পঞ্চম পরিচ্ছেদ – এক
রাজারা আসিতে আরম্ভ করিয়াছেন। রেবার তীরে মেঘপুঞ্জবৎ পট্টবাসগুলি পূর্ণ হইয়া উঠিতেছে। কোনও রাজার সঙ্গে সহস্র পরিজন, কোনও রাজার সঙ্গে দুই সহস্র; অরক্ষিত অবস্থায় কেহ আসেন নাই। পরিজন যাহারা আসিয়াছে তাহাদের মনোভাব বরযাত্রীর মত; দেহে নবীন বস্ত্র, নূতন মণ্ডন। তাহারা গুম্ফ শাণিত করিয়া নগরে ঘুরিয়া বেড়াইতেছে, মোণ্ডা মিঠাই খাইতেছে, তালকী মাধুক ইক্ষুরস পান করিতেছে, মদবিহ্বলা নগরকামিনীদের সঙ্গে শ্লেষযুক্ত রসিকতা করিতেছে। গীত বাদ্য হট্টগোল; নগরে হুলস্থূল পড়িয়া গিয়াছে।
ভারতবর্ষে স্বাধীন নরপতি সামন্ত মাণ্ডলিক প্রভৃতি মিলিয়া অনেক রাজা; মিত্র রাজারা সকলেই আমন্ত্রিত হইয়াছিলেন। ছোট রাজারা একটু আগে ভাগেই আসিতে আরম্ভ করিয়াছেন। তন্মধ্যে উত্তর-পশ্চিম হইতে আসিয়াছেন মৎস্যরাজ, দক্ষিণ হইতে ভোজরাজ। কলিঙ্গ হইতে সভারূঢ় হইতে আসিয়াছেন দুই রাজপুত্র। দুই চারিজন সামন্ত অন্তপাল উপস্থিত হইয়াছেন। বরমাল্য লাভ যদি নাও ঘটে সেই সূত্রে আমোদপ্রমোদ দেশভ্রমণ বহ্বাড়ম্বর তো হইবে। রাজাদের জীবনে মৃগয়া দ্যূত এবং গ্রামধর্ম পালন ব্যতীত বৈচিত্র্যের অবকাশ কোথায়?
যা হোক, লক্ষ্মীকর্ণের পক্ষ হইতে সকলকেই আদর আপ্যায়ন করা হইতেছে। রাজপুরুষেরা অতিথিদের খাদ্য পানীয় এবং মন যোগাইতে গলদ্ঘর্ম হইতেছেন। সেই সঙ্গে গুপ্তচরেরা আনাচে কানাচে ঘুরিয়া বেড়াইতেছে; কোন্ রাজার মনে কিরূপ দুর্বুদ্ধি আছে তাহা লক্ষ্য করিতেছে। মহারাজ লক্ষ্মীকর্ণ নিপুণ সারথির মত রশ্মি ধরিয়া সকলকে পরিচালিত করিতেছেন।
কেবল একটি বিষয়ে মহারাজ লক্ষ্মীকর্ণের মনে সুখ নাই। স্বয়ংবর সভায় যে বিরাট প্রহসন রচনা করিয়া সারা ভারতবর্ষে অট্টহাস্যের ঢক্কানিনাদ তুলিবেন মনস্থ করিয়াছিলেন তাহা মনের মত হইতেছে না। শিল্পীটা অভিপ্রেত মূর্তি গড়িতে পারিতেছে না।
গুপ্ত মন্ত্রগৃহে লক্ষ্মীকর্ণ শিল্পীকে ডাকিয়া ধমক দিতেছেন। প্রাতঃকালে গুপ্তকক্ষে অন্য কেহ। নাই, কেবল এক কোণে লম্বোদর অদৃশ্য হইয়া বসিয়া আছে। সে মহারাজের কর্ণে দৈনিক সংবাদ নিবেদন করিতে আসিয়াছে।
মহারাজ শিল্পীকে বলিলেন— ‘তুমি অপদার্থ।’
শিল্পী জোড়হস্তে বলিল— ‘মহারাজ, যাকে কখনও চোখে দেখিনি তার মূর্তি আমি কী করে গড়ব? সাধ্যমত চেষ্টা করছি, পঞ্চাশটা মুখ গড়েছি—’
মহারাজ বলিলেন— ‘কিছুই হয়নি, কেবল পণ্ডশ্রম। যাও, আবার চেষ্টা কর।’
অসহায় শিল্পী প্রস্থান করিলে অন্ধকার কোণ হইতে লম্বোদর মৃদু গলা ঝাড়া দিয়া বলিল— ‘আয়ুষ্মন্—’
লক্ষ্মীকর্ণের ইঙ্গিত পাইয়া সে গুটি গুটি কাছে আসিয়া যুক্তকরে বসিল, কোনও প্রকার ভণিতা না করিয়া বলিল— ‘আমার গৃহে যে অতিথিটা রয়েছে সে মূর্তি গড়তে জানে।’
লক্ষ্মীকর্ণ বিরক্তস্বরে বলিলেন— ‘মূর্তি গড়তে জানে এমন লোক অনেক আছে।’
লম্বোদর কহিল— ‘এ পাটলিপুত্রের লোক, হয়তো মগধের যুবরাজকে দেখেছে।’
লক্ষ্মীকর্ণ কিছুক্ষণ লম্বোদরের মুখের পানে প্রখরচক্ষে চাহিয়া রহিলেন, তাহার কথার মর্মার্থ বুঝিতে তাঁহার বিলম্ব হইল না। তিনি কতকটা নিজ মনেই বলিলেন— ‘বটে। তাহলে হয়তো—। লম্বোদর, তুমি চেষ্টা কর। যদি সে পারে, তাকে আমার কাছে নিয়ে এস। এখনও দশদিন সময় আছে।’
লম্বোদর ঘরে ফিরিয়া চলিল। মধুকর যে ভাল মূর্তি গড়িতে পারে তাহা সে নিজে দেখে নাই, বেতসীর মুখে শুনিয়াছিল। শিল্পকলার প্রতি তাহার তিলমাত্র অনুরাগ ছিল না, তাই সে উদাসীন ছিল। শিল্পকলার রসাস্বাদন করিবার সময়ই বা কোথায়? কিন্তু মধুকর পাটলিপুত্রের মানুষ, বিগ্রহপালকে অবশ্য দেখিয়াছে। সে যদি ভাল শিল্পী হয় নিশ্চয় বিগ্রহপালের মূর্তি গড়িতে পারিবে।
দুই
গতরাত্রে বিগ্রহপালের মুখে যৌবনশ্রীর সংকল্পের কথা শুনিয়া অনঙ্গের মন খারাপ হইয়া গিয়াছিল। আজ প্রাতে ঘুম ভাঙ্গিয়া উঠিয়াও মনের তিলমাত্র উন্নতি হয় নাই। এই স্ত্রীজাতিকে লইয়া কি করা যায়!
ভগবান তাহাদের বুদ্ধি দেন নাই, ভালই করিয়াছেন। স্ত্রীজাতির বুদ্ধির প্রয়োজন কি? সেজন্য পুরুষ আছে। মেয়েরা গৃহস্থালি করিবে, পতিগতপ্রাণা হইবে, সর্ববিষয়ে ভর্তার অনুবর্তিনী হইবে; পূজার্হা গৃহদীপ্তি হইয়া থাকিবে। মনু যথার্থই লিখিয়া গিয়াছেন, স্ত্রীজাতি বাল্যে পিতার বশ, যৌবনে স্বামীর এবং বার্ধক্যে পুত্রের। কিন্তু বর্তমান যুগের যুবতীরা মনুকে গ্রাহ্যই করে না; তাহারা ভাবে তাহাদের ভারি বুদ্ধি হইয়াছে। অবশ্য বান্ধুলি সে রকম নয়। কিন্তু রাজকন্যার এ কিরূপ মতিগতি? এমন একটা অসম্ভব সংকল্প করিয়া বসিলেন! তিনি বিগ্রহকে হৃদয় সমর্পণ করিয়াছেন, অথচ তাঁহার এই ব্যবহার। …এত চেষ্টা এত কৌশল, বুড়া লক্ষ্মীকর্ণকে অঙ্গুষ্ঠ দেখাইবার এমন সুযোগ— সব ভ্রষ্ট হইয়া গেল। নাঃ, স্ত্রীজাতিকে বিশ্বাস নাই— পুরুষের কাজ ভণ্ডুল করিবার জন্যই তাহাদের জন্ম।
এইরূপ ক্ষুব্ধ-বিরক্ত চিন্তায় বেলা বাড়িতেছে দেখিয়া অনঙ্গ মূর্তি গড়িতে বসিয়াছিল। কিন্তু মূর্তি গঠনে তাহার মন বসিল না; একতাল মাটি লইয়া সে নাড়াচাড়া করিতে লাগিল। আজ সকালে উঠিয়া সে বান্ধুলির দেখা পায় নাই, ভোর হইতে না হইতে বান্ধুলি রাজবাটীতে চলিয়া গিয়াছে। সে জন্যও মন ভাল নয়।
পিছনে দরজা ভেজানো ছিল। একটু শব্দ শুনিয়া অনঙ্গ পিছু ফিরিয়া চাহিল; দেখিল দ্বার ঈষৎ ফাঁক করিয়া লম্বোদর উঁকি মারিতেছে। লম্বোদরের সুবর্তুল চোখ দুটিতে কৌতূহল, ভালুকে খাওয়া নাকটি শশকের নাকের মত একটু একটু নড়িতেছে, অধরে বোকাটে হাসি।
অনঙ্গ আত্মসম্বরণ করিয়া বলিল— ‘এই যে লম্বোদর ভদ্র। অনেকদিন আপনার দেখা নেই। আসুন।’
বকধার্মিকের মত শনৈঃ শনৈঃ পদক্ষেপ করিয়া লম্বোদর প্রবেশ করিল, অপ্রতিভস্বরে বলিল— ‘সময় পাই না। রাজকন্যার স্বয়ংবর ব্যাপারে সর্বদাই ব্যস্ত থাকতে হয়। কিন্তু কুটুম্বিনীর কাছে আপনার সংবাদ পাই। আপনার কষ্ট হচ্ছে না তো?’
