গল্প
উপন্যাস
পরিশিষ্ট

তুমি সন্ধ্যার মেঘ – ৩

তৃতীয় পরিচ্ছেদ – এক

জাতবর্মা নৌকাযোগে আসিতেছেন এ সংবাদ পূর্বেই ত্রিপুরীতে পৌঁছিয়াছিল। রোহিতাশ্বগড়ে লক্ষ্মীকর্ণদেবের একজন গূঢ়পুরুষ ছিল; সে নৌকা যাইতে দেখিয়াছিল, নৌকার শীর্ষে কেতন চিনিয়াছিল। বেগবান অশ্বে চড়িয়া সে লক্ষ্মীকর্ণকে জানাইয়াছিল। কথাটা এমন কিছু গোপনীয় নয়। তাই রাজপুরী হইতে ক্রমশ নগরে বিস্তার লাভ করিয়াছিল। স্বয়ংবর উপলক্ষে প্রথম আসিলেন রাজ-জামাতা; তিনিও কি স্বয়ংবর সভায় বসিবেন না কি? নাগরিকদের মধ্যে নানাবিধ জল্পনা আরম্ভ হইয়াছিল। বলা বাহুল্য স্বয়ংবরের কথাটা এখন আর গোপন নাই; রাজপ্রাসাদের বিস্তীর্ণ পুরোভূমিতে মণ্ডপ নির্মাণ আরম্ভ হইয়া গিয়াছে।

জগতবর্মার নৌকা বোলা দ্বিপ্রহরে যখন ঘাটে আসিয়া লাগিল তখন লক্ষ্মীকর্ণ ও যৌবনশ্রী ঘাটে উপস্থিত আছেন। লক্ষ্মীকর্ণ কন্যা-জামাতাকে আগ বাড়াইয়া লইতে আসিয়াছেন, সঙ্গে অনেক অশ্বারোহী রক্ষী। যৌবনশ্রী দিদিকে দেখিবার জন্য উৎসুক ছিলেন, তিনিও পিতার সঙ্গে রথে আসিয়াছেন।

আর একজন লক্ষ্মীকর্ণের সঙ্গে আসিয়াছে, তাহার নাম লম্বোদর। কথিত আছে, গুপ্তচর রাজাদের কর্ণ। লম্বোদর ছিল মহারাজ লক্ষ্মীকর্ণের কর্ণ, সকল সময় তাঁহার কাছে থাকিত।

জাতবর্মা ও বীরশ্রী নৌকা হইতে অবতরণ করিলে লক্ষ্মীকর্ণ কন্যার মস্তক আঘ্রাণ, জামাতাকে আলিঙ্গন করিলেন। যৌবনশ্রী ঈষৎ লজ্জিতভাবে একটু দূরে দাঁড়াইয়া ছিলেন, বীরশ্রী ছুটিয়া তাঁহার কাছে গেলেন— ‘ওমা! যৌবনা, তুই এতবড় হয়েছিস!’ দুই ভগিনী পরস্পর কণ্ঠলগ্ন হইলেন। তিন বৎসর পরে সাক্ষাৎ; বিবাহের পর বীরশ্রী যখন পতিগৃহে যান তখন যৌবনশ্রীর বয়স ছিল চৌদ্দ বৎসর।

ওদিকে শ্বশুর ও জামাতার মধ্যে কথা হইতেছিল। কুশল প্রশ্নের পর নৌকা সম্বন্ধে লক্ষ্মীকর্ণের অনুসন্ধিৎসার উত্তরে জাতবর্মা বলিতেছিলেন— ‘…দ্বিতীয় নৌকাটি আমার নয়, পাটলিপুত্র থেকে ওরা আমাদের সঙ্গে সঙ্গে এসেছে।’

পাটলিপুত্রের নামে লক্ষ্মীকর্ণ কান খাড়া করিলেন— ‘পাটলিপুত্র থেকে! ওরা কারা জানো?’

জাতবর্মা তাচ্ছিল্যভরে বলিলেন— ‘বণিক। স্বয়ংবর উপলক্ষে ত্রিপুরীতে বাণিজ্য করতে এসেছে।’

লক্ষ্মীকর্ণের সন্দেহ দূর হইল না। বিগ্রহপালের নৌকা ঘাটের অন্য প্রান্তে বাঁধা হইয়াছিল, তিনি ভ্রূকুটি করিয়া সেইদিকে চাহিয়া রহিলেন। এই সময় রইঘর হইতে অনঙ্গ বাহির হইয়া আসিল এবং উৎসুক নেত্রে ঘাটের জন-সমাবেশ দেখিতে লাগিল। তাহার পরিধানে মহার্ঘ বেশ, মাথায় পাগ, পায়ে ময়ূরপঙ্খী পাদুকা। বিগ্রহপাল কিন্তু বাহিরে আসিলেন না। লক্ষ্মীকর্ণ তাঁহাকে দেখিয়া ফেলিলে সর্বনাশ।

লক্ষ্মীকর্ণ কিয়াৎকাল বিরাগপূর্ণ নেত্রে অনঙ্গকে নিরীক্ষণ করিয়া ঘাটের এদিক ওদিক দৃষ্টি ফিরাইলেন। লম্বোদর অদূরে একটি নিম্ববৃক্ষ তলে দাঁড়াইয়া অচঞ্চল চক্ষে লক্ষ্মীকর্ণের পানে চাহিয়া ছিল; তাহার সহিত চোখাচোখি হইতেই লক্ষ্মীকর্ণ শিরঃসঞ্চালন করিয়া অনঙ্গকে দেখাইলেন। লম্বোদর একবার অনঙ্গের পানে চক্ষু ফিরাইয়া সপ্রশ্ন ভ্রূ তুলিল, তারপর ঘাড় নাড়িল।

অতঃপর লক্ষ্মীকর্ণ জামাতা ও কন্যাদের লইয়া ঘাটের বাহিরে গেলেন। ঘাট-সংলগ্ন ভূমিতে ক্ষুদ্র একটি জনবসতি গড়িয়া উঠিয়াছে। কয়েকটি চালা ঘর, একটি বিপণি, দুই চারিটি গো-শকট; এই পথে যে-সকল যাত্রী যাতায়াত করে তাহাদের পথের প্রয়োজন মিটাইয়া ইহারা জীবন নির্বাহ করে। আজ সহসা রাজ-সমাগমে স্থানটি অনভ্যস্ত জনবাহুল্যে পূর্ণ হইয়া উঠিয়াছে।

অশ্বারোহী রক্ষীর দল অশ্বের বল্‌গা ধরিয়া এইখানে অপেক্ষা করিতেছিল; দুইটি রথও ছিল। লক্ষ্মীকর্ণ জামাতাকে জিজ্ঞাসা করিলেন— ‘রথে যাবে? না ঘোড়ার পিঠে?’

‘ঘোড়ার পিঠে’ বলিয়া জাতবর্মা এক লাফে একটি অশ্বের পৃষ্ঠে উঠিয়া বসিলেন। দীর্ঘকাল নৌকায় বাস করিয়া তাঁহার হস্তপদে কিছু জড়ত্ব আসিয়াছিল, অশ্ব চালাইলে তাহা দূর হইবে। — ‘আপনারা রথে যান।’

লক্ষ্মীকর্ণ একবার চোখ পাকাইলেন। জামাতা বাবাজী বয়সে নবীন হইতে পারেন, কিন্তু তিনি কি মনে করেন লক্ষ্মীকর্ণ একেবারেই অথর্ব হইয়া পড়িয়াছেন? তিনি আর একটি অশ্বের পৃষ্ঠে উঠিয়া বসিয়া বলিলেন— ‘আমিও ঘোড়ার পিঠে যাব।’

কন্যাদের রথে আসিবার আদেশ দিয়া তিনি ঘোড়া চলাইলেন। অধিকাংশ রক্ষীর দল তাঁহার সঙ্গে চলিল, বাকি রথের অনুগমন করিবে বলিয়া রহিয়া গেল। যে দুইজন অশ্বারোহীর অশ্ব জাতবর্মা ও লক্ষ্মীকর্ণ লইয়াছিলেন তাহারা অন্য রথে ফিরিবে।

ঘাটের অঙ্গন প্রায় শূন্য হইয়া গেলে বীরশ্রী এবং যৌবনশ্রী হাত ধরাধরি করিয়া রথের দিকে চলিলেন। রাজরথের বৃদ্ধ সারথি, বীরশ্রীকে প্রণাম করিল। বীরশ্রী আবদার করিয়া বলিলেন— ‘সম্পৎ, আমি রথ চালাব।’

বৃদ্ধ সম্পৎ চক্ষু মুদিয়া দন্তহীন হাসিল— ‘সে আমি জানি। তাই মন্দুরা থেকে সবচেয়ে সুবোধ ঘোড়া দুটোকে জুতে এনেছি। কিন্তু তুমি শ্বশুরবাড়ি গিয়ে রথ চালাতে ভুলে যাওনি তো? বংগাল দেশে শুনেছি ঘোড়া নেই, কেবল হাতি।’

বীরশ্রী ভ্রূভঙ্গি করিয়া বলিলেন— ‘আমার শ্বশুরবাড়ির নিন্দা করলে ভাল হবে না সম্পৎ। রথ চালাতে আমি মোটেই ভুলিনি। তোমার চেয়ে ভাল চালাব, দেখে নিও।’

সম্পৎ আবার চক্ষু কুঞ্চিত করিয়া হাসিল— ‘আচ্ছা আচ্ছা। তোমরা দুই বোন আমার রথে চড়। আমি পিছনের রথে থাকব।’

দুই ভগিনী রথে চড়িতে উদ্যত হইয়াছেন এমন সময় একটি শব্দ তাঁহাদের কানে আসিল— ‘বম্‌ শঙ্কর— বম্‌ বম্‌।’

দুইজনে চকিত হইয়া ফিরিয়া চাহিলেন। অদূরে বৃহৎ অশ্বত্থবৃক্ষ তলে প্রস্তরের চক্রবেদী, তাহার উপর বসিয়া আছেন এক সন্ন্যাসী। মাথায় সর্পিল জটা, মুখে গাঢ় ভস্ম প্রলেপ, কটিতে ব্যাঘ্রচর্ম। মেরুযষ্টি কঠিন করিয়া তিনি পদ্মাসনে বসিয়া আছেন এবং গালবাদ্য করিতেছেন— বম্‌ বম্‌ ববম্‌ বম্‌!

বীরশ্রী বলিলেন— ‘ওমা, সন্ন্যাসী!— আয় ভাই, সন্ন্যাসী ঠাকুরকে প্রণাম করি।’

দুই বোন অশ্বত্থবৃক্ষের দিকে চলিলেন।

ওদিকে অনঙ্গ নৌকায় দাঁড়াইয়া দেখিতেছিল। লক্ষ্মীকর্ণ ও জাতবর্মা ঘোড়ায় চড়িয়া চলিয়া যাইবার পর সে বিগ্রহপালকে ডাকিল। বিগ্রহ রইঘর হইতে বাহিরে আসিলেন। তাঁহার পরিধানে সাধারণ বেশভূষা, রাজপুত্র বলিয়া মনে হয় না। ধরা পড়িবার আশঙ্কা আর নাই দেখিয়া তিনি নৌকা হইতে ঘাটে নামিলেন। নির্লিপ্ত লম্বোদর যে নিম্বতলে দাঁড়াইয়া আছে তাহা কাহারও চোখে পড়িল না।

বীরশ্রী ও যৌবনশ্রী ভক্তিভরে বেদীর উপর মাথা ঠেকাইয়া প্রণাম করিলেন। সন্ন্যাসী হাত তুলিয়া আশীর্বাদ করিলেন— ‘চিরায়ুষ্মতী হও। ভর্তার বহুমতা হও। স্বর্ণপ্রসূ হও।’ তাঁহার মুখে ভস্মাচ্ছাদিত প্রসন্নতা ক্রীড়া করিতে লাগিল।

বীরশ্রী বলিলেন— ‘ঠাকুর, আপনি সিদ্ধপুরুষ। আমার এই বোনটির শীঘ্রই বিয়ে হবে। ওর করকোষ্ঠী একবার দেখুন না।’

যৌবনশ্রীর মুখখানি অরুণাভ হইয়া উঠিল। মনে যথেষ্ট কৌতূহল, কিন্তু সন্ন্যাসীর সম্মুখে হস্ত প্রসারিত করিতে লজ্জা করিতেছে। বীরশ্রী তখন জোর করিয়া তাঁহার বাঁ হাতখনি সাধুর সম্মুখে বাড়াইয়া ধরিলেন।

সাধু যৌবনশ্রীর প্রসারিত করতলের দিকে একবার কটাক্ষপাত করিলেন, তারপর সম্মুখে ঝুঁকিয়া অভিনিবেশ সহকারে দেখিলেন। তাঁহার মুখে আবার ছাই-ঢাকা হাসি ফুটিয়া উঠিল। তিনি যৌবনশ্রীর মুখের পানে মিটিমিটি চাহিয়া বলিলেন— ‘রাজনন্দিনি, তোমার প্রিয়-সমাগমের আর বিলম্ব নেই। অদ্যই তুমি ভাবী পতির সাক্ষাৎ পাবে।’

যৌবনশ্রী অবাক হইয়া সন্ন্যাসীর মুখের পানে চোখ তুলিলেন। বীরশ্রী সবিস্ময়ে বলিয়া উঠিলেন— ‘অ্যাঁ— কি বললেন প্রভু—?’

