দশ
চাঁদকে দেখে পূর্ণিমা বোঝার উপায় ছিল না, কারণ, আকাশের মেঘ পুরু আড়াল তৈরি করেছিল৷ গতকাল থেকেই বৃষ্টির আশা তৈরি হচ্ছিল, কিন্তু বৃষ্টি এখনও সবাইকে অপেক্ষায় রেখেছে৷
ফেস্টিভ্যাল হলে রিহার্সাল চলছিল৷ যাদের হাজির থাকার কথা তারা সবাই হাজির৷ দুটো গ্রুপে ভাগ হয়ে মেয়েরা কাকলি ম্যাডাম আর শম্পা ম্যাডামের কাছে তালিম নিচ্ছিল৷ রবিনা ম্যাডাম একপাশে বসে রবীন্দ্রনাথের ‘সঞ্চয়িতা’র পাতা ওলটাচ্ছিলেন আর মাঝে-মাঝে কয়েকটা সাদা পাতায় কী যেন টুকে নিচ্ছিলেন৷
বড়দি আজ আসেননি, তবে ওঁর চালু করে দেওয়া টিফিন আর চায়ের নিয়মটা পালটায়নি৷
আজও যথারীতি অনুষ্কা চা-টিফিন খায়নি৷ ‘বাইরের জিনিস খাওয়া ডাক্তারের বারণ’ বলে এড়িয়ে গেছে৷
ও একটা কাগজ হাতে ধরে বসেছিল৷ তাতে রবীন্দ্রনাথের ‘প্রশ্ন’ কবিতাটা লেখা৷ রবিনা ম্যাডাম ওকে এই কবিতাটা তৈরি করতে বলেছেন৷
রিহার্সালের জন্য সামান্য হট্টগোল চলছিল৷ তার মধ্যে হঠাৎই একটা শব্দ সমর্পিতার কানে গেল৷ হলের টিনের চালে একটা জোরালো শব্দ হয়েছে৷ বোধহয় বড় মাপের কোনও গাছের ডাল ভেঙে পড়েছে৷
সম্পি বোধহয় ওর ডাকাবুকো স্বভাবের পুরোটা এখনও ছাড়তে পারেনি৷ আর তার সঙ্গে ওর শখের গোয়েন্দা হয়ে ওঠার শখটাও ছাড়েনি৷ তাই ও চট করে উঠে দাঁড়াল৷ ওর ঢাউস স্কুল-ব্যাগটা হাতে নিয়ে বেরিয়ে গেল হলের বাইরে৷
ইলিনা ব্যাপারটা লক্ষ করেছিল৷ ও অনুষ্কাকে বলল, ‘যাই, কী ব্যাপার একবার দেখে আসি—৷’ তারপর উঠে রওনা হল৷
হলের বাইরে বেশ কয়েকটা আলো লাগানো, কিন্তু উঁচু চালের কাছটায় অন্ধকার৷ চালের ওপরে গাছের ডালপালা আর পাতা ঝুঁকে পড়েছে৷ কিন্তু তারই মধ্যে কী যেন নড়েচড়ে বেড়াচ্ছে, গাছের ডাল আর পাতা সরিয়ে খুব ক্ষিপ্রভাবে এদিক থেকে ওদিক চলাফেরা করছে৷
সম্পিকে দেখতে পেল ইলিনা৷ ব্যাগটা হাতে ঝুলিয়ে ওপর দিকে তাকিয়ে কিছু একটা দেখার চেষ্টা করছে৷
রনিতা ম্যাডামের সঙ্গে টিচার্স রুমের সেই ঘটনার পর থেকে সম্পির একটা ব্যাপার ইলিনা লক্ষ করেছে : সম্পি কখনও ওর স্কুল-ব্যাগটা কাছ-ছাড়া করে না৷
ইলিনা সম্পির কাছে গিয়ে দাঁড়াল : ‘কিছু দেখতে পেলি?’
‘হ্যাঁ—কিছু একটা হলের চালের ওপরে ঘোরাফেরা করছে৷’
‘বোধহয় ভাম-টাম কিছু হবে৷’
ইলিনা এ-কথা বলল কারণ, স্কুল চত্বরে মাঝে-মাঝে ভাম দেখা যায়৷
ওর কথার উত্তরে সম্পি বলল, ‘হ্যাঁ, ভাম হতে পারে৷ তবে প্রবলেমটা হল ভামটা আমাদের মতো স্কুল-ড্রেস পরে রয়েছে৷’
ইলিনা কিছুক্ষণ হাঁ করে তাকিয়ে রইল সম্পির দিকে৷ তারপর মোবাইল ফোন উঁচিয়ে ধরে বলল, ‘অনুষ্কাকে ফোন করে ডাকব?’
