নবম পরিচ্ছেদ – এক
দুই পক্ষের গুপ্তচরগণ বিপক্ষ-বাহিনীর গতিবিধির উপর লক্ষ্য রাখিয়াছিল। মগধের সৈন্যদল পাটলিপুত্র হইতে যাত্রা করিবার অষ্টাহ পরে একদিন প্রখর মধ্যাহ্নে দুই পক্ষের সাক্ষাৎ হইল। স্থানটি শোণ নদের পূর্বতটে, পাটলিপুত্র হইতে পঞ্চাশ-ষাট ক্রোশ দক্ষিণে।
নদের অববাহিকায় কোথাও ঊষর মুক্ত ভূমি, কোথাও বা শাল তমাল জম্বু শাল্মলীর বন, শাখোট শিংশপাও আছে। চেদিরাজ্য ও মগধের সীমান্ত এই জনবসতিহীন অরণ্যমেখলা দ্বারাই নির্দেশিত হইত, সুচিহ্নিত সীমারেখা ছিল না। সেদিন দ্বিপ্রহরে লক্ষ্মীকর্ণ এই সীমান্তের এক জম্বুবনে আসিয়া বাহিনীর যাত্রা স্থগিত করিলেন। জম্বুবন ছায়াস্নিগ্ধ, তাহার সম্মুখে ও পশ্চাতে বিস্তীর্ণ প্রান্তর; এইখানে তপ্ত দ্বিপ্রহর নিষ্পন্ন করিয়া তৃতীয় প্রহরে আবার অগ্রসর হইবেন। মগধের সৈন্যদল বেশি দূরে নাই, শীঘ্রই সাক্ষাৎকার ঘটিবে। অতএব সৈন্যদলকে বিশ্রাম দিয়া যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত থাকা প্রয়োজন।
ধূলিধূসর সৈন্যদল ছুটি পাইয়া প্রথমেই ছুটিয়া গিয়া নদের জলে ঝাঁপাইয়া পড়িল; হস্তী ও অশ্বগণ তীরে গিয়া জল পান করিল। সৈন্যগণ স্নানান্তে জম্বুকুঞ্জে ফিরিয়া দ্বৈপ্রাহরিক আহারের চেষ্টায় তৎপর হইল। ঘোড়াগুলি নদীর তীরে সবুজ শষ্প যাহা পাইল ছিঁড়িয়া খাইল। হস্তীযূথ জম্বুবৃক্ষের সপত্র সফল শাখাগুলি ভাঙ্গিয়া চর্বণ করিতে লাগিল।
সৈন্যমণ্ডলীর মধ্যস্থলে এক বিশাল জম্বুবৃক্ষতলে আসন পরিগ্রহ করিয়া মহারাজ লক্ষ্মীকর্ণ একটি আস্ত কণ্টকী ফল সেবন করিয়া পিণ্ডপূজা সম্পন্ন করিলেন; সঙ্গে পরিপাকের জন্য এক স্কন্ধ কদলী। রাজমাতা আন্দোলিকায় শুইয়া কেবল এক ঘটিকা জল পান করিলেন। যৌবনশ্রী আহার্যের স্থালী হইতে এক মুষ্টি ভিজা মুদ্গ দাল লইয়া মুখে দিলেন।
সহসা সৈন্যদলের সম্মুখভাগ হইতে কড়্ কড়্ শব্দে পটহ বাজিয়া উঠিল। সৈন্যগণ যে যেমন অবস্থায় ছিল ক্ষণকাল তেমনি রহিল, তারপর হাতের কাজ ছাড়িয়া অস্ত্র ধরিল। লক্ষ্মীকর্ণ আসন ত্যাগ করিয়া নিমেষমধ্যে উঠিয়া দাঁড়াইলেন। পটহধ্বনির সংকেত সুস্পষ্ট; শত্রুসৈন্য দেখা দিয়াছে।
লক্ষ্মীকর্ণ লৌহজালিক ত্যাগ করেন নাই, তরবারি কটিতে ছিল; কিন্তু হাতের কাছে যানবাহন ছিল না। তিনি মদমত্ত হস্তীর ন্যায় সেনাদলের সম্মুখদিকে চলিলেন। অনেক সৈনিকও সেইদিকে ছুটিয়াছিল; লক্ষ্মীকর্ণ তাঁহাদের মৃগযূথের ন্যায় দুইপাশে সরাইয়া দিয়া অগ্রসর হহলেন।
মহারাজ সেনাদলের পুরোভাগে উপস্থিত হইলে পটহধ্বনি নীরব হইল। তিনি দেখিলেন, সম্মুখে বিস্তীর্ণ প্রান্তর, দৈর্ঘ্যে-প্রস্থে প্রায় দশ রজ্জু। প্রান্তরের পরপারে শালবন আরম্ভ হইয়াছে। শালবনের মাথা ভেদ করিয়া ধ্বজশীর্ষে কেতন উড়িতেছে, কয়েকটা হস্তী বন হইতে বাহিরে আসিয়া শুণ্ড আস্ফালন করিতেছে। বনের মধ্যে যতদূর দৃষ্টি যায় কাতারে কাতারে সৈন্য। তাহারাও প্রান্তরের পরপারে শত্রু সমাবেশ দেখিতে পাইয়াছে এবং ডঙ্কা বাজাইতেছে।
মহারাজ লক্ষ্মীকর্ণ কিছুক্ষণ শাণিত চক্ষে শালবনের দিকে চাহিয়া রহিলেন। তাঁহার মস্তিষ্কে দ্রুত চিন্তার ক্রিয়া হইতে লাগিল। এই সুযোগ! উহারা পথশ্রমে ক্লান্ত, ব্যূহ রচনার অবকাশ পায় নাই। আমার সৈন্যদল বিশ্রাম পাইয়াছে, আহার করিয়াছে। এখন যদি আক্রমণ করি উহারা দাঁড়াইতে পরিবে না। —
ইতিমধ্যে লক্ষ্মীকর্ণের সেনানীদল তাঁহার পাশে আসিয়া দাঁড়াইয়াছিলেন, লক্ষ্মীকর্ণ তাঁহাদের দিকে ফিরিয়া বজ্রকণ্ঠে কহিলেন— ‘দেখছ কি! ঢক্কা বাজাও— শৃঙ্গ বাজাও! সৈন্যগণ প্রস্তুত হোক। এখনি ওদের আক্রমণ করব। আর কাল বিলম্ব নয়, সন্ধ্যার পূর্বেই অধম শক্রকে ছিন্নভিন্ন করে দেব।’
ঢক্কা ও শৃঙ্গ বাজিয়া উঠিল— ডঙ্ক ডঙ্ক! তুতুহু তুতুহু! এই বিপুল শব্দ-সংঘট্টের সঙ্কেত সৈন্যগণের অপরিচিত নয়। হস্তী অশ্ব রথ পদাতি ঝটিতি যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হইল। —
সেদিন লক্ষ্মীকর্ণ যদি মগধ-বাহিনীকে আক্রমণ করিতে পারিতেন তাহা হইলে ফল কিরূপ হইত বলা যায় না; হয়তো তিনি জয়লাভ করিতেন। কিন্তু তাঁহার আক্রমণ করা হইল না, বিধাতা বাদ সাধিলেন। সহসা সূর্যের মুখের উপর ছায়া পড়িল, চারিদিক ধূম্রবর্ণ হইয়া গেল। লক্ষ্মীকর্ণ চকিতে ঊর্ধ্বে চক্ষু তুলিলেন। নৈর্ঋত হইতে যমদূতাকৃতি মেঘ ছুটিয়া আসিতেছে। নিদাঘের প্রমত্ত ঝঞ্ঝাবাত।
দেখিতে দেখিতে ঝড় আসিয়া পড়িল। ঝক্মক্ বিদ্যুৎ, কড়্ কড়্ বজ্র, শন্ শন্ ঝটিকা। মনে হইল উন্মত্ত ঝটিকা জম্বুবনের বৃক্ষগুলাকে কেশ ধরিয়া নাড়া দিয়া উন্মূলিত করিয়া ফেলিবে। তারপর সেখান হইতে লাফাইয়া শালবনের উপর গিয়া পড়িল। শালবন মথিত হইয়া উঠিল।
