গল্প
উপন্যাস
পরিশিষ্ট

তুমি সন্ধ্যার মেঘ – ২

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ – এক

এক মাস চম্পা নগরীতে যাপন করিয়া মহারাজ নয়পাল স্কন্ধাবার তুলিয়া পাটলিপুত্রে ফিরিয়া গেলেন। দীপঙ্কর তিব্বতে চলিয়া গিয়াছেন, তাঁহার কোনও সংবাদ নাই। লক্ষ্মীকর্ণও চুপচাপ।

কুমার বিগ্রহ অগ্নিকন্দুকটি অতি যত্নে একটি ক্ষুদ্র পেটরার মধ্যে লুকাইয়া রাখিয়া দিয়াছেন, অগ্নিকন্দুকের কথা পিতামাতাকেও বলেন নাই। কেবল একজনকে বলিবার জন্য তাঁহার মন ছটফট করিতেছে, সে তাঁহার প্রাণের বন্ধু অনঙ্গপাল। অনঙ্গপাল পালবংশেরই সন্তান, বিগ্রহপালের দূরস্থ দায়াদ। সে উত্তরাধিকার সূত্রে বহু ধনসম্পত্তি লাভ করিয়াছে, পালবংশে জন্মগ্রহণ করিলে কাহাকেও বৃত্তি-চিন্তা করিতে হয় না, যোগ্যতা অনুযায়ী রাজকর্ম জুটিয়া যায়। অনঙ্গপাল কিন্তু কোনও বৃত্তি অবলম্বন করে নাই। সে একজন শিল্পী; ছবি আঁকে, মূর্তি গড়ে, গান যায়, বাঁশি বাজায়। আবার সাঁতার কাটিতে, অশ্বপৃষ্ঠে মৃগয়া করিতেও সে পটু। সে সঙ্গে নাই বলিয়া চম্পা নগরীতে আসিয়া বিগ্রহপালের মনে সুখ ছিল না। পাটলিপুত্রে ফিরিবার পর দুই বন্ধুর মিলন হইল।

রাজপুরীর দীর্ঘিকায় পাশাপাশি বসিয়া ছিপ দিয়া মাছ ধরিতে ধরিতে বিগ্রহপাল বন্ধুকে বিক্রমশীলা ঘটিত সমস্ত কাহিনী বলিলেন। শুনিয়া অনঙ্গপাল অগ্নিকন্দুকের কথা বিশ্বাস করিল না, বলিল— ‘মহাপুরুষ দীপঙ্কর বিভূতি দেখিয়েছেন। যা হোক, গোলাটা রেখে দিস, হয়তো ওতে এখনও মন্ত্রের তেজ আছে।’ লক্ষ্মীকর্ণ ও স্বয়ংবরের প্রসঙ্গে সে বলিল— ‘ছিপ দিয়ে কুমীর ধরা যায় না। বুড়ো ঘড়িয়ালটাকে যখন হাতে পাওয়া গিয়েছিল তখন ঠেঙ্গিয়ে মারলেই ভাল হত। যাক, বুড়ো যদি স্বয়ংবরে না ডাকে তখন দেখা যাবে।’

অতঃপর আরও এক মাস কাটিয়া গেল। বিগ্রহপাল বন্ধু অনঙ্গপালের সঙ্গে পাশা খেলিয়া, মাছ ধরিয়া, কদাচ মৃগয়া করিয়া কালাহরণ করিলেন। স্বয়ংবরের নিমন্ত্রণ লিপি কিন্তু আসিল না।

গূঢ়পুরুষ আসিয়া মহারাজ নয়পালকে সংবাদ দিল, লক্ষ্মীকর্ণ স্বয়ংবরের আয়োজন করিতেছেন, বহু রাজা এবং রাজপুত্রের নিকট লিপি প্রেরিত হইয়াছে। নয়পাল ক্রুদ্ধ হইয়া স্থির করিলেন মিথ্যাবাদী তস্করের কন্যার সহিত তিনি পুত্রের বিবাহের কোনও চেষ্টাই করবেন না। তিনি কাশী কোশল কলিঙ্গ প্রভৃতি কয়েকটি রাজ্যে ভাট পাঠাইলেন; যদি উপযুক্ত রাজকন্যা পাওয়া যায় তাহার সহিত পুত্রের বিবাহ দিবেন।

মাসাবধি কাল পরে ভাটেরা একে একে ফিরিয়া আসিল। কাশী কৌশল প্রভৃতি দেশের রাজারা সকলেই মগধের যুবরাজকে জামাতারূপে পাইতে উৎসুক; কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত কাশীরাজকন্যা ইতিপূর্বেই বিবাহিতা ও বহুপুত্রবতী, কোশলরাজের কন্যা অন্যের বাগ্‌দত্তা; কলিঙ্গরাজের একটি কন্যা আছে বটে, কিন্তু সেটি দাসীকন্যা, মহারাজ নয়পাল যদি তাহাকে পুত্রবধূরূপে গ্রহণ করিতে প্রস্তুত থাকেন—

নয়পাল রাগে ফুলিতে লাগিলেন কিন্তু কিছুই করিতে পারিলেন না। তাঁহার বুঝিতে বাকি রহিল না যে এ সমস্তই লক্ষ্মীকর্ণের নষ্টামি। শৃগাল খাল পার হইয়া কুমীরকে কলা দেখাইয়াই ক্ষান্ত হয় নাই, শত্রুতা করিতেছে। ক্রুদ্ধ নয়পাল কয়েকজন তেজস্বী বজ্রযানী সাধককে ডাকিয়া পাঠাইলেন এবং তন্ত্রমন্ত্রের সাহায্যে লক্ষ্মীকর্ণকে সংহার করা যায় কিনা তাহারই পরামর্শ করিতে লাগিলেন।

বিগ্রহপাল সকল সংবাদ পাইতেছিলেন; তাঁহার মাথায় দুষ্টবুদ্ধি নৃত্য করিয়া উঠিল। তিনি অনঙ্গপালকে গিয়া বলিলেন— ‘চল অনঙ্গ, ত্রিপুরী যাই। বুড়ো শেয়ালের মেয়েটাকে কেড়ে নিয়ে আসি।’

অনঙ্গপাল আপন গৃহে বসিয়া মাটির মূর্তি গড়িতেছিল— একটি পীনপয়োধরা যক্ষিণীমূর্তি। অনঙ্গপাল বিপত্নীক, দুই বছর পূর্বে পত্নীকে হারাইয়া সে আর বিবাহ করে নাই; বাঁশি বাজাইয়া, চিত্র আঁকিয়া, যক্ষিণী কিন্নরীর মূর্তি গড়িয়া যৌবনের ক্ষুধা মিটাইতেছিল। সে বিগ্রহপালের দিকে একবার চক্ষু ফিরাইল, তারপর একতাল মৃত্তিকা যক্ষিণীর বক্ষে জুড়িয়া দিয়া নিপুণহস্তে গড়িতে গড়িতে বলিল— ‘কেড়ে আনতে হলে সৈন্য নিয়ে যেতে হয়, তাতে সুবিধা হবে না। স্বয়ংবরের আগে সেখানে অনেক রাজা আসবে, তারাও লড়বে।’

বিগ্রহ বলিলেন— ‘তবে চল, চুরি করে আনি।’

‘সে কথা মন্দ নয়’— অনঙ্গপাল জলপূর্ণ কটাহে হাত ধুইয়া বিগ্রহের কাছে আসিয়া বসিল— ‘কিছু ফন্দি মাথায় এসেছে নাকি?’

‘না। আয় দু’জনে ফন্দি বার করি।’

দুই বন্ধুর মধ্যে অনেকক্ষণ ধরিয়া মন্ত্রণা চলিল। উচ্চ হাসি ও চটুল রসালাপের সঙ্গে সঙ্গে মন্ত্রণা। অবশেষে অভিসন্ধি পাকা হইলে অনঙ্গ বলিল— ‘মহারাজকে কোনও কথা বলা হবে না। চল, ভট্ট যোগদেবের কাছে যাই। তিনি রসিক ব্যক্তি, অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা করে দেবেন।’

দুই বন্ধু উপসচিব যোগদেবের সহিত সাক্ষাৎ করিলেন। যোগদেবের বয়স চল্লিশের নীচে, মন্ত্রিত্বের নিম্নতন সোপানে পা রাখিয়াছেন; রাজনীতির ইক্ষুযন্ত্রে তাঁহার মন এখনও ছিব্‌ড়া হইয়া যায় নাই। বিগ্রহপালকে তিনি ভালবাসিতেন; পরবর্তী কালে বিগ্রহপাল সিংহাসনে আরোহণ করিলে তিনি রাজার মহাসচিব হইয়াছিলেন।

মন্ত্রণা শুনিয়া তিনি মৃদু মৃদু হাসিতে লাগিলেন, বলিলেন— ‘শঠে শাঠ্যম্‌। — ভাল, আমি সব ব্যবস্থা করে দেব। ত্রিপুরীতে আমার অগ্রজ রন্তিদেব বাস করেন, তিনি ওখানকার বড় জ্যোতিষী। আমি তাঁকে পত্র লিখে দেব, ওখানকার ব্যবস্থা তিনি করতে পারবেন।’

দুই

মহারাজ লক্ষ্মীকর্ণ জয়যাত্রায় বাহির হইয়াছিলেন রথে চড়িয়া, ফিরিলেন গো-শকটে আরোহণ করিয়া। যাত্রাকালে তাঁহার সঙ্গে গিয়াছিল ছয় সহস্র সৈন্য, ফিরিয়া আসিল গুটি চার-পাঁচ সেনানী। জামাতা জাতবর্মা পথেই শ্বশুর মহাশয়ের পদধূলি লইয়া স্বদেশে প্রত্যাগমন করিয়াছিলেন, শ্বশুরের সান্নিধ্যে তাঁহার আর রুচি ছিল না। নিজগৃহে শ্বশুরকন্যাকে রাখিয়া আসিয়াছিলেন সেইদিকে তাঁহার মন টানিতেছিল।

বলা বাহুল্য লক্ষ্মীকর্ণের মানসিক অবস্থা ভাল ছিল না। রাজপুরীতে ফিরিয়া ময়ূর মাংস সহযোগে মাধ্বী পান করিতে করিতে তিনি মাঝে মাঝে দন্ত কড়মড় করিতেছিলেন। প্রিয় কিঙ্করীরা নানাভাবে সেবা করিয়াও তাঁহাকে ঠাণ্ডা করিতে পারিতেছিল না।

লক্ষ্মীকর্ণ এমন অপদস্থ জীবনে হন নাই। যুদ্ধে জয় পরাজয় আছেই, তাহাতে লজ্জা নাই। কিন্তু এ তো পরাজয় নয়, নয়পাল তাঁহার মুখে চুন-কালি দিয়া ছাড়িয়া দিয়াছে। এর প্রতিশোধ লাইতে না পারিলে—

কিন্তু প্রতিশোধ লওয়া সহজ নয়। আবার সৈন্য সাজাইয়া যুদ্ধযাত্রা করা যাইতে পারে, কিন্তু তাহাতে ফল ভিন্নরূপ হইবে কি? ওই দুষ্টবুদ্ধি দীপঙ্করটা আছে, তাহার পোষা পিশাচ আছে। কী ভয়ঙ্কর পিশাচ! কী তার হৃৎপ্রকম্পী ক্রিয়াকলাপ! এরূপ পিশাচের বিরুদ্ধে কে যুদ্ধ করিবে?