অনঙ্গ বলিল— ‘আমি পরম আনন্দে আছি। — বসুন। আজ বুঝি রাজকার্যের তেমন চাপ নেই?’
অনঙ্গ বুঝিয়াছিল লম্বোদর বিনা প্রয়োজনে আসে নাই; তাহার মন কৌতূহলী হইয়া উঠিয়াছিল। লম্বোদর উপবেশন করিয়া বলিল— ‘হেঁ হেঁ, আপনি দেখছি মূর্তি গড়ছেন। কুটুম্বিনীর কাছে শুনেছি আপনি উত্তম শিল্পী; কিন্তু আপনার শিল্পবস্তু দেখার সুযোগ হয়নি।’
অনঙ্গ হাসিয়া বলিল— ‘সামনেই রয়েছে— দেখুন।’
লম্বোদর মূর্তিগুলি দেখিল; তাহাদের শিল্প-সৌন্দর্য বুঝিল কিনা বলা যায় না, বলিল— ‘অহহ, কী সুন্দর!— আপনি নিশ্চয় মানুষ দেখে তার প্রতিমা গড়তে পারেন?’
‘পারি। দেখবেন? তাহলে স্থির হয়ে বসুন।’ মৃৎপিণ্ড তুলিয়া লইয়া অনঙ্গ গড়িতে আরম্ভ করিল। অল্পক্ষণ মধ্যে একটি মুণ্ড তৈয়ার করিয়া বলিল— ‘দেখুন। কেমন হয়েছে?’
লম্বোদর কিছুক্ষণ হাঁ করিয়া থাকিয়া বলিল— ‘আপনি অদ্ভুত শিল্পী। মগধের ভদ্ররা দেখছি কলাকুশলী হয়। এঁ— আপনি মগধের যুবরাজ বিগ্রহপালকে দেখেছেন?’
অনঙ্গ একটু চমকিত হইল। কলাকুশলতার সঙ্গে বিগ্রহপালের সম্পর্ক কি? সে সতর্কভাবে বলিল— ‘দেখেছি— দূর থেকে।’
‘আচ্ছা, আমার মুখ যেমন গড়লেন, তাঁর মুখ তেমন গড়তে পারেন?’
‘পারি। যার মুখ একবার দেখেছি তার মুখ গড়তে পারি। কেন বলুন দেখি?’
লম্বোদর একবার কান চুলকাইল, একবার ঘাড় চুলকাইল,— তারপর বলিল— ‘মধুকর ভদ্র, আপনি শিল্পী। আপনার মত শিল্পী চেদিরাজ্যে নেই।’
অনঙ্গ বিনয় করিয়া বলিল— ‘না না, সে কি কথা!’
লম্বোদর বলিল— ‘চলুন আপনি রাজার কাছে। মহারাজ কর্ণদেব শিল্পকলার অনুরাগী, তিনি আপনার গুণের পরিচয় পেলে প্রীত হবেন।’
অনঙ্গের খট্কা লাগিল। লম্বোদরের প্রকৃত উদ্দেশ্য কি? তবে কি লক্ষ্মীকর্ণ জানিতে পারিয়াছে? ছল করিয়া তাহাকে রাজপুরীতে লইয়া গিয়া বন্দী করিতে চায়? কিন্তু না, লক্ষ্মীকর্ণ যদি জানিতে পারিত তাহা হইলে ছল-চাতুরী করিত না, গলায় রজ্জু দিয়া সিধা টানিয়া লইয়া যাইত। হয়তো অন্য কোনও উদ্দেশ্য আছে।
সে বলিল— ‘মহারাজের দর্শনলাভ তো ভাগ্যের কথা। কিন্তু— আমি সামান্য বিদেশী, বিনা প্রয়োজনে মহারাজের সম্মুখীন হওয়া—’
লম্বোদর বলিল— ‘স্বয়ংবর সভা অলঙ্কৃত হচ্ছে, মহারাজ আপনার গুণের পরিচয় পেলে আপনাকে দিয়েও অলঙ্করণের কাজ করিয়ে নিতে পারেন।’
অনঙ্গ ভাবিল, মন্দ কথা নয়। দেখাই যাক না ইহাদের মনে কি আছে। সে বলিল— ‘বেশ, আমি যাব। কখন যেতে হবে?’
লম্বোদর বলিল— ‘এখনই চলুন না। আমাকে কর্মসূত্রে মহারাজের কাছে যেতে হবে। আপনাকেও সঙ্গে নিয়ে যাব।’
‘এখনি?’
‘দোষ কি? আপনি প্রস্তুত হয়ে নিন, আমি ততক্ষণ কুটুম্বিনীকে দেখা দিয়ে আসি।’
লম্বোদর কক্ষ হইতে নিষ্ক্রান্ত হইলে অনঙ্গ বেশবাস পরিবর্তন করিতে প্রবৃত্ত হইল। সামান্য বেশে রাজসমীপে যাওয়া চলিবে না; অনঙ্গ মূল্যবান বেশভূষা পরিধান করিল। উপরন্তু অরিক্তপাণি হইয়া রাজার কাছে যাইতে হয়, হাতে উপঢৌকন থাকা প্রয়োজন। অনঙ্গ একটি স্বকৃত বিষ্ণুমূর্তি সঙ্গে লইল। লক্ষ্মীকর্ণকে সামনা-সামনি দেখিবার আকস্মিক সুযোগ পাইয়া তাহার মন উত্তেজিত হইয়া উঠিয়াছে। এইবার মহারাজ লক্ষ্মীকর্ণের প্রকৃত স্বরূপ জানা যাইবে।
ওদিকে লম্বোদর রসবতীতে গিয়া দেখিল বেতসী রন্ধনকার্যে ব্যস্ত। পিছন হইতে বেতসীকে দেখিয়া সে দ্বারের কাছেই দাঁড়াইয়া পড়িল। বেতসীর কুণ্ডলিত চুলগুলি শিথিল হইয়া গ্রীবামূলে এলাইয়া পড়িয়াছে, কাঁচলি ও কটির মাঝখানে পিঠের নিম্নভাগ দেখা যাইতেছে। লম্বোদর উৎকণ্ঠিতভাবে চাহিয়া রহিল। শীর্ণ লতায় কখন অলক্ষিতে নব পল্লবোদ্গম হইতে আরম্ভ করিয়াছে তাহা সে লক্ষ্য করে নাই।
হঠাৎ ঘাড় ফিরাইয়া বেতসী লম্বোদরকে দেখিতে পাইল। হাতা-বেড়ি ফেলিয়া আঁচলে হাত মুছিতে মুছিতে সে লম্বোদরের কাছে আসিয়া দাঁড়াইল। আনন্দ বিগলিত স্বরে বলিল— ‘কখন এলে?’
