তুমি পিশাচ – ৫

পাঁচ

তিন দিন স্কুল ছুটি দেওয়া হল৷ তার সঙ্গে রবিবার জুড়ে গিয়ে চার দিন৷ সেই চারদিনে পুলিশি তদন্ত মোটামুটি একটা জায়গায় এসে দাঁড়াল৷ কিন্তু পরানের দেহের রক্তশূন্যতার কোনও ব্যাখ্যা পাওয়া গেল না৷ পুলিশের রিপোর্টে হায়েনা, গোসাপ কিংবা বড়সড় কোনও বেজির আক্রমণের সম্ভাবনার কথা বলা হল—যদিও পুলিশের লোকজনের কাছে প্রচুর প্রশ্নচিহ্ন থেকে গেল৷

ব্যাপারটা নিয়ে জল ঘোলা যাতে কম হয় সেইজন্য প্রীতি দত্ত পুলিশের কাছে স্টেটমেন্টে শুধু রবিনা ম্যাডামের কথা বলেছেন৷ বলেছেন, সেই রাতে ওইসব আজগুবি কাণ্ডকারখানা রবিনা ম্যাডাম একা দেখেছেন—ছাত্রীরা কেউ দেখেনি৷ তাই ইলিনারা পুলিশের জেরা থেকে রেহাই পেয়ে গেছে৷

সোমবার স্কুলে গিয়ে স্কুলটাকে নতুন চোখে দেখতে চাইল ইলিনা৷

আজ বৃষ্টি নেই৷ আকাশে মেঘের চেহারা অনেক ফিকে৷ কিন্তু সেই রাতের ঘটনাটা চোখের সামনে থেকে কিছুতেই সরে যাচ্ছে না৷

কালো মেঘ৷ লিকলিকে শাখা-প্রশাখা ছড়ানো মরা গাছ৷ অন্ধকার রাত৷ আর সেই উজ্জ্বল আলোর চোখ৷

ঘটনার পরদিন সকালে স্কুলের দিকে আসার সময় মরা গাছটার কাছে গিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়েছিল ইলিনা৷ ওটার চারপাশে খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে নজর বুলিয়েছিল৷ কিন্তু গতকাল রাতের ওই ঘটনার কোনও চিহ্ন খুঁজে পায়নি৷ তা সত্ত্বেও ওর গা ছমছম করছিল৷

তারপর, পরানের অপঘাতে মারা যাওয়ার খবরটা পাওয়ার পর, ওর মনে হয়েছে, ওই ‘খারাপ’ প্রাণীগুলো কখনও চিহ্ন রেখে যায় না৷

আজ সকালেও স্কুলে আসার সময় দূর থেকে ওই মরা গাছটার দিকে ইলিনা তাকিয়ে থেকেছে৷ আর তখনই এক অদ্ভুত শিরশিরানি টের পেয়েছে শরীরে৷

আজ ক্লাসে ঢুকে অনুষ্কাকে দেখতে পেয়ে ওর খুব ভালো লাগল৷ সুন্দর টলটলে মুখটি নিয়ে চুপচাপ নিজের ডেস্কে বসে আছে৷ ওর মুখের ডানপাশে জানলা দিয়ে আলো এসে পড়েছে৷ সেই আলোয় ওকে কেমন যেন স্বপ্নের মতো দেখাচ্ছে৷ নিজের চিন্তায় ডুবে থাকা এক রূপসী৷

অনুষ্কার দু-পাশে রেখা আর সঞ্চিতা বসে৷ দুজনের মধ্যে রেখার সঙ্গে ইলিনার রিলেশানটা বেটার৷ তাই ও রেখাকে বলে বসার জায়গা অদলবদল করল৷ পিঠের ব্যাগ হাতে নিয়ে অনুষ্কার পাশের ডেস্কে বসে পড়ল৷

‘অনেকদিন তোমাকে দেখিনি৷’ ইলিনা হেসে বলল৷

‘স্কুল তো ছুটি ছিল৷ তা ছাড়া সেই বাজে দিনটায় আমি তো আসিনি…তার পরের দিনও আসিনি৷’

না এলেও অনুষ্কা ফোনে-ফোনে সব ঘটনাই জেনে গেছে৷ বড়দি যতই বারণ করে থাকুন, এই ভয়ংকর বিচিত্র ব্যাপারটা নিয়ে চাপা কথাচালাচালি মোটেই বন্ধ হয়নি৷

ইলিনাও এই ছুটির মধ্যে অনুষ্কাকে ফোন করেছিল৷ ওর সঙ্গে ফোনে কথা বলে ইলিনার মনে হয়েছিল অনুষ্কা যেন কিছু বলতে চায় কিন্তু বলতে পারছে না৷

ক্লাস শুরু হতে এখনও সাতমিনিট বাকি৷ তাই গোটা ক্লাসে ভোমরার গুনগুন চলছিল৷ ইলিনা অনুষ্কার কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে বলল, ‘জানো, আমার না এখন স্কুলে আসতে ভয় করে…৷’

‘কেন?’ অনুষ্কা ভুরু তুলে তাকাল৷

‘ওই রাতটার কথা বারবার মনে পড়ে…৷’

অনুষ্কা একটা হাত রাখল ইলিনার হাতে৷ ওর ছোঁয়া ইলিনার ভালো লাগল৷ সেই ছোঁয়ায় কেমন যেন একটা ভরসা ছিল৷

কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকার পর অনুষ্কা আলতো গলায় বলল, ‘আজ ছুটির পর তুমি বরং আমার বাড়িতে চলো৷ বাপি গাড়ি নিয়ে আমাকে নিতে আসবে৷ তারপর বাড়িতে গিয়ে আমরা অনেক গল্প করব৷ সময়টা দারুণ কাটবে৷ তুমি—৷’

‘তোমার কোনও প্রবলেম হবে না তো!’ ইলিনা কথাটা বলল বটে, কিন্তু ওর ভেতরে-ভেতরে খুব আনন্দ হচ্ছিল৷ সেই প্রথম দিন থেকেই ও অনুষ্কার সঙ্গে আলাপ করতে চেয়েছে, বন্ধুত্ব করতে চেয়েছে৷ আর আজ অনুষ্কা নিজে থেকেই ওকে ওর বাড়িতে যেতে বলছে! এই প্রথম৷

‘না, না, প্রবলেম কীসের!’ অনুষ্কা তাড়াতাড়ি বলল, ‘আমিই তো তোমাকে আসার জন্যে রিকোয়েস্ট করছি৷’

‘কিন্তু বাড়িতে ফোন করে একটু বলতে হবে—নইলে মা ভীষণ টেনশান করবে৷’

স্কুলে মোবাইল ফোন ব্যবহার করা শুধু নয়, সঙ্গে করে নিয়ে আসাটাই বারণ৷ এ নিয়ে গত বছরে একটা বড়সড় গোলমাল হয়েছিল৷ সুতরাং ইলিনার মুখে চিন্তার রেখা ফুটে উঠল৷ ওদের কারও কাছে সেলফোন নেই৷ মা-কে ফোন করে খবরটা দেবে কেমন করে!

ওর মনের কথা অনুষ্কা বোধহয় টের পেল৷ বলল, ‘তোমার কোনও চিন্তা নেই৷ বাপির সঙ্গে মোবাইল থাকে৷ ছুটির পর বাপির ফোন থেকে তুমি আন্টিকে ফোন করে দিয়ো৷ তার সঙ্গে বোলো, আন্টি যেন তোমার ফেরার চিন্তা না করেন৷ বাপি তোমাকে গাড়ি করে পৌঁছে দিয়ে আসবে—অবশ্য বাপির সঙ্গে আমিও থাকব৷’ হেসে কথাটা শেষ করল অনুষ্কা৷ কিন্তু তারপরই হঠাৎ চাপা গলায় বলল, ‘আমার বাড়িতে যাচ্ছ এ-কথাটা কাউকে এখন বোলো না…প্লিজ…৷’

‘বলব না৷’ মাথা হেলিয়ে বলল ইলিনা৷ ভাবল, অনুষ্কাটা এত মুখচোরা কেন কে জানে! তা ছাড়া ওর বাড়িতে যাওয়ার ব্যাপারটা গোপন করারই বা কী আছে?

ইলিনার একটু অবাক লাগছিল৷ যে-অনুষ্কা সবার সঙ্গে আলাপ-টালাপ করার ব্যাপারটা সবসময় এড়িয়ে চলে সে হঠাৎ ইলিনাকে বাড়িতে নেমন্তন্ন করছে! এ-ক’দিনে ও হঠাৎ পালটে গেল কেন?

সে যাই হোক, ইলিনার মনটা খুশি-খুশি হয়ে উঠল৷ আর তখনই স্কুলের প্রথম ক্লাস শুরু হওয়ার ঘণ্টা পড়ল৷

একটার পর একটা ক্লাস পেরিয়ে সময়টা ক্রমশ বিকেলের দিকে গড়াতে লাগল, আর ইলিনার উৎফুল্লতা তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাড়তে লাগল৷

টিফিনের সময় অনেকের সঙ্গে কথাবার্তা বলতে গিয়ে ইলিনা বুঝল, এমনিতে সবাই চুপচাপ থাকলেও পরানের ব্যাপারটা নিয়ে ভালোরকম ফিসফাস কানাকানি হচ্ছে৷

খবরটা কোনও নিউজ চ্যানেলে দেখায়নি কিংবা কাগজেও ছাপেনি৷ হয়তো প্রীতি দত্তের অনুরোধে কিংবা প্রভাবে পুলিশ মুখে কুলুপ এঁটেছে আর মিডিয়া হাত গুটিয়ে বসে থেকেছে৷ কিন্তু ‘হুইসপারিং ক্যাম্পেন’ বসে থাকেনি৷

টিফিনের সময় ইলিনা একা-একাই টিফিন খেল৷ ওর শত অনুরোধেও অনুষ্কা ওর টিফিন শেয়ার করল না৷ বারবার সুন্দর করে হেসে বলল, ‘আমি বাড়ি থেকে খেয়ে এসেছি৷ তা ছাড়া আমার চট করে খিদে পায় না৷’

ইলিনার বেশ খটকা লাগলেও কিছু বলল না৷

ছুটির সময় যতই এগিয়ে এল আকাশ ততই কালো হয়ে উঠল৷ মেঘও ডেকে উঠল দু-চারবার৷ অনুষ্কা অপছন্দের মুখে জানলার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘বর্ষাকালটা খুব বিচ্ছিরি৷ আমার ভাল্লাগে না৷’

ইলিনা ওর দিকে তাকাল শুধু—কিছু বলল না৷

সাড়ে চারটের সময় ছুটির ঘণ্টা পড়তেই ওরা সিঁড়ি দিয়ে নেমে চলে এল একতলায়৷ গাড়িবারান্দার বাইরে বেরিয়ে আকাশের দিকে একবার তাকাল৷ মেঘের যা চেহারা তাতে মনে হচ্ছে জলকণার ভারে মেঘের দল কাবু হয়ে পড়েছে৷ যে-কোনও মুহূর্তে মেঘের চাদর ফুঁড়ে জলের ধারা নীচে নামবে, পৃথিবী ভাসিয়ে দেবে৷

অনুষ্কা ইলিনার হাত ধরে টান মারল : ‘শিগগির চলো৷ বাপি গাড়িটাকে ওপাশটায় দাঁড় করায়—৷’

পিচের রাস্তা ধরে ওরা দুজনে তাড়াতাড়ি পা চালাল৷ অন্য মেয়েরাও চটপট এগিয়ে চলেছে মেন গেটের দিকে৷ কেউ-কেউ আবার ছুটছে৷ নিউ কাটের খটখট শব্দে বাস্কেটবল গ্রাউন্ডের ভূতুড়ে ঘোড়সওয়ারদের কথা মনে পড়ে গেল ইলিনার৷

পিচের রাস্তার বাঁ-দিকটা বলতে গেলে জঙ্গলে ঢাকা৷ আগাছার জংলা ঝোপ, আর তার মাঝে-মাঝে কয়েকটা বড়-বড় গাছ৷ গাছের পাতার আড়াল থেকে কোকিল ডাকছে৷ দুটো ফিঙে ঘূর্ণি নাচের ভঙ্গিতে উড়ছে৷ বোধহয় উড়ন্ত পোকামাকড় ধরছে৷ একটা কাঠবিড়ালি একটা বড় গাছের ডালে বসে ইলিনাদের দিকে তাকিয়ে আছে৷ তবে সামান্য ছুতোয় ছুটে পালানোর জন্য সে বেশ তৈরি বলেই মনে হল৷ মেঘলার জন্য ঘোলাটে ছায়া থাকলেও কাঠবিড়ালিটাকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল৷

অনুষ্কা কাঠবিড়ালিটার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিল৷ ওর চোখে আকাঙ্ক্ষার আলতো ছোঁয়া দেখতে পেল ইলিনা৷ জিগ্যেস করল, ‘কাঠবিড়ালি তুমি ভালোবাসো?’

অনুষ্কা চমকে ঘুরে তাকাল : ‘দারুণ ভালোবাসি৷’

‘তা হলে ধরে নিয়ে চলো—পুষবে৷’

কথাটা ইলিনা খুব হালকাভাবেই বলেছিল৷ কিন্তু ওর কথা শেষ হতে না হতেই অনুষ্কা একটা আজব কাণ্ড করে বসল৷

রাস্তা ছেড়ে পলকে ছুটে গেল জঙ্গলের দিকে৷ এবং কাঠবিড়ালিটাকে লক্ষ্য করে শূন্যে লাফ দিল৷

কাঠবিড়ালিটা আর দেরি করেনি৷ অনুষ্কা তাকে তাক করে লাফানো মাত্রই সে গাছের ডাল বেয়ে সড়সড় করে আরও ভেতরদিকে ছুটে গেল৷

কিন্তু অনুষ্কাও হাল ছাড়ার পাত্রী নয়৷ ও-ও তৎপর ভঙ্গিতে লাফের পর লাফ মেরে আগাছা আর গাছের আড়ালে হারিয়ে গেল৷

ইলিনা থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছিল৷ পিঠে স্কুল-ব্যাগের বোঝা চাপানো অবস্থায় অনুষ্কা যে-স্পিডে কাঠবিড়ালিটাকে তাড়া করল তাতে ও অবাক হয়ে গিয়েছিল৷ মনে হল, অনুষ্কা যেন লং জাম্প আর ট্রিপল জাম্পে তুখোড় কোনও অ্যাথলিট৷

অনুষ্কার ব্যাপারটা আরও দু-চারজন মেয়ের চোখে পড়েছিল৷ তারাও মজা দেখার লোভে ইলিনার কাছাকাছি দাঁড়িয়ে পড়েছে৷

আগাছার ঝোপ আর গাছের পাতা নড়াচড়ার শব্দ পাওয়া যাচ্ছিল৷ কিন্তু মেঘলা ছায়াতে অনুষ্কাকে ভালো করে দেখা যাচ্ছিল না৷ তবে ওর সাদা টপের ঝলক দেখা যাচ্ছিল৷

একটু পরেই অনুষ্কা গাছপালার ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে এল৷ ওর স্কার্ট আর টপের এখানে-সেখানে গাছের পাতার টুকরো-টাকরা লেগে আছে৷ আর ডানহাতের মুঠোয় ধরা একটা কাঠবিড়ালি৷ চিঁ-চিঁ করে ডাকছে৷

ইলিনা তো অবাক৷ ছুটে গিয়ে কেউ কাঠবিড়ালি ধরেছে, এমনটা ও কখনও শোনেনি৷ আর অনুষ্কার ক্ষিপ্রতা কোনও শিকারি চিতাকেও হার মানাবে!