‘না, না—এখনও সেরকম কিছু সিচুয়েশান হয়নি৷’ সম্পি হাত নেড়ে বারণ করল : ‘তা ছাড়া অন্য সবাই সন্দেহ করতে পারে৷ তারপর রনিতা ম্যাডাম জানতে পারবেন…৷ চল, ফিরে যাই৷’
ওরা দুজন হলে ফিরে চলল৷
সম্পি বলল, ‘রনিতা ম্যাডামের সঙ্গের দুটো মেয়েকে আমরা চিনতে পারিনি৷ তা ছাড়া এর মধ্যে কারও ঘাড়ে ওরা কামড় বসিয়েছে কি না কে জানে! সংখ্যাটা তা হলে তিন থেকে আরও বেড়ে যাবে…৷’
ইলিনার অনুষ্কার কথা মনে পড়ল৷ মনে পড়ল, পূর্ণিমার রাতে ওই পিশাচগুলো পাগলের মতো হয়ে ওঠে৷ আজ ওরা একটা কিছু করবেই৷ অনুষ্কাকে ছাড়া আর কাউকে ওরা ভয় পায় না৷ ওরা এখন বোধহয় সুযোগের অপেক্ষায় আছে৷
ইলিনা আর সমর্পিতা ফেস্টিভ্যাল হলে ঢুকে পড়ল৷ তারপর ওরা অনুষ্কা আর সজনীর কাছে গিয়ে বসে পড়ল৷
সম্পি চাপা গলায় চালে শব্দ হওয়ার ব্যাপারটা ওদের বলল৷
একটু পরেই সম্পি বলল, ‘অ্যাই, আমাকে টয়লেটে যেতে হবে৷’ ও ব্যাগ হাতে উঠে দাঁড়াল৷
সঙ্গে-সঙ্গে বাকি তিনজনও উঠে পড়ল, বলল, ‘চল আমরাও যাই—৷’
অনুষ্কা রবিনা ম্যাডামের কাছে গিয়ে চাপা গলায় টয়লেটে যাওয়ার পারমিশান নিল৷ তারপর ওরা চারজন আবার বেরিয়ে এল হলের বাইরে৷
আকাশে এখনও মেঘ৷ চাঁদ মেঘের আড়ালে থাকলেও চাঁদের ঘোলাটে জ্যোতি দেখা যাচ্ছে৷ বাতাস বেশ জোরে বইছে৷ বড়-বড় গাছের পাতা এলোমেলো নড়ছে, পাতায়-পাতায় ঘষা লেগে খসখস শব্দ হচ্ছে৷
ফেস্টিভ্যাল হল থেকে বেরিয়ে প্রায় পনেরো-কুড়ি মিটার দূরে টয়লেট৷ জায়গাটা স্কুল-বিল্ডিং-এর পিছনদিক৷ টয়লেটের বাঁ-দিকে রেলিং ঘেরা বাগান৷ আর ডানদিকে ঘোরানো লোহার সিঁড়ি৷
এই টয়লেটটা সাধারণত তালা দেওয়া থাকে৷ এখন রিহার্সাল চলছে বলে বড়দির নির্দেশে তালা খুলে দেওয়া হয়েছে৷ মাঠে যখন প্যান্ডেল বেঁধে স্কুলের কোনও ফাংশান-টাংশান হয় তখন এই টয়লেটটা গেস্টদের জন্য খুলে দেওয়া হয়৷
ওরা চারজন টয়লেটের দরজার কাছে এসে দাঁড়াল৷ ঝিলমিল লাগানো বিশাল দরজা—প্রায় দেড়মানুষ উঁচু৷ তিনটে সিঁড়ির ধাপ উঠে তারপর টয়লেটে ঢুকতে হয়৷
সম্পি বলল ও আগে যাবে৷ তখন ইলিনা বলল, ‘তোর ব্যাগটা আমার কাছে দিয়ে যা—৷’
তাতে ও স্পষ্ট জবাব দিল, ‘না রে, ব্যাগটা আমার সঙ্গেই থাক…৷’ তারপর দরজা ঠেলে ঢুকে গেল৷
ব্রিটিশ আমলের টয়লেট৷ তার সিলিং যেমন উঁচু, আকারও তেমনি বিশাল৷ তবে মাত্র একজন ব্যবহার করতে পারে৷
টয়লেটে চল্লিশ ওয়াটের দুটো বালব জ্বলছে৷ বাঁ-দিকের দেওয়ালে বড় ওয়াশ বেসিন৷ তার ওপরে বিরাট মাপের বেলজিয়ান আয়না৷ তার পাশে একটা প্রকাণ্ড বাথটাব৷ লম্বায় প্রায় আট ফুট হবে৷ তার সাদা রং অনেক জায়গায় চটে গিয়ে জং ধরা লোহা বেরিয়ে পড়েছে৷
ডানদিকে বড় মাপের ইউরিনাল কিউবিকল, আর তার পাশে একটা ছোট ঘর হল ল্যাট্রিন৷
টয়লেটের দেওয়ালে-দেওয়ালে ঝুল-কালি আর মাকড়সার জাল দেখে বোঝাই যায় এটা খুব কম ব্যবহার হয়৷
টয়লেটের দরজা বন্ধ করল সম্পি৷ তারপর দু-পাল্লার ঝিলমিলের ওপরে কাঠের লক আটকে দিল৷
এবার ও টয়লেটের প্রতিটি আনাচকানাচ খতিয়ে দেখে নিল যে, টয়লেটে সত্যিই ও একা৷
সিলিং-এর দিকে তাকাল সম্পি৷ অনেক উঁচুতে চার দেওয়ালে চারটে বড় মাপের ভেন্টিলেটার৷ তার চারপাশে মোটা-মোটা ঝুল জমে আছে৷
সম্পির একটু ভয়-ভয় করছিল৷ ও ব্যাগটা শুকনো মেঝেতে নামিয়ে রেখে তাড়াতাড়ি ইউরিনাল কিউবিকল-এ ঢুকল৷ তখনই যেন একটা ছোট্ট কাশির শব্দ শুনতে পেল৷
ও গলা বাড়িয়ে বাইরেটা আবার দেখে নিল৷ কেউ নেই৷
ভাগ্যিস ও ভয়ে চিৎকার করে ওঠেনি! স্কুলে ডাকাবুকো বলে যার পরিচয়, তাকে সবাই ভিতুর ডিম বলে ডাকুক এটা ও কিছুতেই চায় না৷
কিন্তু ইউরিনাল কিউবিকল থেকে ও যখন বাইরে বেরিয়ে এল তখন টয়লেটে ও একা নয়৷ টয়লেটের দরজার কাছে রনিতা ম্যাডাম দাঁড়িয়ে রয়েছেন৷ ওঁর মুখটা এখনও পালটে যায়নি, কিন্তু দু-চোখে সাদা আলো জ্বলছে৷
ম্যাডামের পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে স্কুল ইউনিফর্ম পরা একটা মেয়ে৷ সম্পি ওর নাম জানে না, তবে মুখটা চেনে৷ যতদূর মনে পড়ছে, মেয়েটা ক্লাস নাইনের ‘সি’ সেকশানে পড়ে৷ ওর চোখেও সাদা আলো ধকধক করে জ্বলছে৷
যতটা ভয় পাওয়ার কথা সম্পি ততটা ভয় পেল না৷ কারণ, দরজার বাইরে ওর তিন বন্ধু দাঁড়িয়ে আছে৷ তার মধ্যে আবার অনুষ্কা রয়েছে৷
কিন্তু এই পিশাচ দুটো কোথায় লুকিয়ে ছিল? সম্পি তো এদের খুঁজে পায়নি! তা হলে কি ল্যাট্রিনের ছাদের ওপরে লেপটে শুয়ে ছিল?
