অষ্টম পরিচ্ছেদ – এক
স্বয়ংবরে আমন্ত্রিত রাজারা লক্ষ্মীকর্ণকে গালি দিতে দিতে স্বরাজ্যে ফিরিয়া গিয়াছেন। ত্রিপুরী নগরীতে বহু জন সমাগমে যে সংখ্যাস্ফীতি ঘটিয়াছিল তাহ আবার সহজ অবস্থায় ফিরিয়া আসিয়াছে। নগরীর ব্যবসায়ী ও বিলাসিনীরা দুঃখিত, শান্তিপ্রিয় গৃহস্থেরা আনন্দিত। জল্পকেরা স্বয়ংবর সম্পর্কে নানা সম্ভব অসম্ভব কাহিনী পরস্পরকে শুনাইতেছে এবং শুনিতেছে। মোটের উপর নগরীর অবস্থা স্বাভাবিক।
রাজভবনের অবস্থা কিন্তু মোটেই স্বাভাবিক নয়। রাজমাতা অম্বিকা দেবী নিজ শয্যায় অনড় হইয়া পড়িয়া আছেন; আগে দুই একটি কথা বলিতেন এখন তাহাও বলেন না, কেবল দুঃস্বপ্নভরা চক্ষু মেলিয়া চাহিয়া থাকেন। গভীর রাত্রে প্রদীপের আলোকে তাঁহার মুখ দেখিয়া মনে হয় তিনি উৎকর্ণ হইয়া চঞ্চলা রাজলক্ষ্মীর ক্রম-বিলীয়মান পদধ্বনি শুনিতেছেন।
প্রাসাদের অন্যত্র যৌবনশ্রী নিজ কক্ষে অবরুদ্ধা আছেন। দ্বারে রঙ্গিণী প্রহরিণী। একাকিনী রাজকন্যা, দিন কাটে তো রাত কাটে না। তিনি বেণী খুলিয়া আবার বয়ন করেন; আবার খোলেন, আবার বয়ন করেন। পাচিকা অন্ন রাখিয়া যায়, কখনও আহারে বসেন, কখনও বসেন না। কক্ষে কালিদাসের কয়েকটি পুঁথি আছে, তাহাই খুলিয়া নাড়াচাড়া করেন। মেঘদূতের দুই চারিটি শ্লোক পড়েন, রঘুবংশের অজবিলাপ পড়েন, কুমারসম্ভবের রতিবিলাপ পড়িতে পড়িতে সহসা পুঁথি বন্ধ করিয়া শয্যায় শয়ন করেন। চক্ষু মুদিয়া শয্যায় পড়িয়া থাকেন। বাতায়নের বাহিরে বপ্পীহ পাখিটা আম্রকানন হইতে বুক-ফটা স্বরে ডাকে— পিয়া পিয়া পিয়া!
মহারাজ লক্ষ্মীকর্ণের মানসিক অবস্থা বোধ করি সর্বাপেক্ষা মর্মান্তিক। যত দিন যাইতেছে অপমান ও লাঞ্ছনার শেল ততই গভীরভাবে তাঁহার মর্মে প্রবেশ করিতেছে। মন্ত্রীরা তাঁহাকে ধীরভাবে বিবেচনা করিয়া কাজ করিতে অনুরোধ করিতেছেন, কিন্তু বিশেষ ফল হইতেছে না। তিনি পণ করিয়াছেন মগধের কুক্কুরবংশকে নির্বংশ করবেন, পালবংশে বাতি দিতে কাহাকেও রাখিবেন না। মন্ত্রণাসভায় এইরূপ আস্ফালন করিতে করিতে হঠাৎ ছুটিয়া গিয়া তিনি দেখিয়া আসিতেছেন, মেয়েটা পলাইয়াছে কিনা। যদিও রাজপুরী ঘিরিয়া কঠিন প্রহরা বসিয়াছে, প্রহরীদের চক্ষু এড়াইয়া একটি ইন্দুরেরও বাহির হইবার উপায় নাই, তবু মহারাজ নিজ চক্ষে না দেখিয়া নিশ্চিন্ত হইতে পারিতেছেন না।
মন্ত্রীরা তাঁহাকে বুঝাইতেছেন, মগধের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করিতে হইলে পরিপূর্ণরূপে সুসজ্জিত ও সুরক্ষিত হইয়া যুদ্ধযাত্রা করা উচিত। স্বয়ংবর সংক্রান্ত ব্যয়বাহুল্যের ফলে রাজকোষের অবস্থা ভাল নয়; এক্ষেত্রে একা যুদ্ধযাত্রা না করিয়া যদি কোনও মিত্র রাজাকে সহযাত্রী রূপে পাওয়া যায় তাহা হইলে সব দিক দিয়া মঙ্গল। সম্প্রতি মগধের বিরুদ্ধে একাকী যুদ্ধযাত্রা করিয়া যে ব্যাপার ঘটিয়াছে তাহার পুনরভিনয় বাঞ্ছনীয় নয়।
মহারাজ লক্ষ্মীকর্ণের ওইখানেই সবচেয়ে বেশি ব্যথা। তিনি ক্রোধে লাফাইতে লাগিলেন। গড্ডলচূড়ামণি নয়পাল যুদ্ধের জানে কি? দীপঙ্কর ও তাহার পিশাচগুলা না থাকিলে তিনি দেখিয়া লইতেন! এখন দীপঙ্কর তিব্বতে গিয়াছে, তাহার পিশাচগুলাও সুতরাং নিস্তেজ হইয়া পড়িয়াছে, এইবার তিনি দেখিয়া লইবেন। নয়পালকে ধরিয়া খন্ড খন্ড করিয়া কাটিবেন, তারপর কাক-শকুন ডাকিয়া তাহাদের ভূরিভোজন করাইবেন।