অবাক হল বাকি সব মেয়েরাও৷ ওরা অনুষ্কাকে ঘিরে কাঠবিড়ালি দেখতে লাগল৷

অনুষ্কা বাঁ-হাতে স্কার্ট ঝাড়তে-ঝাড়তে বলল, ‘কী কিউট, না? এটা আমি পুষব৷’

ইলিনা বলল, ‘বাব্বা, তোমার কী স্পিড! স্পোর্টসে নাম দিলে তুমি অনেক প্রাইজ পাবে৷’

অনুষ্কা হাসল শুধু—কোনও কথা বলল না৷

এমন সময় মেঘ ডাকল আবার৷ দু-এক ফোঁটা বৃষ্টিও পড়তে শুরু করল৷

সঙ্গে-সঙ্গে অনুষ্কা যেন শক খেয়ে চমকে উঠল৷ ‘শিগগির চলো—বৃষ্টি পড়ছে’ বলে পিচের রাস্তা ধরে ছুট লাগাল৷

অন্য মেয়েগুলো একটু অবাক হয়ে গেল৷ এ-বৃষ্টি ভেজার মতন কিছু নয়৷ তাই অনুষ্কার দৌড়টা ওদের বেখাপ্পা মনে হল৷ আর ইলিনার মনে পড়ে গেল প্রথম দিন আলাপের সময় অনুষ্কা বলেছিল, ‘…বৃষ্টি আমার ভাল্লাগে না…৷’

ইলিনা একটুও দেরি না করে অনুষ্কার পিছন-পিছন দৌড়ল৷

দূরে মরা গাছটা দেখা যাচ্ছে৷ সেই রাতের দৌড়টার কথা ওর মনে পড়ে গেল৷

পিচের রাস্তা ধরে বাঁ-দিকে বাঁক নিতেই সার বেঁধে পার্ক করা কয়েকটা প্রাইভেট কার চোখে পড়ল৷ তার পাশে হলদে রঙের তিনটে স্কুলবাস৷

একটা সাদা গাড়ির সামনে বড় একটা ছাতা মাথায় দিয়ে সুপুরুষ একজন ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে ছিলেন৷ ভদ্রলোকের মাথায় কুচকুচে কালো কোঁকড়ানো চুল, চোখে সরু ফ্রেমের চশমা, আর মুখে একগাল হাসি৷ ওঁকে দেখতে এত সুন্দর যে, স্রেফ দেখেই বোঝা যায় উনি অনুষ্কার বাবা৷

ছুটন্ত অনুষ্কার দিকে ছাতা বাড়িয়ে ধরলেন তিনি৷ আর একইসঙ্গে গাড়ির সামনের প্যাসেঞ্জার সিটের দরজাটা খুলে ধরলেন৷ ইলিনা লক্ষ করল, গাড়ির জানলায় টিন্টেড গ্লাস লাগানো৷

গাড়িতে উঠতে-উঠতে অনুষ্কা বলল, ‘বাপি, ও ইলিনা—আমার ক্লাসমেট…আমার খুব বন্ধু৷ ও আমাদের সঙ্গে এখন যাবে—৷’

‘তাই?’ চওড়া করে হাসলেন অনুষ্কার বাপি : ‘গুড—ভেরি গুড৷ এসো, এসো—উঠে পড়ো গাড়িতে৷ বৃষ্টিতে ভিজো না৷’ পিছনের একটা দরজা খুলে ইলিনাকে গাড়িতে ওঠার জন্য আমন্ত্রণ জানালেন৷

ইলিনা গাড়িতে উঠে পিঠের স্কুল-ব্যাগটা খুলে সিটের ওপরে রাখতেই বাপি দরজাটা বন্ধ করে ড্রাইভিং সিটে গিয়ে বসলেন৷ গাড়িতে স্টার্ট দেওয়ার সময় ছোট্ট কাঠবিড়ালিটা বাপিকে দেখাল অনুষ্কা৷

‘এই দ্যাখো, বাপি, এই কাঠবিড়ালিটা স্কুলের বাগান থেকে ধরেছি৷ এটা বাড়িতে নিয়ে গিয়ে পুষব…৷’

কাঠবিড়ালিটা তখন কিচকিচ করে শব্দ করছে, ওর কালো চোখের তারা চঞ্চলভাবে এদিক-ওদিক দেখছে৷

কাঠবিড়ালিটার দিকে একদৃষ্টে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন বাপি৷ তারপর জোরে হেসে বললেন, ‘ওটা আগেই আমি দেখেছি৷ বাঃ, গুড—ভেরি গুড৷ কিন্তু কত কিছুই তো তুমি পুষবে বলে ধরে আনো৷ তারপর কতটুকু কী পোষা হয় তা তুমি ভালোই জানো!’ মেয়ের দিকে অর্থপূর্ণ চোখে তাকিয়ে কী এক গোপন রসিকতায় হেসে উঠলেন৷ তারপর একপলক ইলিনাকে দেখে নিলেন৷

কাঠবিড়ালিটার গায়ে একবার আদরের হাত বুলিয়ে গাড়ি চালাতে শুরু করলেন বাপি৷

অনুষ্কা বলল, ‘বাপি, তোমার ফোনটা দাও৷ ইলিনা ওর বাড়িতে একটা ফোন করবে—নইলে ওর মা-বাবা চিন্তা করবে…৷’

‘ওহ শিয়োর—এই নাও৷’ জামার বুকপকেট থেকে রুপোলি রঙের একটা ছোট্ট মোবাইল ফোন বের করে মেয়ের দিকে এগিয়ে দিলেন৷

অনুষ্কা আর ইলিনা চটপট বোতাম টিপে ফোনের কাজটা সেরে নিল৷

গাড়ির ভেতরে একটা অদ্ভুত পারফিউমের গন্ধ পাচ্ছিল ইলিনা৷ মনে হচ্ছিল, মিহি দারচিনি গুঁড়ো কেউ বাতাসে ভাসিয়ে দিয়েছে৷

এই গন্ধটা ও অনুষ্কার কাছে কখনও পায়নি৷ তা হলে কি ওর বাপি এরকম অফবিট পারফিউম লাগিয়েছেন? নাকি এটা স্পেশাল টাইপের কোনও কার পারফিউম?

অনুষ্কার বাপি গাড়ি চালাতে-চালাতে নানান বিষয়ে বকবক করছিলেন আর মাঝে মাঝেই হেসে উঠছিলেন৷ তবে ওঁর বেশি আগ্রহের বিষয় যে সিনেমা আর নাটক সেটা বোঝা যাচ্ছিল৷ গল্প করার ফাঁকে তিনি থেকে-থেকেই বলছিলেন, ‘এই তো, এসে গেলাম…৷’

গাড়ি নানান রাস্তা ধরে চলছিল৷ ইলিনা কোনও রাস্তাই চিনতে পারছিল না৷ অবশ্য ওর চেনার কথাও নয়৷ ওর শুধু মনে হচ্ছিল, অনুষ্কা ওর ‘বেস্ট ফ্রেন্ড’ হতে চলেছে৷ আর সেই চিন্তাটা ওর মনে খুশির বাতাস ছড়িয়ে দিচ্ছিল৷

একটু পরেই গাড়ি যে-বাড়িতে এসে ঢুকল সেটা মাপে ছোট হলেও অনায়াসে তাকে বাগানবাড়ি বলা যায়৷ কারণ, অবহেলায় ফেলে রাখা বাগানের একপাশে একটা ছোট দোতলা বাড়ি৷ বাড়ি আর বাগান জং ধরা রেলিঙে ঘেরা৷ তার কোথাও-কোথাও এমনভাবে ভাঙা যে, কুকুর-বেড়াল কি অন্যান্য ছোট প্রাণী সহজেই ঢুকে পড়তে পারে৷

বাড়িটা পুরোনো ধাঁচের, তবে সদ্য রং করা হয়েছে৷ সেই রংটা গরিব পথশিশুর গায়ে ঝকঝকে নতুন জামা-প্যান্টের মতো দেখাচ্ছে৷

বাড়ির ছাদের কার্নিশে অনেক গোলাপায়রা বসে আছে৷ মাঝে-মাঝে পায়রাগুলো এদিকে-ওদিকে উড়ে যাচ্ছে৷

আকাশ মেঘে-মেঘে কালো৷ বৃষ্টি এখন নেই, কিন্তু যে-কোনও সময় শুরু হতে পারে৷

গাড়ি বাড়ির কাছে গিয়ে থামল৷ ওরা তিনজনে নেমে বাড়িতে ঢুকল৷ অনুষ্কার হাতে ধরা কাঠবিড়ালিটা তখনও কিচকিচ করে শব্দ করছে৷

বাড়িতে ঢোকার সময় অনুষ্কার বাপি ইলিনাকে বললেন, ‘ওয়েলকাম, ইলিনা—ওয়েলকাম টু আওয়ার লিটল হাউস৷ যাও, অনুষ্কার সঙ্গে ওপরে যাও৷ ওর ঘরে বসে গল্প করো, টিভি দ্যাখো, চুটিয়ে আড্ডা মারো—এনজয় করো…৷’ একটু থেমে অনুষ্কার দিকে হাত বাড়িয়ে চাপা গলায় বললেন, ‘দাও, ওটা আমাকে দাও৷ জায়গামতো রেখে দিই…৷’

অনুষ্কা কোনও কথা না বলে কাঠবিড়ালিটা বাপির হাতে দিল৷ ওটার মাথায় ছোট্ট করে হাত বুলিয়ে বাপি বললেন, ‘সুইট স্কুইরেল…৷’

এই কথা বলে বাপি একতলার একটা ঘরে ঢুকে গেলেন৷ আর ওরা দুজনে সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠতে লাগল৷

বাড়িটা নতুন রং করা হয়েছে বলে ইলিনা রঙের গন্ধ পাচ্ছিল৷ কিন্তু তার সঙ্গে দারচিনির মিষ্টি গন্ধটাও ওর নাকে আসছিল৷

সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় বাড়িটা খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে দেখছিল ইলিনা৷ ছিমছাম সাজগোজে বাড়িটাকে যথেষ্ট আধুনিক করার চেষ্টা হয়েছে৷

দরজা-জানলায় ভারী পরদা, দেওয়ালে ওয়াল হ্যাঙার, সিঁড়ির ল্যান্ডিং-এ পেইন্টেড পট৷

এসব দেখতে-দেখতে অনুষ্কার ঘরে পৌঁছে গেল ইলিনা৷

অনুষ্কা আলো জ্বালতেই ঘরটা চোখের সামনে প্রকাশিত হল৷

একটা আলমারি, বুককেস, এল. সি. ডি টিভি আর পড়াশোনার টেবিল৷ তার পাশে কম্পিউটার টেবিল৷ ডানদিকের দেওয়াল ঘেঁষে পাতা সিঙ্গল খাট৷ তার বিছানার রঙিন চাদর এলোমেলো৷ তার ওপরে পড়ে আছে একটা বড়সড় হেডফোন৷

বিছানার একটু ওপরে দেওয়ালে জন আব্রাহাম আর মাইকেল জ্যাকসনের বিশাল পোস্টার৷ তার পাশেই একটা অন্যরকম ডিজিটাল প্রিন্ট৷

এই অন্যরকম ছবিটায় দেখা যাচ্ছে, আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ৷ জ্যোৎস্না ধোওয়া প্রান্তরে—একটা বিশাল প্রাসাদ—অতিকায় ডাইনোসরের মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে৷ প্রাসাদের একটা ঘরে শুধু আলো জ্বলছে—বাকিটা ছায়া-ছায়া অন্ধকার৷

সেই ছবিটার পাশে একটা ছোট কাগজ দেওয়ালে সেলোটেপ দিয়ে লাগানো৷ তাতে লাল কালিতে একটা প্রতীক চিহ্ন আঁকা : একটা ফুলকে ঘিরে দুটো সাপ, তাদের লেজের ডগা দুটো জড়াজড়ি করে আছে৷ এই ছবিটা ইলিনা আগে অনুষ্কার খাতায় দেখেছে৷

হেডফোনটা ছুড়ে একপাশে সরিয়ে দিয়ে অনুষ্কা স্কুল-ব্যাগটা খুলে বিছানার কোণে রাখল৷ তারপর ধপাস করে বিছানায় বসে পড়ল, ইলিনাকেও বসতে বলল৷

ইলিনা স্কুল-ব্যাগটা খুলে বিছানায় নামিয়ে রাখল৷ তারপর হাত-পা ছড়িয়ে আরাম করে বসল৷ কিন্তু বারবার ওর চোখ চলে যাচ্ছিল ফুল আর সাপের ছবিটার দিকে৷

ইলিনা স্বপ্নেও ভাবেনি হঠাৎ করে এরকমভাবে অনুষ্কা ওকে এত কাছে টেনে নেবে৷ তাই একটা অপ্রত্যাশিত খুশির ঢেউ ওকে ভাসিয়ে দিচ্ছিল৷ অনুষ্কার ‘আহা মরি’ মুখের দিকে তাকিয়ে ব্যাপারটা ওর কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছিল না৷

দু-পাঁচ মিনিটের মধ্যেই ওরা দুজনে প্রাণখোলা গল্পে মেতে উঠল৷ আর তারই মধ্যে কখন যেন ঝমঝম করে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল৷

ওদের গল্প আর হাসাহাসির ঢেউয়ের মাঝে হঠাৎ করেই পরানের ডেডবডির কথা ভেসে উঠল৷

অনুষ্কা টেলিফোনে ব্যাপারটা জেনেছে ঠিকই, কিন্তু মনে হল তাতে ওর কৌতূহল মেটেনি৷ কারণ, ও ইলিনাকে খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে নানান প্রশ্ন করতে লাগল৷

সেই রাতের ঘটনা খুব ধীরে-ধীরে স্লো-মোশান সিনেমার মতো পরপর দু-বার বলতে হল ইলিনাকে৷

কপালে ভাঁজ ফেলে চোখ সরু করে গভীর মনোযোগে ইলিনার কথামালা শুনল অনুষ্কা৷

‘তোমরা ঠিক দেখেছ, দুজন টপ আর স্কার্ট পরে ছিল? মানে, আমাদের স্কুল-ড্রেস?’

‘হ্যাঁ, ঠিক দেখেছি৷’

‘আর-একজন শাড়ি?’

‘হ্যাঁ৷ আমাদের একজন ম্যাডাম ওইরকম শাড়ি পরে সেদিন স্কুলে এসেছিল৷ পাড়ের ডিজাইনটা দেখে সম্পি চিনতে পেরেছে৷’

‘কোন ম্যাডাম?’

‘সম্পি জানে৷ ও আমাদের এখনও বলেনি৷ লাস্ট দিন যখন ওর সঙ্গে কথা হয় তখন ও বলেছিল, ম্যাডামের নামটা এখন ও কাউকে বলবে না৷ কয়েকটা দিন ও ম্যাডামের ওপরে নজর রাখতে চায়…৷’

এ-কথা শুনে অনুষ্কা বেশ চিন্তায় পড়ে গেল৷ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর ও আনমনাভাবে বলল, ‘এতে তো সম্পির বিপদ হতে পারে! যদি সেই ম্যাডাম সম্পির ব্যাপারটা জানতে পেরে যায় তা হলে…৷’

ইলিনা হাত নেড়ে বলল, ‘জানলে জানবে! সম্পির গায়ে অনেক জোর—ও কাউকে ভয় পায় না…৷’

ইলিনার দিকে অদ্ভুত চোখে তাকাল অনুষ্কা৷ মলিন হেসে বলল, ‘সম্পি ওদের সঙ্গে পারবে না৷ ওদের গায়ে অমানুষিক শক্তি৷ ওরা লোহা চিবিয়ে গুঁড়ো করে দিতে পারে—৷’

ইলিনা অবাক হয়ে তাকাল : ‘তুমি জানলে কী করে?’

অনুষ্কা চুপ করে রইল৷ ওরা দুজনে বৃষ্টির ধারাপাত শুনতে লাগল৷

কিছুক্ষণ পর ইলিনা আবার জিগ্যেস করল, ‘তুমি জানলে কী করে?’

‘আমি জানি৷ সব জানি—৷’

‘কী জানো, বলো—৷’ অনুষ্কার আরও কাছে সরে এল ইলিনা৷

‘পরান ছেলেটা কীভাবে মারা গেছে আমি জানি৷’

বাইরে প্রচণ্ড শব্দে বাজ পড়ল৷ পড়ল ইলিনার বুকের ভেতরেও৷ উত্তেজিত হৃৎপিণ্ডের ধকধক আওয়াজ শুনতে পাচ্ছিল ও৷

ফ্যালফেলে মুখে অনুষ্কার দিকে তাকিয়ে ছিল ইলিনা৷ হোঁচট খাওয়া গলায় কোনওরকমে প্রশ্ন করল, ‘কী-কীভাবে ম-মারা গেছে পরান?’

‘ওর সব রক্ত শুষে নিয়েছে কেউ…৷’

ইলিনার শীত-শীত করে উঠল৷

ঘরের দুটো জানলাতেই কাচের শার্সি লাগানো৷ বৃষ্টির ফোঁটা কাচের ওপরে আছড়ে পড়ছিল৷ তারপর কাচ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছিল৷ ল্যাম্পপোস্টের ছিটকে আসা আলোয় মনে হচ্ছিল কাচ বেয়ে কতকগুলো স্বচ্ছ ব্যাঙাচি সাঁতরে নামছে৷

ইলিনা শুধু যে অনুষ্কার কথায় ভয় পেয়েছে তা নয়৷ অনুষ্কা কী করে এসব জানল, সে-কথা ভেবেও ওর ভয় করছে৷ অথচ অনুষ্কার প্রতি ওর টানটাও তো মিথ্যে নয়! তাই ভয় পেলেও ইলিনা এক অদ্ভুত টানে অনুষ্কার কাছে বসে রইল, ওর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল৷ আর নানান কথা ভাবতে লাগল৷

তা হলে সেই ছাতাওয়ালা প্রাণীগুলো পিশাচ? ওরাই কি পরানের রক্ত শুষে নিয়েছে? কিন্তু ওদের স্কুলের দুজন ছাত্রী আর একজন ম্যাডাম ওরকম পিশাচ হয়ে গেল কী করে?

ইলিনার চিন্তাগুলো দিশেহারাভাবে ছোটাছুটি করে বেড়াচ্ছিল আর বারবার অদৃশ্য এক পাথরের দেওয়ালে মাথা খুঁড়ে মরছিল৷

অনুষ্কা বলল, ‘ইলিনা, তুমি ভয় পেয়ো না৷ আমি তো আছি! শুধু সম্পিকে বোলো খুব কেয়ারফুল থাকতে৷ ও যেন বেশি রিসক না নেয়৷’

ইলিনা কেমন একটা ঘোরের মধ্যে ঘাড় নাড়ল৷ দারচিনির মিষ্টি গন্ধটা ওর নাকে এল আবার৷

অনুষ্কা প্রসঙ্গ পালটানোর জন্য জানলার কাচের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘বৃষ্টিটা যে কখন থামবে কে জানে! রেইনি সিজনটা খুব বিচ্ছিরি৷’ মুখ ফিরিয়ে ইলিনার দিকে তাকাল : ‘আমার মায়ের সঙ্গে তোমার আলাপ হল না৷ মা বিকেলে কীসব কেনাকাটা করতে বেরিয়েছে—মনে হয়, বৃষ্টিতে আটকে গেছে৷ একটু পরে বাপি মা-কে ফোন করে দেখবে৷ যদি মায়ের ফিরতে প্রবলেম হয় তা হলে তোমাকে বাড়িতে ড্রপ করে বাপি মা-কে গিয়ে নিয়ে আসবে৷’

‘তোমার মা একা বেরিয়েছেন? রাত হয়ে গেলে যদি কোনও বিপদ-আপদ হয়! তার চেয়ে আমি এখনই চলে যাই—তোমার মা তা হলে তাড়াতাড়ি ফিরতে পারবেন…৷’

‘তুমি শুধু-শুধু চিন্তা করছ—’ মিষ্টি করে হাসল অনুষ্কা : ‘বিপদ-আপদকে আমরা ভয় পাই না৷ তা ছাড়া বাপি এখুনি তোমার জন্যে স্ন্যাক্স-ট্যাক্স কিছু নিয়ে আসবে৷ আর বাড়িটাও তো তোমাকে ঘুরিয়ে দেখানো হয়নি—চলো৷’ অনুষ্কা ওর হাত ধরে টানল৷ তারপর ঘর ছেড়ে ওরা চলে এল বাইরে, অলিন্দে৷

বাড়ির সব জায়গাতেই উজ্জ্বল আলো জ্বলছিল৷ সাদা টিউবলাইট অথবা নানান চেহারার সি. এফ. এল.৷ দোতলার ঘরগুলো দেখাতে-দেখাতে অনুষ্কা বলল, ‘আমাদের বাড়ির দুটো ফ্লোর একই প্যাটার্নে তৈরি৷ একতলার দুটো ঘরে উলটোপালটা জিনিস বোঝাই করা আছে, আর থার্ড ঘরটায় আমার…পোষা…মানে, পেটসরা থাকে৷ কাঠবিড়ালি, পায়রা, শালিখ, চড়াই এসব৷’

দোতলার তিনটে ঘর শেষ হতেই অনুষ্কা বলল, ‘ওপাশে ওই যে দুটো ছোট-ছোট ঘর—ওগুলো টয়লেট আর কিচেন—দেখানোর কিছু নেই৷’

ইলিনা জিগ্যেস করল, ‘তুমি রান্না জানো?’