সম্পি চিৎকার করার কথা ভাবল৷ কিন্তু দরজার ঠিক বাইরেই যখন তিন বন্ধু দাঁড়িয়ে আছে তখন চিৎকার না করে, ওদের স্বাভাবিক গলায় ডাকলেই হয়৷ তা হলে ওরা বুঝবে, সম্পি ভিতু নয়৷
সম্পি ‘ইলিনা! ইলিনা!’ বলে ডেকে উঠল৷ ডাকটা সম্পির অনিচ্ছা সত্ত্বেও চিৎকারের মতো হয়ে গেল৷
কিন্তু কোনও সাড়া পেল না৷
পিশাচ দুটো চাপা খিলখিল হাসিতে ঢলে পড়ল৷ গোপন রসিকতায় এ ওর গায়ে ঠেলা মারতে লাগল৷ রনিতা ম্যাডাম ওঁর ছাত্রীর যেন ইয়ার-দোস্ত হয়ে গেছেন৷
‘ওরা কেউ নেই রে৷ ওরা চলে গেছে৷’ হেসে বললেন রনিতা৷ ওঁর গলাটা অস্বাভাবিকরকম মিহি শোনাল : ‘আমাদের মতো আর-একজন ওদের মিছে কথা বলে ডেকে নিয়ে গেছে৷ তোর পাহারা থেকে সরিয়ে দিয়েছে৷’
পিশাচের কথা বিশ্বাস করল না সমর্পিতা৷ ও আবার ইলিনা আর অনুষ্কার নাম ধরে জোরে-জোরে ডেকে উঠল—একবার, দু-বার, তিনবার৷
না, কেউ সাড়া দিল না৷ সম্পির গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল৷
পিশাচ দুটো আবার খিলখিল করে হেসে উঠল৷ কাচের চুড়ির সঙ্গে কাচের চুড়ি ঠোকাঠুকি লাগল যেন৷ তারপর আহ্লাদে আটখানা হয়ে এ ওর গায়ে ঢলে পড়তে লাগল৷
‘কেউ নেই—’ আঙুল ঘুরিয়ে ব্যঙ্গের গলায় বললেন রনিতা, ‘তুই এখন আমাদের৷ তোর বন্ধু অনুষ্কা—ওই ন্যাকা ভ্যাম্পায়ারটা—ওকেও আজ আমরা খতম করব৷ ভ্যাম্পায়ার, কিন্তু মানুষ ধরা পছন্দ করে না৷ ন্যাকাষষ্ঠী! বেড়াল বলে মাছ ছোঁব না! তার উপর আমাদের পিণ্ডি চটকানোর প্ল্যান আঁটছে! আজ দেখব ওর দৌড় কত!’
‘তোকে আজ কেউ বাঁচাতে পারবে না৷’ রনিতার সঙ্গী পিশাচটা বলল, ‘আজ আমাদের পূর্ণিমা ফেস্টিভ্যাল…৷’
সম্পি ঝুঁকে পড়ে ওর ব্যাগ খুলল৷ একটা জলের বোতল বের করে ছিপি খুলল৷ ভীষণ তেষ্টা পাচ্ছে৷
পিশাচ দুটো বিদ্যুৎঝলকের মতো লাফ দিল৷ এক লহমায় চলে এল সম্পির কাছে৷ ওর দু-পাশে ঘন হয়ে দাঁড়াল৷ লম্বা জিভ বের করে ওর ঘাড়-গলা চাটতে লাগল৷ আর মুখ থেকে জড়ানো গলায় ‘আঃ—! আঃ—!’ করে লোভের শব্দ বের করতে লাগল৷
সমর্পিতার গা ঘিনঘিন করছিল কিন্তু একইসঙ্গে আরাম কিংবা তৃপ্তির ঝিমুনি লাগছিল৷ সেই অবস্থাতেই ওর মনে প্রশ্ন জাগল : এই পিশাচগুলো কি সম্মোহন জানে?
রনিতা ম্যাডাম সম্পির হাতের জলের বোতলের দিকে তাকিয়ে নেশা-ধরা গলায় বললেন, ‘সম্পি, তোর তেষ্টা পাচ্ছে, তেষ্টা?…আমাদেরও পাচ্ছে…দারুণ তেষ্টা…তেষ্টা—আ—আ—আঃ…!’
রনিতা ম্যাডামের কথা শেষ হওয়ার আগেই জলের বোতলটা ওঁর মাথায় উপুড় করে দিল সম্পি৷ তাই রনিতার শেষ দিকের ‘আঃ!’-টা আরামের চিৎকার থেকে যন্ত্রণার চিৎকারে বদলে গেল৷
মানুষের মাথার ওপরে গাঢ় সালফিউরিক অ্যাসিডের বোতল উপুড় করে দিলে যে-দশা হয়, রনিতা ম্যাডামের দশা তার চেয়েও দশগুণ খারাপ হয়ে গেল৷
ওর শরীর গাঢ় ধোঁয়ায় ঢেকে গেল৷ গরম তেলের ওপর জলের ফোঁটা পড়ল যেরকম চড়বড়-চড়বড় শব্দ হয় সেরকম শব্দ হতে লাগল৷ তার সঙ্গে অসহ্য যন্ত্রণার মরণ আর্তনাদ৷
ধোঁয়াটে রনিতা ম্যাডাম কেমন যেন দলা পাকিয়ে খসে পড়ল মেঝেতে৷
বৃষ্টির জলের সত্যি-সত্যি এত শক্তি!
সম্পি তাজ্জব হয়ে গেল৷ এই পিশাচটাকে নিকেশ করার জন্য ও কতদিন ধরে বৃষ্টির জল জমিয়ে রেখেছিল৷ দুটো প্লাস্টিকের বোতলে সেই জল ভরে ও সেই কবে থেকে স্কুল-ব্যাগে বোতলগুলো বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে!
আজ সেটা কাজে এল৷
ধেড়ে পিশাচ তো পায়ের কাছে লুটিয়ে পড়েছে, কিন্তু কচিটা?