স্বয়ংবর! কন্যা যৌবনশ্রীর স্বয়ংবর দিবার অভিপ্রায় তাঁহার কস্মিনকালেও ছিল না, দীপঙ্করকে ভুলাইবার জন্য একটা ছুতা করিয়াছিলেন মাত্র। অবশ্য যৌবনশ্রীর সপ্তদশ বৎসর বয়স হইয়াছে, সে সুন্দরী; সুতরাং তাহার স্বয়ংবর দিলে মন্দ হয় না। লক্ষ্মীকর্ণের মস্তকে কুবুদ্ধি অঙ্কুরিত হইল— ঠিক হইয়াছে! লক্ষ্মীকর্ণ স্বয়ংবর সভা আহ্বান করিবেন, ভারতবর্ষের সমুদয় রাজন্যবর্গকে নিমন্ত্রণ করিবেন। কিন্তু মগধের যুবরাজকে নিমন্ত্রণ করিবেন না। একটি বানরের মূর্তি গড়াইয়া স্বয়ংবর সভায় বসাইয়া দিবেন; ভাট মূর্তির পরিচয় দিবে— মগধের যুবরাজ। দেখিয়া সভারূঢ় রাজকুল অট্টহাস্য করবে, সেই অট্টহাস্যের প্রতিধ্বনি মগধের রাজসিংহাসনে গিয়া পৌঁছিবে—

এই কূট-কৌশল উদ্ভাবন করিয়া লক্ষ্মীকর্ণের প্রতিহিংসা-পিপাসু মন অনেকটা শান্ত হইল। তিনি মহা উদ্যমে স্বয়ংবর সভা আহ্বানের আয়োজন করিতে লাগিলেন। উত্তরাপথের ও দাক্ষিণাত্যের রাজারা কুঙ্কুমরঞ্জিত চন্দন সুরভিত নিমন্ত্রণ পত্র পাইলেন; উপরন্তু দূতমুখে তাঁহারা নানা দিগ্‌দেশের সন্দেশ পাইলেন। দূতগণের বাক্‌চাতুর্যের ইঙ্গিতে ইহাও প্রকাশ পাইল যে মগধের যুবরাজ আপন উচ্ছৃঙ্খলতার দোষে রাজযক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হইয়াছেন, তাই তাঁহাকে স্বয়ংবর সভায় আহ্বান করা হয় নাই।

যাহার স্বয়ংবর সে কিন্তু কিছুই জানিল না।

একদিন অপরাহ্ণকালে রাজকুমারী যৌবনশ্রী আপন ভবনে বাতায়ন তলে বসিয়া রঘুবংশম্‌ পাঠ করিতেছিলেন।

বিরাট দ্বি-ভূমক রাজপুরীর বহু শাখা-প্রশাখা। তন্মধ্যে দ্বিতলের একটি প্রশাখা যৌবনশ্রীর নিজস্ব। বাতায়ন দিয়া পিছনের দীর্ঘিকা দেখা যায়, আম্রকাননের সুগন্ধি মর্মর ভাসিয়া আসে, অস্তমান সূর্যের কনকচ্ছটা বিচ্ছুরিত হয়। এইরূপ একটি বাতায়ন তলে কোমল অজিনাসনে পা ছড়াইয়া বসিয়া পৃষ্ঠ দ্বারা শীতের রৌদ্র সেবন করিতে করিতে কুমারী যৌবনশ্রী কালিদাসের মহাকাব্য কোলে লইয়া পাঠ করিতেছেন। ষষ্ঠ সর্গ পাঠ করিতে করিতে মন বসিয়া গিয়াছে।

সপ্তদশ বৎসর বয়সে রাজকুমারী যৌবনশ্রীর দেহ নবোদ্ভিন্ন লাবণ্যের রসে টলমল করিতেছে, যেন এইমাত্র তিনি লাবণ্যের সরসীনীরে স্নান করিয়া আসিলেন। মন কিন্তু কৌমার্যের প্রশান্তিতে নিস্তরঙ্গ; সেখানে যৌবনসুলভ প্রগল্‌ভতা নাই, রাজকন্যাসুলভ গর্ব নাই। মুখখানিতে একটু মধুর গাম্ভীর্য, চোখ দুটিতে স্নিগ্ধ বুদ্ধির প্রভা। পিছন হইতে চুলের উপর সূর্যের আলো পড়িয়া একটি স্বর্ণাভ মণ্ডল রচনা করিয়াছে। একাকী বসিয়া কাব্য পড়িতে পড়িতে তিনি মগ্ন হইয়া গিয়াছিলেন।

যৌবনশ্রীর সৌম্যশুচি রূপলাবণ্য দেখিয়া কেহ কল্পনা করিতে পারে না যে তিনি দৈত্যাবতার লক্ষ্মীকর্ণের কন্যা। লক্ষ্মীকর্ণের মহিষী পরম রূপবতী ছিলেন, ভাগ্যক্রমে কন্যা মাতার রূপ পাইয়াছে। নহিলে কন্যার স্বয়ংবর করা চলিত না।

রঘুবংশে ইন্দুমতীর স্বয়ংবর পড়িতে পড়িতে দ্বারের কাছে দ্রুত চঞ্চল পদধ্বনি শুনিয়া যৌবনশ্রী চক্ষু তুলিলেন। বান্ধুলি আসিতেছে। বান্ধুলি তাঁহার প্রিয় সহচরী ও পর্ণসম্পূট বাহিনী। সে অন্যান্য পুরাঙ্গনার মত রাজপুরীতে বাস করে না, দ্বিপ্রহরে গৃহে যায়, আবার সন্ধ্যার প্রাক্কালে পুরীতে ফিরিয়া আসে। রাত্রে কখনও গৃহে যায় কখনও কুমারীর পালঙ্কের পায়ের কাছে শুইয়া রাত কাটাইয়া দেয়। দুইজনে প্রায় সমবয়স্কা, দুইজনের মধ্যে বড় প্রীতি। বান্ধুলির এখনও বিবাহ হয় নাই। — কিন্তু বান্ধুলির প্রসঙ্গ থাক, তাহার সম্বন্ধে পরে অনেক কথা বলিতে হইবে।

যৌবনশ্রী বান্ধুলির চোখে-মুখে উৎফুল্ল উত্তেজনা দেখিয়া প্রশ্ন করিলেন— ‘কি রে বান্ধুলি?’

বান্ধুলি আসিয়া যৌবনশ্রীর কাছে বসিল, একটু হাঁপাইয়া বলিল— ‘ও পিয়সহি, তুমি শোনোনি? তোমার যে স্বয়ংবর।’

যৌবনশ্রী রঘুবংশের পুঁথি মুড়িয়া বান্ধুলির মুখের পানে চাহিলেন, তাঁহার নবকিশলয়ের মত ঠোঁট দুটি একটু বিভক্ত হইল। কিন্তু কোনও অবস্থাতেই চাঞ্চল্য প্রকাশ করা বা অধিক কথা বলা তাঁহার স্বভাব নয়। একটু মৌন থাকিয়া তিনি বলিলেন— ‘আমি শুনিনি। তুই কোথায় শুনলি?’

বান্ধুলি গাঢ়স্বরে ফিস্‌ফিস্‌ করিয়া বলিল— ‘লম্বোদর বলেছে। বাহিরে এখনও প্রকাশ নেই, কিন্তু রাজাদের কাছে লিপি গেছে।’

রাজকুমারীর নবনীতুল্য গাল দুটি একটু উত্তপ্ত হইল, স্খলিত আঁচলটি তুলিয়া তিনি বুকের উপর টানিয়া দিলেন। ঊর্ধ্বদৃষ্টিতে কিছুক্ষণ চাহিয়া থাকিয়া বান্ধুলির দিকে দৃষ্টি নামাইলেন, একটু হাসির উন্মেষ তাঁহার অধর কোণে দেখা দিয়াই মিলাইয়া গেল। তারপর কিছু না বলিয়া তিনি আবার ইন্দুমতীর স্বয়ংবর পড়িতে আরম্ভ করিলেন। মহাকবির কাব্য এখন তাঁহার কাছে নূতন অর্থপূর্ণ হইয়া উঠিয়াছে।

বান্ধুলি সাগ্রহে বলিল— ‘পিয়সহি, মহারাজ তোমাকে কিছু বলেননি?’

যৌবনশ্রী স্মিতমুখ তুলিয়া বলিলেন— ‘না।’ তারপর আবার কাব্যে মনঃসংযোগ করিলেন।

বান্ধুলি বোধহয় প্রিয়সখীর নিকট অন্যরূপ প্রতিক্রিয়া প্রত্যাশা করিয়াছিল। সে একটু নিরাশ হইল। ক্ষণেক নীরব থাকিয়া বলিল— ‘তোমার চুল বেঁধে দেব?’

যৌবনশ্রী পুঁথি হইতে চোখ না তুলিয়া বলিলেন— ‘দে।’

তিন

বিগ্রহ মাতার কাছে গিয়া বলিলেন— ‘মা, আমি দেশ ভ্রমণে যাব। পাটলিপুত্র আর ভাল লাগে না।’

মাতা উদ্বিগ্নমুখে বলিলেন— ‘কোথায় যাবি?’

বিগ্রহ বলিলেন— ‘কোথাও যাব না, নৌকায় চড়ে এদেশ ওদেশ ঘুরে বেড়াব। তুমি ভেব না মা, অনঙ্গ আমার সঙ্গে থাকবে।’

মাতা অনেকটা নিশ্চিন্ত হইলেন, কারণ অনঙ্গপালের উপর তাঁহার অগাধ আস্থা। অনঙ্গ বুদ্ধিমান ও সাহসী, সে বিগ্রহকে সংযত করিয়া রাখিতে পরিবে। বলিলেন— ‘মহারাজের অনুমতি নিয়েছিস?’

‘না। তুমি মহারাজকে বল।’

মহারাজ শুনিয়া আপত্তি করিলেন না। তাঁহার আয়ু ফুরাইয়া আসিতেছে, ছেলে বয়ঃপ্রাপ্ত হইয়াছে। একবার সিংহাসনে বসিবার পরে পর-রাজ্যে ভ্রমণের আর সুযোগ থাকিবে না; সুতরাং এইবেলা কাজটা সারিয়া আসুক। স্বয়ংবরের ব্যাপারে সে বোধহয় মনে আঘাত পাইয়াছে, দু’দিন ঘুরিয়া আসিলে মন ভাল হইবে।

মাঘ মাসের এক দ্বিপ্রহরে অনঙ্গকে লইয়া বিগ্রহ নৌকায় উঠিলেন। নৌকাটি বেশ বড়, উপরে সুসজ্জিত রইঘর; নীচে রন্ধনের ও হালী মাঝিদের থাকিবার স্থান। ছয়জন দাঁড়ী, একজন হালী, একজন দিশারু; ভৃত্য বা পাচক সঙ্গে নাই। অনঙ্গপাল নিজে উৎকৃষ্ট পাচক; দিশারুর কাজ কম, সেও রাঁধিবে। সর্ব-সাকুল্যে নৌকায় দশজন মানুষ। সকলেই অস্ত্রধারণ করিতে জানে। সঙ্গে অস্ত্রও যথেষ্ট আছে। এদিকে জলদস্যু নাই, দক্ষিণে গৌড় বঙ্গে জলদস্যুর বড় দৌরাত্ম্য। তবু সাবধানের মার নাই; জলপথে বা স্থলপথে যে পথেই হোক, বিদেশযাত্রার সময় অস্ত্রশস্ত্র সঙ্গে লইতে হয়।

অনুকূল পবনে পাল তুলিয়া নৌকা মরালগতিতে উজান চলিল। গুণবৃক্ষের মাথায় রাজকীয় লাঞ্ছন নাই, নৌকায় যে রাজপুত্র চলিয়াছেন তাহা অনুমান করা যায় না; মনে হয় প্রয়াগ বা বারাণসীর কোনও বণিকের নৌকা, সাগর হইতে ফিরিতেছে। বিগ্রহের উদ্দেশ্যও তাই, আত্মপরিচয় প্রকাশ না করিয়া তিনি ত্রিপুরী নগরীতে প্রবেশ করিতে চান।

দাঁড়ীরা দাঁড় ধরিল; নৌকার বেগ বর্ধিত হইল। ঘাটে দাঁড়াইয়া দাসীপরিবৃতা রানী সাশ্রুনেত্রে নৌকার পানে চাহিয়া রহিলেন। বিগ্রহপাল নৌকার ছাদে দাঁড়াইয়া হাস্যমুখে হাত নাড়িতে লাগিলেন।

ক্রমে পাটলিপুত্রের শত সৌধচূড়া নদীর বাঁকে অদৃশ্য হইয়া গেল। বিগ্রহপাল ছাদ হইতে নামিয়া রইঘরে আসিয়া বসিলেন। মন স্ফুর্তিতে পূর্ণ; তিনি যেন রাজহংসের মত রেবাতীরস্থ কমলবনের উদ্দেশে উড়িয়া চলিয়াছেন। সেখানে কমলবনের পরাগ-সুরভিত জলে একটি রাজহংসী বাস করে—

অনঙ্গপাল একটি বীণাযন্ত্রের কর্ণমর্দন করিতে করিতে তন্ত্রীতে সুর বাঁধিতেছিল, বিগ্রহপাল তাহার পৃষ্ঠে সস্নেহ মুষ্ট্যাঘাত করিয়া বলিলেন— ‘যাত্রা ভালই হয়েছে, কি বলিস? ঘাটের ধারে দুটো খঞ্জনপাখি ল্যাজ নাচাচ্ছিল।’

অনঙ্গপাল বীণার তন্ত্রীতে তর্জনীর টঙ্কার দিয়া বলিল— ‘খঞ্জন নয়, ও-দুটো কাদাখোঁচা।’

‘না না, খঞ্জন। কাদাখোঁচা কখনো ল্যাজ নাচায়! তা সে যাহোক, কতদিনে ত্রিপুরীতে পৌঁছুব বল দেখি?’