লম্বোদর চকিতে একবার বেতসীর সারা দেহে চক্ষু বুলাইয়া উদ্বিগ্নভাবে বলিল— ‘এই এলাম— এখনি আবার যেতে হবে।’
বেতসী তাহার হাতে হাত রাখিয়া আবদারের সুরে বলিল— ‘একটু থাক না। আজকাল দিনান্তে তোমার দেখা পাই না।’
লম্বোদর কুন্ঠাভরে বলিল— ‘রাজকার্য—’
বেতসী বলিল— ‘হোক রাজকার্য, একটু থাক আমার কাছে। — আচ্ছা, এক কাজ কর না! আমার রান্না তৈরি, গরম গরম খেয়ে নাও না। নইলে তো সেই তিন পহর।’
লম্বোদর তাড়াতাড়ি বলিল— ‘না বেতসি, এখন নয়। রাজবাটী যেতে হবে। ফিরে এসে খাব।’
বেতসী ঠোঁট ফুলাইয়া বলিল— ‘রাজবাটী আর রাজবাটী। নিজের বাড়ি বুঝি কিছু নয়। — আচ্ছা, একটু দাঁড়াও, একটা মিষ্টি মুখে দিয়ে যাও।’
বেতসী নারিকেল গুড় ও ক্ষীর দিয়া মিষ্টান্ন তৈয়ার করিয়াছিল, দ্রুত গিয়া এক মুঠি আনিয়া বলিল— ‘হাঁ কর।’
লম্বোদর মুখ ব্যাদান করিল। বেতসী মুখের মধ্যে মিষ্টান্ন পুরিয়া দিয়া বলিল— ‘তবু পেটে ভর পড়বে। — জল নাও।’
জল পান করিয়া লম্বোদর বলিল— ‘আমি অতিথিকে সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছি। চেষ্টা করব মধ্যাহ্নে ফিরতে।’
বেতসী বলিল— ‘আচ্ছা, আমি থালা সাজিয়ে বসে থাকব।’
ইতিমধ্যে অনঙ্গ সাজসজ্জা করিয়া মাথায় পাগ বাঁধিয়া প্রস্তুত হইয়াছিল; লম্বোদর তাহাকে লইয়া বাহির হইল। পথে যাইতে যাইতে লম্বোদর অধিক কথা বলিল না, কিন্তু নানা কূটচিন্তার ফাঁকে ফাঁকে কর্মরতা বেতসীর চিত্রটি বার বার তাহার মনে উদিত হইতে লাগিল।
তিন
মহারাজ লক্ষ্মীকর্ণ গুপ্ত মন্ত্রগৃহেই ছিলেন। অনঙ্গ তাঁহার সম্মুখে বিষ্ণুমূর্তিটি রাখিয়া যুক্তকর হইল। লক্ষ্মীকর্ণ মূর্তিটি দেখিলেন, অনঙ্গকে দেখিলেন; তারপর মূর্তিটি তুলিয়া লইলেন।
অনঙ্গও লক্ষ্মীকর্ণকে দেখিল। ইতিপূর্বে সে লক্ষ্মীকর্ণের রূপবর্ণনাই শুনিয়াছিল; দেখিল বর্ণনায় তিলমাত্র অত্যুক্তি নাই। মহারাজ লক্ষ্মীকর্ণ সত্যই একটি কদাকার অতিকায় দৈত্য বিশেষ।
অতঃপর প্রশ্নোত্তর আরম্ভ হইল। লক্ষ্মীকর্ণ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে অনঙ্গকে বিদ্ধ করিয়া বলিলেন— ‘তুমি বিদেশী। তোমার নিবাস কোথায়?’
অনঙ্গ বলিল— ‘আজ্ঞা, মগধের রাজধানী পাটলিপুত্রে।’
‘নাম কি?’
‘আজ্ঞা, নাম মধুকর সাধু।’
‘বৈশ্য?’
‘আজ্ঞা।’
‘পিতার নাম?’
অনঙ্গ প্রস্তুত ছিল, বলিল— ‘আমার পিতা স্বর্গত। নাম ছিল সুধাকর সাধু।’
‘ত্রিপুরীতে কি জন্য এসেছ?’
‘স্বয়ংবর উপলক্ষে শিল্পসামগ্রী বিক্রয়ের উদ্দেশ্যে এসেছি।’
‘অন্য কোনও উদ্দেশ্য নেই?’
‘অন্য উদ্দেশ্য দেশ ভ্রমণ।’
লক্ষ্মীকর্ণ কিছুক্ষণ ভ্রূ কুঞ্চিত করিয়া রহিলেন। —
‘তুমি পাটলিপুত্রের লোক, যুবরাজ বিগ্রহপালের সঙ্গে নিশ্চয় পরিচয় আছে?’
অনঙ্গ জিভ কটিয়া বলিল— ‘আজ্ঞা না। আমি সামান্য ব্যক্তি, রাজপুত্রের সঙ্গে পরিচয় নাই। তবে তাঁকে অনেকবার দেখেছি।’
‘বিগ্রহপাল এখন কোথায় জানো?’
‘সম্ভবত পাটলিপুত্রেই আছেন। আমি জানি না।’
লক্ষ্মীকর্ণ গলার মধ্যে শব্দ করিলেন, বলিলেন— ‘আমি সংবাদ পেয়েছি সে পাটলিপুত্রে নেই। যা হোক—’ লক্ষ্মীকর্ণ ক্ষণেক বাক্ সম্বরণ করিয়া পুনশ্চ বলিলেন— ‘তুমি পাটলিপুত্রের লোক হলেও তোমাকে সজ্জন বলে মনে হচ্ছে।’ বিষ্ণুমূর্তিটি লইয়া নাড়াচাড়া করিতে করিতে বলিলেন— ‘লম্বোদরের মুখে শুনলাম তুমি ভাল শিল্পী, তোমার কাজ দেখেও তাই মনে হচ্ছে। — তুমি দেখা-মুখের প্রতিমা গড়তে পারো?’
‘আজ্ঞা পারি’ বলিয়া অনঙ্গ লম্বোদরের পানে চাহিল। লম্বোদর সবেগে মুণ্ড আন্দোলন করিলে।
‘ভাল।’ মহারাজ কণ্ঠস্বর গাঢ় করিয়া বলিলেন— ‘তোমাকে দিয়ে একটা গোপনীয় কাজ করাতে চাই। যদি করতে পারো, পুরস্কার পাবে।’
হাত জোড় করিয়া অনঙ্গ বলিল— ‘আজ্ঞা করুন।’
মহারাজ ক্ষণকাল বিবেচনা করিয়া গাত্রোত্থান করিলেন। বলিলেন— ‘তোমরা আমার সঙ্গে এস।’
কয়েকটি অলিন্দ পার হইয়া শিল্পশালার দ্বার। শিল্পশালা রাজভবনের অন্তর্গত হইলেও তাহার প্রবেশদ্বার স্বতন্ত্র। দ্বারে শূলধারী দৌবারিক পাহারা দিতেছে।
লক্ষ্মীকর্ণ সঙ্গীদের লইয়া প্রবেশ করিলেন। শিল্পশালার কক্ষটি সভাগৃহের ন্যায় বিস্তৃত, মাঝে মাঝে স্থূল স্তম্ভ ছাদকে ধরিয়া রাখিয়াছে; স্তম্ভের গায়ে শিল্পকর্ম। কিন্তু শোভা কিছু নাই। দুই চারিটা প্রাচীরচিত্র, দুই চারিটা প্রস্তরমূর্তি যত্রতত্র বিচ্ছিন্নভাবে দাঁড়াইয়া আছে, যত্নের অভাবে ধূলিমলিন হইয়া পড়িয়াছে। লক্ষ্মীকর্ণের পূর্বপুরুষেরা শিল্পকলারসিক ছিলেন, কিন্তু লক্ষ্মীকর্ণ নিজে ও-সবের ধার ধারেন না। হঠাৎ দুষ্টবুদ্ধি মস্তিষ্কে উদিত হওয়ায় শিল্পশালার দ্বার খুলিয়াছে।
শিল্পশালার মাঝখানে একটি স্তম্ভে ঠেস দিয়া হতাশ ভঙ্গিতে শিল্পী বসিয়া আছে। তাহার পাশে স্তূপীকৃত মূর্তি গড়িবার মৃত্তিকা, সম্মুখে অসংখ্য মৃন্ময় মুণ্ড, অদূরে একটি মুণ্ডহীন কবন্ধ। কবন্ধ ও মুণ্ডগুলি সবই প্রমাণ আকৃতির।
রাজাকে দেখিয়া শিল্পী ত্রস্তে উঠিয়া দাঁড়াইল। রাজা তাহাকে বলিলেন— ‘চক্রনাথ, তুমি এখন গৃহে যাও। তোমার কাজ সম্বন্ধে কারও সঙ্গে জল্পনা করবে না। যদি প্রয়োজন হয় তোমাকে আবার ডেকে পাঠাব।’
শিল্পী চক্রনাথ অনঙ্গের প্রতি বক্র কটাক্ষপাত করিল, তারপর ‘যথা আজ্ঞা মহারাজ’ বলিয়া প্রস্থান করিল।
তখন লক্ষ্মীকর্ণ অনঙ্গকে বলিলেন— ‘মধুকর, এই মুণ্ডগুলা দেখে বলতে পার, বিগ্রহপালের সঙ্গে কোনও মুণ্ডের সাদৃশ্য আছে কিনা?’
