গল্প
উপন্যাস
পরিশিষ্ট

তুমি সন্ধ্যার মেঘ – ১

প্রথম পরিচ্ছেদ – এক

শকাব্দের দশম শতকে ভারতের ভাগ্যাকাশে সূর্যাস্ত হইতেছিল। নয়শত বর্ষব্যাপী মহারাত্রি আসন্ন, পশ্চিম দিক্‌প্রান্তে রাক্ষসী বেলার রুধিরোৎসব আরম্ভ হইয়াছে।

দীর্ঘকাল ভারতের সংকট-সীমান্তে উল্লেখযোগ্য বহিরুৎপাত কিছু হয় নাই। পাঁচশত বৎসর পূর্বে হূণেরা আসিয়াছিল বটে, কিন্তু তাহারা নিশ্চিহ্ন হইয়া জনসমুদ্রে মিশিয়া গিয়াছে; ভারতের সংস্কৃতি তাহাদের স্বতন্ত্র সত্তাকে জঠরস্থ করিয়া জীর্ণ করিয়া ফেলিয়াছে। তারপর আর কেহ আসে নাই। আর কেহ আসিতে পারে এ চিন্তাও মানুষের মন হইতে মুছিয়া গিয়াছিল। ভারতের অগণিত রাজন্যবর্গ পরস্পর যুদ্ধবিগ্রহ করিয়া, অবস্থা বিশেষে মৈত্রী মিতালি করিয়া মনের আনন্দে কাল কাটাইতেছিলেন। প্রজারাও মোটের উপর মনের সুখে ছিল। তাহাদের জীবনধারা অভ্যস্ত পরিচিত খাতে প্রবাহিত হইতেছিল।

৮৯৯ শকাব্দে সবক্তগীণ আসিয়া লাহোর পর্যন্ত রাজ্য বিস্তার করিলেন। ৯২০ শকাব্দে আসিলেন মামুদ গজনী। ৯৪৬ হইতে ৯৪৮ শকাব্দের মধ্যে সোমনাথের মন্দির লুণ্ঠিত হইল। ১১১৫ শকাব্দে মহম্মদ ঘোরী দিল্লী অধিকার করিলেন। মহারাত্রির অন্ধকার ঘনাইয়া আসিল।

ইহা ভারতের পশ্চিম প্রান্তের কথা। ভারতের পূর্বভাগে তখনও একটু আলো ছিল। ক্ষীণ চন্দ্রের আবছায়া আলো। সে আলোতে দূর পর্যন্ত দেখা যায় না, নিজের আঙিনাটুকু মাত্র দেখা যায়। আঙিনায় ফুল ফুটিয়াছিল, লবঙ্গলতার পরিশীলনে কোমল মলয়ানিল বহিতেছিল। মানুষ নিশ্চিন্ত মনে প্রেম করিতেছিল, গান গাহিতেছিল, শিল্প রচনা করিতেছিল। রাজারাও নিজেদের অভ্যস্ত খেলা খেলিতেছিলেন; যুদ্ধবিগ্রহ, মৈত্রী মিতালি, রাজনৈতিক কূট-ক্রীড়া চলিতেছিল। কিন্তু আসন্ন দুর্যোগের অগ্রবর্তী ছায়া তাঁহাদের মুখের উপর পড়ে নাই। পশ্চিম ভারতে বিজাতীয় শত্রু প্রবেশ করিয়াছে এ সংবাদ যে তাঁহারা একেবারেই জানিতেন না তাহা নয়। তাঁহারা ঘরের ব্যবস্থা লইয়াই ব্যস্ত ছিলেন, বাহিরের দিকে দৃক্‌পাত করিবার অবসর তাঁহাদের ছিল না।

পূর্ব ভারতের কেবল একটি মানুষ পশ্চিম প্রান্তে দুর্মদ আততায়ীর আবির্ভাব শঙ্কিত চক্ষে নিরীক্ষণ করিতেছিলেন এবং ভবিষ্যতের কথা ভাবিয়া উদ্বিগ্ন হইয়া উঠিয়াছিলেন। এই মানুষটির নাম অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান।

দুই

দীপঙ্কর বাঙ্গালী ছিলেন। বঙ্গাল দেশের বিক্রমণিপুর মণ্ডলে বজ্রযোগিনী গ্রামে তাঁহার জন্ম; জাতনাম চন্দ্রগর্ভ। অলৌকিক প্রতিভার বলে তিনি জ্ঞান ও পাণ্ডিত্যের শিখরে উঠিয়াছিলেন। তাঁহার তুল্য অশেষবিৎ জ্ঞানী তৎকালীন ভারতে কেহ ছিল না। ভারতের বাহিরেও ছিল না। সুদূর চীন ও তিব্বত হইতে জ্ঞানভিক্ষুরা আসিতেন তাঁহার পদপ্রান্তে বসিয়া জ্ঞানভিক্ষা লইতে। তারপর দেশে ফিরিয়া গিয়া দিকে দিকে তাঁহার জয়গান করিতেন। তাঁহার লৌকিক নাম কালক্রমে লুপ্ত হইয়া গিয়াছিল, তিনি অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান এই উপাধিতে প্রথিত হইয়াছিলেন। সংক্ষেপে দীপঙ্কর। জ্ঞান-জ্যোতির আধার।

কিন্তু কেবলমাত্র জ্ঞানের সাধনাতেই দীপঙ্করের সমস্ত প্রতিভা নিঃশেষিত হয় নাই। কর্মশক্তিতেও তিনি অসামান্য ছিলেন। তাঁহার কর্মকাহিনীর স্মৃতি বহু প্রাচীন গ্রন্থে বিধৃত আছে। ষাট বছর বয়সে তিনি হিমদুর্গম পথে তিব্বত যাত্রা করিয়াছিলেন।

যে সময় এই আখ্যায়িকার আরম্ভ সে সময় দীপঙ্কর ছিলেন বিক্রমশীল বিহারের মহাচার্য। বিক্রমশীল বিহারের প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন পাল রাজবংশের মুকুটমণি পরমসৌগত মহারাজ ধর্মপালদেব। তারপর দুই শতাব্দী কাটিয়া গিয়াছে। পাল রাজবংশ বহু উত্থান পতনের ভিতর দিয়া শিলাসংকুল পথে আপন অদৃষ্টলিপি খোদিত করিতে করিতে চলিয়াছে। ধর্মপালের অধস্তন অষ্টমপুরুষ নয়পালদেব এখন পাটলিপুত্রের সিংহাসনে আসীন। নয়পালের পিতা মহীপালদেব পরাক্রান্ত পুরুষ ছিলেন, তিনি অনধিকৃত-বিলুপ্ত পিতৃরাজ্য পুনরুদ্ধার করিয়াছিলেন। কিন্তু মহীপালের মৃত্যুর পর পালরাজ্য আবার সঙ্কুচিত হইয়া মগধের সীমানার মধ্যে গণ্ডীবদ্ধ হইয়াছে। পূর্বদিকে বঙ্গালদেশে স্বাধীন রাজারা মাথা তুলিয়াছেন। পশ্চিম ও দক্ষিণেও তাই। ভারতের পূর্বার্ধে সার্বভৌম নরপতি কেহ নাই।

মহীপালদেব দীপঙ্করকে বিক্রমশীলার মহাচার্যের আসনে বসাইয়াছিলেন। তারপর অষ্টাদশ বর্ষ অতীত হইয়াছে। দীপঙ্কর সগৌরবে উক্ত আসন অলঙ্কৃত করিতেছেন।

বিক্রমশীল বিহার মগধের অঙ্গদেশে গঙ্গার তীরে অবস্থিত। উচ্চ শিলাপট্টের উপর প্রাচীর-বেষ্টিত বিস্তীর্ণ বিহারভূমি; মধ্যস্থলে চৈত্য ঘিরিয়া বিশাল উপাসনাগৃহ। উপাসনাগৃহকে আবেষ্টন করিয়া ছয় দিকে ছয়টি দেবায়তন। সর্বশেষে সীমা-প্রাচীরের সমান্তরালে অষ্টোত্তরশত মন্দিরের শ্রেণী। একশত চৌদ্দজন আচার্য আছেন, তাঁহারা অগণিত বিদ্যার্থীদের বিভিন্ন শাস্ত্রে শিক্ষা দিয়া থাকেন। কেবল বৌদ্ধ ধর্মশাস্ত্রই নয়, বেদ ব্যাকরণ শব্দবিদ্যা চিকিৎসাবিদ্যা যোগশাস্ত্র জ্যোতিষ সঙ্গীত, সকল বিদ্যারই পঠন-পাঠন হয়। সকলের উপরে আছেন সর্ববিদ্যার আধার মহাচার্য দীপঙ্কর। মহারাত্রির সায়াহ্নে নালন্দার গৌরব গরিমা ভস্মাচ্ছাদিত হইয়াছে, কিন্তু বিক্রমশীল মহাবিহারের জ্ঞান-দীপ এখনও ভাস্বর শিখায় জ্বলিতেছে।

তিন

আজ হইতে নয় শতাব্দী পূর্বের একটি শারদ অপরাহ্ণ। বিক্রমশীল বিহারের পাষাণ-তট-লেহী গঙ্গার জল স্বচ্ছ হইয়াছে। গাঢ় নীল আকাশে একটি দুটি লঘু মেঘ ভাসিতেছে। গঙ্গার বুকে যেন ওই মেঘেরই প্রতিচ্ছবির ন্যায় একটি পাল-তোলা নৌকা। অস্তমান সূর্য পশ্চিম দিগন্তে স্বর্ণরেণুর প্রলেপ দিতেছে। চারিদিক শান্ত উজ্জ্বল ও পরিচ্ছন্ন।

বিহারভূমির মধ্যেও প্রসন্ন শান্তি বিরাজ করিতেছে। বিদ্যায়তনগুলি শূন্য, বিদ্যার্থীরা বিদ্যাভ্যাস শেষ করিয়া চলিয়া গিয়াছে। যাহারা বিহারে বাস করে তাহারা নিজ নিজ প্রকোষ্ঠে অন্তর্হিত হইয়াছে। বিদ্যায়তন ও সীমান্ত-প্রাচীরের মধ্যবর্তী শষ্পাকীর্ণ মাঠে চৈত্যচূড়ার ছায়া দীর্ঘতর হইতেছে। মাঠে ইতস্তত অশোক কদম্ব বকুল প্রভৃতি বৃক্ষ। একটি বকুল বৃক্ষের ছায়ায় বসিয়া তিনজন আচার্য বিশ্রম্ভালাপ করিতেছেন। এতদ্ভিন্ন বাহিরে আর কাহাকেও দেখা যায় না। বিহারের অসংখ্য অধিবাসী এই সময়টিতে যেন বল্মীকের ন্যায় বিবরপ্রবিষ্ট হইয়াছে।

চৈত্যচূড়ার চারিপাশে চতুষ্কোণ ছাদ, উপাসনাগৃহের স্তম্ভগুলি এই ছাদকে ধরিয়া রহিয়াছে। সঙ্কীর্ণ সোপানশ্রেণী বাহিয়া ছাদে উঠিতে হয়; কিন্তু উপরে উঠিয়া আর সঙ্কীর্ণতা নাই, স্তম্ভের স্থূল চূড়া ঘিরিয়া প্রশস্ত ছাদ অঙ্গনের মত চতুর্দিকে ছড়াইয়া পড়িয়াছে। এই ছাদের এক কোণে একটি দারুনির্মিত প্রকোষ্ঠ; অবশিষ্ট স্থান অসংখ্য মৃৎকুণ্ডে পূর্ণ। প্রত্যেকটি কুণ্ডে একটি করিয়া শিশুবৃক্ষ বা লতা; চম্পা মল্লিকা জাতী কুরুবক শেফালী; পারস্য দেশের দ্রাক্ষালতা, মহাচীনের চারুকেশর, তিব্বতের সূচীপর্ণ। মহাচার্য দীপঙ্কর এই দারু-প্রকোষ্ঠে বাস করেন এবং অবসরকালে শিশুবৃক্ষগুলিকে সন্তানস্নেহে লালন করেন।

আজ সায়াহ্নে তিনি ছাদের উপর একাকী পদচারণ করিতে করিতে চিন্তা করিতেছিলেন। শাস্ত্রচিন্তা নয়, ধর্মচিন্তা নয়, নিতান্তই ঐহিক ভাবনা তাঁহাকে উন্মনা করিয়া তুলিয়াছিল। থাকিয়া থাকিয়া তিনি ঊর্ধ্ব আকাশের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করিতেছিলেন। কার্পাসের মত শুভ্র একখণ্ড মেঘ ধীরে ধীরে মধ্যাকাশ হইতে পশ্চিম দিকে যাইতেছে। প্রথমে মেঘের প্রান্তে রক্তিমার স্পর্শ লাগিল, তারপর মেঘ পশ্চিম আকাশের লাবণ্য শোষণ করিয়া লইয়া সিন্দূরবর্ণ ধারণ করিল। দীপঙ্কর দেখিতেছেন, কিন্তু তাঁহার মনে বহিঃপ্রকৃতির প্রতিবিম্ব পড়িতেছে না।

ষাট বৎসর বয়সে দীপঙ্করের মুখে জরার চিহ্নমাত্র নাই। মুখের গঠন দৃঢ়; মস্তক ও শ্মশ্রুগুম্ফ মুণ্ডিত না হইলে যোদ্ধার মুখ বলিয়া ভ্রম হইতে পারিত। চক্ষু উজ্জ্বল অথচ শান্ত। দেহের আয়তন অপেক্ষাকৃত হ্রস্ব বলা চলে, কিন্তু স্কন্ধ বাহু ও বক্ষ দৃঢ় পেশীবদ্ধ। পরিধানে পীতবর্ণ সংঘাটি স্কন্ধ হইতে জানু পর্যন্ত আবৃত করিয়া রাখিয়াছে এবং দেহের মুক্ত অংশে চম্পকতুল্য বর্ণাভা সঞ্চারিত করিয়াছে। দীপঙ্করকে একবার দেখিলে তাঁহার পৌরুষই সর্বাগ্রে চোখে পড়ে, তাঁহাকে মহাতেজস্বী কর্মবীর বলিয়া মনে হয়। তিনি যে সকল বিদ্যার পারঙ্গম দিগ্বিজয়ী জ্ঞানবীর তাহা অনুমান করা যায় না।