ঝড়ের সঙ্গে নামিল বৃষ্টি। মুষলধারায় বর্ষণ। হাতি ঘোড়া ভিজিতে লাগিল; সৈন্যদল ভিজিয়া কাদা হইল। মহারাজ লক্ষ্মীকর্ণ ভিজিলেন। আন্দোলিকার আবরণের জন্য অম্বিকা ও যৌবনশ্রী কিছু রক্ষা পাইলেন। আর এক বিপদ, জম্বুবৃক্ষের মোটা মোটা ডাল ঝড়ের ঝাঁকানিতে মড়্ মড়্ শব্দে ভাঙ্গিয়া পড়িতে লাগিল। দুই-চারি জন সৈনিকের হাত-পা ভাঙ্গিল। কয়েকটা ঘোড়া ভয় পাইয়া ছুটিয়া পলাইল। হাতিগুলা আত্মরক্ষার চেষ্টায় শুঁড় উঁচু করিয়া রহিল। দুই পক্ষের প্রায় সমান অবস্থা। ওপক্ষে বীরশ্রী বান্ধুলি জাতবর্মা বিগ্রহপাল সকলে রথে বসিয়া ভিজিলেন; সৈন্যদের তো কথাই নাই। কেবল শালগাছের ডাল অত পল্কা নয়, তাই বেশি ভাঙ্গিল না।
এ দুর্যোগে কে যুদ্ধ করিবে? সকলে সাময়িকভাবে যুদ্ধচিন্তা ত্যাগ করিলেন।
প্রায় দুই ঘটিকা মাতামতি চলিবার পর ঝড় উড়িয়া গিয়া আকাশ আবার পরিষ্কার হইল। চতুর্দিক বর্ষণধৌত সূর্যকিরণে ঝলমল করিয়া উঠিল। তখনও সূর্যাস্ত হইতে দুই ঘটিকা বিলম্ব আছে।
এখন আর যুদ্ধ করিয়া লাভ নাই, আরম্ভ করিলে যুদ্ধ অমীমাংসিত থাকিয়া যাইবে। দুই পক্ষ বনের মধ্যে রাত্রি যাপনের ব্যবস্থা করিলেন; কয়েকটা শিবির পড়িল। যুদ্ধ হইবে কাল প্রাতে।
দুই
দুই সৈন্যদল মুখোমুখি বসিয়াছে, মাঝখানে প্রান্তরের ব্যবধান। দুই পক্ষই সতর্ক আছে; জম্বুবন ও শালবন ঘিরিয়া রক্ষীরা ঘুরিয়া বেড়াইতেছে। বাদ্যকরের দল বনের কিনারে স্থানে স্থানে দাঁড়াইয়া বাহিরের দিকে লক্ষ্য করিতেছে, শত্রুপক্ষের কোনও প্রকার সন্দেহজনক কার্যকলাপ দেখিলেই ভেরী-তূরী বাজাইয়া নিজপক্ষকে সাবধান করিয়া দিবে।
তখনও সূর্যাস্ত হইতে দুই তিন দণ্ড বিলম্ব আছে, শালবনের ভিতর হইতে একটি রথ বাহির হইয়া আসিল। জম্বুবনের রক্ষীরা দেখিল রথটি ধীর মন্থর গমনে কণ্টকগুল্ম বাঁচাইয়া তাহাদের দিকেই আসিতেছে। সঙ্গে হস্তী অশ্ব পদাতি নাই, কেবল একটি রথ। সকলে বিস্ময়-বর্তুলিত চক্ষে চাহিয়া রহিল।
রথটি অর্ধেক পথ আসিলে বিস্ময় আরও বাড়িয়া গেল। রথের সারথি স্ত্রীলোক। সঙ্গে আর কেহ নাই, স্ত্রীলোকটি রথ চালাইয়া একাকিনী আসিতেছে।
অবশেষে রথ আসিয়া জম্বুবনের সম্মুখে দাঁড়াইল। রক্ষীরা রথ ঘিরিয়া ফেলিল। তাহারা পূর্বে বীরশ্রীকে দেখে নাই, ভাবিল-এ কি মগধের রাজ্যশ্রী! এমন নয়ন ভুলানো রূপ, এমন রত্নদ্যুতি বিচ্ছুরিত বেশভূষা— এ রাজলক্ষ্মী না হইয়া যায় না।
রক্ষীদের নায়ক সাহসে ভর করিয়া বলিল— ‘দেবি, আপনি কে? এখানে কার সঙ্গে প্রয়োজন?’
দেবী প্রসন্ন হাসিয়া রথ হইতে অবতরণ করিলেন, বলিলেন— ‘একজন ঘোড়ার রাশ ধর। — তোমরা আমাকে চেনো না। আমি মহারাজ লক্ষ্মীকর্ণদেবের কন্যা বীরশ্রী।’
সকলে মুখ ব্যাদান করিয়া রহিল। বীরশ্রী রথ হইতে একটি জলপূর্ণ তাম্রকুণ্ড হাতে লইয়া বলিলেন — ‘হাঁ করে দেখছ কি? রথের মধ্যে ঠাকুরের প্রসাদ আছে, বার কর। আমি ঠাকুরানীকে দেখতে এসেছি। কোথায় আছেন ঠাকুরানী, আমাকে সেখানে নিয়ে চল।’
একজন রক্ষী রথ হইতে প্রকাণ্ড থালি বাহির করিল; থালির উপর স্তূপীকৃত মিষ্টান্নের গোলক। বীরশ্রী তাম্রকুণ্ড হস্তে মরাল গমনে জম্বুবনে প্রবেশ করিলেন, রক্ষী মিষ্টান্নের থালি হস্তে তাঁহাকে পথ দেখাইয়া লইয়া চলিল। বীরশ্রী শত্রুশিবির হইতে আসিয়াছেন, তাঁহার আদেশ যে অমান্য করা যাইতে পারে একথা কাহারও মনে আসিল না। কেবল, তিনি বনের মধ্যে অন্তর্হিত হইলে রক্ষীদের নায়ক একজনের কানে কানে কিছু বলিল, সে ছুটিয়া গেল মহারাজকে সংবাদ দিতে।
জম্বুবনের ছায়াচ্ছন্ন অভ্যন্তরে কিছুক্ষণ চলিবার পর বীরশ্রী দেখিলেন, বড় বড় কয়েকটি গাছের ফাঁকে ফাঁকে ঘন সন্নিবিষ্ট অনেকগুলি শিবির তোলা হইয়াছে। এই শিবিরগুলিতে রাজা, তাঁহার প্রধান সেনানীগণ, রাজমাতা এবং রাজকন্যার রাত্রিবাসের ব্যবস্থা হইয়াছে। সাধারণ সৈনিকদের জন্য কোনও ব্যবস্থা নাই, তাহারা যে যেখানে পাইবে মাটিতে শুইয়া রাত্রি কাটাইবে।
মধ্যস্থলে রাজার শিবির। তাহার বামপার্শ্বে কয়েকটি বৃক্ষের অন্তরে অন্তঃপুর, অর্থাৎ রাজমাতা, রাজকন্যা এবং তাঁহাদের চেটী-কিঙ্করীদের বাসস্থল। মিষ্টান্নের থালি লইয়া রক্ষী সেইদিকে চলিল, বীরশ্রী তাহার অনুসরণ করিলেন। জম্বুবনের মধ্যে দিনের আলো কমিয়া আসিতেছে; এখনও শিবির ঘিরিয়া পাহারা বসে নাই। একটি বস্ত্রাবাসের সম্মুখে আসিয়া রক্ষী দাঁড়াইল। বলিল— ‘এটি রাজমাতার শিবির।’
বীরশ্রী শিবিরে প্রবেশ করিলেন। রক্ষী দ্বারের কাছে থালি নামাইয়া দিয়া চলিয়া গেল।
শিবিরের মধ্যে দিবালোক নিঃশেষিত, এখনও দীপ জ্বলে নাই। অম্বিকা একাকী শয্যায় শুইয়া আছেন। বীরশ্রী হ্রস্বকণ্ঠে ডাকিলেন— ‘দিদি।’
কর্কশ স্খলিতস্বরে অম্বিকা প্রশ্ন করিলেন— ‘কে?’
