চতুর্থ পরিচ্ছেদ – এক
পূর্ণিমার রাত্রি শেষ হইয়া নূতন দিন আরম্ভ হইতেছে। ত্রিপুরী নগরীর নরনারীরা জাগিয়া উঠিতে আরম্ভ করিল। আমাদের পরিচিত কয়েকজনেরও একে একে নিদ্রাভঙ্গ হইতেছে।
লম্বোদরের গৃহে প্রথম ঘুম ভাঙ্গিল লম্বোদরের। সে উঠিয়া নদীতীরে গেল। তখনও একটু ঘোর-ঘোর আছে। নদীতীর হইতে ফিরিয়া লম্বোদর বস্ত্রাদি পরিবর্তন করিল। রাত্রে এক মুঠি চণক ভিজানো ছিল তাঁহাই গুড় সহযোগে ভক্ষণ করিল। ঘরের মধ্যে আলো ফুটিতে আরম্ভ করিয়াছিল, সে দেখিল বেতসীরও ঘুম ভাঙ্গিয়াছে; বেতসী শয্যায় শুইয়া শুইয়া তাহাকে দেখিতেছে। চোখে চোখে পড়িতে বেতসী একটু হাসিল।
লম্বোদর বেতসীর খট্বার উপর ঝুঁকিয়া মৃদুস্বরে বলিল— ‘আমি বেরুচ্ছি। তুমি অতিথিটিকে দেখো।’
সে তাড়াতাড়ি বাহির হইয়া গেল। বেতসী আরও কিছুক্ষণ শুইয়া রহিল, তারপর আলস্য ভাঙ্গিয়া উঠিয়া বসিল। আজ তাহার শরীর-মন যেন অনেকটা স্বচ্ছন্দ মনে হইতেছে। গৃহে অতিথি, তাহার পরিচর্যা করিতে হইবে। বান্ধুলি তো এখনি রাজবাটী চলিয়া যাইবে। লম্বোদর কখন ফিরিবে স্থির নাই। অন্যদিন দাসী না আসা পর্যন্ত সে শয্যায় পড়িয়া থাকে, আজ ধীরে ধীরে উঠিয়া পড়িল। সংসারের সব কাজ তো দাসীকে দিয়া হয় না। —
গৃহের আর একটি ঘরে বান্ধুলির ঘুম ভাঙ্গিয়াছিল। চোখ মেলিয়া সে কিছুক্ষণ শূন্যে চাহিয়া রহিল। কাল রাত্রে অনেকখানি হাসি বুকে লইয়া সে ঘুমাইয়াছিল; হাসিও তাহার সঙ্গে সঙ্গে ঘুমাইয়াছিল, আবার তাহার জাগার সঙ্গে সঙ্গে জাগিয়া উঠিয়াছে। কিন্তু কিসের জন্য হাসি? দিদিরানী আসিয়াছেন তাই কি? হঠাৎ মনে পড়িল। অতিথি! মজার অতিথি!…কিন্তু এখনই রাজপুরীতে যাইতে হইবে। অতিথি কি জাগিয়াছে? বান্ধুলি শয্যায় উঠিয়া বসিল।
বাহিরের ঘরে অতিথি তখনও ঘুমাইতেছিল। কাল অনেক রাত্রি পর্যন্ত সাগর-সেঁচা ঊর্বশী সম্বন্ধে জল্পনা কল্পনা করিতে করিতে অনঙ্গ নিদ্রা গিয়াছিল, এখনও ঘুম ভাঙ্গে নাই। কিছুক্ষণ পরে বান্ধুলি যখন রাজবাটী যাইবার জন্য বাহির হইল তখন সে বহিঃকক্ষের সম্মুখ দিয়া যাইবার সময় বন্ধ দ্বারের কাছে একবার থমকিয়া দাঁড়াইল; কান পাতিয়া শুনিল, কিন্তু কিছু শুনিতে পাইল না। তখন সে গৃহ হইতে নির্গত হইল। এতক্ষণে বাহিরে বেশ আলো ফুটিয়াছে। —
রাজভবনের বাতায়ন পথেও রবিরশ্মির সোনার কাঠি প্রবেশ করিয়াছিল, ঘরে ঘরে ঘুমন্ত মুখের উপর পড়িয়াছিল।
বীরশ্রী ও যৌবনশ্রী একটি শয্যায় মুখামুখি শুইয়া ঘুমাইতেছেন। যৌবনশ্রীর ঘুম একটু তরল হইল। তিনি চোখ মেলিয়া দেখিলেন দিদির চক্ষু দুটি তখনও মুদিত। তিনি আবার চক্ষু মুদিলেন। কিছুক্ষণ পরে বীরশ্রী চক্ষু মেলিলেন, যৌবনশ্রীর চক্ষু মুদিত দেখিয়া তিনি আবার চক্ষু মুদিলেন। তারপর দুই বোন একসঙ্গে চক্ষু মেলিলেন। দু’জনের চোখে আলস্য-ভরা হাসি ফুটিল। —
আর একটি কক্ষে বিশাল শয্যার উপর জাতবর্মা নিদ্রিত। ঘুমের ঘোরে তিনি পাশের দিকে হাতড়াইলেন কিন্তু কিছুই না পাইয়া চক্ষু খুলিলেন। অপরিচিত শয্যা, বীরা শয্যায় নাই; তিনি বিস্মিত হইয়া উঠিয়া বসিলেন। তারপর সব মনে পড়িয়া গেল। —
রাজভবনের অন্য প্রান্তে আর একটি কক্ষে পালঙ্কের উপর মহারাজ লক্ষ্মীকর্ণের দেহ রণক্ষেত্রে নিহত ঘটোৎকচের মত পড়িয়া ছিল; তাঁহার নাসারন্ধ্র হইতে ঘোর সিংহনাদ নিঃসৃত হইতেছিল। একজন কিঙ্করী পদপ্রান্তে বসিয়া পদসেবা করিতেছিল। লক্ষ্মীকর্ণ সহসা পা ঝাড়া দিলেন, পদসেবিকা ছিট্কাইয়া নীচে পড়িল। মহারাজ তখন পাশ ফিরিয়া শুইয়া আবার নাসিকাধ্বনি করিতে লাগিলেন। দাসী উঠিয়া আবার মহারাজের পা কোলে তুলিয়া লইল। মহারাজ যখন পা ঝাড়া দিয়াছেন তখন শীঘ্রই গা ঝাড়া দিবেন এরূপ আশা করা অন্যায় হইবে না। —
রাজপুরীর মধ্যে কেবল অম্বিকা দেবী নিজ কক্ষের দ্বারের দিকে চক্ষু পাতিয়া বিনিদ্র চাহিয়া ছিলেন। রোগীর ঘুম কখন আসে কখন যায়; তিনি মধ্যরাত্রির পর আর ঘুমান নাই। কখন ভোর হইবে, কখন নাতিনীরা তাঁহার কাছে আসিবে এই আশায় পথ চাহিয়া ছিলেন। —
রাজপুরী হইতে দূরে নগরের কেন্দ্রস্থলে গ্রহাচার্য রন্তিদেবের গৃহে যুবরাজ বিগ্রহপালের ঘুম ভাঙ্গিয়াছিল। প্রথমেই তাঁহার চোখের সম্মুখে ভাসিয়া উঠিল যৌবনশ্রীর মুখখানি। তিনি সহর্ষে আলস্য ভাঙ্গিয়া উঠিয়া বসিলেন। তারপর মনে পড়িয়া গেল, কাল রাত্রে অনঙ্গ আসে নাই। কোথায় গেল অনঙ্গ!
অনঙ্গ কোথাও যায় নাই, সে তখনও ঘুমাইতেছে। কিন্তু তাহাকে আর বেশিক্ষণ ঘুমাইতে হইল না, দ্বারে ঠক্ ঠক্ শব্দ শুনিয়া তাহার নিদ্রাভঙ্গ হইল। চকিতে উঠিয়া আলুথালু বেশবাস সম্বরণ করিতে করিতে সে গিয়া দ্বার খুলিল।
দ্বার খুলিয়া কিন্তু নিরাশ হইল। যাহাকে দেখিবে আশা করিয়াছিল সে নয়, এ অন্য মেয়ে। কৃশাঙ্গী রোগমলিন মুখশ্রী তবু কাল রাত্রির সেই নধরকান্তি যুবতীর সহিত যথেষ্ট সাদৃশ্য আছে। নিশ্চয় লম্বোদরের রুগ্না কুটুম্বিনী।
অনঙ্গ চট্ করিয়া কর্তব্য স্থির করিয়া ফেলিল। মুখে গদ্গদ আপ্যায়নের ভাব আনিয়া বলিল— ‘ক্ষমা করুন, আমার ঘুম ভাঙ্গতে বড় দেরি হয়ে গেছে। — আপনি গৃহস্বামীর স্বামিনী— কেমন?’
বেতসী মাথার উপর একটু আঁচল তুলিয়া দিয়া চক্ষু নত করিল, মৃদু স্বরে বলিল— ‘গৃহস্বামী কাজে বেরিয়েছেন, আমাকে অতিথির পরিচর্যা করতে বলে গেছেন।’
অনঙ্গ ব্যস্ত হইয়া বলিল— ‘সে কি কথা! আপনার শরীর অসুস্থ, আপনি পরিচর্যা করতে পারবেন কেন? বরং আপনার ভগিনী—’
বেতসী চোখ তুলিল— ‘সে রাজবাটীতে গেছে।’
অনঙ্গ কণ্ঠস্বরে নৈরাশ্য দমন করিয়া বলিল— ‘ও। সে বুঝি দিনের বেলা রাজবাটীতে থাকে?’
বেতসী বলিল— ‘রাত্রেও থাকে। কদাচ কখনও গৃহে আসে। আপনি হাত-মুখ ধুয়ে নিন, আমি আপনার জলপান তৈরি করে রেখেছি।’
‘আমি এখনই প্রস্তুত হয়ে নিচ্ছি।’
অল্পকাল পরে অনঙ্গ আহারে বসিল। কিছু ফলমূল, যবের শক্তুর সহিত দুগ্ধ-শর্করা মিশ্রিত কিছু মণ্ড, তিল ও গুড়ের পাক মিষ্টান্ন। অনঙ্গ পরম পরিতৃপ্তির সহিত আহার করিতে লাগল, বেতসী দ্বারের কাছে চৌকাঠ ঠেস দিয়া দাঁড়াইয়া রহিল।
অনঙ্গ বলিল— ‘আপনি রোগা মানুষ, দাঁড়িয়ে রইলেন কেন? বসুন।’
বেতসী দ্বার-পীঠিকার একপাশে বসিল। অতিথি বড় মিষ্টভাষী সজ্জন। কাল রাত্রে বেতসী অতিথিকে বুড়া মনে করিয়াছিল। মোটেই বুড়া নয়, কমকান্তি যুবা। তাহাকে দেখিলে তাহার কথা শুনিলে মন প্রীত হয়।
আহার করিতে করিতে অনঙ্গ বলিল— ‘আপনাদের নগর অতি সুন্দর। এখানে কেউ মাছ খায় না?’
বেতসী উৎসুক মুখ তুলিল— ‘মাছ?’
‘হাঁ। নর্মদায় মাছ আছে, আপনারা মাছ খান না?’
‘খাই। কিন্তু সব সময় পাই না।’
‘পান না কেন? জেলেরা মাছ ধরে না?’
‘ধরে। ডিঙায় চড়ে নদীতে জাল ফেলে মাছ ধরে, তারপর নদীর ঘাটে এনে বিক্রি করে। এখানে মাছের বাজার নেই। আমরা কালেভদ্রে মাছ খাই।’
অনঙ্গ গাঢ়স্বরে বলিল— ‘ভগিনি, তোমার শরীর দুর্বল, মাছ না খেলে শরীর সারবে কি করে? শুধু শাক-পাতা খেলে কি স্বাস্থ্য ভাল থাকে?’
বেতসীর অধরে হাসি ফুটিল। যে অতিথি ভগিনী বলিয়া সম্বোধন করে তাহার কাছে কতক্ষণ গম্ভীর হইয়া থাকা যায়! সে স্মিতমুখে বলিল— ‘আপনি বুঝি মাছ খেতে ভালবাসেন?’
অনঙ্গ বলিল— ‘খেতে ভালবাসি এবং খাওয়াতে ভালবাসি। তোমাকে মাছ রেঁধে খাওয়াব। তিন দিন খেলে তোমার দুর্বলতা দেশ ছেড়ে পালাবে।’
বেতসী বলিল— ‘আমি আজই দাসীকে মাছের সন্ধানে পাঠাব—’
অনঙ্গ হাত নাড়িয়া বলিল— ‘কোনও প্রয়োজন নেই। আমি মাছ সংগ্রহ করব। আজ আর হবে না। আজ আমাকে তৈজসপত্র আনতে যেতে হবে।’
‘দ্বিপ্রহরে ফিরবেন তো?’
‘ফিরব। আমার জন্য বেশি কিছু রেঁধো না, আজ দুটি তণ্ডুল আর ঘৃত হলেই চলে যাবে।’
জলপান সমাধা করিয়া অনঙ্গ উঠিল। তারপর ঘোড়ায় চড়িয়া বাহির হইল। বেতসী দ্বারের কাছে দাঁড়াইয়া অনেকক্ষণ চাহিয়া রহিল। আজ তাহার রুগ্ন দেহে ক্লান্তি আসিল না।
অনঙ্গ যখন রন্তিদেবের গৃহে পৌঁছিল তখন বেলা বাড়িয়াছে। দ্বিতলের অলিন্দে নাপিত বিগ্রহপালের ক্ষৌরকর্ম করিয়া দিতেছে। অনঙ্গও বসিয়া গেল।
নাপিতের সম্মুখে কোনও কথা হইল না। সে বিদায় লইলে অনঙ্গ বলিল— ‘আমার নাম মধুকর সাধু।’
বিগ্রহ বলিলেন— ‘সাধু সাধু। আমি কাশীর বণিকপুত্র, নাম রণমল্ল। — কাল রাত্রে তুই কোথায় ছিলি?’
‘গৃহস্থ লম্বোদরের গৃহে’— বলিয়া অনঙ্গ কল্যকার ঘটনা বিবৃত করিল।
বিগ্রহ উচ্চহাস্য করিলেন— ‘বাঘের ঘরে ঘোগের বসতি!— যা হোক, আর ওদিকে যাস্নি।’
অনঙ্গ মাথা নাড়িল— ‘না, যেতে হবে। একটা সূত্র পাওয়া গেছে, ছাড়া চলবে না।’
রন্তিদেব আসিয়া আলাপে যোগ দিলেন, বলিলেন— ‘কি সূত্র?’
অনঙ্গ হাসিয়া বলিল— ‘বড় সূক্ষ্ম সূত্র, টানাটানি করলে ছিঁড়ে যাবে। — আর্য রন্তিদেব, আপনার ঘোড়াটা ফিরিয়ে এনেছি। ওটা আমি আর চড়ব না! আমি আপনার ঘোড়া চড়ে বেড়াচ্ছি যদি গুপ্তচর চিনতে পারে গণ্ডগোল বাধবে।’
রন্তিদেব বলিলেন— ‘সে কথা ঠিক। কিন্তু ঘোড়া তো তোমাদের দরকার।’
বিগ্রহ জিজ্ঞাসা করিলেন— ‘এখানে ঘোড়া কিনতে পাওয়া যায় না?’
রন্তিদেব বলিলেন— ‘পাওয়া যায়। বানায়ু দেশ থেকে সম্প্রতি একদল বণিক অনেক ঘোড়া এনেছে। উৎকৃষ্ট ঘোড়া।’
বিগ্রহ বলিলেন— ‘তাহলে আর কথা কি! আজি বৈকালে গিয়ে দুটো ঘোড়া কিনলেই হবে।’
রন্তিদেব বলিলেন— ‘ভাল। আমি আমার ঘোড়াডোমকে তোমাদের সঙ্গে দেব, তোমরা পছন্দ করে ঘোড়া কিনো।’
তখন বিগ্রহপাল বলিলেন— ‘আর্য রন্তিদেব, আমরা নিরাপদে ত্রিপুরীতে এসে পৌঁচেছি, আপনার গৃহে নিরাপদ আশ্রয় পেয়েছি। যতদূর মনে হয় কেউ সন্দেহ করে না। এখন বলুন কর্তব্য কি?’
রন্তিদেব বলিলেন— ‘বৎস, কাল রাত্রেও তুমি এই প্রশ্ন করেছিলে। তোমার প্রশ্ন শুনে আমি খড়ি পেতে প্রশ্ন-গণনা করেছিলাম।’
শ্রোতৃদ্বয়ের চোখের দৃষ্টি উৎসুক হইল—
‘কি পেলেন?’