ছাদে পরিক্রমণ করিতে করিতে দীপঙ্কর চিন্তা করিতেছিলেন— লোকজ্যেষ্ঠ বলিয়াছেন হিংসায় হিংসার ক্ষয় হয় না, বৃদ্ধি হয়…সত্য কথা…কিন্তু হিংসা ও আপৎ নিবারণ এক বস্তু নয়, রাগদ্বেষ অনুভব না করিয়া বিগতজ্বর হইয়া যুদ্ধ করা যায়। কিন্তু যুদ্ধ করিবে কে? রাজার ইচ্ছায় যুদ্ধ। ভারতবর্ষের শতাধিক রাজা নিজ নিজ ক্ষুদ্র স্বার্থ রক্ষা করিতে ব্যস্ত। যে-সব রাজারা যুদ্ধ করিতে ভালবাসে তাহারাও বহিরাগত বর্বর আততায়ীর কথা ভাবে না, নিজের প্রতিবেশী রাজার গলা কাটিতে পারিলেই সন্তুষ্ট। চাণক্যনীতি! এই চাণক্যনীতি দেশের সর্বনাশ করিয়াছে। …মহীপালদেব ছিলেন দূরদর্শী রাজা; তিনি বুঝিয়াছিলেন এই বিধর্মী দুর্বৃত্তগুলাকে সময়ে নিবৃত্ত করিতে না পারিলে তাহারা সমস্ত দেশ ছাইয়া ফেলিবে, আর্যাবর্তের অপৌরুষেয় সংস্কৃতি শোণিতপঙ্কে নিমজ্জিত হইবে। মহীপাল তুরস্কদের দূর করিবার জন্য প্রস্তুত হইতেছিলেন। কিন্তু দেশের দুরদৃষ্ট, তিনি বাঁচিলেন না। এখন কে দেশ রক্ষা করিবে? নয়পাল মহীপালের পুত্র হইলেও পিতার ন্যায় ভবিষ্যচিন্তক নয়, যুদ্ধবিগ্রহেও রুচি নাই। অন্য যাহারা আছে তাহারা শৌর্যবীর্যে রণকৌশলে তুরস্কদের সমকক্ষ নয়। তুরস্কগণ নিষ্ঠুর যোদ্ধা, তাহার উপর ঘোর বিশ্বাসঘাতক। তাহাদের ধর্মজ্ঞান নাই; যুদ্ধে তাহাদের কে পরাস্ত করিবে? সমস্ত আর্য রাজাগণ একত্র হইলে পরাস্ত করিতে পারে। কিন্তু আর্য রাজারা কখনও একত্র হইবে না, তাহারা একে একে মরিবে তবু একত্র হইবে না। আজ যদি একজন একচ্ছত্র চক্রবর্তী সম্রাট থাকিত! অশোকের মত— হর্ষবর্ধনের মত— ধর্মপাল দেবপালের মত! কিন্তু সে দিন আর নাই। একটি সিংহের পরিবর্তে ভারতবর্ষ জুড়িয়া এক পাল ফেরু!…তুরস্করা অস্ত্রশস্ত্রেও ভারতবাসী অপেক্ষা উন্নত; তাহাদের অসিতে ধার বেশি, ভল্ল অধিক তীক্ষ্ণ। …হায়, যদি রামায়ণ মহাভারতের অলৌকিক অস্ত্রের ন্যায় শতঘ্ন সহস্রঘ্ন বাণ থাকিত—! সেকালে অগ্নিবাণ বরুণবাণ কি সত্যই ছিল? না কবিকল্পনা? হয়তো কিছু সত্য ছিল, কবিকল্পনারও অবলম্বন চাই। …যদি ঐরূপ অলৌকিক অস্ত্র বর্তমানে থাকিত দুর্ধর্ষ ম্লেচ্ছগুলাকে হিমালয়ের পরপারে তাড়াইয়া দেওয়া যাইত, রাজাদের সংঘবদ্ধ হইবার প্রয়োজন হইত না…

দীপঙ্করের চিন্তা কোনও দিকে নিষ্ক্রমণের পথ না পাইয়া নিষ্ফল কল্পনা বিলাসের চক্রপথ ধরিয়াছে এমন সময় সোপান বাহিয়া আর এক ব্যক্তি ছাদে উপস্থিত হইলেন। ইনি বিক্রমশীল বিহারের মহাধ্যক্ষ রত্নাকর শান্তি। বয়সে দীপঙ্কর অপেক্ষা কিছু বড়, জ্যেষ্ঠের অধিকারে দীপঙ্করকে নাম ধরিয়া ডাকেন; কিন্তু সকল সময় গুরুর ন্যায় মান্য করেন। শরীর কিছু স্থূল, জরার প্রকোপে চর্ম লোল হইয়াছে; মুখে বিপুল দায়িত্ব বহনের কিণচিহ্ন। বিক্রমশীল বিহারের সহস্র কর্মভারে অবনত এই বৃদ্ধের তুলনায় দীপঙ্করকে তরুণ বলিয়া মনে হয়।

রত্নাকরের কটিলম্বিত কুঞ্চিকাগুচ্ছের ঝুম ঝুম শব্দে দীপঙ্কর পরিক্রমণ স্থগিত করিয়া দাঁড়াইলেন। রত্নাকর তাঁহার কাছে আসিলেন, কয়েকবার দীর্ঘশ্বাস টানিয়া বলিলেন— ‘আজকাল সিঁড়ি উঠতে হাঁফ ধরে।’

দীপঙ্কর উদ্বিগ্নচক্ষে রত্নাকরকে নিরীক্ষণ করিলেন, তারপর কটিবদ্ধ কুঞ্চিকাগুচ্ছের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়া স্মিতমুখে বলিলেন— ‘ওই প্রকাণ্ড চাবির গোছা নিয়ে ছাদে উঠতে কার না হাঁফ ধরে? সম্প্রতি চাবির গোছা কি আরও বেড়েছে?— কিন্তু তুমি এলে কেন। ডেকে পাঠালেই তো আমি তোমার কাছে যেতাম।’

রত্নাকর হাত নাড়িয়া যেন ও প্রসঙ্গ সরাইয়া দিলেন, বলিলেন— ‘চন্দ্রগর্ভ, তিব্বতীরা আট দিন হল এসেছে, তাদের আর ঠেকিয়ে রাখা যাচ্ছে না। তোমার সঙ্গে দেখা করতে চায়।’

দীপঙ্কর ঈষৎ ভ্রূকুটি করিয়া আকাশের দিকে চাহিলেন। তিব্বতীরা আসিয়াছে তিনি জানিতেন, কেন আসিয়াছে তাহাও অনুমান করিয়াছিলেন, তাই তাহাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করিতে বিলম্ব করিতেছিলেন। এখন বলিলেন— ‘ওরা আবার এসেছে কেন? গতবারে আমাকে তিব্বতে নিয়ে যেতে এসেছিল, আমি অস্বীকার করেছিলাম। আবার কি চায়?’

রত্নাকর বলিলেন— ‘কিছু বলছে না। এবার তোমার জন্য অনেক উপঢৌকন এনেছে।’

দীপঙ্কর হাসিলেন— ‘উপঢৌকন!’

‘হাঁ। তিব্বতের রাজা পাঠিয়েছেন। ওদের সঙ্গে আমার যা দু’চারটে কথা হয়েছে তা থেকে মনে হয় তিব্বতে ধর্মের গ্লানি বেড়ে গেছে, তুমি গিয়ে ধর্মসংস্থাপন করবে এই তাদের আশা। কিন্তু স্পষ্ট কিছু বলছে না। শুধু তোমার সঙ্গে দেখা করতে চায়।’

‘দেখা করব। কিন্তু তিব্বতরাজের নিমন্ত্রণ রক্ষা করা তো সম্ভব নয়। একবার না বলেছি, আবারও না বলতে হবে।’

‘উপায় কি?’

‘বেশ, তুমি তাদের এখানেই পাঠিয়ে দাও।’

রত্নাকর কয়েক পা গিয়া আবার ফিরিয়া আসিলেন, বলিলেন— ‘অতীশ, তুমি যদি তিব্বতে যাও তিব্বতে ধর্মের দীপ জ্বলে উঠবে, কিন্তু ভারতবর্ষ অন্ধকার হয়ে যাবে। অগণ্য তুরস্ক সৈন্য ভারতবর্ষ আক্রমণ করেছে। তিব্বতীদের মধুর বাক্যে সেকথা ভুলে যেও না।’

দীপঙ্কর বলিলেন— ‘আমি থাকলেই কি তুরস্কদের রোধ করতে পারব?’

‘তবু তো আপৎকালে তুমি কাছে থাকবে।’

‘ভয় নেই, আমি তিব্বতে যাব না। তুমি ওদের পাঠিয়ে দাও।’

রত্নাকর নামিয়া গেলেন। অর্ধদণ্ড পরে চারিজন তিব্বতী ভিক্ষু ছাদে উপস্থিত হইলেন। তিব্বতীদের যিনি অগ্রণী তাঁহার নাম আচার্য বিনয়ধর, তিব্বতী নাম ট্‌ষল্‌ খ্রিম গ্যাল্‌বা। তাঁহার সহচরগণ একটি গুরুভার বেত্র-পেটিকা ধরাধরি করিয়া আনিতেছে।

বিনয়ধর ভূমিষ্ঠ হইয়া দীপঙ্করকে প্রণাম করিলেন, তাঁহার সঙ্গীরাও করিলেন। দীপঙ্কর সকলকে আলিঙ্গন করিলেন।

তখন সূর্যাস্ত হইয়াছে, কিন্তু ছাদের উপর যথেষ্ট আলো আছে। দীপঙ্কর তাঁহার দারুকক্ষ হইতে তৃণাস্তরণ আনিয়া পাতিয়া দিলেন। সকলে উপবিষ্ট হইলেন।

কিছুক্ষণ শিষ্টাচার ও কুশলপ্রশ্ন বিনিময়ের পর বিনয়ধর বলিলেন— ‘আর্য, গতবার যাঁর আজ্ঞায় আপনার চরণদর্শন করতে এসেছিলাম সেই তিব্বতরাজ লাহ-লামা-যে-শেস্-এর মৃত্যু হয়েছে। বড় শোচনীয় তাঁর মৃত্যু, সে কাহিনী পরে আপনাকে জানাব। মৃত্যুর পূর্বে তিনি আপনাকে একটি পত্র লিখেছিলেন, সে-পত্রও আমি সঙ্গে এনেছি, যথাকলে নিবেদন করব। বর্তমান রাজা চান্-চুব পূর্বতন রাজার ভ্রাতুষ্পুত্র। এবার তিনিই আমাদের পাঠিয়েছেন।’

দীপঙ্কর বলিলেন— ‘ভাল। নূতন তিব্বতরাজ সদ্ধর্মে নিষ্ঠাবান জেনে সুখী হলাম। কিন্তু তিনি আবার আপনাদের এই দুর্গম পথে কেন পাঠিয়েছেন আচার্য?’

আচার্য বিনয়ধর একটু হাস্য করিলেন। তাঁহার কৃশ দেহ, অস্থিসার মুখ এবং তির্যক চক্ষু দেখিয়া মনে হয় না যে তাঁহার প্রাণে বিন্দুমাত্র রস আছে; কিন্তু তাঁহার শান্ত অত্বরিত বাক্‌ভঙ্গিতে এমন একটি মসৃণ সমীচীনতা আছে যাহা প্রবীণ রাষ্ট্রদূতগণের মধ্যেও বিরল। তিনি ধীরস্বরে বলিলেন— ‘বারবার একই প্রস্তাব নিয়ে আপনার সম্মুখীন হতে আমি বড় সঙ্কুচিত হচ্ছি আর্য। কিন্তু ও কথা এখন থাক। আমাদের নবীন রাজা আপনাকে যে উপঢৌকন পাঠিয়েছেন তাই আগে নিবেদন করি।’

দীপঙ্কর বলিলেন— ‘কিন্তু আমাকে উপঢৌকন কেন? আমি তো রাজা নই, সামান্য ভিক্ষু।’

বিনয়ধর বলিলেন— ‘আপনি রাজার রাজা, রাজাধিরাজ।’

বিনয়ধর ইঙ্গিত করিলেন, বাকি তিনজন ভিক্ষু বেত্র-পেটিকাটিকে তুলিয়া দীপঙ্করের সম্মুখে রাখিল এবং ডালা খুলিয়া দিল। দীপঙ্কর দেখিলেন পেটিকাটি কপিত্থ ফলের ন্যায় গোলাকৃতি বস্তুতে পূর্ণ। গোলকগুলি পোড়া মাটি দিয়া প্রস্তুত মনে হয়। দীপঙ্কর ঈষৎ বিস্ময়ে ভ্রূ উত্থিত করিয়া প্রশ্ন করিলেন— ‘এ কী বস্তু?’