এই সময় বাধা পড়িল। সহসা পিছন হইতে একটি হাত আসিয়া যৌবনশ্রীর প্রসারিত করতলের উপর ন্যস্ত হইল, একটি মন্দ্র-মন্থর পুরুষ কণ্ঠ শোনা গেল— ‘সাধুবাবা, আমার হাতটা একবার দেখুন তো!’

চমকিয়া যৌবনশ্রী ঘাড় ফিরাইলেন। রাজকন্যার হাতের উপর হাত রাখে কোন্‌ ধৃষ্ট!

যে মুখখানি যৌবনশ্রী দেখিতে পাইলেন তাহাতে একটু দুষ্টামিভরা হাসি লাগিয়া আছে, আরও কত কি আছে। চোখে চোখে দৃষ্টি বিনিময় হইল। যৌবনশ্রীর দেহ একবার বিদ্যুৎপৃষ্টের মত কাঁপিয়া উঠিল, সবেগে নিশ্বাস টানিয়া তিনি একেবারে রুদ্ধশ্বাস হইয়া গেলেন; তাঁহার মুখ হইতে সমস্ত রক্ত নামিয়া গিয়া মুখ পাণ্ডুবর্ণ ধারণ করিল। তিনি নিজের প্রসারিত হাতখনি আগন্তুকের করতল হইতে সরাইয়া লইতে ভুলিয়া গেলেন।

সন্ন্যাসী বিগ্রহপালের করকোন্ঠী দেখিতেছিলেন, বলিলেন— ‘বৎস, তুমি রাজকুলোদ্ভব—’

‘চুপ চুপ!’— বিগ্রহপাল সচকিতে চারিদিকে চাহিলেন। ভাগ্যক্রমে কাছে পিঠে কেহ নাই।

বীরশ্রী বিগ্রহপালের এই হঠকারিতায় চমৎকৃত হইয়া গিয়াছিলেন। তাঁহার ভয় হইল, আর বেশিক্ষণ এখানে থাকিলে বিগ্রহ না জানি আরও কি প্রগল্‌ভতা করিয়া বসিবে। তিনি যৌবনশ্রীর হাত ধরিয়া টানিয়া লইলেন। বলিলেন— ‘চল, যৌবনা, আমরা যাই।’

তন্দ্রাচ্ছন্নের মত যৌবনশ্রী সেখান হইতে চলিয়া আসিলেন। বীরশ্রী রথে উঠিয়া অশ্বের বল্‌গা হাতে লইলেন। যৌবনশ্রী রথে উঠিবার আগে আপনার অবশে একবার পিছু ফিরিয়া চাহিলেন। প্রগল্‌ভ যুবক দুষ্টামিভরা মুখে তাঁহার পানেই চাহিয়া আছে। তিনি বিহ্বলভাবে রথে উঠিয়া পড়িলেন।

রথ চলিতে আরম্ভ করিল।

বীরশ্রী বলিলেন— ‘আশ্চর্য সন্ন্যাসী! বোধহয় তান্ত্রিক।’

যৌবনশ্রী উত্তর দিলেন না।

রথের গতি ক্রমশ দ্রুত হইল। আরও কিছুক্ষণ চলিবার পর যৌবনশ্রী প্রথম কথা বলিলেন। সম্মুখ দিকে চক্ষু রাখিয়া ঈষৎ স্খলিতকণ্ঠে প্রশ্ন করিলেন— ‘দিদি, ও কে?’

বীরশ্রী ভগিনীর প্রতি একটি তির্যক দৃষ্টি হানিলেন; তাঁহার অধরপ্রান্ত একটু স্ফুরিত হইল। যেন কিছুই বুঝিতে পারেন নাই এমনিভাবে বলিলেন— ‘কার কথা বলছিস? সন্ন্যাসী ঠাকুরের?’

যৌবনশ্রী একবার দিদির পানে ভর্ৎসনাপূর্ণ দৃষ্টি ফিরাইলেন। কিছুক্ষণ নীরব থাকিয়া বলিলেন— ‘বল না।’

‘কি বলব?’ বীরশ্রী মুখ টিপিয়া হাসি গোপন করিলেন— ‘ও! যে তোর হাতে হাত রেখেছিল তার কথা বলছিস? তা— সে কে আমি কি জানি।’

আবার কিছুক্ষণ নীরব থাকিয়া যৌবনশ্রী বলিলেন— ‘বল না।’

বীরশ্রী হাসিয়া ফেলিলেন— ‘বণিক। পাটলিপুত্র থেকে ব্যবসা করতে এসেছে।’

এবার যৌবনশ্রী অনেকক্ষণ নীরব হইয়া রহিলেন। বীরশ্রী রথ চালাইতে চালাইতে একবার ঘাড় ফিরাইলেন, যৌবনশ্রীর চক্ষু দুটি বাষ্পাকুল, অধর কাঁপিতেছে। বীরশ্রী অনুতপ্ত হইয়া বলিলেন— ‘আচ্ছা আচ্ছা, বণিক নয়— রাজপুত্র। এবার হল তো? ধন্যি মেয়ে তুই! কোথায় ভেবেছিলাম তোকে অনেক বোঝাতে পড়াতে হবে, অনেক কষ্টে রাজী করাতে হবে। তা নয়, একবার দেখেই মূর্ছা!’

যৌবনশ্রী চক্ষু দুটি কিছুক্ষণ মুদিয়া রহিলেন; চোখের বাষ্প গলিয়া দুই বিন্দু অশ্রূ ঝরিয়া পড়িল।

একবার দেখিয়া নিজেকে হারাইয়া ফেলা সকলের জীবনে ঘটে না। মানুষের সহিত মানুষের প্রীতি বড়ই বিচিত্র বস্তু। কখনও দেখা যায়, দীর্ঘ পরিচয়ের পর হঠাৎ একদিন মানুষ বুঝিতে পরিল— ওই মানুষটি না থাকিলে জীবন অন্ধকার। কখনও মনের মানুষ চিরদিনের জন্য চলিয়া যাইবার পর বুঝিতে পারে সে কী হারাইয়াছে। আবার কখনও মেঘমালার ভিতর হইতে তড়িল্লতার মত অজ্ঞাত অপরিচিত মানুষ হৃদয়ে শেল হানিয়া দিয়া চলিয়া যায়, অন্তর্লোকে অলৌকিক ইন্দ্রজাল ঘটিয়া যায়।

যাহারা যৌবনোন্মেষের সঙ্গে সঙ্গে প্রণয়ের কথা চিন্তা করে, প্রেম লইয়া মনে মনে জল্পনা করে, তাহাদের পক্ষে প্রথম প্রেমের আবির্ভাব তেমন মারাত্মক নয়। কিন্তু যাহাদের মনের কৌমার্য ভঙ্গ হয় নাই তাহাদের পক্ষে প্রথম প্রেম বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতই দারুণ; দুঃসহ জ্যোতিরুচ্ছ্বাসে চক্ষু অন্ধ হইয়া যায়।

রাজকুমারী যৌবনশ্রীর তাহাই হইয়াছিল।

দুই

রাজকুমারীরা রথে চড়িয়া চলিয়া গেলেন; অন্য রথটি এবং বাকি রক্ষীর দল তাঁহাদের পিছনে গেল। ঘাটের অঙ্গন শূন্য হইল। কেবল লম্বোদর অঙ্গনের অন্য প্রান্তে একটি ঘোড়ার রাশ ধরিয়া দাঁড়াইয়া অনঙ্গ ও বিগ্রহপালের উপর নজর রাখিল।

অনঙ্গ এতক্ষণ সন্ন্যাসী ঠাকুরের কাছে আসে নাই, একটু দূরে অপেক্ষা করিতেছিল; এখন বিগ্রহপালের পাশে আসিয়া দাঁড়াইল। বিগ্রহপাল তখনও বিলীয়মান রথের পানে চাহিয়া আছেন। অনঙ্গ বলিল— ‘কি হল তোর? ধন্দ লেগে গেল নাকি?’

চমক ভাঙিয়া বিগ্রহপাল হাসিলেন। বন্ধুর পৃষ্ঠে চপেটাঘাত করিয়া বলিলেন— ‘দেখলি?’

অনঙ্গ বলিল— ‘দেখলাম।’

‘অপরূপ সুন্দরী— না?’

‘হুঁ। কিন্তু এখন ত্রিপুরী যাবার উপায় কি?’

এই সময় সন্ন্যাসী ঠাকুর গলা খাঁকারি দিলেন। বিগ্রহপাল সন্ন্যাসীর কথা ভুলিয়া গিয়াছিলেন, এখন তাঁহার দিকে একবার চাহিয়া অনঙ্গকে বলিলেন— ‘জানিস অনঙ্গ, সাধুবাবা একেবারে ত্রিকালদর্শী পুরুষ। আমার হাত দেখে বলে দিলেন, আমি রাজকুলোদ্ভব!’

অনঙ্গ সাধুবাবাকে ভাল করিয়া পরিদর্শন করিল, তারপর নিজের হাত বাড়াইয়া দিয়া বলিল— ‘বলুন তো সাধুবাবা, আমি কে?’

সাধুবাবা অনঙ্গের হাতের দিকে দৃকপাত করিলেন না, বলিলেন— ‘তুমি অনঙ্গপাল।’

অনঙ্গ চমকিত হইল, আর একবার সাধুবাবাকে উত্তমরূপে পর্যবেক্ষণ করিল; তাহার মুখে ধীরে ধীরে হাসি ফুটিয়া উঠিল— ‘ও— আপনি জ্যোতিষাচার্য রন্তিদেব।’

বিগ্রহপাল সবিস্ময়ে বলিলেন— ‘অ্যাঁ! আর্য যোগদেবের ভ্রাতা রন্তিদেব—?’

সাধুবাবা ব্যগ্রস্বরে বলিলেন— ‘চুপ চুপ, কেউ শুনতে পাবে। — তোমাদের জন্যে কাল থেকে এখানে অপেক্ষা করছি। চারিদিকে লক্ষ্মীকর্ণের গুপ্তচর ঘুরে বেড়াচ্ছে তাই ছদ্মবেশে এসেছি। কে জানতো যে লক্ষ্মীকর্ণ স্বয়ং এসে উপস্থিত হবে। — যা হোক, আমি সঙ্গে দুটো ঘোড়া এনেছি, আর একটা গো-শকট। তোমরা ঘোড়ায় চড়ে চলে যাও, আমি পরে গো-শকটে যাব। তোমাদের সঙ্গে যে তৈজসপত্র আছে তাও গো-শকটে যাবে।’

বিগ্রহপাল বলিলেন— ‘ধন্য। কিন্তু নগরে গিয়ে আপনার গৃহ খুঁজে পাব কোথায়?’

রন্তিদেব বলিলেন— ‘নগরে গিয়ে কাক কোকিলকে জিজ্ঞাসা করলে রন্তিদেব দৈবজ্ঞের গৃহ দেখিয়ে দেবে। তবে, আমার ভৃত্য তোমাদের চেনে না। এই রুদ্রাক্ষ নাও, ভৃত্যকে দেখালে সে তোমাদের গৃহে স্থান দেবে, আদর যত্ন করবে। আমার ফিরতে সন্ধ্যা হবে।’

রুদ্রাক্ষ লইয়া বিগ্রহপাল বলিলেন— ‘আপনি সকল ব্যবস্থাই করেছেন দেখছি। অনঙ্গ, তুমি নৌকায় যাও, গরুড়কে বলে দাও আমাদের তৈজসপত্র যেন সাধুবাবার গো-শকটে তুলে দেয়।’

‘যাই’— অনঙ্গ রন্তিদেবের দিকে ফিরিয়া বলিল— ‘গ্রহাচার্য মহাশয়, একটি প্রশ্ন আছে। আমরা দু’জন যে বিগ্রহপাল ও অনঙ্গপাল তা অবশ্য আর্য যোগদেবের পত্রে জানতে পেরেছেন। কিন্তু আমি যে অনঙ্গপাল আর ও যে বিগ্রহপাল তা চিনলেন কি করে? আগে কি আমাদের দেখেছেন?’

‘না, পঞ্চদশ বৎসর আমি ত্রিপুরীতে আছি।’

‘তবে?’