‘ওরে বাবা!’ ভয় পাওয়ার কপট ভঙ্গি করল অনুষ্কা : ‘রান্না-টান্না আমি একটুও জানি না৷’

‘তোমার মা—মানে, আন্টি নিশ্চয়ই ভালো রান্না জানেন?’

‘উহুঁ—’ অনুষ্কা মাথা নাড়ল : ‘মা রান্না-টান্না তেমন জানে না…৷’

‘সে কী? তা হলে রোজ রান্না করে দেয় কে? তোমার স্কুলের টিফিন কে তৈরি করে? রান্নার মাসি?’

অনুষ্কাকে দেখে মনে হল, ও কেমন যেন দিশেহারা হয়ে গেছে৷ কী বলবে ভাবছে৷

‘না, মানে…রান্নার মাসি…আমাদের রান্নার মাটি-টাসি কেউ নেই৷’

অনুষ্কার কথাটা শেষ হওয়ার আগেই রান্নাঘরের দিকে পা বাড়িয়ে ভেতরে উঁকি মেরে দেখেছে ইলিনা৷

এবং বিস্ময়ে থ হয়ে গেছে৷

রান্নাঘর একেবারে পরিষ্কার৷ কয়েকটা থালা-বাসন, ছুরি-চামচ ছাড়া সেখানে আর কিছু নেই৷ তাকে মশলাপাতির কোনও কৌটো নেই৷ এমনকী কোনও উনুন, স্টোভ, গ্যাস আভেন, গ্যাস সিলিন্ডার, বা মাইক্রোওয়েভ আভেন—কিচ্ছু নেই৷

বিস্ময়ের ধাক্কাটা সামলে ইলিনা ঘুরে তাকাল বন্ধুর দিকে৷

দুজনেই চুপচাপ৷ যেন ক্যামেরার ফ্রিজ শটে দুজনে ধরা পড়েছে৷ ওদের মুখে কোনও কথা নেই৷ শুধু বৃষ্টির ঝমঝম শব্দ ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকের মতো বাজছিল৷

‘আমাদের রান্নাবান্নার কোনও ব্যাপার নেই৷ আমরা সবসময় কেনা খাবার খাই—৷’

অনুষ্কা এ-কথা বলতে না বলতেই ওর বাপির গলা পাওয়া গেল৷

‘ইলিনা, এই কেনা খাবারগুলো খেয়ে দ্যাখো—দারুণ লাগবে৷ খুব ফেমাস দোকান থেকে কেনা…৷’

সেই কথার দিকে লক্ষ করে চোখ ফেরাল ইলিনা৷ এবং সরাসরি অনুষ্কার বাবাকে দেখতে পেল৷

অনুষ্কার ঘরের দরজায় বাপি দাঁড়িয়ে৷ হাতে একটা খাবারের প্লেট৷

ওরা বাপির কাছে এগিয়ে গেল৷ বাপি খাবারের প্লেটটা অনুষ্কার হাতে দিলেন : ‘নাও, বন্ধুকে ঘরে বসিয়ে খাওয়াও৷’ ইলিনার দিকে তাকালেন : ‘লজ্জা কোরো না, ইলিনা—পেট ভরে খাবে৷ তা কেমন লাগছে বলো৷ এনজয় করছ তো?’

ইলিনা সামান্য হেসে ঘাড় নাড়ল৷ নীচু গলায় বলল, ‘করছি—এনজয় করছি৷’

‘গুড—ভেরি গুড৷’ জোরে হেসে উঠলেন বাপি৷ তারপর চলে যেতে গিয়েও থমকে দাঁড়ালেন : ‘হ্যাঁ, ভালো কথা৷ তুমি ফেরার সময় হলে বোলো৷ তোমাকে বাড়িতে ড্রপ করে দেব…৷’

বাপি সিঁড়ি ধরে নামতে শুরু করলেন৷

ঘরে ঢুকে ইলিনার সামনে প্লেটটা এগিয়ে দিল অনুষ্কা : ‘নাও—খেয়ে নাও৷’

ইলিনা প্লেটটা নিয়ে বিছানায় বসল৷ ওর খুব খিদে পাচ্ছিল৷ খাবারগুলো সামনে পেয়ে খিদেটা যেন আরও অনেক বেড়ে গেল৷ মনজিনিসের ফিশ এনভেলাপ, চিকেন বার্গার—তার পাশে দুটো বড় সন্দেশ৷

খাওয়া শুরু করার আগে ও অনুষ্কাকে জিগ্যেস করল, ‘তুমি খাবে না?’

ইলিনা জানত অনুষ্কা কী বলবে৷ কারণ, স্কুলে টিফিন শেয়ার না করার ব্যাপারটা ওর মনে ছিল৷

অনুষ্কা ঠিক তাই বলল, ‘নাঃ, আমার খিদে নেই—৷’

ইলিনা চিকেন বার্গারে কামড় বসিয়ে হাসল : ‘তোমার দেখছি কখনও খিদে-টিদে পায় না৷’

অনুষ্কা অস্বস্তি পেয়ে হাসল, বলল, ‘বোধহয় তাই৷ ডাক্তার দেখাব ভাবছি—৷’

এরপর ওদের গল্প ঘুরে গেল গানের দিকে৷ বাইরে বৃষ্টির শব্দ তখন অনেকটা কমে এসেছে৷

অনুষ্কা যে মাইকেল জ্যাকসনের ভক্ত সেটা দেওয়ালের পোস্টারটা দেখেই বোঝা গিয়েছিল৷ তার সঙ্গে জানা গেল ও নিজেও হারমোনিয়াম বাজিয়ে গানের চর্চা করে৷

ইলিনার গানের ‘চর্চা’ বলতে শুধু গান শোনা৷ ওর প্রিয় বিষয় হল ছবি আঁকা আর ট্যাটুর ডিজাইন৷ দেওয়ালে লাগানো পূর্ণিমার রাতের ছবিটা অনেকক্ষণ ধরেই ওর চোখ টানছিল৷ তাই ও হঠাৎই জিগ্যেস করল, ‘এই ছবিটা এখানে কী জন্যে লাগিয়েছ? এটার কি স্পেশাল কোনও ব্যাপার আছে?’

অনুষ্কা ছবিটার দিকে তাকিয়ে একটু ইতস্তত করে বলল, ‘না, মানে… স্পেশাল কোনও ব্যাপার নেই৷ ছবিটা আমার ভালো লাগে, তাই—৷’

‘ওরে বাবা, আমার তো ওটার দিকে তাকালেই গা-টা কেমন শিরশির করছে! ভয়-ভয় করছে৷ ওই বাড়িটা যেন কেমন৷’

হাসল অনুষ্কা : ‘আমার ভয়-টয় একটু কম…৷’

অনুষ্কার দিকে তাকিয়ে রইল ইলিনা৷ হঠাৎই ওর মনে একটা প্রশ্ন উঠে এল৷

অনুষ্কা ওকে আজ হঠাৎ বাড়িতে ‘নেমন্তন্ন’ করল কেন? আগে ও যখন গায়ে পড়ে ওর সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে গেছে তখন অনুষ্কা এতটুকুও আগ্রহ দেখায়নি৷ অথচ আজ হঠাৎ উলটো ব্যাপার৷

তা হলে কি অনুষ্কা স্কুলের ওই ভয়ানক কাণ্ডটা ইলিনার কাছ থেকে সামনাসামনি বসে খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে শুনতে চেয়েছিল? সব শোনার পর সেটা নিয়ে গোয়েন্দার মতো অনেক প্রশ্নও করেছে ও৷ ওর কথাবার্তায় ইলিনার মনে হয়েছে অনুষ্কা যেন এই রহস্যের গভীর পর্যন্ত জানে৷ কারণ, ও বলেছে, ‘আমি জানি৷ সব জানি—৷’

খাওয়া শেষ করে ইলিনা উঠে দাঁড়াল৷ পড়ার টেবিলে রাখা একটা জলের বোতল ওর দিকে এগিয়ে দিল অনুষ্কা৷ আলতো গলায় বলল, ‘তুমি খুব সাবধানে থেকো৷’

ঢকঢক করে জল খেল ইলিনা৷ তারপর বিছানা থেকে ওর স্কুল-ব্যাগটা তুলে নিল : ‘রাত হয়ে যাচ্ছে—এবার আমি যাই…৷’

ঘর থেকে বেরিয়ে ওরা দুজনে সিঁড়ির দিকে এগোল৷

ছয়

অনুষ্কাকে ঘিরে ইলিনার মনে কিছু প্রশ্ন, জিজ্ঞাসা আর রহস্য তৈরি হয়েছিল৷ কিন্তু ওর প্রতি অলৌকিক এক টান এইসব দ্বিধা আর সংশয়কে ফিকে করে দিয়েছিল৷ শুধু একটা কথা ওর কানে বারবার বেজে উঠছিল : ‘আমি জানি৷ সব জানি—৷’

ক্লাসের পড়ায় ইলিনার মন বসছিল না৷ ও একটা খাতার শেষ পাতায় একটা ট্যাটুর ডিজাইন আঁকছিল : একটা ফুল—তাকে ঘিরে দুটো সাপ৷ এই নকশাটার মধ্যে কী আছে কে জানে! এটা অনুষ্কার এত প্রিয় কেন?

ইলিনা আজ সমর্পিতা আর সজনীর মাঝে বসেছে৷ ক’দিন ধরেই তাই বসছে৷ সমর্পিতার পাশে বসলে ও কেমন যেন ভরসা পায়৷ ওর মনে হয়, কোনও বিপদ-আপদ হলে দশাসই সম্পি সেটা ঠিক রুখে দেবে৷ কিন্তু ঠিক কীরকম বিপদ-আপদ সেটা ইলিনা জানে না৷

অরুণিমা ম্যাডাম বাংলা ব্যাকরণ পড়াচ্ছিলেন৷ ওঁর ভীষণ রোগা চেহারা, মাথায় অনেক সাদা চুল৷ খুব শিগগিরই রিটায়ার করে যাবেন৷ ক্লাসে শুধু হাই তোলেন আর চেয়ারে বসে মাঝে-মাঝেই ঘুমিয়ে পড়েন৷

অরুণিমা ম্যাডাম খুব ঠান্ডা আর ভালোমানুষ টাইপের৷ পড়া না পারলে শাস্তি দেওয়া তো দূরের কথা বকাবকিও করেন না৷ শুধু ক্লাসে গোলমাল না করলেই হল৷

সেই ‘নিয়ম’ মেনে ইলিনারা চাপা গলায় কথা বলছিল৷

ইলিনা ট্যাটু আঁকা থামিয়ে হঠাৎ বলল, ‘সম্পি, তোর সেই শাড়ির পাড়ের ডিজাইনের গল্পটা তো দেখলাম অনেকেই জেনে গেছে৷ বড়দিকে তুই কী বলেছিলি মনে নেই—যে সবটাই তোর দেখার ভুল?’

সম্পি বাঁকাভাবে হাসল৷ বলল, ‘সবাই যা বলে তাই করে নাকি? আমি ইচ্ছে করেই ব্যাপারটা একটু রটিয়ে দিয়েছি৷’

সজনী জিগ্যেস করল, ‘কেন রে?’

‘যাতে কথাটা সেই শয়তান ম্যাডামের কানে যায়৷ তা হলে সেই ম্যাডাম একটু চাপে থাকবে৷’

‘চাপে থাকলে কী হবে?’

‘দেখাই যাক না কী হয়৷’ ঠোঁট টিপে বলল সম্পি, ‘হয়তো শয়তান ম্যাডামটা চালে কোনও ভুল করে ফেলতে পারে…৷’

হঠাৎই সম্পি প্রসঙ্গ পালটে ইলিনাকে জিগ্যেস করল, ‘সেদিন দেখলাম তুই ছুটির সময় অনুষ্কার গাড়িতে উঠলি…৷’

ইলিনা অপ্রস্তুতভাবে বলল, ‘আমার শরীরটা ভালো লাগছিল না৷ ওকে বলেছিলাম—তাই ও আমাকে বাড়ির কাছে নামিয়ে দিয়েছে৷’

‘ওরা খুব বড়লোক, না রে?’ সজনী গলা বাড়িয়ে জিগ্যেস করল৷

‘কী জানি!’ ঠোঁট ওলটাল ইলিনা : ‘তবে অনুষ্কা বলছিল, ও সব জানে৷ ও তোকে—’ সম্পির দিকে তাকাল ইলিনা : ‘খুব কেয়ারফুল থাকতে বলেছে, কোনও রিসক নিতে বারণ করেছে৷’

সম্পি এ-কথায় ভয় তো পেলই না, উলটে ‘ডোন্ট কেয়ার’ হাসি হাসল৷ তারপর কৌতূহল নিয়ে জিগ্যেস করল, ‘অনুষ্কা সব জানে মানে?’

‘কী জানি! সেসব ক্লিয়ার করে বলেনি৷’

‘তোরা চিন্তা করিস না৷ ব্যাপারটার পেছনে আমি লেগে আছি৷’

‘তুই কিন্তু কেয়ারফুল থাকিস…৷’ ইলিনা ফিসফিস করে সম্পিকে আবার বলল৷

সম্পি কোনও কথা বলল না৷ শুধু চোখের ইশারায় বোঝাল, ও কেয়ারফুল থাকবে৷

বাংলা ব্যাকরণের পর আরও দুটো ক্লাস পার হয়ে গেল৷ সম্পি কেমন যেন ছটফট করছিল৷ কোনও কিছুতেই ঠিকমতো মন বসাতে পারছিল না৷

ইলিনা খেয়াল করেছে, সম্পি ক’দিন ধরেই স্কুল ক্যাম্পাসের আনাচেকানাচে ঘুরে বেড়াচ্ছে৷ ওই মরা গাছটার কাছে গিয়ে তার আশপাশটা খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে দেখছে৷ গত পরশু স্কুল ছুটি হওয়ার পর ও সার্ভেন্টস কোয়ার্টারের সামনে দাঁড়িয়ে বলাইদার সঙ্গে কীসব যেন কথাবার্তা বলছিল৷ তারপর গতকাল টিফিনের সময় আগাছার জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে এদিক-ওদিক চষে বেড়াচ্ছিল৷

ব্যাপারস্যাপার দেখে ইলিনার মনে হচ্ছিল, সমর্পিতা যেন শখের গোয়েন্দা হয়ে উঠেছে৷ এটা যেমন ইলিনাদের চোখে পড়ছে তেমন অন্যদেরও নিশ্চয়ই চোখে পড়ছে৷ তা হলে সেই রাতের ওই ভয়ংকর তিনজন…তারাও নিশ্চয়ই সমর্পিতার পাগলামো দেখছে৷ তারপর যদি…৷

ইলিনা আর ভাবতে পারছিল না৷ অনুষ্কার রহস্যময় কথাগুলো ওর মাথার ভেতরে ঝড় তুলছিল৷

টিফিনের পরের পিরিয়ডটায় রনিতা ম্যাডামের ইতিহাস ক্লাস৷ তিনি ক্লাসে এসে নিজস্ব বিরক্তিকর স্টাইলে পড়াতে লাগলেন৷ তারপর আজকের ‘বলির পাঁঠা’ হিসেবে সম্পিকে বেছে নিলেন৷ যত কঠিন-কঠিন প্রশ্ন ওর দিকে ছুড়ে দিলেন৷

সম্পি প্রায় কোনও প্রশ্নেরই উত্তর দিতে পারছিল না৷ ফলে ওকে হেনস্থা করার সাফল্যে রনিতা ম্যাডামের চোখ চকচক করছিল৷

সমর্পিতাকে বাঁচানোর জন্য অনুষ্কা বারবার উত্তর দিতে চেয়ে হাত তুলছিল, কিন্তু রনিতা ম্যাডাম সেটা যেন দেখেও দেখছিলেন না৷

একসময় তিনি ঠান্ডা চোখে অনুষ্কার দিকে তাকালেন৷ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ধারালো গলায় কেটে-কেটে বললেন, ‘আমি জানি তুমি সব জানো৷ কিন্তু তোমার কাছ থেকে আমি কিছু জানতে চাইছি না৷’

সম্পিকে যাচ্ছেতাইভাবে নাস্তানাবুদ করার পর ওকে ভালোরকম বকাবকি করলেন রনিতা ম্যাডাম৷ তারপর বললেন, ‘তুমি ছুটির পর আমার সঙ্গে দেখা করবে৷ তোমাকে ঠিক পথে আনা দরকার…৷’

সম্পি উঠে দাঁড়িয়ে মাথা নীচু করে ঘাড় নাড়ল৷

ইলিনা লক্ষ করল, সম্পির মুখচোখ লাল৷ প্রায় কাঁদোকাঁদো অবস্থা৷

রনিতা ম্যাডাম চলে যাওয়ার পর সম্পি ইলিনাকে বলল, ‘সবাই জানে আমি পড়াশোনায় বাজে…তাও কেন যে আমাকে রনিতা ম্যাডাম হ্যারাস করলেন কে জানে! আমার কপালে নির্ঘাত গার্জেন কল ঝুলছে৷’

ইলিনা আর সজনী ওকে ভরসা দিতে লাগল৷

আকাশে কালো-কালো মেঘের ছানা ভেসে বেড়াচ্ছিল৷ বৃষ্টি এখনও শুরু হয়নি—তবে যে-কোনও সময় শুরু হতে পারে৷ জানলা দিয়ে বড়-বড় গাছের মাথাগুলো দেখা যাচ্ছিল৷ এলোমেলো বাতাসে এপাশ-ওপাশ মাথা নাড়ছে৷

সম্পিকে দেখে মনে হল, ও যেন একটু দমে গেছে৷ চুপচাপ কী যেন ভাবছে৷

ইলিনা বারবার ওকে জিগ্যেস করল, ‘কী রে, কী হয়েছে?’