বিনয়ধর পেটিকা হইতে একটি গোলক তুলিয়া লইয়া মৃদু হাস্যে বলিলেন— ‘আর্য, এর নাম অগ্নিকন্দুক। চীন দেশ থেকে কারুকর আনিয়ে আমাদের রাজা এই কন্দুক নির্মাণ করিয়েছেন। এর সাহায্যে আপনি বিধর্মী তুরস্কদের দেশ থেকে বিতাড়িত করতে পারবেন।’

দীপঙ্কর বিস্ফারিত নেত্রে চাহিলেন। কিন্তু তিনি কিছু বলিবার পূর্বেই নিম্নে বিহারভূমি হইতে বহুজনের রূঢ় কলকোলাহল আসিল।

চার

শান্তরসাস্পদ বিহারভূমিতে দিবাবসানকালে বহু নরকণ্ঠের উগ্র কোলাহল কোথা হইতে আসিল তাহার বৃত্তান্ত কিছু পূর্ব হইতে জানা প্রয়োজন।

পাল রাজা যেমন মগধে রাজত্ব করিতেন, তেমনি মগধের দক্ষিণ-পশ্চিমে নর্মদাতীরে চেদি রাজ্য ছিল; কলচুরি-রাজ লক্ষ্মীকর্ণ সেখানে রাজত্ব করিতেন। তাঁহার রাজধানীর নাম ত্রিপুরী। নয়পাল ও লক্ষ্মীকর্ণের মধ্যে বংশানুক্রমিক শত্রুতা ছিল। লক্ষ্মীকর্ণের পিতা গাঙ্গেয়দেব এবং নয়পালের পিতা মহীপাল অক্লান্তভাবে সারা জীবন পরস্পর যুদ্ধ করিয়াছিলেন।

লক্ষ্মীকর্ণ মধ্যবয়সে রাজা হইয়া মহানন্দে পিতৃব্রত মাথায় তুলিয়া লইলেন। তিনি অতি ধূর্ত ও দুষ্টবুদ্ধি লোক ছিলেন। প্রকাণ্ড দেহ, হস্তিতুল্য বলশালী; নানাপ্রকার ব্যসনের মধ্যে যুদ্ধকার্যই ছিল তাঁহার প্রধান ব্যসন। তিনি ধর্মে বৈষ্ণব ছিলেন। কিন্তু সেকালে বৈষ্ণব বলিলে বিষ্ণু-উপাসক বুঝাইত, পরবর্তী কালের কন্ঠিধারী নিরামিষ বৈষ্ণব বুঝাইত না। লক্ষ্মীকর্ণ প্রত্যহ অন্যান্য খাদ্যাখাদ্যের সহিত একটি আস্ত ময়ূর ভক্ষণ করিতেন এবং প্রচুর মদ্যপান করিতেন। তাঁহার পুত্রসন্তান ছিল না; কেবল দুই কন্যা, বীরশ্রী ও যৌবনশ্রী। পাটরানীর মৃত্যুর পর আর মহিষী গ্রহণ করেন নাই; রাজপুরীর দাসী কিঙ্করীরা কেহ কেহ উপ-মহিষী হইয়া থাকিত। আত্মসুখ ও পরনিগ্রহ ভিন্ন লক্ষ্মীকর্ণদেবের অন্য চিন্তা ছিল না।

অপরপক্ষে নয়পাল ছিলেন ঠিক বিপরীত চরিত্রের মানুষ। তিনিও মধ্যবয়সে রাজা হইয়াছিলেন; পিতার জীবনব্যাপী যুদ্ধবিগ্রহ দেখিয়া তাঁহার যুদ্ধে বিতৃষ্ণা জন্মিয়াছিল। তাই তিনি ক্ষাত্রতেজ সংবরণ করিয়া যেটুকু পিতৃরাজ্য পাইয়াছিলেন তাহা লইয়াই সন্তুষ্ট ছিলেন। অবসরকালে পট্ট মহিষীর সহিত পাশা খেলিতেন, অথবা বৌদ্ধ আচার্যদের ডাকিয়া তন্ত্রের গূঢ় প্রক্রিয়া সম্বন্ধে আলোচনা করিতেন। যুবরাজ বিগ্রহপালের বিবাহযোগ্য বয়স হইয়াছে, একথা মহিষী বারম্বার স্মরণ করাইয়া দিলেও নয়পাল সেদিকে কর্ণপাত করিতেছিলেন না। তিনি শান্তিপ্রিয় মানুষ, পুত্রের বিবাহ দিতে গেলে রাজকন্যা অন্বেষণ করিতে হইবে, বিবাহ উৎসবে সমস্ত রাজন্যবর্গকে আমন্ত্রণ করিতে হইবে, দীর্ঘকালব্যাপী একটা হৈ হৈ রৈ রৈ কাণ্ড চলিবে; তাই কর্তব্য বুঝিয়াও নয়পালের মন পরাঙ্মুখ হইয়া ছিল। তিনি এমন প্রকৃতির লোক যে বাহির হইতে প্রবল খোঁচা না খাইলে কোনও কাজে অগ্রসর হইতে পারেন না।

লক্ষ্মীকর্ণ নয়পালের শান্ত নির্বিরোধ প্রকৃতির কথা জানিতেন। তদুপরি একটা গুপ্তচরের মুখে সংবাদ পাইলেন যে পাটলিপুত্রে নয়পাল অনেকগুলি তান্ত্রিক সাধুকে লইয়া মাতিয়াছেন, দিবারাত্র গোপনে বীরাচারের অভ্যাস চলিয়াছে; তাঁহার সৈন্যগণও অবিন্যস্ত, যুদ্ধের জন্য অপ্রস্তুত। লক্ষ্মীকর্ণের মন অনেকদিন যাবৎ যুদ্ধ করিবার জন্য উস্‌খুস্‌ করিতেছিল, কেবল সুযোগের অভাবে এতদিন লাগিয়া পড়িতে পারেন নাই। তিনি দেখিলেন এই সুযোগ। এক মাসের মধ্যে ছয় সহস্র সৈন্য লইয়া তিনি বাহির হইয়া পড়িলেন। উদ্দেশ্য, এই ফাঁকে মগধের দক্ষিণে অঙ্গদেশটা দখল করিয়া বসিবেন। সংবাদ পাইয়া নয়পাল যদি হৃতরাজ্য পুনরুদ্ধার করিতে আসে তখন দেখা যাইবে।

লক্ষ্মীকর্ণ বুদ্ধিটা ভালই খেলাইয়াছিলেন, কিন্তু তাঁহার হিসাবে একটু ভুল ছিল। তাঁহার গুপ্তচর পাটলিপুত্র হইতে ত্রিপুরীতে আসিতে একপক্ষ কাল লইয়াছিল, তিনি নিজে সৈন্য সাজাইয়া যাত্রা করিতে এক মাস লইয়াছিলেন; তারপর সসৈন্যে অঙ্গদেশে পৌঁছিতে আরও এক মাস লাগিয়াছিল। এই আড়াই মাসে পাটলিপুত্রের পরিস্থিতি অপ্রত্যাশিতভাবে পরিবর্তিত হইয়াছিল।

তান্ত্রিকেরা এক মাস চেষ্টা করিয়াও যখন ভৈরবীচক্রে দেবদেবীর আবির্ভাব ঘটাইতে পারিল না তখন নয়পাল বীতশ্রদ্ধ হইয়া তান্ত্রিকদের তাড়াইয়া দিলেন। তারপর সপরিবারে সেনা পরিবৃত হইয়া চম্পা নগরীর অভিমুখে যাত্রা করিলেন। চম্পা অঙ্গদেশের প্রধান নগরী।

এইখানে একটি কথা উল্লেখযোগ্য। পাল রাজাদের কোনও স্থায়ী রাজধানী বা মহাস্থানীয় ছিল না। পাল রাজ্যকালের আরম্ভে ধর্মপাল ও দেবপাল প্রাগ্‌জ্যোতিষ হইতে কাশ্মীর পর্যন্ত সাম্রাজ্য স্থাপন করিয়াছিলেন, এক স্থানে বসিয়া এই বিপুল ভূভাগ শাসন করিবার সুবিধা ছিল না। তাই তাঁহারা সৈন্যসামন্ত অমাত্য সচিব শ্রেষ্ঠী পরিষৎ সঙ্গে লইয়া সাম্রাজ্যের একস্থান হইতে স্থানান্তরে পর্যটন করিয়া বেড়াইতেন। বারাণসী মুদ্‌গগিরি গৌড় মহাস্থান, যখন যেখানে যাইতেন সেখানে অস্থায়ী রাজধানী বা স্কন্ধাবার বসিত। কিন্তু কালক্রমে যখন পালরাজ্য সঙ্কুচিত হইয়া মগধের সীমানায় আবদ্ধ হইল তখনও রাজা পুরাতন রীতি ত্যাগ করিলেন না। পাটলিপুত্রে রাজার স্থায়ী পীঠ রহিল বটে কিন্তু মাঝে মাঝে রাজা রাজ্য পরিদর্শনে বাহির হইয়া পড়িতেন। ভ্রমণও হইত, দূরস্থ রাজকর্মচারীদের উপর দৃষ্টিও রাখা চলিত।

যা হোক, নয়পাল মন্দ মন্থরগতিতে চম্পার দিকে আসিতেছেন, ওদিকে লক্ষ্মীকর্ণ যথাসম্ভব চুপিচুপি আসিতেছেন; চম্পা নগরীর সন্নিকটে উভয়পক্ষে দেখা হইয়া গেল। নয়পাল লক্ষ্মীকর্ণের এই তঞ্চকতায় অগ্নিবৎ জ্বলিয়া উঠিলেন। রাগ হইলে তাঁহার হিতাহিত জ্ঞান থাকে না, ক্ষাত্রতেজ বিস্ফুরিত হয়, তিনি আক্রমণের আজ্ঞা দিলেন। লক্ষ্মীকর্ণ ভাবিলেন নয়পাল তাঁহার জন্য ফাঁদ পাতিয়াছে, নিশ্চয় তাহার সঙ্গে বিশ হাজার সৈন্য আছে। নয়পালের দলে অধিকাংশ লোকই যে অসামরিক তাহা তিনি কি করিয়া জানিবেন? তিনি ভগ্ন-মনোরথ হইয়া পড়িলেন। তাঁহার সৈন্যরাও মন দিয়া যুদ্ধ করিতে পারিল না, দুই চারি ঘা মার খাইয়া ছত্রভঙ্গ হইয়া পড়িল।

পলায়ন ছাড়া লক্ষ্মীকর্ণের আর গত্যন্তর রহিল না। তিনি অল্পাধিক এক সহস্র সৈন্য লইয়া পূর্বদিকে পলাইয়া চলিলেন। নয়পালের তখন রোখ চড়িয়া গিয়াছে, তিনি অসামরিক সহচরদের পিছনে রাখিয়া দুই সহস্র সৈন্য সঙ্গে লক্ষ্মীকর্ণের পশ্চাদ্ধাবন করিলেন। পুত্র বিগ্রহপাল সঙ্গে রহিল।

নয়পাল কিন্তু লক্ষ্মীকর্ণকে ধরিতে পারিলেন না। লক্ষ্মীকর্ণ পলায়ন করিতে করিতে গোধূলি কালে বিক্রমশীল বিহারের নিকট উপস্থিত হইলেন। তখন তাঁহার মাথায় আর একটি বুদ্ধি খেলিয়া গেল। নয়পাল ধর্মে বৌদ্ধ, তিনি কখনই সশস্ত্র সৈন্য লইয়া বিহারভূমিতে প্রবেশ করিবেন না। অতএব—

বিহারভূমিতে প্রবেশের কোনই বাধা নাই; প্রাচীরগাত্রে বিস্তৃত উন্মুক্ত তোরণদ্বার, যে-কেহ যখন ইচ্ছা প্রবেশ করিতে পারে। লক্ষ্মীকর্ণ সদলবলে বিহারভূমিতে প্রবেশ করিলেন।

ইহাদেরই রূঢ় কোলাহল দীপঙ্কর ছাদ হইতে শুনিয়াছিলেন।

নয়পাল যখন আসিয়া পৌঁছিলেন তখন মূষিক বিবরে প্রবেশ করিয়াছে। তিনি পবিত্র বিহারভূমিতে সৈন্য লইয়া পদার্পণ করিলেন না, তোরণের বাহিরে অনতিদূরে থানা দিয়া বসিলেন।

পাঁচ

দীপঙ্কর ছাদের কিনারায় গিয়া দেখিলেন বন্যার ঘোলা জলের ন্যায় সৈন্যস্রোত তোরণাপথে প্রবেশ করিতেছে, তাহাদের অস্ত্রশস্ত্র সন্ধ্যার আলোয় ঝিকঝিক করিতেছে। দীপঙ্কর ত্বরিতে নীচে নামিয়া গেলেন। তিব্বতী চারিজন তাঁহার পিছনে রহিলেন।

নীচে তখন ভারি গণ্ডগোল। সংঘভূমির চারিদিকে লোক দৌড়াদৌড়ি করিতেছে। সংঘের যাহারা বাসিন্দা তাহারা নিজ নিজ প্রকোষ্ঠ হইতে নির্গত হইয়া চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করিয়া দিয়াছে, ভয়ার্তেরা নিজেদের মধ্যে ঠেলাঠেলি গুঁতাগুঁতি করিতেছে। দেখিতে দেখিতে কয়েকটা মশাল জ্বলিয়া উঠিল; মশালগুলা অন্ধকারে আলেয়ার অগ্নিপিণ্ডের ন্যায় শূন্যে সঞ্চরণ করিয়া বেড়াইতে লাগিল।

দীপঙ্কর নামিয়া আসিয়া চারিদিকে চাহিলেন। মশালের আলো সত্ত্বেও মনে হয় অসংখ্য প্রেত ছুটাছুটি করিতেছে। একস্থানে তিনি লক্ষ্য করিলেন কয়েকটা মশাল স্থির হইয়া আছে এবং কয়েকটি লোক সেখানে দাঁড়াইয়া আছে। একজন লোকের আকৃতি বিশাল, সে মেঘমন্দ্র স্বরে আদেশ দিতেছে, অন্য সকলে সেই আদেশ পালনের জন্য দৌড়িতেছে। দীপঙ্কর সেইদিকে গেলেন; দেখিলেন শালপ্রাংশু ব্যক্তি ও তাহার আশেপাশে যাহারা দাঁড়াইয়া আছে সকলের অঙ্গে লৌহজালিক, হস্তে তরবারি। সুতরাং ইহারাই এই সৈন্যদলের অধিনায়ক সন্দেহ নাই। দীপঙ্কর তাহাদের সম্মুখীন হইয়া প্রশ্ন করিলেন, ‘তোমরা কারা? পবিত্র বিহারক্ষেত্রে তোমাদের কী প্রয়োজন?’