রন্তিদেব একটু ইতস্তত করিয়া বলিলেন— ‘তোমার কার্যসিদ্ধি হবে, কিন্তু বর্তমানে কিছু বাধাবিঘ্ন আছে। পূর্ণ সিদ্ধিলাভ এখন হবে না।’
বিগ্রহপাল ব্যর্থতা-ভরা চক্ষে চাহিলেন— ‘কার্যসিদ্ধি হবে না।’
রন্তিদেব বলিলেন— ‘ভগ্নোদ্যম হয়ো না। এখন পূর্ণ সিদ্ধি না হলেও অন্তে সিদ্ধি অনিবার্য।’
কিছুক্ষণ তিনজনে নীরব রহিলেন। তারপর অনঙ্গ শান্তস্বরে বলিল— ‘দৈবের কথা বলা যায় না, যা ভবিতব্য তা হবেই। কিন্তু তাই বলে চুপ করে বসে থাকা যায় না।’
রন্তিদেব বলিলেন— ‘আমিও তাই বলি। ফল যাই হোক পূর্ণমাত্রায় চেষ্টা করতে হবে। আমার গণনা ভুলও হতে পারে। জন্ম মৃত্যু বিবাহ বলতে পারে না বরাহ।’
বিগ্রহপাল ক্ষণিক অবসাদ, কাটাইয়া উঠিলেন, বলিলেন— ‘যা হবার হবে। এখন কর্তব্য কি বলুন?’
রন্তিদেব কহিলেন— ‘প্রথম কর্তব্য রাজপুরীর সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করা।’
অনঙ্গ বলিল— ‘অবশ্য। কিন্তু আমি কিম্বা বিগ্রহ রাজপুরীতে গেলে ধরা পড়বার ভয়। অন্য কী উপায়ে রাজপুরীতে জাতবর্মা কিম্বা দেবী বীরশ্রীর সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করা যেতে পারে আপনি ভেবেছেন?’
রন্তিদেব ভাবিতে ভাবিতে বলিলেন— ‘আর কাউকে পাঠানো চলবে না, ষট্কর্ণে মন্ত্রভেদ।’ তারপর সহসা উদ্দীপ্ত হইয়া উঠিলেন— ‘আমি যেতে পারি! মুখে ছাই মেখে জটাজূট ধারণ করে যদি যাই, কেউ আমাকে চিনতে পারবে না। —’
অনঙ্গ হাসিয়া মাথা নাড়িল— ‘না আর্য, আপনাকে আর ষড়যন্ত্রের পাকে জড়ানো উচিত হবে না। এখন থেকে যা করবার আমরাই করব, আপনি নেপথ্যে থাকবেন।’
রন্তিদেব ক্ষুণ্ণস্বরে বলিলেন— ‘কিন্তু আর তো কোনও উপায় দেখছি না—’
অনঙ্গ বলিল— ‘একটা উপায় হতে পারে। আমি যার বাড়িতে আছি সে সম্ভবত রাজার গুপ্তচর। কিন্তু তার এক শ্যালী আছে, সে যৌবনশ্রীর তাম্বূলকরঙ্কবাহিনী। তাকে দিয়ে কাজ উদ্ধার হতে পারে।’
বিগ্রহ অনঙ্গের পানে কিছুক্ষণ চাহিয়া থাকিয়া প্রশ্ন করিলেন— ‘শ্যালিকাটি অনূঢ়া?’
অনঙ্গ মুচকি হাসিল— ‘তাই মনে হল।’
‘দেখতে কেমন?’
উত্তরে অনঙ্গ ইঙ্গিতপূর্ণ চোখ নাচাইল। তারপর রন্তিদেবকে বলিল— ‘আর্য, আপনি কি বলেন? চেষ্টা করতে পারি? অবশ্য খুব সতর্কভাবে চেষ্টা করতে হবে—’
অতঃপর তিনজনে দীর্ঘকাল আলাপ আলোচনা করিলেন। ক্রমে দ্বিপ্রহর সমাসন্ন দেখিয়া অনঙ্গ উঠিয়া পড়িল। নিজের প্রয়োজনীয় তৈজসপত্র একটি ভৃত্যের স্কন্ধে তুলিয়া পদব্রজে লম্বোদরের গৃহে ফিরিয়া চলিল।
দুই
রাজপুরীতে ঠাকুরানী কক্ষে পর্যঙ্কের উপর ঠাকুরানী শয়ান ছিলেন, তাঁহার দুই পাশে দুই নাতিনী। লক্ষ্মীকর্ণ জামাতাকে মাতৃদেবীর চরণ দর্শন করাইতে আসিয়াছিলেন, তাঁহারা প্রস্থান করিয়াছেন। যে দুইজন উপস্থায়িকা অম্বিকা দেবীর কাছে থাকে তাহাদের বিদায় করা হইয়াছে। বান্ধুলি রাজকুমারীদের পিছন পিছন ঘুরিতেছিল, বীরশ্রী তাহাকে বলিয়াছেন— ‘বান্ধুলি, তোর বাড়িতে অতিথ্ এসেছে বলছিলি, তা তুই ঘরে ফিরে যা। বেতসী একলা হয়তো পেরে উঠবে না।’ বান্ধুলির মন দোটানায় পড়িয়াছিল, ছুটি পাইয়া সে উৎসুকচিত্তে গৃহে ফিরিয়া গেল।
কক্ষ শূন্য হইলে ঠাকুরানী দুই নাতিনীর দিকে পর্যায়ক্রমে মন্থর চক্ষু ফিরাইলেন, বলিলেন— ‘এবার তোদের কথা শুনব। তার আগে একটা কাজের কথা বলে রাখি। আজ মাসের প্রথম দিন, আজ থেকে বিয়ের দিন পর্যন্ত যৌবনশ্রী মন্দিরে পূজা দিতে যাবে। নগরে যত মন্দির আছে সব মন্দিরে নিজে গিয়ে পূজা দেবে। রাজবংশের এই প্রথা।’
বীরশ্রী বলিলেন— ‘ঠিক তো, আমার মনে ছিল না। আমিও তো গিয়েছিলাম পূজা দিতে।’
অম্বিকা বলিলেন— ‘নগরের বাইরে নর্মদার উৎসমুখের কাছে ত্রিপুরেশ্বরীর দেউলেও পূজা দিতে যেতে হবে।’
বীরশ্রী বলিলেন— ‘হাঁ দিদি। আমি যৌবনাকে নিয়ে রথে চড়ে সব মন্দিরে পূজা দিয়ে আসব।’
অম্বিকা বলিলেন— ‘এবার তোদের কথা বল।’
তখন বীরশ্রী নৌকায় যাহা যাহা ঘটিয়াছিল এবং বিগ্রহপালের মুখে যাহা শুনিয়াছিলেন আনুপূর্বিক বর্ণনা করিলেন। শুনিয়া অম্বিকা কিয়ৎকাল অর্ধ-নিমীলিত নেত্রে নীরব রহিলেন, তারপর অস্ফুটস্বরে বলিলেন— ‘এই ব্যাপার! যুদ্ধে হেরে কর্ণ শপথ করেছিল, বিগ্রহপালকে স্বয়ংবর সভায় নিমন্ত্রণ করবে, সে শপথ ভঙ্গ করেছে! এখন সব বুঝতে পারছি। কর্ণের মনে পাপ আছে, অন্য কোনও রাজাকে জামাই করবে স্থির করেছে।’— যৌবনশ্রীর দিকে চক্ষু তুলিয়া বলিলেন— ‘তুই বিগ্রহপালিকে দেখেছিস। তাকে বিয়ে করতে চাস?’
যৌবনশ্রী অরুণাভ মুখখানি নত করিয়া রহিলেন, তাঁহার ললাটে বিন্দু বিন্দু স্বেদ দেখা দিল। বীরশ্রী তাঁহার পানে চাহিয়া মুখ টিপিয়া হাসিতে লাগিলেন। শেষে বলিলেন— ‘বিগ্রহ যদি স্বয়ংবর সভায় থাকেন তাহলে যৌবনা তাঁর গলাতেই মালা দেবে।’
ঠাকুরানীর স্তিমিত চক্ষু কৌতূহলী হইয়া উঠিল। তিনি বলিলেন— ‘সত্যি ওকে মনে ধরেছে? যৌবনা, আমার পানে চোখ তুলে তাকা। তোর চোখ দেখলেই বুঝতে পারব।’
যৌবনশ্রী চোখ তুলিবার চেষ্টা করিলেন কিন্তু চোখ অর্ধেক উঠিয়া আবার নামিয়া পড়িল। ঠাকুরানীর মুখে একটু হাসি ফুটিল, তিনি একটি নিশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন— ‘আচ্ছা বুঝেছি। তোরা এখন যা। আমি কর্ণকে ডেকে পাঠাচ্ছি।’
বীরশ্রী শঙ্কিত হইয়া বলিলেন— ‘বাবাকে এসব কথা যেন বোলো না দিদি।’
ঠাকুরানী বলিলেন— ‘আমি কিছুই বলব না। শুধু তাকে জিজ্ঞাসা করব কোন্ কোন্ রাজাকে স্বয়ংবরে ডেকেছে, মগধের যুবরাজকে নিমন্ত্রণ করেছে কিনা।’
বীরশ্রী ও যৌবনশ্রী আশ্বস্ত হইয়া ঠাকুরানীর কক্ষ হইতে নির্গত হইলেন।
জাতবর্মা নিজকক্ষে পিঞ্জরাবদ্ধ সিংহের ন্যায় একাকী পদচারণ করিতেছিলেন, পত্নী ও শ্যালিকা প্রবেশ করিলে তিনি বক্ষ বাহুবদ্ধ করিয়া তাঁহাদের সম্মুখে দাঁড়াইলেন। গম্ভীরকণ্ঠে প্রশ্ন করিলেন— ‘বলতে পার আমি শ্বশুরালয়ে এসেছি, না কারাগারে এসেছি?’
বীরশ্রীও গম্ভীর হইয়া বলিলেন— ‘তুমি কারাগারে এসেছ। আমরা দু’জন তোমার রক্ষী।’
জাতবর্মা বলিলেন— ‘চমৎকার রক্ষী! সারারাত্রি দেখা নেই।’
বীরশ্রী বলিলেন— ‘বন্দী কি রক্ষীদের দেখতে পায়! রক্ষীরা আড়াল থেকে বন্দীর ওপর নজর রাখে।’
জাতবর্মা যৌবনশ্রীর প্রতি কটাক্ষ করিয়া বলিলেন— ‘ভাল কথা। কিন্তু একটি বন্দীর পিছনে দুটি রক্ষী কেন? দ্বিতীয় বন্দীটাকে ধরতে পারছ না?’
জাতবর্মার সহিত যৌবনশ্রীর পরিহাসের সম্পর্ক, দু’জনের মধ্যে প্রীতিও যথেষ্ট আছে। কিন্তু যৌবনশ্রী রঙ্গ-রস সম্পূর্ণ উপভোগ করিলেও নিজে প্রগল্ভতা করিতে পারেন না, রসের কথা ঠোঁট পর্যন্ত আসিয়া আট্কাইয়া যায়। তিনি দিদির প্রতি দৃষ্টি ফিরাইয়া হাসিলেন। হাসির অর্থ তুমি উত্তর দাও।
বীরশ্রী বলিলেন— ‘দ্বিতীয় বন্দী কোথায় যে ধরব? কাল নদীর ঘাটে সেই শেষ দেখেছি।’
জাতবর্মা এবার হাসিলেন, বলিলেন— ‘ভেব না। সে যখন যৌবনশ্রীকে দেখেছে তখন তাকে কারাগারের বাইরে ঠেকিয়ে রাখাই শক্ত হবে। নিতান্তই শ্বশুর মহাশয়ের ভয়ে ঢুকে পড়তে পারছে না। — যৌবনশ্রী, তুমি অধীরা হয়ো না। দু’একদিনের মধ্যেই সে পাঁচিল ডিঙিয়ে এসে জুটবে।’
যৌবনশ্রী আর সেখানে দাঁড়াইলেন না, ভগিনী ও ভগিনীপতিকে একত্র রাখিয়া দ্বারের দিকে চলিলেন। সেখান হইতে একবার মুষ্টি তুলিয়া জাতবর্মাকে দেখাইলেন, তারপর দ্রুত অদৃশ্য হইয়া গেলেন।
ওদিকে মন্ত্রগৃহে মহারাজ তখন নিভৃতে নানা রাজকর্ম চালাইতেছেন। লম্বোদর তাহার বার্তা নিবেদন করিয়াছে। নৌকায় আগত লোকটা সম্ভবত নিরীহ; বিশেষত যে যখন লম্বোদরের গৃহেই উঠিয়াছে তখন তাহার সম্বন্ধে নিশ্চিন্ত হওয়া যাইতে পারে। লক্ষ্মীকর্ণ লম্বোদরকে অন্য গুহ্য কর্মে নিয়োগ করিলেন। স্বয়ংবর ব্যপদেশে রাজধানীতে নানা লোক আসিতেছে, শীঘ্রই রাজারা আসিতে আরম্ভ করিবেন। সুতরাং গুপ্তচর সম্প্রদায়ের ব্যস্ততার অন্ত নাই।
লম্বোদর প্রস্থান করিলে লক্ষ্মীকর্ণ কিছুক্ষণ একাকী বসিয়া তাম্বূল চর্বণ করিলেন। শিল্পাগারে রাজশিল্পী যে শিল্পকর্মটি আরম্ভ করিয়াছে রাজার মন সেইদিকে প্রক্ষিপ্ত হইল। শিল্পী কী করিতেছে তাহা রাজা ভিন্ন আর কেহ জানে না, শিল্পাগারে অন্য সকলের প্রবেশ নিষেধ। কিন্তু শিল্পীর কর্ম রাজার মনোমত হইতেছে না। তিনি ঠিক যাহা চান তাহা হইতেছে না।
শিল্পাগার রাজভবনেরই একটি অংশ। রাজা উঠিয়া শিল্পাগারের দিকে চলিলেন।
এই সময় অন্তঃপুরের এক দাসী আসিয়া নিবেদন করিল, অম্বিকা দেবী পুত্রকে স্মরণ করিয়াছেন। মহারাজ ভ্রূকুটি করিলেন, চক্ষু ঘূর্ণিত করিলেন; তারপর বলিলেন— ‘দু’দণ্ড আগে মাতৃদেবীর চরণ দর্শন করেছি, আবার কী প্রয়োজন? বল গিয়ে আমি রাজকার্যে ব্যস্ত আছি, পুনরায় মাতৃদেবীর চরণ দর্শন করবার অবকাশ নেই।’
গলার মধ্যে ঘুৎকার শব্দ করিয়া তিনি শিল্পাগার অভিমুখে চলিলেন।
তিন
অনঙ্গপাল লম্বোদরের গৃহে ফিরিয়া আসিল। ভৃত্য তাহার কক্ষে পেটরা পোট্টলি প্রভৃতি নামাইয়া রাখিলে তাহাকে কিছু পুরস্কার দিয়া বলিল— ‘আর্যকে বোলো আজ অপরাহ্ণে আমি আবার আসিব।’
ভৃত্য প্রস্থান করিলে অনঙ্গ নিজ কক্ষের বাহিরে আসিয়া ইতস্তত দৃষ্টি নিক্ষেপ করিল কিন্তু কাহাকেও দেখিতে পাইল না। গৃহে সাড়াশব্দ নাই। দাসী গৃহকর্ম সারিয়া প্রস্থান করিয়াছে, গৃহস্বামী এখনও ফিরিয়া আসে নাই; গৃহিণী সম্ভবত পাকশালায় রন্ধনে ব্যস্ত। গৃহের এই নিরাবিলতার মধ্যে যেন একটি শান্তিপূর্ণ প্রসন্নতা আছে।
অনঙ্গ তখন আবার কক্ষে প্রবেশ করিয়া দ্বার ভেজাইয়া দিল, পেটরা খুলিয়া নিজ দ্রব্যসামগ্রী দিয়া ঘর সাজাইতে প্রবৃত্ত হইল। নিজ ব্যবহার্য বস্ত্রাদির সঙ্গে ছিল কয়েকটি ক্ষুদ্র মৃৎপুত্তলি, রঙের পাত্র তুলিকা ইত্যাদি। দক্ষিণ দিকের গবাক্ষ খুলিয়া দিয়া অনঙ্গ শিল্পসামগ্রীগুলি তাহার নীচে মেঝেয় সাজাইয়া রাখিল। কিছু মৃত্তিকা সংগ্রহ করিতে হইবে। এই গবাক্ষের নীচে বসিয়া সে নূতন মূর্তি গড়িবে।
অতঃপর আর কোনও কাজ নাই। জঠরে ক্ষুধার উদ্রেক হইয়াছে দেখিয়া অনঙ্গ গামোছা কাঁধে ফেলিয়া নদীতে স্নান করিতে চলিল।
এখানে রেবার তীরে বাঁধা ঘাট নাই, কিন্তু উচ্চ পাড় ক্রমশ নিম্নগামী হইয়া নদীর জলে মিশিয়াছে। অনঙ্গ জলের কিনারায় নামিয়া আসিয়া এক তাল ভিজা মাটি হাতে তুলিয়া পরীক্ষা করিল। ভাল মাটি। কাঁকর নাই, ঈষৎ বালু মিশ্রিত লাল মাটি। এ মাটিতে ভাল মূর্তি গড়া যাইবে। অনঙ্গ নিশ্চিন্ত হইয়া নদীতে অবগাহন করিল।
ওদিকে বান্ধুলি ঘরে ফিরিয়াছিল। অতিথির ঘরের দ্বার বন্ধ রহিয়াছে। এখনও ঘুমাইতেছে নাকি? বান্ধুলি একটু ইতস্তত করিল, তারপর সন্তর্পণে কপাটের উপর করতল রাখিয়া অল্প ঠেলিল। দ্বার ঈষৎ খুলিল।
ভিতরে কেহ নাই, শয্যা শূন্য। কিন্তু জানলার নীচে ও কি! বান্ধুলি চমৎকৃত হইয়া গেল, নিজের অজ্ঞাতসারেই সে কক্ষে প্রবেশ করিল।
কী অপূর্ব মূর্তিগুলি! কোনটি লক্ষ্মীর মূর্তি, কোনটি সরস্বতীর; কার্তিক আছেন, গজানন আছেন; তাছাড়া বুদ্ধমূর্তি, যক্ষিণীমূর্তি। বিতস্তিপ্রমাণ মূর্তিগুলিতে বর্ণের সমাবেশই বা কি অপরূপ। সবগুলি যেন জীবন্ত।
বান্ধুলি কিছুক্ষণ উৎফুল্ল নেত্রে চাহিয়া রহিল, তারপর ছুটিয়া ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল।
গৃহের পশ্চাদ্ভাগে পাকশালা বা রসবতী। বেতসী উনানে আঢ়কী দাল চড়াইয়া দর্বীদ্বারা মন্থন করিতেছিল, বান্ধুলি ছুটিয়া গিয়া সেখানে উপস্থিত হইল। বলিল— ‘ও দিদি, দেখবি আয়, দেখবি আয়। কি সুন্দর পুতুল!’