যা হোক, শেষ অবধি মন্ত্রিগণ রাজাকে রাজী করাইলেন, কর্ণাটকুমার বিক্রমাদিত্যকে পত্র পাঠানো হইবে। পত্র এইরূপ—
স্বস্তি শ্রীমন্মহাপরাক্রম কর্ণাটযুবরাজ পরমভট্টারক শ্রীবিক্রমাদিত্য সমীপে চেদীশ্বর শ্রীলক্ষ্মীকর্ণদেবের সাদর সংবোধন। অতঃপর স্বয়ংবর সভায় অধম গুপ্তশত্রুর দ্বারা আমি কিভাবে অপমানিত হইয়াছি তাহা আপনি প্রত্যক্ষ করিয়াছেন। কেবল আমি নয়, সমগ্র রাজকুল অপমানিত হইয়াছেন। আপনার ন্যায় বীরকেশরী অপমানিত হইয়াছেন। সিংহের গ্রাস যদি শৃগালের দ্বারা উচ্ছিষ্ট হয় তবে কি সিংহ তাহা সহ্য করে? কদাপি নয়।
আমি প্রস্তাব করিতেছি, আসুন, আপনি এবং আমি সম্মিলিত হইয়া মগধ আক্রমণ করি। নষ্টবুদ্ধি নয়পালকে রাজ্যচ্যুত করিয়া তাহার রাজ্য উভয়ে ভাগ করিয়া লইব। আপনি পুরুষসিংহ, অপমানের প্রতিশোধ লইতে এবং ক্ষত্রোচিত ধর্মযুদ্ধের সুযোগ লইতে কখনও বিরত হইবেন না। অলমিতি।
পত্রের উত্তর আসিতে বিলম্ব হইল না। বিক্রম লিখিলেন— নরপুঙ্গব চেদিরাজ, আপনি নিতান্তই বালকোচিত পত্র লিখিয়াছেন। যুদ্ধ করিয়া আমার কেশ শুক্ল হইয়াছে, কৈতববাদে আর্দ্র হইয়া যুদ্ধে লিপ্ত হইবার বয়স আমার নাই। আপনি যদি অপমানিত হইয়া থাকেন সেজন্য দোষ সম্পূর্ণ আপনার; মগধের যুবরাজকে মর্কটবৃত্তি অবলম্বন করিতে আপনিই শিখাইয়াছেন। অনুরক্তা কন্যার জন্য স্বয়ংবর সভা আহ্বান করা অতীব গর্হিত কার্য; আপনি স্বয়ংবর সভা আহ্বান করিয়া আমাদের সকলকে অপমান করিয়াছেন। মগধরাজ বা মগধের যুবরাজের প্রতি আমার ক্রোধ নাই; তাহারা আমার কোনও অনিষ্ট করে নাই। আমি কিজন্য মগধের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করিব? বরং আপনার বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করিলে অন্যায় হইত না। কিন্তু আপনি নিজ নির্বুদ্ধিতার জন্য সমুচিত দণ্ডিত হইয়াছেন, আপনাকে আর অধিক দণ্ড দিতে চাহি না।
আপনি যুদ্ধযাত্রা করিবার জন্য বড়ই ব্যস্ত হইয়াছেন। শ্রবণ করুন। — আর্যাবর্তের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে বর্বর ম্লেচ্ছ জাতি বারবার উপদ্রব করিতেছে। বহু আর্য রাজার রাজ্য তাহারা কাড়িয়া লইয়াছে; তাহারা নারীহরণ করিতেছে, মন্দির দূষিত করিতেছে। আসুন, যদি যুদ্ধ করিবার সাধ থাকে, আমার নেতৃত্বে যুদ্ধযাত্রা করুন; আপনি আমার সঙ্গে যোগ দিলে অন্য রাজারাও যোগ দিবেন। বর্বর বিজাতীয়দের অচিরাৎ হিমালয়ের পরপারে খেদাইয়া দিতে পারিব। আসুন, আর্তত্রাণরূপ ক্ষত্রিয়ধর্ম পালন করিয়া যশস্বী হোন। অলমিতি।
পত্র পাইয়া মহারাজ লেলিহ শিখায় জ্বলিতেছিলেন, এমন সময় আসিল মগধের দূত। অগ্নি দাবানলে পরিণত হইল।
মন্ত্রীদের মধ্যস্থতায় দূতের প্রাণটা বাঁচিয়া গেল। মহারাজ বজ্রকণ্ঠে মগধের বিরুদ্ধে যুদ্ধঘোষণা করিয়া দূতকে বিদায় করিলেন। এবার আর ছয় হাজার সৈন্য নয়, বিশ হাজার সৈন্য লইয়া তিনি যাইবেন; রক্তস্রোতে পৃথিবী প্লাবিত করিবেন। প্রথমে নয়পালের কাটা-মুণ্ড হাতে লইয়া তাণ্ডব নাচিবেন, তারপর কর্ণাটের ওই অথর্ব জরদ্গবটাকে মজা দেখাইবেন। এতবড় স্পর্ধা! আমাকে তাহার অধীনে যুদ্ধ করিতে ডাকে। তিনটা যুদ্ধ জিতিয়া এত দর্প! ভারতবর্ষের উত্তর-পশ্চিমে সহস্র যোজন দূরে বর্বর হানা দিয়াছে তাহাতে আমার কি? আমি কেন বর্বরদের সঙ্গে যুদ্ধ করিতে যাইব?