সমর্পিতা অন্যমনস্কভাবে মাথা নাড়ল, বলল, ‘না, কিছু না…৷’

ওর দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল ইলিনা৷ ওর মনে হল, ডাকাবুকো সম্পি ভয় পেয়েছে৷

শেষ পিরিয়ড শুরু হওয়ার আগে সম্পি একবার টয়লেটে যাওয়ার নাম করে বেরোল৷

ইলিনার কী মনে হল, সম্পির পিছন-পিছন ও-ও বেরিয়ে এল বারান্দায়৷ দেখল, সম্পি বারান্দার রেলিং-এর কাছে দাঁড়িয়ে ক্লাস নাইন-বি-র একটা মেয়ের সঙ্গে কথা বলছে৷

মেয়েটার নাম নিনা৷ সম্পিদের পাড়ায় থাকে—ওর বন্ধুও৷ আর সম্পির মতো নিনারও একটু ভয়ডর কম৷

ইলিনা চটপট ক্লাসে ফিরে এল আবার৷ একটু পরে সম্পি ফিরে এসে ওর পাশে বসল৷

প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই শম্পা ম্যাডাম ক্লাসে ঢুকে পড়েছেন৷

শম্পা ভূগোল পড়ান এবং খুব ভালো পড়ান৷ কিন্তু শেষ পিরিয়ডে ইলিনার হাই উঠছিল৷ ভাবছিল কখন ছুটি হবে, স্কুল বাসে করে বাড়ি যাবে৷

ও সম্পিকে বলল, ‘নিনার সঙ্গে কী কথা বলছিলি?’

সম্পি কী যেন চিন্তা করছিল, চটকা ভেঙে বলল, ‘রনিতা ম্যাডামের কাছে যাওয়ার সময় ওকে সঙ্গে নেব ভেবেছিলাম৷ তাই ওকে বলছিলাম৷ কিন্তু ওর কাজ আছে—বাড়ি ফেরার তাড়া আছে…৷’

‘ওকে সঙ্গে নিবি কেন?’

‘না, মানে…যদি কোনও প্রবলেম হয়…৷’

‘কী প্রবলেম?’

‘যদি বকাবকি করে, মারধর করে………তারপর গার্জেন কল……৷’ একটু থেমে সম্পি আবার বলল, ‘যাকগে, যা হয় হবে৷’

‘আমি তোর সঙ্গে যাব?’ ইলিনা জিগ্যেস করল৷

সমর্পিতা একলহমা কী যেন ভাবল, তারপর বলল, ‘নাঃ, থাক—দরকার নেই৷ দেখি না কী হয়!’

এরপর ও আর কোনও কথা বলল না৷ অন্যমনস্কভাবে শম্পা ম্যাডামের ভূগোল পড়ানো শুনতে লাগল৷

ইলিনা বুঝতে পারছিল, সম্পি কেমন একটা দ্বিধা-দ্বন্দ্বের মধ্যে রয়েছে৷ কী করবে ভেবে উঠতে পারছে না৷

কিন্তু কোনও টিচার পড়া না পারার জন্য সম্পিকে টিচার্স রুমে ডেকে পাঠাচ্ছেন, এটা তো সম্পির কাছে নতুন নয়! তা হলে ও এরকম ঘাবড়ে যাচ্ছে কেন?

এসব ভাবতে-ভাবতে ইলিনা জানলা দিয়ে বাইরে তাকাল৷ আকাশের কালো-কালো মেঘের ছানাগুলো কখন যেন একজোট হয়ে পড়েছে৷ এখন ওদের কালো দৈত্যের মতো দেখাচ্ছে৷ ওদের ঘন কালো শরীর ভেদ করে বিদ্যুতের রুপোলি তরোয়াল মাঝে-মাঝে ঝিলিক দিয়ে উঠছে৷ আর তারপরই গম্ভীর চাপা গর্জন৷

কখন যেন ছুটির ঘণ্টা পড়ল৷ গোটা ক্লাস সঙ্গে-সঙ্গে চঞ্চল হয়ে উঠল৷ কথার ফুলঝুরি ছিটকে পড়তে লাগল চারিদিকে৷

বৃষ্টি শুরু হওয়ার আগেই বাড়ি রওনা হতে হবে এই চিন্তায় সবাই তাড়াহুড়ো শুরু করে দিল৷ কিন্তু সম্পি চুপচাপ বসে রইল৷ ধীর স্থির গম্ভীর৷

ইলিনা আর সজনী ক্লাস ছেড়ে চলে যাওয়ার আগে সম্পির দিকে একবার তাকাল৷ ইলিনা জিগ্যেস করল, ‘কী রে, তোর সঙ্গে থাকব?’

‘না, না—তুই বাড়ি যা৷’ চটপট বলল সম্পি, ‘আমি একা ম্যানেজ করে নেব৷’

ইলিনার মনে হল, সমর্পিতা চায় না ওকে কেউ ভিতু বলুক৷

ও এখন মনের ভেতরে বাড়তি সাহস তৈরি করছে৷

ক্লাসরুম যখন ফাঁকা হয়ে গেল তখন সম্পি উঠে দাঁড়াল৷ ব্যাগটা হাতে ঝুলিয়ে চলে এল বাইরের অলিন্দে৷ অলিন্দ ধরে খানিকটা এগোলেই একটা বড় চৌকো চাতাল৷ তাকে ঘিরে কাস্ট আয়রনের ঢালাই করা নকশা কাটা রেলিং৷

দোতলার এই চাতালটাকে অনেকটা ছাদের মতো দেখায়৷ চাতালের গা ছুঁয়ে একটা কৃষ্ণচূড়া আর একটা কাঁঠাল গাছ উঠেছে৷

চাতালের একপাশে বেশ বড়সড় টিচার্স রুম৷ সম্পি কোনাকুনিভাবে চাতালটা পেরিয়ে টিচার্স রুমের কাছে গেল৷ তখন টিপটিপ করে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে৷

রুমের চওড়া দরজায় বাদামি রঙের ভারী পরদা ঝুলছে৷ পরদার পাশ দিয়ে ঘরটা একচিলতে দেখা যাচ্ছে৷ আর ভেতর থেকে কথাবার্তার শব্দ শোনা যাচ্ছে৷

চারপাশে চোখ বুলিয়ে নিল সমর্পিতা৷ নিজেকে সাহস জোগানোর আপ্রাণ চেষ্টা করল৷ রনিতা ম্যাডাম আর যা-ই করুন, নিশ্চয়ই মারধোর করবেন না!

বুকের ভেতরে ধকধক শব্দ শুনতে পাচ্ছিল সম্পি৷ ওর হাত সামান্য কাঁপছে নাকি?

দূর! যা হয় হবে!

এক হাতে ভারী পরদা সরাল ও৷ তারপর জুতোয় শব্দ তুলেই ঘরের ভেতরে ঢুকে পড়ল৷

ঘরে মাত্র দুজন টিচার : রনিতা ম্যাডাম আর রবিনা ম্যাডাম৷ ওঁরা পাশাপাশি দুটো চেয়ারে বসে হোম লোন আর ব্যাঙ্ক ইন্টারেস্ট নিয়ে কীসব আলোচনা করছিলেন৷ সমর্পিতাকে দেখেই ওঁরা চুপ করে গেলেন৷ তারপর রনিতা বললেন, ‘এসো, সমর্পিতা, এসো…৷’

রবিনা ম্যাডাম উঠে দাঁড়ালেন৷ ম্যাডামের দিকে তাকিয়ে সমর্পিতা ছোট্ট করে হাসল৷ কিন্তু ম্যাডাম ওর দিকে তাকালেন শুধু—হাসলেন না৷ টেবিলে রাখা নস্যি রঙের কাঁধ-ব্যাগটা তুলে নিয়ে চুপচাপ ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন৷ ওঁর হাবভাব দেখে মনে হল তিনি যেন সমর্পিতার ঘরে ঢোকার জন্যই অপেক্ষা করছিলেন৷ নিশ্চয়ই রনিতা ম্যাডাম ওঁকে বলে রেখেছিলেন যে, সম্পিকে তিনি কথা বলার জন্য টিচার্স রুমে ডেকে পাঠিয়েছেন৷

টিচার্স রুমে ঢুকে সবচেয়ে প্রথমে যেটা চোখে পড়ে সেটা হল প্রকাণ্ড একটা টেবিল৷ টেবিলটা প্রায় কুড়ি ফুট লম্বা, পাঁচ ফুট চওড়া৷ মেহগনি কাঠের তৈরি, ঝকঝকে পালিশ৷ টেবিলের আটটা পায়া আটটা সিংহের থাবা৷ টেবিলের নানান নকশা আর কারুকাজ দেখে বোঝা যায় এ টেবিল ব্রিটিশ আমলের কনফারেন্স টেবল৷

ঘরের একপাশে চারটে কাঠের আলমারি, আর তার পাশে একটা স্টিলের আলমারি৷

তার ঠিক বিপরীতে একটা কাঠের ব়্যাক—তাতে অনেকগুলো ক্লাস রেজিস্টার, চকের বাক্স আর ডাস্টার৷ ব়্যাকের পাশে বড়-বড় তারিখওয়ালা একটা ক্যালেন্ডার৷

ঘরে তিনটে চার ব্লেডের সিলিং ফ্যান—তবে এখন একটা চলছে৷ তার হাওয়ায় রনিতা ম্যাডামের কানের পাশে চুল উড়ছে৷

আকাশ মেঘলা থাকায় ঘরে দুটো টিউবলাইট জ্বলছে৷ রনিতা ম্যাডামের পিছনে তিনটে বিশাল-বিশাল জানলা—সম্পিদের ক্লাসরুমের মতো৷ খোলা জানলা দিয়ে আকাশের মেঘ দেখা যাচ্ছে, তার সঙ্গে বাতাসে মাথা ঝাঁকানো পাগল গাছপালা৷

কোকিলের ডাক শুনতে পেল সম্পি৷ এই ডাকটা ওকে যেন ভরসা জোগাল৷

সম্পি টেবিলের কাছে এগিয়ে গিয়েছিল, কিন্তু বসেনি৷ কারণ, ম্যাডাম ওকে বসতে বলেননি৷

টেবিলের এপার থেকে ও রনিতা ম্যাডামকে দেখছিল৷

রনিতা ম্যাডামের সামনে তিন-চার ভাগে ভাগ করে রাখা ক্লাস টেস্টের খাতা৷ খাতার ওপরে লোহার পেপার-ওয়েট চাপানো৷ খাতার পাতার কোনাগুলো পাখার হাওয়ায় উড়ছে৷

খাতাগুলোর পাশে রনিতার কাঁধ-ব্যাগ৷ গাঢ় নীল রঙের ব্যাগ—ব্যাগের খোলা মুখ দিয়ে ছাতার রঙিন বাঁট দেখা যাচ্ছে৷

‘এদিকে এসো, সমর্পিতা—এপাশটায় এসো…৷’ হাতের ইশারায় ওকে নিজের কাছে ডাকলেন ম্যাডাম৷

‘না, ম্যাডাম—এখানেই ঠিক আছি৷’ কথা বলতে-বলতে হাতে ঝোলানো স্কুল-ব্যাগটা টেবিলের ওপরে রাখল সম্পি৷

হাসলেন রনিতা ম্যাডাম৷ বললেন, ‘কোনও ভয় নেই, সমর্পিতা—এপাশটায় এসো, আমার কাছে এসো৷ তোমাকে আমি কানও মুলব না, মারধোরও করব না৷ তবে হ্যাঁ—’ চওড়া করে হাসলেন রনিতা : ‘একটু বকাবকি হয়তো করব৷ এসো…এপাশটায় এসো—৷’

এরপর আর আপত্তি করা যায় না৷

টেবিলের পরিসীমা ধরে ধীরে-ধীরে এগোতে শুরু করল সমর্পিতা৷ ম্যাডাম মুখে বলছেন বটে ‘কোনও ভয় নেই’, কিন্তু যদি রাগের মাথায় কান-টান মুলে দেন! তা হলে কিন্তু বড় প্রেস্টিজের ব্যাপার হবে৷

‘আজকাল তোমার পড়াশোনায় একটুও মন নেই কেন বলতে পারো?’ বকুনির পালা শুরু করে দিলেন রনিতা : ‘ক্লাসে সবসময় দেখি অন্যমনস্ক৷ এরকম করলে তো তোমার রেজাল্ট অনেক নীচে নেমে যাবে!’

সমর্পিতা ততক্ষণে ম্যাডামের বেশ কাছে পৌঁছে গেছে—তবে মোটেই হাতের নাগালের মধ্যে নয়৷ কাঁচমাচু মুখ করে দাঁড়িয়ে ও ম্যাডামের ভর্ৎসনা গায়ে মাখছিল৷

‘আজও ক্লাসে দেখলাম তুমি কোনও পড়া বলতে পারছ না৷ ইতিহাস বলে যে একটা সাবজেক্ট আছে সেটাই বোধহয় তুমি ভুলে গেছ৷’ কথা বলতে-বলতে উঠে দাঁড়ালেন রনিতা : ‘সত্যি করে বলো তো, তোমার কী প্রবলেম হয়েছে? লেখাপড়া ছেড়ে তুমি এখন কী নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছ?’

সমর্পিতা মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে ছিল৷ মিনমিনে গলায় বলল, ‘কিছু নিয়ে তো মাথা ঘামাচ্ছি না, ম্যাডাম—পড়ছি…৷’

‘ছাই পড়ছ!’ ধমকে উঠলেন রনিতা, ‘আসলে তুমি স্কুলের ওই অ্যাক্সিডেন্টটা নিয়ে বড্ড বেশি ইনভলভড হয়ে পড়েছ, তাই না?’

সমর্পিতা চুপ করে রইল৷

জানলার বাইরে মেঘ ডাকল৷ বৃষ্টিও জোরে শুরু হল৷ রনিতা বৃষ্টির শব্দে জানলার দিকে একবার তাকালেন৷ তারপরই ব্যাগ থেকে ছাতাটা টেনে বের করে নিজের হাতের কাছে রাখলেন৷

সম্পিকে চুপ করে থাকতে দেখে ম্যাডামের ধৈর্য কয়েক ডিগ্রি কমে গেল৷

‘চুপ করে আছ কেন? বলো৷ পরানের অ্যাক্সিডেন্টাল ডেথটা নিয়ে তুমি একটু বাড়াবাড়ি রকমের ইনভলভড হয়ে পড়েছ না?’

সমর্পিতা আর চুপ করে থাকতে পারল না৷ আলতো গলায় বলল, ‘ম্যাডাম, ওটা অ্যাক্সিডেন্টাল ডেথ নয়—মার্ডার৷’

‘তোমাকে কে বলেছে মার্ডার?’ ধৈর্য আরও কমে গেল : ‘পুলিশ ইনভেস্টিগেট করে যা রিপোর্ট দেওয়ার দিয়ে দিয়েছে৷ তা ছাড়া সবাই জানে এই স্কুলটা একটু ইয়ে…মানে, ভূতুড়ে…একটু দোষ আছে৷ আর সেদিন রাতে তুমি বা রবিনা যা দেখেছ সবটাই—৷’

‘হ্যালুসিনেশান৷ আমাদের দেখার ভুল—তাই তো?’ ম্যাডামের কথার খেই ধরে সমর্পিতা বলল৷

সম্পির কথার সুরে ব্যঙ্গ আর বিদ্রোহের ছোঁয়া পেয়ে রনিতা খেপে উঠলেন : ‘তোমার আস্পর্ধা তো কম নয়! শিক্ষা-দীক্ষা পাওনি? বাজে নোংরা মেয়ে!’

সম্পির মাথায় আগুন জ্বলে গেল৷ ও ভুলে গেল কাকে কী বলছে৷ ক্ষিপ্ত গলায় ও চেঁচিয়ে উঠল, ‘আমি বাজে নোংরা মেয়ে! তুই কী? তোর সেই শাড়িটা কোথায়? ওই যে, পাড়ের কাছে শঙ্খের ডিজাইন করা৷ যেটা পরে সেদিন অন্ধকারে ছাতা মাথায় দিয়ে ওই মরা গাছটায় হনুমানের মতো লাফাচ্ছিলি৷ শাড়িটা আছে, না পুড়িয়ে ফেলেছিস?’