বেতসী কৌতূহলী হইয়া বলিল— ‘পুতুল! কোথায় পুতুল?’
‘অতিথির ঘরে। শিগ্গির দেখবি আয়।’ বলিয়া বান্ধুলি ফিরিয়া চলিল।
বেতসী দর্বী হাতে লইয়াই তাহার পিছন পিছন চলিল। চলিতে চলিতে বলিল— ‘অতিথি কি ফিরে এসেছে নাকি?’
‘তা জানি না। ঘরে কেউ নেই।’
দুই ভগিনী অতিথির ঘরে প্রবেশ করিল। মূর্তিগুলি দেখিয়া বেতসীও মুগ্ধ হইয়া চাহিয়া রহিল। কুম্ভকার রচিত স্থূল হাতি-ঘোড়া নয়, অপরূপ শিল্পকৃতি। বেতসী সংহতকণ্ঠে বলিল— ‘সত্যি সুন্দর। বণিক বোধহয় পুতুলের ব্যবসা করে।’
বান্ধুলি বলিল— ‘পাশে রঙ তুলি রয়েছে। হয়তো নিজেই মূর্তি গড়ে। কারুকর।’
বেতসী বলিল— ‘তাই হবে। তল্পিতল্পা নিয়ে ফিরেছে দেখছি। কিন্তু গেল কোথায়?’
পিছন হইতে শব্দ হইল— ‘এই যে আমি। নর্মদাতে স্নান করতে গিয়েছিলাম।’
দুইজনে ফিরিয়া দেখিল— অতিথি। তাহার গায়ে ভিজা গামোছা জড়ানো, এক হাতে সিক্ত বস্ত্রের পিণ্ড, অন্য হাতে এক দলা কাদা। দুই বোন অপ্রস্তুত হইয়া পড়িল, বেতসী হাতের দর্বী পিছনে লুকাইল। অনঙ্গ কিন্তু লেশমাত্র অপ্রতিভ হইল না, মাটির দলা ভূমিতে রাখিয়া বলিল— ‘আমার পুতুল দেখছিলে? কেমন, ভাল নয়? এই কাদা এনেছি, আরও পুতুল গড়ব।’
দুই ভগিনী তির্যকভাবে দ্বারের দিকে চলিল। সেখানে পৌঁছিয়া বেতসী বলিল— ‘আমার রান্না তৈরি, এখনি দিচ্ছি।’
সে অদৃশ্য হইল। বান্ধুলিও তাহার অনুসরণ করিতেছিল, কিন্তু তৎপূর্বেই অনঙ্গ তাহাকে সম্বোধন করিল— ‘এই যে, তুমি রাজবাটী থেকে ফিরে এসেছ।’
বান্ধুলি জড়িতস্বরে বলিল— ‘হাঁ, দিদিরানী বললেন—’
অনঙ্গ বলিল— ‘আমি ভেবেছিলাম আজ রাত্রির আগে তোমার দেখা পাব না। দিদিরানী কে?’
বান্ধুলি বলিল— ‘বড় রাজকুমারী দেবী বীরশ্রী।’
‘ও— বড় রাজকুমারীর নাম বীরশ্রী। — আর তোমার নাম কি?’
বান্ধুলি থতমত খাইয়া বলিল— ‘বান্ধুলি।’
‘বান্ধুলি!’ অনঙ্গ ফিক করিয়া হাসিল— ‘সুন্দর নাম। আমার নাম কি জান? মধুকর।’
বান্ধুলি প্রথমে শ্লেষটা ধরিতে পারে নাই। তারপর তাহার মুখে যেন আবীর ছড়াইয়া পড়িল। বান্ধুলি আর মধুকর— ফুল আর ভোমরা। সে আর বাক্যব্যয় না করিয়া পলায়ন করিল। অতিথি হয়তো সরলভাবেই নিজের নাম বলিয়াছে, কিন্তু—
বান্ধুলি যখন রসবতীতে ফিরিয়া গেল তখন তাহার মুখে ভয়ভঙ্গুর হাসি লাগিয়া থাকিলেও বুক ঢিব ঢিব করিতেছে। বেতসী কিছু লক্ষ্য করিল না, থালিতে অন্ন-ব্যঞ্জন সাজাইতে সাজাইতে বলিল— ‘অতিথি লোকটি বেশ ভাল, না রে?’
বান্ধুলি বলিল— ‘হুঁ। তুই রোগা শরীর নিয়ে নিজেই সব রেঁধেছিস!’
বেতসী বলিল— ‘আজ আমার শরীর অনেক ভাল। তুই ফিরে আসবি তা কি জানতাম? তা এখনও তো অনেক কাজ বাকি, তুই কর না।’
‘কি করব বল।’
‘অতিথির ঘরে জল-ছাড়া দিয়ে পিঁড়ি পেতে দে, ঘটিতে কর্পূর-দেওয়া খাবার জল দে, ঝারিতে আচমনের জল দে, মুখশুদ্ধির পান-সুপারি সাজিয়ে রাখ। কাজ কি একটা!’
বান্ধুলিও কাজে লাগিয়া গেল। ছোট পিতলের শরাবে পান-সুপারি সাজাইয়া রাখিয়া জলের ঘটি লইয়া অতিথির ঘরে গেল। পরম সংযতভাবে দেহের বস্ত্রাদি সম্বরণ করিয়া মেঝেয় জল-ছড়া দিল; ঘরেই পিঁড়ি ছিল; তাহা পাতিয়া দিয়া জলের ঘটি পাশে রাখিল। অনঙ্গ খট্বার পাশে বসিয়া সপ্রশংস নেত্রে দেখিতে লাগিল।
‘তোমরা দুই বোন ভারি অতিথিবৎসলা। — গৃহস্বামী লম্বোদর ভদ্র এখনও আসেননি?’
বান্ধুলি উত্তর দিবার পূর্বেই বেতসী থালা লইয়া প্রবেশ করিল, পীঠিকার সম্মুখে থালা রাখিয়া বলিল— ‘গৃহস্বামীর কি সময়ের জ্ঞান আছে। রাজভৃত্য যে। কখন আসেন কখন যান তা দৈবজ্ঞও বলতে পারে না। — আসুন।’
অনঙ্গ পীঠিকায় বসিল। আহার্য শুধু ঘৃত-তণ্ডুল নয়; অড়রের দাল, শাক-শিম্বির ব্যঞ্জন, নিম্বের তিক্ত, তিন্তিড়ির অম্ল, দধি ও পর্পট। আহার্যগুলি পরিদর্শন করিয়া অনঙ্গ বলিল— ‘এ কি করেছ ভগিনী! এত অন্ন-ব্যঞ্জনের প্রয়োজন ছিল না। সামান্য শাক-তণ্ডুলই আমার পক্ষে যথেষ্ট।’
বেতসী প্রীতা হইয়া বলিল— ‘সে কি কথা, আপনি অতিথি। — বান্ধুলি, পাখা নিয়ে আয়।’
বান্ধুলি তালবৃন্তের পাখা আনিয়া দিল, বেতসী সম্মুখে বসিয়া থালার উপর পাখা নাড়িতে লাগিল। অনঙ্গ আহারে মন দিল। বান্ধুলি তাম্বূলের শরাব হস্তে দ্বারে ঠেস দিয়া দাঁড়াইয়া রহিল।
কিয়াৎকাল নীরবে কাটিবার পর বেতসী বলিল— ‘আপনি আমাকে ভগিনী বলে ডেকেছেন তাই জিজ্ঞাসা করতে সাহস করছি। আপনার দেশ কোথায় ভদ্র?’
অনঙ্গ বলিল— ‘আমার দেশ বঙ্গ-মগধ। আমি পাটলিপুত্রে বাস করি।’ বলিয়া লম্বোদরকে যেরূপ পরিচয় দিয়াছিল বেতসীকেও সেইরূপ দিল।
বেতসী জিজ্ঞাসা করিল— ‘পিতা-মাতা? দার-কুটুম্ব? সন্তান-সন্ততি?’
‘কেউ নেই। পৃথিবীতে আমি একা। তাই তো ভবঘুরের মত হেথা হোথা ঘুরে বেড়াই।’ বলিয়া অনঙ্গ সুগভীর নিশ্বাস মোচন করিল।
বেতসী সমবেদনাপূর্ণ মুখে চুপ করিয়া বসিয়া রহিল; বান্ধুলির চোখ ছলছল করিতে লাগিল। অনঙ্গ মুখে হাসি টানিয়া আনিয়া বলিল— ‘কিন্তু সংসারে কেঁদে কোনও লাভ নেই। আমি আমার শিল্পকলা নিয়ে আনন্দে আছি। তোমাদের মত সুখের সংসার যখন দেখি তখন ইচ্ছা হয় আবার সংসার পেতে বসি। পাটলিপুত্রে আমার ঘর-বাড়ি জমিজমা সব আছে, কেবল ভোগ করবার কেউ নেই।’ বলিয়া বান্ধুলির দিকে বৈরাগ্যপূর্ণ কটাক্ষপাত করিল।
ক্রমে আহার করিতে করিতে অনঙ্গের মুখ আবার প্রফুল্ল হইয়া উঠিল। সে বলিল— ‘কি মিষ্টি তোমার হাতের রান্না ভগিনী। তোমার বোনও কি তোমার মত রাঁধতে পারে?’
বেতসী বান্ধুলির দিকে তৃপ্তিপূর্ণ চক্ষে চাহিয়া বলিল— ‘পারে বইকি। তবে ও তো বেশি রাঁধে না, কুমারী যৌবনশ্রীর কাছে থাকে। ক্রমে শিখবে।’
আহারান্তে বান্ধুলির হাত হইতে পান লইয়া অনঙ্গ বলিল— ‘আমি এখন দু’দণ্ড বিশ্রাম করব, তারপর উঠে মূর্তি গড়তে আরম্ভ করব। তোমরা খাওয়া-দাওয়া সেরে নাও গিয়ে।’
বেতসী ও বান্ধুলি রসবতীতে গিয়া আহারে বসিল, আহার করিতে করিতে পরস্পরের পানে স্মিত চকিত কটাক্ষপাত করিতে লাগিল। অজ্ঞাত অখ্যাত শিল্পী কোথা হইতে আসিয়া তাহাদের জীবনে রঙ ফলাইতে আরম্ভ করিয়াছে; যে বীজ মাটির তলে অনাদৃত পড়িয়া ছিল তাহা অলক্ষিতে অঙ্কুরিত হইয়া উঠিতেছে। আশা— অস্পষ্ট অনির্দিষ্ট আশা; তবু বেতসীর কাছে তাহা যেন নব-জীবনের সঞ্জীবনমন্ত্র। আশা মানুষের মনে যে বর্ণাঢ্য চিত্র আঁকিতে পারে মর্ত্য শিল্পীর তাহা সাধ্যাতীত।
বেতসী ও বান্ধুলি আহার শেষ করিয়া উঠিলে লম্বোদর ফিরিল। ঝড়ের মত আসিয়া পিঁড়ি পাতিয়া বসিল, বলিল— ‘শিগ্গির খেতে দাও, এখনি আবার বেরুতে হবে।’
বান্ধুলি তাড়াতাড়ি অন্ন-ব্যঞ্জন আনিয়া দিল। বেতসী পাশে বসিয়া তাহার গায়ে পাখার বাতাস করিতে লাগিল। সঙ্কুচিত স্বরে বলিল— ‘একটু বিশ্রাম করবে না?’
‘সময় নেই’ বলিয়া লম্বোদর গোগ্রাসে গিলিতে আরম্ভ করিল। তাহার মন বাহিরে কাজের দিকে পড়িয়া ছিল; তবু সে অনুভব করিল গৃহে যেন কিছু ভাবান্তর ঘটিয়াছে। আহার্যের বৈচিত্র্য কিছু বেশি। সে একবার ঘাড় ফিরাইয়া বেতসীর পানে চাহিল; প্রত্যুত্তরে বেতসী একটু হাসিল। লম্বোদর আবছায়াভাবে মনের মধ্যে একটু বিস্ময় অনুভব করিল।
খাওয়া শেষ করিয়া মুখ প্রক্ষালন করিতে করিতে লম্বোদর বলিল— ‘অতিথি খেয়েছে?’
বেতসী তাহার হাতে পান দিয়া বলিল— ‘হাঁ। অতিথি নিজের তল্পিতল্পা নিয়ে এসেছে, এখন আহারের পর বিশ্রাম করছে।’
‘ভাল।’ আর কোনও কথা হইল না। লম্বোদর একবার বান্ধুলির দিকে সপ্রশ্ন দৃষ্টি নিক্ষেপ করিল, যেন প্রথম তাহাকে লক্ষ্য করিল। তারপর মুখে পান পুরিয়া ঊর্ধ্বশ্বাসে প্রস্থান করিল।
দুই বোন পরস্পর চাহিয়া হাসিল। লম্বোদরের এমনই স্বভাব। যখন ঘরে আসে মনটা বাহিরে রাখিয়া আসে।
বেতসী আজ অত্যধিক পরিশ্রম করিয়াছিল, সে এবার নিজ শয্যায় আশ্রয় লইল। বান্ধুলিকে বলিল— ‘আমি শুলাম, সন্ধ্যার আগে আর উঠছি না। তুই অতিথির দেখাশুনা করিস।’
‘আচ্ছা’ বলিয়া বান্ধুলি কিছুক্ষণ সেখানে ঘোরাঘুরি করিল, তারপর নিজের ঘরে গেল। দরজা একটু ফাঁক করিয়া রাখিয়া শয্যার পাশে বসিল। বালিশের তলে অশ্বত্থপত্রের আকারের একটি ক্ষুদ্র রূপার আদর্শ ছিল, সেটি মুখের সামনে ধরিয়া ঘুরাইয়া ফিরাইয়া দেখিতে লাগিল; শুধু নিজের চোখ দিয়া নয়, যেন আর একজনের চক্ষু দিয়া নিজেকে দেখিবার চেষ্টা করিল। কিন্তু সেই সঙ্গে তাহার কান বাহিরের দিকে সতর্ক হইয়া রহিল।
অনঙ্গ আহারের পর শয্যায় অঙ্গ প্রসারিত করিয়া তন্দ্রাচ্ছন্ন হইয়া পড়িয়াছিল। মস্তিষ্কের মধ্যে সূক্ষ্ম চিন্তার সূত্র লূতা-জাল বুনিতেছিল— মেয়েটা দেখিতে বড় সুন্দর, দেখিলেই লোভ হয়…কিন্তু তাহার স্বভাব-চরিত্র সম্বন্ধে কিছু না জানিয়া বেশি অগ্রসর হওয়া যায় না…বোধহয় ভারি সরলা…কিন্তু যে মেয়েরা অহরহ রাজকন্যার পার্শ্বে বিচরণ করে তাহারা কি সরল হইতে পারে?…রাজপুরীতে নিরন্তর প্রচ্ছন্ন প্রতিদ্বন্দ্বিতা, ঈর্ষা কৈতব চক্রান্ত, চক্রের মধ্যে চক্র…বান্ধুলি…নামটি যেন মধুক্ষরা…
দুই দণ্ড ঝিমাইয়া অনঙ্গ উঠিয়া বসিল। এবার মূর্তি গড়া আরম্ভ করিতে হইবে; পাটলিপুত্র ত্যাগ করার পর আর সে মূর্তি গড়ে নাই; মন বুভুক্ষিত হইয়া উঠিয়াছে। কিন্তু ঘরে জল নাই। সে উঠিয়া গিয়া দ্বার খুলিল, মুণ্ড বাড়াইয়া দেখিল অলিন্দে কেহ নাই। তখন সে গলা ঝাড়া দিয়া বলিল— ‘এহুম্—!’