সেটা তখন সম্পিকে জাপটে ধরে ইস্পাতের দাঁতের পাটি ফাঁক করেছে৷ এবং সেই ধারালো দাঁত বসিয়ে দিতে চাইছে সমর্পিতার গলায়৷
সম্পি এক ভয়ংকর চিৎকার করে উঠল—অনেকটা যুদ্ধের ডাকের মতো৷ তারপর বোতলে যে-সামান্য জল ছিল সেটা ছুড়ে দিল দ্বিতীয় পিশাচের গায়ে৷
পিশাচটার গা থেকে ধোঁয়া বেরোল৷ ওটা চকিতে দু-পা পিছিয়ে গেল সম্পির কাছ থেকে৷
সমর্পিতা এইটুকু সময়ই চাইছিল৷ যন্ত্রের মতো নির্ভুল দ্রুতগতিতে ও ব্যাগ থেকে দ্বিতীয় জলের বোতলটা বের করে নিল৷ একলাফে আহত পিশাচটার কাছে পৌঁছে গেল৷ ছিপি খুলে বোতলের জল ঢেলে দিল ওটার মাথায়৷
ধোঁয়া৷ চড়বড় শব্দ৷ যন্ত্রণার চিৎকার৷
পিশাচটা পড়ে গেল মেঝেতে৷ ধোঁয়ায় মাখামাখি হয়ে ছটফট করতে লাগল৷
দুটো ধোঁয়ার কুণ্ডলীকে পিছনে ফেলে দরজার দিকে পাগলের মতো ছুট লাগল সম্পি৷ একইসঙ্গে খ্যাপাটে চিৎকার করতে লাগল৷ হাতের খালি বোতলটা এক ঝটকায় ছুড়ে ফেলে দিয়ে টয়লেটের দরজার কাছে পৌঁছে গেল৷ তারপর ছিটকিনি খুলে সোজা বাইরে৷
সম্পি বাইরে এলেও ওর চিৎকার থামেনি৷ চিৎকার করতে-করতে ও ছুটে গেল ফেস্টিভ্যাল হলের দরজার দিকে৷
ওর চিৎকার শুনে অনেকেই বাইরে বেরিয়ে এসেছে৷ কিন্তু দরজার কাছে ভিড় করে সবাই দাঁড়িয়ে৷ পুরোনো ঘটনার কথা মনে রেখে কেউই এগোতে সাহস পায়নি৷
সম্পি ছুটতে-ছুটতে এসে কাকলি ম্যাডামকে দেখতে পেয়ে ওঁর ওপর একেবারে ঝাঁপিয়ে পড়ল৷ বিকৃত গলায় হাঁপাতে-হাঁপাতে বলল, ‘পিশাচ! পূর্ণিমা! পিশাচ! টয়লেটে৷ রনিতা…রনিতা ম্যাডাম…পিশাচ!’
এটুকু শুনেই কাকলি ম্যাডাম চোখ কপালে তুলে অজ্ঞান হয়ে গেলেন৷
সম্পি টাল সামলাতে না পেরে আর-একটু হলেই পড়ে যাচ্ছিল— কোনওরকমে নিজেকে সামলে নিল৷
মেয়েরা কাকলি ম্যাডামকে ধরাধরি করে ভেতরে নিয়ে গেল৷
অন্যরা সমর্পিতাকে ঘিরে ধরে হাজারটা প্রশ্ন করতে লাগল৷
ও বড়-বড় শ্বাস টেনে অনেক কিছু বলতে চাইল, কিন্তু ওর মুখ দিয়ে জড়ানো এলোমেলো শব্দ বেরিয়ে আসতে লাগল৷
কয়েক মিনিটের মধ্যেই ধাতস্থ হয়ে সম্পি টয়লেটের ভয়ংকর ঘটনা সবাইকে খুলে বলল৷ তারপর জিগ্যেস করল, ইলিনা, সজনী, অনুষ্কা ওরা কোথায়৷
কেউই কিছু বলতে পারল না৷ সবাই শুধু মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে লাগল৷ ভয়ে এক জায়গায় জড়ো হয়ে রইল৷
হঠাৎই একটি মেয়ে বলল, ‘তোমার সঙ্গেই তো ওরা তিনজন হল থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল৷ তারপর তো আর দেখিনি—৷’
তা সত্ত্বেও সম্পির চোখ ভিড়ের মধ্যে তিন বন্ধুকে খুঁজতে লাগল৷ কোথায় গেল ওরা? ওদের ফোন করার কোনও উপায় নেই, কারণ মোবাইল ফোন ও টয়লেটে ব্যাগে ফেলে এসেছে৷
সম্পি এতক্ষণে ভয় কাটিয়ে দম ফিরে পেয়েছিল৷ ও এদিক-ওদিক তাকিয়ে জুতসই একজন সঙ্গী খুঁজতে লাগল৷ ইলিনাদের খোঁজার জন্য কয়েকজনকে ও সঙ্গে নিতে চায়৷
ও সামনে দাঁড়ানো দুজন মেয়েকে বলল, ‘আমি ইলিনাদের খুঁজতে যাব৷ তোমরা আমার সঙ্গে যাবে?’
ওর কথায় দুজনের জায়গায় ছ’জন ওর কাছে এগিয়ে এল : ‘চলো, আমরা যাব…৷’
সম্পির চোখ সাহসী রবিনা ম্যাডামকে খুঁজল কিন্তু দেখতে পেল না৷
কয়েকজনকে জিগ্যেস করে জানল, মিনিট পনেরো-কুড়ি আগে ক্লাস নাইনের একটি মেয়ে এসে রবিনা ম্যাডামকে কোথায় যেন ডেকে নিয়ে গেছে৷
সম্পি আর দাঁড়াল না৷ ওর মন কু-ডাক ডাকতে লাগল৷ ওর মনে হল, রবিনা ম্যাডাম, ইলিনা, সজনীদের খুব বিপদ৷ কারণ আজ পূর্ণিমা৷
অনুষ্কা কি পারবে সবাইকে বিপদ থেকে বাঁচাতে?
সম্পি পিচের রাস্তা ধরে বাস্কেটবল গ্রাউন্ডের দিকে রওনা হল৷ প্রায় সাত-আটজন মেয়ে দল বেঁধে ওর সঙ্গী হল৷ শম্পা ম্যাডাম বারবার সম্পিকে ডাকলেন, অন্ধকারে এসব খোঁজাখুঁজির কাণ্ড থামাতে বললেন৷ কিন্তু সম্পির আজ কোনও বারণ না শোনার দিন৷
নিরুপায় শম্পা ম্যাডাম তখন মোবাইল ফোন নিয়ে বড়দিকে ফোন করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন৷
সম্পিরা তখন হইহই করে এগিয়ে চলেছে৷ থেকে-থেকে ইলিনা, সজনী আর অনুষ্কার নাম ধরে ডাকছে৷
আকাশের চাঁদের দিকে সম্পির চোখ গেল৷
মেঘের আড়াল সরিয়ে ফ্যাকাসে হলদে চাঁদ কখন যেন বেরিয়ে এসেছে৷
এগারো
উদভ্রান্তের মতো যে-মেয়েটি ওদের কাছে ছুটে এল ইলিনারা ওর মুখ চেনে, কিন্তু নাম জানে না৷ ক্লাস টেন-এর-ই অন্য কোনও একটা সেকশানে যেন পড়ে৷
ইলিনা, সজনী আর অনুষ্কা টয়লেটের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ছিল৷ সমর্পিতার বেরিয়ে আসার জন্য অপেক্ষা করছিল৷
মেয়েটা হাঁপাতে-হাঁপাতে বলল, ‘তোমাদের তিনজনকে…রবিনা ম্যাডাম…এক্ষুনি ডাকছেন৷ তোমাদের নাম ইলিনা, সজনী আর…আর অনুষ্কা তো?’