শালপ্রাংশু ব্যক্তি দীপঙ্করের দিকে ব্যাঘ্র-দৃষ্টি ফিরাইলেন। মশালের অস্থির আলোকে তাঁহার বৃহৎ মুখমণ্ডল ভয়ঙ্কর দেখাইল। তিনি রূঢ়স্বরে বলিলেন— ‘তুমি কে?’

দীপঙ্কর ধীরকণ্ঠে বলিলেন— ‘আমি বিক্রমশীল বিহারের একজন ভিক্ষু। তুমি কে?’

ব্যাঘ্র-চক্ষু ব্যক্তির মুখ আরও ভয়ঙ্কর হইয়া উঠিল। এই ধৃষ্ট ভিক্ষুটাকে হত্যা করা কর্তব্য কিনা তিনি এই কথা ভাবিতেছেন এমন সময় তাঁহার পার্শ্বস্থ এক ব্যক্তি কথা কহিল। তরুণকান্তি যুবক, যোদ্ধৃবেশ সত্ত্বেও তাহাকে যোদ্ধা বলিয়া মনে হয় না। সে বলিল— ‘ইনি ত্রিপুরীর মহারাজ শ্রীমৎ লক্ষ্মীকর্ণদেব।’

দীপঙ্করের ভ্রূ বিস্ময়ে ঈষৎ উত্থিত হইল। তিনি বলিলেন— ‘চেদিরাজ লক্ষ্মীকর্ণদেব! মহারাজ, আপনি নিজ রাজ্য থেকে বহুদূরে এসে পড়েছেন।’

ভিক্ষুটা তাঁহাকে চেনে দেখিয়া লক্ষ্মীকর্ণের মন একটু নরম হইল। সঙ্গে সঙ্গে মাথায় কূটবুদ্ধিরও উদয় হইল। সংঘভূমিতে রক্তপাত করিয়া লাভ নাই; বিশেষত নয়পাল পিছনে বসিয়া আছে। বরং মিষ্টকথায় যদি কার্যসিদ্ধি হয় সেই চেষ্টাই করিয়া দেখা যাক না। তিনি কণ্ঠস্বরে প্রসন্নতা আনিয়া বলিলেন— ‘তুমি আমার নাম জান, তুমি তো সামান্য ভিক্ষু নও। তোমার নাম কি?’

শীর্ণকায় বিনয়ধর দীপঙ্করের পিছনে প্রচ্ছন্ন থাকিয়া বলিলেন— ‘ইনি অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান, এই বিহারের মহাচার্য।’

লক্ষ্মীকর্ণ চকিত হইলেন। অতীশ দীপঙ্করের নাম জানে না এমন মানুষ তখন ভারতে ছিল না। লক্ষ্মীকর্ণের পাশে যে দাঁড়াইয়া ছিল তাহার চক্ষে সম্ভ্রম ফুটিয়া উঠিল। লক্ষ্মীকর্ণ মস্তক ঈষৎ আনত করিয়া বলিলেন— ‘আপনি অতীশ দীপঙ্কর! ধন্য।’

দীপঙ্কর স্থির নেত্রে লক্ষ্মীকর্ণের দিকে চাহিয়া বলিলেন— ‘মহারাজ, আপনি কি মগধ আক্রমণ করেছেন?’

মহারাজ দুই হাত নাড়িয়া উচ্চহাস্য করিলেন। হাস্য করিলে তাঁহার মুখখানি অশোকস্তম্ভের শীর্ষস্থিত সিংহের মুখের মত দেখায়। তিনি অসি কোষবদ্ধ করিয়া বলিলেন— ‘না না, সে কি কথা! আমরা মৃগয়ায় বেরিয়েছিলাম, পথ ভুলে মগধের সীমানায় ঢুকে পড়েছি।’

কথাটা এতই মিথ্যা যে তাঁহার পার্শ্বস্থ যুবক এবং অন্য লোকগুলি সবিস্ময়ে তাঁহার মুখের পানে চাহিল। লক্ষ্মীকর্ণ কিন্তু তিলমাত্র লজ্জিত না হইয়া সহাস্যমুখে চারিদিকে চাহিতে লাগিলেন। দীপঙ্করের মুখেও একটু হাসির আভাস দেখা দিল। তিনি বলিলেন— ‘বিক্রমশীল বিহারেও কি মহারাজ মৃগয়ার উদ্দেশ্যে ঢুকে পড়েছেন?’

লক্ষ্মীকর্ণ বলিলেন— ‘না, নিরুপায় হয়ে ঢুকেছি। আমাদের সঙ্গে যা খাদ্য ছিল তা শেষ হয়ে গিয়েছে, তাই আপনার আশ্রয় নিয়েছি। মহাশয়, আপনি ধার্মিক ব্যক্তি, আমরা নিরাশ্রয়। নিরাশ্রয়কে আশ্রয় দিয়ে পুণ্য সঞ্চয় করুন।’ নয়পালের তাড়া খাইয়া যে তাঁহারা বিহারে প্রবেশ করিয়াছেন সে কথা লক্ষ্মীকর্ণ চাপিয়া গেলেন।

এই সময় বিহারের একজন শ্রমণ সেইদিক দিয়া ছুটিয়া যাইতে যাইতে মশালের আলোকে দীপঙ্করকে দেখিতে পাইয়া তাঁহার কাছে আসিল এবং হাঁপাইতে হাঁপাইতে বলিল— ‘মহাচার্য, দস্যুরা আর্য রত্নাকর শান্তির কাছ থেকে কুঞ্চিকা কেড়ে নিয়ে অন্নকোষ্ঠ লুণ্ঠন করছে।’

দীপঙ্করের মুখ কঠিন হইল। তিনি লক্ষ্মীকর্ণকে বলিলেন— ‘এই কি আশ্রয় যাঞার রীতি?’

লক্ষ্মীকর্ণ আবার অট্টহাস্য করিলেন, তারপর ছদ্ম বিনয়ের ব্যঙ্গবঙ্কিম স্বরে বলিলেন— ‘ওরা ক্ষুধার্ত। ক্ষুধার্তের অন্নস্পৃহা স্বাভাবিক। আপনি ওদের ক্ষমা করুন।’

দীপঙ্কর বলিলেন— ‘মহারাজ লক্ষ্মীকর্ণ, ধর্মের প্রতি যদি আপনার নিষ্ঠা থাকে এই দণ্ডে আপনার অনুচরদের বিহারভূমি ত্যাগ করতে আদেশ করুন।’

লক্ষ্মীকর্ণের মুখ আবার গম্ভীর হইল, তিনি বলিলেন— ‘অসম্ভব। আমাদের আশ্রয় এবং খাদ্যের প্রয়োজন।’

‘বিহার ত্যাগ করবেন না?’

‘না।’ লক্ষ্মীকর্ণ ব্যাঘ্র-চক্ষু মেলিয়া একবার দীপঙ্করকে দেখিলেন, তারপর নিজের সঙ্গীদের দিকে ফিরিয়া আলাপ করিতে লাগিলেন।

দীপঙ্করের অন্তর ব্যর্থতায় পূর্ণ হইয়া উঠিল। দুর্বৃত্তদের দমন করিবার কোনও অহিংস পন্থা কি নাই; তথাগত, তুমি অক্রোধের দ্বারা ক্রোধকে জয় করিতে বলিয়াছ, কিন্তু—

বিনয়ধর চুপি চুপি তাঁহার কানে বলিলেন— ‘মহাচার্য, যদি আদেশ করেন আমরা এদের তাড়াবার চেষ্টা করতে পারি।’

দীপঙ্কর ঘাড় ফিরাইয়া কিছুক্ষণ বিনয়ধরের পানে চাহিয়া রহিলেন, কি করিয়া বিনয়ধর এতগুলা বর্বরকে তাড়াইবেন বুঝিতে পারিলেন না। অবশেষে সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়িয়া শুষ্কস্বরে বলিলেন— ‘চেষ্টা করুন।’

বিনয়ধর ও তাঁহার তিব্বতী সঙ্গীরা নিঃশব্দে সংঘের অন্ধকারে অদৃশ্য হইয়া গেলেন।

দীপঙ্কর দাঁড়াইয়া রহিলেন। লক্ষ্মীকর্ণ আর তাঁহার দিকে ফিরিলেন না, নিজেদের মধ্যে বাক্যালাপ করিতে লাগিলেন। মশালধারীরা মশাল ঊর্ধ্বে তুলিয়া দণ্ডায়মান রহিল। লক্ষ্মীকর্ণের সঙ্গে যুবক ব্যতীত আর যে কয়জন পুরুষ ছিল তাহারা সকলেই বয়স্থ এবং পুষ্টদেহ; বোধহয় তাহারা লক্ষ্মীকর্ণের সেনাধ্যক্ষ। লক্ষ্মীকর্ণ তাহাদের সঙ্গে নিম্নকণ্ঠে বোধকরি কূট-পরামর্শ করিতেছেন। যুবক একটু দূরে সরিয়া গিয়া এদিক ওদিক কৌতূহলী দৃষ্টি প্রেরণ করিতে লাগিল।

কিছুক্ষণ কাটিয়া গেল। তারপর আচম্বিতে এই মশালবিদ্ধ অন্ধকারের মধ্যে যে কাণ্ড আরম্ভ হইল তাহার বর্ণনা করা দুষ্কর। হঠাৎ দুম্‌ করিয়া একটা বিকট শব্দ হইল; মাটি হইতে খানিকটা আগুন ছিটকাইয়া পড়িল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে কিছু দূরে আবার দুম্‌ করিয়া শব্দ এবং আগুনের উচ্ছ্বাস! মাটি কাঁপিয়া উঠিল। দেখিতে দেখিতে বিহারভূমির চতুর্দিক বিকট দুম্‌দাম শব্দে পরিপূর্ণ হইয়া উঠিল। এমন অনৈসর্গিক শব্দ কেহ কখনও শোনে নাই। যেন ভূগর্ভ ফাটিয়া আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণ ঘোর শব্দে বাহির হইয়া আসিতেছে।

শুধু শব্দই নয়। হঠাৎ আগুনের একটা সাপ স্ফূলিঙ্গ বিকীর্ণ করিতে করিতে মাটির উপর ছুটাছুটি করিতে লাগিল। আর একটা! আর একটা! চারিদিকে বিসর্পিত স্ফূলিঙ্গ কিল্‌বিল্‌ করিতে লাগিল।

প্রথম দুইবার বিকট শব্দ হইবার পরই মশালধারীরা মশাল ফেলিয়া দৌড় মারিয়াছিল। মহারাজ লক্ষ্মীকর্ণ অন্ধকারে দাঁড়াইয়া একেবারে আড়ষ্ট হইয়া গিয়াছিলেন। এ কী বীভৎস ব্যাপার! বৌদ্ধারা কি পিশাচসিদ্ধ! এরূপ প্লীহা-চমকপ্রদ শব্দ ও আগুনের খেলা প্রেত-পিশাচ ছাড়া আর কে সৃষ্টি করিতে পারে? লক্ষ্মীকর্ণদেব যুদ্ধক্ষেত্রে কখনও ভয় পান নাই, কিন্তু আজ তাঁহার হৃৎপিণ্ড কাঁপিয়া উঠিল।

দুম্‌ দাম্‌ দাড়াম্‌ শব্দের ফাঁকে ভয়ার্ত চিৎকার আসিতে লাগল। লক্ষ্মীকর্ণের সৈন্যগণ কিছুক্ষণ হতভম্ব থাকিয়া পরিত্রাহি চিৎকার ছাড়িতে ছাড়িতে পলাইতে আরম্ভ করিয়াছে। যে যেদিকে পাইল পলাইল, কেহ প্রাচীর ডিঙাইয়া ছুট দিল, কেহ অন্ধ ত্রাসে গঙ্গার জলে ঝাঁপাইয়া পড়িল। দেখিতে দেখিতে বিহারভূমি শূন্য হইয়া গেল। কেবল লক্ষ্মীকর্ণ ও তাঁহার সহচরীগণ অভিভূত বুদ্ধিভ্রষ্টের ন্যায় দাঁড়াইয়া রহিলেন।

দীপঙ্করও কম অভিভূত হন নাই। কিন্তু তিনি অস্পষ্টভাবে ব্যাপার বুঝিতে আরম্ভ করিয়াছিলেন।

দুম্‌ দাম্‌ শব্দ কমিয়া আসিতেছে। হঠাৎ লক্ষ্মীকর্ণের পশ্চাদ্দেশে ফর্‌র্‌ শব্দ করিয়া আগুনের একটা উৎস জ্বলিয়া উঠিল, যেন ভূতলস্থ কোনও ছিদ্রপথে অগ্নিশ্বাস রাক্ষস ফুৎকার দিতেছে। লক্ষ্মীকর্ণ সভয়ে পলাইতে গিয়া পড়িয়া গেলেন; আবার উঠিয়া পলায়নের চেষ্টা করিবেন এমন সময় একজন সেনাধ্যক্ষ তাঁহার পিঠের উপর পড়িল। তার উপর আর একজন পড়িল। সর্বোপরি পড়িল যুবক। সকলে মিলিয়া হাত-পা ছুঁড়িতে লাগিলেন।

মশালগুলি নিভিয়া গিয়াছে; দুম্‌ দাম্‌ শব্দ প্রায় থামিয়া আসিয়াছে; আগুনের উৎস আর স্ফুরিত হইতেছে না। চারিদিক ঘোর অন্ধকার।

দীপঙ্করের স্বর শোনা গেল— ‘মহারাজ লক্ষ্মীকর্ণ, আপনি আছেন তো?’