বান্ধুলি নিজ কক্ষের দ্বার হইতে মুণ্ড বাহির করিয়া চাহিল। দু’জনের চোখাচোখি হইল, অধরে অনাহূত হাসি খেলিয়া গেল। অনঙ্গ বলিল— ‘একটু জল চাই।’
বান্ধুলি ঘাড় নাড়িল, তারপর ত্বরিতে রসবতী হইতে শীতল জল লইয়া অতিথির কক্ষে উপস্থিত হইল।
অনঙ্গ বান্ধুলির হাত হইতে ঘটি লইয়া কিছু জল আলগোছে গলায় ঢালিল, তারপর জানালার সম্মুখে গিয়া বসিল। ঘটির জলে দুই হাত ভিজাইয়া মাটির পিণ্ডটা তুলিয়া লইল, দুই হাতে তাহা চট্কাইতে লাগিল। বান্ধুলি ঘর হইতে চলিয়া যাইবার জন্য পা বাড়াইল, কিন্তু বেশি দূর যাইতে পারিল না, দ্বার পর্যন্ত গিয়া ইতস্তত করিতে লাগিল। অনঙ্গ আড়াচোখে তাহা লক্ষ্য করিয়া বলিল— ‘তোমার যদি অন্য কাজ না থাকে তুমি বসে আমার কাজ দেখ না।’
এই আমন্ত্রণটুকু বান্ধুলি লোলুপমনে কামনা করিতেছিল। শিল্পী কেমন করিয়া মূর্তি গড়ে তাহা জানিবার জন্য তাহার ঔৎসুক্যের সীমা ছিল না। সে দ্বিরুক্তি না করিয়া ফিরিয়া আসিল এবং অনঙ্গ হইতে কিছু দূরে একপাশে হাঁটু মুড়িয়া বসিল।
অনঙ্গ কাদা থাসিতে থাসিতে হাস্যমুখে বলিল— ‘কী মূর্তি গড়ব বলো?’
বান্ধুলি সলজ্জে চক্ষু নত করিল— ‘আমি জানি না।’
অনঙ্গ আর কিছু বলিল না, নিপুণ অঙ্গুলি দিয়া মৃৎপিণ্ড গড়িতে আরম্ভ করিল। বান্ধুলির মুখের দিকে তাকায় আর গড়ে। তারপর তালপত্রের ক্ষুরিকা দিয়া সন্তর্পণে মাটি চাঁছিয়া ফেলে। বান্ধুলিও কৌতূহলী চক্ষে চাহিয়া থাকে, কিন্তু অনঙ্গের অঙ্গুলির ফাঁকে ফাঁকে কী বস্তু প্রস্তুত হইতেছে তাহা ধরিতে পারে না। শিল্পীর কর্মতৎপর অঙ্গুলিগুলির দিক হইতে তাহার উৎসুক দৃষ্টি শিল্পীর মুখের দিকে সঞ্চারিত হয়, আবার অঙ্গুলির দিকে ফিরিয়া আসে। তাহার মনে হয় যেন সে চতুর মায়াবীর ইন্দ্রজাল দেখিতেছে।
অবশেষে অনঙ্গ মৃৎপিণ্ডটি বান্ধুলির মুখের কাছে ধরিয়া জিজ্ঞাসা করিল— ‘কার মুখ চিনতে পারো?’
বান্ধুলি রুদ্ধশ্বাসে দেখিল, তাহারই মুখ। নাক চোখ কপাল গণ্ড, কোনও প্রভেদ নাই। ভিজা মাটিতে তাহার মুখের ডৌল অবিকল ফুটিয়াছে। সে ব্যগ্রবিহ্বল কণ্ঠে বলিল— ‘আমি!’
অনঙ্গ হাসিতে হাসিতে মুখখানাকে আবার নিরবয়ব মৃৎপিণ্ডে পরিণত করিল, বলিল— ‘ভাল হয়নি। পরে তোমার মুখ আবার ভাল করে গড়ব।’
বান্ধুলি সম্মোহিতের ন্যায় বসিয়া দেখিতে লাগিল। অনঙ্গ তাল-সদৃশ মৃৎপিণ্ডকে তিন ভাগ করিয়া ছোট ছোট মূর্তি গড়িতে আরম্ভ করিল। এবার শুধু মুখ নয়, পুণাবয়ব মূর্তি। গড়িতে গড়িতে অনঙ্গ লঘুকণ্ঠে আলাপ করিতে লাগিল।
‘আমার গড়া পুতুল তোমার ভাল লেগেছে?’
‘এত সুন্দর পুতুল—’ বান্ধুলির কথা অসম্পূর্ণ রহিয়া গেল।
‘আমার পুতুল রাজকুমারীদের ভাল লাগবে?’
‘খুব ভাল লাগবে। এমন চমৎকার পুতুল রাজকুমারীরাও দেখেননি।’
অনঙ্গ কিছুক্ষন নীরবে কাজ করিল, তারপর বলিল— ‘আমি একটি ভাল পুতুল তৈরি করে তোমাকে দেব, তুমি সেটি রাজপুরীতে নিয়ে গিয়ে কুমার-ভট্টারিকাদের দেখাতে পারবে?’
বান্ধুলি সাগ্রহে বলিল— ‘পারব। ওঁরা দেখলে খুব প্রীতা হবেন। কবে আপনি পুতুল তৈরি করে দেবেন?’
তাহার আগ্রহ দেখিয়া অনঙ্গ হাসিল। সত্যই মেয়েটা সরলা। সে বলিল— ‘পুতুল তৈরি করে তাকে আগুনে পোড়াতে হবে, তারপর রঙ রসান চড়াতে হবে। দুই তিন দিন লাগবে।’—
এইভাবে তিন চারি দণ্ড কাটিয়া গেল। বান্ধুলির জড়তা ক্রমে কাটিয়া যাইতে লাগিল। অপরাহ্ণকাল উপস্থিত হইলে অনঙ্গ কাজ বন্ধ করিয়া উঠিল। বলিল— ‘আমাকে একবার বেরুতে হবে। সন্ধ্যার আগেই ফিরব।’
চার
বিগ্রহপাল প্রতীক্ষা করিতেছিলেন, অনঙ্গ উপস্থিত হইলে দুইজনে অশ্বক্রয়ের জন্য বাহির হইলেন। পদব্রজে চলিলেন; একজন ঘোড়াডোম কম্বল বল্গা প্রভৃতি পর্যয়ণ লইয়া তাঁহাদের পথ দেখাইয়া চলিল।
নগরের পশ্চিম প্রান্তে যেখানে লোকালয় শেষ হইয়া মাঠ আরম্ভ হইয়াছে সেইখানে বিস্তীর্ণ স্থান ঘিরিয়া ঘোড়ার আগড়। প্রায় ছয়-সাত শত অশ্ব এই বংশ-বেষ্টনীর মধ্যে আবদ্ধ আছে; অধিকাংশ অশ্বই মুক্ত অবস্থায় ঘুরিয়া বেড়াইতেছে, কয়েকটি বাঁধা আছে। লাল কালো সাদা নানা বর্ণের উৎকৃষ্ট তেজস্বী অশ্ব।
আগড়ের প্রবেশদ্বারের পাশে একটি শ্বেতবর্ণ বড় পট্টাবাস। তাহার চারিধারের যবনিকা খোলা রহিয়াছে; মাটিতে পুরু আস্তরণ পাতা। তিন চারিজন মানুষ বসিয়া আছে।
মানুষগুলিকে দেখিলেই চমক লাগে। যেমন তাঁহাদের বেশবাস, তেমনই আকৃতি। বিগ্রহ এবং অনঙ্গ নিকটবর্তী হইলে তাহারা পট্টাবাসের বাহিরে আসিয়া দাঁড়াইল। সকলেই দীর্ঘাঙ্গ, প্রাণসার মেদবর্জিত দেহ। পরিধানে আগুল্ফলম্বিত অঙ্গাবরণ মধ্যদেশে নীল কটিবন্ধ দ্বারা সম্বৃত; মস্তকে অবগুন্ঠনের ন্যায় আচ্ছাদন পৃষ্ঠে ও স্কন্ধে ঝুলিয়া পড়িয়াছে, কেবল মুখমণ্ডল অনাবৃত রহিয়াছে। মুখের বর্ণ যেমন তুষার-গৌর, মুখাস্থির গঠন তেমনি মর্মরদৃঢ়। নাসা তীক্ষ্ণোচ্চ, গণ্ড ও চিবুকের চর্ম অল্প কেশাকৃত। ইহারা যে ভারতবর্ষের লোক নয় তাহা ইহাদের দর্শনমাত্রেই বুঝিতে পারা যায়।
ইহাদের মধ্যে একজন অপেক্ষাকৃত বয়স্থ ব্যক্তি ছিল, বিগ্রহ ও অনঙ্গ সম্মুখীন হইলে সে নিজে বুকের কাছে মুক্ত করতল তুলিয়া অভিবাদন করিল, ভাঙ্গা ভাঙ্গা অবহট্ট ভাষায় বলিল— ‘শান্তি হোক। আপনারা ঘোড়া কিনতে এসেছেন? আদেশ করুন।’
বিগ্রহ কিছুক্ষণ উৎসুক নেত্রে তাহাদের নিরীক্ষণ করিয়া বলিলেন— ‘হাঁ, আমরা ঘোড়া কিনতে এসেছি। আপনারা কোন্ দেশের লোক?’ বয়স্ক ব্যক্তির চোখের দৃষ্টি সতর্ক হইল। সে গম্ভীরমুখে বলিল— ‘আমরা আরব দেশের সওদাগর— বণিক।’
বিগ্রহ বলিলেন— ‘আরব দেশ— সে কোথায়?’
বণিক পশ্চিমদিকে বাহু প্রসারিত করিয়া বলিল— ‘এই দিকে। অনেক দূরে। বহু নদী পাহাড় মরুভূমি পার হয়ে যেতে হয়।’
‘ভাল। আমরা দুটি উৎকৃষ্ট ঘোড়া কিনতে চাই।’
‘আমার সব ঘোড়াই উৎকৃষ্ট, নিকৃষ্ট ঘোড়া নেই। আরব দেশ থেকে নিকৃষ্ট ঘোড়া আনলে আমাদের পোষায় না।’
‘ভাল। ঘোড়া দেখান।’
বণিক তখন বলিল— ‘আর একটা কথা। আমরা ঘোড়ার দাম সোনা ছাড়া অন্য কোনও মুদ্রায় নিই না।’
বিগ্রহ বলিলেন— ‘সোনাই পাবেন।’
অনঙ্গ এতক্ষণ নীরব ছিল, নীরবে এই বিদেশী বণিকদের পর্যবেক্ষণ করিতেছিল। তাহার মনে হইতেছিল, ইহাদের ভাবভঙ্গি বাহ্যত বণিকজনোচিত হইলেও সম্পূর্ণ সহজ ও স্বাভাবিক নয়। ইহারা সম্বৃতমন্ত্র ও সতর্ক, যেন সর্বদাই নিজেদের প্রকৃত স্বরূপ গোপন করিবার চেষ্টা করিতেছে। ঘোড়া বিক্রয় করাই ইহাদের একমাত্র উদ্দেশ্য নয়।
অনঙ্গ বলিল— ‘সোনা ছাড়া অন্য মুদ্রা নেবেন না। এর কারণ কি? অন্য ব্যবসায়ীরা তো নিয়ে থাকেন।’
বণিক চক্ষু কুঞ্চিত করিয়া কিছুক্ষণ অনঙ্গকে দেখিল— ‘হিন্দুস্তান স্বর্ণপ্রসূ, আরব দেশে সোনা নেই। উপরন্তু সোনা নিয়ে যাবার সুবিধা।’
অনঙ্গ বলিল— ‘তা বটে। আপনারা কি ভারতবর্ষের সর্বত্র যাতায়াত করেন?’
এই সময় বণিকের পাশের এক ব্যক্তি অবোধ্য ভাষায় কিছু বলিল; বণিক তাহার উত্তর না দিয়া শান্তকণ্ঠে বলিল— ‘আমরা অশ্ব-বণিক, অশ্ব বিক্রয় করবার জন্যই দেশ ছেড়ে এখানে আসি এবং যেখানে অশ্ব বিক্রয়ের সম্ভাবনা দেখি সেখানে যাই। সব অশ্ব বিক্রয় হলে দেশে ফিরে যাই।’
‘প্রতি বৎসর আসেন?’
‘দুই তিন বৎসরে আসি।’
‘উত্তম। এবার অশ্ব দেখান।’
‘আসুন।’
অর্গল খুলিয়া সকলে বেষ্টনীর মধ্যে প্রবেশ করিলেন। অশ্বগুলি এতক্ষণ যথেচ্ছা বিচরণ করিতেছিল, এখন তাহাদের মধ্যে যেন একটা সাড়া পড়িয়া গেল। যাহারা দূরে ছিল তাহারা মনোরম গ্রীবাভঙ্গি করিয়া ফিরিয়া তাকাইল। নিকটস্থ অশ্বগুলি কিছুক্ষণ ব্যায়তনেত্রে চাহিয়া থাকিয়া ধীরে ধীরে তাহাদের কাছে আসিতে লাগিল; কেহ কেহ নাসামধ্যে মৃদু হর্ষধ্বনি করিল। যে ঘোড়াগুলি বাঁধা ছিল— বোধহয় বণিকদের নিজস্ব ব্যবহারের ঘোড়া— তাহারা পদদাপ করিয়া আগ্রহ জ্ঞাপন করিল।
কয়েকটি ঘোড়া কাছে আসিলে বণিক মুখে একপ্রকার শব্দ করিল, ঘোড়াগুলি সঙ্গে সঙ্গে চিত্রার্পিতের ন্যায় দাঁড়াইয়া পড়িল। বণিক মুখে আর একপ্রকার শব্দ করিল, ঘোড়াগুলি তিন কদম পিছু সরিয়া স্থির হইয়া দাঁড়াইল। বণিক বলিল— ‘শিক্ষিত ঘোড়া। মানুষের মত বুদ্ধিমান, যা শেখাবেন তাই শিখবে।’
বিগ্রহ ও অনঙ্গ মুগ্ধভাবে ঘোড়াগুলির পানে চাহিয়া রহিলেন। তাঁহাদের যেমন সুঠাম আকৃতি, চোখের দৃষ্টিতে তেমনই বুদ্ধি জ্বলজ্বল করিতেছে। সহসা অনঙ্গ একটি দুগ্ধশুভ্র অশ্বের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়া বলিল— ‘দেখ্ দেখ্, ওর নাক দিয়ে যেন দিব্যজ্যোতি বেরুচ্ছে!’
বিগ্রহ হাসিয়া বলিলেন— ‘বেশ, তুই ওটা নে, নাম রাখিস দিব্যজ্যোতি।’
অনঙ্গ বলিল— না, তুই ওটা নে।’
‘বেশ।’ বলিয়া বিগ্রহ শ্বেত অশ্বটির কাছে গেলেন। তাহার কপালে হাত রাখিতেই সে স্নেহভরে হ্রেষাধ্বনি করিল।
বণিক বলিল— ‘আপনাকে ও প্রভু বলে স্বীকার করেছে। স্বীকার না করলে মুখ ফিরিয়ে নিত।’
বিগ্রহ বলিলেন— ‘ওর দিব্যজ্যোতি নামই রইল। — অনঙ্গ, তুই এবার নিজের ঘোড়া পছন্দ কর।’
‘আমি এই লাল ঘোড়াটা নিলাম’ বলিয়া অনঙ্গ একটি পাটলবর্ণ অশ্বের গ্রীবায় হাত রাখিল। অশ্ব মুখ ফিরাইয়া লইল না, বরং অনঙ্গের দিকে গ্রীবা বাঁকাইয়া নাসামধ্যে আনন্দধ্বনি করিল।
বিগ্রহ জিজ্ঞাসা করিলেন— ‘কি নাম রাখবি?’
অনঙ্গ বলিল— ‘রোহিতাশ্ব।’
অতঃপর বণিককে অশ্বের মূল্য জিজ্ঞাসা করিলে সে বলিল— ‘সাদা ঘোড়ার দাম দশ স্বর্ণ-দীনার, লাল ঘোড়ার দাম আট স্বর্ণ-দীনার।’
বিগ্রহ প্রশ্ন করিল— ‘দামে তফাৎ কেন?’