‘আমি বীরা’— জলের পাত্র রাখিয়া বীরশ্রী পিতামহীর শয্যাপার্শ্বে নতজানু হইলেন। অম্বিকা একটি বাহু দিয়া তাঁহাকে সবলে জড়াইয়া লইলেন। এইভাবে কিছুক্ষণ আলিঙ্গনবদ্ধ থাকিবার পর অন্ধকারে দুইজনে কানে কানে কথা বলিতে লাগিলেন; দ্রুত নিম্নকণ্ঠে বার্তা বিনিময় হইল।
ওদিকে মহারাজ লক্ষ্মীকর্ণের কাছে সংবাদ পৌঁছিয়াছিল। তিনি তীরবিদ্ধ ব্যাঘের ন্যায় লাফাইয়া উঠিলেন। কী, এত বড় স্পর্ধা! শত্রুর পুত্রবধূ আমার শিবিরে আসিবে! আজি দেখিয়া লইব। বলা বাহুল্য, বীরশ্রী ও জাতবর্মা যে একশত রণহস্তী লইয়া নয়পালের পক্ষে যোগ দিয়াছেন, লক্ষ্মীকর্ণ গুপ্তচরের মুখে তাহা অবগত ছিলেন।
মহারাজ লক্ষ্মীকর্ণ যখন মাতৃদেবীর শিবিরে প্রবেশ করিলেন তখন শিবিরে দীপ জ্বলিয়াছে। উপস্থায়িকা দুইজন ভয়ে ভয়ে একপাশে দাঁড়াইয়া আছে। বীরশ্রী পিতামহীর শয্যাপার্শে বসিয়া ছিলেন, উঠিয়া আসিয়া সহজভাবে পিতাকে প্রণাম করিলেন।
লক্ষ্মীকর্ণ জ্বলজ্বল চক্ষে চাহিয়া দন্তে দন্ত ঘর্ষণ করিলেন, বলিলেন— ‘তুই কি জন্য এখানে এসেছিস?’
উপস্থায়িকারা মহারাজের মূর্তি দেখিয়া পা টিপিয়া টিপিয়া পলায়ন করিল। বীরশ্রী শান্তস্বরে বলিলেন — ‘আমি ঠাকুরানীকে দেখতে এসেছি। তাঁর জন্য গঙ্গাজল আর দেবতার প্রসাদ এনেছি।’
লক্ষ্মীকর্ণ গর্জন করিলেন— ‘গঙ্গাজল! প্রসাদ! দুষ্টা, তুই শত্রুর গুপ্তচর, তোকে পাঠিয়েছে সন্ধান নেবার জন্য। যা— এই দণ্ডে চলে যা আমার শিবির থেকে। নইলে—’
শয্যা হইতে ঠাকুরানী কথা বলিলেন— ‘নইলে কী? নিজের কন্যাকে হত্যা করবি? তাই কর্। তুই অপুত্রক, মেয়ে দুটাকেও হত্যা কর্। বংশে বাতি দেবার জন্যে কাউকে রাখিসনি।’
মাতার বাক্যে লক্ষ্মীকর্ণের সর্বাঙ্গ জ্বলিয়া উঠিল; কিন্তু তিনি বাক্যব্যয় করিলেন না, কেবল কষায় চক্ষে মাতার পানে চাহিলেন। বীরশ্রীর চক্ষু অশ্রুপূর্ণ হইয়া উঠিল, তিনি বলিলেন— ‘পিতা, কেন আপনি আমাকে এত নিষ্ঠুর কথা বলছেন? আমি কি আপনার কন্যা নই?’
লক্ষ্মীকর্ণ বলিলেন— ‘কন্যা হলেও তুই আমার শত্রু। তোরা সবাই আমার শত্রু। আমি ক্ষীর খাইয়ে কালনাগিনী পুষেছি।’ বলিয়া মাতার প্রতি অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করিলেন।
বীরশ্রী বলিলেন— ‘পিতা, কেউ আপনার সঙ্গে শত্রুতা করেনি। আপনি যৌবনশ্রীর স্বয়ংবর সভা আহ্বান করেছিলেন, যৌবনশ্রী নিজের মনোমত বরের গলায় মালা দিয়েছে। এ কি তার দোষ? আপনি বাক্যদান করে কেন বিগ্রহপালকে স্বয়ংবর সভায় আহ্বান করেননি? এ কি যৌবনশ্রীর অপরাধ? পিতা, যারা আপনার একান্ত আপন জন তাদের আপনি পর করে দিয়েছেন। কিসের জন্য যুদ্ধ? জগতের চক্ষে বিগ্রহপাল যৌবনশ্রীর স্বামী; আপনি তার বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করেছেন। যুদ্ধে পরাজয় যারই হোক, ইষ্ট কার হবে? পিতা, আমরা আপনার সন্তান, আপনি আমাদের প্রতি প্রসন্ন হোন, ক্রোধ ত্যাগ করুন।’
লক্ষ্মীকর্ণ পদদাপ করিয়া বলিলেন— ‘না না না— যুদ্ধ হবে। আমি বুঝেছি, ধূর্ত নয়পাল তোকে পাঠিয়েছে চাটুবাক্যে আমাকে বশ করতে। কিন্তু তা হবার নয়। কাল যুদ্ধ হবে। তোর শ্বশুর যত হাতিই পাঠাক, মগধ আমি ছারখার করব। নয়পালকে শূলে দেব। তারপর বংগাল দেশে গিয়ে তোর শ্বশুরকে উৎখাত করব। আমার কুটুম্ব হয়ে আমার বিরুদ্ধে হাতি পাঠিয়েছে, এতবড় স্পর্ধা!’
বীরশ্রী অঞ্চলে অশ্রু মুছিয়া বলিলেন— ‘ভাল, আপনার যা অভিরুচি তাই করবেন। নিয়তি কে খণ্ডাতে পারে? আমি আজ চক্রস্বামীর প্রসাদ এনেছিলাম, ভেবেছিলাম দেবতার প্রসাদে আপনার মন প্রসন্ন হবে।’ বীরশ্রী প্রসাদের থালি দুই হাতে ধরিয়া লক্ষ্মীকর্ণের সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইলেন, বলিলেন— ‘পিতা, চক্রস্বামীর প্রসাদও কি আপনি গ্রহণ করবেন না?’
চক্রস্বামীর প্রসাদ— অর্থাৎ বিষ্ণুর প্রসাদ। মহারাজ ধর্মে বৈষ্ণব। যুদ্ধের প্রাক্কালে ইষ্টদেবতার প্রসাদ প্রত্যাখ্যান করা সমীচীন নয়। ফাঁপরে পড়িয়া মহারাজ একখণ্ড মিষ্টান্ন তুলিয়া মুখে ফেলিলেন। বীরশ্রী বলিলেন— ‘যাই বাকি প্রসাদ পরিজনদের বিতরণ করে দিই। আমি বেশিক্ষণ থাকব না পিতা। ঠাকুরানী ও আপনার চরণ দর্শন করলাম, এবার যৌবনার সঙ্গে দুটো কথা বলেই চলে যাব।’
লক্ষ্মীকর্ণ গলার মধ্যে ঘুৎকার শব্দ করিয়া পদদাপ করিতে করিতে প্রস্থান করিলেন। কন্যার সহিত বাগ্যুদ্ধে তিনি জয়ী হইতে পারেন নাই, কন্যাকে শাস্তি দেওয়াও সম্ভব নয়, এই খেদ বক্ষে লইয়া তিনি নিজ শিবিরে ফিরিয়া গেলেন এবং শয্যায় শয়ন করিলেন। এ সংসারে স্ত্রীজাতিকে সমুচিত শাস্তি দিবার কোনও উপায় নাই, বিশেষত যদি তাহারা মাতা কিম্বা কন্যা হয়। পুরুষ এরূপ ধৃষ্টতা করিলে—
শুইয়া শুইয়া চিন্তা করিতে করিতে মহারাজের ক্ষুব্ধ মন— সম্ভবত চক্রস্বামীর প্রসাদের গুণে— ক্রমশ উৎফুল্ল হইয়া উঠিতে লাগিল। কাপুরুষ নয়পাল নিশ্চয় ভয়ে মুক্তকচ্ছ হইয়াছে, তাই বীরশ্রীকে পাঠাইয়াছে সন্ধি করিবার আশায়। ধূর্ত শৃগাল! কণ্টক দিয়া কণ্টক উদ্ধার করিতে চায়। কিন্তু আমি সতর্ক আছি। আমার চক্ষে ধূলা দেওয়া নয়পালের কর্ম নয়—
ক্রমে একটি পরম সুখকর আলস্য তাঁহার সারা দেহে সঞ্চারিত হইতে লাগিল। চিন্তার সূত্র ক্ষীণ হইয়া আসিল। কাল যুদ্ধ, আজ রাত্রে উত্তম বিশ্রাম প্রয়োজন—
মহারাজ গভীর নিদ্রায় অভিভূত হইলেন।
তিন
মহারাজ লক্ষ্মীকর্ণ মাতৃশিবির হইতে বাহির হইবার পর বীরশ্রীও প্রসাদের পাত্র হস্তে বাহির হইলেন। বাহিরে জম্বুবনে তখন অন্ধকার নামিয়াছে। একদল রক্ষী শিবিরগুলিকে ঘিরিয়া পরিক্রম আরম্ভ করিয়াছে, দুই চারিটা উল্কা জ্বলিতেছে। সেনানিবাসের নিয়ম, সন্ধ্যার পূর্বেই রাত্রির আহার সম্পন্ন করিতে হইবে; সৈনিকেরা আহার সমাপ্ত করিয়া শয়নের উদ্যোগ করিতেছে।