ওরা মাথা নাড়ল৷ হ্যাঁ৷
‘তোমাদের…তোমাদের রবিনা ম্যাডাম…এক্ষুনি ডাকছেন…খুব দরকার৷’
ল্যাম্পপোস্টের আলোয় যতটুকু দেখা গেল তাতে ‘খুব দরকার’ ভাবটা মেয়েটির চোখে-মুখেও ফুটে উঠেছিল৷
‘ম্যাডাম কোথায়? ফেস্টিভ্যাল হলে?’
‘না, ম্যাডাম হল থেকে বেরিয়ে ক্যাম্পাসের পেছনের দিকে গেলেন৷ তোমাদের তিনজনকে তাড়াতাড়ি সেখানে যেতে বললেন…৷’
ইলিনারা ইতস্তত করল৷ এ ওর দিকে তাকাল৷ রবিনা ম্যাডাম হঠাৎ ক্যাম্পাসের পিছনদিকে কী করতে গেলেন?
অনুষ্কা বলল, ‘ইলিনা, সজনী—তোমরা বরং যাও, আমি এখানে থাকছি৷’
মেয়েটি অসহায়ের মতো বলল, ‘কিন্তু ম্যাডাম যে তিনজনকেই ডেকেছেন—বলেছেন ভীষণ আর্জেন্ট…৷’
তখন অনুষ্কা ওকে বুঝিয়ে বলল, ‘আমাদের এক বন্ধু টয়লেটে গেছে৷ আমরা ইন ফ্যাক্ট ওর জন্যেই ওয়েট করছি৷ ও বেরোলে আমরা…৷’
মেয়েটি বেশ বিপন্ন গলায় বলল, ‘তা হলে তো খুব প্রবলেমে পড়লাম! ম্যাডাম যেভাবে বললেন…৷’
ইলিনা মোবাইল ফোন বের করে সমর্পিতাকে ফোন করতে লাগল৷
রিং বেজে গেল, কিন্তু কেউ ফোন ধরল না৷ তখন ইলিনা ফোন কেটে দিল৷
‘ফোন বেজে যাচ্ছে৷ ও ধরছে না—৷’
সজনী বলল, ‘ওর ফোনটা নিশ্চয়ই সাইলেন্ট মোডে আছে—৷’
অনুষ্কা বলল, ‘ঠিক আছে৷ তোমরা দুজন যাও—নিশ্চয়ই ওখানে কোনও প্রবলেম হয়েছে৷ আমি এখানে থাকছি৷ সম্পি টয়লেট থেকে বেরোলে তারপর আমি যাব৷ কোনও ভয় নেই—৷’
‘ভয়? ভয় কীসের?’ অন্য মেয়েটি কৌতূহলে জানতে চাইল৷
ইলিনা আর সজনী তাড়াতাড়ি বলে উঠল, ‘না, না—এমনি৷ চলো, যাই…৷’
ওরা দুজনে যখন মেয়েটির সঙ্গে এগোচ্ছে তখন অনুষ্কা ডেকে বলল, ‘কোনও প্রবলেম হলেই আমাকে সঙ্গে-সঙ্গে ফোন কোরো৷ সম্পি বেরোলেই আমি ওকে নিয়ে যাচ্ছি—৷’
‘ঠিক আছে৷’ বলে ওরা জোর পায়ে হাঁটা দিল৷
দু-পাশে গাছপালা, মাঝখান দিয়ে পিচের রাস্তা৷ ল্যাম্পপোস্টের হলদে আলো এখানে-সেখানে ছিটকে পড়েছে৷ অন্ধকার আর আলো দাবার ছক তৈরি করেছে যেন৷
রিহার্সালের গানের আওয়াজ কানে আসছে৷ তার সঙ্গে ঘুঙুরের শব্দ৷
অনুষ্কা আনমনাভাবেই আকাশের চাঁদের দিকে তাকাল৷ কী সুন্দর গোল আর স্পষ্ট৷ ওর ঘরের দেওয়ালে টাঙানো ছবিটার কথা মনে পড়ে গেল৷ ছবির চাঁদটা মেঘে ঢাকা পড়েছে কি না কে জানে! প্রকৃতির সঙ্গে ওই ছবিটা সবসময় মেলে না৷
চাঁদের দিকে তাকিয়ে অনুষ্কার কেমন ঘোর লেগে গেল৷ ও অপলকে তাকিয়ে নিশিনাথকে দেখতে লাগল৷
হঠাৎই অনুষ্কার হাতের মুঠোয় ধরা মোবাইল ফোন থরথর করে কেঁপে উঠল৷ ও চমকে উঠে ফোনের পরদার দিকে তাকাল৷
ইলিনা৷
ফোন ধরতেই ইলিনার বিপন্ন গলা শোনা গেল৷ শুধু বিপন্ন নয়, ওর গলা কাঁপছে৷
‘অনুষ্কা, শিগগির এসো—সর্বনাশ হয়েছে!’
‘তোমরা কোথায়?’
‘পিছনদিকের পাঁচিলের কাছে—যেখানে তুমি আর আমি কোকিল দেখতে গিয়েছিলাম৷ সেই ইটের পাঁজা…৷’
আর শোনার দরকার মনে করল না অনুষ্কা৷ ফোন কেটে দিয়ে পিছনের বাউন্ডারি ওয়ালের দিকে বিদ্যুৎগতিতে ছুটতে শুরু করল৷
আলো আর অন্ধকারে ওর শরীরটা একবার দেখা যাচ্ছিল, একবার মিলিয়ে যাচ্ছিল৷ যেন ওর ছুটন্ত শরীরটা জ্বলছে-নিভছে৷
ছুটতে-ছুটতে অনুষ্কার মনে হল, টয়লেটের দিক থেকে একটা মিয়োনো ডাক যেন ভেসে এল৷ ইলিনার নাম ধরে কেউ ডেকে উঠল যেন৷
কিন্তু ওর সামনে দু-বন্ধুর ডাক, পিছনে এক বন্ধুর ডাক৷ তাই অনুষ্কা দৌড় থামাল না—ছুটতেই থাকল৷ সেই অবস্থাতেই ও লম্বা-লম্বা লাফ দিয়ে শূন্যে ভেসে উঠে অলৌকিক গতিতে দুরত্ব কমাতে লাগল৷
মনে হচ্ছিল যেন ও উড়ে চলেছে৷ অন্ধকার কিংবা গাছপালা ওর গতি রুখতে পারছিল না৷ ওকে এই অবস্থায় দেখলে যে-কেউ স্তম্ভিত হয়ে যেত, ভয় পেত৷
অকুস্থলে পৌঁছতে অনুষ্কার সময় লাগল আট সেকেন্ডেরও কম৷ রাস্তা ছেড়ে গাছপালার ভেতরে ঢুকে পড়ল ও৷
ওই তো, পুরোনো টিন, কাঠ আর অ্যাসবেস্টস৷ তার পাশে ইটের পাঁজা৷ ইটের পাঁজার ওপরে শুয়ে আছে ওরা দুজন কে? শুয়ে-শুয়ে ছটফট করছে? গায়ে স্কুল-ড্রেস?