মন্ত্রিগণ রাজার মানসিক অবস্থা বুঝিয়া আর উচ্চবাচ্য করিলেন না। রণসজ্জা আরম্ভ হইল। সঙ্গে সঙ্গে মহারাজের অবর্তমানে কে শূন্যপাল হইয়া থাকিবে, কিভাবে মন্ত্রীরা রাজ্য পরিচালনা করিবেন, রাজকোষ পূর্ণ করিবার জন্য কিরূপ কর ধার্য করিতে হইবে তাহার আলোচনা হইতে লাগিল।
একদিন মহারাজ লক্ষ্মীকর্ণ অবরোধ পরিদর্শনে গিয়াছেন। কন্যা যথাস্থানে আছে দেখিয়া তাঁহার ইচ্ছা হইল মাতৃদেবীকেও একবার দর্শন করেন। ইচ্ছাটা মাতৃভক্তি প্রণোদিত নয়; মাতৃদেবীকে একটি বিশেষ সংবাদ শুনাইয়া তাঁহার মর্মপীড়া ঘটানোই প্রধান উদ্দেশ্য।
মাতৃদেবী তাঁহাকে দেখিয়া প্রীতা হইলেন না, কেবল একটি ভ্রূ তুলিয়া প্রশ্ন করিলেন। মহারাজ বলিলেন — ‘আমি মগধ জয় করতে যাচ্ছি বোধহয় শুনেছেন। এবার কুকুর দুটাকে গলায় শিকল দিয়ে বেঁধে আনব, তারপর নর্মদার জলে চুবিয়ে মারব।’
অম্বিকা বললেন— ‘তোর মতিচ্ছন্ন হয়েছে। প্রজাদের ওপর নূতন কর বসিয়েছিস। তুই যুদ্ধে গেলেই প্রজারা ডিম্ব করবে।’
লক্ষ্মীকর্ণ বলিলেন— ‘ডিম্বের ব্যবস্থা আগে থেকেই করে রেখেছি। আপনি যে আমার বিরুদ্ধে আবার ষড়যন্ত্র করে প্রজাদের ক্ষেপিয়ে তুলবেন তা হতে দেব না। আপনাকে এবং যৌবনশ্রীকে আমার সঙ্গে যুদ্ধে নিয়ে যাব।’
জননীর মুখে নিরাশার ব্যঞ্জনা দেখিয়া মহারাজ অতিশয় হৃষ্ট হইলেন এবং হাসিতে হাসিতে প্রস্থান করিলেন।
দুই
অম্বিকা দেবীর মস্তিষ্কের অর্ধাংশ রোগে অকর্মণ্য হইয়া পড়িলেও চিন্তা করিবার শক্তি যথেষ্ট পরিমাণে ছিল। তিনি দুই দিন ধরিয়া একাগ্রভাবে চিন্তা করিলেন। হঠাৎ মনে পড়িয়া গেল, বিগ্রহপাল ত্রিপুরীতে আসিয়া জ্যোতিষী রন্তিদেবের গৃহে লুকাইয়া ছিল। তিনি পথ দেখিতে পাইলেন। মনে মনে প্রবন্ধ স্থির করিয়া পুত্রকে ডাকিয়া পাঠাইলেন।
লক্ষ্মীকর্ণ ভাবিলেন মাতৃদেবী যুদ্ধে যাওয়ার নামে ভয় পাইয়াছেন, স্তুতিমিনতি কান্নাকাটি করিয়া গৃহে থাকিবার অনুমতি ভিক্ষা করিবেন। তিনি প্রফুল্ল মনে মাতৃসকাশে চলিলেন।
অম্বিকা কিন্তু কান্নাকাটি করিলেন না, বলিলেন— ‘জ্যোতিষীকে পাঠিয়ে দে। কবে মরব জানতে চাই।’
লক্ষ্মীকর্ণ একটু বিমূঢ় হইলেন। অবশ্য মাতার মৃত্যুকাল জানিতে তাঁহার আপত্তি ছিল না; কিন্তু একটা অসুবিধা ছিল। মগধ হইতে ভ্রষ্ট-অভিযানের পর ফিরিয়া আসিয়া তিনি সভাজ্যোতিষীকে তাড়াইয়া দিয়াছিলেন। যাহার কথায় যুদ্ধযাত্রা করিয়া এমন দুর্দশা হয় তাহাকে সভাপণ্ডিত করিয়া রাখার কোনও অর্থ হয় না। কিন্তু তাহার পরিবর্তে অন্য পণ্ডিত নিয়োগ করাও ঘটিয়া উঠে নাই। তেমন ত্রিকালীদর্শী পণ্ডিতই বা কোথায়? সব পিণ্ডভোজী ভণ্ড!
লক্ষ্মীকর্ণ বলিলেন— ‘আমার সভাপণ্ডিত নেই, তাকে দূর করে দিয়েছি।’
অম্বিকা বলিলেন— ‘সভাজ্যোতিষী চাই না। তোর সভাজ্যোতিষীর জ্ঞানবুদ্ধি তোরই মত। রন্তিদেবকে ডেকে পাঠা।’
রন্তিদেব! রন্তিদেবের কথা লক্ষ্মীকর্ণের মনে ছিল না। লোকটা স্পষ্টবাদী বটে, কিন্তু পাণ্ডিত্য আছে। সে একবার বলিয়াছিল, মাতার আয়ু যতদিন লক্ষ্মীকর্ণেরও ততদিন। ‘আচ্ছা দেখি’ বলিয়া ভাবিতে ভাবিতে তিনি ফিরিয়া গেলেন। রন্তিদেব যে আকণ্ঠ তাঁহার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত আছেন তাহা লক্ষ্মীকর্ণ জানিতে পারেন নাই।
রন্তিদেব সেদিন মধ্যাহ্ন ভোজনের পর বিশ্রামের উদ্যোগ করিতেছিলেন এমন সময় রাজার আহ্বান আসিল। রন্তিদেব শঙ্কিত হইলেন। পাষণ্ড জানিতে পারিয়াছে নাকি? অবশ্য জ্যোতিষ গণনা অনুসারে রন্তিদেবের সময় এখন ভালই যাইতেছে। তবু কিছুই বলা যায় না; জন্ম মৃত্যু বিবাহ বলিতে পারে না বরাহ। তিনি ইষ্টনাম স্মরণ করিয়া বাহির হইলেন। সহধর্মিণীকে বলিয়া গেলেন— ‘যদি না ফিরি, পুত্রকন্যার হাত ধরে পাটলিপুত্রে যেও, সেখানে আমার ভাই আছে।’
লক্ষ্মীকর্ণ রন্তিদেবকে ভদ্রভাবেই সম্ভাষণ করিলেন। বলিলেন— ‘আমি যুদ্ধযাত্রার সংকল্প করেছি। গণনা করে দেখুন ফলাফল ভাল হবে কিনা।’
ভয়ের কোনও কারণ নাই দেখিয়া রন্তিদেব নিশ্চিন্ত হইলেন। বলিলেন— ‘এটা যুদ্ধযাত্রার সময় নয়, তবে জ্যেষ্ঠা-মূলীয়া যাত্রা হতে পারে। দেখি।’
তিনি খড়ি পাতিলেন, অনেকক্ষণ ধরিয়া বিচার করিলেন। আজ আর কোনও প্রকার চাতুরী অবলম্বন করিলেন না। বলিলেন— ‘নরপাল, গণনায় বড় বিচিত্র ফল পাচ্ছি। আপনার এই যুদ্ধযাত্রার জয় কিম্বা পরাজয় কিছুই হবে না।’
লক্ষ্মীকর্ণ ভ্রূ বাঁকাইয়া বলিলেন— ‘তা কি করে সম্ভব? যুদ্ধে জয় পরাজয় আছেই।’
রন্তিদেব কহিলেন— ‘কি করে সম্ভব তা জানি না মহারাজ। গণনায় যা পেলাম তাই বলছি।’
মহারাজ খুব তুষ্ট হইলেন না, কিয়ৎকাল ভ্রূবদ্ধ-ললাটে থাকিয়া বলিলেন— ‘পরাজয় হবে না?’