মাটির নিকট হইতে লক্ষ্মীকর্ণের উত্তর আসিল— ‘এই যে আমি এখানে। মহাচার্যদেব, আপনার পিশাচদের সম্বরণ করুন।’

অন্ধকারে দীপঙ্কর হাসিলেন।

সংঘের ভিতর হইতে একটি আলোকবর্তিকা বাহির হইয়া আসিতেছে। কাছে আসিলে দেখা গেল, তিব্বতী আচার্য বিনয়ধর দীপ হস্তে আসিতেছেন। দীপের প্রভায় দেখা গেল, লক্ষ্মীকর্ণ সপারিষৎ মৃত্তিকার উপর উপবিষ্ট আছেন।

দীপঙ্কর বলিলেন— ‘মহারাজ, আপনার সৈন্যেরা বোধহয় আপনার অনুমতি না নিয়েই বিহারভুমি ত্যাগ করেছে।’

লক্ষ্মীকর্ণ দীপঙ্করের কথা শুনিতে পাইলেন কিনা সন্দেহ। তিনি পূর্বে কখনও তিব্বতী দেখেন নাই, প্রদীপের আলোয় বিনয়ধরের মুখ দেখিয়া তাঁহার বুক গুরুগুরু করিয়া উঠিল। তিনি দেখিলেন— পিশাচ। দীপঙ্করের পোষা পিশাচ। তিনি হাত জোড় করিয়া কম্পিত স্বরে বলিলেন— ‘আচার্য দীপঙ্কর, আমাদের ক্ষমা করুন। আপনি যা বলবেন তাই শুনব।’

দীপঙ্কর মৃদু হাস্যে বলিলেন— ‘ভয় নেই। আসুন আমার সঙ্গে। অস্ত্র ত্যাগ করে আসুন।’

ছয়

নয়পাল তাঁহার দুই সহস্র সৈন্য লইয়া বিহার-তোরণ হইতে তিন-চারি রজ্জু দূরে বসিয়াছিলেন। রাত্রি আসন্ন, সঙ্গে রাত্রিবাসের উপযোগী বস্ত্রাবাস আচ্ছাদন কিছুই নাই, লক্ষ্মীকর্ণকে তাড়া করিবার সময় সবই পশ্চাতে ফেলিয়া আসিয়াছেন। সুতরাং আজ রাত্রিটা নক্ষত্রখচিত আকাশের তলে কাটাইতে হইবে।

শুধু তাহাই নয়। প্রত্যেক সৈনিকের সঙ্গে সামরিক নিয়মানুযায়ী এক বেলার খাদ্য, অর্থাৎ দুই মুষ্টি চণক বা তণ্ডুল বা যবচূর্ণ আছে বটে, কিন্তু রাজা বা রাজপুত্রের সঙ্গে কণামাত্র আহার্য নাই; অতএব পেটে কিল মারিয়া রাত্রিযাপন করা ছাড়া তাঁহাদের গত্যন্তর নাই। সঙ্গে যে কয়জন সেনানী আছেন তাঁহাদেরও সেই অবস্থা।

মহারাজ নয়পাল তাহাতে বিশেষ বিচলিত হন নাই। তিনি বয়স্থ ব্যক্তি, জঠরের অগ্নি মন্দ হইয়াছে; পবিত্র গঙ্গাজল পান করিয়া তাঁহার চলিয়া যাইবে। তিনি লক্ষ্মীকর্ণের উদ্দেশ্যে কিছু গালিগালাজ বর্ষণ করিয়া ক্ষান্ত হইয়াছিলেন। সেনানীরাও সৈন্যদের কাছে উঞ্ছবৃত্তি করিয়া যাহোক একটা ব্যবস্থা করিয়া লইতে পরিবে। কিন্তু যুবরাজ বিগ্রহপাল?

বিগ্রহপাল যুবপুরুষ, জঠরাগ্নি বিলক্ষণ প্রবল। সৈনিকদের নিকট কণা-ভিক্ষা তিনি প্রাণ গেলেও করিবেন না। তাই সারারাত্রি না খাইয়া কাটাইবার সম্ভাবনায় তাঁহার মন বড়ই অস্থির হইয়া পড়িয়াছিল। রাজপুত্রদের উপবাস করার অভ্যাস কোনও কালেই নাই।

বিগ্রহপালের বয়স এই সময় কুড়ি বৎসর। উজ্জ্বল কাংসফলকের ন্যায় শুক্লপীতাভ দেহের বর্ণ, নাতিদীর্ঘ নাতিহ্রস্ব আকৃতি, মুখে পৌরুষের লাবণ্য। রাজপুত্র বটে, কিন্তু দেহে যেমন লেশমাত্র মেদ নাই, মনে তেমনি বিন্দুমাত্র অভিমান নাই। ক্রীড়াচটুল কৌতুকোচ্ছল প্রগল্‌ভ প্রকৃতি। রাজপুত্রদের মধ্যে এরূপ প্রকৃতি প্রায়শঃ দেখা যায় না; বোধকরি বাঞ্ছনীয়ও নয়।

বর্তমানে যুবরাজ ক্ষুৎপীড়িত অবস্থায় বিচরণ করিতেছেন। অন্ধকারে সৈন্যগণ মাটির উপর বসিয়া শুষ্ক শস্য চিবাইতে চিবাইতে গল্প করিতেছিল; মহারাজ তাঁহার সেনানীদের লইয়া সৈন্য-মণ্ডলীর মাঝখানে বিরাজ করিতেছিলেন; কিন্তু যুবরাজ সৈন্যচক্রের মাঝখানে নিরাপদ স্থানে আবদ্ধ থাকিতে পারেন নাই, চক্রের বাহিরে আসিয়া একাকী পরিভ্রমণ করিতেছিলেন। পশ্চিমে দিনের চিতা নিভিয়া গিয়াছে। অদূরে গঙ্গার স্রোতঃপ্রবাহ দেখা যাইতেছে না কিন্তু তাহার কলধ্বনি কানে আসিতেছে। সম্মুখে বিহারের ঊর্ধ্বোত্থিত চূড়া বিপুলায়তন প্রস্তরীভূত অন্ধকারের আকার ধারণ করিতেছে; বিহারভূমি হইতে কোলাহলের শব্দ আসিতেছে…কয়েকটি মশাল জ্বলিয়া উঠিল…

সেনা-মণ্ডলীর সীমান্ত পরিক্রমণ করিতে করিতে যুবরাজ বিগ্রহপাল চিন্তা করিতেছিলেন— বুড়া লক্ষ্মীকর্ণ একটা গ্রন্থিচ্ছেদক…চোর…দিব্য বিহারে ঢুকিয়া চর্ব্যচুষ্য খাইতেছে, আর আমরা…দূর হোক। আজ যদি প্রিয়বয়স্য অনঙ্গপাল সঙ্গে থাকিত নিশ্চয় একটা বুদ্ধি বাহির করিত…অন্ধকারে চুপি চুপি বিহারে ঢুকিয়া পড়িলে কেমন হয়? আমাকে তো কেহ চেনে না। …কিন্তু পিতৃদেবের নিষেধ সশস্ত্রভাবে বিহারে প্রবেশ করিবে না। …কী উপায়! আজ রাত্রে খাদ্যসংগ্রহ করিতেই হইবে। নিরস্ত্র হইয়া বিহারে প্রবেশ করিলে কেমন হয়? একবার আর্য দীপঙ্করের কাছে পৌঁছিতে পারিলে আর ভয় নাই…কিন্তু আর্য দীপঙ্কর কিরূপ আছেন কে বলিতে পারে! হয়তো মহাপিশুন লক্ষ্মীকর্ণ তাঁহাকে বাঁধিয়া রাখিয়াছে। তা যদি করিয়া থাকে, পাষণ্ডের মুণ্ড লইয়া গেণ্ডুয়া খেলিব…

এই সব চিন্তার জালে বিগ্রহপালের মন জড়াইয়া গিয়াছে এমন সময় বিহারভূমি হইতে বিকট শব্দ আসিল— দুম্‌! তারপর দ্রুত পরম্পরায়— দুম্‌ দাম্‌ দড়াম্‌! নয়পালের দুই হাজার সৈন্য একযোগে উঠিয়া দাঁড়াইল। এ কি ভয়ানক শব্দ! সকলে কাষ্ঠপুত্তলির ন্যায় দাঁড়াইয়া বিহারের দিকে চাহিয়া রহিল। শব্দটা বিহারের প্রাচীর বেষ্টনের মধ্যে আবদ্ধ আছে তাই কেহ পলায়ন করিল না, নচেৎ অবশ্য পলায়ন করিত। বিগ্রহপাল ক্ষণেকের জন্য বিমূঢ় হইয়া গেলেন, তারপর কটি হইতে তরবারি খুলিয়া ফেলিয়া দ্রুতহস্তে দেহের বর্মচর্ম মোচন করিতে লাগিলেন। যেখানে উত্তেজক ব্যাপার ঘটিতেছে সেখান হইতে বিগ্রহপালকে ঠেকাইয়া রাখা অসম্ভব।

দুম্‌ দাম্‌ শব্দ চলিতে লাগিল। কিয়ৎকাল পরে তাহার সহিত ভীত মনুষ্যকণ্ঠের কলকল শব্দ মিশিল। তারপর বিহারের চারিদিক হইতে ছায়ামূর্তির মত মানুষ ছুটিয়া বাহির হইতে লাগিল; বল্মীকস্তূপের উপর পদাঘাত করিলে যেমন পিল্‌পিল্‌ করিয়া কীট বাহির হয় তেমনি। নয়পালের সৈন্যদল যেখানে যূথবদ্ধ হইয়া দাঁড়াইয়া ছিল সেদিকে কেহ আসিল না, বিভিন্ন দিকে ছুটিয়া পলাইতে লাগিল।

বিগ্রহপালের কৌতূহল ও আগ্রহ আর বাধা মানিল না। পিতার অনুমতি লাইতে গেলে অনেক সময় লাগিবে, তিনি কাহাকেও কিছু না বলিয়া বিহারের দিকে ছুটিলেন। দুম্‌ দাম্‌ শব্দ এতক্ষণে থামিয়া আসিয়াছে, পলায়মান মানুষগুলাও অদৃশ্য হইয়াছে।

বিগ্রহপাল বিহার-তোরণের সম্মুখে যখন পৌঁছিলেন তখন বিহার নিস্তব্ধ ও অন্ধকার। বিড়ালের ন্যায় লঘুপদক্ষেপে তিনি সোপান অতিক্রম করিয়া বিহারভূমিতে প্রবেশ করিলেন।

বিহারভূমি জনশূন্য, কেবল একটি কটু ধূমের গন্ধ চারিদিকে ব্যাপ্ত হইয়া আছে। বিগ্রহপাল বিহারের কেন্দ্রস্থিত ভবনে প্রবেশ করিলেন। তিনি পূর্বে কয়েকবার পিতার সঙ্গে বিক্রমশীল বিহারে আসিয়াছেন, স্থানটি তাঁহার অপরিচিত নয়। মহাচার্য দীপঙ্কর ছাদের কাষ্ঠ-প্রকোষ্ঠে বাস করেন তাহাও তিনি জানেন। তবু ছাদে উঠিবার সিঁড়িটা সহসা খুঁজিয়া পাইলেন না। একে সূচীভেদ্য অন্ধকার, তার উপর কোথাও জনমানবের চিহ্ন নাই।

সতর্কভাবে এদিক ওদিক হাত্‌ড়াইতে হাত্‌ড়াইতে সহসা দূরে আলোকের প্রভা তাঁহার চোখে পড়িল। তিনি অতি সন্তর্পণে সেইদিকে চলিলেন। সংঘ শত্রু কিম্বা মিত্র কাহার অধিকারে তাহা জানা নাই, সাবধানে চলা ভাল।

আলোকপ্রভার কাছাকাছি আসিয়া তিনি দেখিলেন একটি প্রকোষ্ঠে তিন-চারিটি দীপ জ্বলিতেছে, কয়েকজন লোক আহারে বসিয়াছে। দুইজন ভিক্ষু পরিবেশন করিতেছে। ভোক্তাদের মধ্যে একজন বিশালকায় পুরুষ গোগ্রাসে আহার করিতেছে, তাহার পাত্রে খাদ্যদ্রব্য পড়িতে পড়িতে অদৃশ্য হইয়া যাইতেছে।

আজ দ্বিপ্রহরে বিগ্রহপাল এই বিশালকায় লোকটাকে যুদ্ধক্ষেত্রে বহুদূর হইতে দেখিয়াছিলেন— নিশ্চয় লক্ষ্মীকর্ণ। বিগ্রহপাল বাহিরের অন্ধকারে দাঁড়াইয়া দেখিতে লাগিলেন। ক্রমে তাঁহার কর্ণে আসিল একটি শান্ত পরিচিত কণ্ঠস্বর। দীপঙ্কর প্রকোষ্ঠের মধ্যেই আছেন, বাহির হইতে তাঁহাকে দেখা যাইতেছে না। বিগ্রহপাল শুনিতে পাইলেন, দীপঙ্কর বলিতেছেন— ‘মহারাজ লক্ষ্মীকর্ণ, বৌদ্ধবিহারে রাজকীয় খাদ্য-পানীয় নেই, রাজকীয় রতিগৃহের পালঙ্কশয্যাও নেই। আজ ভিক্ষুর খাদ্য এবং ভিক্ষুর শয্যাতে আপনাকে সন্তুষ্ট থাকতে হবে। আপনারা পথক্লান্ত, আহারের পর বিশ্রাম করুন। পাশের প্রকোষ্ঠে আপনাদের তৃণশয্যা রচিত হয়েছে। ভয় নেই, প্রেত পিশাচ বা মানুষ, কেউ আপনাদের বিরক্ত করবে না। কাল প্রাতে আপনার সঙ্গে কিছু আলোচনা করবার আছে। তারপর আপনি যদি ইচ্ছা করেন নিজ রাজ্যে ফিরে যেতে পারবেন। আজ আমি চললাম। আমার কিছু অন্য কাজ আছে। — আরোগ্য।’

উত্তরে লক্ষ্মীকর্ণ গলার মধ্যে ঘোঁৎ ঘোঁৎ শব্দ করিলেন। দীপঙ্কর একটি দীপ হস্তে লইয়া কক্ষের বাহিরে আসিলেন। বিগ্রহপালকে তিনি দেখিতে পাইলেন না, অলিন্দ দিয়া একদিকে চলিতে আরম্ভ করিলেন।

বিগ্রহপাল নিঃশব্দে তাঁহার অনুসরণ করিলেন। অলিন্দের প্রান্তে ছাদে উঠিবার সিঁড়ি। দীপঙ্কর সিঁড়ির প্রথম ধাপে পা দিয়াছেন এমন সময় পিছনে অস্পষ্ট শব্দ শুনিয়া ফিরিয়া দাঁড়াইলেন। বিগ্রহপাল তাঁহার কাছে আসিয়া নত হইয়া তাঁহার পদস্পর্শ করিলেন।

প্রদীপ তুলিয়া ধরিয়া দীপঙ্কর বিগ্রহপালের মুখ দেখিলেন, বিস্ময়োৎফুল্ল স্বরে বলিলেন— ‘এ কি বিগ্রহ! তুমি এখানে কোথা থেকে এলে?’