‘তোর মন যে বাতাসের আগে উড়ে চলেছে! এ কি মনপবনের নাও? এত বেশি আগ্রহ কিসের? যাকে চুরি করতে যাচ্ছিস তাকে তো চোখেও দেখিসনি!’

বিগ্রহপালের চক্ষু উত্তেজনায় নাচিয়া উঠিল— ‘তাতে কি! চুরি করাটাই আসল। আর মেয়েটা নিশ্চয় সুন্দর, নইলে স্বয়ংবর হত না।’

বীণা নামাইয়া রাখিয়া অনঙ্গ বলিল— ‘তা কি বলা যায়? রাজারা কি শুধু রূপ দেখেই বিয়ে করে, অনেক সময় রাজনৈতিক চালও থাকে। দশটা রানীর মধ্যে গোটা তিন-চার সুন্দরী থাকলেই হল। মহারাজ লক্ষ্মীকর্ণের কন্যাটি হয়তো বাপের মত দেখতে।’

বিগ্রহ বলিলেন— ‘যদি তা হয় তাহলে তাকে হরণ করে এনে তোর সঙ্গে বিয়ে দেব।’

অনঙ্গ বলিল— ‘তুইও ভীষ্ম নয়, আমিও বিচিত্রবীর্য নই, তোর হরণ করা মেয়ে আমি বিয়ে করব কেন? তোকেই বিয়ে করতে হবে।’

‘আচ্ছা, সে তখন দেখা যাবে। আগে বল ত্রিপুরীতে পৌঁছুব কখন?’

অনঙ্গ দিশারুকে ডাকিল। দিশারুর নাম গরুড়ধ্বজ, চেহারা গিরগিটির মত। সে গুণবৃক্ষে উঠিয়া দিগ্‌দর্শন করিতেছিল, নামিয়া আসিয়া দ্বারের কাছে দাঁড়াইল। অনঙ্গ জিজ্ঞাসা করিল— ‘গরুড়, ত্রিপুরী যেতে কতদিন লাগবে?’

গরুড় বলিল— ‘আজ্ঞা, নৌকা ত্রিপুরী পর্যন্ত যাবে না। ত্রিপুরী নগরী হল গিয়ে নর্মদা নদীর তীরে, শোণ নদের শেষ ঘাট থেকে চার ক্রোশ দূরে।’

‘অর্থাৎ শোণি নদের শেষ ঘাটে নেমে স্থলপথে যেতে হবে। সেখানে যানবাহন পাওয়া যাবে?’

‘আজ্ঞা, মাঝে পাহাড়ের ভিতর দিয়ে পথ আছে, বণিকেরা পণ্য নিয়ে যাতায়াত করে।’

‘এখান থেকে শোণ নদের শেষ ঘাটে পৌঁছুতে কতদিন লাগবে?’

‘গঙ্গাতে উজান ঠেলে যেতে হচ্ছে, শোণেও উজান ঠেলে যেতে হবে। সারা পথ উজান, দশ দিন লাগবে। ফেরার সময় পাঁচ দিনে হবে।’

বিগ্রহ বলিলেন— ‘দশ দিন! হা হতোস্মি!— আর গঙ্গা-শোণ মোহানায় পৌঁছুতে কতক্ষণ লাগবে?’

গরুড় বলিল— ‘আজ্ঞা, শোণের মোহানা এখান থেকে পাঁচ ক্রোশ; বাতাস যদি অনুকূল থাকে সন্ধ্যার আগেই পৌঁছাতে পারি। দু’ঘটি দেরি হলেও ক্ষতি নেই; আজ শুক্লপক্ষের ষষ্ঠী, আকাশে চাঁদ থাকবে।’

‘তাহলে আজ রাত্রে গঙ্গা-শোণ সঙ্গমেই নৌকা বাঁধবে?’

‘আজ্ঞা, তাই ইচ্ছা।’

‘ভাল, যাও তুমি নিজের কাজ কর গিয়ে।’

গরুড় চলিয়া যাইতেছিল, ফিরিয়া দাঁড়াইয়া বলিল— ‘আজ্ঞা, আড়্‌কাঠে উঠেছিলাম, দেখলাম সামনে অনেক দূরে একটা নৌকা যাচ্ছে।’

বিগ্রহ বলিলেন— ‘বটে! কি রকম নৌকা?’

গরুড় বলিল— ‘দূর থেকে বংগাল দেশের নৌকা মনে হল। সঙ্গে একটি ছোট ডিঙি আছে।’

‘বংগাল দেশের নৌকা! হয়তো পশ্চিমে বাণিজ্যে যাচ্ছে।’

‘আজ্ঞা, হতে পারে। তবে বংগাল দেশের নৌকা পশ্চিমে বড় আসে না। পশ্চিম দেশের নৌকাই বংগাল দেশ দিয়ে সাগরে যায়।’

‘আচ্ছা, তুমি যাও। আশঙ্কার কিছু নেই তো?’

‘আজ্ঞা, মনে তো হয় না। তবে যদি বংগাল দেশের নৌকা হয়, সতর্ক থাকা ভাল।’

চার

শীতের সূর্য পশ্চিমে ঢলিয়া পড়িলে বিগ্রহপাল নৌকার ছাদের উপর আসিয়া বসিলেন। অনঙ্গ বীণা লইয়া মৃদু মৃদু বাজাইতে লাগিল। মিঠা লঘু চৈতালি সুর, যেন অদূর বসন্তকে চুপি চুপি ডাকিতেছে।

ছাদের উপর আতপ্ত রৌদ্র ও শীতল বাতাসের সংমিশ্রণ বড়ই উপাদেয়। চারিদিকের দৃশ্যও চিত্তগ্রাহী। নৌকা স্রোতের ঠিক মাঝখান দিয়া যাইতেছে না; মাঝখানে স্রোতের বেগ বেশি, তাই একটু পাশ কাটাইয়া চলিয়াছে; বাম দিকের তীর নিকটে, দক্ষিণ দিকের তীর দূরে। মাঘ মাসের কৃশাঙ্গী গঙ্গা দুই তীরে সিকতাঞ্চল বিছাইয়া দিয়াছে। নদীর বুকেও স্থানে স্থানে বালুচর জাগিয়াছে। চরের শুষ্ক বালুকার উপর অগণিত হংস লীন হইয়া রোদ পোহাইতেছে, নৌকা কাছে আসিলে গ্রীবা তুলিয়া ডাকাডাকি করিতেছে। শীতের আরম্ভে হিমালয়ের হ্রদগুলি যখন হিমাবৃত হয় তখন ইহারা দলে দলে ভারতের নদ-নদীতে নামিয়া আসে, শীতের অন্তে আবার হিমালয়ে ফিরিয়া যায়।

গঙ্গার দক্ষিণ তীর নৌকা হইতে স্পষ্ট দেখা যায়। সৈকতসীমা পার হইয়া উচ্চ পাড়; পাড়ের উপর কোথাও কর্কশ কাশ-স্তম্ব, কোথাও পীতপুষ্পিত সরিষার ক্ষেত, কোথাও তৃণশীর্ষ ছোট গ্রাম। নৌকা আগে চলিয়াছে গ্রাম পিছাইয়া যাইতেছে; আবার কাশের বন, আবার পীতপুষ্পিত সরিষার ক্ষেত, আবার গ্রাম। বিগ্রহ হর্ষোৎফুল্ল নেত্রে দেখিতে দেখিতে চলিলেন।

ক্রমে সূর্য পাটে বসিল। আর একটি অজ্ঞাত অখ্যাত গ্রাম; গ্রাম-বধূরা নদীতে জল ভরিতে আসিয়াছে, একপাল গরু বাছুর জলের কিনারায় সারি দিয়া দাঁড়াইয়া জল পান করিতেছে। ঘাট হইতে অদূরে চক্রবাক মিথুন কাতর কলধ্বনি করিয়া পরস্পর বিদায় লইল। সন্ধ্যা নামিতেছে, আকাশের গায়ে বৈরাগ্যের গৈরিক উত্তরীয়।

অতঃপর শোণ-সঙ্গম পর্যন্ত আর গ্রাম নাই, কেবল কাশের ক্ষুপ। শোণের মোহানা এক স্থানে স্থির থাকে না, কখনও পশ্চিমে সরিয়া যায়, আবার কখনও পাটলিপুত্রের দিকে সরিয়া আসে। স্মরণাতীত কাল হইতে এই চলিতেছে। তাই এই অব্যবস্থিত চিত্ত নদের মুখের কাছে জনবসতি নাই।

বিগ্রহপালের নৌকা যখন গঙ্গা-শোণ সঙ্গমে পৌঁছিল তখন দিনের আলো আর নাই, চাঁদের আলো ফুটিফুটি করিতেছে। অনচ্ছ চন্দ্রকিরণে জলস্থল অবাস্তব আলো-আঁধারিতে পরিণত হইয়াছে। বাতাস মন্থর হইয়া ক্রমশ থামিয়া আসিতেছে।

গরুড় আসিয়া বলিল— ‘আজ এখানেই নৌকা বাঁধি। বংগাল দেশের নৌকাটা সামনেই বেঁধেছে।’

বিগ্রহপাল হিম-কুহেলির ভিতর দিয়া সম্মুখে দৃষ্টি প্রেরণ করিলেন, দেখিলেন চার-পাঁচ রজ্জু দূরে কিনার ঘেঁষিয়া একটি নৌকার অস্পষ্ট অবয়ব দেখা যাইতেছে। পাল নামানো, গুণবৃক্ষটি শীর্ণ তর্জনীর মত ঊর্ধ্বদিকে নির্দিষ্ট।

অনঙ্গপালও দেখিতেছিল, বলিল— ‘মোহানার কাছে নৌকা বেঁধেছে, ওরাও বোধহয় শোণ নদে যাবে।’

গরুড় বলিল— ‘আজ্ঞা, তাই মনে হয়। ওরা বেলা থাকতে থাকতে নৌকা বেঁধেছে, গঙ্গা দিয়ে যাবার হলে মোহানা পেরিয়ে নৌকা বাঁধত।’

অনঙ্গ বলিল— ‘তুমি এখানেই নৌকা বাঁধো, আর বেশি কাছে গিয়ে কাজ নেই।’

অতঃপর পাল নামাইয়া নৌকা তীরের আরও কাছে লইয়া গিয়া কাদায় বাঁশ পুতিয়া বাঁধা হইল। দাঁড়ী মাঝিরা সারা দিন পরে বিশ্রাম পাইল।

গরুড় রইঘরে দীপ জ্বালিয়া দিল, চারি কোণে দণ্ডের মাথায় চারিটি ঘৃতদীপ। দুই বন্ধু পাশা পাতিয়া খেলিতে বসিলেন। গরুড় নীচে রন্ধন করিতে গেল। অনঙ্গ তাহাকে বলিয়া দিলে— ‘গরুড়, বেশি কিছু রাঁধতে হবে না, কেবল ভাত আর অলাবুর দধিপাক। মহারানী প্রচুর মাছ রেঁধে সঙ্গে দিয়েছেন, তাতেই আজ রাতটা চলে যাবে। তোমরাও পাবে।’

পাল রাজ-বংশীয়েরা বাঙ্গালী ছিলেন। বঙ্গদেশ হইতে বিচ্যুত হইয়াও তাঁহারা মাছ-ভাতের নেশা ছাড়িতে পারেন নাই।