‘না মহারাজ।’
‘প্রাণের আশঙ্কা নেই?’
‘না মহারাজ।’
‘ভাল। যদি আপনার গণনা সত্য হয়, অভিযান থেকে ফিরে এসে আপনাকে সভাজ্যোতিষী নিয়োগ করব।’
রন্তিদেব অত্যধিক আনন্দ প্রকাশ করিলেন না, শুধু বলিলেন— ‘মহারাজের অনুগ্রহ।’
লক্ষ্মীকর্ণ পণ্ডিতকে দক্ষিণা দিয়া বিদায় করিতেছিলেন, অম্বিকা দেবীর কথা মনে পড়ায় বলিলেন— ‘মাতৃদেবী আপনাকে স্মরণ করেছেন। তাঁর মৃত্যুকাল জানতে চান।’
‘ভাল মহারাজ।’
এক কিঙ্করী রন্তিদেবকে লইয়া অম্বিকা দেবীর কক্ষে উপনীত করিল। অম্বিকা চোখের ইঙ্গিতে কিঙ্করী এবং সেবিকাদের বিদায় করিলেন, তারপর রন্তিদেবকে শয্যার পাশে বসিতে আদেশ করিলেন। রন্তিদেব উপবিষ্ট হইয়া সসম্ভ্রমে বলিলেন— ‘দেবি, আপনার কোষ্ঠী গণনা—’
অম্বিকা বলিলেন— ‘কোষ্ঠী গণনার জন্য তোমাকে ডাকিনি। কাছে এসে আমার কথা শোনো। — বিগ্রহপাল ত্রিপুরীতে এসে তোমার গৃহে ছিল। তুমি সবই জানো?’
রন্তিদেব তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে বৃদ্ধাকে নিরীক্ষণ করিয়া সতর্কভাবে ঘাড় নাড়িলেন। বৃদ্ধা বলিলেন— ‘এখন মন দিয়ে আমার কথা শোনো। লক্ষ্মীকর্ণ যৌবনশ্রীকে ঘরে বন্ধ করে রেখেছে। কিন্তু সে শীঘ্রই মগধের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করবে, তখন যৌবনশ্রীকে এবং আমাকে সঙ্গে নিয়ে যাবে। আমাদের চোখের আড়াল করতে চায় না। এই সংবাদ বিগ্রহপালকে জানানো প্রয়োজন। তুমি যত শীঘ্র সম্ভব পাটলিপুত্রে যাও। সেখানে গিয়ে বিগ্রহপালকে সব কথা বলবে। বলবে, লক্ষ্মীকর্ণ যখন আমাদের নিয়ে মগধে উপস্থিত হবে তখন যেন কৌশলে যৌবনশ্রীকে হরণ করে নিয়ে যায়। আমি যত প্রকারে সম্ভব সাহায্য করব।’
রন্তিদেব উদ্দীপ্ত হইয়া উঠিলেন। এই জাতীয় কার্য তাঁহার অত্যন্ত রুচিকর। তিনি নিজের ইষ্টানিষ্ট চিন্তা করিলেন না, মহোৎসাহে বলিলেন— ‘দেবি, আমি অবিলম্বে পাটলিপুত্র যাত্রা করব। অনেক দিন স্বদেশে যাইনি। আর কিছু আজ্ঞা আছে কি?’
অম্বিকা একটু চিন্তা করিয়া বলিলেন— ‘আমার বড় নাতনী বংগাল দেশের রাজপুত্রবধূ—’
‘জানি দেবি।’
‘সে বড় চতুরা। তাকেও সংবাদটা দিতে পারলে ভাল হয়।’
‘দেব। পাটলিপুত্র থেকে আমি স্বয়ং বংগাল দেশে যাব। বীরশ্রীকে নিজমুখে সব কথা বলব।’
‘ভাল। তোমার পাথেয় এবং পুরস্কার—’
‘দেবি, আপনার দর্শন পেলাম— এই আমার পাথেয় এবং পুরস্কার।’
রাজপুরী হইতে বাহির হইবার পথে রন্তিদেব আবার মহারাজের সাক্ষাৎ পাইলেন। মহারাজ জিজ্ঞাসা করিলেন— ‘মাতৃদেবীর আয়ু আর কতদিন?’
রন্তিদেব সহাস্যে বলিলেন— ‘আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন, আর্যা এখনও দীর্ঘকাল বাঁচবেন।’
তিনদিনের মধ্যে রন্তিদেব স্ত্রীপুত্রকন্যা লইয়া নৌকাযোগে যাত্রা করিলেন। বন্ধু ভৃত্য যজমানদের বলিয়া গেলেন তীর্থযাত্রায় চলিয়াছেন; কাশী প্রয়াগ প্রভৃতি দর্শন করিয়া দুই চারি মাসের মধ্যে ফিরিবেন। সঞ্চিত নিধি যাহা ছিল সব সঙ্গে লইলেন। মন একটু বিষণ্ণ হইল। সংসার অনিত্য, আবার ফিরিতে পরিবেন কিনা কে জানে?