বণিক বলিল— ‘সাদা ঘোড়া রাজাদের বাহন, তাই দাম বেশি।’
তখন ঘোড়া দুটির মুখে বল্গা লাগাইয়া বেষ্টনীর বাহিরে আনা হইল। ঘোড়াডোম তাহাদের পিঠে পর্যয়ণ বাঁধিয়া দিল। বণিককে অশ্বের মূল্য দিয়া দুই বন্ধু ঘোড়ার পিঠে উঠিলেন।
এই সময় সূর্য দিগন্তরেখা স্পর্শ করিয়াছে। বণিক তাহা দেখিয়া একজন সঙ্গীকে ইঙ্গিত করিল; সঙ্গী পট্টাবাসের ভিতর হইতে একটি পট্টিকা আনিয়া মুক্ত আকাশের তলে বিছাইয়া দিল; তারপর সকলে তাহার উপর পশ্চিমাস্য হইয়া পাশাপাশি দাঁড়াইল। বিগ্রহ ও অনঙ্গ বিস্মিত হইয়া দেখিলেন তাহারা এক বিচিত্র প্রক্রিয়া আরম্ভ করিয়াছে। সকলে একসঙ্গে নতজানু হইতেছে, মাটিতে মাথা ঠেকাইতেছে, ঊরুতে হাত রাখিয়া ন্যুব্জ হইয়া দাঁড়াইতেছে। এবং সঙ্গে সঙ্গে অস্ফুটস্বরে অবোধ্য ভাষায় মন্ত্র পড়িতেছে।
অনঙ্গ ও বিগ্রহ বিস্ময়-বিমূঢ় দৃষ্টি বিনিময় করিলেন। ঘোড়াডোমটা বোধহয় এই বিদেশীদের আচার-ব্যবহার অবগত ছিল, সে চুপিচুপি বলিল— ‘ওরা পূজা করছে।’
পূজা! এ কি রকম পূজা? ফুল নাই, নৈবেদ্য নাই— পূজা! কিছুক্ষণ ইহাদের ক্রিয়া-কলাপ নিরীক্ষণ করিয়া বিগ্রহ ও অনঙ্গ ঘোড়ার মুখ ফিরাইয়া তাহাদের নগরের দিকে চালিত করিলেন। ঘোড়া দুটি কপোত-সঞ্চারী গতিতে যেন উড়িয়া চলিল।
চলিতে চলিতে অনঙ্গ একসময় বলিল— ‘বণিকদের ভাবগতিক খুব স্বাভাবিক নয়।’
বিগ্রহ বলিলেন— ‘বিদেশীদের আচার-আচরণ অস্বাভাবিক মনে হয়।’
‘আমি তা বলছি না। ঘোড়ার ব্যাপার করাই ওদের প্রধান উদ্দেশ্য মনে হয় না।’
‘প্রধান উদ্দেশ্য তবে কী?’
‘হয়তো গুপ্তচর বৃত্তি। পশ্চিমে বিধর্মী বর্বরজাতি ঢুকছে। এরা তাদের চর হতে পারে।’
বিগ্রহ হাসিয়া উঠিলেন— ‘তোর মন বড় সন্দিগ্ধ। সে যাক, এদিকের সংবাদ কি বল। তোর গৃহস্বামীর শ্যালিকাটি কি বেশ নাদুস নুদুস?’
অনঙ্গ বলিল— ‘নাদুস নুদুস নয়— ন্যগ্রোধপরিমণ্ডলা।’
দুই বন্ধু তখন হাস্য পরিহাসের ফাঁকে ফাঁকে কাজের কথা আলোচনা করিতে করিতে চলিলেন।
পাঁচ
তারপর একটি একটি করিয়া দিন কাটিতে লাগিল। নব-বসন্ত যেন একটি একটি করিয়া তাহার শতদল উন্মোচন করিতেছে।
কিন্তু বসন্তের এই নবোন্মীলনের প্রতি সকলের দৃষ্টি নাই। মহারাজ লক্ষ্মীকর্ণ অতিশয় ব্যস্ত। একদিকে স্বয়ংবর সভা নির্মাণ, অন্যদিকে প্রত্যাসন্ন রাজবৃন্দ ও তাঁহাদের পরিজনবর্গের জন্য স্কন্ধাবার মণ্ডপ রচনা, রাজাদের মনোরঞ্জনের জন্য নানাবিধ ক্রীড়াকৌতূক নৃত্যগীত বিলাসব্যসনের ব্যবস্থা। নর্মদার তীর ধরিয়া বস্ত্রনগরী গড়িয়া উঠিতেছে। লক্ষ্মীকর্ণ সমস্ত কার্য পরিদর্শন করিতেছেন, আবার চুপি চুপি শিল্পশালায় গিয়া গুপ্ত শিল্পকার্য দেখিয়া আসিতেছেন। শিল্পীকে ধমক দিতেছেন, মন্ত্রীদের তাড়না করিতেছেন, কর্মীদের গালাগালি দিতেছেন। কাহারও নিশ্বাস ফেলিবার অবসর নাই।
লম্বোদর ও তাহার অধীনস্থ চরগণও ব্যস্ত। তাহারা যেন সহস্রাক্ষ হইয়া চারিদিকে বিচরণ করিতেছে। কোন্ বণিক বিদিশা হইতে বিক্রয়ার্থ বহুসংখ্যক অসি আনিয়াছে, তাহার উপর দৃষ্টি রাখা প্রয়োজন। বিদিশার অসি অতি বিখ্যাত, এ অসি হাতে পাইলে কাপুরুষও সিংহ হয়। ওদিকে উজ্জয়িনী হইতে এক দল নট-নটী আসিয়া নগরের এক রম্যোদানে আসর বাঁধিয়াছে; দলে দলে নাগরিকেরা কালিদাসের মালবিকাগ্নিমিত্র ভবভূতির উত্তররাম মালতীমাধব বিশাখাদত্তের মুদ্রারাক্ষস অভিনয় দেখিতে যাইতেছে। কিন্তু যাযাবর নট-সম্প্রদায় সর্বকালেই রাজপুরুষদের সন্দেহভাজন, ইহাদের কোনও গোপন অভিসন্ধি আছে কিনা তাহার অনুসন্ধান আবশ্যক। লম্বোদর দ্বিপ্রহরে কখনও ঘরে আসে কখনও ঘরে আসে না; রাত্রিটুকু কোনও মতে ঘরে কাটাইয়া প্রভাত হইতে না হইতে চলিয়া যায়।
রাজপুরীর অবরোধ অংশে কিন্তু তেমন ব্যস্ততা নাই। ভরা নদীর মাঝখান দিয়া যখন খরস্রোত প্রবাহিত হয় নদীর দুই তীরে তখন সামান্য আবর্ত মাত্র দেখা যায়। বীরশ্রী ভগিনীকে লইয়া প্রত্যহ মন্দিরে মন্দিরে পূজা দিতে যান, এ ছাড়া অন্য কোনও তৎপরতা নাই। যৌবনশ্রীর আচরণ পূর্বের মতই ধীর ও শান্ত; কিন্তু ভাল করিয়া লক্ষ্য করিলে দেখা যায় চোখ দুটিতে যেন একটু চাঞ্চল্যের আবির্ভাব হইয়াছে। চোখ দুটি যেন সর্বদাই চকিত হইয়া আছে। যৌবনশ্রী মুখে কিছু বলেন না, কিন্তু বীরশ্রী তাঁহার চোখের প্রশ্ন শুনিতে পান— আবার কবে দেখা হবে? বীরশ্রী স্বামীকে গিয়া খোঁচা দেন— কোথায় গেল বিগ্রহ? তার সন্ধান নিতে হবে না?— জাতবর্মা কী উপায়ে বিগ্রহপালের সন্ধান করিবেন স্থির করিতে না পারিয়া শ্বশুরকে গিয়া বলিলেন— আমি নগরভ্রমণে যাব। শ্বশুর বলিলেন— ভাল, দশজন পার্শ্বচর রক্ষী সঙ্গে দিচ্ছি। জাতবর্মা হতাশ হইয়া পুনরায় অবরোধে ফিরিয়া আসেন। দশজন সঙ্গী লইয়া বিগ্রহপালকে খুঁজিতে বাহির হইলে নগরে কাহারও জানিতে বাকি থাকিবে না, সর্বাগ্রে শ্বশুর মহাশয় জানিতে পারিবেন। অণ্ড দ্রব হইয়া যাইবে।
রন্তিদেবের গৃহে বিগ্রহপালও ছটফট করিতেছেন। তীরে আসিয়াও তরী ঘাটে ভিড়িতেছে না। একবার দেখিয়া যাহার মূর্তি চিত্তপটে আঁকা হইয়া গিয়াছে সে যেন ছলনা করিয়াই আবার দেখা দিতেছে না। বিগ্রহপালের উষ্ণ নিশ্বাসে রন্তিদেবের গৃহমারুত আতপ্ত হইয়া উঠিল।
লম্বোদরের গৃহে কিন্তু শীতল মলয়ানিল বহিতেছিল, গৃহে যেন প্রচ্ছন্ন উৎসবের ছোঁয়া লাগিয়াছিল। অনঙ্গ নদীর ঘাট হইতে পাকা রুই মাছ আনিয়া রাই-সরিষার ঝাল রাঁধিয়া বেতসী ও বান্ধুলিকে খাওয়াইয়াছে। বেতসীর দেহ-মন হিমশীর্ণা লতার ন্যায় কিশলয়-রোমাঞ্চিত হইয়া উঠিতেছে। এখনও বাহিরে কিছু দেখা যায় না; কিন্তু তাহার প্রাণে আশা জাগিয়াছে, আকাঙ্ক্ষা জাগিয়াছে জীবনের শত ক্ষুদ্র সুখ ভোগ করিবার স্পৃহা জন্মিয়াছে। অনঙ্গ কি ইন্দ্রজাল জানে? কেবলমাত্র তাহার আবির্ভাবেই যেন বেতসীর জীবনের নিম্নগামী ধারা অবরুদ্ধ হইয়াছে।
আর বান্ধুলি? যেন জন্মান্ধ যুবতী হঠাৎ একদিন প্রভাতে চক্ষু মেলিয়া রূপরসময়ী ধরিত্রীকে দেখিতে পাইয়াছে! যেমন বিস্ময় তেমনি আনন্দের অবধি নাই। একদিন ছিল যখন অবস্থাবশে লম্বোদরকে বিবাহ করা তাহার পক্ষে অসম্ভব ছিল না; কিন্তু এখন তাহাকে কুচিকুচি করিয়া কাটিলেও সে অন্য পুরুষকে স্পর্শ করিতে পরিবে না। একজন মানুষ কোথা হইতে আসিয়া তাহার মনের কৌমার্য হরণ করিয়া লইয়াছে। যাহাকে প্রথম দর্শনে বুকের মধ্যে হাসির উচ্ছ্বাস উদ্বেলিত হইয়া উঠিয়াছিল সে ছাড়া পৃথিবীতে অন্য পুরুষ নাই, দেহ মন সমস্তই তাহার মধ্যে একাকার হইয়া গিয়াছে।
অনঙ্গ আপন মনে মূর্তি গড়ে, বান্ধুলি অদূরে বসিয়া দেখে। কখনও শিল্পকর্মের দিকে চাহিয়া থাকে, কখনও শিল্পীর পানে। অনঙ্গ সহসা চোখ তুলিলে চোখে চোখ ধরা পড়িয়া যায়। বান্ধুলি মুখ ফিরাইয়া হাসে। অনঙ্গ বলে— ‘তুমি আমাকে দেখে হাসো কেন বল দেখি? আমি কি সঙ?’
বান্ধুলি উত্তর দেয় না, নড়িয়া চড়িয়া বসে; তাহার অধরে হাসি আরও গাঢ় হয়।
বেতসী প্রবেশ করিয়া বলে— ‘মধুকর-ভাই, তোমার পুতুল কেমন হল দেখি। — ওমা, কী সুন্দর!’
এই তিনজনের মধ্যে একটি রস-নিবিড় সম্বন্ধ স্থাপিত হইয়াছে, লম্বোদর তাহার কোনও খবরই রাখে না। বেতসী অনঙ্গকে মধুকর-ভাই বলিয়া ডাকে, অনঙ্গ বেতসীকে বলে বহিন। বান্ধুলিকে সে নাম ধরিয়া ডাকে, বান্ধুলি অনঙ্গকে নাম ধরিয়া ডাকে না, সম্বোধনটা এড়াইয়া যায়।
বেতসী প্রশ্ন করে— ‘এ কার মূর্তি ভাই?’
অনঙ্গ বলে— ‘অনঙ্গ-বিগ্রহ।’
বিতস্তিপ্রমাণ মূর্তি। হাতে ধনুর্বাণ, আকুঞ্চিত-সব্যপাদ হইয়া তীর ছুঁড়িতেছে। অতি নিপুণ সূক্ষ্ম কারুকলায় মূর্তিটি প্রাণবন্ত হইয়া উঠিয়াছে।
মূর্তিটি গড়িতে অনঙ্গের তিনদিন লাগিল। মূর্তি প্রস্তুত হইলে তাহাকে রৌদ্রে শুকাইয়া পরে আগুনে পোড়ানো হইল। তিনজনে মিলিয়া পোড়াইল। উদ্যানে মূর্তিটি শুকনা পাতার উপর রাখিয়া সযত্নে খড় ও পাতা দিয়া ঢাকা হইল, তারপর সন্তর্পণে তাহার উপর জ্বালানি কাঠ চাপা দেওয়া হইল। বেতসী প্রদীপের পলিতা দিয়া তাহাতে আগুন দিল।
তিন ঘটিকা পুড়িবার পর আগুন নিভিলে ভস্মের ভিতর হইতে মূর্তি বাহির করা হইল। মূর্তি অটুট আছে এবং পুড়িয়া পাটল বর্ণ ধারণ করিয়াছে। তিনজনে শোভাযাত্রা করিয়া মূর্তি ঘরে লইয়া গেল।
অনঙ্গ মৃন্মূর্তির চোখ মুখ আঁকিল, পাদপীঠে লিখিল— অনঙ্গ-বিগ্রহ। রঙ রসান চড়াইয়া মূর্তিটি করতলের উপর তুলিয়া ধরিয়া বলিল— ‘কেমন হয়েছে? রাজকুমারীদের পছন্দ হবে?’
বান্ধুলির চোখ আনন্দে মুদিত হইয়া আসিল; বেতসী উচ্ছ্বসিত হইয়া উঠিল। —
বেতসীর উচ্ছ্বাস কমিলে বান্ধুলি ধরা-ধরা গলায় বলিল— ‘মূর্তি রাজবাটীতে নিয়ে যাই?’
অনঙ্গ হাসিয়া বলিল— ‘বেশ তো। রাজকুমারীরা যদি জানতে চান বোলো পাটলিপুত্রের কারিগরের তৈরি।’
অপরাহ্ণে বান্ধুলি রাজবাটীতে যাইবার জন্য প্রস্তুত হইল। মূর্তিটি অতি যত্নে তুলায় মুড়িয়া উত্তরীয়ের প্রান্তে বাঁধিয়া লইল।
দুই রাজকুমারী সেদিন দ্বিপ্রহরে নগরের কয়েকটি মন্দিরে পূজা দিতে গিয়াছিলেন, বৈকালে ফিরিয়া একরাশ ফুল লইয়া মালা গাঁথিতে বসিয়াছিলেন। বীরশ্রী ফন্দি করিয়াছিলেন, একটি বরমাল্য গাঁথিবেন, তারপর বরমাল্যটি যৌবনশ্রীর হাতে দিয়া দুই ভগিনী একযোগে জাতবর্মাকে আক্রমণ করিবেন, বলিবেন— ভাল চাও তো শীঘ্র বিগ্রহপালকে খুঁজে বার কর, নইলে যৌবনশ্রী তোমার গলাতেই বরমাল্য দেবে। তখন বিপাকে পড়িয়া জাতবর্মা নিশ্চয় একটা কিছু ব্যবস্থা করিবেন। শ্বশুরবাড়ি আসিলে সব জামাতাই অলস ও অকর্মণ্য হইয়া পড়ে, জাতবর্মাকে খোঁচা না দিলে তিনি কিছু করিবেন না।
যৌবনশ্রী দিদির সহিত পারিয়া ওঠেন না, নিতান্ত ছেলেমানুষী জানিয়াও তিনি সম্মত হইয়াছেন। মালা গাঁথা হইতেছে।
মালা গাঁথিতে গাঁথিতে বীরশ্রী বলিলেন— ‘কিন্তু যৌবনা, ও যদি সত্যি তোর মালা নেয় তখন কি হবে?’
যৌবনশ্রী মুখ টিপিয়া হাসিলেন। দিদির সহবাসে তাঁহার একটু মুখ ফুটিয়াছে, বলিলেন— ‘তখন বলব, ও মালা আমার নয়, দিদি গেঁথেছে।’
‘যদি তাতেও না শোনে?’
‘তখন তুমি সামলাবে।’
বীরশ্রী বলিলেন— ‘মন্দ কথা নয়। তুই মালা হাতে নিয়ে যাবি, আর আমি যাব মুগুর হাতে নিয়ে। যদি গণ্ডগোল করে মাথায় এক ঘা।’
কিন্তু যুবতীদ্বয়ের মন্ত্রণা কার্যে পরিণত করিবার প্রয়োজন হইল না, এই সময় বান্ধুলি আসিয়া উপস্থিত হইল।
বীরশ্রী বলিলেন— ‘কি রে বান্ধুলি, তোর অতিথির খবর কি?’