জায়গাটা অন্ধকার৷ গাছপালার পাতার আড়াল থাকায় চাঁদের আলোও সেখানে ঢোকেনি৷ কিন্তু তা সত্ত্বেও ভ্যাম্পায়ার মেয়ের দেখতে কোনও অসুবিধে হল না৷
চিত হয়ে শুয়ে আকুলিবিকুলি করছে ইলিনা আর সজনী৷ ওরা যে চিৎকার করতে পারছে না তার কারণ স্কুল-ড্রেস পরা একটা পিশাচ ওদের ওপর উপুড় হয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে আছে৷ পিশাচটার মুখ ভয়ংকর, চোখ জ্বলছে, ইস্পাতের দাঁত ঝিলিক দিচ্ছে৷
কিন্তু রবিনা ম্যাডাম কোথায়?
প্রশ্নটা অনুষ্কার মনে ঝলসে গেলেও একইসঙ্গে ও প্রতিরক্ষার কাজ শুরু করল৷
ও ইলিনাদের কাছ থেকে প্রায় পাঁচ-ছ’ হাত দূরে দাঁড়িয়ে ছিল৷ সেই দূরত্বটাকে ও মোটেই কমাতে চেষ্টা করল না৷ ওখানে দাঁড়িয়েই ওর ডানহাতটা বাড়িয়ে দিল৷
হাতটা পলকে রবারের মতো লম্বা হয়ে গেল৷ একইসঙ্গে হাতের পেশি, শিরা-উপশিরা সব দেখা গেল৷ যেন অনুষ্কার হাতটা স্বচ্ছ কাচের তৈরি৷
পিশাচটা ততক্ষণে ইলিনার গলার খাঁজে কামড় বসিয়েছে৷ আর ঠিক তখনই অনুষ্কার হাতের চেটোতে কতকগুলো কাঁটা গজিয়ে গেছে—ছুচলো ইস্পাতের কাঁটা৷
সেই হাতে বজ্রমুঠিতে পিশাচটার ঘাড় চেপে ধরল অনুষ্কা৷ শরীর থেকে যেমন করে জোঁক ছাড়ায় সেভাবে পিশাচটাকে ইলিনার কাছ থেকে ছাড়িয়ে নিল, এক হ্যাঁচকায় টেনে নিল নিজের কাছে৷
ইলিনা আর সজনী এবার প্রাণপণ চিৎকার জুড়ে দিল৷ সেই চিৎকারে গাছপালার ঘুমন্ত পাখিরা জেগে উঠে ডাকতে লাগল, ওড়াউড়ি শুরু করল৷
ইলিনারা টের পেল দারচিনির গন্ধে জায়গাটা ভরে গেছে৷
ইলিনার গলা থেকে রক্ত পড়ছিল, মাথা টলে যাচ্ছিল৷ ও কোনওরকমে উঠে বসল৷ তাকাল অনুষ্কার দিকে৷
সজনীও তাকাল৷
ওই তো দাঁড়িয়ে রয়েছে ইলিনার প্রিয়তম ভ্যাম্পায়ার! শত্রুর সঙ্গে লড়াই করছে৷
অনুষ্কার হাতের মুঠোয় পিশাচটার দম বন্ধ হয়ে আসছিল৷ ওটা হাঁ করে বাতাস টানার চেষ্টা করছিল৷ যন্ত্রণার চিৎকার করছিল৷ ইস্পাতের দাঁতের পাটি ঝকঝক করছে৷ আর তার ফাঁকে সাপের মতো কুণ্ডলী পাকানো একটা কালো রঙের জিভ৷ সেটা কখনও-কখনও লম্বা হয়ে বেরিয়ে আসছে বাইরে৷
অনুষ্কার শক্তি এতটাই যে, পিশাচটা তার কানাকড়িও ডিঙোতে পারছিল না৷ তাই জেতার চেষ্টা করতে-করতে ওটা কাহিল হয়ে পড়ল৷
অনুষ্কা মোবাইল ফোন ফেলে দিয়ে বাঁ-হাতে পিশাচটার নাক চেপে ধরল৷ সঙ্গে-সঙ্গে অদ্ভুত একটা গোঙানির শব্দ করে পিশাচটার মাথা কাত হয়ে গেল একপাশে৷
অনুষ্কা ওটাকে ছেড়ে দিল৷ ওটার নিষ্প্রাণ শরীরটা ভেজা কাপড়ের মতো খসে পড়ল মাটিতে৷ পড়েই রইল৷
অনুষ্কার ডানহাতটা আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এল৷
ইলিনা আর সজনী থরথর করে কাঁপছিল৷ ভয়ে কুঁকড়ে যাচ্ছিল৷
এই তা হলে অনুষ্কার গোপন শক্তি! অনুষ্কা না থাকলে ইলিনারা আজ বাঁচত না৷
কৃতজ্ঞতার আবেগে ইলিনার কান্না পেয়ে গেল৷ একইসঙ্গে গলার অসহ্য যন্ত্রণা ওকে অজ্ঞান করে দিতে চাইছিল৷ ও সজনীকে প্রাণপণে আঁকড়ে ধরে রইল৷
সজনীর অবস্থা তখন সাংঘাতিক৷ ওর বুক ধড়াস-ধড়াস করছিল৷ আধো-অন্ধকারে এইমাত্র ও কী দেখল? ওদের বন্ধু অনুষ্কা! সে কেমন পালটে ভয়ংকর হয়ে গেল! অমানুষের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অমানুষিক লড়াই করল!