তিন
ত্রিপুরীতে রণসজ্জা পূর্ণোদ্যমে চলিয়াছে।
রাজার যে স্থায়ী সেনাদল আছে তাহা যথেষ্ট নয়। তাই রাজ্যের সর্বত্র রাজপুরুষেরা গিয়া সৈন্য সংগ্রহ করিতেছে। নবাগত সৈনিকেরা রণাভ্যাস করিতেছে, ধনুর্বাণ আসি ভল্ল চালাইতে শিখিতেছে। নবাগতদের মধ্যে যাহারা যোগ্যতর তাহারা নায়ক পত্তিনায়কের পদ পাইতেছে। মাঠে মাঠে রণাঙ্গন। কড়্ কড়্ শব্দে রণভেরী বাজিতেছে, শৃঙ্গ তূরী করতাল বাজিতেছে। সেই তুমুল শব্দ-সংঘট্টে সৈনিকদের রক্ত নাচিয়া উঠিতেছে। হুলস্থূল কাণ্ড।
কেবল সৈন্য সংগ্রহ নয়; সেই সঙ্গে অস্ত্র সংগ্রহ, খাদ্য সংগ্রহ, বাহন সংগ্রহ। চতুরঙ্গ সেনা, হস্তী অশ্ব রথ পদাতি। তাহার উপযোগী খাদ্য চাই, খাদ্য বহনের জন্য যানবাহন চাই। অসংখ্য অনুচর— পাচক, বৈদ্য, গুপ্তচর, পথনির্দেশক, হস্তীপক, অশ্বপাল, গণক, গণিকা। উপরন্তু রাজমাতা ও রাজকন্যা সঙ্গে যাইতেছেন, তাহাদের জন্য স্বতন্ত্র অবরোধ, স্বতন্ত্র দাসী কিঙ্করী সেবিকা। রাজ্যের রাজপুরুষগণ নানা প্রকার ব্যবস্থা লইয়া গলদ্ঘর্ম হইতেছেন। সময় বড় বেশি নাই, জ্যেষ্ঠা-মূলীয়া তিথি অগ্রসর হইয়া আসিতেছে।
প্রজারা, বিশেষত নগরবাসী প্রজারা, নূতন করবৃদ্ধির জন্য প্রথমে অসন্তুষ্ট হইয়াছিল। কিন্তু রণসজ্জা যেমন বৃদ্ধি পাইতে লাগিল তাহারাও অসন্তোষ ভুলিয়া যাইতে লাগিল। রণোদ্যমের একটা প্রবল উন্মাদনা আছে; রণবাদ্য, শ্রেণীবদ্ধ সেনার সদর্প পদপাত, অস্ত্রের ঝনঝনা, অশ্বের হ্রেষা, হস্তীর বৃংহণ, সকল মিলিয়া অসামরিক মানুষকেও রণমত্ত করিয়া তোলে, যুদ্ধটা ন্যায়যুদ্ধ কি অন্যায় যুদ্ধ সে বিচার আর থাকে না।
একদিন অশ্ব-ব্যাপৃতকের অধীন এক সেনানী মহারাজের সহিত সাক্ষাৎ করিলেন, বলিলেন— ‘আয়ুষ্মন্, ঘোড়া কিছু কম পড়ছে। তিন হাজার ঘোড়া সংগ্রহ হয়েছে। আরও চার পাঁচশত প্রয়োজন।’
মহারাজ বলিলেন— ‘যখন প্রয়োজন তখন সংগ্রহ কর।’
সেনানী বলিলেন— ‘যুদ্ধের উপযোগী ঘোড়া আর পাওয়া যাচ্ছে না। দেশান্তরে পাঠিয়েও সংগ্রহ করা গেল না।’
মহারাজ বলিলেন— ‘কি আশ্চর্য, কোনও দেশে ঘোড়া নেই!’
সেনানী বলিলেন— ‘দূর দেশে লোক পাঠালে সংগ্রহ করা যায়। কিন্তু তাতে বিলম্ব হবে। জ্যৈষ্ঠ মাস আগতপ্রায়, জ্যেষ্ঠা-মূলীয়া তিথিতে যাত্রা করতে হলে আর সময় নেই।’
মহারাজ বলিলেন— ‘তোমরা অপদার্থ। যেখান থেকে পার সংগ্রহ কর।’
সেনানী ক্ষণেক নীরব থাকিয়া বলিলেন— ‘এখানে এক ম্লেচ্ছ অশ্ব-বণিক কিছুদিন থেকে রয়েছে, তার আগড়ে তিন চার শত ঘোড়া আছে। উৎকৃষ্ট ঘোড়া, কিন্তু বড় বেশি মূল্য চাইছে। কোষাধ্যক্ষ বলছেন, অত মূল্য দিয়ে ঘোড়া কেনা যেতে পারে না।’
লক্ষ্মীকর্ণ চক্ষু ঘূর্ণিত করিয়া বলিলেন— ‘বেশি মূল্য চাইছে! কত মূল্য চায়?’
‘প্রত্যেক ঘোড়ার জন্য আট স্বর্ণ-দীনার।’
মহারাজ লাফাইয়া উঠিলেন— ‘আট দীনার! একটা ঘোড়ার মূল্য আট দীনার! চোর! তস্কর। আট দীনারে আটটা ঘোড়া পাওয়া যায়। যাও তুমি, সৈন্য নিয়ে এখনি সমস্ত ঘোড়া কেড়ে নিয়ে এস।’
সেনানী ইতস্তত করিয়া বলিলেন— ‘কত মূল্য দেওয়া হবে?’
রাজা বলিলেন— ‘দেব না মূল্য। এক কপর্দক মূল্য দেব না।’
সেনানী আরও কুণ্ঠিত হইয়া বলিলেন— ‘কিন্তু আয়ুষ্মন্, বিদেশী বণিকের পণ্য হরণ করলে নিন্দা হবে। ভবিষ্যতে কোনও বিদেশী বণিক এ রাজ্যে আসবে না।’
রাজা গর্জন করিলেন— ‘না আসুক। ম্লেচ্ছ বণিকের এত স্পর্ধা সে আমার রাজ্যে বাণিজ্য করবে। আবার আমাকেই ঠকাবে! যাও, তার সর্বস্ব কেড়ে নিয়ে এস। শুধু ঘোড়া নয়, ধনরত্ন যা পাবে সব হরণ করে আনবে।’
সেনানী আর দ্বিরুক্তি না করিয়া প্রস্থান করিলেন।
সেদিন অপরাহ্ণে একদল সৈন্য গিয়া ম্লেচ্ছ বণিকের আস্তানায় হানা দিল। তাহাদের উদ্দেশ্য জানিতে পারিয়া বণিক নীরব রহিল, এতগুলা সশস্ত্র সৈনিকের বিরুদ্ধে তাহারা কয়জন কী করিতে পারে? কেবল তাঁহাদের চক্ষু দিয়া অসহায় ক্রোধের স্ফুলিঙ্গ বাহির হইতে লাগিল।
সৈন্যগণ অশ্ব ও ধনরত্ন লইয়া প্রস্থান করিলে বণিক কিছুক্ষণ শূন্য আগড়ের দিকে চাহিয়া কঠিন-দেহে দাঁড়াইয়া রহিল। ক্রমে সূর্য মাঠের পরপারে দিগন্তরেখা স্পর্শ করিল। বণিক তখন একজন সহচরকে ইঙ্গিত করিল, সহচর কয়েকটি পট্টিকা আনিয়া মুক্ত স্থানে পাতিয়া দিল। তারপর সকলে পট্টিকার উপর পশ্চিমাস্য দাঁড়াইয়া তাহাদের পুষ্প-নৈবেদ্যহীন অনাড়ম্বর উপাসনা আরম্ভ করিল।
লক্ষ্মীকর্ণ বিনা শুল্কে ঘোড়া পাইয়া হৃষ্ট হইলেন। তিনি জানিতেন না যে এ সংসারে বিনা শুল্কে কিছুই পাওয়া যায় না, মহাকালের অক্ষপটল পুস্তিকায় কালির আঁচড় পড়িয়াছে।
চার
রন্তিদেব পাটলিপুত্রে উপনীত হইয়া দেখিলেন সেখানেও সাজ সাজ রব। তিনি ভ্রাতা যোগদেবের গৃহে পরিবার রাখিয়া রাজভবনে চলিলেন।
রাজভবনের বাতাস কিছু উত্তপ্ত। একে তো যুদ্ধের উত্তেজনা, উপরন্তু ত্রিপুরী হইতে দূত ফিরিয়া আসিয়া নয়পালের নিকট লক্ষ্মীকর্ণের যুদ্ধঘোষণাকালীন কটুবাক্যগুলি নিবেদন করিয়াছে। মহারাজ অসুস্থ দেহে চটিয়া আগুন হইয়া আছেন।
বিগ্রহপালের সহিত রন্তিদেবের সাক্ষাৎ হইলে বিগ্রহ ছুটিয়া আসিয়া তাঁহার পদধূলি লইলেন, প্রশ্নোৎফুল্ল নেত্রে বলিলেন— ‘আর্য, আপনি! কোনও সংবাদ আছে নকি?’