‘ভয়ঙ্কর শব্দ শুনে এসেছি আর্য।’ বলিয়া দ্রুত নিম্নকণ্ঠে সকল কথা বলিলেন। শুনিয়া দীপঙ্কর হাসিতে লাগিলেন, বলিলেন— ‘এতক্ষণে লক্ষ্মীকর্ণের ব্যাপার বুঝলাম। ভাল হয়েছে, ভাল হয়েছে। — তুমি এখন ফিরে যাও, তোমার পিতৃদেবকে সঙ্গে করে নিয়ে এস। তাঁর সঙ্গে অনেক কথা আছে।’

‘যে আজ্ঞা। কিন্তু আর্য, কিসের এমন বিকট শব্দ হচ্ছিল?’

‘পরে শুনো। এখন যাও, শীঘ্র মহারাজকে নিয়ে এস।’

‘আজ্ঞা। কিন্তু আর্য, বড় পেট জ্বলছে, ফিরে এসে যেন খেতে পাই।’

দীপঙ্কর তাঁহার স্কন্ধে হাত রাখিয়া বলিলেন— ‘পাবে।’

সাত

রাত্রির প্রথম প্রহর উত্তীর্ণ হইয়াছে।

বিহারের একটি কক্ষে খড়ের শয্যায় শয়ন করিয়া মহারাজ লক্ষ্মীকর্ণ সানুচর নিদ্রা যাইতেছেন। তৃণশয্যার জন্য নিদ্রার কোনও ব্যাঘাত হয় নাই, মহারাজের নাসারন্ধ হইতে থাকিয়া থাকিয়া বীরোচিত সিংহনাদ বাহির হইতেছে। অন্যথা বিহার নিস্তব্ধ এবং অন্ধকারে আচ্ছন্ন।

কেবল ছাদে দীপঙ্করের দারু-কক্ষে দীপ জ্বলিতেছে। কক্ষটি আয়তনে প্রশস্ত, ভূমির উপর তৃণাস্তরণ; চারি কোণে স্তূপীকৃত তালপাতার পুঁথি ছাড়া কক্ষে আর কিছু নাই। এই কক্ষের মাঝখানে পাঁচটি মানুষ অর্ধচন্দ্রাকারে বসিয়াছেন। দীপঙ্করের একপাশে নয়পাল ও বিগ্রহপাল, অন্যপাশে আচার্য বিনয়ধর ও মহাধ্যক্ষ রত্নাকর শান্তি।

বিগ্রহপালের পেট ঠাণ্ডা হইয়াছে, নয়পাল যৎকিঞ্চিৎ জলযোগ করিয়াছেন। গুরুতর আলোচনা আরম্ভ হইয়াছে। যদিও এত রাত্রে ছাদে কেহ নাই, তবু যথাসম্ভব নিম্নকণ্ঠে কথা হইতেছে।

মহারাজ নয়পাল গম্ভীর স্বরে বলিলেন— ‘কাল সকালে লক্ষ্মীকর্ণকে বিহারের বাহিরে টেনে নিয়ে গিয়ে ওর নাক কেটে নেব।’ নয়পালের চক্ষু দুটি ঈষৎ রক্তাভ; অন্তরের অগ্নিশিখা প্রশমিত হইয়া এখন কেবল অঙ্গার জ্বলিতেছে।

দীপঙ্কর হাসিলেন— ‘অতটা প্রয়োজন হবে না। লক্ষ্মীকর্ণ বিলক্ষণ ভয় পেয়েছে। যে অদ্ভুত ব্যাপার আজ সে দেখেছে—’

নয়পাল বলিলেন— ‘অদ্ভুত ব্যাপার— অসম্ভব ব্যাপার! মানুষ যে এমন শব্দ সৃষ্টি করতে পারে তা কল্পনা করা যায় না।’

দীপঙ্কর বলিলেন— ‘লক্ষ্মীকর্ণ ভেবেছে এ পিশাচের কাণ্ড।’

আচার্য বিনয়ধর নিজের কেশহীন কঙ্কালসার মুখে আঙ্গুল বুলাইয়া বলিলেন— ‘শুধু তাই নয়, আমাকেই তিনি পিশাচ মনে করেছেন।’

অন্য সকলের মুখে হাসির স্ফুরণ দেখা দিল, কিন্তু তাঁহারা তৎক্ষণাৎ তাহা দমন করিলেন। দীপঙ্কর বলিলেন— ‘আচার্য বিনয়ধর, তিব্বতের নবীন মহারাজা যে উপঢৌকন পাঠিয়েছেন তার তুল্য মূল্যবান বস্তু পৃথিবীতে আর আছে কিনা সন্দেহ। সোনারূপা মণিমাণিক্য এর কাছে তুচ্ছ।’

নয়পাল বলিলেন— ‘এ বস্তু পেলে একজন সামান্য রাজা সারা পৃথিবী জয় করতে পারে।’

দীপঙ্কর বলিলেন— ‘ঠিক এই কথা আমিও ভাবছিলাম। পৃথিবী জয়ের কথা নয়, সম্প্রতি ভারতবর্ষে যে উৎপাত এসেছে তাকে দূর করার কথা। বর্বর তুরস্কদের বিতাড়িত করতে হলে এই বস্তুটির একান্ত প্রয়োজন।’

বিনয়ধর ধীরে ধীরে বলিলেন— ‘আচার্য দীপঙ্কর, আজ আপনারা অগ্নিকন্দুকের যে-ক্রিয়া দেখেছেন তা এর শক্তির সামান্য নিদর্শন মাত্র। অমিতশক্তি এই অগ্নিপদার্থ, এর সাহায্যে মুষ্টিমেয় লোক একটা রাজ্য ছারখার করে দিতে পারে, অগণিত শত্রুকে নাশ করতে পারে।’

দীপঙ্কর বলিলেন— ‘সম্ভব। যেখানে শক্তি আছে সেখানে শক্তি-প্রয়োগের কৌশল জানা থাকলে কিছুই অসম্ভব নয়। আচার্য বিনয়ধর, এই অগ্নিকন্দুক আপনি কত এনেছেন?’

‘যা এনেছিলাম সবই প্রায় শেষ হয়ে গেছে, আর্য কেবল একটি অবশিষ্ট আছে।’ বলিয়া বিনয়ধর নিজের জটিল বস্ত্রাবরণের ভিতর হইতে একটি গোলক বাহির করিয়া সকলের সম্মুখে রাখিলেন।

সকলের নিষ্পলক নেত্র ক্ষুদ্র গোলকের উপর নিবদ্ধ হইল। এই বিশেষত্বহীন ক্ষুদ্রকন্দুকের মধ্যে যে এত শক্তি নিহিত আছে তাহা বিশ্বাস হয় না। বিগ্রহপাল একবার সেদিকে লোলুপ হস্ত প্রসারিত করিয়া আবার হাত টানিয়া লইলেন। বিনয়ধর সহস্যে বলিলেন— ‘আপনি স্বচ্ছন্দে ওটি হাতে নিতে পারেন। সজোরে আছড়ে না মারলে ওর শক্তি আত্মপ্রকাশ করে না।’

বিগ্রহপাল সন্তর্পণে গোলকটি তুলিয়া লইয়া পরম কৌতূহলভারে ঘুরাইয়া ফিরাইয়া দেখিলেন, তারপর আবার সন্তর্পণে রাখিয়া দিলেন। দীপঙ্কর একটি নিশ্বাস ফেলিলেন— ‘মাত্র একটি। কিন্তু একটি দিয়ে তো তুরস্কদের তাড়ানো যাবে না। অনেক চাই। আচার্য বিনয়ধর, আপনি এই বস্তুর নির্মাণ কৌশল জানেন?’

বিনয়ধর ধীরে ধীরে মাথা নাড়িলেন— ‘না আর্য। তিব্বতে কেউ এ গূঢ়বিদ্যা জানে না। কেবল চীনদেশে মুষ্টিমেয় বিজ্ঞানবিৎ আছেন যাঁরা এর রহস্য জানেন। আমাদের মহারাজ তাঁদেরই একজন আনিয়ে এই অগ্নি-ক্রীড়নকগুলি প্রস্তুত করিয়ে আপনার জন্যে পাঠিয়েছেন। এগুলি খেলার সামগ্রী মাত্র; এর চেয়ে শতগুণ ভীষণ অস্ত্র তাঁরা নির্মাণ করতে জানেন।’

কিছুক্ষণ কোনও কথা হইল না। দীপশিখার আলোকে পাঁচটি মূর্তি সম্মুখস্থ অগ্নিকন্দুকের পানে চাহিয়া বসিয়া আছেন। অবশেষে দীপঙ্কর বলিলেন— ‘এই গূঢ়বিদ্যা যদি কেউ শিখতে চায় তাঁরা কি শেখাবেন?’

বিনয়ধর বলিলেন— ‘সকলকে শেখাবেন না। দুষ্ট লোকের হাতে এ বিদ্যা সর্বনাশা হয়ে উঠতে পারে, মনুষ্যজাতিকে ধ্বংস করে ফেলতে পারে। তাই তাঁরা এ বিদ্যা সহজে কাউকে দেন না। তবে যদি কোনও শুদ্ধ-সাত্ত্বিক সাধু ব্যক্তি লোকহিতের জন্য শিখতে চান তাহলে শেখাতে পারেন।’

দীপঙ্কর বিনয়ধরের দিকে ঈষৎ ঝুঁকিয়া সাগ্রহকণ্ঠে বলিলেন— ‘আচার্য বিনয়ধর, আপনি জানেন ভারতের পশ্চিমপ্রান্তে এক মহা আপৎ উপস্থিত হয়েছে। সংক্রামক ব্যাধির মত এ আপৎ ক্রমে পূর্বদিকে এগিয়ে আসছে। একে যদি সময়ে শাসন করা না যায় তাহলে ভারতের সংস্কৃতি ঐতিহ্য কিছু থাকবে না, সংঘ এবং ধর্ম ভারত থেকে লুপ্ত হয়ে যাবে, এই বিক্রমশীল বিহার ভগ্নস্তূপে পরিণত হবে। আমাদের এই মহা আশঙ্কার দিনে মহাচীনের বিজ্ঞানবিৎ সাধুরা কি আমাদের সাহায্য করবেন না?’

বিনয়ধর বলিলেন— ‘অবশ্য করবেন। কিন্তু মহাচার্য, অযোগ্য ব্যক্তিকে তাঁরা এই মহা গুহ্যবিদ্যা দেবেন না।’

দীপঙ্কর বলিলেন— ‘না, না, অযোগ্য ব্যক্তিকে এ বিদ্যা দান করা কদাপি উচিত নয়। — একটা কথা জিজ্ঞাসা করি, মহারাজ নয়পাল যদি চৈনিক গুণীদের ভারতে আসতে আমন্ত্রণ করেন, তাঁরা আসবেন কি?’

বিনয়ধর মাথা নাড়িলেন— ‘না আর্য, আসবেন না। আমাদের মহারাজ অতি কষ্টে একজন গুণীকে তিব্বতে আনিয়েছেন, আর অধিক দূর তিনি আসবেন না। হিমালয়ের দুর্লঙ্ঘ্য বাধা অতিক্রম করা তাঁর পক্ষে অসম্ভব।’

দীপঙ্কর কিয়ৎকাল চিন্তা করিয়া বলিলেন— ‘মনে করুন, বিক্রমশীল বিহারের কোনও বিদ্যার্থী বা আচার্য যদি তিব্বতে যান, তিনি শেখাবেন কি?’