একজন শিবির-রক্ষী উল্কা হস্তে অম্বিকা দেবীর শিবিরের সম্মুখ দিয়া যাইতেছিল, বীরশ্রীকে বাহিরে আসিতে দেখিয়া সসম্ভ্রমে দাঁড়াইল। বীরশ্রী যে শত্রুশিবির হইতে পিতৃশিবিরে আসিয়াছেন একথা কাহারও অবিদিত ছিল না; মহারাজের উগ্রকণ্ঠের চিৎকারও বাহির হইতে অনেকে শুনিয়াছিল। চেটী-কিঙ্করীরা শুনিয়াছিল বস্ত্র-প্রাচীরের পরপার হইতে; মুখে মুখে কথাটা প্রচার হইয়া পড়িয়াছিল। দেবী বীরশ্রী শান্তির প্রস্তাব লইয়া আসিয়াছিলেন, কিন্তু উদ্ধত রাজা প্রস্তাবে কর্ণপাত করেন নাই। কাল যুদ্ধ হইবেই। কত লোক মরিবে, কত লোক অন্ধ খঞ্জ হইবে। কিন্তু কে তাহা গ্রাহ্য করে? রাজার ইচ্ছায় যুদ্ধ।
বীরশ্রী রক্ষীর কাছে আসিলেন, হাসিমুখে তাহাকে একটি মিষ্টান্ন দিয়া বলিলেন— ‘চক্রস্বামীর প্রসাদ নাও।’
রক্ষী কৃতার্থ হইয়া প্রসাদ মুখে দিল। বীরশ্রী বলিলেন— ‘সকলকে প্রসাদ দেওয়া তো সম্ভব নয়, কেবল রক্ষীদেরই দিই, চক্রস্বামীর দয়ায় সকলেরই মঙ্গল হবে। চল তুমি উল্কা নিয়ে আমার সঙ্গে, আমি সকলকে প্রসাদ দিয়ে আসি।’
রক্ষী বলিল— ‘কোথাও যাবার প্রয়োজন হবে না দেবি। রক্ষীরা সবাই এই পথেই ঘুরছে, এখনি একে একে আসবে।’
বীরশ্রী দাঁড়াইয়া রহিলেন, রক্ষীও উল্কা লইয়া রহিল। অন্য রক্ষীরা আবর্তনের পথে সেখানে আসিল এবং রাজকুমারীর হাত হইতে প্রসাদ পাইয়া চরিতার্থ হইল। তারপর বীরশ্রী বলিলেন— ‘এবার অন্তঃপুরিকাদের প্রসাদ দিই গিয়ে। কুমারী যৌবনশ্রীর শিবির কোনটা?’
‘এই যে— পাশেই’— রক্ষী বীরশ্রীকে যৌবনশ্রীর শিবিরের দ্বার পর্যন্ত আলো দেখাইয়া পৌঁছাইয়া দিয়া গেল, যাইবার সময় ভক্তিভরে বীরশ্রীকে প্রণাম করিল। বীরশ্রী মধুরকণ্ঠে আশীর্বাদ করিলেন— ‘ চিরঞ্জীব হও— বিজয়ী হও।’
রক্ষী মধ্যবয়স্ক ব্যক্তি, বীরশ্রীর মধুর বাক্যে তাহার হৃদয় বিগলিত হইয়া গেল। সে গদ্গদ স্বরে বলিল— ‘মা, তুমি সাক্ষাৎ লক্ষ্মী। আমি সামান্য যোদ্ধা, আমার আয়ুর হিসাব চিত্রগুপ্তও রাখেন না। জয়-বিজয়েও আমার গৌরব নেই; সে গৌরব রাজার। আশীর্বাদ কর, আমার সন্তান-সন্ততি যেন সুখে থাকে।’
এই সরল যোদ্ধার ক্ষুদ্র আকিঞ্চনে বীরশ্রীর হৃদয়ও আর্দ্র হইল। তিনি বলিলেন— ‘তোমরা সকলে সুখে থাক।’
বীরশ্রী শিবিরদ্বারের প্রচ্ছদ সরাইয়া ভিতরে প্রবেশ করিলেন। দীপের মন্দালোকে যৌবনশ্রী শয্যায় বসিয়া আছেন; আর, ভূমিতে বসিয়া রঙ্গিণী রাবণ রাজার চেড়ীর মত তাঁহাকে পাহারা দিতেছে। যৌবনশ্রী যেন অশোক বনের সীতা। রণক্ষেত্রে শিবিরে বসিয়াও তাঁহার বন্দীদশা ঘুচে নাই।
কিন্তু রঙ্গিণীর ভাবভঙ্গি এখন আর তেমন কঠিন নয়। দীর্ঘকাল রাজকন্যাকে পাহারা দিয়া সে বোধহয় বুঝিয়াছে এ কাজ কেবল গায়ের জোরে হয় না, কিছু কলাকৌশলও প্রয়োজন। বিশেষত রাজপ্রাসাদে ও রণক্ষেত্রের বাতাবরণে অনেক প্রভেদ; কাল যুদ্ধের ফলাফল কী হইবে কেহ জানে না, যদি লক্ষ্মীকর্ণ পরাজিত হন তখন রঙ্গিণীর দশা কী হইবে? তাই বীরশ্রী ও যৌবনশ্রী যখন আলিঙ্গনবদ্ধ হইলেন তখন সে বাধা দিল না, ভূমি হইতে উঠিয়া দাঁড়াইয়া অস্বচ্ছন্দভাবে মৃদু মৃদু হাসিতে লাগিল।
বীরশ্রী বাস্পরুদ্ধ স্বরে বলিলেন— ‘কী হয়ে গিয়েছিস যৌবনা!’
যৌবনশ্রীর গণ্ডে দুই বিন্দু অশ্রু গড়াইয়া পড়িল।
যৌবনশ্রীকে ছাড়িয়া বীরশ্রী আবার প্রসাদের থালি হাতে লইলেন। রঙ্গিণীর সম্মুখে কোনও কথাই হইতে পারে না। তিনি যৌবনশ্রীর সম্মুখে থালি ধরিয়া বলিলেন— ‘চক্রস্বামীর প্রসাদ নে যৌবনা।’
যৌবনশ্রী প্রসাদ হাতে লইবার পূর্বেই বীরশ্রী রঙ্গিণীর দিকে ফিরিয়া বলিলেন— ‘তুমিও নাও। আর, অন্য সব মেয়েদের ডেকে নিয়ে এস। সকলকে প্রসাদ দেব।’
রঙ্গিণী তাড়াতাড়ি আসিয়া প্রসাদ লইয়া মুখে দিল, তারপর মাথায় হাত মুছিয়া অন্য সকলকে ডাকিতে গেল।
সে প্রস্থান করিলে বীরশ্রী যৌবনশ্রীর কানে কানে দ্রুত হ্রস্বকণ্ঠে সংক্ষেপে ব্যাপার বুঝাইয়া দিলেন। যৌবনশ্রী চক্ষু বিস্ফারিত করিয়া চাহিলেন, তারপর থরথর কাঁপিয়া শয্যায় বসিয়া পড়িলেন।
রঙ্গিণী যখন পুরস্ত্রীদের লইয়া ফিরিয়া আসিল তখন দুই ভগিনী শয্যায় বসিয়া গল্প করিতেছেন। পুরস্ত্রীরা সংখ্যায় দশ বারো জন, অম্বিকার উপস্থায়িকা দুইজনও আছে। সকলেই বীরশ্রীর পরিচিত। তাহারা বীরশ্রীর পদধূলি লইল, কলকণ্ঠে সংবর্ধনা করিল। বীরশ্রী সকলের সহিত মিষ্ট সম্ভাষণ করিলেন, সকলের হাতে মিষ্টান্ন দিলেন। সকলে প্রসাদ মুখে দিয়া আনন্দিত মনে চলিয়া গেল।
রঙ্গিণী কিন্তু গেল না, শিবিরের এক পাশে ভূমির উপর বসিয়া রহিল।
বীরশ্রী ও যৌবনশ্রী শয্যার উপর মুখোমুখি বসিয়া গল্প করিতেছেন। বীরশ্রী অধিকাংশ কথা বলিতেছেন; শ্বশুরবাড়ির গল্প, নৌকাযোগে ত্রিপুরী হইতে বিক্রমণিপুর গমনের গল্প। তাঁহার নিজ শিবিরে ফিরিয়া যাইবার কোনও ত্বরা নাই। যৌবনশ্রী মাঝে মাঝে দুই একটি কথা বলিতেছেন। অদূরে বসিয়া রঙ্গিণী কান পাতিয়া শুনিতেছে।
দুই দণ্ড বসিয়া বসিয়া গল্প করিবার পর দুই ভগিনী শয্যায় পাশাপাশি শয়ন করিলেন; শুইয়া শুইয়া গল্প চলিতে লাগিল।
রঙ্গিণীও হাই তুলিয়া শয়ন করিল।
শুইয়া শুইয়া তাহার তন্দ্রাবেশ হইল। সে জাগিয়া থাকিবার চেষ্টা করিল, কিন্তু পারিল না। মাথার মধ্যে ইন্দ্রিয়ের যোগসূত্র ছিন্নভিন্ন হইয়া যাইতে লাগিল।
আরও কিছুক্ষণ কাটিবার পর বীরশ্রী ঘাড় তুলিয়া রঙ্গিণীর দিকে দেখিলেন, ডাকিলেন— ‘রঙ্গিণি!’
