ঝুঁকে এলেন টেবিলের ওপর। আস্তে বললেন, কী ব্যাপার?

বলছি। ১৯৭০ সালের ১৭ই জুন সম্ভবত সুশোভন রায়-সংক্রান্ত একটা খবর সমস্ত কাগজের লাইব্রেরির ফাইলে কেউ কেটে নিয়ে গেছে। তোমাদের রেকর্ডসে ওই তারিখে সুশোভন রায় সংক্রান্ত

হাত তুলে ডি সি ডি ডি বললেন, বলেছি–খোঁজা হয়েছে। পাইনি।

১৯৭০ সালের ১৭ জুন নীলরতন সরকার হাসপাতালের মর্গে ওর বডি সনাক্ত করা হয়।

লেট আস ট্রাই এগেন। অরিজিৎ কলিং বেলের বোতাম টিপলেন। একজন স্মার্ট চেহারার শাদা পোশাকের পুলিশ এসে সেলাম দিল। বললেন, এই স্লিপটা নিয়ে যাও। বাগচিবাবুকে দাও।

স্লিপে কিছু লিখে দিলেন। ফের বললেন, লাস্ট চান্স। দেখা যাক কী হয়..

দীর্ঘ দশ মিনিট পরে নাদুস নুদুস চেহারার এক অফিসার হন্তদন্ত এলেন। সঙ্গে একজন বেয়ারা। তার হাতে এক গাদা ফাইল। অরিজিৎ বললেন, ঠিক আছে। এগুলো থাক আমার কাছে।

অফিসার কর্নেলের দিকে আড়চোখে তাকাতে তাকাতে চলে গেলেন। অরিজিৎ বললেন, ১৯৭০, ১৭ জুন এন আর এসে বডি-সুশোভন রায়? বলে ফাইল ওল্টাতে থাকলেন।

একটু পরে একখানে থেমে অস্ফুট স্বরে বলে উঠলেন, এ কী!

 মিসিং?

তিনটে পাতা নেই! অরিজিতকে ক্রুদ্ধ দেখাচ্ছিল। ঠোঁট কামড়ে ধরলেন। শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে বললেন, ডিপার্টমেন্টাল এনকোয়ারি তো হবেই। আগে ওই বাগচিবাবু-রেকর্ড কিপার, ওকে সাসপেন্ড করব। বাঘের ঘরে ঘোঘের বাসা! কী ভেবেছে?

কর্নেল উঠে দাঁড়ালেন।…ভুলে গিয়েছিলুম। কেয়া বা তার মা ফরেন্সিকে জামাপ্যান্ট সনাক্ত করতে গিয়েছিল কি?

অরিজিৎ আস্তে বললেন, দুজনেই গিয়েছিল। সনাক্ত করেছে। কর্নেল বেরিয়ে এলেন। ঠিক তুরুপের তাসের মতো কেউ বা কারা প্রতিটি দানের তাসগুলো জিতে নিচ্ছে। কে বা কারা তারা? একটা ব্যাপার ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, সে বা তারা প্রভাবশালী লোক।

লাল ল্যান্ডরোভারের গতি দক্ষিণে রেড রোড ধরে। চৌদ্দ নম্বর গোখেল : পার্কের প্রিয়তমা’ নামে বাড়িটির লনে ঢুকে গাড়ি পার্ক করলেন কর্নেল।

দোতলার ৪ নম্বর ফ্ল্যাটে কলিং বেল টিপলেন। ভেতর থেকে সাড়া এল, চলে এস শ্যামলদা। দরজা তোমার জন্য খুলে রেখেছি।

চিত্রকর বিমলকুমার তাহলে শ্যামলকান্তির জন্য অপেক্ষা করছেন।

কর্নেলকে দেখে নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে বললেন, আপনাকে চেনা মনে হচ্ছে! কে বলুন তো?

বিমলকুমারের হাতে মদের গেলাস। শিল্পী মানুষ। সারাক্ষণ কি মদ ছাড়া চলে না? কর্নেল বললেন, কাল রাত্রে আমি এসেছিলুম।

তাই বুঝি? আমার কিছু মনে থাকে না! বলুন, কী করতে পারি।

 পোর্টেট আঁকানোর কথা বলেছিলুম।

 মনে নেই। বসুন। এনি ড্রিংক?

 ধন্যবাদ। কর্নেল ছবির গাদার পাশে সোফায় বসলেন।

বিমলকুমার ইজেলে ক্যানভাস এঁটে একটা ছবি আঁকছেন। গেলাসে চুমুক দিয়ে ওতে তুলির একটা পোঁচ টেনে পিছিয়ে এলেন। দেখার পর হাসি মুখে ঘুরে বললেন, আপনার পোর্ট্রেট?

হ্যাঁ। আচ্ছা বিমলবাবু, কাল রাত্রে ওখানে যে ছবিটা দেখেছিলুম

কোন ছবিটা বলুন তো?

অ্যাবস্ট্রাকট পেন্টিং আমি বুঝি না। মনে হয়েছিল, যেন পিঠে ছুরি বেঁধা একটা মানুষ–সামনে ঝুঁকে পড়েছে।

বিমলকুমার গেলাস ও তুলি রেখে এগিয়ে গেলেন বড়বড় ফ্রেমে আঁটা ক্যানভাসগুলির দিকে। দুমদাম এদিক-ওদিকে ফেলতে শুরু করলেন। পাগলের হাবভাব মুখে। তারপর প্রায় চেঁচিয়ে উঠলেন, কোন শুয়োরের বাচ্চা ওটা চুরি করল? তাকে আমি মেরে ফেলব। একেবারে খতম করে দেব। তিন বছরের পরিশ্রম! ওঃ! আমার একটা মাস্টারপিস! প্যারি এক্সজিবিশনে পাঠানোর কথা ছিল।

ছবিগুলোতে লাথি মারতে থাকলেন বিমলকুমার। কর্নেল গিয়ে ধরলেন তাকে বললেন, আপনার সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে বিমলবাবু!

শাট আপ! নো কথা। আমার মাস্টারপিস উধাও। দুহাতে মুখ ঢেকে শিশুর মতো কেঁদে উঠলেন চিত্রকর। তারপর ধপাস করে বসে পড়লেন মেঝেয়।

কর্নেল তাকে শান্ত করতে পারলেন না। তার কোনো প্রশ্নের জবাবও পেলেন না। বিমলকুমার পাগলের মতো লাথি মারতে থাকলেন মেঝেয় পড়ে থাকা ছবিগুলোতে। উন্মত্ত ভাঙচুর শুরু হলো।

একটু দাঁড়িয়ে থেকে বেরিয়ে এলেন কর্নেল। হুঁ, এও তুরুপের তাস। আরও একটা দানের তাসগুলি জিতে নিয়েছে ধূর্ত খেলোয়াড়।…