বিনয়ধরের ওষ্ঠপ্রান্তে একটু হাসি খেলিয়া গেল, তিনি বলিলেন— ‘জানি না আর্য। কিন্তু একটা কথা বলতে পারি। বিক্রমশীল বিহারের মহাচার্য অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান যদি যান, তাঁকে অবশ্য শেখাবেন।’

দীপঙ্কর কিছুক্ষণ বিনয়ধরের গূঢ়হাস মুখের পানে চাহিয়া রহিলেন, ক্রমে তাঁহার অধরকোণেও একটু হাসি ফুটিয়া উঠিল। ‘বুঝেছি’— বলিয়া তিনি করলগ্নকপোলে গভীর চিন্তায় আচ্ছন্ন হইয়া পড়িলেন।

বিনয়ধরের কৌশল অন্য সকলেও বুঝিয়াছিলেন। রত্নাকর শান্তি সন্ত্রস্ত হইয়া কাতরকণ্ঠে বলিয়া উঠিলেন— ‘অতীশ, তুমি যদি চলে যাও—’

দীপঙ্কর মুখ তুলিয়া দৃঢ়স্বরে বলিলেন— ‘আমিই তিব্বতে যাব। বিনয়ধর, তোমার ইচ্ছাই পূর্ণ হল। হয়তো বুদ্ধেরও তাই ইচ্ছা।’ তিনি অগ্নিকন্দুকটি সাবধানে তুলিয়া লইয়া উঠিয়া দাঁড়াইলেন— ‘আজ মন্ত্রণা স্থগিত হোক, রাত্রি অনেক হয়েছে। — মহারাজ, আপনি আর কুমার বিগ্রহ এই কক্ষেই শয়ন করুন, আমরা ছাদে থাকব। কাল প্রাতে লক্ষ্মীকর্ণের সঙ্গে বোঝাপড়া আছে।’

রত্নাকরও উঠিয়া দাঁড়াইলেন, কাকুতি-ভরা স্বরে বললিলেন— ‘চন্দ্রগর্ভ, কিন্তু তোমার অবর্তমানে—’

দীপঙ্কর তাঁহার স্কন্ধে হাত রাখিয়া বলিলেন— ‘রত্নাকর, আমাকে তিব্বতে যেতেই হবে। এ বিদ্যা না শিখতে পারলে ভারতের রক্ষা নেই। সামনেই হিমঋতু, সুতরাং যত শীঘ্র সম্ভব যাত্রা করব। তুমি চিন্তা কোরো না, গূঢ়বিদ্যা শিখে আমি অবিলম্বে ফিরে আসব।’

আট

পরদিন পূর্বাহ্ণে আবার সভা বসিয়াছে। এবার ছাদে নয়, নিম্নের একটি প্রকোষ্ঠে। দীপঙ্কর মাঝখানে বসিয়াছেন, একপাশে সপুত্র নয়পাল, অন্যপাশে লক্ষ্মীকর্ণ ও তাঁহার সহচর নবীন যুবা। রত্নাকর শান্তি ও বিনয়ধর আজিকার সভায় উপস্থিত নাই। গত সন্ধ্যাকালে বিহারে যে বিশৃঙ্খলা ঘটিয়াছিল, রত্নাকর শান্তি তাহার শোধন-সংস্কারে ব্যস্ত আছেন, বিদ্যার্থীরা ভয়চঞ্চল হইয়া উঠিয়াছে, তাহাদের শান্ত করিতেছেন। আর আচার্য বিনয়ধর সঙ্গীদের লইয়া বিহারভূমির একটি আমলক বৃক্ষতলে বসিয়া সহর্ষে হাত ঘষিতেছেন এবং বলিতেছেন— ‘জয় সিদ্ধার্থ! দীপঙ্কর তিব্বতে যাবেন! জয় সিদ্ধার্থ!’ তিনি মাঝে মাঝে গিয়া বিগলিত চিত্তে মন্ত্রণাগৃহে উঁকি মারিয়া আসিতেছেন।

মন্ত্রণাগৃহের বাতাবরণ কিছু আতপ্ত। প্রকাশ্যে নয়পাল বা লক্ষ্মীকর্ণ কোনও প্রকার পারুষ্য প্রকাশ করিতেছেন না বটে, কিন্তু উভয়েরই রক্ত প্রবাহ উষ্ণ হইয়া উঠিয়াছে। নয়পাল স্থির-কষায় নেত্রে লক্ষ্মীকর্ণকে নিরীক্ষণ করিতেছেন, নরাধমটাকে হাতে পাইয়াও কিছু করিতে পারিতেছেন না এই ক্ষোভ তাঁহার অন্তরে তুষানলের মত জ্বলিতেছে। অপরপক্ষে লক্ষ্মীকর্ণের পারুষ্য দেখাইবার মত অবস্থা নয়, তিনি বড়ই বিপাকে পড়িয়া গিয়াছেন; নিরস্ত্র নিঃসহায় অবস্থায় শত্রুর সম্মুখীন হইয়া বিক্রম প্রকাশের সুবিধা পাইতেছেন না। সৈন্যগুলা যদি পিশাচের ভয়ে না পলাইত তাহা হইলেও বা কথা ছিল। লক্ষ্মীকর্ণ মাঝে মাঝে তির্যকভাবে নয়পালের দিকে ব্যাঘ্র-দৃষ্টি নিক্ষেপ করিতেছেন।

বিগ্রহপাল ও অপরপক্ষীয় যুবকটি কিন্তু পরস্পরের প্রতি বিদ্বেষভাবাপন্ন নয়। দুইজনের বয়স প্রায় সমান, বিগ্রহপাল সম্ভবত দুই তিন বছরের ছোট, দুইজনেরই দু’জনকে ভাল লাগিয়াছে। বিপক্ষদল না হইলে তাঁহারা এতক্ষণ ভাব করিয়া ফেলিতেন, কিন্তু বর্তমানে তাঁহারা কেবল পরস্পরের প্রতি অপাঙ্গদৃষ্টি প্রেরণ করিয়াই নিবৃত্ত আছেন।

মন্ত্রণাসভার আলোচনা কণ্টকাকীর্ণ পথে অগ্রসর হইতেছে। দীপঙ্কর বলিতেছেন— কৌটিল্যনীতি আমি অবগত আছি— অন্তরহীন রাজ্যের অধিপতিরা পরস্পর শত্রু। সুখের বিষয়, রাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রেও একথা আংশিক সত্য। প্রতিবেশীদের মধ্যে যেমন বৈরভাব থাকতে পারে তেমনি মৈত্রভাবও থাকতে পারে। সজ্জন প্রতিবেশী পরস্পর ভরণ করে, কেবল দুর্জন প্রতিবেশী পরস্পর অনিষ্টচিন্তা করে। একথা সামান্য গৃহস্থ সম্বন্ধে যেমন সত্য রাজাদের সম্বন্ধেও তেমনি সত্য।’

লক্ষ্মীকর্ণ যেন অবোধ শিশুকে বুঝাইতেছেন এমনি ধীরতার অভিনয় করিয়া বলিলেন— ‘মহাশয়, সামান্য গৃহস্থের সঙ্গে ক্ষত্রিয় রাজা তুলনীয় নয়। যুদ্ধ করা ক্ষত্রিয় রাজার ধর্ম।’ তিনি মৃগয়া করিতে গিয়া ভ্রমক্রমে মগধরাজ্যে প্রবেশ করিয়াছেন এই হাস্যকর ভান বহুপূর্বেই পরিত্যক্ত হইয়াছে।

দীপঙ্কর ভ্রূ তুলিয়া বলিলেন— ‘যুদ্ধ করা ক্ষত্রিয় রাজার ধর্ম একথা আপনি কোথায় পেলেন?’

‘আমাদের ধর্মশাস্ত্রে আছে।’ লক্ষ্মীকর্ণ এমনভাবে কথাটা বলিলেন যেন ধর্মশাস্ত্রের অনুশাসন বিনা তিনি এক পা চলেন না।

দীপঙ্কর দৃঢ়স্বরে বলিলেন— ‘কদাপি নয়। আর্তের ত্রাণই ক্ষত্রিয়ের ধর্ম। মহারাজ, আপনি ধর্মে বৈষ্ণব, স্মরণ করুন স্বয়ং বিষ্ণুর অবতার শ্রীকৃষ্ণ কি বলেছেন। ধর্মযুদ্ধই শ্রেয়ঃ, তস্করবৃত্তি ক্ষাত্রধর্ম নয়।’

লক্ষ্মীকর্ণ উগ্রভাবে উত্তর দিতে যাইতেছিলেন, কিন্তু এই সময় তাঁহার চোখে পড়িল দ্বারের নিকট হইতে গতরাত্রের পিশাচটা উঁকি মারিতেছে। মহারাজের ক্ষাত্রতেজ অমনি প্রশমিত হইল। একে তো দীপঙ্করের সঙ্গে শাস্ত্র সম্বন্ধীয় তর্কে জয়ের আশা নাই, লোকটা ঘোর পণ্ডিত; উপরন্তু তাহার পোষা পিশাচ আছে। মহারাজ ঢোক গিলিয়া নীরব হইলেন।

নয়পাল অধীরভাবে বলিলেন— ‘মহাচার্য, পাথরে জল ঢেলে লাভ কি? পাথর গলবে না। এখন কর্তব্য কি তাই আদেশ করুন।’

দীপঙ্কর বলিলেন— ‘কর্তব্য শান্তি রক্ষা, মৈত্রী রক্ষা। দেশে বহিঃশত্রু দেখা দিয়েছে, এ সময় যদি আপনারা কলহ করেন তাহলে দু’জনেই ধ্বংস হবেন।’

নয়পাল কহিলেন— ‘আমি কলহ করিনি। কলহ বিবাদ আমার ভাল লাগে না।’

লক্ষ্মীকর্ণ কথা কহিলেন না, কেবল নাকের মধ্যে একপ্রকার শব্দ করিলেন। নয়পালের চক্ষু জ্বলিয়া উঠিল। দীপঙ্কর হাত তুলিয়া তাঁহাকে নিবারণ করিলেন, বলিলেন— ‘এভাবে প্রশ্নের মীমাংসা হবে না। যেখানে এক পক্ষ কলহ করবার জন্য বদ্ধপরিকর সেখানে কলহ অপরিহার্য। কুরু-পাণ্ডবের যুদ্ধে পাণ্ডবেরা শান্তি চেয়েছিল, কিন্তু শান্তি রক্ষা হয়নি। আমি কাল রাত্রে অনেক চিন্তা করেছি। আমার একটি প্রস্তাব আছে।’

লক্ষ্মীকর্ণ সন্দিগ্ধ চক্ষে দীপঙ্করের পানে চাহিলেন। নয়পাল বলিলেন— ‘আদেশ করুন আর্য।’

দীপঙ্কর একবার দুই পার্শ্বস্থ দুই রাজার দিকে দৃষ্টি ফিরাইলেন, তারপর অত্বরিত কণ্ঠে বলিলেন— ‘স্বভাব বশে যদি দুই রাজার মধ্যে মৈত্রী না হয় তখন কুটুম্বিতার দ্বারা মৈত্রী স্থাপনের প্রথা আছে। মহারাজ নয়পাল, আপনার পুত্র যুবরাজ বিগ্রহপালের বিবাহযোগ্য বয়স হয়েছে। আমার প্রস্তাব, কুমার বিগ্রহের সঙ্গে মহারাজ লক্ষ্মীকর্ণের কন্যার বিবাহ হোক।’

প্রকোষ্ঠের মধ্যে যেন বিদ্যুৎ খেলিয়া গেল। বিগ্রহপাল চকিতে মুখ তুলিয়া লক্ষ্মীকর্ণের পানে চাহিলেন। লক্ষ্মীকর্ণের সহচর যুবক উৎফুল্ল মুখে বিগ্রহের প্রতি কৌতুকদৃষ্টি নিক্ষেপ করিলেন। লক্ষ্মীকর্ণ ক্ষণেক স্তম্ভিত থাকিয়া লাফাইয়া উঠিলেন— ‘অসম্ভব! আমার কন্যা— অসম্ভব!’ নয়পালও নেত্রদ্বয় ঘূর্ণিত করিয়া আপত্তি করিতে যাইতেছিলেন, কিন্তু লক্ষ্মীকর্ণের লম্ফঝম্ফ দেখিয়া তাঁহার মন বিপরীত-মুখী হইল। লক্ষ্মীকর্ণের যখন আপত্তি তখন তাহার কন্যার সহিত তিনি বিগ্রহের বিবাহ দিবেন। স্ত্রীরত্নং দুষ্কুলাদপি।

লক্ষ্মীকর্ণ আরও কয়েকবার অসংলগ্নভাবে ‘অসম্ভব’ বলিয়া ক্রমশ নীরব হইলেন। তাঁহার বিরাগপূর্ণ অসম্মতি ভেদ করিয়া কূটবুদ্ধি ও পিশাচভীতি আবার মাথা তুলিল। এরূপ অবস্থায় ঝগড়া করা চলে না, কৌশলে আত্মরক্ষার প্রয়োজন। কৌশল! সাপও মরিবে দণ্ডও ভাঙিবে না। তারপর একবার এই বেড়া-জাল ছিঁড়িয়া বাহির হইতে পারিলে—

রাজাদের ভাবভঙ্গি দেখিয়া দীপঙ্করের মুখ গম্ভীর হইয়াছিল। তিনি প্রশ্ন করিলেন— ‘মহারাজ নয়পাল, আপনার আপত্তি আছে?’