রন্তিদেব হাসিলেন— ‘ও যদি অনঙ্গপাল হত তাহলে যৌবনশ্রীর হাতের ওপর হাত রাখত না। শুধু সাজসজ্জা দিয়ে সকলের চোখে ধূলা দেওয়া যায় না।’

উত্তর শুনিয়া অনঙ্গ পরিতুষ্ট হইল এবং হাসিতে হাসিতে নৌকার দিকে চলিয়া গেল। একজন তীক্ষ্ণধী ব্যক্তিকে সঙ্কটময় কার্যে সহকারীরূপে পাওয়া কম কথা নয়। লক্ষণ সবই ভাল মনে হইতেছে।

নৌকায় গিয়া অনঙ্গ গরুড়কে তৈজসপত্র সম্বন্ধে যথাযোগ্য উপদেশ দিল, তারপর বলিল— ‘আমরা ত্রিপুরী চললাম, কবে ফিরব কিছু স্থির নেই। তোমরা সর্বদা নৌকায় থাকবে, সর্বদা প্রস্তুত থাকবে। হয়তো এক নিমেষের মধ্যে নৌকা নিয়ে দেশে ফিরে যেতে হবে। মনে রেখো।’

গরুড় বলিল— ‘আজ্ঞা।’

দ্বিপ্রহর অতীত প্রায়। রন্তিদেবের ঘোড়া দুটি চালা ঘরে বাঁধা ছিল, দুই বন্ধু তাহাদের বাহিরে আনিয়া রন্তিদেবের নিকট বিদায় লইলেন, ঘোড়ার পিঠে চড়িয়া ত্রিপুরী অভিমুখে যাত্রা করিলেন।

লম্বোদর এতক্ষণ দূর হইতে সমস্ত দেখিতেছিল, কিন্তু কথাবার্তা কিছু শুনিতে পায় নাই। অনঙ্গ এবং বিগ্রহপাল যখন বাহির হইয়া পড়িলেন তখন সেও ঘোড়ার পিঠে চড়িয়া তাঁহাদের অনুসরণ করিল।

ঘাট হইতে যে পথটি নগরের দিকে গিয়াছে তাহা ঈষৎ আঁকাবাঁকাভাবে মেখল পর্বতকে বেষ্টন করিয়া গিয়াছে। মেখল পর্বত বিন্ধ্য গিরিশ্রেণীর নিতম্বদেশ। এই পর্বত হইতে দুইটি নদ-নদী শোণ ও নর্মদা উৎপন্ন হইয়া পূর্ব ও পশ্চিমে মেখলার মতই ভারতবর্ষের কটিদেশ অলঙ্কৃত করিয়া রাখিয়াছে।

পথটি মেখল পর্বতকে যথাসম্ভব পাশ কাটাইয়া যাইবার চেষ্টা করিয়াছে, তবু সর্বত্র সমতল হইতে পারে নাই, ক্রমাগত উচ্চ হইতে হইতে আবার নিম্নাভিমুখে গড়াইয়া পড়িয়াছে। এই তরঙ্গায়িত নিরস্তপাদপ পথে দুই অশ্বারোহী ক্ষুরোদ্ধৃত ধূলিকে পশ্চাতে ফেলিয়া চলিয়াছেন। মধ্যাহ্নে সূর্যের তাপ কিছু প্রখর বটে কিন্তু গতিবেগের জন্য তাহা অনুভব হয় না।

পাশাপাশি অশ্ব চালাইতে চালাইতে দুইজনের মধ্যে বিশ্রাম্ভালাপ হইতেছিল। বিগ্রহপাল বলিলেন— ‘এ পর্যন্ত যাত্রা বেশ ভালই হয়েছে বলতে হবে। যাত্রার সময় খঞ্জন দেখেছিলাম সে কি মিথ্যে হয়? তুই বললি— কাদাখোঁচা। কাদাখোঁচা হলে কি যাত্রা এত ভাল হত?’

অনঙ্গ বলিল— ‘যাত্রা এখনও শেষ হয়নি। কিন্তু ও-কথা যাক। এখানকার খঞ্জনটিকে কেমন মনে হল খুলে বল।’

বিগ্রহপালের চক্ষু রসাবিষ্ট হইয়া উঠিল, তিনি গাঢ়স্বরে বলিলেন— ‘ভাই, ও খঞ্জন নয়— রাজহংসী। মানস সরোবরের রাজহংস। তুইও তো দেখেছিস। বল, সত্যি কিনা!’

অনঙ্গ ঢোক গিলিয়া বলিল— ‘হাঁ, তা— সত্যি বৈকি। তোর চোখে যখন ভাল লেগেছে—’

বিগ্রহপাল মহা বিস্ময়ে বলিলেন— এ কি বলছিস! তোর চোখে ভাল লাগেনি?’

অনঙ্গ বলিল— ‘না না, ভাল লেগেছে, খুবই সুন্দরী। তবে—’

‘তবে কি?’

‘ভাই একটু বেশি তন্বী। অত তন্বী হওয়া ভাল নয়। আমার বৌটা ছিল ভীষণ তন্বী, তাই টিকল না। গায়ে একটু মেদমাংস থাকলে হয়তো টিকত।’ বলিয়া অনঙ্গ গভীর নিশ্বাস মোচন করিল।

বিগ্রহপাল উচ্চকণ্ঠে হাসিয়া উঠিলেন— ‘তুই শিল্পী কিনা, তাই জগদ্দল পাথরের যক্ষিণীমূর্তি না হলে তোর মন ওঠে না। দাঁড়া, এবার, পাটলিপুত্রে ফিরে গিয়ে তোর জন্যে একটি হস্তিনী খুঁজে বার করব।’

অনঙ্গপাল বলিল— ‘রোগা বৌয়ের অবশ্য একটা সুবিধা আছে, দরকার হলে কাঁধে তুলে নিয়ে পালাতে পারবি।’

রঙ্গ পরিহাসে দুই ক্রোশ পথ অতিক্রান্ত হইল। বিগ্রহ বলিলেন— ‘এ পথে বেশি লোক চলাচল নেই। এতদূর এলাম, একজন পথিকও চোখে পড়ল না।’

অনঙ্গ বলিল— ‘পথিক যারা ছিল তারা সব এগিয়ে গেছে, পিছনে কেউ নেই।’ অলসভাবে পিছন দিকে ঘাড় ফিরাইয়া সে বলিয়া উঠিল— ‘আছে আছে। একটা লোক পিছনে আসছে।’

বিগ্রহপাল পিছন ফিরিয়া দেখিলেন। প্রায় পাঁচ-ছয় রজ্জু দূরে পথ যেখানে কুব্জ পৃষ্ঠের ন্যায় উঁচু হইয়াছে সেইখানে একজন অশ্বারোহী আসিতেছে। এতদূর হইতে মানুষটার চেহারা ভাল দেখা গেল না, পোশাক পরিচ্ছদেরও আড়ম্বর নাই। বিগ্রহ বলিলেন— ‘লোকটা আসুক, ওর কাছ থেকে জানা যাবে ত্রিপুরী আর কত দূর।’

লোকটা কিন্তু আসিল না। ইঁহারা ঘোড়া থামাইয়াছেন দেখিয়া সেও ঘোড়া থামাইয়া অবতরণ করিল এবং ঘোড়ার পা তুলিয়া ক্ষুর পরীক্ষা করিতে লাগিল।

কিছুক্ষণ অপেক্ষা করিয়া দুইজনে আবার মন্থরগতিতে অশ্ব চালাইলেন। পিছনের পথিকও ঘোড়ায় চড়িয়া মন্থরগতিতে আসিতে লাগিল। তাঁহাদের মাঝখানের ব্যবধান কমিল না। দুই বন্ধু জোরে ঘোড়া চালাইলেন; কিছুক্ষণ পরে পিছু ফিরিয়া দেখিলেন পিছনের অশ্বারোহী যত দূরে ছিল তত দূরেই আছে, ব্যবধান বাড়ে নাই।

অনঙ্গ মাথা নাড়িয়া বলিল— ‘গতিক সুবিধার নয়। বোধহয় মহারাজ লক্ষ্মীকর্ণ আমাদের পিছনে একটি গুপ্তচর জুড়ে দিয়েছেন।’

‘আচ্ছা দেখা যাক—’ বলিয়া বিগ্রহপাল আবার ঘোড়া থামাইলেন, ঘোড়ার মুখ ফিরাইয়া হাত তুলিয়া লোকটিকে আহ্বান করিলেন। লোকটি যেন দেখিতেই পায় নাই, এমনিভাবে ঘোড়া হইতে নামিয়া আবার ঘোড়ার ক্ষুর পরীক্ষা করিতে লাগিল। তখন আর সন্দেহ রহিল না।

দুইজনে আবার সম্মুখ দিকে অশ্ব চালাইলেন। অনঙ্গ বলিল— ‘গুপ্তচরই বটে। আমরা কোথায় যাই দেখতে চায়।’

বিগ্রহ বলিলেন— ‘হুঁ। কিন্তু গুপ্তচর লাগিয়েছে কেন? আমি কে তা কি জানতে পেরেছে?’

অনঙ্গ বলিল— ‘সম্ভব নয়। নূতন লোক দেখলেই বোধহয় পিছনে গুপ্তচর লাগে।’ কিছুক্ষণ চিন্তা করিয়া বলিল— ‘গুপ্তচরটা আমার পিছু নিয়েছে, তোর নয়। কারণ লক্ষ্মীকর্ণ যতক্ষণ ছিলেন তুই ততক্ষণ বাইরে আসিসনি। — এক কাজ করা যাক। নগরে পৌঁছে আমরা দু’জনে দুই পথে যাব। গুপ্তচরটা তখন কী করবে? নিশ্চয় আমার পিছনে আসবে। তুই তখন নির্বিঘ্নে রন্তিদেবের বাড়িতে গিয়ে উঠিস।’

‘তারপর?’

‘তারপর আমরা নগরের মধ্যে হারিয়ে যাব। যদি দেখি গুপ্তচরকে এড়াতে পারলাম না, তখন নগরে কোথাও বাসা নেব। আর যদি ফাঁকি দিতে পারি রন্তিদেবের বাড়িতে গিয়ে উপস্থিত হব। যদি আজ রাত্রির মধ্যে না যেতে পারি তুই ভাবিসনি।’

দুইজনে আরও কিছুক্ষণ আলোচনা করিয়া পরামর্শ স্থির করিলেন। ক্রমে ত্রিপুরী নগরী নিকটবর্তী হইতে লাগিল। পথের ধারে দুটি-একটি গৃহ, দুটি-একটি মন্দির, ক্রমশ ঘন সন্নিবিষ্ট লোকালয়।

পথটি নগরে প্রবেশ করিতে গিয়া ত্রিধা হইয়াছে; একটি পথ নগরের বুক চিরিয়া ভিতরে প্রবেশ করিয়াছে, অন্য দুইটি দক্ষিণে ও বামে বাহু বিস্তার করিয়া নগরকে বেষ্টন করিয়া রাখিয়াছে। অনঙ্গ ঘাড় বাঁকাইয়া দেখিল গুপ্তচর পিছনে আছে; দুই বন্ধু দুই পথ ধরিলেন।

অনঙ্গ যে পথ ধরিয়াছিল তাহা অপেক্ষাকৃত বিরলগৃহ; এক পাশে অধিকাংশই মাঠ, অন্য পাশে দুই চারিটা গৃহ আছে। গৃহগুলি মধ্যমশ্রেণীর; পথে মানুষের যাতায়াত কম। দিবা তৃতীয় প্রহরে স্থানটি নিরাবিল এবং নিদ্রালু।

গুপ্তচর তাহারই পিছনে আসিতেছে দেখিয়া অনঙ্গ প্রীত হইল। সে জোরে ঘোড়া চলাইল। এইবার গুপ্তচর মহাশয়কে ধরিতে হইবে।

কিছুদূর ঘোড়া ছুটাইবার পর অনঙ্গ দেখিল, সম্মুখে একটি শাখা-পথ বাহির হইয়া নগরের অভ্যন্তরের দিকে গিয়াছে। সন্ধিস্থলের কোণে ঘন বাঁশ-ঝাড়ের যবনিকা। অনঙ্গ ঘোড়ার মুখ সেই দিকে ফিরাইয়া শাখা-পথে প্রবেশ করিল, তারপর ঘোড়ার বেগ সংযত করিয়া চুপি চুপি বাঁশ-ঝাড়ের আড়ালে গিয়া লুকাইল।

বেশিক্ষণ অপেক্ষা করিতে হইল না, দ্রুত অশ্বক্ষুরধ্বনি শোনা গেল। গুপ্তচরও এই দিকে ঘোড়া ফিরাইয়াছে, অনঙ্গকে সম্মুখে দেখিতে না পাইয়া তাহার মুখ উদ্বিগ্ন—

বক্র হাসিয়া অনঙ্গ বাঁশ-ঝারের আড়াল হইতে বাহির হইয়া আসিল, ঘোড়া ছুটাইয়া গুপ্তচরের পার্শ্ববর্তী হইল। গুপ্তচর তাহাকে পাশে দেখিয়া ভ্যাবাচাকা খাইয়া গেল, তারপর তাহার মুখে বোকাটে হাসি ফুটিয়া উঠিল।

দুইটি ঘোড়া পাশাপাশি চলিয়াছে। অনঙ্গ এতক্ষণে গুপ্তচরের মূর্তি ভাল করিয়া দেখিল। মাঝারি মাংসল দেহ, তামাটে বর্ণ, বয়স অনুমান চল্লিশ; মুখখানি গোলাকার, চক্ষু দুটি গোলাকার, ভ্রূ অর্ধ-গোলাকার; নাকটি বোধহয় ভালুকে খাইয়া গিয়াছে। মুখে বুদ্ধির নামগন্ধ নাই। অনঙ্গের মনে একটু ধোঁকা লাগিল। সত্যই গুপ্তচর বটে তো?