যথাকলে অন্ন প্রস্তুত হইলে দুই বন্ধু আহার করিলেন। অনঙ্গপাল পানের বাটা লইয়া পান সাজিতে বসিল। এলা দারুচিনি ও কেয়া-খয়ের দেওয়া সুগন্ধি তাম্বূল; দুইজনে পান চিবাইতে চিবাইতে বাহিরে আসিয়া দাঁড়াইলেন। চন্দ্র অস্ত গিয়াছে, কালপুরুষকে মধ্যে লইয়া অসংখ্য উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক আকাশে ঝলমল করিতেছে।

সহসা দূর হইতে মধুর স্ত্রীকণ্ঠের সঙ্গীত ভাসিয়া আসিল। দুই বন্ধু চকিত হইয়া চাহিলেন; সম্মুখের নৌকা হইতে স্বরলহরী আসিতেছে। বিগ্রহ কিছুক্ষণ কান পাতিয়া শুনিয়া বলিলেন— ‘ধন্য! কথা বোঝা যাচ্ছে না বটে, কিন্তু ভারি মিষ্ট গলা।’

অনঙ্গ বলিল— ‘দেশ-বরাড়ী রাগ, যতি তাল। সঙ্গে সুষির বাজছে।’

বিগ্রহ বলিলেন— ‘ওদের সঙ্গে যখন স্ত্রীলোক আছে, তখন ওরা নিশ্চয় চোর ডাকাত নয়।’

অনঙ্গ মাথা নাড়িল— ‘বলা যায় না, হয়তো মেয়ে-গলার গান শুনিয়ে আমাদের নিশ্চিন্ত করবার একটা ছল, ব্যাধ যেমন বাঁশি বাজিয়ে হরিণ ধরে।’

বিগ্রহ বলিলেন— ‘তোর সব তাতেই সন্দেহ। যদি ওদের সত্যিই কোনও দুরভিসন্ধি থাকে, আমার সঙ্গে অগ্নিকন্দুক আছে।’

অনঙ্গ কিছু বলিল না। অগ্নিকন্দুক সম্বন্ধে তাহার মনে বিশেষ ভরসা ছিল না। মায়াবী যন্ত্রের সাহায্যে মায়া দেখায়, সেই যন্ত্র পাইলে প্রাকৃতব্যক্তি মায়া দেখাইতে পারে কি? যা হোক, গান বন্ধ হইল অনঙ্গ গরুড়কে ডাকিয়া রাত্রে সতর্ক থাকিবার অনুজ্ঞা দিল, তারপর দুই বন্ধু রইঘরে গিয়া পাশাপাশি শয্যায় শয়ন করিল। দুই দণ্ড পরে গঙ্গার কুলকুল ধ্বনি শুনিতে শুনিতে তাহারা ঘুমাইয়া পড়িল।

অন্য নৌকার যাত্রীরাও দেখিয়াছিল পাটলিপুত্র হইতে একটি নৌকা দূরে দূরে তাহাদের পিছনে আসিতেছে। তাহারাও সতর্কভাবে রাত্রিযাপন করিল।

পাঁচ

লক্ষ্মীকর্ণদেবের জামাতা জাতবর্মা শ্বশুর মহাশয়ের নিকট অর্ধপথে বিদায় লইয়া স্বদেশে ফিরিয়া গিয়াছিলেন। শ্বশুরের সহিত যুদ্ধযাত্রার সাধ তাঁহার আদৌ ছিল না, নিতান্তই শ্বশুরের সাগ্রহ আহ্বানে অনিচ্ছাভরে জয়যাত্রায় যোগ দিয়াছিলেন। জয়যাত্রা যে এমন প্রহসনে পরিণত হইবে তাহা তিনি স্বপ্নেও ভাবেন নাই।

রাজধানী বিক্রমপুরে উপনীত হইয়া জাতবর্মা পিতৃদেবকে সমস্ত কথা নিবেদন করিলেন। শুনিয়া মহারাজ বজ্রবর্মা খুব খানিকটা হাসিলেন; বৈবাহিক বিপাকে পড়িলে কার না আনন্দ হয়? তারপর বলিলেন— ‘যাক, প্রাণে প্রাণে ফিরে এসেছ এই যথেষ্ট। ভরসা করি বৈবাহিক মহাশয়ের শিক্ষা হয়েছে। নয়পাল নিরীহ মানুষ, তাই বেঁচে গেলেন। — বিগ্রহপালের সঙ্গে যদি যৌবনশ্রীর বিবাহ হয় তাহলে উভয় পক্ষেরই মঙ্গল। আমাদেরও মঙ্গল। বিগ্রহপাল তোমার শ্যালীপতি হবে। শ্যালীপতিদের মধ্যে যুদ্ধবিগ্রহের আশঙ্কা কম। এখন অন্তঃপুরে যাও। বধূমাতা তোমার জন্য উৎকণ্ঠিতা আছেন।’

জাতবর্মা অন্তঃপুরে গেলেন। পত্নীর সহিত মিলন হইল। যেন কতদিনের দীর্ঘ বিচ্ছেদ, দুইজনে নিবিড়ভাবে আলিঙ্গনবদ্ধ হইলেন।

বীরশ্রী তাঁহার ভগিনী যৌবনশ্রী অপেক্ষা তিন বৎসরের বড়। দীঘল পূর্ণায়ত দেহ; সর্বাঙ্গে পরিণত যৌবনের প্রাচুর্য ফাটিয়া পড়িতেছে। মুখখানি হয়তো যৌবনশ্রীর মত অত সুন্দর নয়, তবু রসে রহস্যে চটুলতায় এমনই প্রাণবন্ত যে নিছক সৌন্দর্যের ন্যূনতা সহসা অনুভব হয় না। দুই ভগিনীর প্রকৃতিও সম্পূর্ণ বিপরীত; একজন যেমন শান্ত গম্ভীর, অন্যজন তেমনি হাস্যকৌতুকময়ী। তিন বৎসর হইল বীরশ্রীর বিবাহ হইয়াছে, এখনও সন্তানাদি হয় নাই; স্বামী-স্ত্রী পরস্পরের মধ্যে মগ্ন হইয়া আছেন।

তৎকালে ভারতে বহু বিবাহ প্রচলিত ছিল, বিশেষত রাজাদের মধ্যে। তাই বলিয়া সকলেই বহু বিবাহ করিতেন না। এক পত্নীতে যাঁহারা সুখী হইতেন তাঁহারা একনিষ্ঠ থাকিতেন। জাতবর্মাও একনিষ্ঠ ছিলেন।

জাতবর্মা ও বীরশ্রী দুই মাস আনন্দে কাটাইয়া দিলেন। তারপর ত্রিপুরী হইতে পত্র লইয়া দূত আসিল। যৌবনশ্রীর স্বয়ংবরে মহারাজ লক্ষ্মীকর্ণ কন্যা-জামাতাকে আহ্বান করিয়াছেন।

জাতবর্মা প্রথমটা ইতস্তত করিয়াছিলেন, শ্বশুর মহাশয়ের ব্যাপারে আবার জড়াইয়া পড়িবার ইচ্ছা তাঁহার ছিল না। কিন্তু বীরশ্রী স্বামীকে শয্যায় পাড়িয়া ফেলিয়া দুই মৃণালভুজে তাঁহার কণ্ঠাশ্লেষ করিয়া ধরিলেন, বলিলেন— ‘যৌবনার স্বয়ংবরে যদি আমায় না নিয়ে যাও, জন্মে তোমার সঙ্গে কথা কইব না।’

এরূপ অবস্থায় কোনও স্বামীই অধিকক্ষণ আক্রমণ প্রতিরোধ করিতে পারে না, জাতবর্মা তবু বলিলেন— ‘কিন্তু বীরা, ভেবে দেখ, যৌবনশ্রী যদি স্বয়ংবর সভায় আমার গলায় মালা দেয় তখন যে বড় বিপদ হবে।’

বীরশ্রী মুখ টিপিয়া হাসিলেন— ‘বেশ তো, ভালই হবে। দুই বোনে কেমন একসঙ্গে থাকব।’

জাতবর্মা বলিলেন— ‘তোমাদের দুই বোনের না হয় ভালই হবে। কিন্তু আমি? একটি বোনকেই সামলাতে পারি না—’

বীরশ্রী স্বামীর মুখের উপর মুখ রাখিয়া চুপিচুপি বলিলেন— ‘ভয় নেই, তোমাকে আমি স্বয়ংবর সভায় যেতে দেব না, ঘরে বন্ধ করে রাখব।’

সুতরাং রাজী হইতে হইল। মহারাজ বজ্রবর্মাও আপত্তি করিলেন না। যাত্রার উদ্যোগ আয়োজন হইল। বাংলা দেশ হইতে ত্রিপুরী যাইতে হইলে জলপথই প্রশস্ত। স্থলপথে যাইলে অনেক লোকজন সঙ্গে লইতে হয়, জলপথ অপেক্ষাকৃত নিরাপদ। জাতবর্মা নৌকা সাজাইয়া বীরশ্রীকে লইয়া বাহির হইয়া পড়িলেন। বড় নৌকা; চৌদ্দজন নাবিক, দুইজন ভীমকায় দেহরক্ষী সঙ্গে আছে। উপরন্তু খাদ্যাদি অতিরিক্ত বস্তু বহনের জন্য একটি ছোট ডিঙা।

নৌকা প্রথমে উত্তরমুখে চলিল, তারপর কজঙ্গলের গিরিসংকট পার হইয়া পশ্চিমমুখী হইল। এখান হইতে মগধের সীমান্ত আরম্ভ। এতদিন গুণবৃক্ষের শীর্ষে রাজকীয় কেতন উড়িতেছিল, মগধে প্রবেশ করিয়া জাতবর্মা কেতন নামাইয়া লইবার আদেশ দিলেন। পররাজ্যে আত্মপরিচয় ঘোষণার প্রয়োজন নাই। মগধে অবশ্য বন্দর নাই, নৌ-সৈন্যের দ্বারা শুল্ক আদায়ের ব্যবস্থা নাই। যে-কালে এখানে অসংখ্য বিশাল রণতরীর সমাবেশ সেতুবন্ধ রামেশ্বরের শৈলশিখরশ্রেণী বলিয়া মনে হইত সে-কাল আর নাই। তবু যথাসম্ভব প্রচ্ছন্নভাবে যাওয়াই বাঞ্ছনীয়।

যাত্রার এক পক্ষ পরে একদিন প্রত্যূষে জাতবর্মার নৌকা পাটলিপুত্র পার হইয়া গেল। আর কয়েক ক্রোশ পরে গঙ্গা-শোণ সঙ্গম; সন্ধ্যার পূর্বেই সেখানে পৌঁছানো যাইবে। একবার শোণ নদে প্রবেশ করিতে পারিলে অনেকটা নিশ্চিন্ত, সম্মুখে মাত্র সাত-আট দিনের পথ বাকি থাকিবে। এ পর্যন্ত অবশ্য নিরুপদ্রবেই আসা গিয়াছে, কিন্তু নারী লইয়া পথে যাত্রা করিলে মনে সর্বদাই চিন্তা লাগিয়া থাকে। এইজন্যই প্রবাদ আছে— পথি নারী বিবর্জিতা।

সেদিন দ্বিপ্রহরে দেখা গেল পাটলিপুত্রের ঘাট হইতে একটি নৌকা বাহির হইয়া তাঁহাদের পিছু লইয়াছে। জেলেডিঙি বা খেয়াতরী নয়, বেশ বড় নৌকা। অবশ্য ইহাতে উদ্বিগ্ন হইবার কিছু নাই, নৌকাটি সম্ভবত কাশী বা প্রয়াগ যাইতেছে। সন্ধ্যার মুখে জাতবর্মা শোণের মোহানার কাছে নৌকা বাঁধিলেন। দুই দণ্ড পরে অস্ফুট চন্দ্রালোকে গা ঢাকিয়া অন্য নৌকাটি নিশাচর পেচকের ন্যায় অদূরে আসিয়া পাল নামাইল।