রন্তিদেব বলিলেন— ‘আছে। গ্রহ অনুকূল। চল, নিভৃত স্থানে বসা যাক।’
এই সময় অনঙ্গ আসিয়া উপস্থিত হইল। সে দিবাকালে অধিকাংশ সময় রাজপুরীতেই কাটায়, বিগ্রহের সঙ্গ ছাড়ে না। রাত্রিকালে বিগ্রহ জোর করিয়া তাহাকে গৃহে পঠাইয়া দেন, বলেন— ‘তুই মহাপাষণ্ড, সারাদিন বান্ধুলিকে একলা ঘরে ফেলে চলে আসিস। বান্ধুলি হয়তো ভাবে, আমিই তোকে আট্কে রাখি। কাল থেকে তুই আর এখানে আসবি না। এখানে তোর এত কি কাজ?’ অনঙ্গ হাসিয়া চলিয়া যায়, পরদিন আবার আসে। সে বিগ্রহপালের চরিত্রের দুর্বলতা জানে, অতি অল্প কারণে তিনি হতাশ্বাস হইয়া পড়েন; তাই সে সর্বদা তাঁহার সঙ্গে থাকে।
অনঙ্গকে দেখিয়া রন্তিদেব আহ্লাদিত হইলেন। তিনজনে রাজপুরীর এক নিভৃত বিশ্রামকক্ষে গিয়া দ্বার রুদ্ধ করিয়া বসিলেন।
রন্তিদেবের মুখে সংবাদ শুনিয়া বিগ্রহপাল উদ্দীপ্ত হইয়া উঠিলেন, অনঙ্গও উল্লসিত হইল। তিনজনে মিলিয়া মন্ত্রণা হইল। মহারাজকে বা অন্য কাহাকেও এখন একথা বলিবার প্রয়োজন নাই; মহারাজের শরীর ভাল নয়, এ সময় তাঁহার চিত্ত বহু চিন্তায় ভারাক্রান্ত করা অনুচিত। যাহা করিবার তাঁহারা তিনজনে করিবেন। লক্ষ্মীকর্ণদেবের গুপ্তচরেরা নিশ্চয় পাটলিপুত্রে ঘুরিয়া বেড়াইতেছে, কোনও প্রকারে মন্ত্রভেদ ঘটিলে সব ভ্রষ্ট হইয়া যাইতে পারে।
রন্তিদেব বলিলেন— ‘আর একটা কথা। অম্বিকা দেবীর আজ্ঞা, বীরশ্রীকেও সংবাদ দিতে হবে।’
বিগ্রহপাল অনঙ্গের ঊরুদেশে চপেটাঘাত করিয়া বলিলেন— ‘ঠিক কথা। অনঙ্গ, দিদিকে সংবাদ দিতে হবে! কিন্তু কে যাবে দিদিকে সংবাদ দিতে? অচেনা কেউ গেলে চলবে না। অনঙ্গ, তুই—’
রন্তিদেব বলিলেন— ‘আমি বিক্রমণিপুর যাবার জন্য প্রস্তুত হয়ে এসেছি। বীরশ্রী আমাকে চেনে, কোনও অসুবিধা হবে না।’
বিগ্রহপাল বিগলিত হইয়া বলিলেন— ‘আপনি যাবেন! ধন্য! আর্য, আমাদের জন্য আপনাকে কত ক্লেশ স্বীকার করতে হচ্ছে—’
রন্তিদেব বলিলেন— ‘কুমার, এতেই আমার আনন্দ। তুমি আমার যাত্রার ব্যবস্থা কর।’
বিগ্রহ বলিলেন— ‘যাত্রার ব্যবস্থাপক তো আপনার ঘরেই রয়েছেন। আর্য যোগদেব সব ব্যবস্থা করে দেবেন।’
অতঃপর সভা ভঙ্গ হইল। পরদিন পূর্বাহ্ণে রন্তিদেব নৌকায় চড়িয়া বংগাল যাত্রা করিলেন। যে নৌকায় বিগ্রহপাল ত্রিপুরী গিয়াছিলেন সেই নৌকা। দিশারুও সেই গরুড়।
যাত্রার পূর্বে বিগ্রহপাল রন্তিদেবের হাতে একটি লিপি দিয়া বলিলেন— ‘এই পত্রখানি দেবী বীরশ্রীকে দেবেন।’
পাটলিপুত্র হইতে জাতবর্মা ও বীরশ্রী যথাকালে বিক্রমণিপুর পৌঁছিয়াছিলেন।
জাতবর্মা পিতাকে সমস্ত সমাচার জানাইয়া নয়পালের পত্র তাঁহাকে দিলেন। মহারাজ বজ্রবর্মা স্থিরবুদ্ধি রাজনীতিজ্ঞ ব্যক্তি; তিনি একদিকে যেমন পরিতোষ লাভ করিলেন, অন্যদিকে তেমনি উদ্বিগ্ন হইলেন। নয়পালের সহিত এতদিন তাঁহার রাজনৈতিক যোগাযোগ ছিল না, এখন যদি মৈত্রীবন্ধন স্থাপিত হয় তাহা অতীব সুখের কথা; কিন্তু লক্ষ্মীকর্ণদেব কুটুম্ব, তাঁহার সহিত প্রকাশ্য বিরোধও বাঞ্ছনীয় নয়। একদিকে পর আপন হইতেছে, অপরদিকে আপন পর হইয়া যাইতেছে। জীবনে নিত্যই এই ব্যাপার ঘটে। কিন্তু মিত্রের সংখ্যা যত বৃদ্ধি পায় ততই মঙ্গল। লক্ষ্মীকর্ণটা মহা দুষ্ট, স্বয়ংবর সভায় এ কী করিয়া বসিল! কিন্তু তবু সে কুটুম্ব; যতই দুর্ব্যবহার করুক এক কথায় তাহাকে ত্যাগ করা যায় না। অথচ নয়পাল প্রকৃত সজ্জন, তাঁহার মিত্রতার প্রস্তাব উপেক্ষা করিলে নিজেরই অনিষ্ট—