ধাবমান অশ্বপৃষ্ঠে আলাপ হইল। অনঙ্গ বলিল— ‘বাপু, তুমি কি এই নগরীর নাগরিক?’

দন্তবিকাশ করিয়া গুপ্তচর বলিল— ‘আজ্ঞা—?’

অনঙ্গ বলিল— ‘তোমাকে যেন কোথায় দেখেছি। তুমি কি শোণের ঘাটে ছিলে?

গুপ্তচর বলিল— ‘আজ্ঞা। কাজে গিয়েছিলাম। — আপনি?’

অনঙ্গ বলিল— ‘আমি বণিক, পাটলিপুত্রে বাড়ি। ত্রিপুরীতে প্রথম এসেছি।’

গুপ্তচর বলিল— ‘বণিক— অহহ। স্বয়ংবরে অনেক রাজ-রাজড়া আসবে তাই অসংখ্য বণিকও এসেছে। তা— আপনার পণ্যবস্তু কৈ?’

‘পণ্যবস্তু নৌকায় রেখে এসেছি। আগে একটা বাসস্থান ঠিক করে পণ্যবস্তু নিয়ে আসব। তুমি ত্রিপুরীর নাগরিক?’

‘আজ্ঞা। আমি রাজকর্মচারী।’

‘বটে! কি কাজ কর?’

‘করণ।’

‘নাম কি?’

‘লম্বোদর।’

‘ভাল, লম্বোদর, তুমি আমাকে একটা বাসস্থানের সন্ধান দিতে পার? একটা ঘর হলেই চলবে।’

লম্বোদর মাথা চুলকাইয়া চিন্তা করিল।

‘একটা ঘর?’

‘হাঁ।’

‘আমার ঘরে আসতে পারেন। আমার গৃহটি বেশ বড়। আমরা মাত্র তিনটি প্রাণী।’

অনঙ্গের মনে একটু দ্বিধা জাগিলেও সে মুখে বলিল— ‘বেশ বেশ। কত ভাটক লাগবে?’

‘কতদিন থাকবেন?’

‘মনে কর এক মাস।’

‘আহারাদি?’

‘মনে কর তোমার গৃহেই।’

লম্বোদর বিবেচনা করিয়া বলিল— ‘তাহলে এক মাসের জন্য এক রূপক লাগবে।’

‘এক রূপক? বেশ, আমি সম্মত আছি।’

লম্বোদর আকর্ণ হাসিয়া বলিল— ‘আসুন, আমার গৃহ বেশি দূর নয়। রেবার তীরে।’

লম্বোদর ডান দিকে মোড় ঘুরিল, অনঙ্গ মোড় ঘুরিল। দুইজন নীরবে চলিল। লম্বোদর একসময় ঘাড় বাঁকাইয়া অনঙ্গের অশ্বটিকে দেখিল, নিতান্ত ভাল মানুষের মত বলিল— ‘সুন্দর ঘোড়া! কোথায় পেলেন?’

অনঙ্গ চট্‌ করিয়া গল্প তৈয়ার করিয়া বলিল— ‘আমার নৌকায় একটি লোক এসেছে, সে ত্রিপুরীতে অশ্বের ব্যবসা করে। ঘাটে তার জন্যে দুটি ঘোড়া উপস্থিত ছিল, সে একটি ঘোড়া আমাকে ধার দিয়েছে।’

আর কোনও প্রশ্নোত্তর হইল না। অনঙ্গ মনে মনে একটু অস্বাচ্ছন্দ্য অনুভব করিতে লাগিল; লোকটার চেহারা এবং কথাবার্তা হইতে ঘোর নির্বোধ বলিয়াই মনে হয়, কিন্তু নির্বোধ না হইতেও পারে। সাবধান থাকা ভাল। যে গুপ্তচরকে গুপ্তচর বলিয়া চেনা যায় না সেই গুপ্তচর ভয়ানক। আজ রাত্রিটা ওর ঘরেই কাটানো যাক, তারপর কাল দেখা যাইবে। বিগ্রহ নিরাপদে যথাস্থানে পৌঁছিয়াছে ইহাই যথেষ্ট।

লম্বোদর মনে মনে ভাবিলে— লোকটাকে বণিক বলিয়াই মনে হইতেছে। যা হোক, এ মন্দ হইল না। আমার গৃহে থাকিবে, আমি সর্বদা দৃষ্টি রাখিতে পারিব।

অল্পক্ষণ পরে তাহারা লম্বোদরের গৃহে পৌঁছিল। নগরের উপান্তে নর্মদার তীরে লম্বোদরের গৃহ, আশেপাশে জনবসতি নাই। নদীর তীর ধরিয়া দৃষ্টি প্রসারিত করিলে অর্ধ-ক্রোশ দূরে রাজপ্রসাদ দেখা যায়।

তিন

রাজপুরীতে বাঁশি বাজিয়া উঠিল।

জামাতাকে লইয়া মহারাজ আসিলেন, তারপর আসিলেন রাজকন্যারা। রাজভবনের দাসী কিঙ্করীরা পুরদ্বারে দাঁড়াইয়া উৎসুক চিত্তে প্রতীক্ষা করিতেছিল, তাহারা শঙ্খ বাজাইল, হুলুধ্বনি করিল, পূর্ণ ঘট হইতে পথের উপর জল ঢালিয়া দিল। বীরশ্রীর মধুর-সরস চরিত্রের জন্য সবাই তাঁহাকে ভালবাসে; সকলে তাঁহাকে ঘিরিয়া ধরিল। তিন বৎসর পরে দেখা, কিন্তু বীরশ্রী কাহারও নাম ভোলেন নাই। জনে জনে প্রিয়সম্ভাষণ করিলেন, কুশলপ্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিলেন, রঙ্গ পরিহাস করিলেন। বান্ধুলির আঁচল ধরিয়া কাছে টানিয়া আনিয়া বলিলেন— ‘হ্যাঁ লা বান্ধুলি, তুইও তো বেশ ডাগর হয়ে উঠেছিস, তা তোর স্বয়ংবরটাও এই সঙ্গে হয়ে যাক না।’

দ্বিতলে উঠিয়া বীরশ্রী যৌবনশ্রীকে বলিলেন— ‘চল ভাই, আগে ঠাকুরানীকে প্রণাম করি গিয়ে। কেমন আছেন তিনি?’

‘আছেন।’ বলিয়া যৌবনশ্রী দিদিকে ঠাকুরানীর কোষ্ঠের দিকে লইয়া চলিলেন।

ঠাকুরানী— মহারাজ লক্ষ্মীকর্ণের জননী অম্বিকা দেবী। অতিশয় প্রবল-পরাক্রান্তা মহিলা; লক্ষ্মীকর্ণের পিতা মহারাজ গাঙ্গেয়দেবও তাঁহাকে ভয় করিয়া চলিতেন। লক্ষ্মীকর্ণ রাজা হইবার পর কিছুকাল অম্বিকা দেবী তাঁহার জীবনে কণ্টকস্বরূপ হইয়া ছিলেন, স্বাধীনভাবে একটি কাজও করিবার অধিকার লক্ষ্মীকর্ণের ছিল না। প্রজারা অম্বিকা দেবীকে ভক্তি করিত, চণ্ডী হইলেও তিনি প্রজাবৎসল ছিলেন। তারপর হঠাৎ একদিন লক্ষ্মীকর্ণের কপাল খুলিল, অম্বিকা দেবী পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হইয়া শয্যাশায়িনী হইলেন। লক্ষ্মীকর্ণ নিষ্কণ্টক হইলেন বটে, কিন্তু অম্বিকা দেবীর স্বভাব পরিবর্তিত হইল না; তিনি সময়ে অসময়ে পুত্রকে রোগ-শয্যার পাশে ডাকিয়া পঠাইয়া তর্জন ও ভর্ৎসনা করিতে আরম্ভ করিলেন। শেষ পর্যন্ত লক্ষ্মীকর্ণ মাতার সহিত দেখা-সাক্ষাৎ বন্ধ করিয়া দিলেন। অম্বিকা শুইয়া শুইয়া যথাসম্ভব পুত্রের অনিষ্ট চেষ্টা করিতে লাগিলেন। অম্বিকা ক্রোধন-স্বভাব হইলেও অতিশয় কূটবুদ্ধি ছিলেন। লক্ষ্মীকর্ণ দূরে থাকিয়া তাঁহাকে ভয় করিতেন।

দ্বিতলের এক পাশে নিভৃত অংশে অম্বিকা দেবীর বাসস্থান। তাঁহার পরিচর্যার জন্য দুইজন উপস্থায়িকা অহর্নিশি উপস্থিত থাকে। যৌবনশ্রী প্রাতে ও রাতে একবার করিয়া ঠাকুরানীকে দেখিয়া যান। বীরশ্রী যে আজ শ্বশুরালয় হইতে ফিরিবেন। এ সংবাদ ঠাকুরানী পাইয়াছিলেন; তাই শয্যায় শয়ান থাকিয়াও তাঁহার চক্ষু দ্বারের উপর নিবদ্ধ ছিল। দুই নাতিনীর মধ্যে প্রথমাকেই তিনি অধিক ভালবাসিতেন।

বীরশ্রী ও যৌবনশ্রী কক্ষে প্রবেশ করিলে অম্বিকা উপবিষ্ট হইবার চেষ্টা করিলেন। কিন্তু তাঁহার বামাঙ্গ পঙ্গু, নিজের চেষ্টায় উপবিষ্ট হওয়া সহজ নয়। তিনি উপস্থায়িকাদের আদেশ করিলেন— ‘আমাকে উঠিয়ে বসিয়ে দে।’— রোগের প্রকোপে তাঁহার জিহ্বা স্খলিতবাক্‌ হইয়া গিয়াছে, কিন্তু আদেশ দিবার ভঙ্গিতে তিলমাত্র জড়তা নাই।

উপস্থায়িকারা তাঁহার পৃষ্ঠে উপাধান দিয়া বসাইয়া দিল। তিনি দক্ষিণ বাহু প্রসারিত করিয়া বীরশ্রীকে ডাকিলেন— ‘আয়।’

বীরশ্রী প্রথমে পিতামহীর চরণ স্পর্শ করিয়া প্রণাম করিলেন, তারপর বাষ্পাকুল চক্ষে শয্যার পাশে বসিতেই অম্বিকা তাঁহাকে বুকে জড়াইয়া লইলেন। তাঁহার চক্ষুও সজল হইয়া উঠিল।

অম্বিকার বয়স এখন প্রায় সত্তর। দেহ স্থূল, শিথিলচর্ম, মুখে রোগজীর্ণ লোলতা, চক্ষু দুটি বড় বড় এবং ধীরসঞ্চারী; মাথার পলিত কেশ বিরল হইয়া গিয়াছে। তবু সব মিলাইয়া এমন একটি অনমিত দুর্দমতা আছে যে শয্যাগত অবস্থাতেও দর্শকের মনে সম্ভ্রম উৎপাদন করে।

কিছুক্ষণ নাতিনীকে বক্ষলগ্ন করিয়া রাখিয়া অম্বিকা তাঁহাকে তুলিয়া গভীর প্রশ্নসমাকুল চক্ষে তাঁহার মুখ দেখিলেন। তারপর কড়া সুরে বলিলেন— ‘তোর বাঙালী তোকে এখনও ভালবাসে?’

বীরশ্রীর ঠোঁটের কোণে একটু হাসি খেলিয়া গেল।

অম্বিকা বলিলেন— ‘অন্য বিয়ে করেনি?’

বীরশ্রী দশন রেখা ঈষৎ ব্যক্ত করিয়া মাথা নাড়িলেন— ‘না দিদি।’

অম্বিকা তৃপ্তির একটি নিশ্বাস ফেলিলেন— ‘ভাল। কিন্তু পুরুষকে বিশ্বাস নেই। সব সময় কড়া নজর রাখবি।’

বীরশ্রী বলিলেন— ‘রাখব দিদি। তুমি কেমন আছ?’

অম্বিকা বলিলেন— ‘আমার আবার থাকা— বেঁচে আছি। তোদের বাপ—’ অম্বিকার চক্ষু ধীরে ধীরে যৌবনশ্রীর দিকে ফিরিল— ‘তোর স্বয়ংবর করছে। কেন স্বয়ংবর করতে চায় জানি না, নিশ্চয় কোনও দুরভিপ্রায় আছে। স্বয়ংবর হলেই রাজায় রাজায় মন কষাকষি, ঝগড়া, যুদ্ধ। তোদের বাপ বোধহয় তাই চায়। — যৌবনা, কাছে আয়।’

যৌবনশ্রী এতক্ষণ পালঙ্কের পদমূলে দাঁড়াইয়া ছিলেন, এখন পাশে আসিয়া দাঁড়াইলেন। অম্বিকা আরও কিছুক্ষণ তাঁহাকে স্থিরদৃষ্টিতে নিরীক্ষণ করিয়া বলিলেন— ‘তোর কি ইচ্ছা? স্বয়ংবরা হতে চাস?’