লক্ষ্মীকর্ণ কোন্ পথে চলিয়াছেন তাহা অনঙ্গ এখনও বুঝিতে পারে নাই, মনের মধ্যে বিস্ময় লুকাইয়া সে মুণ্ডগুলি পরীক্ষা করিল, বলিল— ‘না আর্য, সাদৃশ্য নেই।’
‘তুমি বিগ্রহপালের মুণ্ড গড়ে দেখাতে পার?’
‘মোটামুটি গড়ে দেখাতে পারি।’
‘দেখাও।’
অনঙ্গ তখন মর্মর কুট্টিমের উপর উপবেশন করিল, মাথার পাগ খুলিয়া পাশে রাখিল, এক তাল মাটি তুলিয়া দুই হাতে গড়িতে আরম্ভ করিল। রাজা তাহার পিছনে দাঁড়াইয়া দেখিতে লাগিলেন।
বিগ্রহপালের মুখ গঠন করা অনঙ্গের পক্ষে কিছুই কঠিন কাজ নয়; চোখ মুদিয়া গড়িতে পারে। কিন্তু সে ত্বরা করিল না; ধীরে ধীরে, যেন স্মরণ করিতে করিতে গড়িতে লাগিল। অবশেষে অর্ধদণ্ড পরে মুণ্ডটি এক পীঠিকার উপর রাখিয়া বলিল— ‘তাড়াতাড়িতে ভাল হল না। তবু চিনতে বোধহয় কষ্ট হবে না।’
মুণ্ড দেখিয়া লক্ষ্মীকর্ণের ব্যাঘ্র-মুখে হাসি ফুটিল; হাঁ, সেই মুখই বটে। তিনি অনঙ্গের স্কন্ধে থাবা রাখিয়া বলিলেন— ‘তুমি উত্তম শিল্পী, তোমাকে আমি রাজশিল্পী করে রাখব। চক্রনাথটা ঘোর অকর্মণ্য। — এখন কী কাজ করতে হবে শোনো।’
লক্ষ্মীকর্ণ সংক্ষিপ্ত ভাষায় নিজ উদ্দেশ্য প্রকাশ করিলেন। শুনিতে শুনিতে অনঙ্গের মুখ ভাবলেশহীন হইয়া গেল, কিন্তু মস্তিষ্কের মধ্যে বিদ্যুতের ন্যায় ক্রিয়া চলিতে লাগিল। হতভাগ্য বুড়ার এই উদ্দেশ্য! প্রকাশ্য স্বয়ংবর সভায় বিগ্রহপালকে অপদস্থ করিতে চায়!
লক্ষ্মীকর্ণ যতক্ষণে নিজ বক্তব্য শেষ করিলেন ততক্ষণে অনঙ্গ নূতন ফন্দি বাহির করিয়াছে। দাঁড়াও বুড়া, তোমার অস্ত্রে তোমাকে সংহার করিব! তুমি বিগ্রহপালের মুখে চুন-কালি দিতে চাও, তোমার নিজের মুখে চুন-কালি পড়িবে। এতক্ষণ পথ খুঁজিয়া পাইতেছিলাম না, এবার পাইয়াছি। যৌবনশ্রী স্বয়ংবর সভাতেই বিগ্রহপালের গলায় মালা দিবে—
লক্ষ্মীকর্ণ প্রশ্ন করিলেন— ‘কত দিন সময় লাগবে?’
অনঙ্গ যুক্তকরে বলিল— ‘ভাল করে তৈরি করতে কিছু সময় লাগবে মহারাজ।’
‘স্বয়ংবরের আগে তৈরি হওয়া চাই। তোমার যদি কোনও দ্রব্য প্রয়োজন হয় আমাকে জানিও।’
‘আজ্ঞা, আমার কিছু বেতস ও বাঁশের কঞ্চি চাই। এই যে মাটির কবন্ধ তৈরি হয়েছে এ বড় ভারী। আমি কঞ্চি ও বেতস দিয়ে দেহের কাঠামো তৈরি করব; এত লঘু হবে যে দুইজন লোক মূর্তিটাকে এখান থেকে স্বয়ংবর সভায় নিয়ে যেতে পারবে।’
‘বেশ বেশ। তুমি যা চাও তাই পাবে। এবার কাজ আরম্ভ করে দাও। আমি মাঝে মাঝে এসে তোমার কাজ দেখে যাব। যতদিন তোমার কাজ শেষ না হয় ততদিন তুমি এখানেই থাকবে। স্বয়ংবরের আগের রাত্রে স্বয়ংবর সভায় মূর্তি প্রতিষ্ঠিত করে তারপর তোমার ছুটি।’
অনঙ্গ ত্রস্ত হইয়া বলিল— ‘কিন্তু মহারাজ—’
‘তোমার প্রয়োজনীয় তৈজসপত্র সব লম্বোদর পৌঁছে দেবে। তুমি এখানেই পানাহার করবে, রাজ-পাকশালা থেকে তোমার আহার্য আসবে। রাত্রে শয়নের জন্য শয্যা পাবে। যতদিন কাজ শেষ না হয় ততদিন এই ব্যবস্থা।’
মহারাজ লম্বোদরকে লইয়া প্রস্থান করিলেন। দৌবারিককে বলিয়া গেলেন যেন কোনও অবস্থাতেই শিল্পীকে বাহিরে যাইতে দেওয়া না হয়।
অনঙ্গ মাথায় হাত দিয়া বসিল। বাহির হইতে না পারিলে সে বিগ্রহপালের সহিত সংযোগ স্থাপন করিবে কিরূপে?
চার
লম্বোদর যখন গৃহে ফিরিল তখন তৃতীয় প্রহর আগতপ্রায়। ইতিমধ্যে বান্ধুলি আসিয়াছিল; দুই ভগিনী রসাবতীতে অন্ন-ব্যঞ্জন সাজাইয়া অপেক্ষা করিতেছিল। লম্বোদর ও অতিথি ফিরিলে তাহাদের খাওয়াইয়া নিজেরা খাইতে বসিবে।
লম্বোদরকে দেখিয়া বেতসী বলিল— ‘এতক্ষণে আসা হল। নাও, আর দেরি নয়, বসে পড়। সব জুড়িয়ে গেল।’
লম্বোদর হাত ধুইয়া পীঠিকায় বসিল। বেতসী তাহার সম্মুখে থালি ধরিয়া দিয়া বলিল— ‘বান্ধুলি, তুই অতিথির খাবার দিয়ে আয়।’
লম্বোদর মুখে গ্রাস তুলিতে যাইতেছিল, থামিয়া বলিল— ‘অতিথি আসেনি।’
বেতসী অবাক হইয়া বলিল— ‘আসেনি! ওমা, কোথায় গেল অতিথি?’
লম্বোদর খাদ্যচর্বণ করিতে করিতে নিরুদ্বেগকণ্ঠে বলিল— ‘রাজপুরীতে আছে।’
বান্ধুলি অতিথির থালা হাতে লইবার জন্য নত হইয়াছিল, সেই অবস্থাতেই রহিল; তাহার মুখে আশঙ্কার ছায়া, পড়িল। সে শুনিয়াছিল অনঙ্গ লম্বোদরের সঙ্গে বাহির হইয়াছে, কিন্তু ফিরিয়া আসিল না কেন? রাজবাড়িতে রহিল কি জন্য?
বেতসী বলিল— ‘রাজপুরীতে! কখন ফিরবে?’
লম্বোদর বলিল— ‘এখন দু’চার দিন সেখানেই থাকবে।’
বান্ধুলির বুক ছাঁৎ করিয়া উঠিল। তবে কি রাজা জানিতে পারিয়াছে, অনঙ্গকে ছলে রাজপুরীতে লইয়া গিয়া কারাগারে পুরিয়াছে?
বেতসী বলিল— ‘সে কি! রাজপুরীতে থাকবে কেন?’