জাতবর্মা মনে মনে খুবই শঙ্কিত হইলেন কিন্তু বাহিরে কিছু প্রকাশ করিলেন না। নাবিক ও রক্ষীরা আপনা হইতেই সতর্ক হইয়াছিল, তাহাদের কিছু বলিতে হইল না। কিয়ৎকাল চিন্তিতভাবে নৌকার পট্টপত্তনের উপর বিচরণ করিয়া জাতবর্মা মুখে প্রফুল্লতা আনিয়া রইঘরে প্রবেশ করিলেন। বীরাকে কিছু বলা হইবে না, সে ভয় পাইতে পারে।

রইঘরে দীপ জ্বলিয়াছে। বীরশ্রী আপন হাতে বেণী রচনা করিয়া দর্পণ হস্তে সীমান্তে সিন্দূর পরিতেছেন। সীমান্তে সিন্দূর পরার রীতি তিনি বিবাহের পর শিখিয়াছেন, বঙ্গ-মগধের বাহিরে দক্ষিণ বা পশ্চিম ভারতে সিঁথির সিন্দূর পরার রীতি নাই; বিবাহিত রমণীরা কণ্ঠে মঙ্গলসূত্র ও ললাটে কুঙ্কুমের টিপ পরেন। জাতবর্মা বীরশ্রীর কাছে গিয়া দাঁড়াইলে বীরশ্রী মৃদু হাসিয়া স্বামীর ভ্রূমধ্যে সিন্দূরের ফোঁটা আঁকিয়া দিলেন। জাতবর্মা আপত্তি করিলেন না। তৎকালে স্ত্রী ও পুরুষের প্রসাধন অনেকটা একই প্রকার ছিল; বিলাসী পুরুষেরা অঙ্গদ কুণ্ডল পরিতেন, লাক্ষারসে নখ ও অধর রঞ্জিত করিতেন, চোখে কাজল দিতেন। গলায় হার থাকিত, পায়ে ময়ূরপঙ্খী পাদুকা।

জাতবর্মা বাঁশি লইয়া পালঙ্কের পাশে বসিলেন এবং ধীরে ধীরে বাজাইতে আরম্ভ করিলেন। বীরশ্রী আসিয়া তাঁহার কাঁধে মাথা রাখিয়া পাশে বসিলেন, তারপর তাঁহার কণ্ঠ হইতে গানের মৃদু গুঞ্জরন বাহির হইল। দুইজনেই সঙ্গীতবিদ্যায় নিপুণ। নির্জন গঙ্গার তীরে নৌকার দীপালোকিত রতিগৃহে যেন গন্ধর্বলোকের মায়া সৃষ্ট হইল।

ছয়

পরদিন প্রাতঃকালে দুই নৌকা প্রায় একই সময় কাছি খুলিয়া যাত্রা শুরু করিল। রাত্রে কোনও দুর্ঘটনা ঘটে নাই, তাই উভয় পক্ষই নিশ্চিন্ত হইয়াছেন— অপর পক্ষ দস্যু তস্কর নয়।

বংগাল দেশের নৌকা আগে আগে শোণ নদে প্রবেশ করিল, তাহার পাঁচ রশি পিছনে বিগ্রহপালের নৌকা। এতক্ষণ তাঁহারা পশ্চিম দিকে চলিতেছিলেন, এখন দক্ষিণ-পশ্চিমে চলিলেন। এই পথে আরও তিন দিন চলিলে মগধের সীমানায় পৌঁছানো যাইবে; তারপর হইতে চেদিরাজ্যের আরম্ভ।

সূর্যোদয় হইল। শোণের স্বর্ণাভ জল কাঁচা রৌদ্রে ঝলমল করিয়া উঠিল। দুইটি নৌকা আগে-পিছে চলিয়াছে। যাত্রীদের মন নিশ্চিন্ত হইয়াছে বটে কিন্তু দুশ্চিন্তার পরিবর্তে কৌতূহল জাগিয়াছে। — ওরা কারা? কোথায় যাইতেছে? ওরাও কি ত্রিপুরী যাইবে? না যাইতেও পারে; হয়তো পথে রোহিতাশ্বগড়ে থাকিয়া যাইবে। রোহিতাশ্বগড় শোণ নদের তীরে মগধের দক্ষিণ সীমান্তের প্রহরী।

অনঙ্গপাল নদীতে মাছ ধরার উদ্যোগ করিতেছিল। মাছ না হইলে তাহার চলে না; সে মুগার সূতা, বঁড়শি প্রভৃতি সঙ্গে আনিয়াছিল। এখন নৌকার পিছন দিকে গিয়া বসিল, বঁড়শিতে টোপ গাঁথিয়া দূরে জলের মধ্যে ফেলিয়া সূতা ধরিয়া বসিয়া রহিল। সকালবেলার নরম রৌদ্র বড় মিঠা।

বিগ্রহপাল বন্ধুর কাছে আসিয়া বসিলেন। দুইজনে অলস জল্পনা করিতে লাগিলেন। গঙ্গার জল ধূসর, শোণের জল সোনালি কেন? কত জাতের হাঁস চরে বসিয়া রোদ পোহাইতেছে। উহাদের ধরা যায় না?

তারপর বিগ্রহ বলিলেন— ‘সামনের নৌকায় কে যাচ্ছে জানবার ভারি কৌতূহল হচ্ছে। হয়তো গৌড় কি সমতট কি প্রাগ্‌জ্যোতিষ থেকে কেউ স্বয়ংবরে যাচ্ছে।’

অনঙ্গ বলিল— ‘যদি তাই হয় দূরে থাকাই ভাল। তোকে চিনে ফেললেই বিপদ।’

বিগ্রহ বলিলেন— ‘আমাকে ওরা কি করে চিনবে? যদি জানতে চায়, বললেই হবে আমরা বণিক, ত্রিপুরীতে বাণিজ্য করতে যাচ্ছি।’

মন খুঁত খুঁত করিলেও অনঙ্গ আর আপত্তি করিল না। বিগ্রহপাল তখন গরুড়কে ডাকিয়া বলিলেন— ‘নৌকা আরও জোরে চালাও। সামনের নৌকার পাশাপাশি হয়ে খবর নাও, ওরা কারা, কোথা থেকে আসছে, কোথায় যাবে। আমাদের পরিচয় জানতে চাইলে বোলো আমরা ব্যাপারী।’

‘আজ্ঞা’ বলিয়া গরুড় চলিয়া গেল।

নৌকা এতক্ষণ পালের ভরে চলিতেছিল, সঙ্গে চার দাঁড় ছিল; এখন ছয় দাঁড় লাগিল। নৌকার গতি শীঘ্র হইল। এক দণ্ডের মধ্যে দুই নৌকা পাশাপাশি হইল, মধ্যে ত্রিশ হস্তের ব্যবধান।

দুই নৌকার দুই দিশারুর মধ্যে সতর্ক বাক্যালাপ আরম্ভ হইল। গরুড় গলা বাড়াইয়া প্রশ্ন করিল— ‘কোথা যাও?’

অন্য দিশারুর চেহারাও টিকটিকির মত; নাম বোধকরি জটায়ু। সে বলিল— ‘তুমি কোথা যাও?’

গরুড় বলিল— ‘ত্রিপুরীর ঘাট অবধি।’

জটায়ু বলিল— ‘আমিও ত্রিপুরীর ঘাট অবধি।’

এইখানে ভাষা সম্বন্ধে দু’টা কথা বলিয়া রাখি। তৎকালে সমগ্র উত্তর ভারতে দুইটি ভাষা প্রচলিত ছিল; পশ্চিমে শৌরসেনী অপভ্রংশ এবং পূর্বে মাগধী অপভ্রংশ। উভয় ভাষাই সংস্কৃতের বিকার; উভয়ের মধ্যে প্রভেদ বেশি ছিল না। বাংলা দেশের মানুষ বিনা ক্লেশে শৌরসেনী ভাষা বুঝিত, পশ্চিম ও মধ্যদেশের লোকেরা মাগধী অপভ্রংশের বঙ্গীয় রূপ বুঝিতে গলদ্‌ঘর্ম হইত না। তখনও বাংলা ও অন্যান্য প্রান্তীয় ভাষাগুলি দানা বাঁধিতে আরম্ভ করে নাই।

যা হোক, গরুড় বলিল— ‘কোন কাজে ত্রিপুরী যাও?’

জটায়ু বলিল— ‘তুমি কোন কাজে যাও?’

গরুড় বলিল— ‘ব্যাপার করতে যাই।’

জটায়ু বলিল— ‘আম্মো।’

গরুড় বলিল— ‘তোমার নৌকায় কয়জন যাত্রী?’

এই সময় জাতবর্মা রইঘরের বাহিরে আসিয়া দাঁড়াইলেন। অপর নৌকায় বিগ্রহপাল দিশারুদ্বয়ের বাক্‌চাতুর্যে অধীর হইয়া নৌকার পিছন দিক হইতে উঠিয়া আসিলেন। দুইজনে দৃষ্টি বিনিময় হইল। কিছুক্ষণ অবাক থাকিয়া দুইজনেই উচ্চকণ্ঠে হাসিয়া উঠিলেন।

বিগ্রহ বলিলেন— ‘এ কি, যুবরাজ ভট্টারক জাতবর্মা। শ্বশুরালয়ে চলেছেন?’

জাতবর্মা বলিলেন— ‘আপনি! কুমার—’

বিগ্রহপাল সচকিতে অধরের উপর অঙ্গুলি রাখিলেন, জাতবর্মা থামিয়া গেলেন। ওদিকে অনঙ্গপাল হাসি ও কথার শব্দ শুনিতে পাইয়াছিল, সে গলুইয়ে মাছ-ধরা সূতা বাঁধিয়া তাড়াতাড়ি উঠিয়া আসিল, কর্ণধারকে বলিয়া আসিল— ‘তুমি এদিকে একটু দৃষ্টি রেখো।’

অনঙ্গ বিগ্রহপালের পাশে উপস্থিত হইলে বিগ্রহ তাহার কানে কানে জাতবর্মার পরিচয় দিলেন। অনঙ্গ এমনভাবে বিগ্রহের পানে তাকাইল যাহার অর্থ— কেমন, বলেছিলাম কিনা। তারপর সে জাতবর্মার দিকে ফিরিয়া যুক্তকরে নমস্কার করিল। বিগ্রহ বলিলেন— ‘আমার বয়স্য অনঙ্গ।’

জাতবর্মা প্রতি-নমস্কার করিলেন। বিগ্রহ বলিলেন— ‘আপনি আসুন না আমার নৌকায়, ভাল করে আলাপ করা যাক।’

জাতবর্মা বলিলেন— ‘আপনারা আসুন না, আমি ডিঙা পাঠিয়ে দিচ্ছি।’

বিগ্রহ বলিলেন— ‘আপত্তি নেই। আপনি একা যাচ্ছেন তো?’

বিগ্রহ বলিলেন— ‘না, সঙ্গে শ্বশুরকন্যা আছেন।’

বিগ্রহপাল মুখের একটি সকৌতুক ভঙ্গি করিলেন, বলিলেন— ‘তাহলে আপনিই আসুন।’

জাতবর্মা পলকের জন্য ইতস্তত করিলেন, কিন্তু তাহা অভ্যস্ত সতর্কতার সংস্কার মাত্র। বিগ্রহপালের মনে যে ছল-চাতুরী নাই তাহা তাঁহার মুখ দেখিলেই অনুভব হয়। জাতবর্মা হাসিয়া বলিলেন— ‘ভাল, কি খাওয়াবেন বলুন। বিক্রমশীল মঠের লপ্সিকা দিলে কিন্তু যাব না।’

বিগ্রহপাল উচ্চহাস্য করিয়া উঠিলেন— ‘না না, মায়ের হাতের কর্চরিকা আর ক্ষীরের লাড়ু আছে। যদি আপত্তি না থাকে আসুন।’

জাতবর্মা বলিলেন— ‘মায়ের হাতের কচুরি! ক্ষীরের লাড়ু! ধন্য! আমি এখনি যাচ্ছি। আমার সঙ্গেও কিছু মিষ্টান্ন ছিল, কিন্তু সে অনেক দিন শেষ হয়ে গেছে।’

জাতবর্মার নৌকার পিছনে ডিঙা বাঁধা ছিল, তাঁহার আদেশে নৌকা পাশে আসিয়া ভিড়িল। তিনি ডিঙায় চড়িয়া বিগ্রহপালের নৌকায় আসিয়া উঠিলেন। দুই নৌকা পাশাপাশি চলিতেই রহিল।

বিগ্রহপাল জাতবর্মাকে আলিঙ্গন করিলেন, বলিলেন— ‘প্রথম দর্শনেই আপনার সঙ্গে আলাপ করবার লোভ হয়েছিল। কিন্তু তখন দৈব ছিল প্রতিকূল—’

জাতবর্মা বলিলেন— ‘আপনাদের বোধহয় বিশ্বাস আমি শ্বশুর মহাশয়ের সঙ্গে মগধ জয় করতে এসেছিলাম। আপনারা আমাকে ভুল বুঝেছিলেন। শ্বশুর মহাশয় আমাকে মৃগয়ার ছিল করে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। যা হোক, যা হয়েছে ভালই হয়েছে। আপনি স্বয়ংবর সভায় যাচ্ছেন তো?’