সজনীর বুক ঠেলে কান্না উথলে উঠছিল৷ একইসঙ্গে একটা অচেনা ভয় ওকে অবশ করে দিচ্ছিল৷
ইলিনা আর সজনী নেমে এল ইটের পাঁজা থেকে৷ দুজনেই ভয়ে কাঁপছে, কাঁদছে৷
ইলিনার স্কুল-ড্রেস রক্তে ভেসে যাচ্ছে৷ ও সজনীকে আঁকড়ে ধরে পা ফেলছিল৷ যন্ত্রণায় গুঙিয়ে উঠছিল৷
অনুষ্কা ছুটে গিয়ে ওদের জাপটে ধরল৷ ওরা তিনজনেই হাঁপাচ্ছিল৷ কাঁদছিল৷ আর সজনী শিউরে উঠছিল৷
একটু পরে অনুষ্কা সজনীকে বলল, ‘শিগগির সম্পিকে একটা ফোন করো…৷’ কথাটা বলেই ও ইলিনার গলায় নিজের রুমালটা চেপে ধরল৷ যে করে হোক রক্তটা বন্ধ করা দরকার৷
সজনী কান্না-ভাঙা কাঁপা গলায় বলল, ‘আমাদের দুজনের কারও মোবাইল নেই৷ গণ্ডগোলের সময় কোথায় ছিটকে পড়েছে জানি না…৷’
‘আমার ফোন থেকে ফোন করো৷ ওই তো আমার ফোন ওখানে পড়ে আছে৷’
সজনী এগিয়ে গেল সামনে৷ অন্ধকারে হাতড়ে অনুষ্কার মোবাইলটা মাটি থেকে কুড়িয়ে নিল৷
সম্পিকে ও ফোন করতে যাবে, তখনই অনুষ্কা জিগ্যেস করল, ‘আমরা যে পিশাচটাকে খতম করলাম সেটাই কি টয়লেটের ওখানে আমাদের ডাকতে গিয়েছিল?’
সজনী নাক টেনে-টেনে সহজ হওয়ার চেষ্টা করে বলল, ‘না, ও ভালো মেয়ে৷ এখানে এসে দূর থেকে জায়গাটা আমাদের দেখিয়ে দিয়েই ও ছুটে আবার ফেস্টিভ্যাল হলে চলে গেছে৷ আমরা এখানে এসে রবিনা ম্যাডামকে খুঁজছি, তখনই ওই শয়তান পিশাচটা এগিয়ে এল৷ তারপর…৷’
সজনী কথা বলছিল আর একইসঙ্গে সম্পির নম্বর ডায়াল করে মোবাইল ফোনটা কানে চেপে ধরেছিল৷
রিং হয়ে যাচ্ছে৷ ফোন কেউ ধরছে না৷
সে-কথাই ও বলল অনুষ্কাকে৷
অনুষ্কা বিরক্ত হয়ে বলল, ‘ওঃ, আবার সেই সাইলেন্ট মোড! শিগগিরই চলো, ইলিনাকে এখুনি ডাক্তারখানায় নিয়ে যেতে হবে৷ কুইক—৷’
ইলিনা অনুষ্কার গায়ে প্রায় এলিয়ে পড়েছিল৷ চোখ বুজে ‘ও—ওঃ! ও—ওঃ!’ শব্দ করে কাতরাচ্ছিল৷
ওকে যে করে হোক সুস্থ করে তুলতে হবে৷ অনুষ্কা ভাবল৷ আরও গাঢ় করে ইলিনাকে জাপটে ধরল ও৷
সজনীকে ডেকে নিয়ে এগোতে যাবে তখনই ওর মনে পড়ল রবিনা ম্যাডামের কথা৷ যাঁর নাম করে সেই মেয়েটা ওদের ডেকে নিয়ে এল সেই রবিনা ম্যাডাম কোথায়? আর কোন আর্জেন্ট কাজের জন্য তিনি ওদের তিনজনকে তড়িঘড়ি ডেকে পাঠিয়েছিলেন?
সজনীকে রবিনা ম্যাডামের কথা জিগ্যেস করতেই ও বলল, ‘জানি না৷ এখানে এসে রবিনা ম্যাডামকে আমরা একবারও দেখিনি৷ যখন ম্যাডামকে খোঁজাখুঁজি করছি তখন ইটের পাঁজার আড়াল থেকে ওই ভয়ংকর পিশাচটা আমাদের ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ল৷ তারপর তো তুমি এলে…৷’
ইলিনা যন্ত্রণায় রুদ্ধ গলায় কোনওরকমে বলল, ‘অনুষ্কা, রবিনা ম্যাডামের কোনও বিপদ হয়নি তো?’
সজনী সে-কথায় সায় দিয়ে হাঁপাতে-হাঁপাতে বলল, ‘আমিও ঠিক এই কথাটাই বলছিলাম৷ রবিনা ম্যাডামের কোনও বিপদ হয়নি তো!’
‘না রে, আমার কোনও বিপদ হয়নি৷’ উত্তর দিলেন রবিনা ম্যাডাম নিজেই, ‘এখন আমার আর কোনও বিপদের ভয় নেই…৷’
ওরা তিনজনে চমকে উঠল৷ শব্দ লক্ষ করে তাকাল৷
কাছেই একটা গাছের গুঁড়ির সঙ্গে রবিনা ম্যাডামের দেহটা লেপটে আছে৷ মাটি থেকে প্রায় চার-পাঁচ হাত উঁচুতে ওঁর শরীরটা উলটোভাবে শূন্যে ঝুলছে৷ পা ওপরে৷ মাথা নীচের দিকে৷
বোধহয় অন্ধকারে ঢাকা কোনও জুতসই ডালে রবিনা পা দুটো আঁকশির মতো আটকে রেখেছেন৷
রবিনার শরীর থেকে একটা নীলচে আভা বেরোচ্ছে৷ সেই আভার জন্যই ওঁকে দেখা যাচ্ছে, কিন্তু উলটো হয়ে থাকার জন্য স্পষ্টভাবে চেনা যাচ্ছে না৷
রবিনার গাল বসে গিয়ে চোয়ালটা সামনে বেরিয়ে এসেছে৷ চোখ দুটো অন্ধকার কৃষ্ণগহ্বর৷ আর তার কেন্দ্রে সার্চলাইটের মতো উজ্জ্বল সাদা আলোর বিন্দু৷
‘তেষ্টায় আমার বুক ফেটে যাচ্ছে রে…অসম্ভব পাগল করা তেষ্টা৷’ গাছের গায়ে উলটো হয়ে ঝুলে থাকা পিশাচটা বলল, ‘সেদিন রনিতাদি কী যে কামড় বসাল ঘাড়ে, তারপর থেকেই যত অশান্তি আর ভোগান্তির শুরু৷ তোরা তো আর বুঝবি না, পূর্ণিমার তেষ্টা কী জিনিস! আয়, তোরা কাছে আয়…আয়…৷’
এইসব কথা বলার সঙ্গে-সঙ্গে রবিনার শরীরটা পেন্ডুলামের মতো অল্প-অল্প দুলতে লাগল৷ ঠিক যেন হাওয়ায় দুলছে৷ আর ওঁর মুখটা হাঁ হয়ে গেল৷
ইস্পাতের দাঁতের পাটি দেখা গেল৷ তার ফাঁক দিয়ে একটা লম্বা কালো জিভ সাপের মতো সড়সড় করে বেরিয়ে এল৷ ঝুলে পড়ল নীচের দিকে৷ তারপর সেই দেড়ফুট লম্বা জিভটা নড়তে লাগল, দুলতে লাগল৷
পিশাচটার চোখের দৃষ্টিতে বোধহয় সম্মোহন ছিল৷ কারণ, ইলিনা আর সজনী উলটোভাবে ঝুলে থাকা রবিনার নীল আলো মাখা দেহের দিকে এগিয়ে যেতে চাইল৷
অনুষ্কা ওদের হাত ধরে টেনে আটকে রাখল৷ চিৎকার করে বলল, ‘যেয়ো না—এখানে চুপ করে দাঁড়াও! যেয়ো না! আমার কথা শোনো—!’