ঘরের ভেতরে যেন বাজ পড়ল৷ সম্পির কথাগুলো বুলেটের মতো বিঁধে গেল রনিতা ম্যাডামের গায়ে৷

সাত

ওঁর মুখটা অলৌকিকভাবে পালটে যেতে লাগল৷ গাল দুটো বসে গেল৷ রং ফ্যাকাসে হয়ে গেল! ঠোঁটজোড়া টুকটুকে লাল৷ চোখ দুটো কোটরে ঢুকে গিয়ে দুটো কালো অন্ধকার গর্ত তৈরি হল৷ সেই গর্তের কেন্দ্রবিন্দুতে দুটো উজ্জ্বল সাদা ফুটকি—হাই পাওয়ারের জোনাকির মতো জ্বলছে৷

রনিতা ম্যাডাম অদ্ভুত এক কর্কশ গলায় বললেন, ‘তোর লপচপানি বড্ড বেড়েছে৷ তোকে ঠিক পথে আনা দরকার৷ আমাদের যে কতটা শক্তি তুই জানিস না…৷’

সম্পি ভয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছিল৷ গল্পে পড়া কিংবা সিনেমায় দেখা আজগুবি ব্যাপারটা যে ওর চোখের সামনে ঘটে যাচ্ছে, সেটা কিছুতেই ও বিশ্বাস করতে পারছিল না৷ ওর ভেতর থেকে সমস্ত বেপরোয়া ভাব আর সাহস চুঁইয়ে-চুঁইয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিল৷ ভয়ে ওর জিভ শুকিয়ে গেছে, পা দুটো মেঝেতে এঁটে বসেছে৷

খপ করে হাত বাড়িয়ে টেবিলে রাখা একটা পেপারওয়েট তুলে নিলেন রনিতা৷ ওঁর হাতের আঙুলগুলো কেমন কালো-কালো হাড্ডিসার হয়ে গেছে৷ আর আঙুলের নখগুলো এখন কেমন লম্বা আর বাঁকানো৷

রনিতা খলখল করে হাসলেন৷ তারপর কর্কশ গলায় বললেন, ‘এটা খুব ছোঁয়াচে রোগ৷ কী করে কখন যে হয়ে গেছে একটুও টের পাইনি৷ তোর গায়ে একটা কামড় বসালে তুইও একপলকে আমাদের মতন হয়ে যাবি৷ তখন তেষ্টায় পাগল হয়ে ঘুরবি…আর যদি মরণকামড় দিই তা হলে তুই পরানের মতো শেষ হয়ে যাবি৷ সে-রাতে পরানকে শুষে শেষ করে আমরা আনন্দে ওই মরা গাছটায় নাচানাচি করছিলাম৷ তুই কি চাস আরও একবার তাই করি?’

আকাশে এমনভাবে বিদ্যুৎ চমকাল যেন মেটাল হ্যালোজেন বাতি ঝলসে উঠল৷ সমর্পিতা আর রনিতা ম্যাডামের মুখে-গায়ে সাদা আলো ঝিলিক মেরেই মিলিয়ে গেল৷

সমর্পিতা অনেক কিছুই করার কথা ভাবছিল, কিন্তু কোন এক অলৌকিক অভিশাপ ওকে যেন পায়ে পেরেক ঠুকে মেঝেতে দাঁড় করিয়ে রেখেছে৷

ও একবার খোলা দরজার দিকে তাকাচ্ছিল, আর-একবার জানলার দিকে৷ ও কি একছুটে বাইরের চাতালে চলে যেতে পারবে? তারপর চেঁচিয়ে লোক জড়ো করতে পারবে না? কিন্তু এখন কি ম্যাডামরা কেউ আছেন? বড়দিও হয়তো বাড়ি চলে গেছেন৷ এখন শুধু সার্ভেন্টস কোয়ার্টারের লোকজনই যা ভরসা৷ কিন্তু এখান থেকে চিৎকার করলে সেই আওয়াজ কি সার্ভেন্টস কোয়ার্টার পর্যন্ত পৌঁছবে? এই বৃষ্টিতে কেউ কি আসবে?

সম্পি পাগলের মতো হয়ে যাচ্ছিল৷ ওই তো, রনিতা পিশাচটা খলখল করে হাসছে৷ ওকে ঠেকাতে কিছু একটা করতে হবে, করতেই হবে৷

সম্পি হঠাৎ কোথা থেকে শক্তি খুঁজে পেল কে জানে! ও দু-হাতের দুটো প্রচণ্ড ঘুসি বসিয়ে দিল টেবিলে৷ ভয়ংকর শব্দ হল৷ বিশাল টেবিলটা থরথর করে কেঁপে উঠল৷

আর রনিতা ব্যঙ্গের হাসি হেসে উঠলেন৷ তারপর বড় করে হাঁ করলেন৷

টিউবলাইটের আলোয় পিশাচের দাঁতগুলো ঝিকিয়ে উঠল৷ সম্পির দেখতে কোনও অসুবিধে হল না৷

রনিতার দু-পাটিতেই হাঙরের মতো কয়েক সারি করে ইস্পাতের দাঁত৷ ঝকঝকে এবং ছুঁচলো৷

পপকর্ন খাওয়ার ভঙ্গিতে লোহার পেপারওয়েটটা হাঁ করা মুখের ভেতরে ছুড়ে দিলেন৷ তাপর কড়মড়-কড়মড় করে ওটা চিবোতে লাগলেন৷ ঠিক যেন তালমিছরির ডেলা চিবিয়ে গুঁড়ো করছেন৷

একটু পরেই লোহার গুঁড়ো থু-থু করে টেবিলে উগরে দিলেন রনিতা৷ তারপর পাতলা ঠোঁটের ওপরে কয়েকবার জিভ বুলিয়ে নিয়ে সম্পিকে লক্ষ করে হাসলেন৷

সম্পির শিরদাঁড়া বেয়ে বরফজলের স্রোত নেমে গেল৷ এই পিশাচের সঙ্গে শক্তিতে পেরে ওঠা অসম্ভব৷ সম্পি একমাত্র পালানোর চেষ্টা করতে পারে৷ কিন্তু পা দুটো যে কিছুতেই নড়তে চাইছে না৷

টেবিলে ঘুসি মারার পর থেকেই সম্পির দু-হাতের মুঠো ব্যথা করছিল৷ ও হাত কচলে ব্যথা তাড়ানোর চেষ্টা করতে লাগল৷ কিন্তু ভয়…ভয়টা তাড়ানো যায় কেমন করে?

রনিতা ঘষা-ঘষা গলায় বললেন, ‘শোন মেয়ে, এই মুহূর্তে তুই যা-যা দেখছিস সবই তোর দেখার ভুল৷ এ-কথা মনে থাকে যেন! সব হ্যালুসিনেশান৷’ তারপর একটু রাগি কর্কশ স্বরে বললেন, ‘তোর সাহস তো কম নয়! আমাদের সঙ্গে মোকাবিলা করতে আসিস! এই দেখ…৷’

সমর্পিতাকে দিশেহারা কাবু অবস্থায় পেয়ে রনিতা যেন বেশ মজা পেয়ে গেছেন৷ ঠোঁটজোড়া ছুঁচলো করে টিউবলাইটগুলোর দিকে একবার তাকালেন৷ তারপর ক্ষণপ্রভার গতিতে চোখের পলকে পৌঁছে গেলেন দেওয়ালে গাঁথা ইলেকট্রিক ওয়ারিং-এর কাছে৷ তারগুলোর ওপরে হিংস্র কামড় বসিয়ে দিলেন৷

আলোর ফুলকি ছিটকে বেরোল৷ ‘ফট’ করে একটা শব্দ হল৷ এবং ঘরের আলো নিভে গেল৷ ঘুরন্ত পাখার গতি কমতে লাগল৷

ঘরটা কেমন অদ্ভুত আঁধারে ছেয়ে গেল৷ জানলার বাইরে মেঘ আর বৃষ্টি যেন অকালসন্ধ্যা তৈরি করে দিয়েছে৷ সম্পির চোখের সামনে রনিতা ম্যাডামের অপচ্ছায়া৷ তাঁর চোখের অন্ধকার কোটরে দুটো সাদা আলোর বিন্দু ধকধক করে জ্বলছে৷ আর একইসঙ্গে শোনা যাচ্ছে চাপা খিলখিল হাসি৷

কর্কশ গলায় পিশাচটা বলল, ‘এবার বুঝেছিস, আমাদের কী শক্তি! আজকের এসব ব্যাপার কাউকে বলবি না৷ কাউকে না৷ যদি বলিস, তা হলে—যা বললাম—তুইও পরানের মতো হয়ে যাবি…৷’

এমন সময় তীব্র বিদ্যুৎ ঝলসে উঠল৷ পরক্ষণেই প্রচণ্ড শব্দে বাজ পড়ল৷

সেই কানফাটানো আওয়াজে সম্পির আতঙ্কের ঘোরটা হঠাৎই কেটে গেল৷ ও ‘বাঁচাও! বাঁচাও!’ বলে চিৎকার করতে শুরু করল এবং কোন এক শক্তিতে খোলা দরজার দিকে মরণপণ ছুট লাগাল৷

পিশাচটা ছুটন্ত সম্পিকে লক্ষ করে লাফ দিল৷ দু-লাফে পৌঁছে গেল দরজার কাছে৷

কিন্তু সম্পি ততক্ষণে বাইরের চাতালে এসে পড়েছে৷ ঝুপুস বৃষ্টি ওকে যেন হারানো শক্তি ফিরিয়ে দিল৷ ও ফিরে তাকাল টিচার্স রুমের দরজার দিকে৷

রনিতা ম্যাডাম সম্পিকে তাড়া করার ঝোঁকে টিচার্স রুম ছেড়ে চাতালে এসে পড়েছিলেন৷ কিন্তু বৃষ্টির জল গায়ে পড়তেই আঁতকে উঠলেন৷ এমনভাবে কাতরে উঠলেন যেন বৃষ্টির ফোঁটায় গায়ে ফোসকা পড়ছে৷

যন্ত্রণার ‘উঃ! আঃ!’ শব্দ করে রনিতা একলাফে টিচার্স রুমে আবার ঢুকে গেলেন৷

সম্পি সেটা দেখে অবাক হয়ে অঝোর বৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে ভিজতে লাগল৷ বৃষ্টির জলে কী এমন শক্তি আছে যে, এই পিশাচগুলো বৃষ্টির জলের ‘জ্বালা’ সইতে পারে না?

টিচার্স রুম এখন বেশ অন্ধকার৷ তাই রনিতা ম্যাডামকে সম্পি ভালো করে দেখতে পাচ্ছিল না৷ কিন্তু ম্যাডাম ঘরে ঢুকে পড়ার আগে সম্পি একটা ব্যাপার লক্ষ করেছে৷ ওঁর শরীরে বৃষ্টির ফোঁটা পড়ামাত্রই সেখান থেকে সাদা ধোঁয়া বেরিয়েছে৷ গরম লোহার শিক আচমকা জলে ডোবালে যেমনটা হয়৷

তা হলে কি সত্যি-সত্যিই বৃষ্টির ফোঁটায় এই পিশাচগুলোর ছ্যাঁকা লাগে? সেইজন্যই কি সেই ভয়ংকর রাতে এদের মাথায় ছাতা ছিল?

সম্পি তখনও চিৎকার করছিল : ‘কে কোথায় আছ, শিগগির এসো! দোতলায় আগুন লেগেছে—আগুন!’

কিন্তু বৃষ্টির ফোঁটার ব্যাপারটা বুঝে ফেলার পর ওর হারানো সাহস খুব তাড়াতাড়ি ফিরে এল৷ তা ছাড়া ও লোকজনের ছুটে আসার শব্দ পাচ্ছিল৷

সম্পি আঁজলা করে বৃষ্টির জল ধরতে লাগল৷ এবং এগোতে লাগল টিচার্স রুমের দিকে৷ ওর ভেতরে এখন একটা রাগ টগবগ করে ফুটছিল৷

রনিতা ইলেকট্রিকের তারে কামড় বসানোমাত্রই শর্ট সার্কিট হয়ে স্কুল বিল্ডিং-এর অনেকটা অংশের আলো নিভে গেছে৷ সেই সময় দুজন দারোয়ান রোজকার মতো একতলার ঘরগুলোর জানলা-দরজা বন্ধ করে দরজায়-দরজায় তালা দিচ্ছিল৷ আচমকা অন্ধকার হয়ে যাওয়ায় ওরা হকচকিয়ে যায়৷ আর তারপরই সম্পির চিৎকার ওদের কানে এল৷

সম্পির চিৎকার সার্ভেন্টস কোয়ার্টারেও পৌঁছেছিল৷ সেখান থেকে বলাইদা আর মলিনাদি হন্তদন্ত হয়ে এসে দারোয়ানদের সঙ্গে জড়ো হল৷ ওরা চারজন তাড়াতাড়ি সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠতে শুরু করল৷ বুঝতে পারল, চিৎকারটা দোতলার চাতাল থেকে আসছে৷

তা হলে কি দোতলাতেই আগুন লেগেছে?

কিন্তু ওরা চারজনে চাতালে এসে কাউকে দেখতে পেল না৷ আর আগুনও দেখতে পেল না৷

কারণ, সম্পি তখন বৃষ্টির জল আঁজলা করে নিয়ে টিচার্স রুমে ঢুকে পড়েছে৷ ওর শরীর থরথর করে কাঁপছে৷ সারা গা সপসপে ভেজা৷ মাথার চুল থেকে জলের ধারা গড়িয়ে পড়ছে৷ চুলের গোছা কপালের ওপরে নেমে এসেছে৷ আর সেই ভেজা চুলের ফাঁক দিয়ে ওর দুটো রাগি চোখ দেখা যাচ্ছে৷

‘কোথায় গেলি? আয়, সামনে আয়—’ পিশাচকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিল ডাকাবুকো মেয়েটা৷

রনিতা তখন একটা আলমারির গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে লুকোতে চেষ্টা করছেন৷ ওঁর অন্ধকার গর্তের মতো চোখ দুটো সম্পির দিকে তাকিয়ে স্থির৷ আসলে ওরা তখন সম্পির আঙুলের ফাঁক দিয়ে চুঁইয়ে পড়া বৃষ্টির জলের দিকে লক্ষ রাখছিল৷ অপেক্ষা করছিল, কখন সেই চুঁইয়ে পড়া বন্ধ হবে৷ অর্থাৎ মেয়েটার এক আঁজলা জল কখন শেষ হবে৷

জল শেষ হয়ে যাবে বলে সমর্পিতার মনে কিন্তু ভয় ছিল না৷ ও জানে ওর পোশাক-আশাক থেকে শুরু করে সর্বাঙ্গ বৃষ্টির জলে ভিজে সপসপে৷ এই অবস্থায় ওর পিশাচটাকে জড়িয়ে ধরার খুব সাধ জাগছিল৷

সম্পি হঠাৎই খেয়াল করল, আলমারির পাশে দাঁড়ানো রনিতার চেহারা ধীরে-ধীরে বদলে যাচ্ছে—স্বাভাবিক হয়ে যাচ্ছে আবার৷ একইসঙ্গে দোতলার চাতালে অনেকের পায়ের শব্দ শোনা যাচ্ছে—কথা বলতে-বলতে কারা যেন টিচার্স রুমের দিকে এগিয়ে আসছে৷

সম্পির হাতের জল শেষ হয়ে গিয়েছিল৷ রনিতাকে ও এখন আরও স্পষ্টভাবে দেখতে পাচ্ছিল৷

রনিতা হিসহিস করে চাপা গলায় বললেন, ‘আজকে যা কিছু দেখলি কাউকে বলবি না৷ তা হলে তোর সর্বনাশ হবে৷ মনে রাখিস, আমি একা নই—আমরা সবাই মিলে তোকে অনায়াসে খতম করে দেব…৷’

রনিতা ম্যাডাম স্বাভাবিক চেহারায় ফিরে এলেন৷ ঠোঁটে আঙুল তুলে ইশারায় সমর্পিতাকে চুপচাপ থাকতে বললেন৷

‘কই, কোথায় আগুন লেগেছে?’ পুরুষের গলা : ‘ঘর অন্ধকার কেন?’

‘কে অমন চিৎকার করছিল গো?’ মহিলার কণ্ঠস্বর : ‘কী-করে আগুন লাগল বলো দেখি…৷’

সমর্পিতা পিছন ফিরে চারজনকে দেখতে পেল৷ ওরা তখন বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচতে হুড়মুড় করে টিচার্স রুমে ঢুকে পড়েছে৷

সমর্পিতা কিছু বলে ওঠার আগেই মানুষের ছদ্মবেশে থাকা পিশাচটা বলে উঠল, ‘এই তো, এই তারটা শর্ট সার্কিট হয়ে আর-একটু হলেই আগুন লেগে যাচ্ছিল৷ ভাগ্যিস আমি এই ডাস্টারটা দিয়ে সঙ্গে-সঙ্গে চেপে ধরেছি—৷’

টেবিল থেকে একটা ডাস্টার তুলে নিয়ে দেখালেন রনিতা৷

সম্পি স্থির চোখে ওঁকে দেখছিল৷ পিশাচরা তা হলে অভিনয়টা ভালোই জানে!

রনিতা বললেন, ‘সমর্পিতা থাকায় একটা বড় হেলপ হয়েছে৷ ও সঙ্গে-সঙ্গে ওরকম না চেঁচালে তোমরা কি এত চটপট আসতে?’ সমর্পিতার দিকে তাকিয়ে হাসলেন : ‘থ্যাংক য়ু, সমর্পিতা৷ তোমাকে আমি কাল একটা রিওয়ার্ড দেব…৷’

ঠিক তখনই সাদা আলোর ঝলকানি, আর তারপরই কড়কড় শব্দে বাজ পড়ল কোথাও৷

আট

সমর্পিতা স্কুল বিল্ডিং-এর বাইরে এসে দাঁড়াল৷ বৃষ্টির তেজ খানিকটা কমে এসেছে৷ মেঘলা আকাশের সঙ্গে সন্ধের অন্ধকার মিশে গিয়ে ছাই রং অনেক গাঢ় হয়েছে৷

সমর্পিতার ব্যাগে ছাতা আছে কিন্তু ও ছাতা বের করল না৷ একে তো ওর সর্বাঙ্গ চুপচুপে ভেজা—ছাতা ওকে নতুন কোনও নিরাপত্তা দিতে পারবে না৷ বরং বৃষ্টির জল ওকে রনিতা ম্যাডামের মতো ভয়ংকর প্রাণীগুলোর হাত থেকে বাঁচাবে৷

সমর্পিতা বড়-বড় শ্বাস নিচ্ছিল, থরথর করে কাঁপছিল৷ ওর বুকের ভেতরে ঢিপঢিপ করে শব্দ হচ্ছিল৷ তার সঙ্গে বেশ শীত করছিল৷

ও কালো আকাশের দিকে তাকাল৷ বৃষ্টি উপহার দেওয়ার জন্য ঈশ্বরকে মনে-মনে কৃতজ্ঞতা জানাল৷

স্কুল বিল্ডিং-এর কাছ থেকে পিচের রাস্তা এঁকেবেঁকে চলে গেছে মেন গেটের দিকে৷ সেই রাস্তা ধরে হাঁটতে শুরু করল সম্পি৷ হেঁটে যাওয়ার সময় ও বারবার বাঁ-দিকের ঝোপঝাড় আর গাছপালার দিকে তাকাচ্ছিল৷ এই গাছপালার আড়ালে রনিতা ম্যাডামের মতো কেউ লুকিয়ে নেই তো?