বান্ধুলি সলজ্জ উত্তেজনা চাপিয়া কাছে আসিয়া বসিল, একটু হাঁপাইয়া বলিল— ‘দিদিরানী, একটা জিনিস এনেছি। দেখবে?’
বীরশ্রী বললেন— ‘কী জিনিস? তোর অতিথিকে আঁচলে বেঁধে এনেছিস নাকি?’
বান্ধুলি উত্তরীয়ের বাঁধন খুলিয়া মূর্তি বাহির করিল, বীরশ্রী তাহা হাতে লইয়া বলিলেন— ‘ওমা, এ যে আমার শ্বশুরবাড়ির দেশের কারুকলা! এ তুই কোথায় পেলি?’
বান্ধুলি সবিভ্রম ঘাড়া বাঁকাইয়া বলিল— ‘অতিথি গড়েছে।’
‘সত্যি? তোর অতিথি তো ভারি গুণী লোক—’ এই পর্যন্ত বলিয়া বীরশ্রী থামিয়া গেলেন। তাঁহার চোখ পড়িল মূর্তির পাদপীঠে ক্ষুদ্রাক্ষরে লেখা আছে— অনঙ্গ-বিগ্রহ।
মদনমূর্তির নীচে অনঙ্গ-বিগ্রহ লেখা থাকিলে আশ্চর্য হইবার কিছু নাই; কিন্তু অনঙ্গ এবং বিগ্রহ দুইটা নামই বীরশ্রীর পরিচিত। তিনি চকিতে একবার বান্ধুলির মুখের পানে চাহিলেন। বান্ধুলির মুখে কিন্তু কোনও রহস্যের সঙ্কেত নাই। সে সরলভাবে বলিল— ‘অতিথি পাটলিপুত্রের শিল্পী।’
‘তাই নাকি?’ বীরশ্রীর সন্দেহ দৃঢ় হইল। তিনি বলিলেন— ‘ভারি সুন্দর অনঙ্গ-বিগ্রহ গড়েছে পাটলিপুত্রের শিল্পী। আচ্ছা, তুই পান নিয়ে আয়।’
বান্ধুলি পর্ণসম্পূট আনিতে গেল। বীরশ্রী তখন মূর্তির নীচে লেখা নাম যৌবনশ্রীকে দেখাইলেন। যৌবনশ্রীর মুখে চকিত অরুণাভা ফুটিয়া উঠিল। বীরশ্রী বলিলেন— ‘সংকেত বলেই মনে হচ্ছে। বান্ধুলি কিছু জানে না। ওর কাছে এখন কিছু ভেঙ্গে কাজ নেই। আমি বুদ্ধি বার করছি।’
বান্ধুলি পর্ণসম্পূট লইয়া আসিলে দুই ভগিনী পান মুখে দিলেন। বীরাশ্রী বলিলেন— ‘দিব্যি অতিথি পেয়েছিস। নাম কি রে অতিথির?’
বান্ধুলি নতনেত্রে বলিল— ‘মধুকর।’
বীরশ্রীর একটু ধোঁকা লাগিল। কিন্তু ছদ্মনাম হইতে পারে! তিনি প্রশ্ন করিলেন— ‘বয়স কত?’
‘তা জানি না।’
‘আ গেল ছুঁড়ি! মানুষ দেখে বলতে পারিস না বুড়ো কি ছোঁড়া?’
অপ্রতিভ বান্ধুলি বলিল— ‘ও— মানে— বুড়ো নয়।’
‘তাহলে কত বয়স?’
‘পঁচিশ ছাব্বিশ হবে।’
‘চেহারা কেমন?’
‘যাও দিদিরানী— আমি জানি না।’
‘চেহারা কেমন জানিস না! কী ব্যাপার বল দেখি! তোর রকম-সকম ভাল মনে হচ্ছে না।’
বান্ধুলি রক্তবর্ণ হইয়া বলিল— ‘আমি— চেহারা ভালই— মানে মন্দ না। রঙ ফরসা— কোঁকড়া চুল— বড় বড় চোখ—’
‘লম্বোদরের মত নয়?’
বান্ধুলি ঠোঁটে আঁচল চাপা দিল, বলিল— ‘না।’
বীরশ্রী ভাবিলেন, বোধ হইতেছে অনঙ্গপালই বটে। তিনি বলিলেন— ‘আচ্ছা, এই পুতুলটি আমি নিলাম।’ বলিয়া কান হইতে অবতংস খুলিয়া বান্ধুলির হাতে দিলেন— ‘শিল্পীকে দিস, আমার পুরস্কার।’
যদি অনঙ্গ হয়, অবতংস চিনিতে পরিবে, নৌকাযাত্রা কালে অনেকবার দেখিয়াছে।
বান্ধুলি গদ্গদ মুখে কর্ণাভরণ অঞ্চলে বাঁধিল। বীরশ্রী বলিলেন— ‘তুই আর এখানে থেকে কি করবি, বাড়ি ফিরে যা। কাল সকালে আসিস্ কিন্তু, অতিথি নিয়ে মেতে থাকিস না। কাল আমরা দুপুরবেলা ত্রিপুরেশ্বরীর মন্দিরে পূজা দিতে যাব। তুইও যাবি।’
‘আচ্ছা দিদিরানী।’
ছয়
পরদিন মধ্যাহ্নের দুই তিন দণ্ড পূর্বে অনঙ্গ ও বিগ্রহ যথাক্রমে রোহিতাশ্ব ও দিব্যজ্যোতির পিঠে চড়িয়া ত্রিপুরেশ্বরীর মন্দির অভিমুখে চলিয়াছেন। সঙ্গে একজন ভৃত্য আছে, সে পথ দেখাইয়া দিবে।
নগরের উপান্ত হইতে পূর্বদিকে পথ চলিয়া গিয়াছে। নগরসীমায় পৌঁছিলে ভৃত্য বলিল— ‘এই পথে সিধা চলে যান, তিন চার ক্রোশ গেলেই ত্রিপুরেশ্বরীর মন্দির পাবেন।’ বলিয়া সে ফিরিয়া গেল।
বিটপচ্ছায়াচিত্রিত পথ; দক্ষিণদিক হইতে জলকণাস্নিগ্ধ বাতাস বহিতেছে। দুটি অশ্ব যুগ্ম তীরের ন্যায় ছুটিয়া চলিয়াছে। বিগ্রহপাল প্রাণশক্তির আতিশয্যে উচ্চহাস্য করিয়া উঠিলেন।
‘এতক্ষণে মনে হচ্ছে বেঁচে আছি। তোর মনে হচ্ছে না?’ বলিয়া অনঙ্গের পানে হর্ষোৎফুল্ল মুখ ফিরাইলেন।
অনঙ্গ বলিল— ‘আমার বরাবরই মনে হচ্ছে।’
বিগ্রহ আবার উচ্চহাস্য করিলেন— ‘হাঁ, তুই তো তোর মানসীকে পেয়েছিস। কিন্তু তোকে বিশ্বাস নেই। হয়তো কার্যোদ্ধারের জন্য প্রেমের অভিনয় করছিস।’
অনঙ্গ বলিল— ‘না ভাই, এ সত্যি প্রেম। প্রথমে ভেবেছিলাম একটু রঙ্গ-রসিকতা করে কাজ উদ্ধার করব। কিন্তু এমন ওর স্বভাব, না ভালবেসে উপায় নেই।’
‘তা এখন কি করবি?’
‘তুই যা করবি আমিও তাই করব, ঘোড়ার পিঠে তুলে প্রস্থান।’
‘ওকে কিছু বলেছিস নাকি?’
‘এখনও বলিনি, তাক্ বুঝে বলব। এখন শুধু হাবুডুবু খাচ্ছি।’
‘তুই একলা খাচ্ছিস? না সেও হাবুডুবু খাচ্ছে?’
অনঙ্গ অধর মুকুলিত করিয়া বিগ্রহের দিকে সহাস্য কটাক্ষপাত করিল, উত্তর দেওয়া প্রয়োজন মনে করিল না।
এইভাবে লঘু বাক্যালাপে দুইজনে পথ অতিক্রম করিলেন। পথে পথিকের বাহুল্য নাই। অশ্মাচ্ছাদিত পথ ক্রমশ উপরে উঠিতে উঠিতে নর্মদা প্রপাতের সন্নিকটে শেষ হইয়াছে। দ্বিপ্রহরের পূর্বেই দুইজনে ত্রিপুরেশ্বরীর মন্দিরে উপস্থিত হইলেন।
নর্মদা যেখানে প্রস্রবণের আকারে অন্ধকার গুহা হইতে বাহির হইয়া আসিয়াছে তাহার অনতিনিম্নে উচ্চ পাষাণ-চত্বরের উপর শ্বেতপ্রস্তর-নির্মিত ত্রিপুরেশ্বরীর মন্দির। মন্দিরে কয়েকজন পূজারী আছেন, তাঁহারা অশ্বারোহীদের আসিতে দেখিয়া চত্বরের উপর সারি দিয়া দাঁড়াইলেন। এখানে পূজার্থী যাত্রীর যাতায়াত বেশি নয়, তবে পূজা পার্বণের সময় মেলা হয়।
অশ্বারোহিদ্বয় মন্দিরের নিকট থানিলেন না, আরও অগ্রসর হইয়া গুহার মুখের কাছে আসিয়া অশ্ব হইতে অবতরণ করিলেন। বিপুল গুহা-মুখ হইতে শান্ত ধারায় জল বাহির হইতেছে, স্রোতের উন্মাদনা নাই। যেন নিদ্রোত্থিত অনন্তনাগ ধীর সঞ্চারে বিবর হইতে নির্গত হইতেছে। পশ্চাতে মেখল পর্বত স্কন্ধের পর স্কন্ধ তুলিয়া গুহার পটভূমিকা রচনা করিয়াছে।
গুহার পাশে শীলাকীর্ণ অসমতল ভূমির উপর এখানে ওখানে পাহাড়ী গাছপালা জন্মিয়াছে, গুল্ম রচনা করিয়াছে। উপরন্তু একটি ক্ষুদ্র বৃক্ষ-বাটিকা আছে। মন্দিরের পূজারীরা যত্ন করিয়া অনুর্বর ভূমিতে আম্র, জম্বু, বকুল, কদম্ব প্রভৃতি ফলমূলের বৃক্ষ রোপণ করিয়া বোধ করি কর্মবিরল দিবসের জড়তা অপনোদন করিয়াছেন।
অনঙ্গ ও বিগ্রহ একটি গাছের ডালে ঘোড়া বাঁধিলেন। দ্বিপ্রহরের রৌদ্র বেশ প্রখর, কিন্তু নবোদ্গতপল্লব গাছের নীচে একটু ছায়া আছে।
বিগ্রহ বলিলেন— ‘ওরা এখনও আসেনি। ততক্ষণ কি করা যায়?’
দুইজনে গুহার মুখের কাছে গিয়া দাঁড়াইলেন। অনঙ্গ বলিল— ‘স্নান করলে কেমন হয়?’
বিগ্রহ স্নিগ্ধ শীতল জলের পানে সাভিলাষ দৃষ্টি নিবদ্ধ করিয়া বলিলেন— ‘স্নান! মন্দ হয় না। কিন্তু অন্য বস্ত্র কৈ?’
অনঙ্গ বলিল— ‘নির্জন স্থানে বিবস্ত্র হয়ে স্নান করলে ক্ষতি কি? কেউ দেখতে পাবে না।’
‘কিন্তু ওরা যদি এসে পড়ে?’
চিন্তার কথা বটে। বিবস্ত্র অবস্থায় মহিলাদের কাছে ধরা পড়িলে লজ্জার অবধি থাকিবে না। অনঙ্গ হাসিয়া বলিল— ‘এক কাজ করা যেতে পারে। গুহার ভিতরে অন্ধকার, পাশ দিয়ে ভিতরে যাবার সংকীর্ণ পাড় আছে। ভিতরে গিয়ে স্নান করা যায়। আমি যখন স্নান করব তুই বাইরে পাহারা দিবি, তুই যখন স্নান করবি আমি পাহারা দেব।’
এই সময় পিছনে কণ্ঠস্বর শুনা গেল— ‘ভদ্র, আপনারা কি গুহায় প্রবেশের অভিলাষ করেছেন?’
মন্দিরের পূজারী। কপালে রক্তচন্দনের তিলক, ক্ষৌরিত মস্তকের অধিকাংশ জুড়িয়া স্থূল শিখা, কিন্তু সৌম্য সহাস্য মুখশ্রী। অনঙ্গ বলিল— ‘আপনি বুঝি মন্দিরের পণ্ডপুরুষ! আমরা যদি গুহায় প্রবেশ করে স্নান করি, আপত্তি আছে কী?’
পণ্ডিত বলিলেন— ‘আপত্তি কিসের? তবে গুহার ছাদে বহু মধুমক্ষিকার চক্র আছে, তারা বিরক্ত হতে পারে।’
‘মধুমক্ষিকা বিরক্ত হবে?’
‘হতে পারে। তারা সংখ্যায় লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি। তারা রুষ্ট হলে হস্তীরও প্রাণ সংশয় হয়।’
অনঙ্গ বলিল— ‘তবে থাক। — গুহার বাইরে এখানে যদি স্নান করি?’
পণ্ডিত আবার হাসিলেন— ‘করতে পারেন। আপনারা মনে হচ্ছে বিদেশী। শোনেননি কি নর্মদার জল কর্কটপূর্ণ? কর্কটেরা এই গুহার মধ্যেই বংশবৃদ্ধি করে, তাই গুহার সন্নিকটে কর্কটের প্রাদুর্ভাব বেশি।’
‘তবে কাজ নেই, স্নান না করলেও চলবে।’
পূজারী অমায়িকভাবে বলিলেন— ‘আপনারা মন্দিরে পূজা দেবার আগে স্নান করে শুচি হতে চান, এই তো? কিন্তু স্নানের প্রয়োজন নেই; নর্মদার জল অতি পবিত্র, মাথায় ছিটা দিলেও শুদ্ধ হবেন। — আসুন।’
মন্দিরে পূজা দিবার কথা বিগ্রহপালের মনে আসে নাই, তিনি ব্যস্ত হইয়া বলিলেন— ‘অবশ্য অবশ্য। মন্দিরে পূজা দিতে হবে। কিন্তু পূজার উপচার তো কিছু সঙ্গে আনা হয়নি। আপনি এই সামান্য মূল্য নিয়ে আমাদের পূজার আয়োজন করে দিন।’
বিগ্রহ পণ্ডিতকে একটি স্বর্ণমুদ্রা দিলেন। পণ্ডিত অতিশয় হৃষ্ট হইয়া দুইজনের মাথায় নর্মদার পবিত্র জল ছিটাইয়া দিলেন, তারপর মন্দিরে লইয়া গিয়া যথোপচার পূজার্চনা সম্পন্ন করাইলেন।
পূজান্তে মন্দিরের চত্বর হইতে অবতরণ করিতে করিতে বিগ্রহ দেখিলেন পথ দিয়া দুইটি রথ অগ্রপশ্চাৎ আসিতেছে। প্রথম রথটি চালাইতেছেন যৌবনশ্রী, পার্শ্বে বীরশ্রী উপবিষ্ট। পিছনের রথে পূজোপচারসহ বান্ধুলি।
দুই বন্ধু উৎফুল্ল কটাক্ষ বিনিময় করিলেন। তারপর ক্ষিপ্রপদে সোপান অবতরণ করিতে লাগিলেন।
সোপানের পদমূলে দুই পক্ষের সাক্ষাৎ হইল। বীরশ্রী সর্বাগ্রে ছিলেন, তাঁহার মুখে গূঢ় হাসি স্ফুরিত হইয়া উঠিল। তাঁহার পিছনে যৌবনশ্রী দিদির আঁচল চাপিয়া ধরিয়াছিলেন, তাঁহার মুখ পর্যায়ক্রমে রক্তিম ও পাণ্ডুবর্ণ ধারণ করিতেছিল। সর্বশেষে বান্ধুলি সোনার থালায় পুজোপচার লইয়া বিভক্ত ওষ্ঠাধরে অনঙ্গের পানে চাহিয়া ছিল।
বীরশ্রী বিগ্রহপালকে লক্ষ্য করিয়া ছলনাভরে বলিলেন— ‘ভদ্র, আপনাকে যেন কোথায় দেখেছি মনে হচ্ছে!’
বিগ্রহ যৌবনশ্রীর উপর চক্ষু রাখিয়া কৃতাঞ্জলিপুটে বলিলেন— ‘ভদ্রে, এরই মধ্যে ভুলে গেলেন! আমি যে পলকের তরেও আপনাদের ভুলতে পারিনি।’
বীরশ্রী বলিলেন— ‘মনে পড়েছে। আপনার নাম কী যেন—’
‘অধীনের নাম রণমল্ল।’
এই সময় যৌবনশ্রী একবার চক্ষু তুলিয়া আবার চক্ষু নত করিয়া ফেলিলেন। বীরশ্রী বলিলেন— ‘নামটা নূতন নূতন ঠেকছে, কিন্তু মানুষটা সেই।’ অনঙ্গের দিকে ফিরিয়া বলিলেন— ‘আপনি বুঝি বান্ধুলির বন্ধু মধুকর?’