নয়পাল পরম ভক্তিভরে বলিলেন— ‘আপনি আমার গুরু, আপনার আদেশ অলঙ্ঘনীয়। আপনি যদি চণ্ডাল কন্যা ঘরে আনতে বলেন, তাও আনতে পারি।’

বক্রোক্তিটা লক্ষ্মীকর্ণ ভাল করিয়া হৃদয়ঙ্গম করিবার পূর্বেই দীপঙ্কর তাঁহার দিকে ফিরিয়া বলিলেন— ‘আপনার যে সম্মতি নেই তা বুঝতে পারছি। ভাল— আমার সাধ্যমত আপনার ইষ্টচেষ্টা আমি করলাম, কিন্তু তা যখন আপনার মনঃপূত নয় তখন আমি আর কি করতে পারি। আপনারা পবিত্র সংঘের বাহিরে গিয়ে পরস্পর সম্বন্ধ নিরূপণ করুন। আমার আর কিছু বলবার নেই।’

দীপঙ্কর গাত্রোত্থান করিবার উপক্রম করিতেছেন দেখিয়া লক্ষ্মীকর্ণ সন্ত্রস্ত হইয়া উঠিলেন। তিনি ইতিমধ্যে একটি ফন্দি বাহির করিয়াছিলেন, তাড়াতাড়ি বলিলেন— ‘না না, আচার্য, আমাকে সম্পূর্ণ ভুল বুঝেছেন। কন্যার বিবাহ দিতে আমার কোনও আপত্তি নেই। কিন্তু আপনি বিবেচনা করুন, আমার কন্যা বিবাহিতা; বিবাহিত কন্যাকে তো দ্বিতীয়বার সম্প্রদান করতে পারি না। এই দেখুন আমার জামাতা। এঁর নাম জাতবর্মা। বংগাল দেশের মহাপরাক্রান্ত রাজা বজ্রবর্মা এঁর পিতা।’

লক্ষ্মীকর্ণ পার্শ্বে উপবিষ্ট যুবককে নির্দেশ করিলেন। বাকি তিনজন এতক্ষণে যুবককে ভাল করিয়া দেখিলেন। বিগ্রহপালের মুখে চকিত হাসির বিদ্যুৎ স্ফুরিত হইল। দীপঙ্কর বলিলেন— ‘ইনি আপনার জ্যেষ্ঠ জামাতা। কিন্তু আপনার আর একটি অনূঢ়া কন্যা আছে।’

লক্ষ্মীকর্ণ আবার বিপদে পড়িয়া গেলেন। এই ভিক্ষুগুলা সব খবর রাখে, কোন্‌ রাজার কয়টা মেয়ে তাহাও ইহাদের অজ্ঞাত নয়। মনে মনে সমস্ত ভিক্ষুসমাজকে নিরয়গামী করিয়া তিনি স্খলিতস্বরে কহিলেন— ‘অ্যাঁ— তা— আমার কনিষ্ঠা কন্যা— অর্থাৎ—’

সহসা তাঁহার উর্বর মস্তিষ্কে আর একটি সুবুদ্ধি জন্মলাভ করিল; তিনি প্রকৃতিস্থ হইয়া অপেক্ষাকৃত দৃঢ়স্বরে বলিলেন— ‘আচার্যদেব, আমাকে ক্ষমা করুন। অবস্থাবিপর্যয়ে আমার চিত্ত বিক্ষিপ্ত হয়েছে, তাই প্রকৃত কথা ভাল করে বলতে পারছি না। এখন বলি শুনুন। — আমার বংশে দীর্ঘকাল যাবৎ একটি প্রথা চলে আসছে, প্রত্যেক রাজা অন্তত একটি কন্যাকে স্বয়ংবরা করবেন। সহস্র বৎসরের মধ্যে চেদিবংশে এই প্রথার অন্যথা হয়নি। আমার দুই কন্যা। প্রথমা কন্যা বীরশ্রীর স্বয়ংবর হয়নি, সৎপাত্র পেয়ে তাঁর হাতেই কন্যা সমর্পণ করেছিলাম। সুতরাং কনিষ্ঠা কন্যা যৌবনশ্রীর স্বয়ংবর করতেই হবে। যদি না করি পিতৃপুরুষেরা রুষ্ট হবেন, পিণ্ডোদক গ্রহণ করবেন না। এখন আপনিই বিচার করুন, কি করে কুমার বিগ্রহপালের সঙ্গে কন্যার বিবাহ দিতে পারি।’

কিছুক্ষণ সকলে নীরব রহিলেন। দীপঙ্কর মনে মনে বিচার করিতে লাগিলেন— লক্ষ্মীকর্ণ সম্ভবত মিথ্যা গল্প বানাইয়া বলিতেছে, কিন্তু গল্প না হইতেও পারে। তাঁহার মনে পড়িল, অনুমান ত্রিশ বৎসর পূর্বে গাঙ্গেয়দেবের এক কন্যা, অর্থাৎ লক্ষ্মীকর্ণের ভগিনী স্বয়ংবরা হইয়াছিল। এরূপ অবস্থায় বংশের ধারা লঙ্ঘন করিতে জোর করিলে উৎপীড়ন করা হয়।

দীপঙ্কর একবার বিগ্রহপালের দিকে চক্ষু ফিরাইলেন। সুন্দরকান্তি যুবা, রাজবংশেও এমন সুপুরুষ দুর্লভ। দীপঙ্কর মনস্থির করিয়া বলিলেন— ‘মহারাজ লক্ষ্মীকর্ণ, আপনার অবস্থাবিপর্যয়ে আমাদের আনন্দ নেই, আপনাকে পীড়ন করাও আমাদের উদ্দেশ্য নয়। দুই রাজবংশে মৈত্রী-বন্ধন দৃঢ় হয় ইহাই কাম্য। — আপনি কবে আপনার কন্যার স্বয়ংবর সভা আহ্বান করবেন মনস্থ করেছেন?’

লক্ষ্মীকর্ণ কিছুই মনস্থ করেন নাই, কিন্তু তৎক্ষণাৎ বলিলেন— ‘আগামী চৈত্র মাসে।’

‘ভাল। স্বয়ংবর সভায় আপনি অনেক মিত্র রাজাকে আমন্ত্রণ করবেন। কুমার বিগ্রহকে আমন্ত্রণ করবেন কি?’

লক্ষ্মীকর্ণ কষ্টে আত্মসংবরণ করিয়া বলিলেন— ‘অবশ্য অবশ্য।’

‘কন্যা কুমার বিগ্রহের গলায় মাল্যদান করলে আপনার আপত্তি হবে না?’

‘কিছুমাত্র না।’

দীপঙ্কর নয়পালের পানে একবার চাহিলেন— ‘তাহলে এই স্থির রইল। মহারাজ লক্ষ্মীকর্ণ কন্যার স্বয়ংবর সভায় কুমার বিগ্রহকে আহ্বান করবেন। কন্যা যদি কুমারের গলায় বরমাল্য দান করে তাহলে দুই রাজবংশের মধ্যে কুটুম্ব-মৈত্রী স্থাপিত হবে। সমস্যার সম্যক সমাধান যদিও হল না, তবু মন্দের ভাল। আশা করি অন্তে শুভ হবে।’

লক্ষ্মীকর্ণ আসন ছাড়িয়া উঠিয়া দাঁড়াইলেন— ‘অবশ্য অবশ্য। আমি তাহলে নির্বিঘ্নে স্বরাজ্যে ফিরে যেতে পারি?’

দীপঙ্কর বলিলেন— ‘পারেন।’

নয়

আবার অপরাহ্ণ। আকাশে দুই একটি লঘু মেঘ ভাসিতেছে, গঙ্গায় দুই একটি পাল-তোলা নৌকা। পশ্চিম দিগন্তে স্বর্ণকুঙ্কুমের প্রলেপ।

দীপঙ্কর ছাদে একাকী বিচরণ করিতেছেন। এক অহোরাত্রের মধ্যে কত অভাবনীয় ব্যাপার ঘটিয়া গেল। দীপঙ্কর মনের মধ্যে এক অনভ্যস্ত উত্তেজনা অনুভব করিতেছেন। তিব্বত যাইবার কোনও সঙ্কল্পই ছিল না, অথচ ঘটনাচক্রের আবর্তনে তিব্বত যাওয়া স্থির হইয়াছে। কী অদ্ভুত আসুরিক বিদ্যা! এই বিদ্যা আয়ত্ত করিয়া ফিরিয়া আসিতে হইবে। তিব্বতের পথ হিম-দুর্গম, উপরন্তু দস্যু-অধ্যুষিত। তিনি ফিরিয়া আসিতে পরিবেন কি?— বুদ্ধের ইচ্ছা— সকলই বুদ্ধের ইচ্ছা।

আজ দ্বিপ্রহরে মহারাজ লক্ষ্মীকর্ণ জামাতা ও সহচরদের লইয়া প্রস্থান করিয়াছেন। তাঁহার মনে কী আছে তিনিই জানেন। সুখের বিষয় তাঁহার পলাতক সৈন্য ফিরিয়া আসে নাই। নয়পাল এখনও আছেন; তাঁহার সৈন্যদল নিকটবর্তী গ্রাম হইতে খাদ্য সংগ্রহ করিয়া লইয়াছে। কাল প্রাতে নয়পাল সসৈন্যে চম্পা নগরীতে চলিয়া যাইবেন। আপাতত তিনি পুত্রসহ সংঘেই আছেন।

নানা চিন্তায় মগ্ন হইয়া দীপঙ্কর তাঁহার শিশুতরুশ্রেণীর মধ্যে বিচরণ করিতেছেন এমন সময় রত্নাকর শান্তি ও বিনয়ধর আসিলেন। দীপঙ্কর হাসিয়া বলিলেন— ‘রত্নাকর, তুমি তোমার চাবির গোছা ফিরে পেয়েছ দেখছি।’

রত্নাকরের নিকট হইতে হাসির উত্তর আসিল না। বিষণ্ণমুখে তিনি বলিলেন— ‘অতীশ, তিব্বতে যাওয়া তবে স্থির? এ বিষয়ে আর একবার চিন্তা করে দেখবে না?’

দীপঙ্কর বলিলেন— ‘চিন্তা করবার আর কি আছে রত্নাকর? বুদ্ধের নাম নিয়ে যাত্রা করলেই হল। সামনে হিমঋতু, তার আগে তিব্বতে পৌঁছানো প্রয়োজন। আশীর্বাদ কর যেন সিদ্ধার্থ হই।’

রত্নাকর ক্ষুব্ধমুখে নীরব রহিলেন দেখিয়া বিনয়ধর সান্ত্বনার স্বরে বলিলেন— ‘আর্য রত্নাকর, আপনি মুহ্যমান হচ্ছেন কেন? আগামী বৎসর এই সময় অতীশ ফিরে আসবেন।’

রত্নাকর গভীর নিশ্বাস ত্যাগ করিয়া মুখ তুলিলেন, বিনয়ধরকে বলিলেন— ‘অতীশ না থাকলে ভারতবর্ষ অন্ধকার। বহু বৌদ্ধ প্রতিষ্ঠানের চাবি ওঁর হাতে, ওঁর অবর্তমানে সেই সব প্রতিষ্ঠান শূন্য হয়ে যাবে। চারিদিকের অবস্থা দেখে মনে হয় ভারতবর্ষের দুর্দিন ঘনিয়ে আসছে; আমি অত্যন্ত চিন্তিত হয়েছি। তবু আশীর্বাদ করি তোমরা অতীশকে নিয়ে তোমাদের দেশে ফিরে যাও, সকল প্রাণীর কল্যাণে অতীশের কর্ম ও সেবা নিয়োজিত হোক। — অতীশ, তোমার অনুপস্থিতি কালে আমি কি করব বলে দাও।’

দীপঙ্কর রত্নাকরের স্কন্ধে হাত রাখিলেন, চারিদিকের শিশুবৃক্ষগুলির উপর স্নেহক্ষরিত দৃষ্টি বুলাইয়া বলিলেন— ‘আমার অবর্তমানে এই গাছগুলির পরিচর্যা কোরো। এরা যখন বড় হবে তখন বিহারভূমিতে এদের রোপণ কোরো। দেখো যেন সেবার অভাবে এরা শুকিয়ে না যায়।’—

দিনের আলো মুদিত হইয়া আসিতেছে। রত্নাকর ও বিনয়ধর নীচে নামিয়া গিয়াছেন। দীপঙ্কর একাকী।

বিগ্রহপাল আসিয়া প্রণাম করিলেন।

দীপঙ্কর বলিলেন— ‘কী বিগ্রহ?’

বিগ্রহপাল সলজ্জ হাসিয়া বলিলেন— ‘একটি ভিক্ষা আছে।’

‘ভিক্ষা! কি ভিক্ষা?’

‘ওই অগ্নিকন্দুকটি আমায় দান করুন।’

দীপঙ্কর হাসিলেন।

‘ছেলেমানুষ! ও নিয়ে কি করবে?’

‘তা জানি না। কাছে রাখব। হয়তো কোনও দিন কাজে লাগবে।’

‘এস দিচ্ছি। কিন্তু ওর অপব্যবহার কোরো না।’

নিজের দারু-প্রকোষ্ঠে লইয়া গিয়া দীপঙ্কর বিগ্রহপলকে অগ্নিকন্দুকটি বাহির করিয়া দিলেন। বলিলেন— ‘এটিকে শুষ্ক স্থানে রেখো, যেন ভিজে না যায়। বিনয়ধর বলছিলেন জল লাগলে এর গুণ নষ্ট হয়ে যায়।’

‘যে আজ্ঞা।’

‘আর একটা কথা। — লক্ষ্মীকর্ণের নিমন্ত্রণ পেলে স্বয়ংবর সভায় যেও। তারপর বুদ্ধের ইচ্ছা।’

‘যে আজ্ঞা।’

এইখানেই বলিয়া রাখা যাইতে পারে যে দীপঙ্কর অল্পকাল মধ্যেই তিব্বত যাত্রা করিয়াছিলেন; তারপর সেখানে ত্রয়োদশ বর্ষ যাপন করিয়া সেইখানেই দেহরক্ষা করেন, আর ভারতবর্ষে ফিরিয়া আসিতে পারেন নাই। তিনি গূঢ়বিদ্যা শিখিয়ছিলেন কিনা এবং শিখিয়া থাকিলে কেন স্বদেশে ফিরিয়া আসিলেন না এ সম্বন্ধে ইতিহাস সম্পূর্ণ নীরব।