লম্বোদর বলিল— ‘রাজা তাকে দিয়ে একটা কাজ করিয়ে নিতে চান, যতদিন কাজ শেষ না হয় ততদিন সে শিল্পশালায় থাকবে। ভাবনার কিছু নেই, খুব আরামে থাকবে। রাজার পাকশালা থেকে খাবার আসবে।’
বেতসী আরও অবাক হইয়া বলিল— ‘হাঁ গা, কী এমন কাজ?’
‘একটা মূর্তি গড়তে হবে।’
‘কার মূর্তি? রাজার? রাজকন্যের?’
লম্বোদর আর উত্তর দিল না, আহারে মন দিল। এতটা না বলিলেই ভাল হইত। মেয়েদের বড় বেশি কৌতূহল, তার উপর পেটে কথা থাকে না। যা হোক, আহার শেষ করিয়া আচমন করিতে করিতে সে বলিল— ‘এসব কথা কাউকে বলবে না। আমি এখন চললাম, অতিথির কিছু তৈজসপত্র শিল্পশালায় পৌঁছে দিতে হবে।’—
লম্বোদর প্রস্থান করিবার পর দুই ভগিনী আবার রসবতীতে ফিরিয়া আসিল। বেতসী বলিল— ‘আয় খেতে বসি।’
বান্ধুলি বলিল— ‘দিদি!’
তাহার কণ্ঠস্বর শুনিয়া বেতসী চমকিয়া তাহার পানে চাহিল। এতক্ষণ বান্ধুলির মুখের পানে তাহার নজর পড়ে নাই, এখন দেখিল বান্ধুলির মুখ যেন শুকাইয়া শীর্ণ হইয়া গিয়াছে।
বেতসী বলিল— ‘কি রে?’
বান্ধুলি বলিল— ‘আমি— আমি রাজবাটীতে ফিরে যাই।’
‘বেশ তো। খেয়ে নে, তারপর যাস।’
‘না দিদি, আমি যাই—’
বেতসী বান্ধুলির কাছে আসিয়া দাঁড়াইল, বলিল— ‘কী হয়েছে বল দেখি।’
উত্তর দিতে গিয়া বান্ধুলি কাঁদিয়া ফেলিল, তারপর বেতসীকে জড়াইয়া ধরিয়া তাহার কাঁধে মুখ গুঁজিল।
বেতসীর বিস্ময়ের অবধি রহিল না— ‘বান্ধুলি!’
বান্ধুলি গলার মধ্যে অস্পষ্টস্বরে বলিল— ‘বড় ভয় করছে।’
হঠাৎ বেতসীর মস্তিষ্কের মধ্যে বিদ্যুৎ ঝলকিয়া উঠিল। মধুকর! মধুকরের বিপদ আশঙ্কা করিয়া বান্ধুলি উতলা হইয়াছে। মধুকরকে সে মনে মনে—!
বেতসী বলিল— ‘দেখি, মুখ তোল।’
বান্ধুলি অশ্রুপ্লাবিত মুখ তুলিল। বেতসী তাহার মুখ দেখিয়া মহানন্দে হাসিয়া উঠিল— ‘তুই মধুকরকে— অ্যাঁ!’
বান্ধুলির অশ্রুপ্লাবন আরও বাড়িয়া গেল। বেতসী তাহাকে আবার কণ্ঠলগ্ন করিয়া বলিল— ‘এই কথা! তা এত কান্না কিসের? শুনলি তো রাজা মূর্তি গড়াবার জন্যে তাকে রাজপুরীতে রেখেছেন। এতে ভাবনার কী আছে?’
বেতসী সব কথা জানে না, সুতরাং তাহার ভাবনার কিছু না থাকিতে পারে; কিন্তু বান্ধুলি নিশ্চিন্ত হইবে কি করিয়া? লম্বোদর যে মিথ্যা স্তোক দেয় নাই তাহা কে বলিতে পারে? নিজের চোখে না দেখা পর্যন্ত বান্ধুলির মন প্রবোধ মানিবে না। সে ভাঙ্গা গলায় বলিল— ‘আমি যাই দিদি। তুই কাউকে কিছু বলিস না। কুটুম্ব যদি জানতে পারে—’
বেতসী বলিল— ‘তুই নিশ্চিন্ত থাক।’
বান্ধুলি চোখ মুছিতে মুছিতে চলিয়া গেল।
বেতসী একাই খাইতে বসিল। মধুকরের প্রতি বান্ধুলির মন আসক্ত হইয়াছে ইহা বেতসী আগে জানিতে পারে নাই। কি করিয়াই বা জানিবে? তাহার মন নিজের পুনরুজ্জীবিত সুখ দুঃখ আশা আকাঙ্ক্ষার জালে জড়াইয়া গিয়াছিল, বান্ধুলির মনের দিকে তাহার দৃষ্টি পড়ে নাই। এখন উদ্বেলিত আনন্দে তাহার মন ভরিয়া উঠিল। কেবল বান্ধুলির জন্য নয়, নিজের জন্যও। সংশয়ের দুষ্ট কীট তাহার বুকের মধ্যে বাসা বাঁধিয়াছিল, স্বাস্থ্যোন্নতির পরও কীটের দংশন থামে নাই। কিন্তু এখন আর ভয় নাই। বান্ধুলি মধুকরকে চায়। এখন বেতসী লম্বোদরের মন আবার আকর্ষণ করিয়া লইতে পরিবে।
বান্ধুলি যখন রাজপুরীতে পৌঁছিল তখন তাহার চোখের জল শুকাইয়াছে। সে প্রথমে রাজ-পাকশালায় উপস্থিত হইল। রাজপুরীর কাণ্ড, অনঙ্গ খাইতে পাইয়াছে কিনা তাহা আগে জানা দরকার।
রাজপুরীর বিশাল পাকশালা, দশ বারোটা আখা জ্বলিতেছে। রাজ পরিবারের আহার সমাধা হইলেও অসংখ্য পরিজনের মধ্যাহ্ন ভোজন এখনও বাকি। একপাল পাচক পাচিকা কলরব করিতেছে, পাকশালা কাকসমাকুল উচ্ছিষ্ট স্থানের ন্যায় মুখরিত।
বান্ধুলিকে দেখিয়া কল-কোলাহল একটু শান্ত হইল। বান্ধুলিকে রাজপুরীতে কে না চেনে? কনিষ্ঠা কুমার-ভট্টারিকার সখী।
বান্ধুলি প্রধান সূপকারের কাছে গিয়া বলিল— ‘কৃষ্ণ, শিল্পশালায় খাবার পাঠাতে হবে জানো?’
কৃষ্ণ স্থূলকায় বয়স্ক ব্যক্তি, ঘর্মাক্ত দেহে রন্ধন পরিদর্শন করিতেছিল; সে বলিল— ‘হাঁ দিদি, শিল্পশালায় খাবার পাঠাতে হবে খবর পেয়েছি। — ও মারুতির মা, শিল্পশালায় খাবার নিয়ে যেতে বলেছিলাম তার কি হল?’
মারুতির মা প্রৌঢ়া বিধবা, অদূরে বসিয়া লোহার উদূখলে কচি আম কুটিয়া কাশমর্দ তৈয়ার করিতেছিল, বলিল— ‘এই যে বাছা, একটা কাজ সেরে তবে তো অন্য কাজে হাত দেব। এটা হলেই দিয়ে আসব।’
বান্ধুলি কৃষ্ণকে বলিল— ‘আমার হাতে দাও, আমি দিয়ে আসছি।’
কৃষ্ণ বলিল— ‘তুমি দিয়ে আসবে দিদি! তাহলে তো কথাই নেই। এই যে আমি খাবার সাজিয়ে দিচ্ছি।’
কৃষ্ণ বুঝিয়াছিল রাজকন্যার সখী নিজের হাতে যাহার খাবার লইয়া যাইতে চায় সে সামান্য লোক নয়। কৃষ্ণ প্রকাণ্ড থালায় উৎকৃষ্ট অন্ন-ব্যঞ্জন সাজাইয়া বান্ধুলির হাতে দিল।
বান্ধুলি থালি লইয়া শিল্পশালার দিকে চলিল। দেখিল শিল্পশালার দ্বারে অস্ত্রধারী দৌবারিক দাঁড়াইয়া আছে। তাহার বুক দুরুদুরু করিয়া উঠিল।
দৌবারিকও বান্ধুলিকে চিনিত। বলিল— ‘শিল্পীর জন্য খাবার এনেছ?’
বান্ধুলি বলিল— ‘হাঁ। লম্বোদর ভদ্র কি এসেছিলেন?’