যৌবনশ্রী উত্তর দিলেন না, আনত আতপ্ত মুখে নীরব রহিলেন। বীরশ্রী মৃদুস্বরে বলিলেন— ‘তাতে দোষ কি দিদি? স্বয়ংবর প্রথা আমাদের বংশে আছে। যৌবনার স্বয়ংবর হলে ও নিজের মনের মত বর পছন্দ করে নিতে পারবে। জোর করে বুড়ো রাজার সঙ্গে বিয়ে দেওয়ার চেয়ে সে কি ভাল নয়?’

অম্বিকা বীরশ্রীর পানে তির্যক চক্ষে চাহিলেন— ‘তোর কি বুড়ো রাজার সঙ্গে বিয়ে হয়েছে?’

বীরশ্রী হাসিয়া ফেলিলেন— ‘আমার কথা ছেড়ে দাও—’

অম্বিকা বলিলেন— ‘আমি যতদিন আছি সে ভয় নেই। তোর বাপের মনে যত কুবুদ্ধিই থাকুক, আমি বিছানায় শুয়ে শুয়ে সব পণ্ড করে দিতে পারি।’

বীরশ্রী বলিলেন— ‘কিন্তু দিদি, যৌবনার স্বয়ংবরে কি তোমার মত নেই?’

অম্বিকা বলিলেন— ‘তোরা ছেলেমানুষ। কিছু বুঝিস না। আজকাল স্বয়ংবর আর সে স্বয়ংবর নেই। মেয়ের বাপ আগে থাকতে ঠিক করে রাখে কার গলায় মেয়ে মালা দেবে। সব রাজনৈতিক কূট-কচাল। — যৌবনা, তোর বাপ তোকে কিছু বলেছে?’

যৌবনশ্রী সঙ্কুচিতভাবে মাথা নাড়িলেন— ‘না।’

‘বলবে। তোর পিসীর যখন স্বয়ংবর হয় তখন ওরা বাপ-বেটায় ওই মতলব করেছিল, বুড়ো রাজেন্দ্র চোলকে স্বয়ংবরে ডেকেছিল। আমি জানতে পেরে সব ভণ্ডুল করে দিলাম।’ পুরাতন কথার স্মরণে বৃদ্ধার মুখের দক্ষিণভাগে একটি বাঁকা হাসির খাঁজ পড়িল। বীরশ্রী খিলখিল করিয়া হাসিয়া উঠিলেন। যৌবনশ্রীর মুখেও চাপা কৌতুকের ঝিলিক খেলিয়া গেল।

অম্বিকা হঠাৎ গম্ভীর হইয়া বলিলেন— ‘হাসির কথা নয়। যৌবনা, স্পষ্ট করে বল, স্বয়ংবরা হতে চাস? যদি কারুর ওপর তোর মন পড়ে থাকে, আর সে যদি রাজা বা রাজপুত্র না হয়— আমার কাছে লুকোসনি।’

যৌবনশ্রীর মুখ সিন্দূরবর্ণ হইয়া উঠিল। বীরশ্রী সচকিতে কক্ষের চারিদিকে চাহিলেন। উপস্থায়িকা দুইজন দ্বারের কাছে দাঁড়াইয়া আছে এবং নিশ্চয় কান খাড়া করিয়া সব কথা শুনিতেছে। বীরশ্রী ঠাকুরানীর কানের কাছে মুখ লইয়া গিয়া চুপিচুপি বলিলেন— ‘দিদি, এখন এ সব কথা থাক, পরে তোমাকে বলব। অনেক কথা বলবার আছে।’

বৃদ্ধা তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে দুই নাতিনীকে নিরীক্ষণ করিয়া অল্প ঘাড় নাড়িলেন। বলিলেন— ‘তোরা এখন যা, খাওয়া-দাওয়া করে গিয়ে।’

অতঃপর নাতিনীরা প্রস্থান করিলে পক্ষাঘাতপঙ্গু বৃদ্ধা পুত্রের যজ্ঞপণ্ড করিবার চিন্তায় মগ্ন হইলেন।

লক্ষ্মীকর্ণ তখন জামাতাকে পাশে লইয়া মধ্যাহ্ন ভোজনে বসিয়াছিলেন। সোনার পাত্রে ছত্রিশ ব্যজ্ঞন সেবন করিতে করিতে দুইজন মাঝে মাঝে কথা হইতেছিল।

জাতবর্মা বলিলেন— ‘স্বয়ংবরের আয়োজন সব প্রস্তুত?’

লক্ষ্মীকর্ণ বলিলেন— ‘এখনও এক মাস সময় আছে। আজ পূর্ণিমা, আগামী পূর্ণিমায় স্বয়ংবর। ততদিনে সব আয়োজন সম্পূর্ণ হবে।’

‘কোন্‌ কোন্‌ রাজা আসছেন?’

‘দ্বাদশ জন রাজা ও রাজপুত্র আসছেন এ পর্যন্ত সংবাদ পেয়েছি। তন্মধ্যে ভোজরাজ, কলিঙ্গের দুই রাজপুত্র, উৎকালরাজ, মৎস্যরাজ, অন্ধ্ররাজ, কর্ণাটরাজ বিক্রম আছেন।’

জাতবর্মা নিরীহভাবে প্রশ্ন করিলেন— ‘মগধের বিগ্রহপাল আসছে তো?’

‘মগধের বিগ্রহপল—’ এক গ্রাস অন্ন মুখে পুরিয়া লক্ষ্মীকর্ণ দুলিয়া দুলিয়া হাসিতে লাগিলেন।

জাতবর্মা ঈষৎ বিস্ময়ে শ্বশুরের পানে চাহিলেন। লক্ষ্মীকর্ণ তখন অন্ন-পিণ্ড গলাধঃকরণ করিয়া বলিলেন— ‘হা— হা— রহস্য আছে। পরে জানতে পারবে।’

জাতবর্মা আর কোনও প্রশ্ন করিলেন না। বুড়া ভারি ধূর্ত, বেশি কৌতূহল প্রকাশ করিলে হয়তো সন্দেহ করিবে।

চার

নগরের মধ্যস্থলে চতঃশৃঙ্গের উপর জ্যোতিষাচার্য রন্তিদেবের চতুঃশাল গৃহ। গৃহ ঘিরিয়া ফলফুলের উদ্যান। রন্তিদেব সমৃদ্ধ ব্যক্তি; প্রধানত ধনী শ্রেষ্ঠী সম্প্রদায় তাঁহার যজমান। শ্রেষ্ঠীরা দূর দেশে বাণিজ্য যাত্রার পূর্বে তাঁহার কাছে ভাগ্য-গণনা করাইতে আসে, প্রয়োজন হইলে শান্তি স্বস্ত্যয়ন করায়, স্বর্ণমুষ্টি প্রণামী দিয়া যায়। বহিরাগত শ্রেষ্ঠীরাও রন্তিদেবের নাম জানে, তাহারা ত্রিপুরীতে আসিয়া দৈব বিষয়ে রন্তিদেবের শরণ লয়, কেহ কেহ তাঁহার গৃহেই অবস্থান করে। রন্তিদেবের ভবনে অতিথি সৎকারের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা আছে।

রন্তিদেবের গৃহ খুঁজিয়া বাহির করিতে বিগ্রহপালের কোনই কষ্ট হইল না। নগরের কেন্দ্রভূমিতে বহু অট্টালিকা, পথে বহু নাগরিকের যাতায়াত। বিগ্রহ একজন নাগরিককে জিজ্ঞাসা করিতেই সে অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়া দেখাইয়া দিল—

‘ওই যে তোরণের উপর সাত ঘোড়ার রথ আঁকা রয়েছে, ওই বাড়ি।’

সপ্তাশ্ব রথ, অর্থাৎ সূর্য রথ, সুতরাং গ্রহাচার্যের গৃহই বটে। বিগ্রহপাল তোরণ পথে অশ্ব চালাইলেন।

গৃহদ্বারের সম্মুখে গৃহের প্রধান ভৃত্য, একজন মালী এবং অশ্বশালার ঘোড়াডোমের সঙ্গে দাঁড়াইয়া গালগল্প করিতেছিল। অশ্বারোহীকে দেখিয়া ভৃত্য অগ্রসর হইয়া আসিল। বিগ্রহপল তাহার হাতে রুদ্রাক্ষ দিলেন।

ভৃত্যটি চালাক চতুর, ঘোড়া দেখিয়াই চিনিয়াছিল। সে মহা সমাদর করিয়া বিগ্রহপালকে লইয়া গিয়া ভবনের দ্বিতলে একটি সুসজ্জিত কক্ষে উপস্থিত করিল। ঘোড়াটিকে ঘোড়াডোম গৃহের পশ্চাদ্দেশে অশ্বকুঠীতে লইয়া গেল।

বিগ্রহপাল হস্তমুখ প্রক্ষালন ও বস্ত্রাদি পরিবর্তন করিয়া কিঞ্চিৎ ফলমূল ও মিষ্টান্ন জলযোগ করিলেন, তারপর খট্বাঙ্গে দুগ্ধফেন শয্যায় অঙ্গ প্রসারিত করিয়া অব্যবহিত অতীতকালের কথা মনে মনে পর্যালোচনা করিতে লাগিলেন। নানা চিন্তার মধ্যে যৌবনশ্রীর বিদ্যুল্লতার মত রূপ থাকিয়া থাকিয়া তাঁহার মনে চমকিয়া উঠিতে লাগিল।

রন্তিদেব ফিরিলেন সন্ধ্যার প্রাক্কালে। ভস্মজটাদি ছদ্মবেশ হইতে মুক্ত হইয়া তাঁহার প্রকৃত স্বরূপ ব্যক্ত হইয়াছে। ব্রাহ্মণ পণ্ডিতের মত আকৃতি; ক্ষৌরিত মস্তকে গ্রন্থিবদ্ধ শিখা, শীর্ণ-শাণিত মুখ, চক্ষু দুটিতে বুদ্ধির সহিত কৌতুকের সংমিশ্রণ ঘটিয়াছে। বয়স চল্লিশের ঊর্ধ্বে। রন্তিদেব জ্যোতিষশাস্ত্রে ও অন্যান্য নানা বিদ্যায় সুপণ্ডিত, বয়সও চটুলতার গণ্ডী ছাড়াইয়া গিয়াছে; কিন্তু অন্তরে তিনি এখনও গম্ভীর হইতে পারেন নাই। একটু রঙ্গ-পরিহাস বা নাট্যাভিনয়ের গন্ধ পাইলে তিনি আর স্থির থাকিতে পারেন না। সাধারণত জ্যোতির্বিদেরা জীবন-মৃত্যুর সমস্যা লইয়া সর্বদা নাড়াচাড়া করিতে করিতে অতিমাত্রায় গম্ভীর হইয়া পড়েন; রন্তিদেবের চরিত্র ঠিক তাহার বিপরীত। জীবন-মৃত্যু তাঁহার কাছে মহাকালের নর্তন ছন্দ মাত্র।

রন্তিদেব বিগ্রহপলকে আলিঙ্গন করিয়া বলিলেন— ‘কুমার, আপনি আজ আমার গৃহে অতিথি, এ কেবল আমার পূর্বার্জিত সৎকৃতির ফল।’

বিগ্রহপাল হাসিয়া বলিলেন— ‘আর্য রন্তিদেব, আপনি আমাকে বেশি সম্মান দেখালে লোকে সন্দেহ করবে।’

রন্তিদেব বলিলেন— ‘বটে বটে, সত্য কথা। অভিনয় করতে হবে। তুমি আমার বন্ধু-পুত্র, নিবাস কাশী। তোমার নাম—?’

বিগ্রহ বলিলেন— ‘রণমল্ল কেমন হয়?’

রন্তিদেব সহর্ষে দুই হস্ত ঘর্ষণ করিতে করিতে বলিলেন— ‘রণমল্ল— চমৎকার। ভাল কথা, তোমার বন্ধুটি কোথায়?’

বিগ্রহপাল তখন অনঙ্গ ও গুপ্তচরের কথা বলিলেন। শুনিয়া রন্তিদেব কিছুক্ষণ ললাট কুঞ্চিত করিয়া রহিলেন, পরে বলিলেন— ‘লক্ষ্মীকর্ণের পক্ষে কিছুই আশ্চর্য নয়, লোকটি অতিশয় সন্দিগ্ধচিত্ত। বৃষ লগ্নে জন্ম, তার উপর লগ্নে বৃহস্পতি। শাস্ত্রে বলে— বৃষ লগ্নে গুরুঃ খলঃ।’

বিগ্রহ বলিলেন— ‘আপনি মহারাজ লক্ষ্মীকর্ণকে চেনেন?’

রন্তিদেব মৃদু মৃদু হাসিতে লাগিলেন। — ‘বিলক্ষণ চিনি। মহারাজ আমার প্রতি তুষ্ট নয়।’

‘তুষ্ট নয় কেন?’