বিগ্রহপাল অনঙ্গের দিকে ফিরিয়া মৃদু হাসিলেন, বলিলেন— ‘কতকটা তাই বটে। আসুন, ভিতরে বসা যাক।’

বিগ্রহ ও জাতবর্মা রইঘরের মধ্যে গিয়া বসিলেন। অনঙ্গপাল মান্য অতিথির জন্য পেটরা হইতে মিষ্টান্নাদি বাহির সোনায় থালায় সাজাইতে লাগিল।

জাতবর্মা বলিলেন— ‘কি ব্যাপার বলুন। মনে হচ্ছে কিছু গণ্ডগোল আছে।’

বিগ্রহপাল বলিলেন— ‘গণ্ডগোল আছে। আমি ত্রিপুরী যাচ্ছি বটে কিন্তু স্বয়ংবর সভায় নিমন্ত্রিত হইনি।’

‘নিমন্ত্রিত হননি!’ জাতবর্মা হতবুদ্ধির মত চাহিয়া রহিলেন।

বিগ্রহপাল বলিলেন— ‘আপনি দেখছি জানেন না। আপনার শ্বশুর মহাশয় প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছেন। আর্যাবর্তের ও দাক্ষিণাত্যের প্রায় সকল রাজাই আমন্ত্রিত হয়েছেন, কেবল মগধ বাদ পড়েছে।’

জাতবর্মার মুখ ধীরে ধীরে রক্তবর্ণ হইয়া উঠিল; তিনি কিছুক্ষণ গালে হাত দিয়া বসিয়া রহিলেন। তারপর মুখ তুলিয়া বলিলেন— ‘লজ্জায় আমার মাথা কাটা যাচ্ছে। শ্বশুর মহাশয় সম্বন্ধে আমার মনে কোনও মোহ নেই, কিন্তু তিনি যে বাক্যদান করে খণ্ডন করবেন এ আমার কল্পনার অতীত।’

বিগ্রহ বলিলেন— ‘আপনি ক্ষত্রিয়ের মত কথা বলেছেন। এখন বলুন দেখি, আমার অবস্থায় পড়লে আপনি কি করতেন?’

জাতবর্মার কণ্ঠস্বর উদ্দীপ্ত হইয়া উঠিল— ‘আমি কি করতাম? চেদিরাজ্য আক্রমণ করতাম, বলপূর্বক কন্যাকে হরণ করে আনতাম।’

বিগ্রহপাল কলকণ্ঠে হাসিতে হাসিতে জাতবর্মার গায়ে ঢলিয়া পড়িলেন, বাহু দিয়া পৃষ্ঠ আবেষ্টন করিয়া বলিলেন— ‘বন্ধু, আপনি আমার মনের কথাটি বলেছেন।’

বিগ্রহপালের মুক্তকণ্ঠ হাসি জাতবর্মার মুখেও সংক্রামিত হইল। তিনি বলিলেন— ‘ব্যাপার কি? আপনি কি তবে—?’

এই সময় অনঙ্গ স্বর্ণপাত্রে জলযোগ আনিয়া জাতবর্মার সম্মুখে স্থাপন করিল। বিগ্রহ বলিলেন— ‘আগে একটু মিষ্টিমুখ করুন।’

জাতবর্মা আহার্যগুলিকে সস্নেহে নিরীক্ষণ করিয়া একটি কর্চরিকা তুলিয়া লইলেন, তাহাতে একটু কামড় দিয়া চক্ষু মুদিয়া চিবাইতে লাগিলেন। কিছুক্ষণ পরে চক্ষু খুলিয়া বলিলেন— ‘বিগ্রহ, তুমি আমার ভাই, তোমার মা আমার মা। ত্রিপুরী থেকে ফেরবার পথে আমি পাটলিপুত্রে নামব, মায়ের হাতের রান্না পেট ভরে খেয়ে তবে দেশে ফিরব। তুমি যদি আপত্তি কর তোমার সঙ্গে ঝগড়া হয়ে যাবে।’

বিগ্রহ গদ্‌গদ স্বরে বলিলেন— ‘আজ থেকে তুমি আমার জ্যেষ্ঠ, আমি তোমার কনিষ্ঠ, আমার মা তোমার মা। কিন্তু মনে থাকে যেন তোমার মায়ের ভাগও আমাকে দিতে হবে।’

জাতবর্মা নিশ্বাস ফেলিলেন— ‘আমার মা নেই, জীবনে মায়ের আদর পাইনি। তাই তো তোমার মায়ের ওপর লোভ।’

পরিপূর্ণ হৃদয়ে দুইজন কিছুক্ষণ নীরব রহিলেন। প্রথম দর্শনে তাঁহারা পরস্পরের প্রতি যে আকর্ষণ অনুভব করিয়াছিলেন তাহা যেন এখন সুদৃঢ় বন্ধনে পরিণত হইল। নবীন যৌবনে হৃদয় যখন কোমল থাকে তখন এমনি করিয়াই প্রণয় হয়।

অনঙ্গপাল এতক্ষণ ঘরের মধ্যেই ছিল, কিন্তু ইচ্ছা করিয়া নিজেকে একটু পিছনে রাখিয়ছিল; বিগ্রহ প্রাণ-খোলা মানুষ, সে হয়তো জাতবর্মার কাছে গুহ্য কথা প্রকাশ করিয়া ফেলিবে, এ-আশঙ্কা তাহার মনে ছিল। কিন্তু জাতবর্মার মনের পরিচয় পাইয়া তাহার শঙ্কা দূর হইল। জাতবর্মা এমন মানুষ যে তাঁহার কাছে মনের গুহ্যতম কথা বলিয়াও পশ্চাত্তাপের ভয় নাই।

অনঙ্গ এখন জাতবর্মার কাছে আসিয়া বসিল, বলিল— ‘যুবরাজ, আপনি কিছুই খাচ্ছেন না। মা’র কাছে এত কম খেলে বকুনি খেতে হবে।’

‘সেটাও তো খাওয়া। মা’র কাছে বকুনি খাওয়ার সৌভাগ্য কয়জনের হয়?’ জাতবর্মা আবার জলযোগে প্রবৃত্ত হইলেন, ‘যাক, বিগ্রহ, এখন বল দেখি তুমি একা একা ত্রিপুরী যাচ্ছ কেন? যদি আক্রমণ করাই উদ্দেশ্য, সৈন্য সঙ্গে নেই কেন? সৈন্য কি স্থলপথে যাচ্ছে?’

বিগ্রহ মাথা নাড়িলেন— ‘না। পিতৃদেব সামান্য কারণে যুদ্ধ করার বিরোধী। আমি তাঁকে না জানিয়ে চুপি চুপি ত্রিপুরী যাচ্ছি।’

‘কিন্তু কেন? কোনও ফন্দি আছে নিশ্চয়।’

‘ফন্দি আছে একটা। কিন্তু তোমাকে বলতে সঙ্কোচ হচ্ছে।’

‘কি, বড় ভায়ের কাছে সঙ্কোচ! শীঘ্র বল কি ফন্দি এঁটেছ।’

‘তুমি কাউকে বলবে না?’

‘কাকে বলব? শ্বশুর মহাশয়কে? তুমি নিশ্চিন্ত থাক, ও বুড়ার ওপর আমার তিলমাত্র শ্রদ্ধা নেই। তাঁকে ঘুণাক্ষরে কিছু বলব না।’ জাতবর্মা এই বলিয়া একটু থামিলেন, তারপর বলিলেন— ‘কিন্তু একটা কথা আছে।’

‘কি কথা?’

‘তোমার ভ্রাতৃবধূর কথা, যিনি আমার সঙ্গে আছেন। তিনি যদি সন্দেহ করেন আমি তাঁর কাছে কথা গোপন করছি তাহলে যেন-তেন প্রকারেণ কথাটি বার করে নেবেন। তাঁকে প্রতিরোধ করতে পারি এত শক্তি আমার নেই।’

বিগ্রহপাল হাসিলেন— ‘বধূরানীর কাছে গোপন করতে না পার, তাঁকে বোলো। তিনি নিশ্চয় অন্য কাউকে বলবেন না?’

জাতবর্মা গম্ভীর মুখে বলিলেন— ‘বীরশ্রীর ইচ্ছা না থাকলে তার পেট থেকে কথা বার করতে পারে এমন মানুষ আজও জন্মায়নি।’

বিগ্রহ বলিলেন— ‘তা হলেই হল। বেশি জানাজানি হলে সব পণ্ড হয়ে যেতে পারে।’

‘জানাজানি হবে না। তুমি বল।’

বিগ্রহ তখন বলিলেন— ‘ফন্দি আর কিছু নয়, যৌবনশ্রীকে চুরি করে আনব।’

জাতবর্মা কিয়ৎকাল বিস্ময়োৎফুল্ল নেত্রে চাহিয়া রহিলেন— ‘চুরি করে আনবে!’

‘হাঁ। তোমার আপত্তি নেই তো?’

‘আপত্তি! চুরি করা আর হরণ করা একই কথা। ক্ষত্রিয় যদি কন্যা হরণ করে বিবাহ করে তাতে অন্যায় হয় না। বিশেষত বর্তমান ক্ষেত্রে যৌবনশ্রীকে চুরি করবার সম্পূর্ণ অধিকার তোমার আছে। — কিন্তু চুরি করবে কি করে? রাজপুরী থেকে রাজকন্যাকে চুরি করা তো সহজ কাজ নয়।’

‘উপায় এখনও কিছু স্থির হয়নি। ক্ষেত্রে কর্ম বিধীয়তে। তোমার তাহলে অমত নেই?’

‘না, অমত নেই। যৌবনশ্রী যদি আমার শ্যালিকা না হয়ে ভগিনী হত তবু অমত হত না। এবং আমার বিশ্বাস বীরা যদি জানতে পারে তারও অমত হবে না। সে— বাঙালী স্বামী তার খুব পছন্দ।’ বলিয়া জাতবর্মা বিগ্রহপালের পানে অপাঙ্গে হাসিলেন।

অন্য দুইজনও ঘাড় ফিরাইয়া মৃদু মৃদু হাসিতে লাগিলেন। জাতবর্মা জলযোগ সমাপ্ত করিয়া তাম্বূল মুখে দিতে দিতে পরিতৃপ্ত স্বরে বলিলেন— ‘ধন্য।’

এই সময় নৌকার পিছন দিক হইতে কর্ণধারের উচ্চ কণ্ঠস্বর আসিল— ‘ভট্টা, মাছ টোপ গিলেছে। শীঘ্র আসুন।’

অনঙ্গ এক লাফে বাহিরে গেল। বিগ্রহপাল ও জাতবর্মা তাহার পিছনে গেলেন। গলুইয়ে বাঁধা সূতায় টান পড়িয়াছে, জলের তলায় বঁড়শিবিদ্ধ মাছ মুক্তির জন্য প্রাণপণ ছুটাছুটি করিতেছে। অনঙ্গ দ্রুত সূতা নিজের হাতে লইল, তারপর সূতায় অদৃশ্য মাছের প্রবল আকর্ষণ অনুভব করিয়া হাসিমুখে বলিল— ‘বড় মাছ।’

এক দণ্ড খেলাইয়া অনঙ্গ মৎস্যটিকে নৌকায় তুলিল। সিন্দূরবর্ণ প্রকাণ্ড একটি রোহিত মৎস্য। সকলের মুখের হাসি আকর্ণ প্রসারিত হইল।