দৌবারিক বলিলেন— ‘হাঁ। শিল্পীর তৈজসপত্র রেখে গেছেন। যাও, ভিতরে যাও।’
যাক, লম্বোদরের সঙ্গে এখানে সাক্ষাৎকার ঘটিবার সম্ভাবনা নাই। বান্ধুলি সাহস করিয়া শিল্পশালায় প্রবেশ করিল। বিশাল কক্ষের এক কোণে শয্যা পাতিয়া অনঙ্গ অত্যন্ত বিমর্ষভাবে বসিয়া আছে। বান্ধুলিকে দেখিয়া সে এক লাফে উঠিয়া দাঁড়াইল এবং হাতছানি দিয়া তাহাকে কাছে ডাকিল।
বান্ধুলি যখন তাহার কাছে গিয়া দাঁড়াইল তখন তাহার চোখে আবার জল আসিয়া পড়িয়াছে। অনঙ্গ কিন্তু আনন্দের আবেগে আর একটু হইলেই তাহাকে আলিঙ্গন করিয়া ফেলিত, যথাসময় আত্মসংবরণ করিয়া বলিল— ‘বান্ধুলি! তুমি!’
বান্ধুলি শয্যার পাশে থালা নামাইয়া বলিল— ‘আগে খেতে বোসো। খুব পেট জ্বলছে তো!’
‘পেট! হাঁ, জ্বলছে বটে।’ অনঙ্গ সংযতভাবে খাইতে বসিল। মধ্যাহ্ন ভোজনের সময় যে উত্তীর্ণ হইয়া গিয়াছে তাহা সে নানা দুশ্চিন্তায় ভুলিয়া গিয়াছিল।
বান্ধুলি হ্রস্বকণ্ঠে বলিল— ‘বাড়ি গিয়ে শুনলাম তুমি কুটুম্বের সঙ্গে বেরিয়েছ। তারপর কুটুম্ব ফিরে এলেন, তুমি এলে না। কুটুম্ব বললেন, রাজা তোমাকে শিল্পশালায় আটকে রেখেছেন। তাই আমি—’
‘ধন্য।’ কিছুক্ষণ নীরবে আহার করিয়া অনঙ্গ মুখ তুলিল— ‘তুমি খেয়েছ?’
বান্ধুলি হেঁট মুখে মাথা নাড়িল। অনঙ্গ তখন পাত হইতে এক খণ্ড ভর্জিত মৎস্যাণ্ড লইয়া বান্ধুলির মুখের কাছে ধরিল, বলিল— ‘খাও।’
বান্ধুলি সলজ্জে ঘাড় ফিরাইয়া বলিল— ‘যাঃ!’
অনঙ্গ মৎস্যাণ্ডটি তাহার মুখের কাছে ধরিয়া রাখিয়া বলিল— ‘এক পাতে না খেলে বৌ হওয়া যায় না।’
বান্ধুলি ক্ষণেক দ্বিধা করিল; তারপর মুখ ফিরাইয়া মৎস্যাণ্ডে একটু কামড় দিয়া মুখ বুজিল। অনঙ্গ আর পীড়াপীড়ি করিল না। বাকি মৎস্যাণ্ড নিজের মুখে পুরিয়া চিবাইতে লাগিল এবং বান্ধুলির পানে আড়চোখে চাহিয়া মৃদু মৃদু হাসিতে লাগিল। বান্ধুলির মুখ আকণ্ঠ রাঙা হইয়া উঠিল।
কিছুক্ষণ পরে অনঙ্গ সতর্কভাবে ঘাড় তুলিয়া দ্বারের দিকে চাহিল। দ্বার এখান হইতে অনেকটা দূরে, দৌবারিককেও এ কোণ হইতে দেখা যায় না। তাঁহাদের কথা কেহ শুনিতে পাইবে না এ বিষয়ে নিশ্চিন্ত হইয়া অনঙ্গ গলা নামাইয়া বলিল— ‘বান্ধুলি, তোমাকে আমি সব কথা বলিনি। কিন্তু তুমি বুদ্ধিমতী, যা বলিনি তা নিশ্চয় অনুমান করে নিয়েছ। আমি এক নূতন ফন্দি বার করেছি। দেবী যৌবনশ্রী যে প্রতিবন্ধক সৃষ্টি করেছেন তাকে সরাবার কৌশল উদ্ভাবন করেছি। এখন যা বলছি মন দিয়ে শোনো। বীরশ্রী ও যৌবনশ্রী ছাড়া একথা আর কাউকে বলবে না। আর কেউ যদি জানতে পারে সর্বনাশ হয়ে যাবে; মহারাজ লক্ষ্মীকর্ণ আমাদের সবাইকে কুচকুচ করে কেটে ফেলবেন।’
বান্ধুলি কম্প্রবক্ষে শঙ্কা-হর্ষ-উত্তেজনা লইয়া শুনিল; অনঙ্গ বক্তব্য শেষ করিয়া বলিল— ‘তুমি এখন যাও। অনেকক্ষণ আছ, প্রহরীটা সন্দেহ করবে।’
‘সন্ধ্যার পর আবার আমি তোমার খাবার নিয়ে আসব।’
অনঙ্গ হাসিল— ‘এস।’
শূন্য ভোজনপত্র লইয়া বান্ধুলি পিছু ফিরিয়া চাহিতে চাহিতে চলিয়া গেল। অনঙ্গ বসিয়া ভাবিতে লাগিল। তাহার জীবনে অভাবিত পরিবর্তন ঘটিয়াছে বটে; কিন্তু বান্ধুলির সহিত বিচ্ছেদ ঘটে নাই, তাহাদের প্রণয়কুঞ্জ স্থানান্তরিত হইয়াছে মাত্র। …নাঃ, বান্ধুলিকে লইয়া পলাইতে না পারিলে জীবন বৃথা!
সে উঠিয়া গিয়া কাদামাটি লইয়া কাজ আরম্ভ করিল।
পাঁচ
বিগ্রহপালের মন লণ্ডভণ্ড হইয়া গিয়াছিল। বণিকের তরণী সাত সাগর পাড়ি দিয়া শেষে নিজ ঘাটের কাছে আসিয়া ডুবিবার উপক্রম করিতেছে। অমৃতের পূর্ণপাত্র অধীরের কাছে আসিয়া খসিয়া পড়িতেছে! এখন কি করা যায়?
বিগ্রহপাল প্রথম দর্শনে যৌবনশ্রীর প্রতি আসক্ত হইয়াছিলেন; তারপর যৌবনশ্রীর কোমল মধুর প্রকৃতির পরিচয় পাইয়া প্রীতির রসে তাঁহার হৃদয় পূর্ণ হইয়াছে। কিন্তু এতখানি চরিত্রের দৃঢ়তা যৌবনশ্রীর আছে তাহা তিনি কল্পনা করেন নাই। এই দৃঢ়তার ফলে বিগ্রহপালের সমস্ত পরিকল্পনা বিপর্যস্ত হইয়াছে সন্দেহ নাই। কিন্তু মরি মরি! কী চরিত্র! এমন চরিত্র নহিলে মগধের পট্টমহিষী হইবার যোগ্যতা আর কাহার আছে! বিগ্রহপাল এতদিন যৌবনশ্রীকে শুধুই ভালবাসিয়াছেন; এখন শ্রদ্ধা সম্ভ্রমে তাঁহার অন্তর পূর্ণ হইয়া উঠিল। যৌবনশ্রীর মত নারীকে পত্নীরূপে না পাইলে জীবন মরুভূমি।
কিন্তু কী উপায়ে তাহাকে পাওয়া যায়? বিগ্রহপাল নিজে কোনও পন্থা আবিষ্কার করিতে পারেন নাই। অনঙ্গ পরিস্থিতির কথা শুনিয়াছে কিন্তু কোনও কথা না বলিয়া চলিয়া গিয়াছে। রন্তিদেবও শুনিয়াছেন, কিন্তু বিমর্ষভাবে মস্তকান্দোলন করিয়া ‘গ্রহের ফের’ বলা ছাড়া আর কিছুই করিতে পারেন নাই।
রাত্রে বিগ্রহপালের ভাল নিদ্রা হয় নাই। প্রভাতে উঠিয়া তিনি বিক্ষিপ্তচিত্তে শয়নকক্ষে পাদচারণ করিলেন। মহারাজ লক্ষ্মীকর্ণের কথা যতবার মনে আসিল ততবার ক্রোধে তাঁহার সর্বাঙ্গ জ্বলিয়া উঠিল। ওই হতভাগা বুড়াই যত নষ্টের গোড়া। ও যদি বাক্যদান করিয়া বাক্যভঙ্গ না করিত তাহা হইলে কোনও গণ্ডগোলই হইত না। নষ্টবুদ্ধি জরদগব! মোহান্ধ মর্কট! অনার্য বর্বর পিশুন!