রঙ্গিণী সাড়া দিল না। সাড়া দিলে হয়তো বীরশ্রী পানীয় জল চাহিতেন। কিন্তু কিছুক্ষণ প্রতীক্ষা করিয়াও যখন সাড়া পাওয়া গেল না তখন তিনি নিঃশব্দে শয্যা ছাড়িয়া উঠিলেন, শিবিরের দ্বারের কাছে গিয়া প্রচ্ছদ সরাইয়া বাহিরে উঁকি মারিলেন।
বাহিরে জম্বুছায়াচ্ছন্ন নীরন্ধ্র অন্ধকার; আকাশ মৃত্তিকা কিছুই দেখা যায় না। শব্দও নাই। ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগৎ যেন লুপ্ত হইয়া গিয়াছে।
চার
কেবল শিবিরের মধ্যে স্নিগ্ধ দীপ জ্বলিতেছে।
বীরশ্রী ভিতর দিকে ফিরিয়া হাতছানি দিলেন, যৌবনশ্রী নিঃশব্দে আসিয়া তাঁহার পাশে দাঁড়াইলেন। বীরশ্রী তাঁহার হাত ধরিলেন; তাঁহার জিজ্ঞাসু নেত্র একবার রঙ্গিণীর দিকে সঞ্চারিত হইল; সে অঘোরে ঘুমাইতেছে। বীরশ্রী ফিস্ফিস্ করিয়া বলিলেন— ‘ওষুধ ধরেছে। চল্, এবার যাই। আগে ঠাকুরানীর শিবিরে।’
হাত ধরাধরি করিয়া দুইজনে বাহিরে আসিলেন। পিছনে শিবিরদ্বারের প্রচ্ছদ দীপের ক্ষুদ্র আলোর সম্মুখেও আবরণ টানিয়া দিল। চতুর্দিকে কাজলরুচি তমিস্রা, নিজের হাত দেখা যায় না।
এই অন্ধকারে অম্বিকা দেবীর শিবির কোন্ দিকে? বীরশ্রী স্মরণ করিবার চেষ্টা করিলেন। যৌবনশ্রীর শিবিরে আসিবার সময় অম্বিকার শিবির ডান দিকে পড়িয়াছিল, মাঝে একটি সুপুষ্ট জম্বুকণ্ডের ব্যবধান। যৌবনশ্রীর হাত দৃঢ় মুষ্টিতে ধরিয়া বীরশ্রী সেইদিকে অগ্রসর হইলেন। কোনও অদৃশ্য বস্তুতে হোঁচট খাইলে শব্দ হইবে, তাহা বাঞ্ছনীয় নয়। মন্দং নিধেহি চরণৌ—
সম্মুখে হাত বাড়াইয়া চলিতে চলিতে একটি বৃক্ষের কর্কশ ত্বক হাতে ঠেকিল। সঙ্গে সঙ্গে পায়ে ঠেকিল একটি মনুষ্য দেহ। বীরশ্রী তীক্ষ্ণ নিশ্বাস টানিয়া সরিয়া আসিলেন। বোধহয় কোনও সৈনিক কিম্বা রক্ষী বৃক্ষতলে শুইয়া ঘুমাইতেছে। ভাগ্যক্রমে পদস্পর্শে তাহার ঘুম ভাঙ্গিল না। রক্ষীই হইবে, চক্রস্বামীর প্রসাদে বুঁদ হইয়া ঘুমাইতেছে। সৈনিক হইলে ঘুম ভাঙ্গিয়া যাইত।
আরও সাবধানে দুইজনে চলিলেন। একটু একটু পা বাড়াইয়া; অন্ধ কিঞ্চুলুক যে-ভাবে চলে। আর কাহারও গায়ে পা ঠেকিল না।
কিছুক্ষণ চলিবার পর হঠাৎ একটি অতি ক্ষুদ্র আলোকের বিন্দু যৌবনশ্রীর চোখে পড়িল। মাটির উপর যেন একখণ্ড অঙ্গার জ্বলিয়া জ্বলিয়া ভস্মাবৃত হইয়াছে; যৌবনশ্রী দিদির হাত চাপিয়া অস্ফুটস্বরে বলিলেন— ‘দিদি—’
বীরশ্রীও দেখিতে পাইলেন। নিঃশব্দে সেইদিকে কয়েক পা অগ্রসর হইয়া বুঝিতে পারিলেন, অঙ্গার নয়; কোনও একটি শিবিরের প্রচ্ছদ নিম্নভাগে একটু সরিয়া গিয়াছে, ভিতরের আলো দেখা যাইতেছে।
কাহার শিবির? যদি ঠাকুরানীর শিবির না হয়! যদি ভিতরে অন্য কেহ জাগিয়া থাকে! বীরশ্রী প্রচ্ছদের বাহিরে দাঁড়াইয়া ক্ষণেক কান পাতিয়া শুনিলেন, কিন্তু নিজের হৃদ্যন্ত্রের স্পন্দন ছাড়া আর কিছুই শুনিতে পাইলেন না। তখন তিনি ধীরে ধীরে পর্দার কোণ তুলিয়া উঁকি দিলেন।
দ্বারের কাছেই দুই উপস্থায়িকা হাত-পা ছড়াইয়া পড়িয়া আছে; শয়নের অসম্বৃত ভঙ্গি দেখিয়া বোঝা যায় তাহারা গভীর নিদ্রায় মগ্ন। বীরশ্রী ও যৌবনশ্রী নির্ভয়ে শিবিরে প্রবেশ করিলেন।
অম্বিকা জাগিয়া ছিলেন; স্থিরচিক্ষে ঊর্ধ্বদিকে চাহিয়া অপেক্ষা করিতেছিলেন। হাত তুলিয়া সঙ্কেত করিলেন।
তিনটি মাথা কিছুক্ষণ শয্যার উপর একত্র হইয়া রহিল। শেষে বীরশ্রী বলিলেন— ‘দিদি, বাইরে বড় অন্ধকার, কোথায় যাচ্ছি বুঝতে পারছি না। ভয় হচ্ছে, যদি ধরা পড়ে যাই।’
ঠাকুরানী বলিলেন— ‘এক কাজ কর। আমার শিবিরের প্রদীপ দ্বারের বাইরে নিয়ে গিয়ে রাখ। তবু খানিকটা দেখতে পাবি।’
বীরশ্রী বলিলেন— ‘সে ভাল। হাতে প্রদীপ নিয়ে তো যাওয়া চলবে না। যে রক্ষীরা সীমানা পাহারা দিচ্ছে তারা নিশ্চয় ঘুমোয়নি, আলো দেখলে তারা ধরে ফেলবে।’
অম্বিকা বলিলেন— ‘হাঁ। এবার তোরা যা। যত দেরি করবি তত ধরা পড়ার ভয়। নিজের শিবিরে পৌঁছে একবার ডঙ্কায় ঘা দিতে বলিস, যাতে আমি শুনতে পাই।’
দুই ভগিনী আবার বাহির হইলেন। প্রথমে যৌবনশ্রী শিবির হইতে নির্গত হইলেন, পরে বীরশ্রী প্রদীপ হাতে লইয়া আসিলেন। তিনি প্রদীপটি দ্বারের সম্মুখে রাখিলেন। বাহিরে বাতাস নাই, প্রদীপ অকম্প্রশিখায় জ্বলিতে লাগিল।
এতটুকু আলো, বাহিরের সীমাহীন অন্ধকারের মধ্যে হারাইয়া গিয়াছে। তবু নিশ্ছিদ্র অন্ধকারের চেয়ে ভাল। নিজেকে দেখা যায়। পাশের মানুষকে দেখা যায়; বিরাট দৈত্যের মত গাছগুলাকে ঠাহর করা যায়। কোনও ক্রমে জম্বুবন পার হইতে পারিলে হয়তো নক্ষত্রের আলো পাওয়া যাইবে।
প্রদীপ পশ্চাতে রাখিয়া দুইজনে পা বাড়াইলেন—