কিন্তু সঙ্গে-সঙ্গেই ওর মনে হল, যেরকম জোরে বৃষ্টি পড়ছে তাতে খোলা জায়গায় ওরা থাকতে সাহস পাবে না৷ বৃষ্টিতে গায়ে ফোসকা পড়ে যাবে৷ আর যদি সেদিনের মতো ছাতা মাথায় দিয়ে ঘোরাঘুরির কথা ভাবে তাতেও লাভ নেই৷ কারণ, এ-বৃষ্টি ছাতায় তেমন মানবে না৷

সম্পি তাড়াতাড়ি হাঁটছিল৷ বাড়ি ফিরতে দেরি হয়ে যাবে৷ স্কুল থেকে বেরিয়েই বাস কিংবা অটো পেলে হয়৷

ভেজা পিচের রাস্তায় বৃষ্টির ফোঁটা আছড়ে পড়ছে৷ রাস্তার ধারে লাগানো সোডিয়াম ভেপার ল্যাম্পের আলো রাস্তায় পড়ে কমলা রঙের আলোর ফুলকি তৈরি করছে৷ স্কুলের দু-চারজন মেয়ে তাদের গার্জেনের সঙ্গে ফিরছে৷ এ ছাড়া রাস্তাটা বেশ ফাঁকা-ফাঁকা৷ আর দূরের খেলার মাঠটা বৃষ্টিতে ঝাপসা৷

‘এই, সম্পি—৷’

সমর্পিতা চমকে উঠল৷ বুক ধড়াস করে উঠল৷ ডাক লক্ষ্য করে ফিরে তাকাল৷

ও খেয়ালই করেনি, একটা বড় নিমগাছের নীচে দুটো মেয়ে ছাতা মাথায় দাঁড়িয়ে রয়েছে৷

ইলিনা আর সজনী৷

ওরা দুজনে সম্পির কাছে এগিয়ে এল৷

‘তোর জন্যে চিন্তা হচ্ছিল৷ তাই বাড়ি যাইনি—ওয়েট করছি৷’ ইলিনা বলল, ‘রনিতা ম্যাডাম কী শাস্তি দেয় না দেয়৷ আমি ওয়েট করব শুনে সজনীও থেকে গেল৷’

‘তুই ভিজছিস কেন? ছাতা নেই?’ সজনী জিগ্যেস করল৷

‘তুই এরকম কাঁপছিস কেন?’ ইলিনা৷

সমর্পিতা আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না৷ ইলিনাকে জাপটে ধরে হাউ-হাউ করে কাঁদতে শুরু করল৷

ইলিনা হকচকিয়ে গেল৷ কোনও-রকমে ছাতা সামলে সম্পির ভেজা পিঠে হাত বোলাতে লাগল আর বারবার বলতে লাগল, ‘কী হয়েছে রে, সম্পি—কী হয়েছে?’

সম্পি কাঁদতেই থাকল৷ ওর শরীরটা কেঁপে-কেঁপে উঠতে লাগল৷ আর একইসঙ্গে পাগলের মতো মাথা নেড়ে বলতে লাগল, ‘কিছু হয়নি, কিছু হয়নি৷’

ইলিনা আর সজনী কিছুতেই ওকে শান্ত করতে পারছিল না৷

একটু পরে দু-পাশ থেকে সম্পিকে জাপটে ধরে ওরা মেন গেটের দিকে এগিয়ে চলল৷ ইলিনার মনে হল, রনিতা ম্যাডাম নিশ্চয়ই সম্পিকে সাংঘাতিক অপমান করেছেন, কিংবা চড়-থাপ্পড় মেরেছেন বা কান মুলে দিয়েছেন৷

ওরা যখন স্কুলের গেটের কাছাকাছি এসে পড়েছে তখন একটা গাড়ির হেডলাইটের জোরালো আলো ওদের চোখে-মুখে এসে পড়ল৷

আলোর দিকে তাকিয়ে ওদের চোখ ধাঁধিয়ে গেল৷ বৃষ্টির ফোঁটাগুলোকে ওরা স্পষ্ট দেখতে পেল৷ কিন্তু আলোর পিছনে সব অন্ধকার—কিছুই দেখা যাচ্ছে না৷

গাড়িটা ওদের দিকে ধীরে-ধীরে এগিয়ে আসতে শুরু করল৷

সেটা দেখে ইলিনারা পিচের রাস্তার পাশে ঘাসজমির দিকে সরে গেল৷ কিন্তু গাড়িটা গতিপথ বদলে ওদের মুখোমুখি এসে পথ আগলে দাঁড়াল৷

ইলিনা একটু ভয় পেয়ে গেল৷ সজনীও৷ গাড়িটা ওদের পথ আগলে দাঁড়াল কেন?

ঠিক তখনই গাড়ি থেকে কে যেন ডেকে উঠল, ‘ইলিনা, এসো—সবাই গাড়িতে উঠে এসো…৷’

অনুষ্কার গলা৷

অনুষ্কা এখনও বাড়ি যায়নি? ছুটির পর এতক্ষণ ধরে ও কী করছে?

ওরা তিনজনে গাড়ির পাশে গিয়ে দাঁড়াল৷ দেখল সামনের জানলার কাচটা সামান্য নামানো৷ সেখানে আবছাভাবে অনুষ্কার মুখ দেখা যাচ্ছে৷ ওর পাশেই স্টিয়ারিং-এ ওর বাবা৷

‘তাড়াতাড়ি গাড়িতে উঠে এসো—৷’ অনুষ্কা তাড়া দিল৷ গাড়ির পিছনের দরজাটা খুলে গেল৷

সম্পিকে গাড়িতে উঠতে বলল ইলিনা৷ তারপর ছাতা বন্ধ করে নিজে উঠল৷

সজনী ইতস্তত করছিল৷ বলল, ‘আমি বাড়ি যাব—৷’

অনুষ্কা বলল, ‘চিন্তা কোরো না—আমি সবাইকে বাড়িতে ড্রপ করে দেব৷’

ওরা তিনজনে পিছনের সিটে বসে দরজা বন্ধ করতেই গাড়ি ছেড়ে দিল৷

অনুষ্কা ওর বাবার সঙ্গে সম্পি আর সজনীর পরিচয় করিয়ে দিল৷ ওর বাবা গাড়িটা ইউ টার্ন নিয়ে ঘুরিয়ে বললেন, ‘কী বাজে বৃষ্টি! তোমরা সব একেবারে ভিজে গেছ দেখছি!’

ইলিনা সৌজন্যের ঢঙে বলল, ‘ও কিছু না, কাকু—বাড়িতে গিয়ে ড্রেস চেঞ্জ করে নেব৷’

সমর্পিতার গা ঘেঁষে বসেছিল ইলিনা৷ তাই টের পাচ্ছিল সম্পি তখনও তিরতির করে কাঁপছে৷

ও চাপা গলায়, প্রায় ফিসফিস করে, জিগ্যেস করল, ‘সম্পি তোর কী হয়েছে রে? এবার শান্ত হ৷’

সমর্পিতা অস্পষ্টভাবে বলল, ‘কিচ্ছু না—৷’

অনুষ্কা ওদের কথা শুনতে পেয়েছিল৷ ও নরম সুরে বলল, ‘এখন ওকে ডিসটার্ব কোরো না৷ আমি সব জানি৷ পরে কখনও ওর সঙ্গে কথা বলব…৷’

সমর্পিতা অবাক হয়ে অনুষ্কার দিকে তাকাল, কিন্তু কিছু বলল না৷

ভিজে রাস্তায় গাড়ি চলতে লাগল৷

জানলা দিয়ে বাইরে তাকাল সম্পি৷ বৃষ্টি এখনও পড়ছে৷ সেই বৃষ্টির ফোঁটার ঝিলিমিলির আড়ালে রনিতা ম্যাডামের পালটে যাওয়া মুখটা ও দেখতে পাচ্ছিল৷

আজ বৃষ্টি নেই৷ খোলা জানলার বাইরে অন্ধকার৷ বাতাসে গাছের পাতা নড়ছে৷

জানলার সামনে দাঁড়িয়ে অনুষ্কা অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে ছিল৷ কী দেখছিল কে জানে!

হঠাৎ করে ও ঘুরে দাঁড়াল৷ বিছানায় বসে থাকা ইলিনার দিকে সরাসরি তাকাল৷

বেশ কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থাকার পর গায়ের সবুজ রঙের টপটা কোমরের কাছ থেকে ইঞ্চিচারেক ওপরে তুলে ধরল ও৷

ওর নাভির ঠিক ওপরে কালো রঙে আঁকা একটা ছবি : একটা ফুলকে ঘিরে আছে দুটো সাপ—তাদের লেজের কাছটা একে অপরের সঙ্গে জড়ানো৷

ঠিক এই ছবিটাই লাগানো রয়েছে ওর ঘরের দেওয়ালে৷ এই ছবিটাই ওকে খাতার পাতায় আঁকতে দেখেছিল ইলিনা৷ তখন ওর ছবিটা ভালো লেগেছিল৷ ও তা থেকে ট্যাটুর ডিজাইন করতে চেয়েছিল৷ কিন্তু অনুষ্কা তাতে সায় দেয়নি৷ বাজে ওয়ার্থলেস ছবি বলে কাটাকুটি দাগ দিয়ে ছবিটা নষ্ট করে দিয়েছিল৷

অথচ সেই ছবিটাকেই বডি ট্যাটু করে বসে আছে ও!

‘এই ছবিটাকে তুমি বাজে ওয়ার্থলেস বলেছিলে—’ অভিযোগের সুরে বলে উঠল ইলিনা, ‘আর সেই ছবিটাকেই ট্যাটু করে বসে আছ! আশ্চর্য!’

অনুষ্কা অল্প হাসল৷ টপটা তুলে ধরা অবস্থায় কয়েকটা পা ফেলে ইলিনার খুব কাছে এগিয়ে এল৷ বলল, ‘তুমি ভুল করছ, ইলিনা—এটা মোটেই ট্যাটু নয়৷ হাত দিয়ে দ্যাখো…৷’

সত্যিই ইলিনা আঙুল ছোঁয়াল ছবিটায়৷ ছবিটা যে উল্কি নয় সেটা বুঝতে চাইল : ‘ট্যাটু নয় তো এটা তা হলে কী?’

‘এটা জন্মদাগ৷ মানে, জন্মচিহ্ন৷ আমাদের সবার পেটে আছে৷’

‘জন্মচিহ্ন মানে?’

‘জন্মচিহ্ন মানে জন্মের সময় থেকেই এই দাগটা আমাদের সবার পেটে থাকে…৷’

‘আমাদের সবার মানে কারা?’ অবাক হয়ে প্রশ্ন করল ইলিনা৷

‘আমি, বাপি, মা—আমাদের সবার পেটে এই ছবি আছে—জন্মদাগ৷’

‘কেন? এ কী পিকিউলিয়ার ব্যাপার!’

টপটা ছেড়ে দিল অনুষ্কা৷ ওটা টেনেটুনে ঠিকঠাক করে নিল৷ তারপর ইলিনার চিবুকে হাত দিয়ে বলল, ‘পিকিউলিয়ার নয়, ইলিনা৷ ভ্যাম্পায়ারদের এটাই নিয়ম…৷’

‘ভ্যাম্পায়ার?’ ভয়ে সিঁটিয়ে গেল ইলিনা৷ অনুষ্কার হাতটা সরিয়ে দিল : ‘কী বলছ তুমি!’

‘হ্যাঁ, ইলিনা—’ নীচু গলায় বলল, ‘ভ্যাম্পায়ারদের চেনার এটাই সবচেয়ে বড় চিহ্ন৷ তা ছাড়া এই সিম্বলটা আমাদের কাছে খুব পবিত্র…’ দেওয়ালে লাগানো সাপ আর ফুলের ছবিটার দিকে দেখাল : ‘এটা আমাদের পোশাকের আড়ালে লুকিয়ে থাকে৷ তাই আমাদের দেখে সাধারণ মানুষ বলে মনে হয়…৷ অবশ্য এটা দেখতে পেলেও সবাই ট্যাটু ভাববে৷

ইলিনা কাঁপছিল৷ ওর চোখ বড়-বড় হয়ে গিয়েছিল৷ ও ভয়ের চোখে সহপাঠীকে দেখছিল৷

অনুষ্কা ভ্যাম্পায়ার!

‘ইলিনা, প্লিজ…ভয় পেয়ো না৷ মানুষের মতো…আমাদের মধ্যেও… ভালো-খারাপ আছে৷ আমরা ভালো, ইলিনা, বিশ্বাস করো—৷’

ইলিনার মাথা ঝিমঝিম করছিল৷ চোখে ঝাপসা দেখছিল৷ ও মাথা পিছনে হেলিয়ে বিছানায় দু-হাতে ভর দিল৷

ওর চোখ গেল দেওয়ালে টাঙানো রাতের ছবিটার দিকে৷ জ্যোৎস্না ধোওয়া রাত৷ বিশাল প্রাসাদ৷ পূর্ণিমার চাঁদ৷

আগের দিন ছবিটা যেমন দেখেছিল আজ যেন একটু বদলে গেছে৷ প্রাসাদের ছায়ার পাশ থেকে চাঁদটা যেন অনেকটা দূরে সরে গেছে৷ আর আগের দিন, যতদূর ইলিনার মনে পড়ছে, বাড়িটার একটা জানলায় আলো জ্বলছিল৷

আজ আলো জ্বলছে দুটো জানলায়!

নিজেকে সামলে নিল ইলিনা৷ মাথা ঝিমঝিম করলে চলবে না৷ চোখে ঝাপসা দেখলে চলবে না৷

ও তাকাল অনুষ্কার মুখের দিকে৷

এই অপরূপ রূপসী মেয়েটা ভ্যাম্পায়ার!

আজ টিফিনের সময় অনুষ্কা ইলিনাকে ডেকেছিল৷

ইলিনা ওর কাছে যেতেই ও বলেছে, ‘তোমার সঙ্গে অনেক কথা আছে৷ ভীষণ ইমপরট্যান্ট কথা৷ তুমি আজ ছুটির পর আমাদের বাড়ি চলো—প্লিজ৷’

অনুষ্কার মুখে আকুতির ভাব ফুটে উঠেছিল৷ মনে হচ্ছিল, এমন সব কথা ও ইলিনাকে বলতে চায় যেগুলো না বলতে পারলে ও কষ্ট পাবে৷

ইলিনা রাজি হয়েছিল৷ একইসঙ্গে ওর মনে হয়েছিল, রনিতা ম্যাডামের সমস্যাটা যদি সমাধান করতে হয় তা হলে অনুষ্কার সাহায্য দরকার৷ কারণ, সমর্পিতার ব্যাপারটা যে ইলিনা জানতে পেরেছে সেটা শুধু অনুষ্কার জন্য৷

ওই ঘটনার পর সমর্পিতা এক সপ্তাহ স্কুলে আসেনি৷ ওর বাড়িতে ফোন করে ইলিনা জেনেছে, পরদিন ভোরবেলা থেকে সম্পির খুব জ্বর৷ সেই জ্বর এতটাই খামখেয়ালিভাবে ওঠানামা করছিল যে, সম্পির মা-বাবা খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন৷ তা ছাড়া সম্পি জ্বরের মধ্যে ভুল বকছিল৷ সবকিছু মিলিয়ে ওর মা-বাবা ভাবছিলেন ব্যাপারটা ভাইরাল ফিভার নয়—অন্য কিছু৷

ইলিনা, সজনী আর অনুষ্কা একদিন স্কুলের পর সম্পিকে দেখতে গিয়েছিল৷ তখন ও অনেকটা সামলে উঠেছে৷

ইলিনা আর সজনী ওকে সেদিন টিচার্স রুমের ব্যাপার নিয়ে অনেক প্রশ্ন করল, কিন্তু সম্পি গোঁজ হয়ে বসে রইল৷ ঠিকঠাক কোনও জবাব দিল না৷

ওর মা নানান কথা বলছিলেন৷

‘দ্যাখো না, যে-মেয়ে সবসময় সাহসের বড়াই করে, সে কেমন ভয়ে চুপসে গেছে৷ এই তো, গত পরশু—যখন জ্বরটা খুব বেড়েছিল—তখন জ্বরের ঘোরে প্রলাপ বকছিল৷ বারবার বলছিল, “বৃষ্টির জল৷ বৃষ্টির জল দিয়েই খতম করতে হবে…বৃষ্টির জল চাই…বৃষ্টি চাই৷”

‘আমি ওকে মাথায় জলপটি দিয়ে, ধাক্কা দিয়ে সাড় ফেরাতেই কেমন ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল৷ অনেকবার জিগ্যেস করলাম, “বৃষ্টির জল দিয়ে কী করবি বলছিলি?” তো ও হাঁ করে তাকিয়ে রইল—কোনও জবাব দিল না৷ বলো দেখি, কী মুশকিল!

‘তা ছাড়া ক’দিন ধরে খাবারদাবার কিছু মুখে তুলছে না৷ শুধু বলছে খিদে নেই৷ তোমরা ওকে একটু বুঝিয়ে বলো তো৷ ঠিকঠাক না খেলে শরীরে জোর পাবে কেমন করে?’