বিগ্রহ মুগ্ধ চক্ষে মৎস্যটি নিরীক্ষণ করিয়া বলিলেন— ‘অনঙ্গ, এ মাছ আমাদের জন্য নয়, বধূরানী এ মাছ খাবেন। এখনি তেল-সিঁদুর দিয়ে মাছ ও নৌকায় পাঠিয়ে দাও।’

অনঙ্গ বলিল— ‘সাধু! এখনি পাঠিয়ে দিচ্ছি।’

জাতবর্মা দুই একবার না না করিলেন, তারপর বলিলেন— ‘বেশ, কিন্তু একটি শর্ত। এ বেলা আর সময় নেই, কিন্তু রাত্রে তোমরা দু’জন আমার নৌকায় আহার করবে।’

বিগ্রহ বলিলেন— ‘ভাল। কিন্তু বধূরানী যদি নিজের হাতে রাঁধেন তবেই খাব।’

জাতবর্মা বলিলেন— ‘ওকে দিয়েই রাঁধাব। বিয়ের পর ও মাছ রাঁধতে শিখেছে। পিতৃদেবের আজ্ঞা, বধূরা প্রত্যহ স্বামী শ্বশুরের জন্য অন্তত একটি ব্যঞ্জন রাঁধবে।’

রাজমহিষী রাজবধূ নিজ হস্তে রন্ধন করেন ইহাতে বিস্ময়ের কিছু নাই। সেকালে রাজকুলের কন্যাদের চতুঃষষ্টি কলা শিক্ষা করিতে হইত। বিপুল রাজসংসার পরিচালনের ভার তাঁহাদের হাতেই থাকিত। কেবল পালঙ্কে শুইয়া দাসীদের পদসেবা গ্রহণ করিলে তাঁহাদের নিন্দা হইত। কালিদাস লিখিয়া গিয়াছেন— বামা কুলস্যাধয়ঃ। বস্তুত রাজারানী ও রাজবংশীয়গণ প্রাকৃতজনের সঙ্গে যেমন ব্যবহারই করুন নিজেদের মধ্যে সহজ সাধারণ মানুষের মতই আচরণ করিতেন।

অতঃপর বেলা বাড়িতেছে দেখিয়া জাতবর্মা মৎস্য লইয়া নিজ নৌকায় ফিরিয়া গেলেন।

সাত

জাতবর্মা ও বিগ্রহপাল যখন দুই নৌকায় দাঁড়াইয়া উচ্চকণ্ঠে বাক্যালাপ করিতেছিলেন তখন বীরশ্রী অন্তরাল হইতে তাহা শুনিয়াছিলেন। স্বভাবতই তাঁহার মনে কৌতূহল জাগরূক হইয়াছিল। তারপর জাতবর্মা অন্য নৌকায় চলিয়া গেলেন এবং প্রকাণ্ড একটি মাছ লইয়া ফিরিয়া আসিলেন। মাছ দেখিয়া বীরশ্রীর মন আহ্লাদে ভরিয়া উঠিল। তিনি যতদিন পিত্রালয়ে ছিলেন মাছের স্বাদ জানিতেন না। বংগাল দেশে বিবাহের পর মাছের মহিমা বুঝিয়াছেন। মাছ দেখিয়া তিনি নিজেই বলিলেন— ‘কী সুন্দর পাকা রুই। আমি রাঁধব।’

জাতবর্মা বলিলেন— ‘ভাল, তুমিই রাঁধ। আজ ও নৌকার দু’জনকে রাত্রে খেতে বলেছি।’

বীরশ্রী জিজ্ঞাসা করিলেন— ‘ওরা কারা?’

জাতবর্মা অবহেলাভরে বলিলেন— ‘চেনা লোক।’ বলিয়া স্নানের জন্য প্রস্থান করিলেন। বীরশ্রী কিছুক্ষণ চোখ বাঁকাইয়া সেই দিকে তাকাইয়া রহিলেন, তারপর ভৃত্য ডাকিয়া মাছটির আঁশ ছাড়াইয়া কুটিয়া রাখিবার জন্য ডিঙায় পাঠাইয়া দিলেন।

মধ্যাহ্ন ভোজনের পর জাতবর্মা তাড়াতাড়ি পালঙ্কে শুইয়া পড়িলেন। অল্পকাল মধ্যেই তাঁহার মৃদু মৃদু নাক ডাকিতে লাগিল। বীরশ্রী মনে মনে হাসিয়া রইঘরের ছাদে চুল শুকাইতে গেলেন। দ্বিপ্রহরের রৌদ্র একটু কড়া বটে কিন্তু পালের আওতায় বসিলে গায়ে রোদ লাগে না, কেবল মধুর উত্তাপটুকু পাওয়া যায়।

নিঃঝুম মধ্যাহ্নে চারদিক তন্দ্রাচ্ছন্ন। অন্য নৌকাটা আবার পিছাইয়া পড়িয়াছে। পাটলিপুত্র হইতে ওই নৌকা তাঁহাদের পিছু লইয়াছে। উহাতে কে যাইতেছে? জাতবর্মার চেনা লোক, সুতরাং কখনই সামান্য লোক নয়—

বীরশ্রীর মনে পড়িল দুই মাস পূর্বে মৃগয়া হইতে ফিরিয়া জাতবর্মা তাঁহাকে ভাসা-ভাসা ভাবে পর্যটনের কাহিনী শুনাইয়াছিলেন, মৃগয়া যে প্রকৃতপক্ষে মৃগয়া নয়, মগধ আক্রমণের ছল তাহাও বলিয়াছিলেন। বিক্রমশীল বিহার…পিশাচের দৌরাত্ম্য…মহারাজ নয়পাল, যুবরাজ বিগ্রহপাল— সব কথা বীরশ্রী মন দিয়া শোনেন নাই, বুঝিবার চেষ্টাও করেন নাই। বহুদিন পরে স্বামীকে পাইয়া অন্য সব কথা অবান্তর হইয়া গিয়াছিল, পরম প্রাপ্তির মধ্যে কৌতূহলও ডুবিয়া গিয়াছিল।

কিন্তু ওই নৌকায় কাহারা যাইতেছে? জাতবর্মা উহাদের পরিচয় গোপন করিবার চেষ্টা করিতেছেন কেন? নিশ্চয় কোনও রহস্য আছে।

চুল শুকাইলে বীরশ্রী নীচে গেলেন। জাতবর্মা শয্যায় পূর্ববৎ শুইয়া আছেন। তাঁহার শয়নের ভঙ্গি দেখিয়া সন্দেহ হয়— কপট নিদ্রা। বীরশ্রী তাঁহার পায়ের তলায় অতি কোমলভাবে অঙ্গুলি বুলাইয়া দিলেন। জাতবর্মা ধড়মড় করিয়া উঠিয়া বসিলেন। বীরশ্রী মধুর হাসিয়া বলিলেন— ‘পদসেবা করছিলাম। পতির পদসেবা করা সতীর ধর্ম।’

জাতবর্মা গলার মধ্যে একটি শব্দ করিয়া আবার শয়নের উপক্রম করিলেন। বীরশ্রী কিন্তু তাঁহাকে শুইতে দিলেন না, দুই বাহু দিয়া কণ্ঠ জড়াইয়া ধরিয়া খাড়া রাখিলেন। বলিলেন— ‘এবার কিন্তু কানে কাঠি দেব। মট্‌কা মেরে শুয়ে থাকলেই কি আমার হাত এড়াতে পারবে?’

জাতবর্মা যেন ঈষৎ সচেতন হইয়াছেন এমনিভাবে হাই তুলিবার চেষ্টা করিয়া বলিলেন— ‘কি হয়েছে?’

বীরশ্রী বলিলেন— ‘হয়নি কিছু। ওরা কারা? সত্যি কথা বল, সহধর্মিণীর কাছে মিথ্যে কথা বলতে নেই।’

জাতবর্মা অবাক হইয়া বলিলেন— ‘ওরা? কাদের কথা বলছ?’

‘আহা, কিছুই যেন জানেন না! ওই নৌকার ওরা।’

‘ও— ওদের কথা বলছে! বলেছি তো ওরা চেনা লোক।’

‘চেনা লোক তা বুঝেছি। কিন্তু তোমার সঙ্গে পরিচয় হল কি করে? কোথায় পরিচয় হল?’

‘এঁ— বিক্রমশীল বিহারে দেখা হয়েছিল।’

‘বিক্রমশীল বিহারে তো ভিক্ষুরা থাকে। এরা কি ভিক্ষু?’

‘না। এরা— মানে— বণিক, শ্রেষ্ঠী। স্বয়ংবর উপলক্ষে ত্রিপুরীতে বাণিজ্য করতে যাচ্ছে।’

‘নাম কী?’

‘নাম? নামটা ঠিক মনে পড়ছে না—’ জাতবর্মা মাথা চুলকাইতে লাগিলেন।

‘এত চেনা-শোনা, আর নাম মনে পড়ছে না!’

‘হাঁ হাঁ, বিক্রমপাল।’

বীরশ্রী বিশ্বাস করিলেন না। জাতবর্মার ভাবভঙ্গি হইতে স্পষ্টই বোঝা যায় তিনি সত্য গোপন করিতেছেন। বীরশ্রী তখন বৃথা তর্ক ত্যাগ করিয়া জাতবর্মাকে শয্যার উপর চিৎ করিয়া ফেলিলেন এবং নানা প্রকার উৎপীড়ন আরম্ভ করিলেন। ঘটয় ভুজ বন্ধনম্‌ জনয় রদ খণ্ডনম্‌— কবি জয়দেব এই জাতীয় উৎপীড়নের বিশদ বর্ণনা দিয়া গিয়াছেন। যুগযুগ ধরিয়া প্রেমবতী যুবতীরা পতিদেবতাদের এইভাবে নির্যাতন করিয়া আসিতেছেন, কিন্তু কেহ কিছু বলে না। জাতবর্মা বেশিক্ষণ এই নির্যাতন প্রতিরোধ করিতে পারিলেন না।

‘আচ্ছা— বলছি।’

‘বল— শীঘ্র বল। নইলে—’

‘বলছি— বলছি।’

অতঃপর শান্তি স্থাপিত হইল, দুইজনে পাশাপাশি শয়ন করিলেন; জাতবর্মা সত্য কথা বলিতে আরম্ভ করিলেন। লক্ষ্মীকর্ণের মগধ-অভিযান হইতে আজ প্রাতঃকালের ঘটনা পর্যন্ত সমস্তই প্রকাশ পাইল। শুনিয়া বীরশ্রী শয্যায় উঠিয়া বসিয়া বিস্ময়াহত নেত্রে স্বামীর মুখের পানে চাহিয়া রহিলেন।

‘বাবা এই কাণ্ড করেছেন?’

‘করেছেন। এখন বল, এ প্রস্তাবে তোমার অমত আছে?’