অকস্মাৎ প্রলয়ঙ্কর শব্দে তাঁহাদের মাথার উপর আকাশ ভাঙ্গিয়া পড়িল। ঢং ঢং ঢং ঢং শব্দ! সমস্ত জম্বুবন যেন এই শব্দের অট্টরোলে আলোড়িত হইয়া উঠিল। দুই ভগিনী ভয় পাইয়া পরস্পর জড়াইয়া ধরিলেন। মনে হইল, সর্বনাশ হইয়াছে, সকলে জানিতে পারিয়াছে; তাঁহারা ধরা পড়িয়া গিয়াছেন।
শব্দ যতটা ভয়ঙ্কর মনে হইয়াছিল প্রকৃতপক্ষে ততটা ভয়ঙ্কর নয়। রাত্রির প্রথম প্রহর শেষ হইয়া দ্বিতীয় প্রহর আরম্ভ হইয়াছে, ঘটিকাশালার প্রহরীরা তাহাই ঘোষণা করিতেছে। প্রথম ভয়বিহ্বলতা কাটিয়া যাইবার পর দুইজনে তাহা বুঝিতে পারিলেন। সঙ্গে সঙ্গে ইহাও বুঝিতে পারিলেন যে, শিবির-প্রহরী রক্ষীরা যতই ঘুমাক, জম্বুবনের কিনারে সীমান্ত রক্ষীরা সতর্কভাবে জাগিয়া আছে।
দুইজনে আবার চলিলেন। কোন্ দিকে চলিয়াছেন তাহা জানেন না, কেবল প্রদীপশিখাকে পশ্চাতে রাখিয়া চলিয়াছেন। একবার ভাঙ্গা গাছের ডাল তাঁহাদের পথরোধ করিল; তাহাকে এড়াইয়া বীরশ্রী একবার পিছন ফিরিয়া তাকাইলেন। আলোকরশ্মি দেখা যায় কি যায় না।
আরও কিছুদূর চলিবার পর তাঁহারা হঠাৎ শক্ত হইয়া দাঁড়াইয়া পড়িলেন। সম্মুখে ও কী? অন্ধকারের মধ্যে আরও গাঢ় অন্ধকারের পিণ্ড যেন তাল পাকাইতেছে। সঙ্গে ফোঁস ফোঁস শব্দ; যেন কাহারা সমবেতভাবে নিশ্বাস ফেলিতেছে। একটা দীর্ঘ কালো হাত আসিয়া লঘুভাবে তাঁহাদের মস্তক স্পর্শ করিল।
যৌবনশ্রী বলিলেন— ‘দিদি! হাতি!’
দুই ভগিনী ঊর্ধ্বশ্বাসে পলায়ন করিলেন। অন্ধকারে অপরিচিত হস্তীর মত ভয়াবহ জীব আর নাই। বনের এক স্থানে সমস্ত রণহস্তী বাঁধা ছিল, বীরশ্রী ও যৌবনশ্রী একেবারে তাহাদের দঙ্গলের মধ্যে গিয়া পড়িয়াছিলেন।
হাত ধরাধরি করিয়া ছুটিতে ছুটিতে তাঁহারা বার কয়েক হোঁচট খাইয়া পড়িয়া গেলেন; বসন ছিঁড়িয়া গেল, পায়ে কাঁটা ফুটিল। তারপর সহসা এক সময় আছাড় খাইয়া উঠিয়া তাঁহারা অনুভব করিলেন, অন্ধকার যেন একটু তরল হইয়াছে। তাঁহারা চারিদিকে চাহিলেন, তারপর ঊর্ধ্বে চক্ষু তুলিয়া দেখিলেন আকাশে তারা মিটমিট করিতেছে। তাঁহারা জম্বুবনের বাহিরে আসিয়াছেন।
যাক, জম্বুবনের দুর্ভেদ্য গোলকধাঁধা হইতে নির্গত হইয়াছেন। কিন্তু কোন্ দিকে? সম্মুখদিকে না পশ্চাদ্দিকে? নক্ষত্রের আলোকে যতটুকু অনুভব করা যায়, তাহা নিতান্তই সীমাবদ্ধ; প্রান্তরের এখানে ওখানে দুই চারিটা আগাছার গুল্ম রহিয়াছে; একটা কণ্টকগুল্ম অসংখ্য খদ্যোতিকার জ্যোতিরলঙ্কার পরিয়া ঝলমল করিতেছে। কিন্তু প্রান্তরের পরপারে শালবন আছে কিনা তাহা জানিবার উপায় নাই।
তবু জম্বুবনের প্রহরীচক্র যে তাঁহারা নিরাপদে পার হইয়া আসিয়াছেন ইহাই যথেষ্ট। এখন জম্বুবনকে পশ্চাতে রাখিয়া যত দূর যাওয়া যায় ততই মঙ্গল।
দুই বোন আবার চলিতে লাগিলেন। জম্বুবনে বেশি কাঁটা ছিল না, এখানে দুই পা চলিলেই পায়ে কাঁটা ফোটে। কিছুদূর চলিয়া উভয়ে মাটিতে বসিলেন, অনুভবের দ্বারা পায়ের কাঁটা তুলিয়া ফেলিতে লাগিলেন। একটি দীর্ঘকম্পিত নিশ্বাস যৌবনশ্রীর বুক হইতে উচ্ছ্বসিত হইয়া উঠিল।
বীরশ্রী বলিলেন— ‘নিশ্বাস ফেলেছিস কেন রে যৌবনা?’
যৌবনশ্রী বলিলেন— ‘আমার জন্য তুই কত কষ্ট পেলি তাই ভেবে কান্না পাচ্ছে।’
বীরশ্রী বলিলেন— ‘আমার কষ্টের কথাই ভাবছিস! তোর নিজের?’
যৌবনশ্রী বলিলেন— ‘আমার আবার কষ্ট কি! আমি আমার স্বামীর কাছে যাচ্ছি। দরকার হলে আগুনের ওপর দিয়ে হেঁটে যেতে পারি।’
যৌবনশ্রীর এই স্বভাব-বিরুদ্ধ প্রগল্ভতাটুকু বীরশ্রীর বড় মিষ্ট লাগিল। তিনি হাসিলেন— ‘আমিও আমার স্বামীর কাছে যাচ্ছি। নে ওঠ্। শিবিরে গিয়ে প্রথমেই বিগ্রহকে বলবি পায়ের কাঁটা তুলে দিতে।’
দুইজনে উঠিয়া দাঁড়াইলেন। যৌবনশ্রী বলিলেন— ‘কিন্তু শিবির কোথায়?’
প্রশ্ন অনুত্তর রহিয়া গেল। এই সময় হঠাৎ সন্নিকট হইতে একপাল অদৃশ্য শৃগাল হুক্কাহুয়া করিয়া ডাকিয়া উঠিল। দুইজনে থপ্ করিয়া বসিয়া পড়িলেন।
শৃগালের হট্টকোলাহল থামিলে বীরশ্রী বলিলেন— ‘তোর প্রেমের পথে যে এত কাঁটা তা কে জানত! শেষ পর্যন্ত শিয়ালকাঁটা। দেখছি আজ রাত্রিটা এই মাঠেই কাটাতে হবে। নইলে হয়তো পথ ভুলে আবার জম্বুবনেই ফিরে যাব। দিগ্ভ্রম হয়েছে। ভোরের আলো ফুটলে তখন—’
‘কিন্তু—’
ভোরের আলো ফোটা পর্যন্ত মাঠে বসিয়া থাকার বিপদ আছে তাহা বীরশ্রীও জানিতেন। ভোর হইলে কেবল তাঁহারাই চক্ষু পাইবেন তা নয়, জম্বুবনের প্রহরীরাও চক্ষু পাইবে। তখন—
সমস্যার সমাধান আসিল বিচিত্ররূপ ধরিয়া। নিশীথ রাত্রির নিস্তরঙ্গ বাতাসে দূর হইতে ভাসিয়া আসিল অতি মধুর বাঁশির সুর। বীরশ্রী বিদ্যুৎস্পৃষ্টের ন্যায় শিহরিয়া যৌবনশ্রীর হাত চাপিয়া ধরিলেন— ‘ঐ শোন যৌবনা! শুনতে পাচ্ছিস?’