অনঙ্গ দশনচ্ছটা বিকীর্ণ করিয়া হাত জোড় করিল।
বীরশ্রী সোপানের ঊর্ধ্বদিকে কটাক্ষপাত করিয়া বলিলেন— ‘আর না, পুরোহিত মহাশয় নেমে আসছেন। আপনারা কি এখনই নগরে ফিরে যাবেন?’
বিগ্রহ বলিলেন— ‘আপাতত কিছুক্ষণ বৃক্ষ-বাটিকায় বিশ্রাম করবার ইচ্ছা আছে।’
‘ভাল। আমরাও পূজা দিয়ে কিছুক্ষণ বৃক্ষ-বাটিকায় বিশ্রাম করব। — আয় বান্ধুলি, হাঁ করে পরপুরুষের পানে তাকিয়ে থাকতে নেই।’
বান্ধুলি লজ্জায় ঘাড় ফিরাইয়া ভগিনীদ্বয়ের অনুসরণ করিল। ততক্ষণে পুরোহিত মহাশয় নামিয়া আসিয়া মহা সমাদর সহকারে পূজার্থিনীদের উপরে লইয়া গেলেন। —
দুই দণ্ড পরে পূজার্থিনীরা মন্দির হইতে নামিয়া আসিলেন। বৃদ্ধ রাজ-সারথি সম্পৎ দ্বিতীয় রথটি চালাইয়া আসিয়াছিল; দেখা গেল সে রথ দুটিকে এক বৃক্ষের ছায়ায় লইয়া গিয়াছে এবং অশ্বগুলিকে কিছু ঘাস দিয়া নিজে বৃক্ষতলে নিদ্রা যাইতেছে। যুবতীরা তখন নিঃশঙ্কে বৃক্ষ-বাটিকার দিকে চলিলেন।
বৃক্ষ-বাটিকার পুরোভাগে এক চম্পক বৃক্ষতলে অনঙ্গ দাঁড়াইয়া ছিল, সসম্ভ্রমে বীরশ্রীকে সম্বোধন করিল— ‘দেবি, যে ছদ্মবেশী চোরকে আপনারা খুঁজছেন, সে ওই আমলকী বৃক্ষতলে লুকিয়ে আছে।’
বীরশ্রী বলিলেন— ‘ভাল। তুমি বুঝি এই কুঞ্জবনের দ্বারপাল? আপাতত এই মেয়েটাকে তুমি আটক রাখ, ওকে আমাদের এখন প্রয়োজন নেই। ফেরবার পথে ওকে আবার অক্ষতদেহে আমার কাছে সমর্পণ করবে।’
অনঙ্গ যুক্তকরে বলিল— ‘যথা আজ্ঞা দেবি।’
বীরশ্রী তখন যৌবনশ্রীর হাত ধরিয়া কুঞ্জবনে প্রবেশ করিলেন।
অনঙ্গ দেখিল, প্রণয় সম্ভাষণের পক্ষে স্থান কাল সমস্তই অনুকূল। সে আর দ্বিধা করিল না। বান্ধুলির সম্মুখে আসিয়া গম্ভীরকণ্ঠে বলিল— ‘তুমি আমার বন্দিনী।’
বান্ধুলি হাসিয়া গলিয়া পড়িল। তারপর যথাসম্ভব আত্মসম্বৃত হইয়া বলিল— ‘আপনি কি করে এখানে এলেন? আপনার সঙ্গে উনি কে?’
অনঙ্গ বলিল— ‘কাল বলেছিলে তোমরা এখানে আসবে, মনে নেই? কিন্তু ও-সব কথা এখন থাক। তুমি আমার বন্দিনী। কিন্তু তোমাকে বেঁধে রাখবার পাশ রজ্জু উপস্থিত আমার কাছে নেই। সুতরাং—’ অনঙ্গ বান্ধুলির হাত ধরিল— ‘চল, ওই গাছতলায় চুপটি করে আমার পাশে বসে থাকবে।’
প্রণয়ীর প্রথম করস্পর্শে নাকি প্রণয়িনীর দেহে হর্ষোল্লাস জাগিয়া ওঠে, মন রাগপ্রদীপ্ত হয়। কিন্তু বান্ধুলির মনে হইল তাহার সারা দেহ যেন জুড়াইয়া গেল, স্নিগ্ধ হইয়া গেল। সে শুদ্ধশান্ত চিত্তে অনঙ্গের পাশে বৃক্ষতলে গিয়া বসিল। তাহার ডান হাতখানি অনঙ্গের হাতে ধরা রহিল।
কিছুক্ষণ উভয়ে নীরব; তারপর অনঙ্গ বলিল— ‘বান্ধুলি, আমি যদি তোমাকে ঘোড়ার পিঠে তুলে অনেক দূর দেশে নিয়ে যাই, তুমি যাবে?’
অপ্রত্যাশিত প্রশ্ন। কিন্তু বান্ধুলি চিন্তা করিল না, ক্ষণেকের জন্যও দ্বিধা করিল না, সরল অপ্রগল্ভ চক্ষু দুটি অনঙ্গের মুখের উপর স্থাপন করিয়া বলিল— ‘যাব।’
‘সব ছেড়ে আমার সঙ্গে যেতে ভয় করবে না?’
‘না।’
অনঙ্গ বান্ধুলিকে আরও কাছে টানিয়া লইল, চুপিচুপি বলিল— ‘বান্ধুলি, তুমি এখন কোনও কথা জানতে চেও না। আমরা একটা উদ্দেশ্য নিয়ে ত্রিপুরীতে এসেছি; হঠাৎ একদিন আমাদের চলে যেতে হবে। তখন তোমাকে সঙ্গে নিয়ে যাব, পাটলিপুত্রে ফিরে গিয়ে বিয়ে হবে।’
বান্ধুলি নীরবে ঘাড় নাড়িয়া সায় দিল। সে বুদ্ধিহীনা নয়, আজিকার উপপত্তি দেখিয়া বুঝিয়াছিল বীরশ্রীর সহিত ইহাদের পূর্ব হইতে পরিচয় আছে, ভিতরে ভিতরে নিগূঢ় কোনও ব্যাপার চলিতেছে। কিন্তু তাহার মনে কোনও কৌতূহল জাগিল না। যে-মানুষটিকে সে চায় সেই মানুষটিও তাহাকে একান্তভাবে চায় এই পরম চরিতার্থতার আনন্দেই সে বিভোর হইয়া রহিল।
কুঞ্জবনের অভ্যন্তরে একটি সহকার বৃক্ষতলে আর একপ্রকার প্রণয় সম্ভাষণ চলিতেছিল। চূতাঙ্কুরের গন্ধে বিহ্বল ভ্রমরের মত বিগ্রহপাল যৌবনশ্রীর কর্ণে গুঞ্জন করিতেছিলেন। নব অনুরাগের অর্থহীন গদভাষণ। যৌবনশ্রী বৃক্ষতলে প্রস্তর বেদিকার উপর বসিয়া করলগ্নকপোলে শুনিতেছিলেন। মাঝে মাঝে তাঁহার নিশ্বাস আপনি নিরুদ্ধ হইয়া যাইতেছিল, গণ্ডে ও বক্ষে রোমাঞ্চ ফুটিয়া উঠিতেছিল। বীরশ্রী তাঁহাকে বিগ্রহপালের কাছে রাখিয়া অশোক পুষ্পের অন্বেষণ ব্যপদেশে অন্যত্র প্রস্থান করিয়াছিলেন।
প্রণয়ীর মনে সময়ের জ্ঞান নাই; পলকে রাত্রি পোহাইয়া যায়, পলকের বিরহ যুগান্তকাল বলিয়া মনে হয়। বেলা তৃতীয় প্রহরে বীরশ্রী যখন সহকার বৃক্ষতলে ফিরিয়া আসিলেন তখন দেখিলেন যৌবনশ্রী তেমনই নতমুখে বসিয়া আছেন এবং বিগ্রহপাল তাঁহার দক্ষিণ হস্তখানি দুই করপুটে ধরিয়া গাঢ়স্বরে প্রলাপ বকিতেছেন।
বীরশ্রী প্রণয়ীযুগলের কাছে আসিয়া দাঁড়াইলেও তাঁহারা তাঁহাকে লক্ষ্য করিলেন না। তখন তিনি বলিলেন— ‘বেলা যে তিন পহর হল, এখনও তোমাদের মনের কথা বিনিময় হল না?’
দুইজনে চমকিয়া উঠিলেন। বিগ্রহপাল যৌবনশ্রীর হাত ছাড়িয়া বীরশ্রীর দিকে ফিরিলেন; করুণ হাসিয়া বলিলেন— ‘দিদি, বিনিময় হল কৈ? আমিই কেবল মনের কথা বলে গেলাম, উনি কিছুই বললেন না।’
বীরশ্রী বলিলেন— ‘আচ্ছা, সে আর একদিন হবে। আজ দেরি হয়ে গেছে, এখনি হয়তো সম্পৎ সারথি খুঁজতে আসবে। তার কাছে ধরা পড়া বাঞ্ছনীয় নয়।’
বিগ্রহ এবার বীরশ্রীর হাত ধরিলেন— ‘দিদি, আবার কবে দেখা হবে?’
বীরশ্রী হাসিয়া হাত ছাড়াইয়া লইলেন— ‘যথাসময় জানতে পারবে। আয় যৌবনা।’
যৌবনশ্রী ও বান্ধুলিকে লইয়া বীরশ্রী চলিয়া গেলেন। দুই বন্ধু কুঞ্জবনে বসিয়া রহিলেন। কিছুক্ষণ পরে রথের ঘর্ঘরধ্বনি দূরে মিলাইয়া গেল। বিগ্রহপাল নিশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন— ‘চল অনঙ্গ, আমরাও ফিরি।’
অনঙ্গ জিজ্ঞাসা করিল— ‘ভাব হল?’
বিগ্রহ হাসিলেন, প্রশ্নের উত্তর না দিয়া বলিলেন— ‘তোর বান্ধুলিকে দেখলাম। যা চাস তাই পেয়েছিস। কতদূর অগ্রসর হলি?’
অনঙ্গ বলিল— ‘অনেক দূর। আমরা প্রস্তুত। এখন তোরা প্রস্তুত হলেই যাত্রা করা যেতে পারে।’
বিগ্রহ বিমর্ষভাবে বলিলেন— ‘আমাদের প্রস্তুত হতে সময় লাগবে।’
সাত
বেশি সময় কিন্তু লাগিল না। অমাবস্যা তিথি পূর্ণ হইবার পূর্বেই যৌবনশ্রীর মুখ ফুটিল। হৃদয় যেখানে সহস্র কথার ভারে পূর্ণ সেখানে মুখ কতদিন নীরব থাকে?
ত্রিপুরেশ্বরী সংঘটনের পরদিন প্রাতঃকালে অনঙ্গ রোহিতাশ্বের পিঠে চড়িয়া শোণের ঘাটের দিকে চলিল। নৌকাটা কী অবস্থায় আছে দেখা আবশ্যক, কারণ প্রত্যাবর্তনের দিন ক্রমেই ঘনাইয়া আসিতেছে।
নৌকা সচল সক্রিয় অবস্থায় আছে, গরুড় সাঙ্গোপাঙ্গ লইয়া নৌকাতেই বিরাজ করিতেছে। জাতবর্মার নৌকাটাও আছে, কিন্তু তাহাতে মাঝিমাল্লা নাই। অনঙ্গ গরুড়কে জিজ্ঞাসা করিল— ‘যাত্রা করার জন্য প্রস্তুত আছ?’
গরুড় বলিল— ‘আজ্ঞা, এই দণ্ডে যাত্রা করতে পারি।’
অনঙ্গ সন্তুষ্ট হইল এবং গরুড়কে কিছু অর্থ দিয়া ফিরিয়া চলিল। গরুড় নদীতে সূতা ফেলিয়া একটা মাঝারি আয়তনের মাছ ধরিয়াছিল, অনঙ্গ সেটা সঙ্গে লইল।
দ্বিপ্রহরে খাইতে বসিয়া অনঙ্গ বেতসীকে জিজ্ঞাসা করিল— ‘বহিন, এখন তোমার শরীর কেমন?’
বেতসী কৃতজ্ঞস্বরে বলিল— ‘তোমার রান্না মাছ খেয়ে অনেক ভাল আছি ভাই।’
অনঙ্গ বলিল— ‘আজকের মাছটা তুমিই রাঁধো। দেখি কেমন রাঁধতে শিখেছ।’
বেতসী আনন্দে উদ্বেলিত হইয়া বলিল— ‘আচ্ছা।’
আহারের পর দ্বার ভেজাইয়া দিয়া অনঙ্গ শয়ন করিল। একটু তন্দ্রা আসিয়াছে, পায়ে লঘু করস্পর্শে সে চমক ভাঙিয়া উঠিয়া বসিল। নিঃশব্দে বান্ধুলি ঘরে প্রবেশ করিয়াছে।
অনঙ্গ বলিল— ‘রাজবাটী থেকে কখন এলে?’
বান্ধুলি ষড়যন্ত্রকারিণীর মত চুপি চুপি বলিল— ‘এইমাত্র। দিদিরানী বললেন আজ সূর্যাস্তের পর তিনি প্রিয়সখীকে নিয়ে রেবার তীরে বেড়াতে আসবেন।’
অনঙ্গ চুপি চুপি প্রশ্ন করিল— ‘রেবার তীরে— কোথায়?’
‘রাজবাটীর পিছন দিকে।’
‘আচ্ছা।’ অনঙ্গ হাসিয়া বান্ধুলির হাত ধরিল— ‘তুমি কাউকে কিছু বলনি?’
বান্ধুলি দৃঢ়ভাবে মাথা নাড়িল— ‘না।’
‘বহিন কোথায়?’
‘শুয়েছে।’
‘আর— কুটুম্ব?’
‘কুটুম্ব খেতে এসেছিল, খেয়ে আবার বেরিয়েছে।’
অনঙ্গ বান্ধুলিকে টানিয়া পাশে বসাইল। দুইজনে পরস্পরের মুখের পানে স্মিত-বিগলিত মুখে কিছুক্ষণ চাহিয়া রহিল।
‘বান্ধুলি, আমি তোমাকে চুরি করে নিয়ে পালালে বহিন রাগ করবে না?’
বান্ধুলি ক্ষণেক নতনেত্রে থাকিয়া বলিল— ‘না, সুখী হবে।’
‘সুখী হবে!’
‘হাঁ। দিদি আমাকে ভালবাসে; আমি সুখী হলে দিদিও সুখী হবে।’
‘আর— লম্বোদর?’
বান্ধুলির মুখে একটু অরুণাভা ফুটিয়া উঠিল; সে ঘাড় হেঁট করিয়া হাতের নখ পরীক্ষা করিতে লাগিল।
‘লম্বোদর সুখী হবে না— কেমন?’
বান্ধুলি চোখ তুলিল না, কেবল মাথা নাড়িল।
অনঙ্গ নিবিষ্ট মনে কিছুক্ষণ তাহার মুখের ভাব নিরীক্ষণ করিয়া বলিল— ‘বুঝেছি। একটি ভগিনীকে বিবাহ করে লম্বোদরের উদর পূর্ণ হয়নি। তুমি ভেবো না, লম্বোদরকে কদলী প্রদর্শন করব। কিন্তু কেউ যেন কিছু জানতে না পারে। দিদিও না।’
‘কেউ জানতে পারবে না।’
অনঙ্গ নিশ্চিন্ত হইল, বান্ধুলি প্রাণ গেলেও কাহাকেও কিছু বলিবে না।
‘তুমি কি এখন রাজবাটীতে ফিরে যাবে?’
‘হাঁ। দিদিরানী যেতে বলেছেন।’
‘আচ্ছা এস। রেবার তীরে আবার দেখা হবে।’
সেদিন সূর্যাস্তের পর রাজপ্রাসাদের পশ্চাদ্দেশে নির্জন রেবার তীরে যৌবনশ্রীর সহিত বিগ্রহপালের আবার দেখা হইল। সন্ধ্যার ঝিলিমিলি আলো নদীর উপর দিয়া লঘু পদক্ষেপে পশ্চিম দিগন্তে মিলাইয়া গিয়াছে, রাত্রি আসিয়াছে রত্ন-খচিত নিবিড় নীল উত্তরীয়ের মত; প্রণয়ীযুগলকে স্নেহভরে আবৃত করিয়াছে।
বিগ্রহপাল আবার গাঢ়স্বরে প্রলাপ বকিলেন। যৌবনশ্রী দুটি একটি কথা বলিলেন; কখনও ‘হুঁ,’ কখনও ‘না’। বীরশ্রী অলক্ষিতে থাকিয়া পাহারা দিলেন, রাজপুরী হইতে দাসদাসী কেহ না আসিয়া পড়ে। অনঙ্গ ও বান্ধুলিও দূরে থাকিয়া পাহারা দিল।
তারপর দুই দণ্ড অতীত হইলে বীরশ্রী আসিয়া যৌবনশ্রীর হাত ধরিয়া রাজপুরীতে লইয়া গেলেন। বলিলেন— ‘আজি এই পর্যন্ত। আবার কাল হবে।’
পরদিন আবার ওই স্থানে প্রণয়ীযুগল মিলিত হইলেন। তার পরদিন আবার। এইভাবে চলিতে লাগিল। কৃষ্ণপক্ষ কাটিয়া আকাশে নবীন চাঁদের ফলক দেখা দিল। যৌবনশ্রীর হৃদয়ের মুদিত কোরকটি ধীরে ধীরে উন্মোচিত হইতেছে; একটু একটু করিয়া মুখ ফুটিতেছে। দুইজনে নদীর তীরে পাশাপাশি বসিয়া থাকেন, বিগ্রহপালের মুঠির মধ্যে যৌবনশ্রীর আঙ্গুলগুলি আবদ্ধ থাকে। পশ্চিম দিগন্তে চাঁদ বঙ্কিম হাসিয়া অস্ত যায়। নদীতীরের অন্ধকারে দুইটি মন যৌবন-মদগন্ধে ভরিয়া ওঠে। যৌবনশ্রী অস্ফুটস্বরে, প্রায় মনে মনে, বলেন— ‘আর্যপুত্র!’