সম্পির মা একটানা কথা বলে যাচ্ছিলেন৷ আর অনুষ্কা শান্ত চোখে সম্পির দিকে তাকিয়ে ওকে দেখছিল৷

‘ও, হ্যাঁ৷ তোমাদের একজন দিদিমণি বাড়িতে ফোন করেছিলেন৷ সম্পি কেমন আছে সে-খবর নিচ্ছিলেন৷ বললেন, সম্পি ওঁর খুব প্রিয় স্টুডেন্ট…৷’ মেয়ের দিকে ঘুরে তাকালেন : ‘অ্যাই, কী নাম যেন ওই দিদিমণির? তোকে যে সেদিন বললাম…৷’

সম্পি নিষ্প্রাণ স্বরে বলল, ‘রনিতা ম্যাডাম৷’

ইলিনা আর সজনী মুখচাওয়াচাওয়ি করল৷ কিন্তু কোনও কথা বলল না৷

একটু পরে সম্পির মা ঘর ছেড়ে চলে যেতেই অনুষ্কা বলল, ‘সম্পি, রনিতা ম্যাডাম তোমাকে থ্রেট করেছেন?’

সম্পি চুপ করে রইল৷ বিছানার চাদরের দিকে তাকিয়ে রইল৷ আঙুল খুঁটতে লাগল৷

‘আমি সব জানি, সম্পি৷ রনিতা ম্যাডাম এখন আর মানুষ নেই— অন্য কিছু হয়ে গেছেন৷ পরানের মার্ডারে রনিতা ম্যাডাম ইনভলভড…৷’

সমর্পিতা চমকে মুখ তুলে তাকাল৷ ইলিনা আর সজনীও তাকাল অনুষ্কার দিকে৷

‘তুমি কেমন করে জানলে?’ সম্পি অস্পষ্ট গলায় জিগ্যেস করল৷

‘আমি জানি—’ আত্মবিশ্বাসের জোর ফুটে বেরোল অনুষ্কার উত্তরে : ‘সেদিন ঠিক কী হয়েছিল আমাকে খুলে বলো৷’ অনুষ্কা সম্পির কাঁধে একটা হাত রাখল : ‘কোনও ভয় নেই৷ আমরা তোমাকে হেলপ করতে চাই…৷’

তিনজনে মিলে আরও খানিকক্ষণ বোঝাতেই সম্পি নরম হল৷ ও দুর্বল গলায় ধীরে-ধীরে সেদিনকার সব ঘটনা খুলে বলল৷

শুনতে-শুনতে ইলিনা আর সজনীর ভেতরে ভয়ের হিমেল স্রোত ছড়িয়ে পড়ল৷ এসব কী বলছে সম্পি!

ওর কাহিনি শুনতে-শুনতে অনুষ্কা উত্তেজিত হয়ে পড়ল৷ ওর ফরসা গালে গোলাপি আভা ছড়িয়ে পড়ল৷

একসময় ওরা তিনজন উঠে পড়ল৷ বাড়ি ফিরতে হবে৷ বাইরে তখন বৃষ্টি পড়ছে৷

ক’দিন ধরেই রোজ ভালো বৃষ্টি হচ্ছে৷ রাস্তায় জল জমে যাচ্ছে৷

আজ সম্পির বাড়ি আসার ব্যাপারে অনুষ্কা একটু কিন্তু-কিন্তু করেছিল৷ বলেছিল, যদি সম্পির বাড়ির রাস্তায় জল জমে যায়, তা হলে কিছুতেই ও গাড়ি থেকে নামতে পারবে না৷

শেষ পর্যন্ত সেরকম বৃষ্টি হয়নি৷ কিন্তু তা সত্ত্বেও অনুষ্কা রেনকোট এবং ছাতা দুটোই নিয়ে বেরিয়েছে৷ এ নিয়ে ইলিনা আর সজনী ওর সঙ্গে ঠাট্টা করতে ছাড়েনি৷ কিন্তু অনুষ্কা সেই পুরোনো কথাই বলেছে : বৃষ্টি ওর ভালো লাগে না৷

সম্পির বাড়ি থেকে ফেরার পর তিনটে দিন অনুষ্কা কীরকম যেন আনমনা ছিল৷ তারপর আজ ইলিনাকে বাড়িতে ডেকে নিয়ে এসেছে৷

ইলিনা অন্ধকার প্রাসাদের ছবিটার দিকে তাকিয়ে ছিল৷ না, ও মোটেই ভুল দেখছে না৷ আজ সত্যি-সত্যিই দুটো জানলায় আলো জ্বলছে!

‘এই ছবিটার মধ্যে নিশ্চয়ই কোনও মিস্ট্রি আছে৷’ প্রাসাদের ছবিটার দিকে আঙুল দেখিয়ে ইলিনা বলল, ‘আজ দেখছি দুটো জানলায় আলো জ্বলছে! আমার স্পষ্ট মনে আছে, প্রথম যেদিন তোমার বাড়িতে এসেছিলাম সেদিন…৷’

ওকে থামিয়ে দিয়ে অনুষ্কা বলল, ‘বাড়িটার একটা জানলায় আলো জ্বলছিল৷’ তারপর ইলিনার পাশে বসে পড়ল : ‘সেদিন তোমাকে বলিনি—আজ বলছি৷ এই বাড়িটা আমাদের পূর্বপুরুষের—তিনহাজার বছরের পুরোনো৷ আমাদের মতন যারা…মানে, ইয়ে…তাদের প্রত্যেকের বাড়িতে এই ছবিটা লাগানো আছে৷ এই ছবিটার একটা সুপারন্যাচারাল পাওয়ার আছে৷ ওটা নিজে-নিজে অনেক কিছু করতে পারে—৷’

কথা বলতে-বলতে অনুষ্কা লক্ষ করল ইলিনার মুখে ভয়ের রেখা ফুটে উঠেছে৷ ও বিছানা ঘষটে অনুষ্কার কাছ থেকে পিছিয়ে যেতে চাইছে৷

অনুষ্কা ওর হাত চেপে ধরল৷ অনুনয়ের গলায় বলল, ‘ইলিনা, প্লিজ… বিলিভ মি৷ আমি তোমার বন্ধু—বেস্ট ফ্রেন্ড৷ এটা ঠিকই যে, আমাদের লাইফ আর লাইফ স্টাইল তোমাদের চেয়ে আলাদা৷ কিন্তু বিশ্বাস করো, আমরা কখনও মানুষের ক্ষতি করার কথা ভাবতে পারি না৷ তুমি কি বিশ্বাস করবে, আমরা প্রায় চারশো বছর ধরে মানুষের রক্তের তেষ্টা ভুলে গেছি! তার বদলে আমরা ইঁদুর, কাঠবিড়ালি, চড়াই, পায়রা এসব দিয়ে খিদে-তেষ্টা মেটাই! আমার বাপি আর মা কী বলেন জানো? বলেন, আমাদের অবজেকটিভ হল রেগুলার চেষ্টা করে-করে ফাইনালি ভেজিটারিয়ান হয়ে ওঠা৷ হ্যাঁ, এটাই আমাদের চরম মুক্তি৷’

অনুষ্কার মুখচোখ লাল হয়ে উঠল৷ বড়-বড় শ্বাস নিয়ে ও বলল, ‘আমাদের প্রবলেম একটাই, আমরা সেদ্ধ, ভাজা, পোড়ানো—মানে, রান্না করা খাবার একদম খেতে পারি না৷ আমাদের সিস্টেম নেয় না৷ তাই আমরা সবকিছু কাঁচা খাই৷

‘কিন্তু তা বলে আমরা হাল ছাড়িনি৷ আমরা প্রাণপণ চেষ্টা করছি৷ মানুষের বন্ধু হতে চেষ্টা করছি৷ মানুষের মতো হতে চাইছি৷ বিশ্বাস করো, প্লিজ…৷’

অনুষ্কার চোখ দিয়ে জল পড়ছিল৷ যেন হিরের কুচি ওর ফরসা গালের ওপরে চিকচিক করছিল৷

ওর দুঃখী মুখের দিকে তাকিয়ে ইলিনার মনে হল, এ চোখের জল মিথ্যে হতে পারে না৷ এর মধ্যে কোথায় যেন সত্যের ঝিলিক আছে৷

মুহূর্তের মধ্যে ইলিনার মনে এক আশ্চর্য আবেগ তৈরি হয়ে গেল৷ ও সামনে ঝাঁপিয়ে পড়ে অনুষ্কাকে জাপটে ধরল৷ সঙ্গে-সঙ্গে ওর চোখেও জল এসে গেল৷ কান্না জড়ানো গলায় ও বারবার বলতে লাগল, ‘তুমি আমার বন্ধু, অনুষ্কা৷ তুমি আমার বেস্ট ফ্রেন্ড…বেস্ট ফ্রেন্ড…৷’

নয়

সমর্পিতা যখন স্কুলে আবার এল তখন ওর জ্বর সেরে গেছে, কিন্তু শরীর খুব দুর্বল৷ আগের চেয়ে রোগা দেখাচ্ছে ওকে৷ পিঠের স্কুল-ব্যাগটা প্রকাণ্ড আর বেঢপ মনে হচ্ছে৷

সমর্পিতা এখন অনুষ্কার পাশে বসে৷ ফাঁক পেলেই ওর সঙ্গে গল্প করে৷ আর রনিতা ম্যাডামের ভয়ের কথা আলোচনা করে৷

অনুষ্কার অন্যপাশে বসে ইলিনা৷ অনুষ্কার পাশে বসতে ওর ভালো লাগে তাই৷

অনুষ্কার সঙ্গে আলাপ হওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই সমর্পিতা বুঝতে পেরেছে, অনুষ্কার বুদ্ধি অনেক তীক্ষ্ণ এবং গভীর৷

অনুষ্কার পরামর্শেই এখন ইলিনা, সজনী আর সমর্পিতা মোবাইল ফোন সঙ্গে নিয়ে স্কুলে আসে৷ সেটা হয় সাইলেন্ট মোডে রাখে অথবা অফ করে রাখে৷ কারণ দিদিমণিরা টের পেলেই শাস্তি পেতে হবে৷

সেদিন অনুষ্কার বাড়ি থেকে ফিরে আসার পর ইলিনা রাতে ঘুমোতে পারেনি৷ অন্ধকারে জেগে থেকে শুধু ওই অদ্ভুত মেয়েটার কথা ভেবেছে৷

ভ্যাম্পায়ারের গল্প ইলিনা বইয়ে পড়েছে, দু-একটা সিনেমাতেও দেখেছে৷ কিন্তু বাস্তবে ভ্যাম্পায়ার হয় বলে কখনও ভাবেনি৷ তা ছাড়া ভ্যাম্পায়াররাও যে খারাপ এবং ভালো দু-রকমের হতে পারে সেটাও কখনও ভেবে দেখেনি৷

অনুষ্কা ওকে বলেছে, ‘আমরা কখনও কারও ক্ষতি করি না৷ আমাদের ধর্মে অকারণে শক্তি ব্যবহার করা বারণ৷ আমাদের অনেকরকম সুপার ন্যাচারাল পাওয়ার আছে৷ কিন্তু সেগুলো খুব জরুরি সিচুয়েশান না হলে আমরা ইউজ করি না৷ আমরা সবসময় চুপচাপ থাকি, কারও ব্যাপারে নাক গলাই না৷ কারণ, আমরা…আমরা নিজেদের আসল পরিচয় গোপন রাখতে চাই৷’

অনুষ্কার গোপন কথা ইলিনা কাউকে বলেনি৷ এমনকী মা-বাবাকেও নয়৷

স্কুলে অনুষ্কার পাশে রোজ বসতে পেরে ইলিনার নিজেকে অনেক বেশি সাহসী, শক্তিশালী আর বুদ্ধিমতী মনে হচ্ছিল৷ মনে হচ্ছিল, রনিতা ম্যাডাম—কিংবা ওইরকম কোনও পিশাচ—ওর কোনও ক্ষতি করতে পারবে না৷

ইলিনা পরানের কথা ভাবছিল৷

পরান মারা যাওয়ার পর যে-ঢেউ উঠেছিল সপ্তাহদুয়েকের মধ্যে সেটা থিতিয়ে গেল৷ রাজা চন্দ্রভানু মালটিপারপাস গার্লস স্কুল আবার স্বাভাবিক ছন্দে ফিরে এল৷ এবং স্কুলের অ্যানুয়াল ফাংশানের রিহার্সাল আবার শুরু হয়ে গেল৷ হেডমিসট্রেস প্রীতি দত্ত নোটিশ জারি করে সে-কথা সব ক্লাসে জানিয়ে দিলেন৷

সমর্পিতা মাঝে-মাঝে রনিতা ম্যাডামের সঙ্গে দেখা করে৷ বন্ধুদের বলে ইতিহাস পড়া বুঝতে যাচ্ছে৷ আসলে ও এ-কথাই বলতে যায় যে, ও সেদিনকার কথা কাউকে বলেনি৷

রনিতা ম্যাডামকে দেখে ও অবাক হয়ে যায়৷ এত স্বাভাবিক, এত স্নেহ-মাখানো ব্যবহার! সেদিন কর্কশ-স্বরে-কথা-বলা ভয়ংকর চেহারার যে-পিশাচকে সমর্পিতা দেখেছিল সেটা মনে হয় যেন সত্যি-সত্যি দেখার ভুল, হ্যালুসিনেশান৷

রনিতা ম্যাডামের ওপর নজরদারির কাজটা ইলিনা, সজনী আর সমর্পিতা—তিনজনে মিলে করতে লাগল৷ ওরা চোখ-কান খোলা রেখে খুব সাবধানে পা ফেলতে লাগল৷ আর অনুষ্কাকে সব খবর জানাতে লাগল৷

স্কুলের পিছনদিকে বাউন্ডারি ওয়ালের কাছে অনেক বড়-বড় গাছ আছে৷ সেখানে গাছের ফাঁকে-ফাঁকে অনেক পুরোনো টিন, অ্যাসবেস্টস শিট, ভাঙা কাঠ, আর শ্যাওলা ধরা কয়েকশো ইট ডাঁই করে রাখা আছে৷

একদিন টিফিনের সময় বাইরের মাঠে অনুষ্কা আর ইলিনা গল্প করছিল৷ হঠাৎ কোকিলের মিষ্টি ডাক শোনা গেল৷

স্কুলের বাগানে সবসময়েই কোকিলের ডাক শোনা যায়৷ শুনে মনে হয় কোকিলরা শুধু বসন্তকাল নয়, বর্ষাকালেরও ইজারা নিয়ে নিয়েছে৷ ইলিনার খুব ইচ্ছে যে, ও ‘ডাকন্ত’ কোকিল দেখবে৷ ওর চোখ প্রায়ই সেই দৃশ্যটা খুঁজে বেড়ায়৷ কিন্তু সেই ‘দুর্লভ’ দৃশ্যটা ও আজও খুঁজে পায়নি৷

তাই টিফিনের সময় কোকিলের ডাক শুনেই ইলিনা একেবারে লাফিয়ে উঠল৷ ও অনুষ্কার হাত ধরে টানতে-টানতে ডাকের উৎস লক্ষ করে ছুট লাগাল৷

আন্দাজে ভর করে এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করে শেষ পর্যন্ত ওরা চলে এল স্কুলের পিছনের বাউন্ডারি ওয়ালের কাছে৷ গাছপালার অঞ্চলে ঢুকে ওপরদিকে মুখ তুলে গাছের ডালপালা আর পাতার ফাঁকে কোকিলটাকে খুঁজতে লাগল৷

অনুষ্কাই প্রথম দেখতে পেল পাখিটাকে৷ কুচকুচে কালো রং৷ একটা লম্বা গাছের ওপরদিকে একটা ডালের একেবারে গোড়ায় বসে আছে পাখিটা৷ ‘কু-উ, কু-উ’ করে ডাকছে৷

ইলিনা কোকিলটাকে দেখতে পেয়ে আনন্দে হাততালি দিয়ে উঠল৷ বলল, ‘আমার বহুদিনের একটা ইচ্ছে আজ ফুলফিলড হল—৷’

একটু পরেই পাখিটা উড়ে চলে গেল অন্যান্য গাছের আড়ালে৷

ওরা যখন ফিরে আসছে তখনই ইলিনার চোখে পড়ল, ইট-কাঠের স্তূপের পাশে দুটো লোমশ প্রাণী পড়ে আছে৷

দেখে চেনা গেল৷ একটা কাঠবিড়ালি, আর একটা বেজি৷ দুটো প্রাণী যেন পাশাপাশি ঘুমিয়ে আছে৷

ওরা চট করে সেগুলোর কাছে গিয়ে দাঁড়াল৷ ঝুঁকে পড়ে কাঠবিড়ালির দেহটা হাতে তুলে নিল অনুষ্কা৷

হালকা৷ ফাঁপা৷ বোঝাই যাচ্ছে, ভেতরে সারবস্তু কিছু নেই৷ গলার কাছটায় রক্ত জমাট বেঁধে আছে৷

ইলিনা বেজির দেহটা একবার তুলেই ফেলে দিল৷ সেটাও চরিত্রে কাঠবিড়ালিটার মতো৷

অনুষ্কা বলল, ‘বুঝতে পারছ, ডেডবডিগুলো অন্যরকম?’