যৌবনশ্রী উদ্বেলিত হৃদয়ে বলিলেন— ‘পাচ্ছি। বাঁশির শব্দ। কে— কে বাজাচ্ছে দিদি!’
বীরশ্রী ভগিনীকে হাত ধরিয়া তুলিলেন, গাঢ়স্বরে বলিলেন— ‘আর কে বাজাবে? ও বাঁশিতে ও সুর আর কে বাজাতে পারে? আয়— দিশা পেয়েছি।’
দুই ভগিনী বাঁশির স্বর লক্ষ্য করিয়া হরিণীর মত ছুটিয়া চলিলেন। পায়ে কাঁটা ফুটিতে লাগিল কিন্তু কেহই তাহা অনুভব করিলেন না। —
শালবনের সম্মুখে দাঁড়াইয়া জাতবর্মা বাঁশি বাজাইতেছিলেন, পাশে দাঁড়াইয়া ছিলেন বিগ্রহপাল।
‘আমরা এসেছি’ — নারীকণ্ঠের রুদ্ধশ্বাস স্বর।
‘বীরা!’ দুইজনে সম্মুখে ছুটিয়া গেলেন।
‘যৌবনাকে এনেছি।’
নক্ষত্রসূচীবিদ্ধ অন্ধকারে চারিজন মুখোমুখি হইলেন।
‘যৌবনশ্রী! যৌবনা!’
যৌবনশ্রী মুখে একটি অব্যক্ত শব্দ করিলেন, তারপর সংজ্ঞা হারাইয়া ধীরে ধীরে মাটিতে লুটাইয়া পড়িবার উপক্রম করিলেন।
অল্পক্ষণ পরে শালবনের ভিতর হইতে রণডঙ্কার বিজয়োদ্ধত উল্লাস একবার দ্রুতছন্দে মন্দ্রিত হইয়াই নীরব হইল। মাঠের পরপারে জম্বুবনের একটি দীপহীন শিবিরে এক রোগপঙ্গু বৃদ্ধা সেই শব্দ শুনিতে পাইলেন।
পাঁচ
রাত্রিশেষে মহারাজ লক্ষ্মীকর্ণ স্বপ্ন দেখিলেন। মুক্ত কৃপাণ হস্তে তিনি রণাঙ্গনের মধ্যস্থলে দাঁড়াইয়া আছেন। সম্মুখে অগণিত শত্রুসৈন্য, রথ অশ্ব গজ পদাতিক; রণবাদ্য বাজিতেছে। মহারাজ শক্রকে আক্রমণ করিবার পূর্বে একবার পশ্চাতে ও পার্শ্বে দৃষ্টি ফিরাইলেন। দেখিলেন, কেহ নাই, তিনি একাকী। তাঁহার সৈন্যদল সমস্ত শত্রুপক্ষে যোগ দিয়াছে।
মহারাজের ঘুম ভাঙ্গিয়া গেল। শিবিরের বাহিরে পূর্বকাশে তখন ঊষার অলক্ত-রাগ ফুটিয়া উঠিয়াছে। ঘুমন্ত বনভূমি জাগিতে আরম্ভ করিয়াছে; গাছের ডালে পাখি, গাছের তলে মানুষ হাতি ঘোড়া।
মহারাজ লক্ষ্মীকর্ণ শয্যায় উঠিয়া কিছুক্ষণ জড়বৎ বসিয়া রহিলেন। ক্রমে তাঁহার স্বপ্নের ঘোর কাটিয়া গেল। মিথ্যা স্বপ্ন, অর্থহীন স্বপ্ন। তিনি গদার ন্যায় বাহুদ্বয় আস্ফালনপূর্বক আলস্য ত্যাগ করিলেন, তারপর হুঙ্কার ছাড়িয়া শয্যা হইতে অবতরণ করিলেন। আজ যুদ্ধ!
কয়েকজন পরিজন ছুটিয়া আসিল। মহারাজের আজ্ঞায় ঢক্কা তূরী ভেরী শৃঙ্গ পটহ বাজিয়া উঠিল। যে সকল সৈনিক বৃক্ষতলে পড়িয়া ঘুমাইতেছিল তাহারা চক্ষু মর্দন করিয়া উঠিয়া বসিল। আজ যুদ্ধ!
যৌবনশ্রীর শিবিরে রঙ্গিণীর নিদ্রাভঙ্গ হইল। সে ঘাড় তুলিয়া দেখিল যৌবনশ্রীর শয্যা শূন্য। …এরূপ ঘটনা পূর্বে কখনও ঘটে নাই। কোথায় গেলেন রাজকুমারী? রঙ্গিণীর মনে পড়িল, কাল রাত্রে দুই ভগিনী শয্যায় শুইয়া জল্পনা করিতেছিলেন, রঙ্গিণী শুনিতে শুনিতে ঘুমাইয়া পড়িয়াছিল। তারপর— তারপর— কোথায় গেলেন দুই রাজকুমারী? তবে কি— তবে কি—? রঙ্গিণীর হাত-পা হিম হইয়া গেল। যদি তাই হয়, মহারাজ জানিতে পারিলে কি করিবেন? রঙ্গিণী আবার চোখ বুজিয়া মাটিতে শুইয়া পড়িল।
রাজা যৌবনশ্রীর অন্তর্ধানের কথা জানিতে পারিলেন না। কন্যার কথা চিন্তা করিবার সময় তাঁহার ছিল না, তিনি যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হইতেছিলেন। যুদ্ধ! যুদ্ধ! সৈন্যগণ প্রস্তুত হইলেই যুদ্ধ আরম্ভ হইবে।
সূর্যোদয় হইল।
দুই সৈন্যদল অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত হইয়া প্রান্তরের দুই প্রান্তে সারি দিয়া দাঁড়াইয়াছে। নববল খেলায় যেরূপ বলবিন্যাস হয়, যুদ্ধক্ষেত্রের বলবিন্যাসও সেইরূপ। সম্মুখে পদাতিক সৈন্যের পঙ্ক্তি, তাহার পশ্চাতে রথ অশ্ব গজের শ্রেণী। শ্রেণীর মধ্যস্থলে রাজার রথ।
দুই পক্ষে বিপুল বাদ্যোদ্যম আরম্ভ হইয়াছে। আকাশবিদারী শব্দে চতুরঙ্গ সৈন্যের ধমনীতে রক্ত-স্রোত উষ্ণ হইয়া উঠিতেছে।
মহারাজ লক্ষ্মীকর্ণের রথ সৈন্যব্যূহের মাঝখান হইতে বাহির হইয়া ধীরগমনে সম্মুখ দিকে চলিল। ইহা যুদ্ধারম্ভের সঙ্কেত। সৈন্যদল জয়ধ্বনি করিয়া রাজরথের পশ্চাতে অগ্রসর হইল।
প্রায় সঙ্গে সঙ্গে মাঠের অপর প্রান্তে একটি রথ বাহির হইয়া আসিল। এতদূর হইতে রথের আরোহীকে দেখা যায় না। দুই সৈন্যদল পদভরে মেদিনী দলিত করিয়া পরস্পর নিকটবর্তী হইতে লাগিল।
মহারাজ লক্ষ্মীকর্ণ সারথিকে জিজ্ঞাসা করিলেন— ‘সম্পৎ, কার রথ চিনতে পারছিস?’
সম্পৎ কিছুক্ষণ উত্তর দিল না। দুইটি রথ সৈন্যদল পশ্চাতে লইয়া আরও নিকটবর্তী হইল। মহারাজ কোষ হইতে আসি নিষ্কাশিত করিলেন।
দুই রথ যখন তিন রজ্জু দূরে তখন সম্পৎ হঠাৎ বলিল— ‘আয়ুষ্মন্, ও রথ চালাচ্ছেন কুমারী যৌবনশ্রী!’