আট
জাতবর্মা যৌবনশ্রীকে বলিলেন— ‘পূর্বরাগ অনুরাগ মিলন রসোদাগার সবই তো হল। এখন আমাদের বিরহ সাগরে ভাসাচ্ছ কবে?’
প্রশ্নটি যৌবনশ্রী বুঝিতে পারিলেন না। জাতবর্মা আরও কিছুক্ষণ রঙ্গ-রহস্য করিয়া প্রস্থান করিবার পর যৌবনশ্রী দিদির প্রতি জিজ্ঞাসু নেত্রপাত করিলেন।
কক্ষে অন্য কেহ ছিল না। বীরশ্রী হ্রস্বকণ্ঠে বলিলেন— ‘যৌবনা, বিগ্রহ কি তোকে কিছু বলেছে? কোনও প্রস্তাব করেছে?’
বিগ্রহপাল কথা বলিয়াছেন অনেক, কিন্তু তাহা বহুলাংশে হৃদয়োচ্ছ্বাস; যাহাকে প্রস্তাব বলা যায় এমন কথা তিনি বলেন নাই। যৌবনশ্রী মাথা নাড়িয়া বলিলেন— ‘না। কী প্রস্তাব? আমি কিছু বুঝতে পারছি না।’
বীরশ্রী একটু অধীরভাবে বলিলেন— ‘শুধু অভিসার করলেই চলবে? এর শেষ কোথায়?’
শেষ কোথায়! যৌবনশ্রী সবই জানিতেন। কিন্তু কিছু মনে ছিল না। পিতা বিগ্রহপালকে স্বয়ংবরে আহ্বান করেন নাই, এদিকে লুকাইয়া লুকাইয়া দেখাশুনা চলিতেছে। যৌবনশ্রী বিগ্রহপালকে প্রথম দর্শনেই হৃদয়-মন সমর্পণ করিয়াছেন; তারপর যতবার দেখা হইয়াছে প্রণয়ের আকর্ষণ ততই দৃঢ় হইয়াছে। তিনি মনে মনে কালিদাসের শ্লোক আবৃত্তি করিয়া বলিয়াছেন— ভূয়ো যথা মে জননান্তরেহপি ত্বমেব ভর্তা ন চ বিপ্রয়োগঃ। কিন্তু ইহার পরিণাম কোথায় তাহা তিনি ভাবেন নাই; বর্তমানের ভাব-প্লাবনে তাঁহার হৃদয় মগ্ন হইয়া গিয়াছিল, ভবিষ্যতের চিন্তা তাঁহার মনে আসে নাই।
তিনি হঠাৎ ভয় পাইয়া বীরশ্রীকে জড়াইয়া ধরিলেন— ‘দিদি, কি হবে?’
বীরশ্রী তাঁহাকে আশ্বাস দিয়া হাসিলেন— ‘কি আর হবে? বিগ্রহ স্থির করেছে স্বয়ংবরের আগেই তোকে চুরি করে নিয়ে পালাবে, নৌকায় তুলে একেবারে পাটলিপুত্র। এখন তুই মন স্থির করে ফেললেই হল। স্বয়ংবরের কিন্তু আর বেশি দেরি নেই।’
যৌবনশ্রী ধীরে ধীরে বীরশ্রীর স্কন্ধ হইতে মুখ তুলিলেন। তাঁহার মুখখানি প্রভাতের শিশিরক্ষিণ্ণ কুমুদিনীর মত শীর্ণ দেখাইল। তিনি অস্ফুটস্বরে বলিলেন— ‘চুরি করে—?’
কেবল এই কথাটি বীরশ্রী ভগিনীকে বলেন নাই। ভাবিয়াছিলেন, হঠাৎ বলিলে যৌবনশ্রী চমকিয়া যাইবে, আগে ভাব-সাব হোক, তারপর বলিলেই চলিবে। বীরশ্রী এখন বিগ্রহপালের সমস্ত অভিসন্ধি ব্যক্ত করিলেন; বীরশ্রী ও জাতবর্মার যে এই প্রস্তাবে সম্পূর্ণ সম্মতি আছে তাহাও জানাইলেন। যৌবনশ্রী ধীরভাবে সমস্ত শুনিলেন। তাঁহার মন ক্রমে আত্মস্থ হইল।
মানুষের চরিত্র, বিশেষত স্ত্রী-চরিত্র, অতি গহন দুর্জ্ঞেয়। কখন যে তাহা কুসুমের ন্যায় কোমল, আবার কখন যে বজ্রাদপি কঠোর, তাহা আজ পর্যন্ত কেহ নির্ণয় করিতে পারে নাই।
সেদিন রেবার তীরে খণ্ড চাঁদের আলোয় দু’জনের দেখা হইল। যৌবনশ্রী বিগ্রহপালের সম্মুখে গিয়া দাঁড়াইলেন; তারপর আরও কাছে গিয়া তাঁহার বুকের উপর মাথা রাখিলেন। এই স্বতঃ পরিশীলনের জন্য বিগ্রহপাল প্রস্তুত ছিলেন না, তিনি হর্ষরোমাঞ্চিত দেহে দুই বাহু দিয়া যৌবনশ্রীকে বেষ্টন করিয়া লইলেন।
‘যৌবনশ্রী— ভূবনশ্রী—!’
যৌবনশ্রীর একটি হাত সরীসৃপের ন্যায় ধীরে ধীরে উঠিয়া বিগ্রহপালের স্কন্ধের উপর লগ্ন হইল, মুখখানি একটু উন্নমিত হইল। বিগ্রহপাল দেখিলেন তাঁহার চোখে জল টলমল করিতেছে।
‘যৌবনা! কী হয়েছে?’
যৌবনশ্রীর ঠোঁট দুটি কাঁপিয়া উঠিল— ‘তুমি নাকি আমাকে চুরি করে নিয়ে যাবে?’
বিগ্রহের মুখ উদ্বিগ্ন হইল। এ প্রশ্নের পিছনে আনন্দ, ঔৎসুক্য নাই। তিনি ব্যগ্রস্বরে বলিলেন— ‘অন্য উপায় যে নেই যৌবনা। তোমার পিতা আমাকে স্বয়ংবর সভায় আমন্ত্রণ করেননি।’
যৌবনশ্রী বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে বলিলেন— ‘জানি। কিন্তু তুমি আমাকে চুরি করে নিয়ে যাবে, এ যে বড় লজ্জার কথা কুমার।’
বিগ্রহপালের মুখ ঈষৎ উত্তপ্ত হইল। তিনি বলিলেন— ‘ক্ষত্রিয়ের পক্ষে কন্যা হরণ করে বিবাহ করা লজ্জার কথা নয়।’
যৌবনশ্রীর যে বাহুটি বিগ্রহপালের স্কন্ধ পর্যন্ত উঠিয়াছিল তাহা এবার তাঁহার কণ্ঠ বেষ্টন করিয়া লইল, তিনি বলিলেন— ‘কুমার, আজ আমার নির্লজ্জতা তুমি ক্ষমা কর। আমি তোমার, কায়মনোবাক্যে তোমার; তাই আমি তোমাকে কদাচ এ কাজ করতে দেব না। বাহুবলে কন্যা হরণ করা আর চোরের মত কন্যা চুরি করা এক কথা নয়। রাবণ তস্করের মত সীতাকে চুরি করেছিল; অর্জুন শত শত রাজাকে পরাস্ত করে কৃষ্ণাকে লাভ করেছিলেন।’
বিগ্রহপালের বাহুবেষ্টন শিথিল হইল, তিনি বিস্ময়-বিহ্বল নেত্রে চাহিয়া রহিলেন। যে প্রথমপ্রণয়ভীতা লজ্জাহতা যুবতীকে তিনি প্রেম নিবেদন করিতেছিলেন এ যেন সে নয়। কোথায় প্রচ্ছন্ন ছিল এত তেজ, এত দৃঢ়তা!
অবশেষে বিগ্রহপাল বলিলেন— ‘কিন্তু যৌবনা, তুমি কি বুঝতে পারছি না? এ ছাড়া তোমাকে পাবার আর তো কোনও উপায় নেই।’
যৌবনশ্রী কম্পিতস্বরে বলিলেন— ‘আমাকে তো পেয়েছ। তুমি আমার স্বামী, ইহজন্মে জন্মজন্মান্তরে তুমি আমার স্বামী। কিন্তু যতক্ষণ সর্বসমক্ষে, ভারতের সমস্ত রাজন্যবর্গের সমক্ষে তোমার গলায় মালা না দিচ্ছি ততক্ষণ আমি তোমার সঙ্গে পালিয়ে যাব না। তাতে তোমার পিতৃকুলের, আমার— আমার শ্বশুরকুলের অপমান হবে। ভুলে যেও না কুমার, কোন্ মহিমময় রাজকুলে তোমার জন্ম; অমরকীর্তি ধর্মপাল দেবপাল মহীপাল তোমার পিতৃপুরুষ। অনুরূপ অবস্থায় তাঁরা কি করতেন?’
এ প্রশ্নের সদুত্তর নাই; বিগ্রহপাল নির্বাক রহিলেন। বালসুলভ চপলতার বশে তিনি যে কর্মে অবতীর্ণ হইয়াছিলেন তাহাতে বিবেকের দিক হইতে যে কোনও বাধা আসিতে পারে তাহা তিনি চিন্তা করেন নাই। তিনি যেন নদীতীরে এক-হাঁটু জলে খেলা করিতে করিতে হঠাৎ গভীর জলে পড়িয়া গেলেন।
অবশেষে দীর্ঘ নীরবতার পর তিনি বলিলেন— ‘যৌবনা, তুমি আমার চোখ খুলে দিলে। সমস্ত ভারতবর্ষ আমাকে ধিক্কার দেবে; পাল রাজবংশে কলঙ্ক লাগবে। তা হতে পারে না। কিন্তু এখন উপায় কি?’
‘উপায় তুমি জান।’
‘তুমি কি করবে?’
‘তুমি যা বলবে তাই করব।’
‘স্বয়ংবর তো বন্ধ করা যাবে না। তোমাকে স্বয়ংবর সভায় যেতে হবে।’
‘তুমি যদি স্বয়ংবর সভায় না থাক, আমি যাব না।’
‘কিন্তু তোমার পিতা—’
যৌবনশ্রী নীরব রহিলেন। আকাশের শশিকলা অস্ত গেল, অন্ধকার ঘিরিয়া আসিল। বিগ্রহপাল যৌবনশ্রীকে বাহুমুক্ত করিয়া বলিলেন— ‘আজ আমি যাই। সব লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে। ভাবতে হবে, অনঙ্গের সঙ্গে পরামর্শ করতে হবে, রন্তিদেবের উপদেশ নিতে হবে। — কাল আবার এইখানে এস, দেখা হবে।’
তাঁহাদের প্রেম লঘু পূর্বরাগের স্তর উত্তীর্ণ হইয়া একমুহূর্তে গভীরতর স্তরে উপনীত হইয়াছে।
রাজপুরীতে ফিরিয়া গিয়া যৌবনশ্রী শয্যায় পড়িয়া কাঁদিতে লাগিলেন। সঙ্কল্প যতই দৃঢ় হোক, আশঙ্কাকে ঠেকাইয়া রাখা যায় না। বীরশ্রী যথাসাধ্য তাঁহাকে শান্ত করিবার চেষ্টা করিলেন। চুরি করিয়া পলায়নের মধ্যে যে ঘোর দুর্নীতি ও স্বৈরাচার রহিয়াছে তাহা তিনিও বুঝিয়েছিলেন, যৌবনশ্রী যদি তাহাতে সম্মত না হয় তাহাকে দোষ দেওয়া যায় না। বীরশ্রী পলায়নের প্রসঙ্গ আর উত্থাপন করিলেন না।
কিন্তু যৌবনশ্রী ও বিগ্রহপালের ঘনিষ্ঠতা যে অবস্থায় পৌঁছিয়াছে এখন আর হাল ছাড়িয়া বসিয়া থাকা যায় না। গভীর রাত্রে দুই ভগিনী ঠাকুরানীর কক্ষে গেলেন। উপস্থায়িকাদের বিদায় করিবার পর বীরশ্রী বর্তমান সংস্থা ঠাকুরানীর গোচর করিলেন। যৌবনশ্রী পিতামহীর বুকের উপর পড়িয়া কাঁদিতে লাগিলেন।
অম্বিকা দেবী যৌবনশ্রীর সংকল্প শুনিয়া একদিকে যেমন উদ্বিগ্ন হইলেন অন্যদিকে তেমনি প্রসন্ন হইলেন। যৌবনশ্রী রাজকন্যার মতই সঙ্কল্প করিয়াছে, বর্তমানের তরলমতি যুবক-যুবতীদের মধ্যে এমন দৃঢ়তা দেখা যায় না। কিন্তু— এই জটিল গ্রন্থি উন্মোচন করিবে কে? প্রেম ও কর্তব্যের এই দুরত্যয় ব্যবধানের মাঝখানে সেতুবন্ধ হইবে কিরূপে?
বীরশ্রী চক্ষু মুছিয়া বলিলেন— ‘দিদি, সব দোষ আমার। আমি যদি যোগাযোগ না ঘটাতাম—’
যৌবনশ্রী পিতামহীর বুকের মধ্যে মাথা নাড়িলেন, অস্ফুট রোদনরুদ্ধ স্বরে বলিলেন— ‘না— না—’
ঠাকুরানী বলিলেন— ‘যা হবার হয়েছে, পশ্চাত্তাপে লাভ নেই। যে জট পাকিয়েছ তা ছাড়াতে হবে।’
বীরশ্রী বলিলেন— ‘দিদি, তুমি উপায় কর।’
অম্বিকা বলিলেন— ‘আমি কী উপায় করতে পারি! তোদের বাপকে ডেকে পাঠিয়েছিলাম, সে আসেনি। তাকে আবার ডেকে পাঠাতে পারি, যদি আসে তাকে সব কথা বলতে পারি। কিন্তু তাতে বিপরীত ফল হবে। কর্ণ যদি জানতে পারে বিগ্রহপাল ত্রিপুরীতে এসেছে তাহলে তার জীবন সংশয় হবে—’
যৌবনশ্রী পূর্ববৎ মাথা নাড়িলেন— ‘না— না—’
কিছুক্ষণ লক্ষ্যহীন আলোচনার পর বীরশ্রী বলিলেন— ‘দিদি, এক কাজ করলে কেমন হয়? রাজারা আসতে আরম্ভ করেছে; তাদের কাছে যদি চুপিচুপি খবর পাঠানো যায় যে যিনি স্বয়ংবরা হবেন তিনি অন্যের বাগ্দত্তা— তাহলে—’
অম্বিকা বলিলেন— ‘তাহলে কলঙ্কের সীমা থাকবে না। রাজারা কি চুপ করে দেশে ফিরে যাবে। তারা ঢাক পেটাবে। তোদের বাপকে জিজ্ঞাসা করবে— বাগ্দত্তা মেয়ের স্বয়ংবর দিতে যাও কেন। তখন?’
কোনও মীমাংসা হইল না, কর্তব্য নির্ধারিত হইল না। শেষ পর্যন্ত ঠাকুরানী বলিলেন— ‘এখনও সময় আছে, ভেবে দেখি। — ওদিকে বিগ্রহও ভাবছে। হয়তো কোনও উপায় হবে।’
শেষ রাত্রে ক্লান্ত বিধুর হৃদয় লইয়া যৌবনশ্রী শুইতে গেলেন।
বীরশ্রী নিজ শয়নকক্ষে গিয়া স্বামীকে জানাইলেন এবং সকল কথা বলিলেন। শুনিয়া জাতবর্মা বড়ই বিরক্ত হইলেন। স্ত্রীলোকের আর কোনও কাজ নেই, কেবল পিণ্ড পাকাইতে জানে। এতটা যদি নীতিজ্ঞান, প্রেম করিবার কী প্রয়োজন ছিল, স্ত্রীবুদ্ধি প্রলয়ঙ্করী!
তিনি পাশ ফিরিয়া শুইলেন।