বজ্রবর্মা সহসা মনঃস্থির করিতে পারিলেন না, কিংকর্তব্য চিন্তা করিতে করিতে কয়েকদিন কাটিয়া গেল।
এই সময় হঠাৎ রন্তিদেব আসিয়া উপস্থিত হইলেন। জাতবর্মা তাঁহাকে চিনিতেন না, পরিচয় শুনিয়া বীরশ্রীর কাছে সংবাদ পাঠাইলেন। বীরশ্রী আসিয়া গ্রহাচার্যকে প্রণাম করিলেন।
রন্তিদেব তখন তাঁহার আগমনের রহস্য ভেদ করিলেন। বিগ্রহপালের পত্রও বীরশ্রীকে দিলেন। বীরশ্রী পাঠ করিয়া পত্র জাতবর্মাকে দিলেন। পত্রে লেখা ছিল—
ভ্রাতৃজায়া দেবী বীরশ্রী ও অগ্রজ শ্রীজাতবর্মার চরণাম্বুজে হতভাগ্য বিগ্রহপালের শতকোটি বিনতি। দিদি, তোমরা চলিয়া গিয়া অবধি পাটলিপুত্র শূন্য হইয়া গিয়াছে। অধিক কি লিখিব, আমার হৃদয়ের বেদনা তোমরা অবগত আছ। যৌবনশ্রীকে যদি না পাই এ জীবন রাখিব না, আগামী যুদ্ধে প্রাণ বিসর্জন দিব। আর্য রন্তিদেবের মুখে নূতন সংবাদ শুনিও। একটু আশার আলো দেখা দিয়াছে। কিন্তু তুমি না থাকিলে কে বুদ্ধি দিবে? কে নিয়ন্ত্রিত করিবে? যদি ভাগ্যহত দেবরের প্রতি তিলমাত্র করুণা থাকে, পতিদেবতাকে লইয়া নিজ গৃহ পাটলিপুত্রে চলিয়া আসিও। পিতৃদেব অসুস্থ, যুদ্ধের আয়োজন চলিতেছে। অলমিতি।
সপ্তাহকাল পরে পাঁচখানি রণতরী সাজাইয়া জাতবর্মা পাটলিপুত্র অভিমুখে যাত্রা করিলেন। সঙ্গে বীরশ্রী ও রন্তিদেব। স্থলপথে একশত রণহস্তী চলিয়াছে। মহারাজ বজ্রবর্মা কর্তব্য স্থির করিয়া নয়পালকে পত্র দিয়াছেন—
…কুমার জাতবর্মাকে আমার প্রতিভূস্বরূপ যুদ্ধে যোগ দিবার জন্য পাঠাইলাম। আমার একশত রণহস্তী আপনার পক্ষে যুদ্ধ করিবে। ধর্মের জয় হোক।
পাঁচ
জ্যৈষ্ঠ মাসের নির্দিষ্ট তিথিতে মহারাজ লক্ষ্মীকর্ণ চতুরঙ্গ সেনা সাজাইয়া যুদ্ধযাত্রা করিলেন। সৈন্যদলের মাঝখানে অন্তঃপুর, ব্যূহের মধ্যে ব্যূহ। রাজমাতা অম্বিকা ও রাজকুমারী যৌবনশ্রী আন্দোলিকায় চলিয়াছেন। দুইটি স্বতন্ত্র আন্দোলিকা, সূক্ষ্ম পট্টাবরণ দ্বারা বেষ্টিত। অম্বিকা নিজ আন্দোলিকায় শয়ান রহিয়াছেন, দুই পাশে দুই উপস্থায়িকা। যৌবনশ্রী নিজ আন্দোলিকায় একাকিনী আছেন; তপঃকৃশা অপর্ণার ন্যায় মূর্তি, যেন পঞ্চাগ্নি তপস্যা করিয়া শরীর কৃশ হইয়াছে; তবু রূপের অবধি নাই। রঙ্গিণী ও দাসী কিঙ্করীরা পশ্চাতে কেহ শিবিকায় কেহ গো-রথে চলিয়াছে।
শঙ্খধ্বনি তূর্যধ্বনি করিয়া ডঙ্কা বাজাইয়া বিপুল বাহিনী মহাস্থানীয় হইতে নির্গত হইল। সর্পিল গতিতে মেখল পর্বতের পৃষ্ঠে আরোহণ করিয়া শোণ নদের উৎস পরিক্রমণ করিয়া নদের পূর্বপারে পৌঁছিল, তারপর তীর ধরিয়া ঈশান কোণ অভিমুখে চলিল। ওইদিকে মগধ।
রাজ্যের মহামন্ত্রী ত্রিপুরীতে শূন্যপাল হইয়া রহিলেন। তাঁহার অধীনে কর্মসচিব হইয়া রহিল লম্বোদর। লম্বোদর অনুচ্চপদস্থ গুপ্তচর, এ পদ তাহার প্রাপ্য নয়; কিন্তু সে যৌবনশ্রীর পলায়নে বাধা দিয়া রাজার প্রিয়পাত্র হইয়াছিল, এ পদ তাঁহারই পুরস্কার। উপরন্তু মহামন্ত্রী মহাশয়ের মনে যদি পাপ থাকে, লম্বোদর তাঁহার উপর দৃষ্টি রাখিতে পারিবে। চক্রের ভিতর চক্র। —
পাটলিপুত্রেও রণসজ্জা সম্পূর্ণ হইয়াছে। জাতবর্মা বীরশ্রী ও শত হস্তী উপস্থিত। গুপ্তচরেরা প্রত্যহ আসিয়া ত্রিপুরীর সংবাদ দিতেছে। লক্ষ্মীকর্ণ শোণ নদকে পাশ কাটাইয়া পূর্বতটে উপস্থিত হইয়াছেন এবং শনৈঃ শনৈঃ অগ্রসর হইতেছেন। তিনি মগধের সীমান্তে পদার্পণ করিবার পূর্বেই তাঁহার পথরোধ করিতে হইবে।