‘কী! যৌবনশ্রী!’ মহারাজ হতভম্ব হইয়া চাহিলেন। হাঁ, যৌবনশ্রীই বটে। রথ চালাইতেছে সারথি-বেশিনী যৌবনশ্রী, আর রথের রখী— বিগ্রহপাল!
মহারাজ লক্ষ্মীকর্ণ ক্ষণেকের জন্য দারুব্রহ্মের ন্যায় রথে বসিয়া রহিলেন। তাঁহার মস্তিষ্কের মধ্যে কোন্ চিন্তার ক্রিয়া হইল তাহা নির্ণয় করা দুরূহ। বীরশ্রী এইজন্য আসিয়াছিল তাহা বুঝিতে তিলার্ধ বিলম্ব হইল না। স্বপ্নের কথাও মনে পড়িল। বীরশ্রী যৌবনশ্রী জাতবর্মা ছাড়িয়া গিয়াছে, যাহারা আছে তাহারাও ছাড়িয়া যাইবে?
অতঃপর মহারাজ লক্ষ্মীকর্ণের মনে যে প্রতিক্রিয়া হইল তাহা অদ্ভুত। কুটিল মন স্বভাবতই বক্র পথে চলে; বিশেষত মহারাজ লক্ষ্মীকর্ণের মন শুধু কুটিল নয়, অত্যন্ত জটিল। তিনি এক অভাবনীয় কার্য্য করিলেন।
‘থামা থামা! রথ থামা!’
সম্পৎ রথ থামাইল। পশ্চাতে সৈন্যদল গতি রুদ্ধ করিয়া দাঁড়াইল। মহারাজ লক্ষ্মীকর্ণ এক লাফে রথ হইতে নামিলেন। হাতের তরবারি দূরে ফেলিয়া উন্মত্ত দৈত্যের মত বিগ্রহপালের রথের প্রতি ধাবিত হইলেন।
বিগ্রহপালের রথও থামিয়া গিয়াছিল, তাঁহার পিছনে সৈন্যদলও থামিয়াছিল। গগনভেদী বাদ্যোদ্যম স্তব্ধ হইয়াছিল। যুদ্ধারম্ভে এরূপ অচিন্তনীয় ব্যাপার পূর্বে কখনও ঘটে নাই। দুই পক্ষের সৈন্যদল মার্গাচলরুদ্ধ স্রোতস্বিনীর মত ন যযৌ ন তস্থৌ হইয়া রহিল।
মহারাজ লক্ষ্মীকর্ণ যদি আসি ফেলিয়া না দিতেন তাহা হইলে তাঁহার কার্যের একটা অর্থ পাওয়া যাইত। কিন্তু এ কি! এরূপ আত্মঘাতী কার্য উন্মাদ ভিন্ন আর কে করিতে পারে! তবে কি লক্ষ্মীকর্ণ সত্যই উন্মাদ হইয়া গিয়াছেন?
বিগ্রহপাল ব্যাপার দেখিয়া নিজ রথ হইতে অবতরণ করিলেন। লক্ষ্মীকর্ণের অভিপ্রায় কি তাহা জানা নাই; কিন্তু তিনি অস্ত্রত্যাগ করিয়াছেন, সুতরাং বিগ্রহপালও অস্ত্রত্যাগ করিয়া দাঁড়াইলেন। তাহা দেখিয়া যৌবনশ্রী ছুটিয়া আসিয়া স্বামীর সম্মুখে দাঁড়াইলেন, যেন নিজ দেহ দিয়া স্বামীর দেহ রক্ষা করিবেন। বিগ্রহপাল তাঁহাকে সম্মুখ হইতে অপসারিত করিবার চেষ্টা করিলেন, কিন্তু যৌবনশ্রী অটল রহিলেন। তাঁহার চক্ষে জল অধরোষ্ঠে কঠিন দৃঢ়তা। যদি মরিতেই হয় দুইজনে একসঙ্গে মরিবেন।
উন্মত্ত দৈত্য আসিয়া পড়িল। তারপর মুহূর্তমধ্যে অদ্ভুত ব্যাপার ঘটিল। মহারাজ লক্ষ্মীকর্ণ কন্যা ও জামাতাকে দুইটি মার্জার শাবকের মত অবহেলে তুলিয়া নিজের দুই স্কন্ধে স্থাপন করিলেন এবং উদ্দাম তাণ্ডব নাচিতে শুরু করিলেন। তাঁহার কণ্ঠ হইতে মেঘগর্জনের ন্যায় শব্দ বাহির হইতে লাগিল— ‘ধন্য! ধন্য! ধন্য! আমার কন্যা! আমার জামাতা! ধন্য! ধন্য! ধন্য!’
যুদ্ধ হইল না; রক্তপাত হইল না; রণক্ষেত্র কোন্ মায়াবীর মন্ত্রবলে উৎসব ক্ষেত্রে পরিণত হইল। যে সৈন্যদল পরস্পর হানাহানি করিতে উদ্যত হইয়াছিল। তাহারা আনন্দে বিহ্বল হইয়া পরস্পর আলিঙ্গন করিল, হাত ধরাধরি করিয়া নৃত্য করিতে লাগিল। উগ্র রণবাদ্য পলিকে পারুষ্য ত্যাগ করিয়া ডিমি ডিমি ডিমি আনন্দধ্বনি করিয়া উঠিল। প্রলয়ঙ্কর মহাকাল আর এক বুড়ার কাণ্ড দেখিয়া সহাস্য শিবসুন্দর মূর্তি ধারণ করিলেন।
জাতবর্মা বীরশ্রী অনঙ্গপাল বান্ধুলি সকলে ছুটিয়া আসিয়া নৃত্যপরায়ণ লক্ষ্মীকর্ণকে ঘিরিয়া ধরিলেন। ক্রমে মহারাজ নৃত্য সম্বরণ করিয়া যৌবনশ্রী ও বিগ্রহপালকে স্কন্ধ হইতে নামাইয়া দিলেন, তারপর বিপুল বাহু দিয়া সকলকে আলিঙ্গন করিয়া ধরিলেন। বলিলেন— ‘তোরা সবাই মিলে বুড়োকে ঠকিয়েছিস। কেউ মুক্তি পাবি না। চল ত্রিপুরীতে। সেখানে গিয়ে যৌবনার বিয়ে দেব। আমার বুড়ি মা কোথায়? তাঁকেও কি তোরা চুরি করে এনেছিস নাকি?’
সকলের চক্ষে আনন্দাশ্রু বহিল।
আলিঙ্গন-চক্রের কিনারা হইতে জ্যোতিষাচার্য রন্তিদেব বলিলেন— ‘মহারাজ, আমার গণনা ফলেছে কিনা!’
মহারাজ রন্তিদেবকে শিখা ধরিয়া কাছে টানিয়া আনিলেন, বলিলেন— ‘পণ্ডিত, আজ থেকে তুমি আমার সভাজ্যোতিষী।’
ছয়
সেদিন ভারতের নাট্যমঞ্চে যে কৌতুকনাট্যের অভিনয় হইয়াছিল, যে নটনটীরা অভিনয় করিয়াছিল, তাহারা সন্ধ্যার রাঙা মেঘের মত শূন্যে মিলাইয়া গিয়াছে। কোথায় যৌবনশ্রী, কোথায় বিগ্রহপাল? সেদিন ধীরে ধীরে নাট্যমঞ্চের উপর মহাকালের কৃষ্ণ যবনিকা নামিয়া আসিয়াছিল, প্রদীপ নিভিয়া গিয়াছিল।
তারপর রঙ্গমঞ্চ যুগান্তকাল ধরিয়া তিমিরাবৃত ছিল। নৃত্য গীত হাস্য কৌতুক মূক হইয়া গিয়াছিল। মানুষ চামচিকার মত অন্ধকারে বাঁচিয়া ছিল।
নয়শত বর্ষ পরে আবার সেই রঙ্গমঞ্চে একটি একটি করিয়া দীপ জ্বলিয়া উঠিতেছে, কালের কৃষ্ণ যবনিকা সরিয়া যাইতেছে। এবার এই পুরাতন রঙ্গমঞ্চে জানি না কোন্ মহা নাটকের অভিনয় হইবে!
* স্তনৌ সুকঠিনৌ যস্যা নিতম্বে চ বিশালতা।
মধ্যে ক্ষীণা ভবেদ যা সা নাগ্রোধপরিমণ্ডলা।।
সমাপ্ত