‘হ্যাঁ, বুঝতে পারছি—পরানের মতন৷’

‘এগুলো বেশি পুরোনো নয়৷ গন্ধ থেকে বুঝতে পারছি…’ কাঠবিড়ালিটা ফেলে দিল : ‘কিছু একটা করা দরকার…৷’

ইলিনা ঘড়ি দেখল৷ এখুনি টিফিন শেষের ঘণ্টা পড়বে৷ রবিনা ম্যাডামের ক্লাস শুরু হয়ে যাবে৷ তাই ওরা স্কুল বিল্ডিং-এর দিকে প্রায় ছুট লাগাল৷

ওদের এই কয়েকদিনের গোয়েন্দাগিরিতে একটা ব্যাপার ওরা লক্ষ করেছে৷ ক্লাস নাইনের ‘এ’ সেকশানের একজন ছাত্রী আর ক্লাস টেন ‘সি’ সেকশানের একজন ছাত্রী প্রায়ই রনিতা ম্যাডামের সঙ্গে দেখা করতে যায়৷

ইলিনা, সজনী, সমর্পিতা আর অনুষ্কা ওরা যে যখন যা জানতে পারে সেটা এস-এম-এস করে বা ফোন করে বাকিদের জানিয়ে দেয়৷

পরানের মৃত্যুর ঘটনার পর স্কুলের সার্ভেন্টস কোয়ার্টারের সামনে অনেকগুলো বাড়তি আলো লাগানো হয়েছে৷ স্কুল ক্যাম্পাসের রাস্তায় যেসব ল্যাম্পপোস্টের আলো খারাপ ছিল সেগুলো পালটানো হয়েছে৷ এ ছাড়া বড়দি উদ্যোগ নিয়ে জঙ্গলের কিনারায়, বাস্কেটবল গ্রাউন্ড আর ফেস্টিভ্যাল হলের চারপাশে অনেকগুলো নতুন আলোর ব্যবস্থা করে দিয়েছেন৷

এই চেষ্টা দেখে রনিতা ম্যাডাম একদিন ব্যঙ্গ করে সম্পিকে বলেছেন, ‘আলো দিয়ে ভূত তাড়ানোর কনসেপ্ট বহুকাল হল বাতিল হয়ে গেছে৷ আলোয় আমাদের কোনও প্রবলেম নেই৷’ হাসলেন ম্যাডাম৷ তারপর : ‘যখন আমাদের তেষ্টা পায় তখন কীসের আলো আর কীসের অন্ধকার! তুই-ই বল…৷’

সম্পি কোনও জবাব না দিয়ে চলে এসেছিল৷ তারপর স্কুল ছুটির সময় বাকি তিনজন বন্ধুকে খবরটা জানিয়েছিল৷ তারপর বলেছিল, ‘ওর কথার টোনে আমার মনে হয়েছে খুব শিগগিরই ওরা আর-একটা বড় কুকীর্তি করতে চলেছে…৷’

ইলিনা ঠোঁট কামড়ে বলল, ‘রিহার্সাল আবার শুরু হয়েছে৷ আমার মনে হচ্ছে, ওই পিশাচটা যতই বলুক, রাতের আলোতেই ওদের অ্যাক্টিভিটি বেশি…৷’

এই দুশ্চিন্তাটা ইলিনার সঙ্গে বাড়ি পর্যন্ত গিয়েছিল৷ চিন্তায়-চিন্তায় বহুক্ষণ একা-একা ছটফট করার পর ও অনুষ্কাকে ফোন করেছে৷

অনুষ্কা ফোন ধরতেই ইলিনা বলেছে, ‘শোনো, তোমাকে একটা রিকোয়েস্ট করব—৷’

‘বলো৷’

‘কাল থেকে অ্যানুয়াল ফাংশানের রিহার্সাল আবার শুরু হচ্ছে৷ তুমি কাল থেকে রিহার্সালে চলো…৷’

অনুষ্কা ইতস্তত করল : ‘কী করে যাই বলো তো! একে তো কোনও প্রোগ্রামে আমি নাম দিইনি, তার ওপর আমি—মানে, আমরা—মানুষদের এড়িয়ে চলি৷ নইলে ধরা পড়ে যেতে হয়৷ যেমন তোমার কাছে ধরা পড়ে গেলাম৷’

‘কিন্তু তুমি যদি হেলপ না করো তা হলে কেমন করে হয়! তুমিই তো বলেছ, তুমি সব জানো৷ তুমি ভরসা দিয়ে বলেছ ‘‘আমি তো আছি!’’ ফাংশানের রিহার্সাল রোজ সাতটা-সাড়ে সাতটা পর্যন্ত চলবে৷ যদি কারও কোনও বিপদ হয়! যদি সম্পির আবার কোনও বিপদ হয়! ও তো রনিতা ম্যাডামের টার্গেট হয়ে আছে…৷’

অনুষ্কা চুপ করে ভাবছিল৷

ইলিনা আবার বলল, ‘ওসব জানি না, তুমি কাল রিহার্সালে যাবে৷ আর কিছু না পারো অন্তত একটা আবৃত্তি করবে৷ রবিনা ম্যাডামকে বলবে৷ তুমি রিহার্সালে থাকলে আমরা সবাই ভরসা পাব…৷’

কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর অনুষ্কা বলেছে, ‘ঠিক আছে—কাল থেকে আমি রিহার্সালে যাব৷’

আনন্দে ফুলঝুরি হয়ে গেল ইলিনা৷ বলল, ‘থ্যাংক য়ু, মাই বেস্ট ফ্রেন্ড৷’

পরদিন অনুষ্কাকে রিহার্সালে দেখে অনেকেই অবাক হল৷ এই মুখচোরা ইনট্রোভার্ট মেয়েটা অ্যানুয়াল ফাংশানে পার্টিসিপেট করবে! কিন্তু ওকে কেউ অপছন্দ করতে পারল না৷

ইলিনা জানে, অনুষ্কার মধ্যে এমন অনেক নাম-না-জানা গুণ আছে যার জন্য ওকে কেউ অপছন্দ করতে পারে না৷

অনেকদিন পর ফেস্টিভ্যাল হলটা জমজমাট হয়ে ওঠায় ইলিনাদের খুব ভালো লাগছিল৷ ওরা সবাই মিলে কলকল করে এমন গল্পে মেতে উঠল যে, ওদের চুপ করানোর জন্য শম্পা ম্যাডাম, রবিনা ম্যাডাম, কাকলি ম্যাডামকে বেশ কয়েকবার বকুনি দিতে হল৷ তাতে গুঞ্জনের আওয়াজ কমল বটে কিন্তু থামল না৷

রিহার্সালের তদারকিতে সমর্পিতা, অঙ্গনা, সজনী, রবিনা ম্যাডাম সবাই এদিক-ওদিক ব্যস্তভাবে ছুটোছুটি করছিলেন৷ কাকলি ম্যাডাম হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান তোলানো শুরু করে দিয়েছেন৷ শম্পা ম্যাডাম ক্লাস টেনের মধুরিমা আর শ্রাবন্তীকে নাচের একটা মুদ্রা বোঝাচ্ছেন৷

সব মিলিয়ে মনে হচ্ছিল, কিছু একটা হচ্ছে বটে!

একটা অশুভ ঘটনার পর রিহার্সাল আবার শুরু হচ্ছে৷ তাই বড়দি বলেছেন, তিনি রিহার্সালে আজ আসবেন—তা হলে সবাই উৎসাহ পাবে৷ তা ছাড়া আগে রিহার্সালে শুধু চা-বিস্কুট খাওয়ানো হত—আজ থেকে বড়দি টিফিন দেওয়ার ব্যবস্থা চালু করেছেন৷ বলেছেন, রিহার্সাল অনেকদিন বন্ধ থাকায় হাতে সময় অনেক কমে গেছে৷ তাই রোজ একটু বেশিক্ষণ ধরে রিহার্সাল করতে হবে আর সেইজন্যই ‘স্পেশাল’ টিফিন৷

রিহার্সাল পুরোদমে শুরু হয়ে গেল৷ প্রীতি দত্ত এখনও আসেননি৷ অফিসে কী যেন কাজ করছেন—সেটা সেরেই আসবেন৷ বড়দি যেহেতু রিহার্সালে কখনও আসেন না তাই ওঁর আসাটা একটা বড় ঘটনা৷

ইলিনারা বলাবলি করতে লাগল যে, এবার হয়তো রাশভারী বড়দিকে একটু-আধটু হাসতে দেখা যাবে৷ এ নিয়ে সজনী আর সমর্পিতা বাজিও ধরে ফেলল৷

আজকের সন্ধেটা খুব সুন্দর৷ কোনও বৃষ্টি নেই৷ সূর্য ডোবার পর হালকা ছাই রঙের আকাশ৷ তার ওপরে গাঢ় স্লেট রঙের লম্বা-লম্বা আঁচড়৷ বাতাসে গাছপালার পাতা নড়ছে৷

রিহার্সাল দিতে-দিতে বাইরেটা কখন যেন আঁধার হয়ে গেল৷

ইলিনা অনুষ্কার সঙ্গে গল্প করছিল৷ গত বছরের অ্যানুয়াল ফাংশানের কথা বলছিল৷ কে আবৃত্তি করতে গিয়ে কবিতার লাইন ভুলে গেছে, কে গানে ফার্স্ট প্রাইজ পেয়েছে, কাকলি ম্যাডামের গলা কী মিষ্টি—এই সব গল্প করছিল৷

এর মধ্যে আশাদিকে সঙ্গে করে প্রীতি দত্ত চলে এলেন৷ তিনি এসে পড়ায় অনেকেই তটস্থ হল, আবার খুশিও হল৷ তারপর টিফিনের প্যাকেট আর চা সবাইকে বিলি করা হল৷ সকলেই আনন্দ আর ফুর্তির মেজাজে টগবগ করছিল৷

ইলিনার বেশ ভালো লাগছিল৷ অনুষ্কাও জমজমাট ব্যাপারটা এনজয় করছিল৷ ও কখনও ভাবেনি এত মানুষের মাঝে ও এরকম অস্বস্তিহীনভাবে বসে থাকতে পারবে৷

ইলিনা লক্ষ করল, সম্পি ওর ব্যস্ততার ফাঁকে-ফাঁকে ফেস্টিভ্যাল হলের জানলার কাছে চলে যাচ্ছে৷ বাইরের অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে দেখছে৷ হয়তো সেই বিপজ্জনক সন্ধেটার কথা ও কিছুতেই ভুলতে পারছে না৷

হলের টিনের চালে থেকে-থেকেই খড়মড় আওয়াজ হচ্ছিল৷ ইলিনা জানে, ওগুলো গাছের শুকনো পাতা আর সরু ডালপালার শব্দ৷ হল ঘিরে যেসব বড়-বড় গাছ দাঁড়িয়ে আছে সেগুলো থেকে প্রায়ই ডালপাতা খসে পড়ে৷ কিন্তু তা সত্ত্বেও ওই আওয়াজগুলো ইলিনাকে অল্প-অল্প ভয় পাইয়ে দিচ্ছিল৷

প্রথমদিন বলে বড়দি সাতটা নাগাদ রিহার্সাল শেষ করে দিতে বললেন৷ ভয় এড়াতে সবাই দলবেঁধে হল থেকে বেরিয়ে মেন গেটের পথ ধরল৷

ইলিনার সঙ্গে পিচের রাস্তা ধরে এগোতে-এগোতে অনুষ্কা বলল, ‘মনে হয়, ভয় কেটে গেছে৷ ওই পিশাচরা ঘুমিয়ে পড়েছে…৷’

‘কী করে বুঝলে?’ ইলিনা অবাক হয়ে তাকাল বেস্ট ফ্রেন্ড-এর দিকে৷

অনুষ্কা বলল, ‘ওদের কেউ হয়তো আমাকে ফেস্টিভ্যাল হলে চিনে ফেলেছে৷ ওরা জানে, আমাদের মতো ভ্যাম্পায়াররা কখনও মানুষের প্রবলেমে ইনভলভড হয় না৷ কিন্তু আমাকে দেখে নিশ্চয়ই ওদের কেউ একজন বুঝেছে আমি তোমাদের প্রবলেমে জড়িয়ে পড়েছি—তোমাদের পাশে দাঁড়িয়েছি…৷’

‘তোমাকে ওরা এত ভয় পায়!’ অবাক হয়ে বলল ইলিনা৷

অনুষ্কা হাসল : ‘খারাপ ভ্যাম্পায়াররা ভালোদের সবসময় ভয় পায়৷ ওরা আমাদের ক্ষমতার কথা জানে৷ তবে এটাও জানে, আমরা সবসময় নিজেদের পরিচয় গোপন রাখতে চাই৷’

‘ওরা নিজেদের লুকিয়ে রাখতে চায় না?’

‘চায়—কিন্তু পারে না৷ রক্তের তেষ্টা ওদের পাগল করে দেয়৷ মানুষের গন্ধ ওদের মাথা খারাপ করে দেয়৷ তা ছাড়া পূর্ণিমার সময় ওদের এই পাগলামিটা মারাত্মক বেড়ে ওঠে৷ তখন ওরা পশু কিংবা মানুষ মেরে তেষ্টা মিটিয়ে উল্লাসে নেচে বেড়ায়—কোনও জ্ঞান থাকে না৷’

‘যেদিন রাতে আমি ওরকম তিনটে পিশাচকে গাছে নাচানাচি করতে দেখেছিলাম সেদিন কি তা হলে পূর্ণিমা ছিল?’

‘বোধহয় ছিল৷ সেদিন মেঘ-বৃষ্টি ছিল—তাই হয়তো বুঝতে পারোনি৷’

ইলিনা কিছুক্ষণ কী যেন চিন্তা করল৷ তারপর ভয়ে-ভয়ে আকাশের দিকে তাকাল৷

দূরে খেলার মাঠের কিনারায় শুকনো মরা গাছটা দাঁড়িয়ে আছে৷ তার ডালপালার আড়ালে চাঁদ দেখা যাচ্ছে৷ প্রায় গোল হয়ে এসেছে৷ কয়েকদিন পরেই শুক্লপক্ষের শেষ—তারপর পূর্ণিমা৷

চাঁদটা অনুষ্কাকে দেখাল ইলিনা : ‘ওই দ্যাখো—ক’দিন পরেই পূর্ণিমা৷’

‘কী করে বুঝলে?’ চাঁদের দিকে তাকিয়ে অনুষ্কা জানতে চাইল৷

‘খুব সোজা৷’ ইলিনা বলল, ‘চাঁদের ওপরদিকটা যদি ডানদিকে হেলে থাকে, তা হলে শুক্লপক্ষ চলছে৷ আর যদি বাঁ-দিকে হেলে থাকে তা হলে কৃষ্ণপক্ষ৷ চাঁদের নীচের দিকের বাঁকটা সেই অনুযায়ী কৃষ্ণপক্ষের “ঋ”-ফলা আর শুক্লপক্ষের হ্রস্ব “উ”-কারের বাঁকের সঙ্গে বেশ মিলে যায়৷ এটা আমাকে মা শিখিয়ে দিয়েছে—৷’ ইলিনা হাসল৷ কিন্তু তারপরই আসন্ন পূর্ণিমার কথা ভেবে ভয়ের গলায় বলল, ‘পূর্ণিমার সময় ওরা কিছু করতে পারে…৷’

কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে অনুষ্কা বলল, ‘শুধু পূর্ণিমা কেন? ভয় তো এমনিতেই আছে, কিন্তু পূর্ণিমার সময় ভয়টা আরও বেশি—’

হঠাৎই একটা ব্যাপার মনে পড়ে যাওয়ায় ইলিনা জিগ্যেস করল, ‘তুমি যে বললে তোমাকে ওরা চিনে ফেলেছে—কী করে চিনতে পারল?’

অনুষ্কা আলতো গলায় বলল, ‘আজ রিহার্সালে আমি টিফিন খাইনি—চা-ও খাইনি৷ সেটা হয়তো ওদের কেউ লক্ষ করেছে৷ তা ছাড়া আমাদের দেখতে খুউব সুন্দর হয়৷ আর আমাদের গা থেকে একটা গন্ধ বেরোয় অনেকটা দারচিনির গন্ধের মতো…৷’

চেনার চিহ্নগুলো মনে-মনে খতিয়ে দেখল ইলিনা৷ তারপর গন্ধটার কথা ওর মনে পড়ল৷ ও অনুষ্কার গাড়িতে আর বাড়িতে এইরকম গন্ধ পেয়েছিল৷ কিন্তু গা থেকে ওরকম গন্ধ বেরোলে তো এখনও সেই গন্ধ ইলিনার নাকে আসার কথা!

ওর মনের কথা কী করে যেন টের পেয়ে গেল অনুষ্কা৷ বলল, ‘ইলিনা, তোমার সঙ্গে আমার একটা মেন্টাল ম্যাচিং হয়ে গেছে৷ অনেকটা যেন রেডিয়ো স্টেশান ধরার টিউনিং-এর মতো৷ তাই তুমি হয়তো দু-একবার আচমকা ওই স্মেলটা পেয়ে গেছ৷ আসলে ওই গন্ধটা কুকুরের নাকে ধরা পড়ে—আর ওই পিশাচদের নাকেও৷ কুকুর প্রায় ন’হাজার রকম গন্ধ চিনতে পারে, মনে রাখতে পারে৷ আমরা প্রায় পাঁচশো রকম গন্ধ চিনতে পারি৷ রনিতা ম্যাডামের মতো পিশাচরাও তাই৷ তবে…৷’

‘আর আমরা? আমরা কতরকম গন্ধ চিনতে পারি?’

হাসল অনুষ্কা : ‘কিছু মনে কোরো না৷ তোমাদের বেলায় সংখ্যাটা মাত্র সত্তর থেকে আশি৷ আর তার মধ্যে এই দারচিনির মতো গন্ধটা পড়ে না৷ যেমন, তুমি এখন এই গন্ধটা পাচ্ছ না, তাই না?’

বিহ্বলভাবে মাথা নেড়ে সায় দিল ইলিনা৷ সত্যিই ওই গন্ধটা ও এখন পাচ্ছে না৷ ওই দু-বার ছাড়া কখনও পায়নি৷

হঠাৎই অনুষ্কার জন্য ভয় পেল ইলিনা৷ যদি ওই পিশাচগুলো অনুষ্কার কোনও ক্ষতি করে?

সে-কথাই জিগ্যেস করল ওকে৷

অনুষ্কা ছোট্ট করে হেসে বলল, ‘ভয় পেয়ো না৷ সেটা কিছুতেই পারবে না৷’

ওরা গাড়ির কাছে এসে গিয়েছিল৷ অনুষ্কা ইলিনাকে ওর বাড়িতে নামিয়ে দেবে এরকমই কথা হয়েছিল৷ তাই দুজনেই উঠে বসল গাড়িতে৷

অনুষ্কার বাবা গাড়ি স্টার্ট দিলেন৷ হেডলাইট জ্বেলে গাড়িটা এগিয়ে নিয়ে যেতে-যেতে বললেন, ‘কী, ফাংশানের রিহার্সাল কেমন হল?’

দুজনেই বলল, ‘ভালো—৷’

‘গুড—ভেরি গুড৷’ বলে অনুষ্কার বাবা হাসলেন৷