ভাবী শ্বশুরের উদ্দেশে কুবাক্য প্রয়োগ করিয়া কোনও ফল হইল না, মাথায় বুদ্ধি আসিল না। বেলা বাড়িতে লাগিল। রন্তিদেব প্রবোধ দিবার চেষ্টা করিলেন, কিন্তু বিগ্রহপালের মন প্রবোধ মানিল না। অনঙ্গও আসিল না। সে কোথায় গেল? বোধহয় বান্ধুলিকে লইয়া মত্ত হইয়া আছে, নহিলে এতক্ষণে একটা ফন্দি বাহির করিতে পারিত। বিগ্রহপাল ক্ষুব্ধ হইয়া ভাবিলেন— হায়, আপৎকালে অতিবড় বান্ধবও ত্যাগ করে—
দ্বিপ্রহরে নামমাত্র আহার করিয়া বিগ্রহপাল শয্যায় শয়ন করিলেন। ভাবিতে ভাবিতে হঠাৎ তাঁহার মনে পড়িয়া গেল— অগ্নিকন্দুক! তিনি দ্রুত শয্যায় উঠিয়া বসিলেন। ত্রিপুরীতে পদার্পণ করিবার পর হইতে তিনি অগ্নিকন্দুকের কথা সম্পূর্ণ বিস্মৃত হইয়াছিলেন। বিনা যুদ্ধে শক্রকে জয় করিবার পর অস্ত্রশস্ত্রের কথা কে মনে রাখে? কিন্তু এখন আবার বিপাকে পড়িয়া এই পরম অস্ত্রটির কথা মনে পড়িয়া গেল।
বিগ্রহপাল উঠিয়া পেটরা খুলিলেন। পেটরার তলদেশে বস্ত্রাবরণের মধ্যে অগ্নিকন্দুকটি রহিয়াছে। পলাণ্ডুকন্দের ন্যায় আকৃতি, অজ্ঞ ব্যক্তি দেখিলে ভাবিতেও পারে না উহার মধ্যে অমিতশক্তি সংহত আছে। কিন্তু বিগ্রহপাল স্বচক্ষে ইহার তেজ দেখিয়াছেন; তিনি অনেকক্ষণ কন্দুকটি হাতে লইয়া নিরীক্ষণ করিলেন। তারপর আবার পেটরার মধ্যে সযত্নে রাখিয়া দিতে দিতে মনে মনে বলিলেন— সিধা পথে যদি যৌবনাকে না পাই, স্বয়ংবর সভা ছারখার করিয়া দিব।
সন্ধ্যার পর বিগ্রহপাল নদীতীরে গেলেন। রাজপুরীর পশ্চাতে চাঁদের আলোয় বীরশ্রী ও যৌবনশ্রী দাঁড়াইয়া আছেন। বিগ্রহপাল প্রথমেই গিয়া বীরশ্রীর হাত ধরিলেন— ‘দেবি, এ কি হল! এখন কি উপায় হবে?’
বীরশ্রী হাসিয়া বলিলেন— ‘উপায় হয়েছে।’
বিগ্রহপাল উত্তেজিতভাবে দুই ভগিনীর মুখ পর্যায়ক্রমে নিরীক্ষণ করিলেন— ‘উপায় হয়েছে!’
‘হয়েছে। অনঙ্গ ভদ্র উপায় বার করেছেন।’
‘অনঙ্গ! সে কোথায়? তাকে কোথায় পেলেন?’
‘সব বলছি, অস্থির হয়ো না। এস, ঘাসের ওপর বসি।’
তিনজন শষ্পাস্তরণের উপর বসিলেন; মধ্যে বিগ্রহ, দুইপাশে দুই ভগিনী। বীরশ্রী বান্ধুলির মুখে যাহা শুনিয়াছিলেন সমস্ত বলিলেন। শুনিয়া বিগ্রহপাল কখনও ক্রুদ্ধ হইলেন, কখনও কৌতুকে হাসিলেন; ভাবী শ্বশুর মহাশয়ের প্রতি যে ক্রোধ হইল তাহা তরল হাস্যরসে ভাসিয়া গেল। অনঙ্গের প্রতি মনে মনে যে অবিচার করিয়াছিলেন সেজন্য লজ্জিত হইলেন। তারপর যৌবনশ্রীর কানের কাছে মুখ লইয়া গিয়া বলিলেন— ‘এবার হয়েছে তো? বানরের গলায় মালা দিতে আপত্তি নেই?’
যৌবনশ্রী মাথা নাড়িয়া স্মিতমুখে নীরব রহিলেন। বীরশ্রী বলিলেন— ‘যার যেমন পছন্দ।’
সেরাত্রে চন্দ্রাস্ত পর্যন্ত আলাপ আলোচনা হইল। অনন্তর বিগ্রহপাল যখন নদীতীর হইতে ফিরিয়া চলিলেন তখন তাঁহার মন অনেকটা শান্ত হইয়াছে। অনঙ্গ মন্দ ফন্দি বাহির করে নাই। যৌবনশ্রীকে চুরি করিয়া লইয়া যাওয়া অপেক্ষাকৃত সহজ ছিল বটে, কিন্তু এই নূতন কৌশল আরও চমকপ্রদ, আরও নাটকীয়। সারা ভারতবর্ষে সাড়া পড়িয়া যাইবে, মুখে মুখে গল্প রচিত হইবে। লক্ষ্মীকর্ণ যেমন মগধকে হাস্যাস্পদ করিবার চেষ্টা করিতেছে তেমনি নিজে হাস্যাস্পদ হইবে। পালবংশের গৌরব আরও বৃদ্ধি পাইবে।
ছয়
আকাশের চাঁদ স্বয়ংবরের দিন লক্ষ্য করিয়া ক্রমশ পূর্ণ হইয়া উঠিতেছে। সেদিন আবার বসন্তপূর্ণিমা— হোলিকা; রঙ ও কুঙ্কুম খেলার দিন।
স্বয়ংবরের দিন যত অগ্রসর হইয়া আসিতেছে, তত বড় বড় রাজারা আসিতেছেন। কেহ গজপৃষ্ঠে, কেহ অশ্বপৃষ্ঠে, কেহ চতুর্দোলায়। বড় রাজাদের মধ্যে আছেন উৎকলরাজ, অন্ধ্ররাজ, এবং সর্বোপরি কর্ণাটের মহাপরাক্রান্ত বিক্রমাদিত্য। কর্ণাটের বিক্রমাদিত্য বয়সে পঞ্চাশোধর্ব্বগত হইলেও অদ্যাপি যুবরাজ। অতিবৃদ্ধ পিতা এখনও সিংহাসনে আসীন, তাই তিনি যুবরাজ অবস্থাতেই বিক্রমাদিত্য উপাধি ধারণ করিয়াছেন। অতিশয় দুর্মদ বীর; অনেকগুলি মহিষীর স্বামী। কিন্তু লক্ষ্মীকর্ণের নিকট গোপন ইঙ্গিত পাইয়া স্বয়ংবর সভায় আসিয়াছেন।
মহারাজ লক্ষ্মীকর্ণের ব্যস্ততা প্রত্যেক নূতন রাজার আগমনের সঙ্গে সঙ্গে বাড়িয়া যাইতেছে। তিনি দিবাভাগে অক্লান্তদেহে অতিথি সৎকার করিতেছেন এবং রাত্রিকালে অপর্যাপ্ত মদিরা সেবন ও ময়ূরমাংস ভক্ষণ করিয়া নিদ্রা যাইতেছেন। তবু শিল্পকর্মের কথা তিনি বিস্মৃত হন নাই, অবকাশ পাইলেই চট্ করিয়া গিয়া অনঙ্গের কাজকর্ম পরিদর্শন করিয়া আসিতেছেন।
অনঙ্গের শিল্পকর্ম শনৈঃ শনৈঃ অগ্রসর হইতেছে। সে ইচ্ছা করিয়াই মন্থর হস্তে কাজ করিতেছে; শীঘ্র কাজ শেষ করিলেও স্বয়ংবারের আগে ছাড়া পাওয়া যাইবে না। তাড়া কিসের? বান্ধুলির সহিত প্রত্যহ সাক্ষাৎ হইতেছে, বান্ধুলি বিগ্রহের সংবাদ আনিয়া দিতেছে। সমস্ত প্রস্তুত; এখন স্বয়ংবরের শুভলগ্ন উপস্থিত হইলেই হয়।