‘রাজমাতা অম্বিকা দেবী যখন পক্ষাঘাত রোগে আক্রান্ত হন তখন মহারাজ আমাকে ডেকে মাতার মৃত্যুকাল গণনা করতে বলেছিলেন। আমি গণনা করে বলেছিলাম মাতৃদেবী এখনও দীর্ঘকাল জীবিত থাকবেন; এবং মাতার মৃত্যুর এক মাসের মধ্যে মহারাজের মৃত্যু হবে। সেই থেকে মহারাজ আমার প্রতি বিরূপ। একটি নিরেট ভণ্ড-পণ্ডিতকে সভা-জ্যোতিষী নিযুক্ত করেছেন।’ বলিয়া রন্তিদেব উচ্চহাস্য করিয়া উঠিলেন।

বিগ্রহপাল বিস্ময়াবিষ্ট হইয়া শুনিতেছিলেন, বলিলেন— ‘সত্যি কি গণনায় এই ফল পেয়েছিলেন?’

রন্তিদেব বলিলেন— ‘দীর্ঘায়ু পেয়েছিলাম। বাকিটা কল্পনা।’

‘তবে—?’

‘বৎস রণমল্ল, আয়ু থাকলেও কখনও কখনও অপঘাত মৃত্যু হতে পারে, তাই একটু সতর্কতা অবলম্বন করেছিলাম।’

‘আপনার বিশ্বাস এই সতর্কতা অবলম্বন না করলে মহারাজ লক্ষ্মীকর্ণ নিজের মাতাকে—?’

রন্তিদেব একবার ঊর্ধ্বদিকে উদাস দৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়া অলসকণ্ঠে বলিলেন— ‘মাতৃহত্যা মহাপাপ, এ কাজ মহারাজ কখনই করতে পারেন না। কিন্তু ইচ্ছাকৃত অবহেলায় রুগ্ন ব্যক্তির মৃত্যু হতে পারে। — যাক এসব কথা, এখন তোমার কথা বল। যৌবনশ্রীকে ভাল লেগেছে?’

বিগ্রহ একটু সলজ্জ হাসিলেন, বলিলেন— ‘আর্য, আপনি ওকে আগে দেখেছেন?’

‘দেখিনি! শিশুকাল থেকে ওদের দুই বোনকে দেখছি। বীরশ্রী একটু চঞ্চলা, কিন্তু যৌবনশ্রী বড় ধীরা। সে শুধু রূপবতী নয়, তার মত গুণবতী কন্যা রাজবংশেও বিরল। যদি তাকে লাভ করতে পার বুঝব তুমি ভাগ্যবান।’

বিগ্রহপাল কিছুক্ষণ নীরব থাকিয়া একটু বিস্ময়ভাবে বলিলেন— ‘আর্য রন্তিদেব, পিতা ও পুত্রীর চরিত্রে এতখানি ভিন্নতা কি করে সম্ভব হয়?’

রন্তিদেব বলিলেন— ‘সৃষ্টির এ এক বিচিত্র রহস্য। হিরণ্যকশিপুর ঔরসে প্রহ্লাদ জন্মেছিলেন। বীরের পুত্র কাপুরুষ হয়, লম্পটের সন্তান সাধু হয়, আমি অনেক দেখেছি।’

তারপর দুইজন নানা কথার আলোচনা করিলেন, নানাবিধ মন্ত্রণা করিলেন। রাত্রি হইল, ভৃত্য কক্ষে দীপ জ্বালিয়া দিয়া গেল।

নৈশ ভোজনের আহ্বান আসিলে বিগ্রহপাল ঈষৎ উদ্বিগ্নভাবে বলিলেন— ‘অনঙ্গ এখনও এল না।’

রন্তিদেব বলিলেন— ‘উদ্বেগের কারণ নেই। তাকে একবার দেখেই বুঝেছি সে ভারি চতুর। আজ না হোক কাল সে আসবেই।’

বস্তুত রন্তিদেব ঠিকই বলিয়াছিলেন। অনঙ্গের জন্য উদ্বেগের কোনও কারণ ছিল না। সে লম্বোদরের গৃহের বহির্ভাগে একটি কক্ষে অধিষ্ঠিত হইয়াছিল। লম্বোদর খট্বাঙ্গ পাতিয়া শয্যা বিছাইয়া দিয়াছিল, গৃহের অভ্যন্তর হইতে জলপান আনিয়া খাইতে দিয়াছিল। সবিনয়ে বলিয়াছিল— ‘মহাশয়, আপনার নামটি এখনও জানা হয়নি।’

অনঙ্গ বিবেচনা করিল। সত্য নাম না বলাই ভাল; সে বলিল— ‘আমার নাম মধুকর। মধুকর সাধু।’

‘নিবাস?’

‘নিবাস মগধের পাটলিপুত্র নগরে।’

‘ভাল। আপনি এখন বিশ্রাম করুন, আমি একবার বেরুব। শীঘ্র ফিরব।’ বলিয়া লম্বোদর রাজাকে সমাচার দিতে গেল।

বাহিরে সন্ধ্যা নামিয়াছে। অনঙ্গ কিয়ৎকাল খট্বাঙ্গের পাশে বসিয়া কিংকর্তব্য চিন্তা করিল; তারপর শয্যার উপর লম্বা হইল। রাত্রি আসন্ন, এখন আর বিগ্রহের সন্ধানে বাহির হইয়া কাজ নাই, কাল প্রাতে খোঁজ-খবর লইলেই চলিবে।

পাঁচ

দীপান্বিতা রাজপুরী। প্রথম বসন্তের বাতাসের মত রাজভবনে উৎসবের স্পর্শ লাগিয়াছে। পৌরজনের অঙ্গে নূতন বস্ত্র, পৌরতরুণীদের অঙ্গে নূতন অলঙ্কার। তোরণশীর্ষে মিঠা মিঠা বাঁশি ও মৃদঙ্গ বাজিতেছে। আকাশে নবোদিত পূর্ণচন্দ্র।

প্রমোদকক্ষে মহারাজ লক্ষ্মীকর্ণ জামাতাকে লইয়া নববল খেলিতে বসিয়াছেন। পীঠিকার উপর চৌষট্টি কোঠার ছক আঁকা, তাহার উপর সাদা-কালো বল বসিয়াছে— ঠাকুর, মন্ত্রী, গজবল, নৌবল, অশ্ববল। বড়িয়ার চাল দিয়া খেলা আরম্ভ হইয়াছে। পাশে তাম্বূলের করঙ্ক ও ফলাম্লরসের ভৃঙ্গার লইয়া দুইজন কিঙ্করী নতজানু হইয়া খেলা দেখিতেছে।

খেলা জমিয়া উঠিয়াছে। দুইজনেরই চক্ষু একাগ্রভাবে ছকের উপর নিবদ্ধ। রাজার সন্নিধাতা আসিয়া মাঝে মাঝে তাঁহার কানে কানে কথা বলিতেছে; রাজা অধীরভাবে হাত নাড়িয়া তাহাকে বিদায় করিতেছেন। রাজকর্মের এত তাড়া কী? লম্বোদর আসিয়াছে, অপেক্ষা করুক। স্বয়ংবর-মণ্ডপ নির্মাতা সূত্রধর আদেশ চায়, কাল প্রাতে আদেশ পাইবে। আজ জামাতা বাবাজীকে পরাস্ত করা একান্ত প্রয়োজন। নয়পালের নিকট নাকাল হইবার পর হইতে মহারাজ লক্ষ্মীকর্ণের গূঢ় অন্তর্লোকে একটু আত্মগ্লানি আসিয়াছে, তাই তিনি নানা প্রকারে জামাতার চক্ষে নিজেকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করিবার চেষ্টা করিতেছেন। —

ভবনের দ্বিতলে দুই ভগিনী প্রসাধন করিয়াছেন। দুইজনের পরিধানে দলিতহরিতালদ্যুতি দুকূল; বঙ্গাল দেশ ছাড়া এমন কোমল সূক্ষ্ম দুকূল আর কোথাও পাওয়া যায় না। বীরশ্রী ভগিনীর জন্য অনেক আনিয়াছেন। দুইজনের বেণীতে কুন্দকলি অনুবিদ্ধ। সর্বাঙ্গে পুষ্পভূষা; কর্ণে শিরীষ, কণ্ঠে মল্লীমালা, নিতম্বে অশোকপুষ্পের কাঞ্চী। চরণে গুঞ্জরী নূপুর। যেন দুইটি সঞ্চারিণী পল্লবিনী লতা।

দুই ভগিনী সারা প্রাসাদময় ঘুরিয়া ঘুরিয়া বেড়াইতেছেন। কুমারী-বয়সের পিতৃগৃহ দেখিয়া দেখিয়া বীরাশ্রীর যেন সাধ মিটিতেছে না। বান্ধুলি পর্ণসম্পূট লইয়া সর্বদা তাঁহাদের সঙ্গে আছে। হাস্য কৌতুক ও স্মৃতিরোমন্থন চলিতেছে।

‘চল ভাই, ছাদে যাই।’

রাজভবনের অতিবিস্তীর্ণ ছাদ; চারিদিক উন্মুক্ত। নগর এখানে ভিড় করিয়া আসে নাই। দক্ষিণে নর্মদা প্রবাহিত। চাঁদের আলো নর্মদার জলে চূর্ণ হইয়া গলিত রৌপ্যের মত বহিয়া যাইতেছে।

তিনজনে কিছুক্ষণ মুক্ত আকাশতলে অকারণে ছুটাছুটি করিলেন; তারপর ছাদের মাঝখানে বসিলেন। বীরশ্রী বলিলেন— ‘বান্ধুলি, তুই নাচতে শিখেছিস?’

সরলা বান্ধুলি বলিল— ‘শিখেছি দিদিরানী।’

‘তবে নাচ।’

‘নাচব দিদিরানী, কিন্তু তোমাকে গান গাইতে হবে।’

‘আচ্ছা গাইব, তুই নাচ।’

বান্ধুলি তখন কোমরে উত্তরীয় জড়াইয়া ঝুম্‌ ঝুম্‌ নূপুর বাজাইয়া নাচিল, বীরশ্র, চটুলছন্দে গান গাহিলেন। যৌবনশ্রী কেবল দুই হাতে তাল দিলেন।

তারপর আনন্দের ঝর্ণার মত কলহাস্য করিতে করিতে তিনজন ছাদ হইতে নামিয়া আসিলেন।

যৌবনশ্রীর শয়নকক্ষে আসিয়া দুই বোন পালঙ্কের পাশে বসিলেন। অগুরু মৃগমদের ধূমগন্ধে কক্ষের বাতাস আমোদিত। বীরশ্রী একটি তৃপ্তির নিশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন— ‘বান্ধুলি, তুই এবার নিজের ঘরে ফিরে যা। আজ আমরা দুই বোন একসঙ্গে শোব, সারা রাত গল্প করব।’

যৌবনশ্রী দিদির বাহু জড়াইয়া বিগলিত কণ্ঠে বলিলেন— ‘হ্যাঁ দিদি।’

বান্ধুলি কিন্তু অবাক হইয়া গালে হাত দিল, বলিল— ‘ওমা, তোমরা একসঙ্গে শোবে! আর জামাই রাজা?’

বীরশ্রী ভ্রূ বাঁকাইয়া বলিলেন— ‘জামাই রাজা কী?’

‘জামাই রাজা একলা শোবেন?’

বীরশ্রী হাসি চাপিয়া ভ্রূকুটি করিলেন— ‘তোমার যে জামাই রাজার জন্যে নাড়ি কট্‌ কট্‌ করে উঠল! তা— তুমিই না হয় আজ জামাই রাজার কাছে শোও গিয়ে।’

বান্ধুলি লজ্জায় জিভ কাটিল, পানের বাটা ঝনাৎ শব্দে মেঝেয় রাখিয়া ছুটিয়া পলাইল। দিদিরানী যেন কী! মুখে কোনও কথা বাধে না। একটু কি লজ্জা আছে!