বীরশ্রীর মন সম্পূর্ণরূপে যৌবনশ্রীর হরণ প্রস্তাবে সায় দিয়াছিল। কিন্তু যুবতীরা কোনও কালেই এক কথায় কোনও প্রস্তাবে সম্মত হন না। বীরশ্রী স্রস্ত চুলগুলিকে জড়াইয়া কুণ্ডলী পাকাইতে পাকাইতে গূঢ় হাসিলেন। বলিলেন— ‘আগে মানুষটিকে দেখি।’

অনন্তর বেলা পড়িয়া আসিতেছে দেখিয়া বীরশ্রী কোমরে আঁচল জড়াইয়া মৎস্য রন্ধনের জন্য প্রস্তুত হইতে লাগিলেন।

নদীর মাঝখানে মকরপৃষ্ঠের মত একটি লম্বা বালুচর জাগিয়া উঠিয়াছে। সূর্যাস্ত হইলে জাতবর্মা এই চরের পাশে নৌকা ভিড়াইলেন। বিগ্রহপালের নৌকা এক রশি পিছনে পাল নামাইল। আজ রাত্রিটা এই বালুচরের পাশেই কাটানো হইবে। তীরের চেয়ে নদীর মধ্যস্থিত চর অধিক নিরাপদ। রাজহংস জাতীয় জলচর পাখিরাও রাত্রে নদীতীরে বাস করে না, এইরূপ চারে আসিয়া রাত্রিযাপন করে।

নৌকা বাঁধা হইলে বিগ্রহপাল অনঙ্গকে বলিলেন— ‘আয়, বালির ওপর একটু বেড়াই। মনে হচ্ছে কতদিন মাটিতে পা দিইনি।’

অনঙ্গ বলিল— ‘তোকে তো ও নৌকায় নেমন্তন্ন খেতে হবে।’

বিগ্রহ বলিলেন— ‘তার এখনও দেরি আছে। রাত্রি হোক, তারপর যাব। তুইও তো যাবি।’

অনঙ্গ মাথা নাড়িয়া হাসিল— ‘না, আমি যাব না, তুই এক যা। আমি গেলে রসভঙ্গ হবে। বলে দিস্‌, আমার কান কট্‌কট্‌ করছে।’

বিগ্রহপাল বুঝিলেন, অনঙ্গের কথা যথার্থ। যেখানে দুই পক্ষে ঘনিষ্ঠতার আগ্রহ সেখানে তৃতীয় পক্ষের উপস্থিতি বরবধূর মিলন-মন্দিরে ননদিনীর মত, বাধারই সৃষ্টি করে। বিগ্রহ জোর করিলেন না।

নৌকা হইতে বালুচরের কিনারা পর্যন্ত পাটাতন ফেলিয়া সেতু রচিত হইল, বিগ্রহপাল অবতরণ করিলেন। বালুর উপরিভাগ শুষ্ক, স্থানে স্থানে কাশের অঙ্কুর গজাইয়াছে। অসমতল বালুর খাঁজে নদীর জল ধরা পড়িয়াছে; স্বচ্ছ অগভীর জলে ছোট ছোট শফরী খেলা করিতেছে।

বিগ্রহপাল সামনের নৌকার দিকে না গিয়া পিছন দিক দিয়া দ্বীপ পরিক্রমা আরম্ভ করিলেন। কয়েকটি ময়ূরকণ্ঠী রঙের ছোট হাঁস জলের ধারে রাত্রিবাসের উদ্যোগ করিতেছিল, তাহারা উড়িয়া গিয়া দ্বীপের অপর অংশে বসিল। একটি হ্রস্বপুচ্ছ দীর্ঘজঙ্ঘ সারস মানুষের অভ্যাগমে বিরক্ত হইয়া অন্য দ্বীপের সন্ধানে উড়িয়া গেল।

জলের ধারে ধারে পরিক্রমণ সম্পূর্ণ করিয়া বিগ্রহপাল যখন জাতবর্মার নৌকার সন্নিকটে উপস্থিত হইলেন তখন চাঁদের আলো ফুটিয়াছে। জাতবর্মা নিজ নৌকা হইতে নামিয়া বালুর উপর দাঁড়াইয়া আছেন। বলিলেন— ‘এস ভাই, তোমার জন্যেই অপেক্ষা করছি! অনঙ্গ কোথায়?’

বিগ্রহ বলিলেন— ‘সে এল না। দাঁত কন্‌কন্‌ করছে।’

অনঙ্গ সম্বন্ধে আর কথা হইল না। দুইজনে নৌকায় উঠিলেন।

রইঘর বহু দ্বীপের আলোকে উজ্জ্বল। জাতবর্মা প্রবেশ করিয়া বলিলেন— ‘বীরা, এই নাও তোমার দেবর— আমার ভাই বিগ্রহ।’

বীরশ্রী দেখিলেন, বিগ্রহপাল ননীর পুতুল নয়, লৌহ ভীমও নয়; কমকান্তি নবীন যুবা। মুখ হইতে কৈশোরের সৌকুমার্য সম্পূর্ণ মুছিয়া যায় নাই। চরিত্রে গাম্ভীর্যের হয়তো একটু অভাব আছে, কিন্তু অসংযত লঘুতাও নাই। চোখের দৃষ্টি তীরের মত ঋজু, অধরোষ্ঠ কৌতুকের পুষ্পধনু। বীরশ্রী তৃপ্তির নিশ্বাস ফেলিয়া মনে মনে যৌবনশ্রীকে বিগ্রহপালের পাশে দাঁড় করাইলেন। দিব্য মানাইবে।

বিগ্রহপাল দেখিলেন, বীরশ্রী যেন মূর্তিমতী লক্ষ্মী। পরিধানে রত্নদ্যুতিখচিত পট্টাম্বর, কণ্ঠে কর্ণে কটিতে মণিময় অলঙ্কার, মণিবন্ধে শশিকলার ন্যায় শঙ্খবলয়, সীমান্তে সিন্দূর, মাথায় অবগুণ্ঠন সীমান্ত পর্যন্ত আসিয়া থামিয়া গিয়াছে। বিগ্রহ মনে মনে ভাবিলেন, যৌবনশ্রী যদি দিদির মত দেখিতে হন—

তিনি দ্রুত গিয়া বীরশ্রীর পায়ের কাছে নত হইয়া প্রণাম করিলেন, কৃতাঞ্জলিপুটে বলিলেন— ‘দেবি, আমি আপনার শরণ নিলাম।’

বীরশ্রী অঙ্গুলি দ্বারা তাঁহার মস্তক স্পর্শ করিয়া কৌতুক-তরল কণ্ঠে বলিলেন— ‘বিজয়ী হও— তোমার অভীষ্ট পূর্ণ হোক।’

জাতবর্মা মহানন্দে হাসিয়া উঠিলেন।

তারপর হাস্য পরিহাস পান আহার চলিল। বীরশ্রী বিগ্রহপালের সঙ্গে এমন ব্যবহার করিলেন যেন বিগ্রহ তাঁর অল্পবয়স্ক দেবর, একটু দুষ্ট অকালপক্ক দেবর। বিগ্রহপলও বীরশ্রীর জ্যেষ্ঠত্ব স্বীকার করিয়া লইয়া ছেলেমানুষ হইয়া রহিলেন। বীরশ্রী যে সর্বান্তঃকরণে তাঁহাকে গ্রহণ করিয়াছেন তাহাতে সন্দেহ রহিল না।

স্বয়ংবর ও যৌবনশ্রী সম্বন্ধে কোনও কথা হইল না। বিগ্রহপাল বুঝিলেন, ও প্রসঙ্গ স্থগিত রহিল মাত্র, পরে উত্থাপিত হইবে।

অবশেষে চন্দ্র অস্ত যায় দেখিয়া বিগ্রহপাল পূর্ণ তৃপ্ত হৃদয়ে নিজ নৌকায় ফিরিয়া গেলেন।

অনঙ্গ জাগিয়া ছিল। বিগ্রহপাল শয়ন করিলে জিজ্ঞাসা করিল— ‘দেবী বীরশ্রীকে কেমন দেখলি?’

বিগ্রহ গাঢ়স্বরে বলিলেন— ‘রূপে লক্ষ্মী গুণে সরস্বতী। এমন মহিমময়ী নারী আর দেখিনি।’

অনঙ্গ বলিল— ‘বাপের মত নয়?’

বিগ্রহ হাসিয়া উঠিলেন— ‘দূর! একেবারে বিপরীত।’

‘ভাল। ভরসা করা যেতে পারে, দেবী যৌবনশ্রী জ্যেষ্ঠা ভগিনীর মত হবেন, বাপের মত হবেন না। এবার তুই নিশ্চিন্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়।’

বিগ্রহপালের কিন্তু তৎক্ষণাৎ ঘুম আসিল না। তিনি অনঙ্গকে আজিকার রাত্রির সমস্ত ঘটনা, সমস্ত বাক্যালাপ পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে শুনাইলেন। শুনিয়া অনঙ্গ বলিল— ‘লক্ষণ তো ভালই ঠেকছে। ওঁরা যদি সাহায্য করেন কার্যোদ্ধার করা শক্ত হবে না। তবে যদি দেবী যৌবনশ্রী তোকে অপছন্দ করেন—’

বিগ্রহপাল অন্ধকারে হাসিলেন। ও আশঙ্কা তাঁহার ছিল না।

আট

অতঃপর সপ্তাহকাল একটি দীর্ঘ সোনালি সুখস্বপ্নের মত কাটিয়া যায়। আকাশে চন্দ্র দিনে দিনে পূর্ণ হইয়া ওঠে, শোণ নদ অলক্ষিতে শীর্ণ হইতে থাকে। দুইটি নৌকা যেন অদৃশ্য বন্ধনে শৃঙ্খলিত হইয়া একসঙ্গে চলিয়াছে। যখন অনুকূল বাতাস থাকে না তখন দাঁড় চলে, কিম্বা নাবিকেরা তীরে নামিয়া গুণ টানে। তীরে দূরান্তরিত গ্রাম, গ্রামের আশেপাশে মাষকলায় ও চণকের ক্ষেত। নৌকার যাত্রীরা কখনও তীরে নামিয়া ক্ষেত হইতে কাঁচা মাষকলায় ও চণকের শিম্বী আহরণ করিয়া ভক্ষণ করেন, কখনও গ্রামে গিয়া দুগ্ধ ও নবনীত সংগ্রহ করেন, শাক ফল মূল সংগ্রহ করেন।

নৌকা চলিতে থাকে। মগধের সীমানা শেষ হইয়া যায়, পাষাণদুর্গ রোহিতাশ্বগড় পিছনে পড়িয়া থাকে, তীরভূমি উপল-বন্ধুর হইয়া ওঠে। জাতবর্মা নিজ নৌকায় রাজকীয় লাঞ্ছন উড়াইয়া দেন। বিগ্রহপালের নৌকা কেতনহীন থাকে।

বিগ্রহ প্রত্যহ অন্য নৌকায় যান। কত খেলা হয়; পাশা খেলা, গুটি খেলা, দশ-পাঁচিশ খেলা। কত জল্পনা হয়। বিগ্রহ বীরশ্রীর সহিত খুনসুড়ি করেন। — বলেন— দেবি, নিশ্চয় আপনি শ্বশুরবাড়ির দেশ থেকে কৈ-ডিম্ব নিয়ে যাচ্ছেন, নইলে আপনার রান্না এমন মিষ্ট হয় কি করে? বীরশ্রী কপট ক্রোধে শাসন করেন— দাঁড়াও না, বাপের বাড়ি গিয়ে তোমাদের সব ষড়যন্ত্র ফাঁস করে দেব। যৌবনশ্রীর কানে এমন মন্ত্র দেব সে তোমার পানে ফিরেও চাইবে না।

পরামর্শ সব ঠিক হইয়া গিয়াছে। বীরশ্রী গিয়া যৌবনশ্রীকে রাজী করাইবেন, তারপর স্বয়ংবরের পূর্বেই একদিন বিগ্রহপাল তাঁহাকে চুরি করিয়া লইয়া পলায়ন করিবেন, একেবারে নৌকায় তুলিয়া পাটলিপুত্র লইয়া যাইবেন। ঘরের ইঁদুর যদি বেড়া কাটে, কে কি করিতে পারে? লক্ষ্মীকর্ণ যখন জানিতে পরিবেন তখন আর উপায় থাকিবে না। তখন তাঁহাকে বুঝাইয়া শান্ত করা সহজ হইবে।

যড়যন্ত্রকারীদের মনে আনন্দ আর উত্তেজনা। আহার বিহার ক্রীড়া কৌতুকে দিন কাটিয়া যায়। অনঙ্গ মাছ ধরে, গান গায়। জাতবর্মা বাঁশি বাজান। দুই দিশারুর মধ্যে ভাব হইয়াছে। জাতবর্মার দিশারুর নাম জটায়ু নয়, শুভঙ্কর। রাত্রে নৌকা বাঁধা হইলে তাহারা বালুতে নামিয়া পাশাপাশি বসে, মৃদুস্বরে জল্পনা করে— তুমি কয়বার সমুদ্রে গিয়াছ? আমি কান্যকুজ্বে গিয়াছি। সুবর্ণভূমি দেখিয়াছ? আমি সিংহল গিয়াছি। — সিংহলের মেয়েরা বড় কুৎসিত— কিন্তু—

অবশেষে অষ্টম দিনের পূর্বাহ্ণে দূরে শোণ নদের শেষ ঘাট দেখা গেল। শোণ নদ এইখানে পাহাড় হইতে নামিয়া অপেক্ষাকৃত সমতল ক্ষেত্রে বহিতে আরম্ভ করিয়াছে। ইহার আগে আর নৌকা চলে না। ঘাটটি নদীর পশ্চিম তীরে।