যুদ্ধের উদ্যোগ আয়োজনের মধ্যে যৌবনশ্রীকে উদ্ধার করিবার পরামর্শ চলিতেছে। মন্ত্রণাচক্রে আছেন বীরশ্রী জাতবর্মা বিগ্রহপাল অনঙ্গ ও রন্তিদেব। বহু আলোচনার পর পরামর্শ স্থির হইয়াছে। দুই সৈন্যদল যখন পরস্পরের সম্মুখীন হইবে তখন বীরশ্রী মাতামহীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করিতে যাইবেন। রন্তিদেবের বড়ই ইচ্ছা ছিল তিনি সন্ন্যাসী সাজিয়া শত্রুব্যূহে প্রবেশ করেন কিন্তু তাঁহার প্রস্তাব এক কথায় অগ্রাহ্য হইয়া গিয়াছে। বীরশ্রী বলিয়াছেন— ‘আপনি যদি ধরা পড়েন পিতৃদেব আপনার মুণ্ডটি কেটে নেবেন, কিন্তু আমার উপর যত রাগই হোক মুণ্ড কাটবেন না।’ অগত্যা রন্তিদেব রাজবৈদ্যের নিকট হইতে একটি অতি দুষ্প্রাপ্য চৈনিক ঔষধ সংগ্রহ করিয়াছেন। এই ঔষধের নাম অহিফেন। ইহা বিষও বটে রসায়নও বটে; অধিক সেবন করিলে মৃত্যু, কিন্তু অল্প সেবন করিলে অনিদ্রার মহৌষধ। এই পরম বস্তুটি যৌবনশ্রীর উদ্ধার কার্যে বিশেষ প্রয়োজনীয়।
তারপর একদিন যুদ্ধযাত্রার কাল উপস্থিত হইল। মহারাজ নয়পাল আপনি বিশ্রামকক্ষে যুদ্ধগামীদের ডাকিয়া পাঠাইলেন। নয়পালের বাসনা ছিল তিনি স্বয়ং সৈন্যদলের নায়কত্ব গ্রহণ করিয়া যুদ্ধে যাইবেন, কিন্তু তাঁহার স্বাস্থ্যের প্রতি দৃষ্টি রাখিয়া মহারানী তাঁহাকে যাইতে দেন নাই, রাজবৈদ্যও ঘন ঘন মাথা নাড়িয়া আপত্তি করিয়াছেন। মহারাজের কক্ষে বিগ্রহপাল জাতবর্মা অনঙ্গ ও প্রধান প্রধান সেনানায়কগণ সমবেত হইলে নয়পাল বলিলেন— ‘আমি অসমর্থ, তাই যুবরাজ বিগ্রহপালকে সেনাপতিত্বে বরণ করলাম।’ বিগ্রহপালের ললাটে তিলক পরাইয়া দিয়া পুনশ্চ বলিলেন— ‘বৎস, তোমাকে উপদেশ আর কী দেব? তুমি বয়ঃপ্রাপ্ত, বুদ্ধিমান, বীর; বীরকুলে তোমার জন্ম। তোমার সঙ্গে রইলেন অগ্রজপ্রতিম কুমার জাতবর্মা আর রণপণ্ডিত সেনানীগণ; এঁদের সঙ্গে পরামর্শ করে সব কাজ করবে। যাও, শত্রু দলন করে ফিরে এস। ভগবান সিদ্ধার্থ তোমার মনোরথ সিদ্ধ করুন।’
নয়পাল পুত্রকে আলিঙ্গন করিলেন, বিগ্রহ পিতার পদধূলি মস্তকে লইলেন। তারপর নয়পাল অন্য সকলকে আলিঙ্গন করিয়া সাশ্রুনেত্রে বিদায় দিলেন। বিদায়কালে জাতবর্মার হাত ধরিয়া জনান্তিকে বলিলেন— ‘তোমরা ভিতরে ভিতরে একটা ষড়যন্ত্র করছ আমি বুঝতে পেরেছি। কী ষড়যন্ত্র আমি জানতে চাই না। তুমি বিগ্রহকে দেখো। আর স্মরণ রেখো, আমার পুত্রবধূ যৌবনশ্রীর মুখ না দেখা পর্যন্ত আমার প্রাণে আনন্দ নেই।’
জাতবর্মা তাঁহার পদধূলি লইয়া বলিলেন— ‘স্মরণ রাখব মহারাজ, আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন।’
তারপর জাতবর্মা বিগ্রহ ও অনঙ্গপাল মহারানীর নিকট গেলেন। বীরশ্রী ও বান্ধুলি সেখানে উপস্থিত। সকলে মহারানীর আশীর্বাদ গ্রহণ করিলেন। মহারানী দরবিগলিত নেত্রে সকলের শিরশ্চুম্বন করিয়া রণমঙ্গল কামনা করিলেন।
দ্বিপ্রহরে মগধের সৈন্যদল শঙ্খধ্বনি তূর্যধ্বনি করিয়া ডঙ্কা বাজাইয়া বাহির হইল। সেনাদলের মধ্যস্থলে পুষ্পমাল্যভূষিত একটি রথ, রথের চুড়ায় রক্তবর্ণ কেতন উড়িতেছে। রথ চালাইতেছেন বীরশ্রী, তাঁহার পাশে উপবিষ্টা বান্ধুলি। দিদিরানী যুদ্ধে যাইতেছেন, তাই বান্ধুলিকেও ধরিয়া রাখা যায় নাই; সে না থাকিলে দিদিরানীর পর্ণসম্পূট বহন করিবে কে? রথের দুইপাশে বিগ্রহপাল ও জাতবর্মা অশ্বপৃষ্ঠে চলিয়াছেন, রথের পিছনে অনঙ্গ।
এ যেন যুদ্ধযাত্রা নয়, অপূর্ব শোভাযাত্রা।