ছয়

বীরশ্রী ও যৌবনশ্রীকে শয়নকক্ষে ছাড়িয়া এখন গৃহাভিমুখিনী বান্ধুলিকে অনুসরণ করা যাইতে পারে। কারণ, দুই ভগিনী সারা রাত্রি জাগিয়া কী গল্প করিবেন তাহা আমাদের অজানা নাই; কিন্তু বান্ধুলির সহিত এখনও ভাল করিয়া পরিচয় হয় নাই।

রাজভবন হইতে খিড়কির দ্বার দিয়া বাহির হইয়া বান্ধুলি নিজের গৃহের পানে চলিল। নর্মদার তীর ধরিয়া পায়ে-হাটা পথ, সেই পথে অর্ধদণ্ড চলিলেই গৃহে পৌঁছানো যায়। রাজপথ দিয়া যাইলে অনেকখানি ঘুর হয়, তাই সে এই পথ দিয়াই যাতায়াত করে।

চাঁদিনী রাত্রে পথটি নির্মোকের মত পড়িয়া আছে। এক পাশে নদীর স্রোত, অন্য পাশে উন্মুক্ত ভূমি; কদাচ দুই একটি ঝোপ-ঝাড়ের মধ্যে ঝিল্লি ডাকিতেছে। কোথাও জনমানব নাই। বান্ধুলি চলিতে চলিতে আপন মনে গুন গুন করিয়া গানের কলি আবৃত্তি করিতে লাগিল; তাহার পায়ের নূপুরধ্বনির সহিত গানের গুঞ্জন মিশিয়া গেল। হঠাৎ এক সময় নর্মদার জল-ছোঁয়া ঠাণ্ডা বাতাস গায়ে লাগিতেই তাহার গায়ে কাঁটা দিল, গলার গুঞ্জন একটু কাঁপিয়া গেল। বান্ধুলি আপনা আপনি হাসিয়া উঠিল, তারপর উত্তরীয়টি ভাল করিয়া গায়ে জড়াইয়া চলিতে লাগিল।

বান্ধুলি মেয়েটি বড় সরলা। তাহার আঠারো বছর বয়স হইয়াছে, পাঁচ-ছয় বছর ধরিয়া সে রাজপুরীতে যাতায়াত করিতেছে, নারীজীবনের অবিচ্ছেদ্য সুখদুঃখ সম্বন্ধে পরোক্ষ জ্ঞানও তাহার হইয়াছে; তবু তাহার অন্তরের সহজ সরলতা ঘুচিয়া যায় নাই। একটুতে তাহার মন আনন্দে উচ্ছ্বসিত হইয়া ওঠে, আবার একটুতে চক্ষু বাষ্পাকুল হয়। তাহার আঠারো বছরের জীবন নিরবচ্ছিন্ন সুখের জীবন নয়, তবু সে নিজেকে দুঃখী মনে করিতে পারে নাই। বস্তুত নিজের সুখ-দুঃখের কথা সে বেশি ভাবে না, তাহার মন পরমুখাপেক্ষী; পরের সুখ-দুঃখই তাহার মনে অধিক প্রতিফলিত হয়।

বান্ধুলির পিতা নাগসেন জাতিতে বৈশ্য ছিলেন, কিন্তু তিনি ব্যবসা বাণিজ্য করিতেন না। চেদি রাজবংশের অধীনে দৌত্যকর্ম করিয়া তিনি প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছিলেন। দূতকর্মে তাঁহার অসাধারণ নৈপুণ্য ছিল। সে সময় রাজায় রাজায় মনোমালিন্য লাগিয়াই থাকিত; পূর্বতন মহারাজ গাঙ্গেয়দেব গোলমাল দেখিলেই নাগসেনকে পররাজ্যে দূতরূপে প্রেরণ করতেন। এইরূপে নাগসেনকে প্রায়ই এ রাজ্য হইতে ও রাজ্যে ঘুরিয়া বেড়াইতে হইত; কখনও কাশী, কখনও কাঞ্চী, কখনও কর্ণাট। গৃহে গৃহিণী ছিলেন, আর ছিল দুইটি অপ্রাপ্তবয়স্কা কন্যা— বেতসী ও বান্ধুলি। নাগসেন বৈশ্য হইলেও তাঁহার অন্তরে লোভ ছিল না; একটি গৃহ, কিছু ভূসম্পত্তি এবং রাজার নিকট হইতে বৃত্তি পাইয়া তিনি তৃপ্ত ছিলেন। মাঝে মাঝে যখন গৃহে আসিতেন, গৃহে আনন্দের ধুম পড়িয়া যাইত।

একবার নাগসেন দৌত্যকর্মে কলিঙ্গে গিয়াছেন, হঠাৎ সংবাদ পাইলেন, গুটিকা রোগে তাঁহার স্ত্রীর মৃত্যু হইয়াছে। নাগসেন ত্বরিতে গৃহে ফিরিয়া আসিলেন; শোক সংবরণ করিয়া কন্যাদের কথা চিন্তা করিতে বসিলেন। তাঁহার পক্ষে স্থায়িভাবে গৃহে বাস করা সম্ভব নয়, রাজকার্যে বাহিরে যাইতেই হইবে। আসন্নযৌবনা কন্যাদের অভিভাবকত্ব করিবে কে?

দৌত্যকর্মের সূত্রে একটি লোকের সঙ্গে নাগসেনের ঘনিষ্ঠত হইয়াছিল, তাহার নাম লম্বোদর। সে অতিশয় চতুর এবং বিশ্বাসী। তাহার আকৃতি সুদর্শন নয়, কিন্তু সে রাজার প্রিয়পাত্র; রাজা তাহার চোখ দিয়া দেখেন, তাহার কান দিয়া শোনেন। নাগসেন লম্বোদরের সহিত জ্যেষ্ঠা কন্যার বিবাহ দিলেন। তারপর কনিষ্ঠা কন্যার হাত ধরিয়া রাজপুরীতে লইয়া গেলেন, তাহাকে যৌবনশ্রীর হাতে সঁপিয়া দিয়া বলিলেন— ‘মা, আজ থেকে বান্ধুলি তোমার দাসী।’ যৌবনশ্রী সমবয়স্কা মেয়েটিকে নিজের সখী করিয়া লইলেন; নামমাত্র পরিচয় হইল— পর্ণসম্পূটবাহিনী।

জামাতাকে গৃহে বসাইয়া নাগসেন আবার রাজকার্যে দেশান্তরে প্রস্থান করিলেন। বান্ধুলি রাজগৃহে যাতায়াত করে; কখনও রাত্রে রাজপুরীতেই থাকিয়া যায়, কখনও গৃহে ফিরিয়া আসে। লম্বোদর গুপ্তচর হইলেও মানুষ মন্দ নয়। তাঁহার মনে দাম্পত্য-প্রীতি আছে, বান্ধুলিকে সে স্নেহ করে। সুখে শান্তিতে আবার দিন কাটিতে লাগিল।

কিন্তু গৃহীর সুখ-শান্তি স্থায়ী হয় না। দুই বৎসর পরে বিদেশে গুপ্তশত্রুর বিষপ্রয়োগে নাগসেনের মৃত্যু হইল। পিতাকে হারাইয়া মেয়েরা কান্নাকাটি করিল। লম্বোদর এবার সত্যসত্যই গৃহস্বামী হইয়া বসিল। তবু পরিবারিক পরিস্থিতির কোনও পরিবর্তন হইল না, যেমন চলিতেছিল তেমনি চলিল।

বছর দেড়েক পরে আর একটি ব্যাপার ঘটিল। বেতসী একটি মৃত সন্তান প্রসব করিয়া রোগে পড়িল। ক্রমে রোগ প্রশমিত হইল বটে কিন্তু বেতসীর শরীর আর সারিল না। বেতসী স্বাস্থ্যবতী ফুল্লমুখী যুবতী ছিল, তাহার দেহ-মন অকালে শুকাইয়া গেল। ফুলন্ত লতার মূলে যেন উপদিকা লাগিয়াছে।

দাম্পত্যরসে বঞ্চিত হইয়া লম্বোদর কিন্তু কোনও গণ্ডগোল করিল না। সে যদি দ্বিতীয়বার দার-পরিগ্রহ করিত কেহ তাহাকে দোষ দিত না, সেকালে একাধিক বিবাহ নিন্দনীয় ছিল না। কিন্তু সে তাহা করিল না। লম্বোদর বুদ্ধিজীবী মানুষ, হয়তো তাহার মনে রসের স্থান খুব বেশি ছিল না; কিম্বা কোনও গভীরতর অভিসন্ধি তাহার মনকে পরিচালিত করিতেছিল। বেতসী বেশি দিন বাঁচিবে না, তাহার মৃত্যুর পর বান্ধুলিকে বিবাহ করিলে সংসারে অশান্তির সম্ভাবনা থাকিবে না, উপরন্তু শ্বশুরের সমস্ত সম্পত্তি নির্বিরোধে হস্তগত হইবে— এইরূপ কোনও দূরবিসর্পী অভিপ্রায় তাহার মনের মধ্যে থাকা বিচিত্র নয়।

বান্ধুলি বোধহয় লম্বোদরের মানসিক অবস্থার ইঙ্গিত পাইয়াছিল। সে সরলা হইলেও বুদ্ধিহীনা নয়। তাহার কৈশোর-মুকুলিত দেহের প্রতি লম্বোদর মাঝে মাঝে চকিত-সতৃষ্ণ দৃষ্টিপাত করে ইহা তাহার দৃষ্টি এড়ায় নাই। কখনও কখনও লম্বোদর তাহাকে নিজ কর্মজীবনের এমন সব গূঢ় বৃত্তান্ত বলে যাহা সে বেতসীকে কোনও দিন বলে নাই। এই সব মিলাইয়া বান্ধুলি অনুভব করিয়াছিল যে লম্বোদর মনে মনে তাহাকে চায়। কিন্তু সেজন্য বান্ধুলি কোনও দিন শঙ্কা বা উদ্বেগ বোধ করে নাই। ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে চিন্তা করা তাহার স্বভাব নয়। যদি দিদির মৃত্যু হয়, যদি লম্বোদর তাহাকে বিবাহ করিতে চায় তখন কী হইবে সেকথা এখন ভাবিয়া লাভ নাই।

এইভাবে দুই তিন বছর কাটিয়াছে। বেতসী শীর্ণ হইয়া ক্রমে একটি সঞ্চরমাণ ছায়ায় পরিণত হইয়াছে। বান্ধুলির মুকুলিত কৈশোর বিকশিত শতদল হইয়া ফুটিয়া উঠিয়াছে। লম্বোদরের মনের ফল্গু নদী অন্তঃসলিলা প্রবাহিত হইতেছে। বাহ্যত তাহাদের সম্পর্কে কোনও পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায় না। —

সেরাত্রে কৌমুদী-স্নাত হইয়া বান্ধুলি রাজপুরী হইতে গৃহে ফিরিয়া আসিল।

বাড়িটি ঘিরিয়া বেণু-বংশের বেড়া, ভিতরে ক্ষুদ্র মালঞ্চ। দুইটি কিশোর নীপ তরু আছে, একটি কুরুবক, একটি অশোক। আর আছে সুগন্ধি ফুলের লতাগুল্ম, জাতী, মালতী, লবঙ্গলতা, কুন্দ। মালঞ্চটি বান্ধুলির, সে নিত্য তাহার পরিচর্যা করে। প্রত্যহ প্রভাতে রাজপুরীতে যাইবার আগে গাছে জল দেয়। যদি কোনও দিন সন্ধ্যার আগে রাজপুরী হইতে ফিরিয়া আসে, তখন আবার জল দেয়।

বান্ধুলি গৃহে প্রবেশ করিতে গিয়া দেখিল অশোকতরুর নীচে ঘোড়া বাঁধা রহিয়াছে। ঘোড়াটা যে লম্বোদরের ঘোড়া নয় তাহা সে ছায়ান্ধকারে লক্ষ্য করিল না; ভাবিল, লম্বোদর গৃহে আসিয়াছে, এখনি আবার বাহির হইবে তাই ঘোড়া মন্দুরায় না বাঁধিয়া বাহিরে রাখিয়াছে। লম্বোদর কখন যায় কখন আসে তাহার কোনও স্থিরতা নাই।

বাড়িতে একটিমাত্র ঘরে দীপ জ্বলিতেছে। ঘরটি বেতসী ও লম্বোদরের শয়নকক্ষ। দুইটি খট্বা, মাঝখানে পিত্তলের দীপদণ্ডের মাথায় দীপ। একটি খট্বায় শয়ন করিয়া বেতসী দীপশিখার পানে চাহিয়া আছে।

বান্ধুলি প্রবেশ করিল— ‘দিদি!’

বেতসী যেমন শুইয়া ছিল তেমনি শুইয়া রহিল, কেবল নিষ্প্রভ চক্ষু বান্ধুলির দিকে ফিরাইয়া বলিল— ‘এলি? আমি ভেবেছিলাম আজ তুই আসবি না। বীরশ্রী এসেছেন?’

বান্ধুলি স্মিতমুখে বলিল— ‘এসেছেন, দিদি। তিনিই আমাকে বাড়ি পাঠিয়ে দিলেন।’

‘কেমন দেখলি বীরশ্রীকে?’

‘কি বলব দিদি, ঠিক যেন ইন্দ্রের ইন্দ্রাণী।’

বেতসী একটি ক্ষুদ্র নিশ্বাস ফেলিল, বলিল— ‘তাঁর স্বামী আর বিয়ে করেননি?’

বান্ধুলি পাশের খট্বার কিনারায় বসিয়া হাসিয়া উঠিল— ‘ওমা, সে কি কথা, বিয়ে করতে যাবেন কোন দুঃখে। দিদিরানীর মুখ দেখলেই বোঝা যায় তিনি স্বামীর মন জুড়ে আছেন।’

বেতসীর অক্ষিকোটরে ধীরে ধীরে জল ভরিয়া উঠিল, সে অস্ফুট স্বরে বলিল— ‘হাঁ, আঁচলে যার সোনা বাঁধা আছে তার মুখ দেখলে বোঝা যায়।’

বেতসীর মুখ দেখিয়া বান্ধুলি চকিত উদ্বেগভরে বলিল— ‘দিদি! তোর শরীর কি আজ বেশি খারাপ হয়েছে?’