হঠাৎই দারচিনির গন্ধে বাতাস মিষ্টি হয়ে গেল৷ এক ঝটকায় ইলিনা আর সজনীকে ছিটকে ফেলে দিল অনুষ্কা৷ তারপর ওর ডানহাত চোখের পলকে লম্বা হয়ে ছোবল মারল রবিনা ম্যাডামের গলায়৷ এবং একটানে পিশাচটাকে গাছ থেকে ছাড়িয়ে নিল৷
ইলিনা আর সজনী মাটিতে লুটিয়ে পড়ে ওদের বন্ধুর অলৌকিক কাণ্ডকারখানা দেখছিল৷ মনে হচ্ছিল, ওদের চোখের সামনে যা-যা ঘটে চলেছে সেগুলো বাস্তব নয়, একটা গাঁজাখুরি সিনেমা৷
সেই ‘সিনেমা’-য় অনুষ্কার হাতের ইস্পাতের কাঁটাগুলো পিশাচটার গলায় আমূল গেঁথে গেল৷ ওর হাতের টানে পিশাচটা রবারের সুতোয় বাঁধা বলের মতো ছিটকে চলে এল অনুষ্কার কাছে৷
পিশাচটা যন্ত্রণার হাহাকার তুলছিল৷ মাথাটা এপাশ-ওপাশ নাড়ছিল৷ অনুষ্কা বাঁ-হাতে খপ করে পিশাচটার নাক টিপে ধরল৷ সঙ্গে-সঙ্গে শুরু হল পিশাচটার মরণ গোঙানি৷ বারবার হাঁ করে বাতাস নিতে চাইল৷
একটু পরেই ওটার সব লড়াই শেষ হয়ে গেল৷ সব তেষ্টা মিটে গেল৷
অনুষ্কা ছেড়ে দিতেই ওটা এক টুকরো কাঠের মতো খসে পড়ে গেল মাটিতে৷
অনুষ্কার ডানহাতটা আবার স্বাভাবিক হয়ে গেল৷ ও এতক্ষণ যেন একটা ঘোরের মধ্যে ছিল৷ ঘোর কেটে যেতেই ওর বন্ধুদের কথা মনে পড়ল৷ ও ফিরে তাকাল ইলিনার দিকে, সজনীর দিকে৷ ওদের বিপদে কাজে লাগতে পেরে মনটা ভীষণ ভালো লাগছে৷ এই ভালো লাগা আগে কখনও ও টের পায়নি৷
অনুষ্কা ইলিনাকে তুলে ধরল৷ তারপর ওকে বুকে জড়িয়ে নিল : ‘শিগগির চলো, তোমাকে ডাক্তার দেখাতে হবে…৷’
সজনী নিজে থেকেই উঠে দাঁড়িয়েছিল৷ ও অনুষ্কার কাছে এসে ওর হাত ধরল৷ চাপা গলায় বলল, ‘থ্যাংক য়ু—৷’
ইলিনাও অনুষ্কার কানে-কানে ফিসফিস করে বলল, ‘ও যা বলল, তাই…৷’
অনুষ্কার কানে এল অনেকের হইচই চিৎকার৷
ও চাঁদের দিকে তাকাল৷ কী স্পষ্ট, কী সুন্দর!
চাঁদকে এই মুহূর্তে ওর ভীষণ ভালোবাসতে ইচ্ছে করল৷
ঠিক তখনই সম্পির গলা কানে এল৷ ওদের তিনজনের নাম ধরে চেঁচিয়ে ডাকছে৷
বারো
আমি একজন পিশাচ৷ এ ছাড়া অন্য কোনও পরিচয় আমার নেই৷
এখন আমাকে আবার নতুন আশ্রয়ের খোঁজে বেরোতে হবে৷
আত্মা যদি অবিনশ্বর হয় তা হলে প্রেতাত্মার অবিনশ্বর হতে অসুবিধে কী! সুতরাং আমি অমর৷
তোমার কি মনে নেই, গীতার সাংখ্যযোগে শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, ‘নৈনং ছিন্দন্তি শস্ত্রাণি নৈনং দহতি পাবকঃ৷’ অর্থাৎ, কোনও শস্ত্র এই আত্মাকে ছেদন করিতে পারে না৷ অগ্নি ইহাকে দহন করিতে পারে না৷
তিনি আরও বলেছেন, জল ইহাকে আর্দ্র করিতে পারে না, বায়ু ইহাকে শুষ্ক করিতে পারে না৷
তা হলে আমার ‘মৃত্যু’ হবে কেমন করে?
তাই আকাশে, বাতাসে ধুলোয় মিশে আবার শুরু হোক আমার পথ চলা৷
চলতে-চলতে আবার আমাকে খুঁজতে হবে নতুন আশ্রয়৷ নিতে হবে আবার কোনও নতুন পরিচয়৷ তারপর আবার বিশ্রাম আর আরাম৷
নতুন জায়গায়, নতুন পরিবেশে, নতুন করে শুরু হবে আমার নতুন জীবন৷
আঃ, ভাবতেই কী তৃপ্তি!