অনঙ্গ বাঁশের চঞ্চারি দিয়া একটি বৃহৎ খাঁচা তৈয়ার করিয়াছে; ইহা মূর্তির নিম্নাঙ্গ। খাঁচার অধোভাগ শূন্য, শুধু চারিপাশে ঘন কঞ্চির বেড়া, তাহার উপর মৃত্তিকার লঘু প্রলেপ। এই নিম্নাঙ্গ দেখিয়া মনে হয় মূর্তি উচ্চ আসনের উপর উপবিষ্ট রহিয়াছে। মূর্তির উর্ধ্বাঙ্গ ও হস্তদ্বয় বেত্র দিয়া নির্মিত হইয়াছে; অঙ্গে রঞ্জিত পট্টতন্তুর বড় বড় লোম। এখনও স্কন্ধের উপর মুণ্ড বসে নাই; যখন বসিবে তখন কাহারও বুঝিতে বাকি থাকিবে না যে মগধের যুবরাজ বিগ্রহপাল একটি মর্কট।
বান্ধুলি অনঙ্গের খাবার লইয়া আসে, অনঙ্গ খাইতে বসিলে ব্যাকুলনেত্রে তাহার মুখের পানে চাহিয়া থাকে। যত দিন যাইতেছে তাহার মনের উদ্বেগ ততই বাড়িয়া যাইতেছে। কী হইবে? শেষ রক্ষা হইবে তো! এই সব কথা ভাবিতে ভাবিতে তাহার মন দিশাহারা হইয়া যায়। অথচ অনঙ্গ সম্পূর্ণ অটল, সম্পূর্ণ নিরুদ্বেগ; যেন তাহার কোনও দুশ্চিন্তাই নাই। বান্ধুলির ভয় ও দুশ্চিন্তা যখন অত্যন্ত বাড়িয়া যায় তখন তাহার দুই চোখে জল ভরিয়া ওঠে; ইচ্ছা হয় ওই অটল মানুষটির বুকে মুখ গুঁজিয়া সমস্ত জ্বালা যন্ত্রণা ভুলিয়া যায়। অনঙ্গ তাহার চোখের জল দেখিয়া হাসে, মুখের কাছে মিষ্টান্ন লইয়া গিয়া বলে— ‘কেঁদো না, চন্দ্রপুলি খাও।’
নগরের মাঝখানে রন্তিদেবের গৃহে বিগ্রহপাল পিঞ্জরনিবদ্ধ বন্য ব্যাঘ্রের ন্যায় পরিক্রমণ করিতেছেন। দিনগুলি তাঁহার পিঞ্জরের লৌহ শলাকা; একটি একটি করিয়া খসিয়া পড়িতেছে বটে, কিন্তু যতদিন সবগুলি না খসিবে ততদিন তাঁহার উদ্ধার নাই। প্রত্যহ নদীতীরে যৌবনশ্রীর সহিত সাক্ষাৎ হইতেছে, কিন্তু এ যেন প্রকৃত মিলন নয়; দুইজনের মাঝখানে অদৃশ্য পিঞ্জরের শলাকা ব্যবধান রচনা করিয়াছে। অধীরতা দূর হইতেছে না। রন্তিদেব নানাভাবে তাঁহাকে প্রবোধ দিবার চেষ্টা করিতেছেন, নববল পাশা ইত্যাদি খেলার দ্বারা চিত্ত বিক্ষিপ্ত করিবার প্রয়াস পাইতেছেন, কিন্তু বিশেষ ফল হইতেছে না।
লম্বোদরের গৃহে বেতসীর দেহ-মনে যেন স্বাস্থ্য ও স্ফুর্তির জোয়ার আসিয়াছে। দিনে দিনে সা পরিবর্ধমানা। ওই বেঁটে খাঁদা বর্তুলচক্ষু লোকটিকে সে ভালবাসে; কেন এত ভালবাসে সে নিজেই জানে না। স্বামী বলিয়াই যে ভালবাসে তাহা নয়; নিতান্তই অহৈতুকী প্রীতি, রূপগুণের অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু ভালবাসা চায়। প্রীতির ক্ষেত্রে শুধু দিয়া সুখ নাই, পাওয়াও চাই; তবে মন ভরে। তাই হারানো ভালবাসা ফিরিয়া পাইবার আশায় বেতসী নববর্ষা সমাগমে কদম্বপুষ্পের ন্যায় রোমাঞ্চিত হইয়া উঠিয়াছে।
লম্বোদরের মানসিক অবস্থা একটু অন্য প্রকার। সে যখন বেতসীকে খরচের খাতায় লিখিয়াছিল তখন তাহার মন স্বভাবতই বান্ধুলির প্রতি আকৃষ্ট হইয়াছিল। কিন্তু এখন পুনরুজ্জীবিতা বেতসী আবার তাহাকে টানিতেছে। অথচ বান্ধুলির লোভও সে ছাড়িতে পারিতেছে না। হিন্দোলার মত তাহার মন দুইজনের মাঝখানে দোল খাইতেছে। নিতান্তই বাহিরের কাজে তাহার মন গ্রস্ত হইয়া আছে তাই সে নিজের কথা ভাল করিয়া ভাবিতে পারিতেছে না; এই স্বয়ংবরটা চুকিয়া গেলেই সে ঘরোয়া সমস্যার নিষ্পত্তি করিবে।
ওদিকে রাজপুরীতে এখন প্রায় অষ্টপ্রহরই বাঁশি বাজিতেছে। উৎসবের উত্তেজনা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাইতেছে।
জাতবর্মা শ্বশুরের সঙ্গে গিয়া সমাগত রাজন্যবর্গের সহিত মিষ্টালাপ করিয়া আসিতেছেন। কিন্তু এই কপটতায় তাঁহার চিত্তে সুখ নাই। স্বয়ংবর সভায় যে ব্যাপার ঘটিবে তাহার ফল যেরূপই হোক, জাতবর্মা যে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত আছেন তাহা প্রকাশ পাইবার সম্ভাবনা আছে। শ্বশুর মহাশয় লোক ভাল নয়। তিনি জানিতে পারিয়া কিরূপ মূর্তি ধারণ করিবেন তাহা চিন্তা করিয়া জাতবর্মা মনে মনে একটু উদ্বেগ ও অস্বাচ্ছন্দ্য অনুভব করিতেছেন। বীরশ্রী কিন্তু স্ত্রীজাতি, ছলনা কপটতা তাঁহার সহজাত; তাই তিনি উদ্বেগ অপেক্ষা উত্তেজনাই অধিক অনুভব করিতেছেন।
যৌবনশ্রীর মন উদ্বেগ উত্তেজনা ও অনিশ্চিতের সংশয়ে নিরন্তর দোল খাইতেছে। রাত্রে নিদ্রা আসে না, আসিলে শেষ রাত্রে ভাঙ্গিয়া যায়; তখন দীর্ঘকাল অন্ধকার শূন্যপানে চাহিয়া থাকেন এবং দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করেন। তিনি দিনে দিনে শীর্ণা হইয়া যাইতেছেন। লুকাইয়া প্রেম করার অনেক জ্বালা।
আর আছেন অম্বিকা দেবী। রোগপঙ্গু বৃদ্ধা শয্যায় শুইয়া শুধু চিন্তা করেন। পুত্র কাছে আসে না, তাহাকে আদেশ বা তিরস্কার করিবার সুবিধা নাই। অম্বিকী দেবী মনে মনে গুমরিয়া আগ্নেয়গিরির গর্ভ-গহ্বরের ন্যায় তপ্ত হইতে থাকেন। নাতিনীকে বুকে লইয়া সত্ত্বনা দেন— ‘ভয় নেই, সব ঠিক হয়ে যাবে। তুই আমার নাতনী, গাঙ্গেয়দেবের নাতনী; তোকে জোর করে বিয়ে দেবে এমন সাধ্য তোর বাপের নেই। যদি তা করে আমি দেশসুদ্ধ লোককে ক্ষেপিয়ে দেব, প্রজারা ডিম্ব করবে—’
যৌবনশ্রী মনে মনে ভাবেন আমার প্রিয়তমকে যদি না পাই, প্রজারা ডিম্ব করিলে কী লাভ হইবে!
এইভাবে দিবারাত্র কাটিতেছে। রাজপুরীর অন্য সকলে আনন্দে মগ্ন, কেবল যে চারিজন গূঢ়তত্ত্ব জানেন তাঁহাদের মনে আশঙ্কার ছায়া। প্রদীপের নীচে অন্ধকার।