বেতসী ধীরে ধীরে উঠিয়া বসিল, জল-ভরা চোখ মুছিতে মুছিতে বলিল— ‘বেশি খারাপ আর কী হবে? আমি কি সহজে মরব? সকলকে দগ্ধে দগ্ধে তবে মরব।’

বান্ধুলি ছুটিয়া তাহার পাশে গিয়া বসিল, তাহাকে জড়াইয়া লইয়া ব্যগ্রকণ্ঠে বলিল— ‘ছি দিদি, ওকথা বলতে নেই। তুই তো ভাল হয়ে গেছিস। দেখ না, বসন্তঋতু এসে পড়ল, এবার তুই ঠিক আগের মত হয়ে যাবি।’

বেতসীর মুখে একটু হাসি ফুটিল বটে কিন্তু চোখ দুটি নিরাশায় ডুবিয়া রহিল। সে জানে, সে বুঝিয়াছে। যাহারা মৃত্যু-পথের যাত্রী তাহারা বুঝিতে পারে।

কিছুক্ষণ পরে বান্ধুলি এদিক ওদিক চাহিয়া বলিল— ‘কুটুম্ব কোথায় গেলেন? তাঁকে দেখছি না।’

বেতসী বলিল— ‘সে বিকেলবেলা এসেছিল, আবার তখনি বেরিয়ে গেছে। একজন অতিথ্‌ রেখে গেছে।’

তাহাদের গৃহে অতিথি সজ্জনের যাতায়াত নাই। বান্ধুলি অবাক হইয়া বলিল— ‘অতিথ্‌! কোথায় অতিথ্‌?’

বেতসী বলিল— ‘বাইরের ঘরে আছে। তোর কুটুম্ব তাকে জলপান দিয়ে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে গেল, বলে গেল দু’দণ্ডের মধ্যে ফিরে আসবে। তা এখনও দেখা নেই।’

বান্ধুলি জিজ্ঞাসা করিল— ‘কেমন অতিথ্‌ তুই দেখেছিস?’

বেতসী বলিল— ‘দেখিনি। শুনলাম মগধের এক বণিক।’

বান্ধুলি বলিল— ‘ওর ঘোড়াই তাহলে অশোকতলায় বাঁধা আছে। তা, একটা মানুষ বাড়িতে রয়েছে কিন্তু কোনও সাড়াশব্দ তো পাওয়া যাচ্ছে না।’

বেতসী বলিল— ‘হয়তো বুড়ো মানুষ, একলাটি অন্ধকারে টাকার পুঁটুলি কোলে করে বসে আছে।’

বান্ধুলি গালে হাত দিল— ‘ওমা! ঘরে পিদিম জ্বালা হয়নি?’

বেতসী বলিল— ‘কৈ আর হয়েছে। বাড়ির কর্তা উধাও, আমার নড়বার ক্ষমতা নেই। কে করবে বল। বাড়িতে অতিথ্‌, তাকে রাত্রে কি খেতে দেব জানি না।’

‘সে তুই ভাবিস কেন দিদি, চারখানা চর্পটিকা আমি গড়ে দিতে পারব। আগে যাই, ঘরে আলো জ্বেলে দিয়ে আসি। বুড়ো বণিক হয়তো ভাবছেন, এরা কেমন গৃহস্থ।’

বণিকেরা সাধারণত বুড়াই দেখা যায়, তাই দুই বোনের ধারণা জন্মিয়াছিল, অতিথি বয়োবৃদ্ধ। বান্ধুলি তাড়াতাড়ি প্রদীপ জ্বালিয়া বাহিরের ঘরে গেল। —

অনঙ্গপাল খট্বাঙ্গে লম্বা হইয়া ঘুমাইয়া পড়িয়াছিল। স্বপ্ন দেখিতেছিল, ছিপ দিয়া মস্ত মাছ ধরিয়াছে। মাছের মুখটা লম্বোদরের মত; গোল চোখ, ভাল্লুকে খাওয়া নাক, বোকাটে হাসি। অনঙ্গপাল ভাবিতেছিল, মাছের ঝোল রাঁধিবে, না রাই-সরিষা দিয়া ঝাল রাঁধিবে, এমন সময় মাছটা জলে লাফাইয়া পড়িল এবং অদৃশ্য হইল। …অনঙ্গপাল জলের পানে চাহিয়া আছে, দেখিল একটি আলোর বুদ্বুদ জল হইতে বাহির হইয়া আসিতেছে। বুদ্বুদ শূন্যে উঠিয়া তাহার দিকে ভাসিয়া আসিল। বুদ্বুদের ভিতর হইতে শব্দ আসিতেছে— ঝুম ঝুম ঝুম—

ঘুম ভাঙিয়া গেল, অনঙ্গ চোখ মেলিয়া উঠিয়া বসিল। বুদ্বুদ নয়, তাহার সম্মুখে দাঁড়াইয়া আছে দীপহস্তা এক যুবতী। যুবতীর অঙ্গ নধর, কান্তি কমনীয়, অধর রসসিক্ত, চক্ষু দুটি কাজল না পরিয়াও কৃষ্ণায়ত—

অনঙ্গ চোখ মুছিয়া আবার দেখিল। যুবতীর কণ্ঠে সোনার চিল্‌মীলিকা, কানে সোনার কর্ণাঙ্গুরী, অঙ্গের প্রগল্‌ভ উচ্ছলতা আবৃত করিয়া রাখিয়াছে অচ্ছাভ নীহারিকার ন্যায় একটি নিচোল—

দুইজন অবাক বিস্ময়ে কিছুক্ষণ পরস্পরের পানে চাহিয়া রহিল। তারপর যুবতী সহসা প্রদীপ মেঝের উপর নামাইয়া রাখিয়া দ্বারের দিকে চলিল। তাহার পায়ে মঞ্জরী বাজিয়া উঠিল— ঝিম ঝিম ঝিম।

অনঙ্গপাল সূচীবিদ্ধের মত চমকিয়া মুখে শব্দ করিল— ‘এহুম্‌ এহুম্‌—’

যুবতী দ্বারের কাছে ফিরিয়া দাঁড়াইয়া ভ্রূ ঈষৎ তুলিল। অনঙ্গপাল রাজহংসের মত গলা বাড়াইয়া প্রশ্ন করিল— ‘তুমি কে?’

যুবতীর অধরপ্রান্ত একটু নড়িল, সে বলিল— ‘আমি— গৃহস্বামী আমার কুটুম্ব।’ সে দ্বারের বাহিরে গিয়া দ্বার ভেজাইয়া দিল। অনঙ্গপাল রাজহংসের মত গলা বাড়াইয়া ব্যগ্র-বিহ্বল চক্ষে দ্বারের পানে চাহিয়া রহিল।

বেতসী নিজ শয্যায় বসিয়া দ্বারের দিকে চাহিয়া ছিল, বান্ধুলি ছুটিতে ছুটিতে আসিয়া অন্য শয্যায় শুইয়া পড়িল এবং মুখে উত্তরীয় চাপা দিয়া মৃদু মৃদু দুলিতে লাগিল। বেতসী উৎকণ্ঠিতা হইয়া বলিল— ‘কি হয়েছে রে?’

বান্ধুলি ক্ষণেক মুখ হইতে উত্তরীয় সরাইয়া গাঢ়স্বরে বলিল— ‘এহুম্‌ এহুম্‌।’ তারপর আবার মুখে কাপড় দিয়া দুলিতে লাগিল।

বেতসীর উৎকণ্ঠা বাড়িয়া গেল। সে নিজের শয্যা হইতে নামিয়া বান্ধুলির পাশে বসিল। তাহার গায়ে হাত রাখিয়া চাপা গলায় বলিল— ‘বুড়ো বণিক কিছু বলেছে নাকি?’

‘বুড়ো নয়— তরুণ।’ বান্ধুলি উঠিয়া বসিল এবং বেতসীর কাঁধে মাথা রাখিয়া অসহায়ভাবে হাসিতে লাগিল।

বেতসী বিরক্তিভরে তাহাকে ঠেলিয়া দিয়া বলিল— ‘আ গেল! অত হাসছিস কেন?’

বান্ধুলি কেন এত হাসিতেছে সে নিজেই জানে না। তাহার মনে হাসির কোন্‌ গোপন উৎস-মুখ খুলিয়া গিয়াছে। — অন্ধকার ঘরে বুড়া বণিক শুইয়া আছে দেখিয়া সে পা টিপিয়া টিপিয়া কাছে গিয়াছিল, কৌতূহলবশে প্রদীপ তাহার মুখের কাছে ধরিয়াছিল, তারপর—

বান্ধুলির হাসি আবার উচ্ছ্বসিত হইয়া উঠিল।

হাসি রোগটা ছোঁয়াচে। কিছুক্ষণ পরে বেতসীও মৃদু মৃদু হাসিতে লাগিল, তারপর ছদ্ম তিরস্কারের সুরে বলিল— ‘দেখন-হাসি!— শুধু হাসলেই চলবে? বণিককে খেতে দিতে হবে না?’

বান্ধুলি উঠিয়া পড়িল— ‘তুইও আয় না দিদি। রাঁধতে রাঁধতে গল্প করব।’

দুই বোন রসবতীতে গেল। —

লম্বোদর ফিরিল দুই দণ্ড পরে। তাহার মন ভাল নয়, দীর্ঘকাল অপেক্ষা করিয়াও রাজার দর্শন পায় নাই। আবার কাল সকালে যাইতে হইবে।

আহার্য প্রস্তুত হইয়াছিল, লম্বোদর তাহা লইয়া বাইরের ঘরে গেল। অনঙ্গপাল ঊর্ধ্বে চাহিয়া স্বপ্ন দেখিতেছিল, লম্বোদর বলিল— ‘সাধু মহাশয়, আমার ফিরতে বড় দেরি হয়ে গেল। আপনার খুবই কষ্ট হয়েছে—’

অনঙ্গপাল বলিল— ‘কিছু না। আমি বেশ আনন্দে আছি।’

লম্বোদর বলিল— ‘আসুন, আহারে বসুন।’

অনঙ্গ আহারে বসিল, সঙ্গে সঙ্গে দুই চারিটা কথা হইল। লম্বোদর বলিল— ‘আমার কুটুম্বিনী রুগ্না, বেশি কাজকর্ম করতে পারে না। একটি শ্যালিকা আছে, সে রাজকন্যার তাম্বূলকরঙ্কবাহিনী; বেশির ভাগ রাজপুরীতে থাকে, মাঝে মাঝে গৃহে আসে। আমিও সকল সময় গৃহে থাকি না। একটি প্রৌঢ়া স্ত্রীলোক এসে বাড়ির কাজকর্ম করে দিয়ে যায়। আপনি কোনও সঙ্কোচ করবেন না, আমার গৃহ নিজের গৃহ মনে করবেন। যদি কোনও প্রয়োজন হয় আমার স্ত্রীকে বলবেন কিম্বা দাসীকে আদেশ করবেন।’

অনঙ্গ বলিল— ‘ভাল। কিন্তু আমি শিল্পী মানুষ, আমার প্রয়োজন অতি সামান্য।’

লম্বোদরের গোল চক্ষু আরও গোল হইল, বলিল— ‘শিল্পী? তবে যে বলেছিলেন আপনি বণিক?’

অনঙ্গ বলিল— ‘বণিকও বটে শিল্পীও বটে। আমি চিত্র আঁকি, মূর্তি গড়ি, আর দেশে দেশে তাই বিক্রয় করে বেড়াই।’

লম্বোদর কিছুক্ষণ ঈষৎ হাঁ করিয়া রহিল, তারপর বলিল— ‘অহহ— বুঝলাম। — আপনার শিল্পসামগ্রী বুঝি নৌকায় আছে?’

অনঙ্গ বলিল— ‘কিছু নৌকায় আছে, বাকি এইখানেই রচনা করব। তোমার গৃহটি বেশ নির্জন, এখানে অবাধে কাজ করতে পারব। ভাল কথা, ত্রিপুরীতে উত্তম গণৎকার আছেন?’

‘আছেন। রন্তিদেব নামে একজন মহাপণ্ডিত গণৎকার আছেন। বণিকেরা সকলে তাঁর কাছে যান। তিনি নগরের মাঝখানে থাকেন; জিজ্ঞাসা করলে যে কেউ বাড়ি দেখিয়ে দেবে।’

‘ভাল। কাল প্রাতেই রন্তিদেব মহাশয়ের কাছে যাব। ভাগ্যটা পরীক্ষা করাতে হবে।’

অতঃপর অনঙ্গ আহার সম্পন্ন করিলে লম্বোদর বিদায় লইল।

শয্যায় শুইয়া শুইয়া অনঙ্গ ভাবিতে লাগিল— লম্বোদরের শ্যালিকাটি রাজকন্যার তাম্বূলকরঙ্কবাহিনী! যোগাযোগ ভাল হইয়াছে। শ্যালিকাটি দেখিতে যেন সাগর-সেঁচা ঊর্বশী! কী তার তনুর তনিমা, বক্ষ ও নিতম্বের গরিমা, অধরের লালিমা, কেশকলাপের কালিমা—